হিয়ার মাঝে-লুকিয়ে ছিলে,পর্ব:৩৩

0
486

উপন্যাস: হিয়ার মাঝে-লুকিয়ে ছিলে,পর্ব:৩৩
কলমে: চন্দ্রা।

শাওন আসিলো ফিরে,,সে ফিরে এলো না,,,
বরষা ফুরায়ে গেলো,,আশা তবু গেলো না,,,

কিংবা,

শাওনো রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে,,
বাহিরে ঝড় বহে,নয়নে বারি ঝরে,,,

শ্রদ্ধেয় কবি ও গীতিকারদের এই সৃষ্টি কি শুধুমাত্র শাওন কালের বিরহ বেদনায় মুহ্যমান হয়ে পরার জন্য নাকি আরো কারন আছে?শাওন কাল মানুষের মাঝে ভিন্ন প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে এটা ঠিক যেমন,,কাউকে ভালো লাগার চাদরে মুড়ে দিতে পারে আষ্টেপৃষ্ঠে আবার কেউ কেউ বিষন্নতার মহাকাব্যে একের পর এক পৃষ্ঠার সৃষ্টি করে যেতে পারে মনের গহীনে। বৃষ্টির ধারার মতো অবিরত ভাবে মনের মধ্যে সৃষ্টি হতে থাকে বিরহের ছন্দ,সুর,লয়,তাল।শীত কালের বৃষ্টি কি মানুষের মনে এই প্রেম,বিরহ বা আবেগঘন মুহূর্তের উন্মোচন করতে পারে?হয়তো না।সকাল থেকেই আকাশের সাথে মেঘের মান অভিমান চলছিলো কমবেশি। অবশেষে গোধূলি লগ্নে মেঘবতী জয়ী হয়ে কেঁদে কুটে ধরনী সিক্ত করলো। পৌষের মাঝামাঝি সময় হওয়ায় শীতের প্রতাপ বেশীই ছিলো।হালকা পাতলা বহতা সমীরণ আর ঝুমঝুম বর্ষা তা বাড়িয়ে তুললো দ্বিগুণ হারে। বহুকাল হলো এ এলাকার লোকজন এমন শীতকালীন বৃষ্টির প্রকোপে পরেনি কাজেই কষ্ট তো একটু হবেই।
নিজের শয়নকক্ষের দক্ষিণ মুখী জানালায় দাঁড়িয়ে আছে রিতি। বৃষ্টির হালকা ছাঁট এসে বিন্দু বিন্দু হয়ে জমছে সমস্ত মুখমন্ডলে। আঁখি পল্লবীতে যদিও শ্রাবণের নাচোন-কোদন, দৃষ্টি তার সুদূরে অবস্থিত বাড়ির মূল ফটকে। বাহিরের অশান্ত পরিবেশ তো কোন ছাড় তার দ্বিগুণ,চতুর্গুন চলছে মনের মাঝে।একটাই অবাধ্য দুশ্চিন্তা মাথা উঁচিয়ে চলছে সেখানে,,রূপদা ফিরবে তো আজ।নাকি ভাঙা মনে পরে থাকবে অন্য কোথাও।
সকালে বিরূপাক্ষ নিজেকে সাজিয়েছে তো রিতির পছন্দের পোশাকেই কিন্তু পাঞ্জাবি টা পরেনি।অতি তুচ্ছ তাচ্ছিল্য ভরে বলেছিলো বিরূপাক্ষ,,, এসব নাকি যতসব মিডলক্লাস পছন্দ।সেটা এখন পরে রয়েছে রিতির কাঁধের একপাশটায়। নতুন সুতো আর কাপড়ের হালকা গন্ধ এখনো রিতির ঘ্রানেন্দ্রীয় দিয়ে প্রবেশ করছে ফুসফুসের ভেতরে। কয়েকমাস আগে একটা বিশেষ দিনের সম্ভাবনায় এই পাঞ্জাবি টি নিজে পছন্দ করে কিনে রেখেছিলো রিতি। কিন্তু সেই দিনটি আর আসেনি তাই এটার ব্যবহার ও হয়নি।রিতি পাঞ্জাবি টায় আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়ায়।
বিরূপাক্ষ রিতির দেওয়া পাঞ্জাবি টা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করলেও তাকে দিয়েই পোশাক পছন্দ করিয়েছে।রিতিও নিজের অপমান গায়ে লাগায়নি, অবশেষে বিরূপাক্ষের ক্যাবিনেট থেকে শ খানেক স্যুট টাইয়ের মধ্য থেকে একসেট বের করে দিয়েছে।
হ্যা দারুন মানিয়েছে বিরূপাক্ষকে।
নিজে রেডি হয়ে যখন বেরিয়ে যাচ্ছিল বিরূপাক্ষ, বিজয়ের হাসি হেসে তখন রিতিকে পেছন থেকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,, রিতি তোর বর যাচ্ছে তার বৌয়ের সাথে দেখা করতে ,,নজর কাঁটা দিবি না?

