হিয়ার মাঝে-লুকিয়ে ছিলে,পর্ব:০৭

0
488

উপন্যার:হিয়ার মাঝে-লুকিয়ে ছিলে,পর্ব:০৭
কলমে: চন্দ্রা।

রূপ সবার জন্য তো কিছু না কিছু আনলি কিন্তু একজনকেই শুধু বাতিলের খাতায় ফেললি ক্যানো বলতো?এই কাজটা কিন্তু মোটেও উচিত হলোনা।(নিজের হাতের দামী আইফোনটা নেড়েচেড়ে দেখতে দেখতে কথা গুলো বলে উঠলো প্রদীপ)।
সদ্য স্নান সেরে খালি গায়ে টাওয়াল পরে ড্রেসিং এর সামনে চুল গুলো ব্যাক ব্রাস করছিলো বিরূপাক্ষ, বন্ধুর বাক্যে আয়নার প্রতিবিম্বটার ভ্রুদয় খানিক কুঁচকে আসে।

এইমাত্র বললি যে, বাতিলের খাতায় ফেলে দিয়েছি তো তার জন্য ক্যানো নিজের পকেট উজাড় করবো বল?সে তো আর আমার দেওয়া গিফটের আশায় হাত পা ধুয়ে বসে নেই তাইনা? নিজেকে ঠিকই গুছিয়ে নিয়েছে।
বিরূপাক্ষের ঝাঁঝের সাথে বলা কথা গুলো শুনেও প্রদীপের ক্যানো জানি ভালো লাগলো তাই আর দিরুক্তি করলো না।মনে মনে হাসলো শুধু কারন ওরা যখন রিতিদের বাড়িতে গিয়েছিলো তখন প্রদীপ লক্ষ্য করেছে রূপের অনুসন্ধানী চাহনিতে একটা আগ্রহ ছিলো, কিছু একটা দেখার আশায় এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলো বার বার।সেটা যে কি প্রদীপ তা ভালো করেই জানে।আরো নিশ্চিত হলো,যখন রিতির প্রতিবেশী এক দাদার ছয় বছরের ছেলেটা এসে সুমিতা দেবীকে বললো,ওদিদি,,, দিদি,, ভালো পিসি শউর (শশুর)বাড়ি থাইক্কা কবে আইবো?আমারে বড় মেলায় নিয়া বন্দুক কিন্না দিবো কইলো,,হের কি মনে থাকবো?
সুমিতা দেবী ছেলেটাকে নিয়ে রান্নাঘড়ে যেতে যেতে বলল,তোর পিসি কি কখনো কিচ্ছু ভুলছে?শশীশেখর বাবুর সাথে আলাপরত হাস্যোজ্জল রূপের হাসি টা দপ করে নিভলো যেনো।সুমিতা দেবীর দেওয়া চা,বিস্কুট ,নাড়ু,নিমকি কোনটাই মুখে তুললো না রূপ ।থমথমে মুখে বিদায় নিয়ে বেড়িয়ে পড়লো ঘড় থেকে রিতির কক্ষের দরজাটা খোলাই ছিলো সেখানে আলনায় ঝোলানো পুরোনো কাপড়গুলো ও দৃষ্টি এড়ালো না তার। রাস্তায় একটা কথাও হয়নি দু বন্ধুর মাঝে।

তোর গিফ্ট পছন্দ হয়েছে কিনা সেটা বল?বললো বিরূপাক্ষ।

পছন্দ তো হয়েছে কিন্তু এরপর রাতে ঘুম হবে কিনা কে জানে। নির্বিকার ভাবে বলে প্রদীপ।

ক্যানো ঘুম হবে না?অবাক হয়ে বলে বিরূপাক্ষ।
আরে বুঝলি না এত টাকার মোবাইল ফোন ঘড়ে রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমাই কিভাবে?
প্রদীপের রসিকতা ধরতে পেরে পিঠে একটা চাপর মেরে হেসে ওঠে বিরূপাক্ষ।

