হিয়ার মাঝে-লুকিয়ে ছিলে১০,১১

0
450

উপন্যাস: হিয়ার মাঝে-লুকিয়ে ছিলে১০,১১
কলমে: চন্দ্রা।
পর্ব :১০

বাজলো তোমার আলোর বেণু ,,,,,,

সেই ভোর রাত থেকেই চৌধুরীদের মন্দিরে সাউন্ড বক্সে ফুল ভলিউমে বেজে চলেছে মহালয়ার সুর।সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বারো মাসে তেরো পার্বণ রীতি চালু থাকলেও তন্মধ্যে শারদীয়া দূর্গোৎসবই সর্ব শ্রেষ্ঠ। মহালয়ার মধ্য দিয়ে আরম্ভ হয়ে সে আনন্দের রেশ থাকবে আসছে বৎসর পর্যন্ত।আসলেই আলোর বেণুই বাজবে ধরণীতে। এর আগে কখনো এমন হই হই রই রই ভাবে মহালয়া কেউ শোনেনি এবাড়িতে।রিতিই সবার আগে ঘুম থেকে উঠে অভি রাজের ঘুম ছুটিয়ে মন্দিরে পাঠিয়েছে সাউন্ড সিস্টেম অন করতে।সে বেচারা এখন সবার সাথে ড্রইং রুমের সোফায় বসে ঢুলছে।রিতি আছে মহানন্দে। রঘুনাথ কাল উপজেলার একটা মিটিং এবং অন্যান্য দরকারি কাজ সেরে প্রায় শেষ রাতের দিকে ঘুমিয়েছে।রিতি গিয়ে তাকেও টেনে তুলেছে কম্বলসহ।রঘুনাথের কোন আপত্তি বিপত্তি ধোপে টেকেনি যখন রিতি বললো, দাদাভাই এই একটি বছরই তো সবাই একসাথে বসে মহালয়া শুনবো।
আসছে বছর যদি এ সুযোগ না মেলে তবে কিন্তু আফসোস করবে বলে দিলাম। তারচেয়ে ভালো হয় ভালোয় ভালোয় বসার ঘড়ে চলে এসো।

রঘুনাথ অনেক কষ্টে দুচোখের চারটি পাতা আলাদা করে করুন দৃষ্টিতে তাকায় রিতির দিকে,,
বুড়ি ,, শেষ মেশ তুইও ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করা শুরু করলি?তুই?

রিতি হুট করে উঠে দাঁড়ায়,
সে তুমি যা ভাববার ভাবোগে আমি গেলাম। ইচ্ছে হলে এসো না হলে শুয়ে পরো আমি কম্বল চাপা দেই।
বললো ঠিকই কম্বল চাঁপা দেই কিন্তু দরজাটা হা করে খুলে রেখে আপন গতিতে বেড়িয়ে পড়লো।