রিতি একটু সরে বিরূপাক্ষের দিকে ঘুরে তাকায়,,,
কে তোমাকে নজর দেবে?অবাক হয় রিতি।

তুই যেভাবে দেখছিস তাতে তোর নজর থেকেই বাঁচা দায়। বিরূপাক্ষের কুটিল হাসি রিতির অন্তরে আঘাত হানে। কুঁচকানো ললাট মসৃন হয়,,,
এতই যদি নজর লাগার ভয়,,তাহলে ডেকেছো ক্যানো?আমি তো সেধে আসিনি।রিতি আর কথা বাড়ায়নি।এত আঘাত সইতে চায় না মন।দ্রুত পায়ে বেরিয়ে আসে ও ঘড় থেকে।আসার সময় বিছানায় এলো মেলো হয়ে পরে থাকা পাঞ্জাবি টা আনতে ভোলেনি সে।তার কিছুক্ষণ পরেই নিজের ঘরের জানালায় দাঁড়িয়ে বিরূপাক্ষ কে বেরিয়ে যেতে দেখেছে।
সত্যিই অপূর্ব সুন্দর লাগছে তাকে।নজর লেগে যাওয়ার মতোই সুন্দর। নিজের অজান্তেই ঠোঁটের কোনে তৃপ্তির হাসি ফুটে ওঠে রিতির।ভাবে মনে মনে এত উচ্ছল হাসি কতক্ষন হাসবে রূপ দা??দেখা হবে তো তোমার বনলতার সাথে?

*****
বাহিরের পরিবেশ যতটা বিক্ষুব্ধ,আমির শেখের বৈঠক খানা তার চেয়ে বেশি অশান্ত।যাকে বলে,, নীরবতার সরগরম।কথা কাকলি যদিও তেমন নেই কিন্তু অভ্যন্তরে চলছে কথামালার অবাধ ফুলঝুড়ি।ঢাকা থেকে গেস্ট এসেছেন তিনজন।স্পেশাল গেস্টদের স্পেশাল খাতির যত্নের ব্যাবস্থা চলছে অন্দর মহলের রন্ধনশালায়।বাহারী খাবার এর ঝাঁঝ মাখা সুগন্ধে ম ম করছে বৈঠক খানা।
কথিত আছে সৃষ্টি কর্তা যখন কোনো সৃষ্টি,, বিশেষ করে কোনো মানব শিশুকে ভূমিষ্ঠ হওয়ার জন্য মায়ের গর্ভে প্রেরণ করেন তখন তার ভাগ্য তিনি নিজের হাতে লিখে দেন।তো আমির শেখ আজ এমন তিন বিখ্যাত, কুখ্যাত ব্যক্তিকে আহ্বান করেছে যারা কি না গোটা কতক কাগজের বিনিময়ে আল্লাহর সাথে পাল্লা দিয়ে তাঁর সৃষ্টির সেরা জীব মানুষের ভাগ্য লেখে এবং তাও যদি তারা এদের টার্গেট হয়। উপর ওয়ালার সাথে এদের পার্থক্য এটুকুই তিনি জন্ম, মৃত্যু এবং বিবাহ এই তিন মিলিয়ে লেখেন তার সৃষ্টির কল্যাণে আর এই ব্যাক্তিরা শুধু তাদের মৃত্যু লেখে নিজেদের কল্যাণার্থে।কোন মায়ের বুক খালি হলো সেটা ভাবার সময় নেই কিন্তু নিজের ধনলক্ষী যে দিন দিন ফুলে ফেঁপে উঠছে এটুকুই যথেষ্ট।
কিছুক্ষণ চললো গোপন বৈঠক। অতঃপর সম্পূর্ণ অজানা অচেনা একটা ছেলের মৃত্যুর দিন তারিখ ঘোষণা করলো এই তিন ব্যাক্তি শুধু মাত্র বেশি অংকের টাকার বিনিময়ে।ভাবলোও না এই অজ্ঞাত যুবকের মৃত্যুতে তার পরিবার, পরিজনেরা কি করবে?
হিংস্র মনের অধিকারী এইসব মানুষদের মতো দেখতে পশুগুলো শুধু ভাঙতেই জানে গড়তে জানে না।
****
অনু তোমার ছেলের মতিগতি কিন্তু ঠিক লাগছে না আমার।কি করতে চাইছে সে। একবার বুঝালেও তো পারো।

অন্নপূর্ণা দেবীর চোখের পাতা জড়ো হয়ে এসেছিল ঘুমে,, স্বামীর কথায় চোখ মেলে তাকালেন।ঘড়ে আলো তো নেই তবুও অন্ধকারে স্বামীর দিকে ফিরে শুধুই একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলেন।

এভাবে বড়ো বড়ো দীর্ঘশ্বাস ছাড়লে কোন ফায়দা হবে? বিরক্ত ফুটে উঠল তাঁর কথায়।

অন্নপূর্ণা দেবী মিইয়ে যান স্বামীর কথায়,,,
কি করতে বলো আমাকে?মা হয়ে ছেলেকে আর কি ভাবে বুঝাবো বলো?সে কি এখন ছোট আছে?

যেভাবে বললে শোনে সেইভাবে ক্যানো বলনা? বিরক্তি বাড়ে প্রভাকর রায় চৌধুরীর গলায়।
মাতার চোখে ঘুম নেই সন্তানের চিন্তায়।এমন বৃষ্টি বাদলে ছেলে তাঁর ঘড়ে নেই ফিরবে কি না জানেন না তিনি।রিতি তো রাতের খাবারটাও খেলো না।মা হয়ে সন্তানদের এমন অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হওয়াটা মেনে নিতে পারছেন না তিনি।
অবশেষে দরজায় খুট খুট শব্দ,, অন্নপূর্ণা দেবী সাড়া দিতেই বাইরে থেকে জয়া উচ্চস্বরে বলে গেলো,,,

মামীমা ভাই ফিরেছে।।।

****
মাঝে অতিবাহিত হয়েছে আরো পনেরোটা দিন।এই পনেরো দিনে মথুরাপুর,চন্ডীনগর গ্রাম সহ আশেপাশের এলাকায় ঘটে গেছে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা।এমন ভীতি আর আতঙ্কিত এখানকার মানুষ এর আগে হয়েছে বলে মনে হয় না।দিনে দুপুরে রাস্তায় ধুলো উড়িয়ে ধেয়ে আসা বড়ো বড়ো গাড়ির দিকে মানুষ জন তাকিয়ে থাকে কৌতুহলী হয়ে।এই বুঝি কিছু একটা ঘটলো। সাংবাদিকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের লোকজন এর যাওয়া আসা বেড়েছে প্রভাকর রায় চৌধুরীর অন্তঃপুরে। তিনি প্রভাবশালী ব্যক্তি,একাধারে উপজেলা চেয়ারম্যান।গেলো পরশু রাতে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে আমির শেখ এর খামার বাড়ি থেকে তিনজন সাজাপ্রাপ্ত জেল পলাতক আসামি ধরা পরেছে। আমির শেখ অত্যন্ত চতুরতা এবং টাকার বিনিময়ে ব্যাপারটা থেকে গা বাঁচিয়েছে ঠিকই কিন্তু পুলিশের সজাগ দৃষ্টি সর্বদাই তার আশেপাশে ঘুরছে। এককথায় গৃহবন্দী হয়ে প্রতিশোধের আগুনে গুমরে গুমরে মরছে সে। নিজের অনুগত ভৃত্যরাও তাদের প্রভুর এই দুর্দিনে দুটো শান্তনা বাণী শুনাতে পারছে না।
কিন্তু প্রশাসনের একটাই দুশ্চিন্তা,সেটা হলো এই তিন ব্যক্তি যে আগ্নেয়াস্ত্র গুলি এনেছে সেগুলো উদ্ধার হয়নি যার কারণে বিপদাশঙ্কা বেড়েছে বৈ কমেনি। প্রভাকর রায় চৌধুরীর প্রেসার হাই। রঘুনাথ নিজের নেটওয়ার্ক কাজে লাগিয়ে রেখেছে সর্বদাই। কিন্তু কোনো সুরাহা এখনো হয়নি।

*****
সূর্যটা ঠিক মাথার উপর পূর্ণতেজে জ্বলছে।সুমিতা দেবী স্নান সেরে একটু সরিষার তেল মাখলেন হাতে, পায়ে, নাকে,মুখে।এটা তার পুরোনো অভ্যাস।হোক শীত কিংবা গ্রীষ্ম,স্নান শেষে তেল তাঁকে ঘষতেই হবে।আধ কাঁচা পাকা চুলের ওপর দিয়ে কাপড়ের আঁচলটা মাথায় টেনে ঢুকলেন রিতির ঘড়ে,,সেই সকালে একটুকরো রুটি খেয়ে ঔষধ খেয়েছে মেয়েটা।
মাথার উপর থেকে লেপটা টেনে সরিয়ে অসুস্থ রিতির এলোমেলো চুলে হাত বুলিয়ে ডাকলেন স্নেহাদ্র কন্ঠে,,,ও মা উঠো,,বেলা যায় তো,গতরডা মুইছা দেই,উঠো মা।
সরিষার তেলের ঝাঁঝালো গন্ধে রিতির নাকের পাটা ফুলে ওঠে।আলগা হয় গভীর ঘুম।
ছোট বালতিতে গরম জল এনে তাতে গামছা ভিজিয়ে হাত মুখ মুছিয়ে ঘড় ছাড়েন সুমিতা দেবী।সেই সুযোগে পরনের পোশাক পাল্টে আয়নার সামনে দাঁড়ায় রিতি।। নিজের প্রতিবিম্ব দেখে নিজেই আঁতকে উঠে।চোখ দুটোতে সেই উজ্জ্বল সৌন্দর্য নেই আর।মরা মাছের ফ্যাকাশে চোখের মতো মনি দুটো আবছা হয়ে আছে যেনো। চোখের চারিধারে ডার্ক সার্কেল। গোলাপের শিশিরভেজা পাপড়ির মত ঠোঁট দুটো শুষ্ক হয়ে ফেটেছে কয়েক জায়গায়। সেখানে ব্যাথা অনুভব করে রিতি। জিহ্বা দিয়ে ভিজিয়ে নেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা চালায় একবার। জিহ্বা টা মরুভূমি হয়েছে প্রায়।

গরম গরম ভাত আর থানকুনি পাতার কড়কড়ে করে ভাজা বড়া নিয়ে এসেছেন ন্ত দেবী।বাটিতে ফুলকপির ডালনা।
পড়ার টেবিলে সেগুলি রেখে রিতির চুল গুলো আঁচড়ে পরিপাটি করে দিতে দিতে ন্তঞবললেন সুমিতা দেবী,,,,
যে বিপদ গ্যালো মা,,গোবিন্দের মন্দিরে ন্তন্তষ্টষ্টন্ত ভোগ মানত করছি। তুই সাইরা ওঠ তারপর দিমু।
হাতে। মুখে রুচি নেই একটুও,মনটা তো তার চেয়ে তিক্ততায় ভরে আছে। মেয়েটার ঠান্ডার ধাত আছে।একটু বেশি ঠান্ডা লাগলেই গায়ের তাপমাত্রা বেড়ে চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়।এবারও ঠান্ডা নেহায়েৎ কম লাগেনি। কিন্তু ভগবান রক্ষা করেছেন বলেই বাড়াবাড়ি রকমের কিছু হয়নি। সাধারণ জ্বরেই সীমাবদ্ধ আছে।

আসবো বোনটি,,, দরজায় অখিলেশ।

রিতির দৃষ্টি সেদিকেই।সুমিতা দেবী সসম্ভ্রমে উঠে দাঁড়িয়ে মাথায় আঁচলটা আরেকটু টেনে দেয়। অখিলেশ ভেতরে ঢুকে কাঠের ভারী চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসে রিতির মুখোমুখি।
গায়ের এলোমেলো শালটি ভালো করে জড়িয়ে নেয় রিতি।অখিলেশের ওষ্ঠপ্রান্তে মলিন হাসি দৃষ্টি এড়ায়নি তার।

অখিল দা একদম খালি হাতে এলেন?রোগী দেখতে এলে ফলমূল, শাকসবজি আনতে হয় জানেন না বুঝি? সহাস্যে বললো রিতি।
অখিলেশের কোনো ভাবান্তর হলো না সে কথায়।
সিঁথি ক্যানো ফাঁকা বোনটি?এমনটা তোমাকে মানায়?এমন রংহীন জীবন তোমার নয়তো!!
রিতি ভেতরে ভেতরে সংকুচিত হয়ে পরে। শুরুতেই এমন বাক্য?

আমি জানি তুমি কি বলবে। কিন্তু রং হীন শুধু এপাশে নয় ওপাশেও চলছে সাদা কালোর খেলা।সহ্য করতে পারছো তুমি?

আমি তো আর দেখতে যাচ্ছি না।তাহলে সহ্য হবে না ক্যানো? মিইয়ে যাওয়া গলা রিতির।

হালকা শব্দে হাসলো অখিলেশ,,
ওহো দেখোনি তাহলে? তবে যে সেদিন শুনলাম,এই জ্বরের ঘোরে স্কুলে চলে গিয়েছিলে?আর তিনি নাকি আজকাল কফির মায়া ভুলে স্কুল গেটের সামনের দোকানের চা অমৃতের মতো পান করছে?
সেকি শুধু চায়ের টান নাকি অন্যকিছু?

আপনি কি প্রশ্ন পত্র রেডি করে নিয়ে আসছেন অখিল দা?

অখিলেশ জিভ কাটে,,না না। ভুল বুঝো না বোনটি।আমি তোমাকে, তোমাদের সুখী দেখতে চাই যে,, করুন সুর বাজলো অখিলেশের গলায়।

সে তো আমিও চাই অখিলদা। ছোট্ট অদ্রিকা জীবনে প্রথমবারের মতো তার জন্মদাতাকে বাবা ডেকে বুকে ঝাঁপিয়ে পরুক।যে আমার দাদার আসনে নিজের স্থান গেড়েছে সে সুখী হয়ে স্ত্রী, সন্তান নিয়ে স্থির জীবন পার করুক।নিরু দিদির মতো ভালো একটা মেয়ে নিজের একটা সীকৃতি পাবে।

অখিল মনে মনে খানিক চমকে ওঠে,,এ কদিনে মনের মধ্যে যে সম্ভাবনাময় প্রদীপটা জ্বলছিলো সেটাও নিভলো যেনো এক পলকা বাতাসে,,মুষড়ে পরা গলায় বললো,
অদ্রিকার বাবা ফিরবে তাহলে? কিন্তু তুমি কি করে ফেরাবে বলো?সে তো তোমার কাজ নয়।
রিতির মনের মধ্যে একটা ক্ষীণ আশার আলো জলে উঠলো।বুঝে নিতে একটুও দেরী হলো না,,এই অত্যন্ত ভালো এবং জাগতিক চিন্তা ভাবনা থেকে বিচ্ছিন্ন লোকটি আজো বুঝতে পারেনি,যে শিশুটি বুকে আসলে তার এত শান্তি লাগে তার পিতা কে?যে শিশুটির মুখনিঃসৃত ধ্বনি কানে পরম সুখের সুর তোলে সে সুরের প্রধান উৎস কি?নিজেকে মিথ্যা গম্ভীরতায় মুড়িয়ে বললো,,
সে ঠিক।আমি চাইলে পারি না কিন্তু আপনি চাইলে অবশ্যই পারেন অখিলদা! ছোট্ট অদ্রিকার বাবাকে ফিরিয়ে দিতে।

অখিল ফ্যালফ্যাল করে শুধু তাকিয়ে থাকে রিতির মুখপানে। মেয়েটার ভাষা আজ খুবই দুর্বোধ্য লাগছে তার।
রিতি আজ পনেরো দিন পরে ভীষণ আমোদ বোধ করছে এই সহজ সরল মানুষ টাকে খেলিয়ে।সত্যিই কি বোকা!!
নিরুপমা দি যে ট্রান্সফার নিয়ে চলে যাচ্ছে সেখবর রাখেন?
অখিলেশের বুকের ভেতর টা মুচড়ে ওঠে।একমূহুর্তের মধ্যে হাসি মাখা মুখটা ভেসে ওঠে মানসপটে।

ওহ!! ছোট একটা শব্দ নয় এক আকাশ আফসোস ঝরলো যেনো।

নিজেকে সামলে অন্য কথা তুললো সে,,,
এভাবে নিজেকে ক্যানো কষ্ট দিচ্ছো বোনটি?ফিরে চলো না সেখানে।প্রতিটি মানুষ যে মাথা খুঁড়ে মরছে ও বাড়িতে।তছনছ হয়ে গেছে সবকিছু।

সে বাড়িতে যাওয়ার আর অধিকার আছে আমার? অনেক দূর থেকে যেনো বললো কথাটা।
একটা কাগজ কলম কি সব কিছু শেষ করতে পারে? তোমার এমন বিবর্ণ রূপ বড়ো মা দেখতে পারছেন না। তিনি ও আজকাল বড্ড অগোছালো হয়ে গিয়েছেন।

পালঙ্কের সাথে হেলে বসে চোখ বন্ধ করে রিতি। এবার তার দারুন অসুস্থ লাগছে,,
কিছুক্ষণ কাটলো মৌনতায়,,

আমি যে রঙ হীন একটা দুনিয়া চাই অখিল দা।যেখানে এত এত বাহারী রঙের ছড়াছড়ি থাকবে না,থাকবে শুধু সাদা আর কালো। দুঃখের রঙ গুলো হবে শুধুই সাদা।তাই যদি না হয় তাহলে চোখের জলের কোনো রঙ হয় না ক্যানো বলুন তো। সেতো সাদাই। দুঃখের রঙ যদি নীল হবে তাহলে সে দুঃখে কান্না ক্যানো পায়?আঁখি ক্যানো তার রঙহীন সম্পদের অপচয় করে? ভালো বাসার রঙ হবে কালো,কারণ সাদা মনে দাগ কেটে যায় ভালোবাসা।সাদার উপর কালো রঙের আঁচড় যে খুব ফোঁটে।
শুষ্ক চোখে ঝর্ণা নামে রিতির। অখিলেশ অসহায়। কিছুই করার নেই তার যে যার জেদের কাছে পরাজিত।

****
টিনের চালার ছোট্ট ঘড়ের বেড়া জুড়ে ফাঁক ফোকর। উত্তরের হিম বায়ু আটকাতে সেই ফাঁকফোকরে নিজের পুরনো ছেঁড়া লুঙ্গি দিয়ে পর্দা টানিয়েছে বিনুদা।তেল চিটচিটে বালিশের উপর মুখের একপাশ চেপে ঘুমিয়ে আছে বিরূপাক্ষ। গায়ের উপরে একটা পাতলা কম্বল,তার উপরে শিমুল তুলার লেপ। লেপের কভার কেচে ধুয়ে পরিষ্কার করে দিয়েছে বিনু দা।
অতি চেনা প্রিয় গন্ধে ঘুম ভাঙে বিরূপাক্ষের।
চোখ মেলতেই জ্বালা করে ওঠে।মাথার সামনে জ্যোতির্ময়ী নারী মূর্তিটির দিকে তাকিয়ে রয় কয়েক মূহূর্ত।কল্পনা ভেবে ভ্রম হয়। কিন্তু না,কল্পনা নয়,,সত্যিই মা এসেছেন অভিমান ভুলে।

উঠে বসে হাতের চেটোতে চোখ মুছে বলে,,মা,,, তুমি এসেছো? এখানে কোথায় বসতে দেই বলোতো?
পরিপাটি ছিমছাম ছেলের মুখভর্তি কয়েকদিনের না কামানো দাঁড়ি, চুল গুলো উষ্কখুষ্ক, চোখে ঘুমহীনতার ছাপ স্পষ্ট,শরীরটাও ভেঙেছে খানিকটা।চোখ ফেটে জল আসতে চায় অন্নপূর্ণা দেবীর কিন্তু তিনি তো প্রকাশ করবেন না নিজের দূর্বলতা।কন্ঠে কাঠিন্য এনে বলেন,,আমি তোমার এখানে বসতে আসিনি বাবা,,
বিরূপাক্ষ মাকে দেখে যতটা স্বস্তি পেয়েছিল তা নিভলো তবুও জড়িয়ে ধরে মাকে। অন্নপূর্ণা দেবী আর নিজের কাঠিন্য বজায় রাখতে সক্ষম হয় না,,
ধরা গলায় বলেন,,,ফিরে চল বাবা,, নিজের ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চেয়ে নে খোকা।সব ঠিক হয়ে যাবে। ছেলেকে আঁকড়ে ধরেন অন্নপূর্ণা দেবী।

মা বনলতার সাথে যোগাযোগ করতে পারছি না এ কদিন।মনটা আমার পুড়ে যাচ্ছে। তুমি তো বোঝার চেষ্টা করো মা।
অন্নপূর্ণা দেবীর মনটা বিষিয়ে ওঠে। ছেলের মাথা এবং পিঠ থেকে হাত দুটো আস্তে সরে পরে,,
এখনো তুই বনলতার কথা ভাবছিস?ছি ছি,,এই ছেলে পেটে ধরেছি আমি? মনুষ্যত্বের জলাঞ্জলি দিয়ছিস তুই?অমন সোনার প্রতিমাতে তামাটে রঙ ধরেছে,সে তো তোর জন্যই। দেখেছিস একবার চোখের দেখা?তাকানো যায় না মুখের দিকে। লজ্জায় আমার মাথা কাটা যায়।কই তার জন্য তো কোনো ভাবনা নেই তোর? কাঁদছেন অন্নপূর্ণা দেবী। বিরূপাক্ষ নীরবে শুনলো শুধু। কিছুই বললো না প্রতিউত্তরে।মা কি জানে তার ছেলেটা মনুষ্যত্বের টানে না গেলেও শুধু মাত্র একপলক দেখার জন্য কতকিছুই না করেছে।তার ফলস্বরূপ এই হাঁটুর ছাল উঠে যাওয়া দগদগে ঘা টা।

****
রাতের ঝকঝকে নীল আকাশে একফালি চাঁদ।খাটের লাগোয়া টিনের বেড়ায় দখিনা জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে রিতি।ঘড়ে জ্বলে থাকা আলোটা বিরক্তিকর লাগে রিতির কাছে।এই আলো তাকে অবসন্ন নীরব নিশি জাগরণে ব্যাঘাত ঘটায় বার বার। কিন্তু আলোটা নেভাতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন পিসি।তার নিষেধ অমান্য করলে শাস্তি স্বরূপ নিজে কেঁদে কুটে সারা হবেন।রিতি যেদিন থেকে জ্বরে পরেছে সেই থেকে এঘড়ের আলো নেভাতে দেয়না। অসুস্থ মানুষের ঘড় অন্ধকার থাকলে তাতে নাকি খারাপ কিছু চলাফেরা করে। পিসির কথায় হাসে রিতি।মনটা ভরে ওঠে গভীর আবেগে। পিসির এই কুসংস্কারের পেছনে যে তার জন্য অফুরন্ত স্নেহ লুকিয়ে আছে।

কি হইলো রে মা,,,জানলা খান খুইলা রাখলি ক্যান?যা হিম পরছে আবার ঠান্ডা লাগবো। জানালার পাল্লা দুটো আটকে দিয়ে বললেন সুমিতা দেবী।রিতির কপালে হাত দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলেন,,
যাক, জ্বর আসে নাই আইজ।
কিছুক্ষণ একথা সেকথা বলে সে স্থান ত্যাগ করেন সুমিতা দেবী।রিতি ঘড়ের দরজার কপাট আটকে রুদ্ধ জানালা উন্মুক্ত করে। লোহার রডে পরম যত্নে হাত বুলিয়ে মাথা ঠেকিয়ে বিড়বিড় করে ঠোঁট প্রসারিত করে বলে,,এখানে শুধু হিম বাতাস আসে না পিসি,, গভীর নিশিথে আমার প্রাণ শীতল করার কারনটাও আসে। নিঃশব্দে এসে নীরবে চলে যায়? কিন্তু সে কি জানে আমি শুধু অসুস্থতার জন্য নয়, তার আসার অপেক্ষায় নির্ঘুম থাকি।তার গায়ের গন্ধ সর্বাঙ্গে মাখি।
আমি যদি এতটাই অকিঞ্চিত তার কাছে তাহলে ক্যানো এই লুকোচুরি?ক্যানো এই গোপন দর্শন?
নিজের মনে সাত পাঁচ প্রশ্ন আবৃত্তি করে চলে রিতি। চাঁদটা তখন ঠিক মাথার উপর দাঁড়িয়েছে।

চাঁদের আলোর রূপালী জোছনায় ইটের ভাটার চুল্লির পাইপ গুলো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। আশেপাশে আর কোনো আলোর দেখা মিললো না। কিন্তু অফিস রুমের পেছনে যে গুপ্ত কক্ষটি করেছিল আমির শেখ সেখান থেকে কোনো এক ফাঁক গলে একটা অনুজ্জ্বল আলোর রোশনাই আসছে।কি আজব!অন্যদিন সমস্ত ভাটায় বৈদ্যুতিক বাল্ব জ্বললেও ওঘড়ে কোনো আলো কেউ দেখেনি কিন্তু আজ সব আলো যেখানে ক্লান্ত হয়ে নিভে আছে , সেখানে ঐ আধার কুঠিরে আলো জলছে সাথে জ্বলছে নির্ঘুম কয়েকটি দো-পায়ে প্রাণীর হিংস্র চোখগুলো। অনেক সাধ্য সাধনা এবং সবার নজর এড়িয়ে আজ এই মিটিংয়ের ব্যাবস্থা করেছে আসলাম। আমির শেখ গম্ভীর হয়ে বসে আছে নিজের আসনে।সময় জ্ঞান যাদের নেই তারা কখনো আশানুরূপ কাজ করতে পারে না। আসলাম ভয়ে বার বার শুকনো ঢোক গিলছে।যদি না আসে সে?যাকে নিয়ে আমির ভাইকে এত আশা ভরসা দিলো সেই মানুষটি।

কি ব্যাপার আসলাম?তুইও কি সবার মতো আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিতে চাস? দাঁতে দাঁত পিষে বলে আমির শেখ।
আসলাম কুন্ঠিত বোধ করে,,

মাফ করবেন ভাই।তেনার না আরো আগেই আসার কথা ছিলো,,
চুপ কর আসলাম,,,,

রুমের সুরঙ্গের দরজার জুতোর খট খট শব্দ শুনে থেমে যায় আমির।কক্ষের সব কটা মানুষের দৃষ্টি নিবদ্ধ সেদিকে ‌।আবছা আলোয় এক নারী দেহের অবয়ব স্পষ্ট হয়।কি লাস্যময়ী রূপ সে নারীর। আমির শেখের মতো বিশেষ ব্যক্তিত্বের পুরুষটিও তব্দা খেয়ে দাঁড়িয়ে যায়। চোখের ক্রোধ ছাপিয়ে এক অপূর্ব মুগ্ধতা ভর করে কিন্তু তার মাঝেও একটাই প্রশ্ন উকি দিয়ে যাচ্ছে,,কে এই সুন্দরী রমণী?আর কিসের এমন শত্রুতা চৌধুরী পরিবারের সাথে যার কারনে খুনের মতো অপরাধ করতেও প্রস্তুত?ঐ নরম পেলব হাতে সোহাগের বদলে মরনাস্ত্র তুলবে?ক্যানো?

চলবে,,,,,

ভুল ত্রুটি মার্জনীয়।
ভালো থাকবেন সবাই।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here