তুই আর বদলাবি না।
দুজনের হাস্য রহস্য চলে বেশ কিছুক্ষণ। এতদিন ফোনালাপ চললেও অন্তরঙ্গ বন্ধুকে কাছে বসিয়ে মুখের দিকে না তাকিয়ে কথা বললে কি মনের ভাব সেই ভাবে ব্যক্ত করা যায়? দুজনের কথার মাঝে ডাক পরে দুপুরের খাওয়ার জন্য।ডাইনিং টেবিলে ,বাবা,দাদা,মামাত ভাই অভি আগেই এসেছে। উপস্থিত সবাইকে দেখে মনটা ভালো লাগায় ভরে উঠলো বিরূপাক্ষের।আগে কোনদিন বাবা তাদের সাথে একসাথে উপস্থিত থাকতে পারতো না কাজের চাপে। সংসারে খুব কম সময় দিতেন তিনি।এই ব্যাপারটা বিরূপাক্ষ কে খুব কষ্ট দিতো কিন্তু কোনদিন কিছু বলেনি মুখ ফুটে । খুব চাপা স্বভাবের ছেলেদের যা হয় আরকি।প্রথম প্রথম মাকে ,রঘুদাদাকে এমন কি গ্রাম, গ্রামের বন্ধুদের ছেড়ে শহরে থাকতেও কষ্ট হতো কিন্তু কোনদিন বলেনি আমি শহরের জানযটপূর্ণ পরিবেশ ভালো বাসি না।আমি পল্লী মায়ের ধুলো কাঁদায় নিজের মায়ের কোলে থাকতে চাই। বন্ধুদের সাথে সারা গ্রামে দুরন্ত পনা করতে চাই। কিন্তু তা আর বলে উঠা হয়নি ,নিজেকে পরিবর্তন করে শহুরে ইট পাথরের মত কাঠিন্যে মুড়িয়ে নিয়েছে বিরূপাক্ষ।রঘুর স্বরে সম্বিত ফেরে,
কি হলো তোরা বসছিস না ক্যানো?কাজ ফেলে চলে এলাম একসাথে খাবো বলে।

চেয়ার টেনে বসে দুজন।কথায় কথায় খাওয়া চলছে হঠাৎ বিরূপাক্ষ বলে ওঠে জয়াকে,বৌদিদি, তোমাদেরকে দিদিমনি আসবে কখন।দুপুর তো গড়াতে চললো।তিতলি খাবে কখন।খাওয়া দাওয়ার পার্টটা কি স্কুলেই চলবে?

এত অস্থির হইও ভাই,আমি গনেশ কে দিয়ে ডাকতে পাঠিয়েছি তিতলি চলে আসবে এখনি।

ওহ্,,,

কি মেয়েরে বাবা, স্কুলে না গিয়ে ছাড়লো না।তবে দিদিমনির সাথে মিশে গিয়েছে অল্প সময়ের মধ্যেই।তিতলি মেয়েটা কিন্তু খারাপ না কি বলো ঠাকুর পো? প্রদীপের উদ্দেশ্যে কথাটা বললেও প্রতিউত্তর করলো অভি,
ঠিক বলেছো বৌদিদি।আমার সাথেইতো কি খাতির হলো কাল রাতে।কি জানি আমাকে আবার পছন্দ- টছন্দ করে ফেলে নাকি?আমি আছি মহা চিন্তায় বুঝলে বড়দাভাই?এত দিক একা কিভাবে যে সামাল দেই?
রঘুনাথ বিষম খায়।সামনে মামাবাবু বসে খাচ্ছেন। সবে অষ্টম শ্রেণীতে পড়া ঐটুকু একটা ছেলে মান ইজ্জত সব ডুবাবে ।জয়া ব্যতিব্যস্ত হয়ে জলের গ্লাসটা এগিয়ে ধরে রঘুর মুখের কাছে ‌প্রদীপ চোখ পাকায় অভির দিকে।প্রভাকর রায় চৌধুরীর খাওয়া প্রায় শেষ তিনি উঠে পরেন। জোয়ান জোয়ান ছেলেদের সামনে তিনিও যথেষ্ট অপ্রস্তুত। ছোট মানুষ কোথায় কি বলতে হয় বোঝেনা কিন্তু যাদের সামনে বলে তাদের লজ্জা, অস্বস্তির শেষ থাকে না।

প্রদীপ চোখ কটমট করে তাকালো অভির দিকে।অভি সেটাকে পাত্তা না দিয়ে একটুরো চিকেন মুখে পুরে বললো,সত্যিটা শুনলে সবারই একটু একটু হয় বুঝলে,,,এই যে, সুমিতা দিদিকে কি কেউ বলেছে প্রদীপদা আজকাল এদিক ওদিক,,,কথাটা শেষ হয়না তার আগে প্রদীপ বলে,বড়দা আপনি কি জানেন,ঐ যে ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী রূম্পা আছে না?আরে আমাদের বিরোধী দল করে ওর বাবা,
রঘুনাথ আগ্রহ নিয়ে তাকায়,হ্যা তারপর বল?
আমাদের অভি বাবু সেখানে, চকলেট,চুইংগাম,,, কথাটা আর বলা হয়ে ওঠেনা অভি এটো হাতে ঝাঁপিয়ে পরে প্রদীপের উপর,,
প্রদীপের সারা শার্টে অভির হাতের তেল মসলা চকচক করছে,সে বলছে, তুমি আমাকে ক্যারেক্টারলেস বানাতে চাও বড়দাভাই,বৌদিদির কাছে?আজই আমি বৌমনি আর সুমিতাদি র কাছে নালিশ করবো তোমার নামে তখন দেখো।জয়া এগিয়ে এসে অভির হাতটা টেনে ছাড়িয়ে বলে,ওকে খেতে দেনা ঠিকমতো।ও বলুকগে,আমরা কি বিশ্বাস করছি নাকি তার কথা।

হ্যা হ্যা বৌদিদি বিশ্বাস করোনা,,রূপ আমাকে দামী একটা ফোন গিফ্ট করেছে ওটা দিয়ে এক মাইল দূর থেকে তোমার সচ্চরিত্র অভি সোনার গার্লফ্রেন্ড সহ ছবি তুলে এনে দেবো তখন ঠাকুর ঘরে রেখে পূজো করো তোমরা দুই বৌ মিলে বুঝলে?দেখি একটু দই মিষ্টি দাও শেষ পাতে মিষ্টি মুখ করে উঠি। মেজাজ টা তো তেতো করে দিলো। বিরূপাক্ষ খাওয়া বাদ দিয়ে হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে।রঘুনাথ মানে মানে কেটে পরেছে আগেই।অভি অগ্নিচোখে প্রদীপের দিকে তাকিয়ে ফুঁসছে । বাড়ির কাজের ছেলে গণেশের সাথে উপস্থিত হয় তিতলি ,কি হলো অভি ডার্লিং এভাবে ধরে রেখেছে ক্যানো তোমাকে?আর চোখে ইঁটের ভাটা ক্যানো কোথায় আবার ইট কম পরলো?তিতলির ডার্লিং শব্দটা শুনে প্রদীপ আর বিরূপাক্ষ হইহই করে উঠলো,দেখলে বৌদিদি ,, তোমার অভিসোনা আজকাল বয়সের ফারাকটাও মানছে না।মুখটিপে হাসছে জয়া।অভির রাগটা কমে এসেছে তাকে ডার্লিং বলাতে ।মুখটাও ক্যামন লাজুক দেখাচ্ছে। বিরূপাক্ষ লক্ষ্য করে মজা পেলো,আজকালকার ছেলেমেয়েরা একটু বেশিই সেয়ানা হয়েছে।আর এটাও বুঝলো তার নিজের শূন্য জায়গাটা এখন অভি বাবুই দখল করেছে।বাড়ির ভেতরে এবং বাইরে আদর স্নেহ করার লোকের অভাব নেই শাসনের কথা তো মনেই আসেনা কারো।আদরে আদরে বড়সড় রকমের বাঁদরই হয়েছে।

তিতলি,স্নানটা সেরে খেয়ে নাও আগে সকালে তো কিছুই খেলে না।বললো জয়া।

কি ব্যাপার এসেই ভাব জমানো হয়ে গেছে দিদিমনির সাথে?তোরা মেয়েরা পারিসও বটে।টিটকারী করে বললো বিরূপাক্ষ।

যারা মিষ্টভাষী,সদালাপি তাদের সাথে ভাব জমাতে হয়না জমে যায় বুঝলি হিংসুটে? দারুন চমৎকার মেয়ে ওই ম্যাডাম,, আহা,না মিশলে বুঝবি না,,বয়সে কত ছোট আমার চেয়ে অথচ মেলা মেশায় কোন সংকোচ,জড়তা নেই। আমার আসতে ইচ্ছে করছিলো না কিন্তু সে জোর করে পাঠিয়ে দিলো। খুব ভালো স্কুল তোদেরl(মুগ্ধতায় চকচক করছে তিতলির হালকা বাদামি চোখের মনি জোরা)

গতরাতের আচারণ গুলো মনে পরতেই বিরূপাক্ষ বলে ওঠে,বেশি মাথায় তুলিস না, কথায় কথায় জ্ঞান দেবে,প্রাইমারীর দিদিমনি কিনা?

তুই আসলে দিন দিন রসকষহীন ডিসগাস্টিং হয়ে যাচ্ছিস।
যা বাবা,,আমি কি এত বললাম?
যেতে যেতে ফিরে তাকায় তিতলি,চোখ মুখ কুঁচকে বিরূপাক্ষের প্রতি একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে পুনরায় হাটা ধরলো গেস্টরুমের দিকে।

পিতার সামনে নত মস্তকে বসে আছে বিরূপাক্ষ। প্রভাকর রায় চৌধুরী সময় নিয়ে কথা গুছিয়ে নিতে ব্যাস্ত। অতঃপর নিজের গাম্ভীর্য বজায় রেখে বললেন,তা তোমার পড়াশোনা শেষ হলো?

হ্যা বাবা।সে তো আরো আগেই হয়েছিলো।

এখন কি ভাবছো তাহলে?কি মনে করে দেশে ফিরলে?টাকা পয়সা তো সেখানেই ভালো রোজগার করছিলে।

পিতার কথায় গভীর অভিমানের আভাস টের পেয়ে ও কিছুটা মনক্ষুণ্ণ হলো বিরূপাক্ষ।উনারা কোনোদিনও তার মন বুঝার চেষ্টা করলো না।

বাবা তুমি ভূল বুঝছো আমাকে।আমি কখনো বলিনি টাকা রোজগারের জন্য বিদেশে পরে থাকার কথা। আমিতো শুধু আমার স্বপ্ন পূরনের জন্য বিদেশে পাড়ি জমিয়েছি।
বাহ্ বেশ বললে তো!স্বপ্ন পূরণের জন্য? কিন্তু নিজের স্বপ্ন চরিতার্থ করার জন্য স্বপ্নরথের চাকা যদি অন্যের স্বপ্নকে পিষ্ট করে ধুলোয় মিলিয়ে দেয় তাকে তুমি কি নাম দেবে?(ক্রমশ উত্তেজনা প্রকাশ পাচ্ছে তাঁর কথায়)
বাবা আমি যখন কাউকে স্বপ্ন দেখতে বলিনি তখন কারো স্বপ্ন ভঙ্গের দ্বায় ক্যানো নেবো বাবা?আর সেদিন জেদের বশে আমার সাথেও অন্যায় কম হয়নি।(দৃঢ় স্বর বিরূপাক্ষের)

তোমার মতে, সন্তান জন্মদানের পর খাইয়ে পড়িয়ে আদর স্নেহ দিয়ে বড়ো করলেও তাকে নিয়ে কোন স্বপ্ন বাবা মা দেখতে পারবে না?
বাবা আবারো ভুল বুঝছো।আমি সেটা বলতে চাইনি

থাক আমাকে অতটা বিশ্লেষণ না করে বুঝালেও চলবে। আমি এখনো অতটাও অক্ষম মস্তিষ্কের মানুষ হইনি যে, তোমার কথার মর্মার্থ বুঝতে পারবো না। একদিন ঠিকই বুঝতে পারবে বাবা মা যে সিদ্ধান্ত সন্তানের জন্য নেয় তা কখনো ভুল হয় না।তবে একদিন কিন্তু অনেক কিছুর জন্যই হাহাকার করবে,যা আজ পায়ে ঠেললে।

বাবা,,আমি,,

থাক এখন এসো তুমি।আমি একটু বিশ্রাম নেবো। কিছুক্ষণ বিমূঢ়ের মতো বসে থেকে বিরূপাক্ষ আসছি বলে বেরিয়ে যায় ঘড় থেকে।সেই ছোট্ট বেলা থেকে দেখে আসছে তার বাবা কোনো কারনে রেগে থাকলে এভাবেই হাত উঁচিয়ে বলবে থাক,,এর পরে কেউ হাত পা ধরে কাঁদলেও তিনি আর একটি বাক্যও না শুনবেন আর না বলবেন। নিজের স্বপ্ন সফলের উদ্দেশ্যে এবং অনর্থক জেদের বশে অনেক কষ্ট দিয়েছে মা বাবাকে ।আর দিতে চায়না। দরজার বাইরে মায়ের সাথে দেখা হলো, ছেলেকে দেখেই তিনি চোখের জল মুছলেন।বিরূপাক্ষের দৃষ্টি এড়ায়নি সেটা,
তিনি অভিমানী সুরে বললেন,খোকা, যে মেয়েটাকে তুই সাথে করে এনেছিস তোর বাবা সহ্য করতে পারছে না তাকে।

বিরূপাক্ষ নিজের দিক সমর্থন করে বলে,মা তোমরা যেটা ভাবছো সেটা নয়।তিতলি শুধু মাত্র আমার ভালো বন্ধু। বিশ্বাস করো মা।

সেটা পুনরায় ফিরে পেতে দেরী হবে বাবা!

তরিতে নিজের ঘড়ে প্রবেশ করেন অন্নপূর্ণা দেবী। বিরূপাক্ষ সেদিকে তাকিয়ে সর্বস্ব হারানো দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে নিজের ঘড়ের দিকে চলতে থাকে।মা,বাবা, দেশ ছেড়ে সেও যে খুব সুখে দিন কাটাতে পারেনি সেটা বুঝাবে কে উনাদের?আজ সকালে নিজের পূর্ব কৃত কর্মের জন্য শশিশেখর বাবুর কাছে ক্ষমা চাওয়ার উদ্দেশ্যে ই ওবাড়িতে গিয়েছিলো কিন্তু ঐ আগন্তুক বাচ্চা ছেলেটার মুখে রিতির শশুরালয়ে গমনের কথা শুনে হঠাৎ করেই ভীষণ রাগ এসে জমা হল নিজের মধ্যে।ক্যানো হলো সেটাও বুঝতে অপারগ বিরূপাক্ষ।সেতো চেয়েছিলো রিতি তাকে মনে না রেখে নতুন করে জীবন শুরু করুক। কিন্তু আজ ক্যানো এতটা খারাপ লাগলো তার?রাগটা কার উপর ঠিক ঠাহর করতে পারল না সে।

নিজের ঘড়ে প্রবেশ করার আগে পাশের দরজার অন্তরালে নিচু স্বরে কথা শুনে দাঁড়িয়ে পরে সে।ভালো ভাবে কিছুই শোনা যাচ্ছে না তাই ভেজানো দরজা টা হালকা খুলে উকি দিয়ে দেখলো।সেই দিদিমনি চোখ মুখ কুঁচকে ঠোট কামড়ে বসে আছে বিছানায়।ধবধবে ফর্সা হাঁটু পর্যন্ত শাড়ি গোটানো।বৌদিদি হাঁটুতে কিছু একটা লাগাচ্ছে।মাথাটা ঝিমঝিম করে ওঠে বিরূপাক্ষের একঝটাকয় নিজের মাথাটা ঘুড়িয়ে নেয়।দেশে, বিদেশে অনেক খোলামেলা পোশাকে মেয়েদের দেখেছে সে কিন্তু এমন ঝিমঝিম করা ব্যাপারটা এর আগে ঘটেনি।বৌদিদি বলছেন,এমন দশা হয়েছে হাঁটুর আর সেটা নিয়ে টইটই করে ঘুরে আসলি?তোর কি জানে পরাণে দুঃখ কষ্টের অনুভূতি নেই?কাল ক্যানো বলিসনি?তাহলে এমন ফুলে উঠতো না।গায়ে জরটাও আসতো না।
বিরূপাক্ষ যা বুঝার বুঝে নিয়েছে‌ দিদিমনিকে বাড়ির সবাই ভালোই কদর করে তাহলে।কি এমন মহিয়ষী কন্যা যে, বাড়ির সবাই গদগদ তাকে নিয়ে?

সোফায় বসে ল্যাপটপে বিরূপাক্ষের করা টপ লেভেলের বিভিন্ন ডিজাইন গুলো দেখছিলো প্রদীপ।বিরূপাক্ষকে চিন্তাযুক্ত হয়ে রুমে প্রবেশ করতে দেখলো।
বিরূপাক্ষ কোনো কথা না বলেই বিছানায় চিৎ হয়ে মাথার পেছনে দুহাত রেখে শুয়ে পরলো দৃষ্টি নিবদ্ধ উপরের হালকা গোলাপী দেওয়ালে। হাঁটু পর্যন্ত ঝুলছে খাটের নিচে।প্রদীপ ল্যাপটপ রেখে উঠে এসে বিরূপাক্ষের পাশে শুয়ে পরে ঠিক ওর ভঙ্গিতে।

তোর কাছে আমাদের পারিবারিক ডাক্তারের ফোন নম্বর আছে?

ক্যানো?কি হয়েছে?

ঐ যে তোদের ম্যাডাম আছে না?আরে দিদিমনি তার শরীর খারাপ।আসতে বলবো ড: কে।বেড়াতে এসে যদি অসুস্থ হয়ে পরে। আমাদের একটা দায়িত্ব আছে তো নাকি?

প্রদীপের মুখে মুচকি হাসি।
একটা সত্য কথা বলবি রূপ?

বলনা।এতো বাহানা শিখেছিস তুই?

তোর কি রিতির কথা একবারও মনে পরেনি?দেখার ইচ্ছা জাগেনি কখনো?সত্যি বল।

না মনে পরেনি।দেখার ইচ্ছা জাগেনি আর জাগবেও না।কাট কাট জবাব দেয় বিরূপাক্ষ।

ওহো তাই?তাহলে আজ সকালে তার শ্বশুর বাড়িতে থাকার কথা শুনে ওভাবে উঠে আসলি ক্যানো?আর ওর রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে তুমি ফার্নিচার দেখছিলে?আমি কিছুই বুঝিনি ভেবেছো?ও যদি অন্য কোথাও থেকে সুখে থাকে তাহলে তোর এত জ্বলার কথা না তো।

এই তুই থামবি?এসব কথা বললে কিন্তু বের হয়ে যাবো ঘড় থেকে।

তোর ঘড় থেকে তুই ক্যানো যাবি।আমিই যাচ্ছি‌। বিরূপাক্ষ হুট করে তাকিয়ে কিছু বুঝতে চেষ্টা করেই প্রদীপের বুকের উপর উঠে পরলো, আবার অভিমানো শিখে গেছিস তুই?সুমি তাহলে ট্রেনিং ভালোই দিয়েছে তাইনা?

তোরা ভাইগুলো সবি এক। তোদের মুখে আমার সুমির নামটা এতবার আসে ক্যানো রে? তোদের তো দেশে বিদেশে হিনা,মিনা,টিনার অভাব নেই।তাদের রেখে আমার সুমির নাম জপছিস ক্যানো?

নাম নিলে ট্যাক্স দিতে হবে নাকি?
বিরূপাক্ষ প্রদীপের পেটে কাতুকুতু দিতেই প্রদীপ ব্যাঙের মতো লাফাতে শুরু করে, সুরসুরি দিয়ে মেরে ফেলবি নাকি?ছাড়নারে ভাই।
মেয়েদের মতো এমন করবি আর ?

প্রদীপ দাদা, খাবে নাকি আম মাখা?অভিকে আসতে দেখে উঠে বসে দুজনে। প্রদীপ বিরূপাক্ষ কে ফিসফিসিয়ে বললো মজা দ্যাখ,,ও কিন্তু আমার মোবাইলটা দেখবে বলে এসেছে এখন খাতির জমানোর চেষ্টা।

কিরে এই অবেলায় আম মাখা?খাওয়ার আর সময় পেলিনা?

এই অসময়ে কাঁচা আম কোথায় পেয়েছিস? প্রশ্ন করে বিরূপাক্ষ।

বৌমনি এনেছে কোথা থেকে? জানিনা।খেতে খেতে বললো অভি। প্রদীপ একটুকরো তুলে মুখে পুরে নিলো।
বিরূপাক্ষ হঠাৎ সচকিত হয়ে জিজ্ঞেস করল,এই তুই বৌমনি বললি কাকে?তখনো বললি বৌমনিকে নালিশ করবি?কে তোর বৌ মনি?
প্রদীপের মুখের আমটা যেনো গলায় আঁটকে আসে।
অভি খাওয়া বাদ দিয়ে হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে।যেনো জীবনের প্রথম জোকস্ শুনলো।
আশ্চর্য এমন ভাবে হাসছিস ক্যানো আমি কি এমন বললাম ?বউমনি কাকে ডাকিস?

ছোটদাভাই তুমি এতো বড়ো হয়েও বোকা আছো?দাদাভাইয়ের বৌ যদি আমার বৌদিদি হয় তাহলে ছোটদা ভাইয়ের বৌ আমার কি হবে?বৌমনিইতো না কি?

বিস্ময়ের শেষ সীমানায় পৌঁছে বিরূপাক্ষ নিজের বুকে তর্জনী ঠেকিয়ে বললো ছোটদাভাই মানে আমি?
এই অভি নে আমার ফোনে দু রাউন্ড গেম খেলে দিয়ে দিবি কিন্তু।নে নিজের ঘড়ে যা ভাইডি।অভির আর কি চাই ?না চাইতেই যখন কাঙ্খিত বস্তুটি পাওয়া যায়।আমের বাটিও নিলো না একছুটে বেরিয়ে গেলো ঘড় থেকে।

থম মেরে বসে আছে বিরূপাক্ষ।সকালে মনে অন্যরকম টানাপোড়েন চলছিলো ছেড়ে সম্পর্ক ভাঙার শব্দে।আর এখন বুকটা ঢিপঢিপ করছে অবশেষে থেকে না যায় তার সম্ভাবনাময় আশঙ্কায়। আসন্ন ঝড়ের আশঙ্কা নৃত্য করছে প্রদীপের মনে।
বিরূপাক্ষ ভাবলেশহীন ভাবে বললো, কোথায় আছে সে?এখনো যোগাযোগ রাখে এবাড়ির সঙ্গে?
প্রদীপ নিরুত্তর।

কি হলো বল কোথায় সে?তুই যদি বলিস তাহলে ভালো না হলে আমার কথা অবমাননা করার ফল ওকে ভোগ করতেই হবে। কোথায় লুকিয়ে আছে বল,,হালকা চিৎকার করে উঠল বিরূপাক্ষ। প্রদীপের লুকোচুরি খেলতে ভালো লাগে না,,

লুকিয়ে থাকবে ক্যানো সেতো তোর পাশের ঘড়েই আছে জানিসনা?দেখা হয়নি তোর সাথে?চিনিসনা তাকে?
চক্ষু বিস্ফোরিত হয়ে অবুঝের মতো বললো বিরূপাক্ষ,,, পাশের ঘড়ে মানে?? ওখানে তো,,
হ্যা ওখানেই তোর চিরশত্রু ইদানিং আস্থানা গেড়েছে।ত্ররিতি দিদিমনিই তোমার একসময়ে বিয়ে করে ছেড়ে যাওয়া বৌ!সে এই সাত বছরে একটা দিন ও এবাড়ির চৌকাঠ ডিঙিয়ে ভেতরে আসেনি।এই প্রথম।তোর কথার অবমাননা সে করেনি। তোর উপর কোনো দাবীও সে করবেনা হয়তো।
বীরূপাক্ষের সবকিছু ক্যামন ধোঁয়াশা লাগছে।এটা কিভাবে সম্ভব?সেই ছোট ছোট চুলের ,ময়লা গাত্র বর্ণের টিং টিংয়ে দেহের কিশোরী মেয়েটা এখন কার পূর্ণ যুবতী, পূর্ণ চাঁদের আলোর মতো মনোহারিনী রুপের অধিকারী হয়েছে?

বেশ রাত,আজ বিরূপাক্ষের কক্ষ থেকে টেপ রেকর্ডার এ কোন গানের সুর লহরী ভাসছে না। মধ্যরাতের কফির তৃষ্ণাটাও নেই ‌তার।মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে।কারনটা অজানা তার।
মন খারাপের সঠিক কারনটা না জানাও একধরনের বিষময় যন্ত্রনা।স্টাডি টেবিলে আঁখি মুদে বসে আছে। দরজায় টোকা পরায় বিষন্নতার ঘোর কাটে তার।
দরজা খোলা আছে। সংক্ষিপ্ত জবাব দেয় বিরূপাক্ষ।কফির মগ হাতে ধীরপায়ে প্রবেশ করে রিতি।বিরূপাক্ষের কাছে এগিয়ে গিয়ে বললো মৃদু স্বরে, আপনার কফি।
এক ঝটকায় চোখ খোলে বিরূপাক্ষ।সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রমনীর দিকে একবার তাকায়।কফির মগটা নেওয়ার কোনো সম্মভাবনা দেখা যায় না তার মধ্যে। নিঃশব্দে কফির মগটা টেবিলের উপর রেখে পেছন ঘুরে পা বাড়ায় রিতি। দরজার কাছে যেতেই তীক্ষ্ণ স্বরে ডেকে ওঠে ,,এই দাঁড়া,,
রিতি থমকে দাঁড়ায়,,এমন কর্কশ গলায় তো কাক ও ডাকে না।
ওখান থেকেই প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় বিরূপাক্ষ,,কাল ক্যানো নিজের পরিচয় দিসনি?

পরিচয়টা কি আপনার জন্য সুখকর হতো?নাকি আপনার কানে মধু ঢালতো।(নিচু স্বরে বলল রিতি)
রিতির উত্তরে যে হুল ছিলো তাতেই বিরূপাক্ষের মেজাজ চরে যায়,,
এবাড়িতে ক্যানো এসেছিস তুই?তোকে তো মুক্তি দিয়ে গিয়েছিলাম।তার পরেও আমার আসার খবর শুনে এসে গেড়ে বসেছিস?আমাকে সেবা করা হচ্ছে?রাত দুপুরে একটা পুরুষের ঘড়ে ঢুকে তাকে কফি দিস লজ্জা,ভয় নেই তোর?

রিতির কানে যেনো কেউ গরম সীসা ঢালছে এমন অনুভূতিতে সমগ্র দেহ ঘৃনায় রি রি করে ওঠে। এমনিতেই মাথাটা যন্ত্রনায় ছিঁড়ে যাবে বোধহয়।
আপনি জানেন না আমি ক্যানো এসেছি? আগেরবার তো দু লক্ষ টাকার চেক দিয়ে গিয়েছিলেন ওতে এ যুগে কিছু হয়?এবার বিদেশ থেকে ইনকাম করে ফিরলেন ,তাইতো রাত বিরেতে রূপ দেখিয়ে পাগল করার চেষ্টা করছি যদি দুই কোটি বাগাতে পারি তো সারাজীবন পায়ের উপর ঠ্যাং তুলে আরাম আয়েশ করে কাটিয়ে দিতে পারবো।
এমন বেহায়ার মতো উত্তর শুনে বিরূপাক্ষ হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে এগিয়ে গিয়ে রিতির একটা হাতে পিঠের দিকে মুচড়ে ধরে।রিতি ব্যাথায় অস্পষ্ট গোঙানির মত আওয়াজ করে ওঠে। দাঁতে দাঁত পিষে বলে বিরূপাক্ষ,এত কথার খই ফুটাস তুই কার সামনে হ্যা?আমি কে সেটা মনে রেখে যা বলার বলবি নইলে ফল ভালো হবে না।

ছাড়ুন আমাকে।লাগছে আমার।রিতির কাতর স্বরে সম্বিত ফেরে বিরূপাক্ষের। হাতের বাঁধন শিথিল হতেই এক ছুটে নিজের রুমে বিছানার উপর হুমরি খেয়ে পরে রিতি।

চলবে,,,,
ভুল ত্রুটি মার্জনীয়।
ভালো থাকবেন সবাই।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here