রিতি ঘুম থেকে তুলে দিয়ে গিয়েছে আর রঘুনাথ পুনরায় ঘুমোবে এমনটা তো সম্ভব ই না। অগত্যা আড়মোড় ভেঙে উঠতেই হলো।
পুরো বাড়িতে এখন একটি মানুষই শুধু ঘুমিয়ে আছে কারন তার ঘুম ভাঙানোর দ্বায় রিতির নেই।তিতলিও ব্যপারটা বেশ উপভোগ করছে।সেই ছোট বেলায় ইন্ডিয়া থেকে আনা রানীগোল্ডের বড়ো রেডিওতে বাড়ির সবাই যখন মহালয়া শুনতো ও তখন কাঁথার তলায় ঘুমহীন কাঁচুমাচু হয়ে শুয়ে ভাবতো এবার পুজোয় কি কি কিনবে আড়ং থেকে।অনেক বছর এই আনন্দের ভাগীদার হয়না সে। চুলোয় চায়ের জল চাপিয়ে সরলা পিসিকে বসার ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছে রিতি,,
সবাই বিভোর হয়ে শুনছে মহালয়া।এমন ভাবে পরিবারের সবাইকে নিয়ে মহালয়া শুনা হয় না অনেকদিন।মা গো তুমি এইভাবে আমার সংসারটা ভরিয়ে রেখো সবসময়। মনে মনে কথাগুলো আওড়ে কপালে জোর হাত ঠেকান অন্নপূর্ণা দেবী।
ভোরের আলো ফুটতে আর কিছু মূহুর্ত বাকী।রিতি ট্রেতে করে চায়ের পেয়ালা এগিয়ে দিচ্ছে সবাইকে।প্রভাকর চৌধুরী তাকে টেনে বসালেন নিজের পাশে।হাসি মুখে বললেন,সেই মাঝরাত থেকেই তো ছোটাছুটি শুরু করেছিস।বোস না একটু শান্ত হয়ে।রিতির আর উপায় কি ?বসতেই হলো বাধ্য মেয়েটির মতো।
********
কফির মগ হাতে নিয়ে বিরূপাক্ষের শয়নকক্ষে ঢুকলো রিতি।খালি বিছানা পরে আছে বিছানার মানুষটা নেই।ওয়াশরুম থেকে জল পরার শব্দে নিশ্চিত হলো রিতি ফুল বাবু স্নানে আছেন।বেড সাইড টেবিলে কফির মগটা ঢাকা দিয়ে রেখে হাত লাগালো এলোমেলো বিছানায়। বিছানা গুছিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে সবে বাঁ হাতে হ্যাচকা টানে বুকটা কেঁপে উঠলো রিতির।সামনে বিরূপাক্ষ দাঁড়িয়ে,খালি গায়ে মুক্ত দানার মতো বিন্দু বিন্দু জল চিক চিক করছে কালো পশমাবৃত প্রশস্ত বক্ষে।পরনে সফেদ রঙা তোয়ালে। একজনের নিঃশ্বাসের শব্দ অন্য জনে শুনতে যতটুকু ব্যবধানের প্রয়োজন ঠিক ততটাই দূরত্ব ওদের মাঝে।
রিতি বিমুঢ় বিমোহিতের মতো কিছুক্ষণ দেখতে থাকে বিরূপাক্ষের নগ্ন বক্ষ এবং ললাটের উপরিভাগে লেপ্টে থাকা হালকা জলযুক্ত কেশরাশি গুলো।মনে বড় সাধ জাগে নিজের আঁচল দিয়ে মানুষটার আদ্র চুল গুলো শুষ্ক করে দিতে।
ঘোর কাটতেই অদৃশ্য ভাবে জিভকাটে রিতি নিজের বেহায়া মনে বেশরম সাধ জাগার জন্য।হাতটা টান মেরে ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই অপরপক্ষের ঘোর কাটল।
বিরূপাক্ষ যখন ওয়াশরুমের দরজা খুলে বের হলো তখন হঠাৎ করেই থমকে গিয়েছিলো এক অসীম মুগ্ধতায়।সামনে একটু ঝুঁকে বিছানা চাদর ভাঁজ করে গুছিয়ে রাখছে রিতি।ভেজা একঢাল দীঘল কালো চুল হাঁটু ছাড়িয়ে আরো নিচে ছড়িয়ে আছে।সদ্য পাটভাঙা লালপেড়ে গাঢ়ো নীল শাড়ির আঁচল গড়াচ্ছে মেঝেতে। হাতের নড়াচড়ার তালে যখন আঁচল সরে মেদহীন ফর্সা পেটের খালি অংশটা দেখা গেলো তখন বিরূপাক্ষের নির্লজ্জ দৃষ্টি আটকে গিয়েছিলো সেখানে।সমগ্র দেহে এক অজানা অনুভূতির দোলাচল। কিন্তু মোহ সবার বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। অনেকের সংযম ক্ষমতা অনেক বেশি থাকে।বিরূপাক্ষকে সে দলে ফেলে দেওয়া যায় নির্বিবাদে।নিজেকে সংযত করতে গত রাতের অপমানের কথাটা মনে করলো বারংবার তারই ফলশ্রুতি হাত ধরে হ্যাচকা টান। কিন্তু পেছনে দেখে যে মোহাচ্ছন্ন হয়ে যায় সামনে দেখে সে নিজেকে সামলাবে কি করে।
কি হলো হাতটা ছাড়ুন। কথায় কথায় হাত ধরা এসবের মানে কি হ্যা?
রিতির নিচু স্বরে কড়া বাক্যে মুগ্ধতা কেটে গিয়ে গত রাতের উষ্মা ফিরে এলো বিরূপাক্ষের মনে,,
অনাত্মীয় পুরুষের ঘড়ে দিনে রাতে এভাবে রুপ দেখিয়ে বেড়ালে সেতো একটু আধটু সুযোগ নেবে,কে বলেছে এসব করতে?

হাতটা আগে ছাড়ুন। আমার লাগছে। আপনাদের খাচ্ছি, আপনাদের পরছি এটুকু কাজ করতে পারবোনা?

না আমার আশে পাশে এভাবে ঘুর ঘুর করা যাবে না।এতে আমার মন গলবে না।বৃথা কষ্ট করে লাভ নেই।
রিতি গতকাল রাতে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে কটা দিন আছে এখানে বিরূপাক্ষের সাথে কোন দুরব্যবহার করবে না। আপোষে সবকিছু কন্ট্রোল করে নেবে। শুধু শুধু বিবাদ বাড়িয়ে কি লাভ তাতে যে এক সাথে কাটানো সল্প সময়ের স্মৃতিটুকু ও সুখকর হবে না।তাই বিরূপাক্ষের ক্ষোভপূর্ণ কথার জবাবে মৃদু হেসে বললো,,,

কি ব্যাপার হ্যা,,,আশে পাশে ঘুরঘুর করলে ধরা পরে যাবেন সেই ভয় পাচ্ছেন?ভয় পাবেন না।আমি ছেলেধরা নই।

রিতির হাসি বিরূপাক্ষের কাছে চরম ন্যাকামি মনে হলো,

আর কখনো আমার ঘড়ে ঢুকে এসব করার চেষ্টাটাও করবি না। ভালো ভাবে বলে দিলাম না শুনলে আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না।চোখ দুটো অগ্নিবর্ণ করে বললো বিরূপাক্ষ।রিতিও সে চোখে চোখ রেখে দৃঢ়তার সাথে বললো,,
আমার যা কর্তব্য আমি করবো, পারলে ঠেকান।
বিরূপাক্ষ সজোরে রিতির হাতটা ছুড়ে মারতেই সে টাল সামলে বসে পরলো বিছানায়। এককোণে গুছিয়ে রাখা কম্বল বালিশ এলোমেলো করে ছুঁড়ে মারলো রিতির মুখে,,,

এরকমই হবে বুঝলি?আর কখনো আমার সাথে বৃথা স্পর্ধা দেখাবি না।ভালো কথা শোনার মেয়ে নোস তুই ।তাহলে এভাবে আমার পেছনে পরে থাকতি না।
রিতি আর একটা কথাও বলেনি। একছুটে মুখে কাপড় গুঁজে বেরিয়ে যাওয়ার সময় খেয়ালই করেনি আরো কেউ একজন সমব্যথি হয়ে দরজার বাইরে দেয়ালে লেপ্টে দাঁড়িয়ে আছে ছলছল নয়নে।
রিতি প্রস্থান করতেই বিরূপাক্ষ দুহাতে মুখ ঢেকে বসে পরেছে বিছানায়।মনটা অশান্ত হয়ে উঠেছে।মেয়েটাকে কষ্ট দিলে তার এমন হচ্ছে ক্যানো এটাই বুঝতে পারছে না।একটু বুঝি বেশিই করে ফেললো। বিছানায় কিছু রাখার শব্দে চোখ তুলে তাকালো বিরূপাক্ষ।পালঙ্কের একটা পায়া ধরে দাঁড়িয়ে আছে জয়া। চোখের নিচে সদ্য মোছা জলের দাগ দেখে অবাক হয় বিরূপাক্ষ,,

কি হয়েছে বৌদিদি?ব্যতিব্যস্ত হয়ে প্রশ্ন করে।

ভাই,বৌদিদির মুখটা একটু ম্লান দেখেই ভাবনায় পরে গেলে?আর যে মনের মধ্যে ব্যাথা নিয়ে সবার সাথে হেসে খেলে বেড়ায় তার ব্যাথা বুঝলে না?একটা অনুরোধ করি তোমাকে,মেয়েটাকে ভালো বাসতে না পারো কষ্ট দিওনা তাহলে যে ভগ্নাংশটুকু দেখছো না?সেটুকুও আর অবশিষ্ট থাকবে না।

বিরূপাক্ষকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই দ্রুতপদে বাহিরে চলে যায় জয়া। বিরূপাক্ষ জয়ার বলা কথাগুলো উলোট পালোট করে নিজের মনে। সামনের টেবিলে ঢেকে রাখা কফির মগটা তুলে নিয়ে আনমনে একটা চুমুক দিয়ে বিতৃষ্ণায় চোখ মুখ কুঁচকে থু থু করে ফেলে দেয় ভেতরের তরল পদার্থটুকু।
এটা কি কেবল কফির বিস্বাদ নাকি মনের অবসাদ মিলে মিশে একাকার হয়েছে কে জানে?

বৌমনি,ও বৌমনি শুনেছো কি হয়েছে?
অভি তার ক্যারকেরে গলা বাজাতে বাজাতে ঢুকলো রিতির শয়নকক্ষে।রিতি কিছুক্ষণ আগের আঘাতটা সামলে নিচ্ছিলো।অভির উপস্থিতি টের পেয়ে ভালো করে চোখ মুছে মিথ্যা হাসির ফোয়ারা ছুটিয়ে বললো,,
কি নিউজ বয়ে এনেছে আমাদের অভি বাবু?

ছটদাভাই সেদিন বললো বিদেশ থেকে আমাদের জন্য নাকি কিছুই আনেনি।অত বড়ো বড়ো লাগেজে শুধু নিজের জামাকাপড় এনেছে বলেছিলো আমার অবশ্য সন্দেহ হয়েছিলো।সেটাই ঠিক হলো দেখলে?

অভির কথার ধরনে অনেকক্ষণ পরে মন থেকে হাসি পেলো রিতির।সেও একটু ভাব নিয়ে বললো,তা কি সন্দেহ করেছিলো আমাদের ডিটেকটিভ সাহেব?

তুমি কিন্তু মজা নিচ্ছো বৌমনি!অভির কন্ঠে অভিমান।
রিতি হেসে অভির কাঁধে হাত রেখে বলে,,আর কোনো ফান না এবার বলো কি সন্দেহ ঠিক হলো?
তিতলি দি বললো ছোটদা ভাইয়ের বড়ো লাগেজ দুটোতে সব আমাদের জন্য উপহার এনেছে। আমার তো মনটাই খারাপ হয়েছিলো কিছু আনেনি বলে।এখন যে কি খুশি লাগছে ‌তোমার খুশি হচ্ছে না?

হুম হচ্ছে। ছোট্ট জবাব রিতির।

তুমি ছোটদাভাইয়ের বউ তো।দেখো তোমার জন্যই সবচেয়ে দামি গিফ্টটা এনেছে।

রিতির বুক ভেঙ্গে কান্নারা দলা পাকিয়ে আসতে চায় অভির অতি উচ্ছাসে বলা কথাগুলো শুনে।এত সৌভাগ্য হয়নি তার যেটা অভি ভাবছে।

দুপুরে খাওয়া দাওয়া পর্ব শেষ হলো।ছোট বড়ো শতখানেক মানুষের খাওয়ার আয়োজন হয়েছিলো চৌধুরী বাড়িতে বাগানের এককোনে ফাঁকা জায়গায় চুলা বানিয়ে তাতে রান্না হয়েছে নিরামিষ খিচুড়ি, বেগুন ভাজি আর শেষপাতে দেওয়া হয়েছে মিষ্টান্ন,দধি।
অন্য বছর এমনটা হয় না।এবার হলো রিতির পরামর্শে।যে যুবক ছেলেরা দলবেঁধে পূজার জন্য কলা কেটেছে তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে এই ব্যাবস্থা।সাথে পাড়ার বাচ্চারাও বাদ পরেনি।
কাজে কর্মে ব্যস্ত থেকে দিনটা ভালই কাটলো রিতির। বর্ষার মৌসুমের ধানগুলো পাঁক ধরেছে অদূরে ক্ষেতে। অস্তমিত সূর্যের সোনালী দিগন্তে মিশে যাওয়া দেখলো ছাদে দাঁড়িয়ে।সাথে তিতলির টুকটাক কথোপকথন মন্দ লাগলো না রিতির।কর্ম ব্যস্ততায় আজকাল যান্ত্রিকতার ভূত ভর করেছে তার মধ্যে এসব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মোহ এখন আর টানেনা তাঁকে।আজ খারাপ লাগলো না বরঞ্চ সকালের মন খারাপ ভাবটা উধাও হয়ে গেল এই মনোরম পরিবেশে।

*****
মানুষ ভাবে এক আর হয় আর এক।এই হাসি তো এই কান্না। দুঃখ যেমন সারা জীবন কারো ছায়াসঙ্গী হয় না।সুখেরও শেষ হয়।
নিজের ঘড়ে ড্রেসিং এর সামনে দাঁড়িয়ে আছে রিতি।অশ্রুর ঢল নেমেছে আখি পল্লবীতে।ঝাপসা চোখে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সামনের প্রতিবিম্বের দিকে।প্রতিবিম্বের রিতিকে খুব রাগী দেখাচ্ছে যেনো।চোখে তার অফুরন্ত উপহাস।অট্টহাসিতে ফেটে পরে গম্ভীর গলায় বললো,,তুই এতটা লোভী রিতি?এত নির্লজ্জ ক্যানো তুই?আত্ম সন্মানবোধ বলে কি কিছুই নেই তোর।যে তোকে কানা কড়ির মূল্য দেয়না তার কাছে সোনার মোহর হওয়ার লোভ ক্যানো দেখাস ?উচিৎ শিক্ষা হয়েছে আজ।লোভী, বেহায়া মেয়ে কোথাকার।
চিৎকার করে ওঠে রিতি,,না না না ,আমি লোভী নই।লোভী নই আমি। কাঁদতে কাঁদতে মেঝেতে বসে পড়ে সে।
কিছুক্ষণ আগে,
সন্ধ্যা উতরেছে মাত্র।বসার ঘড়ে বাড়ির সবাই উপস্থিত। রঘুনাথ আজ বিকালে কোনো কাজ রেখেনি। প্রভাকর রায় চৌধুরী সকালের পত্রিকায় মুখ গুঁজেছেন এই ভরসন্ধ্যায় ।অন্নপূর্ণা দেবী জয়ার সাথে সাংসারিক কথাবার্তায় ব্যস্ত।রিতি চা করছে সবার জন্য। বিরূপাক্ষ একটা লাগেজ টেনে নিয়ে নিচে নামতেই সবার কৌতূহলী দৃষ্টি সেদিকেই পরলো।অভির ভেতর টান টান উত্তেজনা‌।কি পরবে তার ভাগে?
ধীরে সুস্থে লাগেজ খুলে যার যার জিনিস তাকে দিয়ে দিলো বিরূপাক্ষ।এসব শাড়ি চুড়ি সব কিনেছে ঢাকায় ব্যাক করেই। ইতিমধ্যে রিতিকে হিড়হিড় করে টেনে এনে নিজের পাশে বসিয়েছে জয়া। সবার সবকিছু দেওয়ার পরে লাগেজে দিকে তাকিয়ে দেখলেন অন্নপূর্ণা দেবী।তাতে বেশ বড় একটা প্যাকেট দেখে প্রশান্তির নিশ্বাস ছাড়লেন সবার অলক্ষ্যে।অভি তার রিমোর্ট কন্ট্রোল উড়ো প্লেনটা নিয়ে ইতিমধ্যেই নিজের ঘড়ে ঢুকেছে।

জয়া মনে শান্তি পাচ্ছে না। নিজেই লাগেজে পরে থাকা প্যাকেটটা বের করে আনপ্যাক করলো। চমৎকার একটা কাতান শাড়ি বেরিয়ে এসেছে সেখান থেকে। অন্নপূর্ণা দেবীর চোখ মুখ স্বস্তিতে চকচক করে উঠলো।জয়া হাসি মুখে শাড়িটার ভাঁজ খুলে মেলে ধরলো রিতির কাঁধে।
কি দারুন লাগছে বলো মামিমা? মানিয়েছে বেশ তাইনা তিতলি?
তিতলি অপ্রস্তুত হয়ে পরে।ও তো জানে একটা অনর্থ ঘটবে কারন এই শাড়িটা রূপ নিজে পছন্দ করে কিনেছে অন্য কারো জন্য। অসহায় চোখে একবার রিতির ঝলমলে মুখের দিকে তাকলো সে।
রিতি মনে মনে ভাবলো মুচকি হেসে, আমায় যদি মনে নাই রাখো তাহলে এসব কি?
বাহ্ বেশ পছন্দ তোর খোকা। বললেন অন্নপূর্ণা দেবী।
বিরূপাক্ষ বললো,মা তোমাদের ভুল হচ্ছে।এই শাড়িটা আমি অন্য কারো জন্য কিনেছি ওর জন্য না।
বিরূপাক্ষের কথায় জয়া শাড়িটা ছেড়ে দিতেই তা নিচে পরে যায় তিতলি মনে মনে ভেবেছিলো রূপ ব্যপারটা সামলে নেবে। কিন্তু ও যে এমন ভাবে মেয়েটাকে অপমান করবে ভাবেনি।রিতির দিকে তাকিয়ে মায়া হলো,ঝলমলে মুখটাতে কেউ যেনো কালিমা লেপন করে দিয়ে গেছে। রঘুনাথ থম মেরে গিয়েছে। অন্নপূর্ণা দেবী খালি হাতেই উঠে গেলেন নিজের ঘড়ে।জয়া উঠবে এমন সময় রিতি তার হাত চেপে ধরে চোখ দিয়ে ইশারা করলো না উঠতে।নিজেই ভাঁজ ভাঙা শাড়িখানি যত্ন করে ভাঁজ করে রাখলো সোফায়।তারপরে ধীরপদে সিঁড়ি ভাঙলো ধাপের পর ধাপ।বিরূপাক্ষ নিজের করা নির্বুদ্ধিতার জন্য নিজেকেই তিরস্কার করলো খানিক।দিয়ে দিলেই হতো ওকে শাড়িটা।ঢাকা থেকেই তো কেনা।আরো পাওয়া যেত।

বর্তমানে,,
এক পা গুটিয়ে আর এক পা মেলে পালঙ্কে বসে আছে রঘুনাথ।প্রচন্ড রাগে চোখদুটো লাল তার।পায়ের কাছে রূপের দেওয়া আইফোনটা বাক্সবন্দী হয়ে পরে আছে।ওটা আর ছুঁয়ে দেখারও ইচ্ছে করছে না। জয়া এসে বসলো পায়ের কাছে,,চোখে জল নিয়ে বললো,,যা হচ্ছে ভালো হচ্ছে না জানো?ভাই যে ক্যানো এমন করছে বুঝতে পারছি না। ভালো করার আশায় মেয়েটার ক্ষতি হয়ে যাবে নাতো? প্রথমবার সামলেছে। এবার কি করবে বলো তো?

ও ঠিকই সামলে নেবে। কিন্তু আমার চিন্তা রূপকে নিয়ে।দেখো দাবার গুটি যেনো উল্টে না যায়। প্রতিক্রিয়া হীন ভাবে বললো রঘুনাথ।
দরজায় টোকা পরতেই জয়া চোখ মুছে উঠে দাঁড়ায়।বাইরে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে রিতি।
বৌদিদি রাতে কি সবাইকে উপোস করাবে ভেবেছো?এভাবে ঘড়ে দরজা দিয়ে দুজনে রোমাঞ্চ করো তাতেই সবার পেট ভরে যাবে।অভিযোগ করে রিতি।
জয়া, রঘুনাথ দুজনেই বিভ্রান্ত রিতির স্বাভাবিকতায়।জয়া পেছনে রঘুনাথের দিকে তাকাতেই সে চোখ দিয়ে ইশারা করে ,ভাবটা এমন যে,বলেছিলাম না ঠিক সামলে নেবে?

চলবে,,,

উপন্যাস :হিয়ার মাঝে-লুকিয়ে ছিলে।

কলমে:চন্দ্রা।

পর্ব:১১

রাত পৌনে একটা বাজে। নিজের ব্যাগ খুলে কালো রঙা শর্টস্ প্যান্টএবং একটা ঘিয়ে রঙা ঢিলা টিশার্ট গায়ে চাপিয়ে নরম বিছানায় গা এলিয়ে দিলো বিরূপাক্ষ। শোয়ার আগে সুইচ টিপে আলোটা নেভাতে ভুললো না।
মনটা ফুরফুরে থাকার মাঝেও যেনো কোথায় একটু কমতি টের পায় সে। মানুষের জীবন কোথা থেকে কোথায় এসে দাঁড়ায় সেটা আজ আবার দেখলো উদাহরণ সহ।মনের মধ্যে অপরাধ বোধও পিঁপড়ার কামড়ের মতো কুট কুট করছে বিকাল থেকেই। নিজের স্বপ্ন পুরন আর জেদের জন্য নিজের প্রাণাধিক বন্ধুদের ও এতদিন কোন খোঁজ রাখেনি এবং কারো কোনো খবর রাখার উপায়ও রাখেনি।তার ফল আজ হাড়ে হাড়ে টের পেলো।সেই বিকাল থেকে পুরোনো বন্ধুদের সাথে আড্ডা জমিয়ে ডিনার সেরেছে আর ঘুরেছে স্মৃতি বিজড়িত কাছে পিঠে কিছু জায়গায়। কাছের বন্ধুদের মধ্যে অখিলেশের সাথে বেশি সখ্যতা ছিলো বিরূপাক্ষের। মধ্যবিত্ত গ্রাম্য পরিবেশ থেকে উঠে আসা অখিলেশ ছিলো একটু সহজ-সরল। কিন্তু বড়ো হয়ে সংসারটাকে সুখী করার একটা দারুন স্পৃহা ছিলো তার মধ্যে।শত বাঁধা বিপত্তিতেও কখনো হার মানেনি। নিজের ইচ্ছায় এই অব্দি এসে পৌঁছেছে। সবার সাথে মিশে যেতো নিমেষেই। মাস্টার্স শেষ বর্ষে ওর বাবা যখন হার্ট অ্যাটাক করে প্যারালাইসড হলো তখন বন্ধুরা মিলে সকল বই কেনা এবং ফর্মফিলাপের ব্যবস্হা করেছিলো।ওর বাবার অসুস্থতায় অনেক টাকা পয়সা দিয়ে পাশে থেকেছে বিরূপাক্ষ।তাতে ছেলে লজ্জায় মিইয়ে থাকতো সারাক্ষণ।যেটা বিরূপাক্ষের একদম ভালো লাগতো না। চার পাঁচটা টিউশনি করেও অখিলেশ কখনো খারাপ রেজাল্ট করেনি। নিজের খরচ চালিয়ে বাড়িতেও টাকা পাঠিয়েছে।জীবনে বড়ো হওয়ার একটা চাঁপা জেদ ছিলো ওর মধ্য। কিন্তু এভাবে হাল ছেড়ে দিয়ে ছেঁড়া পাল নিয়ে বসে থাকবে সেটা কখনো স্বপ্নেও ভাবেনি বন্ধুরা। পড়ালেখা শেষে যখন চাকরীর জন্য চেষ্টা করেছে তখন চরম হতাশায় পরেছে‌।বাবা গত হওয়ার একবছর পরে নিজেদের যতটুকু জমি ছিলো বাস্তুভিটা বাদে বিক্রি করে টাকা দিয়েছিলো একটা সরকারী চাকুরীর জন্য ‌কিন্তু ভাগ্যবিমুখ ছিলো টাকা গুলো সব খোয়া গেলো। ছয়জনের সংসার নিজের কাঁধে নিয়ে হতভম্ব অখিলেশ।চাকরী নেই কোথাও। চাকুরী খুঁজে স্যান্ডেলের তলা ক্ষয় না করে অন্য একজোড়া কমদামি স্যান্ডেলের যেনো অভাব না হয় সেই ব্যাবস্থাই করলো।উপরে উঠার স্বপ্ন সাধ জলাঞ্জলি দিয়ে এক ধাক্কায় ফুটপাতে নেমে এলো। নিজের শিক্ষার কথা মন থেকে ভুলে গিয়ে এখন রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফুচকা আচার বিক্রি করছে আর রাতের বেলায় নিম্নবিত্ত কর্মজীবীদের হোষ্টেলে ডাল ভাত খেয়ে বেড শেয়ার করে সারাদিনের ক্লান্তিতে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে।বিরূপাক্ষের চোখে জল এসে গিয়েছিল যখন অন্য বন্ধুরা ফুচকা খাওয়াতে অখিলেশের ভ্রাম্যমান দোকানে নিয়ে গিয়েছিলো। বিরূপাক্ষ প্রথমে চিনতে পারেনি অখিলেশের চেহারা দেখে‌। আগের সেই সুন্দর চেহারার জৌলুস নেই অখিলেশের।দেখে কেউ বুঝতে পারবে না যে,এই ছেলে একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিত সুন্দরী মেয়েদের ক্রাশ ছিলো।তার গায়ের চামড়াটা টকটকে কাঁচা হলুদের মতো ছিলো। বাংলাদেশ ব্যাংকের উপরমহলের কর্মকর্তা অরিন্দম সেনের একমাত্র কলেজ পড়ুয়া সুন্দরী মেয়ে নিরুপমা সেন একফোঁটা ভালোবাসার আশায় ঘুরেছে অখিলেশের পেছনে। বন্ধুদের হাতে পায়ে ধরেছে অখিলেশকে মানাতে। বিরূপাক্ষ থমকে দাঁড়িয়ে আছে অখিলেশের একহাতের দূরত্বে অখিলেশ থতমত খেয়ে তার তেল চিটচিটে গামছায় বার বার হাত দুটো মুছার অভিনয় করছে।দৃষ্টি ঘুরছে এদিক ওদিক।বিরূপাক্ষের চোখে চোখ রাখতে যত ভয় তার। একজন কাষ্টমার বললো ভাই একপ্লেট ফুসকা দেন তো।
অখিলেশ বাঁচলো যেনো তরিঘরি করে ফুচকা বানাতে ব্যস্ত হয়ে পরলো। বিরূপাক্ষ দেখছিলো পটুহাতে ফুসকাওয়ালার কর্ম।বিরূপাক্ষ ফুচকার প্লেটটা নিয়ে লোকটির হাতে পৌঁছে দিলো।ডাকলো অদূরে দাঁড়ানো বন্ধুদের,,এই তোরা এদিকে আয়,,
ফুচকা খা।দাদা ভালো করে ঝাল মেখে বেশি করে তেঁতুল গুলে আমাদের পাঁচ প্লেট দেনতো।ভালো হলে বকশিশ দেবো।
সারাজীবনের স্পর্শ কাতর অখিলেশের বুকে আঘাত লাগে বন্ধুর কথায়।অন্যদিন হলে দুই বন্ধুতে জড়াজড়ি করে এতক্ষনে চিঁড়ে চ্যাপটা হয়ে যেতো, অসহায় পেয়ে সেও বিদ্রুপ করছে? কাঁপা হাতে ফুসকা বানানোয় মন দেয় অখিলেশ। বিরূপাক্ষ অখিলেশের কম্পনরত হাতটা টেনে সজোরে জাপটে ধরে তাকে। কতদিন পরে বন্ধুকে বুকে নিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে পরে।অন্য বন্ধুদের চোখ ছল ছল করছে। ক্রেতাদের মধ্যে খাওয়ার চেয়ে দেখার আগ্রহ বেশি।রাস্তার ফুসকা ওয়ালাকে সাহেব গোছের কেউ আলিঙ্গন করছে এ যেনো সিনেমার মতো। অখিলেশ নিজেকে ছাড়িয়ে ব্যাস্থ হয়ে পরে,
এই দ্যাখ কি কান্ড করলি তোর শার্টটা তো নষ্ট হলো রূপ?
বিরূপাক্ষ অখিলেশের তৈলাক্ত হাত দুটো নিয়ে নিজের শার্টে ঘষতে থাকে,আদ্র কন্ঠে বলে,
তুই এই ময়লার মধ্যে বসবাস করতে পারিস আর আমি একটু জামায় মাখতে পারবো না?অতটাও ভদ্রলোক হইনি এখনো তা জানবি।তোরা আমাকে পর ভাবতে পারিস আমি নই।
অখিলেশ ভাবাবেগে পুনরায় আলিঙ্গনে বেঁধে নেয় বন্ধু কে।অন্য বন্ধুরাও বাদ পরেনা।
অখিলেশের ফুসকার ভ্যানগাড়িটা টংয়ে উঠিয়ে তবে ক্ষান্ত হয়েছে বিরূপাক্ষ এতদিন এতগুলো বন্ধু মিলে যে অখিলেশ কে টলাতে পারেনি নিজের পথ থেকে রূপের কাছে সে একদিনেই কুপোকাত।

বি:দ্র:সন্মানীয় পাঠক/পাঠিকা বৃন্দ,আমি মনে করি যারা উপন্যাস পড়েন তাঁরা অবশ্যই প্রাপ্ত মনস্ক।তাই আমার লেখার স্বার্থে যদি কোন প্রাপ্তমনস্ক বাক্যের ব্যাবহার হয়ে থাকে তবে এটাকে অশ্লীল রচনার কাতারে ফেলবেন না দয়াকরে।এই অনুরোধ রইল।

বিরূপাক্ষের চোখে ঘুম নেই।অখিলেশ বাদেও তার ঘুম উড়ানোর মতো আরো কতগুলো দুশ্চিন্তা,ভাবনা আছে।কাল রাতে তার বাবা নিজের রুমে ডেকে বেশ কয়েকটা কথা শুনিয়েছেন। কথাগুলো একেবারে ফেলে দেওয়ার মতো নয়। সবকিছু ঠিকঠাক ভাবে নিজ আয়ত্বে আনতে হলে রিতিকে চটানো যাবেনা কোন মতে।তারসাথে আপোষে সমঝোতা করার কথা ভেবে নিয়েছে বিরূপাক্ষ।তিতলিও অনেক বুঝালো। বিরূপাক্ষ একটা কথা ভেবে পায়না মেয়েরা সবকিছু এত সহজে মেনে নেয় কিভাবে?সে যতদূর জানে তিতলি ওকে নিজের জীবনের চেয়ে বেশী ভালোবাসে।একটু ভালোবাসার জন্য নিজের জীবনের অনেক ইচ্ছার গলা টিপে হত্যা করেছে। কিন্তু সে স্যাক্রিফাইস করতে চায় রিতির জন্য।নাকি নিজের পথটা মসৃন করতে চায় বিরূপাক্ষকে নিজের কমিটমেন্ট থেকে সরিয়ে এনে।ভেবে পায়না বিরূপাক্ষ।এদিন অখিলেশও নিরুপমার সাথে ধীরে ধীরে জড়িয়ে পরেছিলো। ভালোবাসার জোয়ারে দুজনে বেশ কয়েকবার অন্তরঙ্গভাবে শরীরও ভাসিয়েছে।সে খবর জানতো বিরূপাক্ষ।সেই নিরুপমা কি করে ভালোবাসার মানুষটির দূর্দিনে প্রেমিকের দিকে ভরসার হাত না বাড়িয়ে অধিক সুখের আশায় অন্যের হাত ধরলো?

বিরূপাক্ষের সব ক্যামন উলোট পালোট লাগে।কি করবে কিছুই ভেবে না।চক্ষু জোড়া ক্লান্ত তবে ঘুম নেই আছে শুধু তন্দ্রা ভাব।আর সেই তন্দ্রার মধ্যে থেকে থেকে ভেসে আসছে একজনের মিহি সুরেলা কন্ঠঝংকার আর একজনের বিধাতার সুক্ষ্ম ধারালো ছেনীর আঘাতে অতি যত্নে গড়া দেবী প্রতিমার মতো মুখশ্রী।তার সারল্য মাখা চাহনিতে জোর করে টেনে আনা কপটতা।

****
কথিত আছে স্রষ্টা যা করেন তার পেছনে সৃষ্টির কোনো নিগূঢ় মঙ্গল লুকিয়ে থাকে।এখন কথা হচ্ছে যে নারীর গর্ভের সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার দেড় মাস বা দুই মাস আগে স্বামী গত হন বা সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার একমাস পরে গত হন।তাহলে এর মধ্যে কি মঙ্গল লুকিয়ে আছে ঐ সদ্যজাত সন্তান বা ঐ বিধবা নারীর জন্য।সেটা আমার বোধগম্য নয়।এটা শুধু উদাহরণ হলে সত্য তো বটে, আমার নিজের দেখা ঘটনা।তারপরেও এখানে যদি, কিন্তু,অথবা কাজে কাজেই কোনটার কোনো ভিত্তি নেই।কারন সৃষ্টিকর্তার কর্মের রহস্য কে কবে সঠিকভাবে জানতে বা বিশ্লেষণ করতে পেরেছে?

ঘটনা যা ঘটার তা ঘটে যায় কিন্তু আবেগ বা দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে গিয়ে অনেকে আবার বহুদিন বাদে নিজের বিবেকের কাছে কোণঠাসা হয়ে পরে।বিরূপাক্ষের জীবনেও ঠিক এই কোনঠাসা অধ্যায় শুরু হয়েছে। কয়েক বছর আগে অন্যের নেওয়া সিদ্ধান্ত মাথা পেতে নেওয়া এবং তারই প্রেক্ষিতে অযাচিত ভাবে একজনকে কথা দেওয়ার জন্য আজ দুই নৌকায় পা দেওয়ার মতো অবস্থা তার।
সেদিন সদ্য বিয়ে করা বউ কে মুখে মুখে মুক্তি দিয়ে গেলেও আজ ক্যানো জানি মুক্তি কথাটায় বড়ো অবসাদ এসে গিয়েছে।
ধর্মীয় রক্ষনশীল পরিবারের ছেলে সে,ছোট বেলায় মাকে দেখেছে মাথায় চওড়া সিঁথিতে মোটা করে সিঁদুর পরে, শাঁখা পলায় ছুঁইয়ে মাথায় ঠেকিয়েছে।রিতির প্রচন্ড জ্বরের রাতে দেখেছে রিতির সিঁথিতে ও সিঁদুর জ্বল জ্বল করছে।বিরূপাক্ষ নিশ্চিত রিতি আজো ওর নামের সিঁদুরেই সিঁথি রাঙায় সবার অলক্ষ্যে।তাহলে আরেকজনও কি সিঁথি রাঙায় ওর নামের সিঁদুরে?

বিরূপাক্ষ ভুলতে পারে না সেই আট নয় বছর আগে ঘটে যাওয়া ঘটনার স্মৃতি। বৈশাখ মাসে বনদেবীর মন্দিরে পাওয়া বনলতাকে। সেদিন ঘটনা ঘটিয়ে এলাকা বাসীরা ওদের একা ছেড়ে দিয়ে যে যার মতো চলে গেলো গন্তব্যে।কিশোরী মেয়েটির হাত ধরে অন্ধকার পথে হাঁটতে থাকে বিরূপাক্ষ,গন্তব্য দূরে অবস্থিত বন বিভাগের অফিস।সেখানে গেলেই মেয়টার মিলবে সঠিক আশ্রয় আর ওর মিলবে স্বস্তি বিরূপাক্ষ বললো,আচ্ছা তোমাদের বাড়ি কি এখানে?একা যেতে পারবে তো?মেয়েটা মাথা নেড়ে হ্যা নাকি না বললো অন্ধকারে ভালো বুঝলো না বিরূপাক্ষ।একটু বিরক্তি এনে বললো,,কথা তো বলতে পারো। অন্ধকারে মুখটাও দেখতে পারছিনা।বলো যেতে পারবে? তোমার বাড়ি কি এখানে?

এবার উত্তর বেরোলো,,না আমার বাড়ি এখানে না।দাদুর সাথে এসেছি বেড়াতে।
বনলতা নামক মেয়েটির মিহি কন্ঠ শুনে বিরূপাক্ষের ইচ্ছা হলো একবার এই কোকিল কন্ঠির মুখখানি দেখতে কিন্তু উপায় নেই আবছা আলো অন্ধকারে শুধু বোঝা গেলো মেয়েটা বেশ লম্বা তবে সাস্থ্যহীন।হয়তো সবে বেড়ে উঠেছে এখনো গায়ে মাংস লাগেনি। অদূরে দুটো টর্চ লাইটের আলো দেখা গেলো।
ওই যে দাদু ডাকছে। খুঁজছে আমাকে।ভয়ার্ত কন্ঠে বললো বনলতা।
বিরূপাক্ষ বুঝলো এই কম্পনরত হাতটা এখন ছেড়ে দিতে হবে।তবে যে সম্পর্কটা একটু আগে গড়ে উঠেছে তার কি হবে?সাধুবাবা যে বললেন,এমন ধন যেনো হেলায় না হারাই ।তবে এখনি কিছুতেই বাঁধা পরবো না আমি,,
এই শোনো আমার নামটাতো বলাই হয়নি,আমি বিরূপাক্ষ রায় চৌধুরী। নড়াইলের মথুরাপুর রায় চৌধুরী বাড়ির প্রভাকর রায়ের ছেলে আমি।এখনি কাউকে কিছু বলো না হ্যা। তোমার ঠিকানা দাও।আমি পরে যোগা যোগ করবো।
আপনি আর ফিরবেন না আমি জানি।জোর করে দেওয়া বিয়েটা আপনি মানবেন না।
একফোঁটা মেয়ের মুখে হঠাৎ এমন প্রত্যয়ী বাক্য শুনে থমকে গেলো বিরূপাক্ষ।
এত আত্মবিশ্বাস ভালো না মেয়ে আমাকে চেনো না তুমি তাই এমন ভাবে বলছো। নিজের মোলায়েম কন্ঠ দ্বারা বশে আনতে চায় বনলতাকে।
আমাকে কি করতে হবে বলে দিয়ে যান তবে,,,এত আকুলতা ঐটকু মেয়ের সাথে যায় না।তবে কি মেয়েরা অল্প বয়সেই অনেকখানি ম্যাচিউর হয়?ভাবলো বিরূপাক্ষ।তথাপি ওর নিজেই ক্যমন জানি একটা শূন্য শূন্য অনুভূতি হচ্ছে। মানুষ আবেগের বশে অনেক সময় ভাবনা চিন্তাকে অবকাশ না দিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। বিরূপাক্ষ ও আগে পিছে না ভেবে ঐ অচেনা অজানা মেয়েটির মুখটা নিজের আজলাতে তুলে নিয়ে বললো,,

তোমার যেটা ভালো মনে হয় সেটাই করো।আর এই দূর্ঘটনা টা যদি তোমার পূর্ণ বয়স হওয়ার পরেও শুধু নিছক দূর্ঘটনা মনে না হয় তাহলে অপেক্ষা করো।আমি ফিরবো। আমার দায়িত্ব আমি পালনে পিছুপা হবো না।
আমি অপেক্ষায় থাকবো।গলাটা কেঁপে উঠলো বনলতার।
টর্চের আলো অতি নিকটে আসতেই দুজনে পৃথক হয়ে একটু দূরত্বে দাