হিয়ার মাঝে-লুকিয়ে ছিলে,পর্ব:৩৪

0
513

উপন্যাস: হিয়ার মাঝে-লুকিয়ে ছিলে,পর্ব:৩৪
কলমে:চন্দ্রা

পনেরো দিন আগের সেই রাতটাই শুধু প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হয়েছে তা নয় রিতিও জীবনের অনেক বড় একটা সর্বনাশা দুর্যোগের সম্মুখীন হয়েছিলো।

বিরূপাক্ষ অতৃপ্ত মন আর ক্লান্ত শরীরে বৃষ্টি ভেজা হয়ে যখন ফিরেছিল বাড়িতে, রাত্রি তখন দ্বি-প্রহর।জয়ার শত অনুরোধের পরেও রাতের খাবার খায়নি সে।
বনলতা তার সাথে দেখা করতে অপারগতা জানিয়েছে সে যখন মংলা বন্দরের কাছাকাছি। সুন্দর একটা মূহুর্তের আশায় সুন্দর বনের কাছে আর যেতে হয়নি তাকে, তার আগেই ফিরে আসতে হয়েছে।মনে জমে থাকা প্রিয়তম দর্শনের তীব্র আকাঙ্ক্ষারা পিষ্ট হয়েছে পথের ধুলোবালিতে।
বনলতা ফোনে জানায়,,তার বিশেষ অসুবিধা থাকায় এবারের মতো দেখা করতে পারবে না। অনুরোধ করে বলেছে সে,, আপনি ফিরে যান প্লিজ। আমার একমাত্র আপনজন খুব অসুস্থ।
তবে আশার বাণী শুনিয়েছে বেশ দৃঢ়তার সাথে,, খুব শীঘ্রই সে দেখা করবে এবং সেটাও রঘুনাথপুরে মানে বিরূপাক্ষ দের গ্রামেই।

অনেক রাত তখন। বৃষ্টির সাথে বাতাসের গতি বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। নিজের ঘড়ের জানালায় খিল এঁটে সবে বিছানায় বসেছে রিতি তখনই বাহিরে দরজায় টোকা পরলো। অধৈর্য হয়ে কেউ নক করছে।রিতির আত্মা ধক করে উঠল সে আওয়াজে। ছিটকিনি না থাকলেও এগিয়ে গিয়ে টেনে খুলে দিল দরজা।সামনে দাঁড়িয়ে বিরূপাক্ষ।হাতে একতারা কাগজ তার।চেহারা বিধ্বস্ত।ভেজা চুল গুলো এলোমেলো।টলছে বোধহয়,,
ঐ বৃষ্টি ভেজা চুলের বিরূপাক্ষকে দেখেই এক অদ্ভুত উন্মাদ মাদকতায় ছেয়ে গেল রিতির মন ময়ূরী।পেখম মেলে নাচলো যেনো ঝুমঝুম তালে। কিন্তু সে মাদকতা দীর্ঘ স্থায়ী হলো না রিতির,

ভেতরে চল রিতি,,বললো বিরূপাক্ষ।

কিসের একটা ঝাঁঝালো গন্ধে গা গুলিয়ে উঠলো রিতির।মনে পরলো হোটেল রুমের কথা।এই তো সেই গন্ধ। ভাবনার মাঝেই বিরূপাক্ষ হেঁটে গিয়ে বসেছে বিছানায়। অজানা ভীতিরা এসে কুন্ডলী পাকায় রিতির বুকে।শঙ্কিত চিত্তে ইতস্তত পায়ে এগিয়ে যায়।
মাথাটা নিচু করে বসে আছে বিরূপাক্ষ।হালকা ভেজা চুলগুলো ছড়িয়ে আছে কপাল জুড়ে।রিতির বুকের ভেতর এক অশুভ সংকেত বার বার তারস্বরে চিৎকার করে যাচ্ছে।

এগুলো ধর রিতি,,সাইন করে দে। ভাববার সময় চাইলে দিতে পারবো না কিন্তু। নির্লিপ্ত বিরূপাক্ষ।

রিতি স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দেখে একটু গলা চড়িয়ে বলে বিরূপাক্ষ,,,
কি দেখছিস অমন করে? এগুলো নে।তুই তো এটাই চাইছিস। তোর আগামী পথটুকু মসৃণ করার দলিল এটা। এখানে সাক্ষর করলে তোদের সে পথে বিরূপাক্ষ নামক কাঁটা টা আর থাকবে না।নে,,,

কাঁপা হাতে রিতি নিয়ে নেয় সেগুলো।খুলে দেখার সাহস পায় না। বুঝতে বাকী নেই যে,কি মহার্ঘ্য বস্তু তার হাতে ধরিয়ে দিলো। কিন্তু বিরূপাক্ষ নাছোড়বান্দা।

কি হলো?পড়ে দ্যাখ!!তোর আত্মার শান্তি এখানে।আর এটাও নে ,,, তোর পুষিয়ে যাবে আশা করি।

কি এটা রূপ দা??গলা কাঁপছে রিতির।

বিরূপাক্ষ ফোলা লালচে চোখে তাকায় এবার।রিতির সহ্য হয় না সে দৃষ্টি।কি ভীষণ অগ্নিকুন্ড জ্বলছে সেখানে।এখনি হয়তো সে তাপে ভস্মীভূত হবে সে।

নিজের ইচ্ছা মত সংখ্যা বসিয়ে নিস। সিগনেচার করে দিয়েছি।

কি সব বলছো তুমি??বুকটা ভেঙে আসে রিতির।

টলমল পায়ে উঠে দাঁড়ায় বিরূপাক্ষ,,,
বুঝদারের মতো বলে,,দ্যাখ রিতি বাবার যা কিছু আছে তা আমার নয়। ওদিকে হাত বাড়াস নে।তোর কাছে দোষ আমি করেছি,জরিমানাটাও আমিই দিচ্ছি। আমার বাবার সম্পত্তির লোভে এখানে পরে থাকিস না প্লিজ,,,
বাবার সম্পত্তির লোভে পরে আছি? অস্ফুটে বিড়বিড় করে।
রিতির সমস্ত শরীর কাঁপছে।গলাটা শুকিয়ে মরুভূমির মতো হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।এখনি এক পুকুর জল পেলে আকন্ঠ পান করে নিতো সে। চোখ দুটো জালা করছে।সেখানেও একফোঁটা জল নেই এখন।সব শুন্য। পরিপূর্ণ শুধু যাতনার ঘড়াটা।

সাক্ষরটা আমার আজই চাই কিন্তু।এই রাতেই।
রিতির হাতে ব্লাঙ্ক চেকটা গুঁজে দিয়ে টলমল পায়ে বেরিয়ে আসে বিরূপাক্ষ। সজোরে দরজাটা বন্ধ হতেই কেঁপে উঠে চমক ভাঙে রিতির।ডিভোর্স পেপারটা বুকে চেপে হুঁ হুঁ করে কেঁদে ওঠে সে। বিছানায় উপুড় হয়ে কাঁদতে থাকতে চিৎকার দিয়ে।নাহ সে চিৎকার বাইরে যায়নি।গেলেও কে শুনবে?মেঘবতী যে বুঝতে পেরেছিল আজ রিতি কাঁদবে তাই তো সে আগে থেকেই কান্না জুড়েছে মরা কান্না।

বেশ অনেকটা সময় কেঁদে নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে বসে রিতি। নিজেই মনে মনে আওড়ায়,,এটা নিশ্চই তুমি সজ্ঞানে করোনি। নিশ্চয়ই অতিরিক্ত নেশার ফলে মস্তিষ্ক বিকৃত হয়েছে।
কিন্তু সাক্ষর যে তাকে করতে হবে। তিনি সময় দিতে পারবেন না। অনেক ভাবলো, অনেক কাঁদলো, অবশেষে হাসলো পাগলিনির মতো।রাতের শেষ প্রহর যখন অত বৃষ্টির মধ্যেও অদূরে কোনো গৃহস্থের বাড়িতে পালের বড়ো মোরগটা ডেকে উঠলো তার নিত্যনৈমিত্তিক স্বরে তখনি রিতি এক কাপড়ে সবার অগোচরে নিজের সাইন করা কাগজটা বিছানায় রেখে পৌঁছোলো রায় চৌধুরী বাড়ির প্রধান ফটকে।তখনো দারোয়ান জাগেনি। দাঁড়ায়নি তার নির্দিষ্ট স্থানটিতে।
শূন্য হাতে বুকের ভেতর অনেক আশা নিয়ে নিয়ে যেমন এসেছিলো এখানে, তেমনি মনের অন্ধকূপে সে আশার সমাধি করে পূণরায় নিঃস্ব হয়ে পা বাড়ায় গেটের বাইরে।
বৃষ্টির ফোঁটা রা তখনো ক্লান্ত হয়নি।জল শুকায়নি মেঘ কুমারীর আঁখির,পরছে অবিরাম।
নেশার ঘোর আর বাইরের আবহাওয়ার কারণে একটা সুদীর্ঘ ঘুমের ঘোরে যখন আত্মতৃপ্তির চরম সীমায় পৌঁছে গেছে বিরূপাক্ষ,,মায়ের হাহাকার মেশানো আর্তনাদে মোটা কম্বল ঠেলে উঠে বসলো বিছানায়।কানখাড়া করে শুনলো চেঁচামেচি তার রূদ্ধদারের সামনেই হচ্ছে।মাথাটা ঝিমঝিম করছে তখনো।বুকটা ধড়ফড় করছে। দরজা খুলে দিতেই বাঁ গালে সপাটে পরলো এক থাপ্পর।অগ্নিচোখে দাঁড়িয়ে আছে অন্য সবার সাথে প্রভাকর রায় চৌধুরী।রাগে, দুঃখে, অপমানে ঠোঁট কাঁপছে তাঁর, সেইসাথে কাঁপছে মোটা পুরু সাদা কালো মিশেল গুম্ফোরাশি।দরজা টা আঁকড়ে নিজের তাল সামলায় বিরূপাক্ষ।না হলে এতক্ষণ নিজ শয়নকক্ষের মেঝেতে ঠাঁই হতো। প্রভাকর রায় চৌধুরী ডিভোর্স পেপার্স গুলো ছুড়ে মারে নিজ পুত্রের বুক বরাবর।এমন অতর্কিত আক্রমনের হেতুটা ঠিক কি তখনো বুঝের বাইরে তার। শুধু অবাক হয়ে একবার দৃষ্টি বুলালো ক্রন্দনরত মা,এবং বৌদিদির দিকে।নিচু হয়ে ডিভোর্স পেপারের সাথে পরে থাকা কাগজ তিনটে তুলে নিয়ে দেখলো,তার নিজেরই সাক্ষর করা ব্লাঙ্কচেক,আরেকটা চেকেও তার নিজের সাক্ষর। বহুকাল আগে হওয়ায় সে কালি ছড়িয়ে মোটা হয়েছে দাগগুলো।এই চেকটা ই তো রিতিকে দিয়েছিলো সেদিন,,যেদিন বিবাহ ঝলমল চৌধুরী বাড়িটার প্রত্যেকটি মানুষকে অপমানের গাঢ়ো অন্ধকারে নিমজ্জিত করে গিয়েছিলো। এখান থেকে পালিয়ে গিয়েছিল প্যারিসে।আগ্রহ ভরে অন্য ব্যাংক চেকটা দেখে,,,পাঁচ লক্ষ টাকার,যেটাতে ত্ররিতি হালদার রায় চৌধুরী নামটা জ্বল জ্বল করছে।
মা কাঁদছে শব্দ করে।জয়া মুখে আঁচল চেপেছে।রাতের ঘটনাটা মনে পরতেই সমস্ত শরীরে একটা ঝাঁকুনি দিলো বিরূপাক্ষের।সম্ভাব্য দুর্ঘটনার আশঙ্কায় নেশার ঘোর ছুটে গিয়েছে তার,,তখনি বুকে আছড়ে পড়ে মা।

কি সর্বনাশ তুই করলি খোকা? একটিবার আমাদের কথা, মেয়েটির কথা ভাবলি না??
এতকিছুর পরেও বাঁচবে তো মেয়েটা?
ক্যানো ফিরে এলি তুই?সবটা সয়েই তো নিয়েছিল।
একটু মেনে নিতে পারলে না ভাই?সারাটা দিন দাদুভাইকে নিয়ে পরে থেকেছে, দাদুভাই একটু সুস্থ হতেই এই বৃষ্টি মাথায় করে বাড়ি ফিরেছে সেকি শুধু তোমার এই টাকার লোভে?বুড়ো অসুস্থ মানুষটা এ খবর শুনলে আর বাঁচবে?এই ঠান্ডায় বৃষ্টির মধ্যে ভিজে ভিজে গেলো মেয়েটি।
বাষ্প রুদ্ধ কন্ঠে বললো জয়া।
তখনি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো রঘুনাথ,,
মামীমা,, শ্বাসকষ্ট বেড়েছে বোনের।গায়ে প্রচন্ড জ্বর। ইনহেলার টা এখানে রেখে গেছে। খুঁজে দাও তো।ডাক্তার কাকাকে সেখানে রেখে এসেছি।
অন্নপূর্ণা দেবীর কান্নার বেগ বাড়ে।একেতো ঠান্ডার ধাত আছে তায় আবার জ্বর বাড়লেই টাইফয়েডের দিকে মোড় নেয়।
বিরূপাক্ষের বুকে ভোঁতা যন্ত্রণা গুলো দামামা বাজিয়ে চলেছে।কোনোমতে বললো,, দাদাভাই আমিও যাবো।
প্রভাকর রায় চৌধুরী স্ত্রীকে ঠেলে পাশে সরিয়ে পুত্রের টি শার্ট এর বুকটা মুচড়ে ধরে প্রচন্ড আক্রোশ নিয়ে,,

কোথায় যাবি তুই অমানুষ কোথাকার?এখনি বেড়িয়ে যা আমার বাড়ি থেকে।তোর মতো কুলাঙ্গারের ঠাঁই হবে না এখানে।
নির্বোধ কোথাকার,, তোর নিজের জীবনের মায়া নেই?ঐ মেয়ের জন্যই তোর মৃত্যুযোগ কাটবে।আর তাকেই তুই ছুঁড়ে মারলি?

বিরূপাক্ষ হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। মনের মাঝে উঁকি মারে বনলতার বিপদাশঙ্কা।কারন স্ত্রী তো সে ই।
গুরুদেব এর কথা যদি সত্যি হয় তাহলে বনলতাকে রক্ষা করবে কে?

রঘুনাথ মামার হাত ছাড়িয়ে অন্যপাশে নিয়ে যায়। অন্নপূর্ণা দেবী কাঁদেন একনাগাড়ে। তাঁর সোনামুখো সংসারের একি পরিনাম?এ কোন পাপের ফল পাচ্ছেন তিনি?

সেদিনই বিরূপাক্ষ নিজের বিলাসবহুল বাড়ি ছেড়ে বেড়িয়ে এসে উঠেছে খামারবাড়িতে বিনুদার ছোট্ট টিনের চালার ঘড়ে।সাথে নিয়ে এসেছে একগাদা প্রশ্নভর্তি মনটা।
একটাই প্রশ্ন তার,,রিতি তো টাকা পয়সা চায়না তাহলে ক্যানো সাইন করলো ডিভোর্স পেপারে?আর এই পাঁচ লাখ টাকা ও ক্যানো দিলো তাকে?
বিরূপাক্ষের সাক্ষর হীন ডিভোর্স পেপারটা সেদিনই গ্যাসের চুলোয় পুড়িয়েছে জয়া।তার যদি ক্ষমতা থাকতো তাহলে হয়তো এই ডিভোর্স বা বিবাহ বিচ্ছেদ শব্দটাই সমূলে পুড়িয়ে দিতো চুলায় ভীষণ আঁচ বাড়িয়ে।

*****
একা মোর গানের তরী,,,,

ভাসিয়ে ছিলাম নয়ন জলে,,,,,

যিনি এই গানটি রচনা করেছিলেন তাঁর মনোভাবটা কি ছিলো ঠিক ঐ সময়ে,আমি জানি না। কিন্তু নিশুতি রাতে কোনো বিরহিনীর বিরহ যদি সুরের পথ ধরে এভাবে চারিদিক মূর্ছিত করে তাহলে পরিবেশটা ক্যামন হয়?
নিজের ঘড়ের প্রিয় সজ্জাটি আজ বড়ো কণ্টকাকীর্ন ঠেকছে রিতির কাছে।এ কোন হৃদয় বিদারক সুর মূর্ছনা?বাতাস বইতে ভুলে গিয়েছে,চাঁদটাও নিজের আলো ছড়াতে ভুলে গিয়ে মুখ লুকিয়েছে মেঘের আড়ালে।

“অবসন্ন কুসুমেরা ঝরিতেছে বনবিথীতলে নীরব রোদনে”

শ্রদ্ধেয় পূর্ণেন্দুশেখর পত্রীর কথাটি আজ এই মুহূর্তে সার্থকতা পেলো বুঝি।

বৃদ্ধ দাদু প্রাণের পৌত্রির এমন বেদনাবিধুর সুরে কোঠরাগত চোখের জল মোছেন ধুতীর খুঁটে। তাঁর সহ্য হয়না আর। মেয়েটাকে সুখী করতে পারলো না জীবনে। দুঃখ দিলো বহুগুনে। দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে সিদ্ধান্ত নেন আরেকবার চেষ্টা করে দেখবেন,, শেষ চেষ্টা।
রিতি তখনো আপন মনে গেয়ে চলেছে,,নয়নে বারি ঝরছে অবিরত।

****
এমনটা না করলেও পারতি রূপ?বুদ্ধি তোর কম নয়। ভেবেছিলাম সামলে নিবি। কিন্তু??? সিগারেট ধরিয়ে একটা টান দেয় অখিলেশ। বিরূপাক্ষ কোনো প্রতিউত্তর করে না।

আমাকে একটা দেতো অখিল,, জ্বালিয়ে দেখি,,জ্বালা কমে নাকি? বাঁশের খুঁটির সাথে হেলে বসে বিরূপাক্ষ। অখিলেশ ফিচেল হেসে নিজেই একটা সিগারেট ধরিয়ে এগিয়ে দেয়।যে বিরূপাক্ষ স্মোকিং এর ঘোর বিরোধী সে কি না আজ জ্বালা কমাতে তাহাই মুখে দিচ্ছে? ভালো।।
বিরূপাক্ষ সিগারেটে টান দিয়েছে কি দেয়নি কাঁশি দিয়ে উঠলো।নাক মুখ দিয়ে ধোঁয়ার ছড়াছড়ি। মুখে হাসি কিন্তু কঠিন চোখে তাকায় অখিলেশ। বিরূপাক্ষ চেনে না অখিলেশ এর এই দৃষ্টি।

যেটা পারবি না,সেটা করিস ক্যানো বলতো?

বিরূপাক্ষের হাত থেকে জলন্ত সিগারেট টা নিয়ে নিজে সুখটান দিতে থাকে অখিল।

একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবি অখিল?
বড্ড স্পষ্ট অথচ করুন শোনায় বিরূপাক্ষের গলা,,

হ্যা বল,,জানলে নিশ্চই বলবো।

এই ব্যাংক চেক গুলোর ধাঁধা থেকে বের করতো আমায়।

অখিলেশ গান ধরে বেসুরো গলায়, গানের কথাগুলোও ভুল ভাল,,

আমি যাহারো লাগিয়া এ ঘড় বাঁধিনু,,,
সে তো চলিয়া যায়য়য়,,,

চরম বিরক্তি নিয়ে তাকায় বিরূপাক্ষ। নিজেকে অবাঞ্চিত মনে হয় আজকাল।ফিক করে হেসে দেয় অখিলেশ,,
ঐ ভাবে তাকাও ক্যানো বন্ধু?আমারে কি দেখতে তোমার বৌয়ের মতো লাগে?

নির্বাক হয়ে থাকে বিরূপাক্ষ। আজকাল নিজের আপন মানুষগুলোও তার সাথে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে কথা বলছে।প্রদীপটা ও ক্যামন মুষড়ে পরেছে বুঝতে পারে সে। নেহায়েৎ বন্ধু বাৎসল্যের খাতিরে কিছু বলতে পারছে না চোখ রাঙিয়ে।রিতি ই তাদের আপন বিরূপাক্ষ কেউ নয়, কিছু নয়।

তুই রিতির সাথে কথা বলে দেখতে পারিস রূপ!যে তোকে ধাঁধা ছুড়ে মেরেছে তাকে ক্যানো ধরছিস না? একেবারে এঁটে বেঁধে ধরে দ্যাখ।ও ছাড়া আর কেউ তোর এই প্যাচ খুলবে বলে মনে হয় না।

বিরূপাক্ষের চোখ দুটো জ্বলে ওঠে ধক করে।সেকি ক্রোধে নাকি নির্জীব অভিমানে জানে না,,
ওর সাথে কথা বলার প্রশ্নই আসে না।দেখলি না ক্যামন ডিভোর্স পেপারে সাইন করে দিয়ে গেলো? ব্যাংক চেক গুলো দিয়ে নিজেকে মহৎ প্রমাণ করতে চায়?ওসব বুঝিনা ভেবেছিস?আরো বড়ো কিছু হাতাতে চায় জানিস তো?

অখিলেশ আর হাসে না,,
হ্যা জানি রূপ।ওই ছোট মেয়েটি অনেক বড়ো কিছু চায়।হয়তো তোর বাবার সকল সম্পত্তিতে নিজের একছত্র অধিকার চায়!

এবার বোঝো তাহলে?ওর জন্য কি না বাবা মা আমাকে ভুল বুঝলো?ও মেয়ে সবকিছু নিয়ে থাকবে এখানে?তাই ভেবেছিস?

অখিলেশ উঠে দাঁড়ায়,,
আজ যাই তাহলে, পরে আসবো। ধাঁধার উত্তর পেতে অনন্ত সামনে গিয়ে দাঁড়া একবার।হয়তো অনেক কিছুই পেয়ে যাবি আর শোন, তুই কিন্তু তোর বাবার সম্পত্তির সবচেয়ে বড়ো অংশ।ঐ লোভী মেয়েটার মেইন টার্গেট এটা নয়তো???অখিলেশ এর চোখে হাসির ঝিলিক। কিন্তু সে হাসি বোধগম্য হয় না বিরূপাক্ষের।

****
শোবার ঘরের এক কোণে ছোট্ট একটা সিংহাসনে নিত্য পূজা করেন অনিতা দেবী।মন এতে না ভরলেও কিছুটা শান্তি মেলে তাঁর।গোধুলী পেরিয়ে ভর সন্ধ্যা যাকে বলে।নিরু হাত মুখ ধুয়ে সবে ঘড়ে ঢুকলো।অনিতা দেবী ঠাকুরের সামনে ভালো তেলের প্রদীপ জ্বেলে ধুপকাটি ধরালেন।উলু দিয়ে প্রণাম সেরে বারান্দায় আসতেই অখিলেশ এর দেখা‌। দুহাতে বাচ্চাদের মুখরোচক খাবারের ব্যাগ। তিনি ছোট্ট অদ্রিকাকে ডেকে অখিলেশ কে বসতে বলে ছুটলেন রান্না ঘরে।এখানে শোয়ার ঘড় থেকে রান্না ঘড়ের দূরত্ব বেশ খানিকটা।
নিরু মায়ের ঘড়েই ঠাকুরের সামনে সদ্য প্রজ্জ্বলিত প্রদীপ এর সামনে ভক্তিভরে প্রণাম করছিলো।আগে এমন অভ্যেস তার ছিলো না।ঠাকুরঘড়ে দর্শন তার কমই মিলেছে। কিন্তু সেই উচ্ছল প্রাণবন্ত নিরুর সকল গোঁয়ার্তুমি হারিয়ে গিয়েছে ছোট্ট জ্যান্ত পুতুলের আগমনে।সে এখন যতটা সময় পারে ঠাকুরের সামনে পরে প্রার্থনা করে অদ্রিকার জন্য কিন্তু অন্তর্যামীই জানেন নিরুর এই আকুল আবেদন শুধু ছোট্ট অদ্রিকার জন্য নয় আরো একজন মানুষ আছে।আরো একজন মানুষের সর্বঙ্গীন মঙ্গল কামনায় ভক্তিভরে পূজা করে সে।প্রণাম সেরে উঠতেই বাহিরে অদ্রিকার অনর্গল কথার শব্দ পেলো নিরু। কৌতুহল নিয়ে এগিয়ে যা দেখলো তাতে পা দুটো স্থির হলো মূহুর্তেই। অখিলেশ অদ্রিকাকে কোলে নিয়ে হাঁটছে বারান্দায়।হাতে অনেক গুলো ক্যাটবেরী পেয়ে সেই খুশিতে অদ্রিকা বলে যাচ্ছে নিজের যত জমানো কথা।তখনি নিরুপমার মনে হলো এমন চোখজুড়ানো দৃশ্য এর আগে ও দেখেনি কখনো। ঠোঁট জুড়ে পরিতৃপ্তির হাসি। তখনি একবার চার চোখের মিলন হলো আর নিরুপমার হাসিও নিভলো। নিজের শোবার ঘড় থেকে একটা শাল জড়িয়ে এসে বসেছে বারান্দায় চেয়ারে। সামনের চেয়ারে অখিলেশ।অনিতা দেবী চা জলখাবার দিয়ে অদ্রিকাকে নিয়ে ঘড়ে ঢুকেছেন।

তারপর কি খবর তোমার?ক্যামন যাচ্ছে দিনকাল?প্রথমেই কথা তুললো নিরু।মৌনতা তার ভীষণ অসহ্য।

হ্যা ভালোই। শুনলাম বদলি নেওয়ার চেষ্টা করছো?নত দৃষ্টি অখিলেশের।

হুম।তবে বদলি নয় চাকরীটাই ছাড়ছি।একটা বেসরকারি ব্যাংকে পরীক্ষা দিয়েছিলাম বাবার এক বন্ধু সেখানকার উর্ধ্বতন কর্মকর্তা,,হয়ে গেছে জবটা আমার।

নিরু এই চাকরি ছাড়ার পেছনের কারনটা কি আমি?নিরুর চোখে চোখ রাখে অখিলেশ।এই চির আকাঙ্খিত মানুষটার চোখে চেয়ে নিরু কি করে মিথ্যে বলবে যে,কারনটা একদমই সত্যি নয়। নিজের শালের কোনটা নখ দিয়ে খুঁটতে খুঁটতে বললো,,
আসলে মেয়েটা শহুরে পরিবেশে অভ্যস্ত তো তাই এখানে মানাতে পারছে না। আর মাকে তো জানো তিনি ও পারেন না এই আবহাওয়া সইতে।

আমার চোখে চেয়ে বলোতো কথাগুলো নিরু। আমি যদি তোমার এই সিদ্ধান্তের কারন হই তো আমিই সরে যাই তুমি ক্যানো?

নিরুর বুকটা হু হু করে ওঠে। কিন্তু তা ভেতরেই সীমাবদ্ধ।

তোমার চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।রিতি,রূপ ওদের কথা বলো শুনি।কথার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে নিরু।অখিলেশও আর এগোয় না ওদিকে।অযাচিতের মতো নিরুর জীবনে সে প্রবেশ করতে চায়না।উঠে দাঁড়ায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে। উঠোনে নামতেই নিরু ডাকে,,
একটু দাঁড়াও।এটা গায়ে জড়িয়ে যাও ঐ পাতলা শার্ট গায়ে ঘুরে বেড়ানোর মতো আবহাওয়া এখন নয়।দু বার না না করেও নিতে হলো শালটি।সেই ফাঁকে নিরুপমার হাতে নিজের হাত ছুঁয়ে যায় অখিলেশের। তাহলে আর মন্দ কি তবুও তো হলো ছোঁয়া ছুয়ি।
ও বাড়ি থেকে বেড়িয়ে নিরুপমার শালটি আর ঠান্ডা রোধ করতে পারেনি অখিলেশের কারণ সেটা এখন গুটি শুটি মেরে তার বুকে পরে আছে।নিরুর গায়ের গন্ধ জড়ানো শাল।সেও যে বহু আঁকা বস্তু।
****
রাতের খাবার খায়নি বিরূপাক্ষ।সেই দুপুরে রিতিদের বাড়ি থেকে এককাপ চায়ের সাথে দুটো বিস্কুট খেয়ে এসেছিলো।বিনুদা খাবার বেড়ে দিয়ে কয়েকবার সেধে গেছে, কাজ হয়নি তাতে।শশীশেখর বাবু ডেকেছিলেন কিছু কথা বলার জন্য।না করতে পারেনি বিরূপাক্ষ, উনার মধ্যে সে নিজের দাদুর ছায়া দেখতে পায়। তাছাড়া গতরাতে বলা অখিলেশের শেষ কথাটা,মনোবীণার কোথাও যেনো আবছা কিছু টুংটাং আওয়াজ তুলেছিলো।
রিতির সাথে দেখা হয়েছিলো আজ।একদম ভেঙে গিয়েছে চেহারা টা।দেখে মনে হবে কতদিনের মুমূর্ষু রোগী সে,, কিন্তু কথাবার্তায় মনেই হলো না ঘটে যাওয়া ঘটনাটা তার মধ্যে কোনো ভাঙন এনেছে।তাতেই বিরূপাক্ষের অন্তর জ্বালাটা দ্বিগুণ করে দিলো।
দাদুভাই এর সাথে কথা শেষ করে বিদায় নিয়ে যখন বেড়িয়ে আসছিল তখন রিতি বেরোলো নিজের শয়নকক্ষ থেকে,,, কোন ভনিতা না করেই বললো সে,,
কি গো রূপদা,, বাড়ি বয়ে এসে দেখা না করেই চলে যাচ্ছো যে? বিরূপাক্ষ থতমত খেয়ে গেলো, ও ভেবেছিলো রিতি বোধহয় সহসা সামনে আসবে না।

না আমি ভাবলাম তুই ঘুমোচ্ছিস তাই,,

ঘুম কি আর আমার রেখেছো?অত সহায় সম্পত্তি হাতছাড়া হয়েছে ঘুম আসে বলো? তীব্র ব্যঙ্গ শুনে বিরূপাক্ষ হতভম্ব।সুমিতা দেবী এগিয়ে এসে বলেন নিচু গলায়,,
ছিঃ মনি এমনে কইতে আছে?কিছু মনে কইরো না বাপ। জানোই তো মাইয়া ডা ক্যামন?ওরে নিয়া ঘড়ে বসায় কথা কও মা। দাঁড়ায় আছে পোলাডা।

রিতির ঠোঁটে শোভা পায় সম্পূর্ণ অবজ্ঞা ভরা হাসি,,কি বলো তুমি পিসি?দিনে দুপুরে পরপুরুষ নিয়ে ঘড়ে বসে কথা বলবো আমি? একেতো চরিত্রের মা বাপের শ্রাদ্ধ হয়ে গেছে আমার।মুখ দেখাতে পারবো আর?স্বামী পরিত্যক্তা কি না।শেষে বাপের ভিটা ছাড়তে হবে।

বিরূপাক্ষ অগ্নিদৃষ্টিতে তাকায় রিতির দিকে।সুমিতা দেবী অসহায়ের মতো একবার সে দিকে তাকিয়ে সরে যান। তিনি জানেন মেয়টা পাগল হয়ে সর্বনাশের খেলায় নেমেছে।এটাতো ওর মনের কথা নয়। মুখে যা আসছে তাই বলে যাচ্ছে?

ফোনের রিংটোন বেজে উঠতেই বিরূপাক্ষের চমক ভাঙে,,, বনলতার নম্বরটা জ্বল জ্বল করছে।দ্রুত রিসিভ করে কানে ঠেকায়।এখন তো এই কলটার তার ভীষণ প্রয়োজন ছিলো। কতদিন পরে বনলতা সিমটা অন করলো।
কয়েকবার হ্যালো হ্যালো করতেই ওপাশ থেকে বসে যাওয়া ফ্যাস-ফেসে গলায় শান্ত স্বরে ডাকলো,,, রূপ কুমার,,,,

চলবে,,,,,

ভুল ত্রুটি মার্জনীয়।
ভালো থাকবেন সবাই।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here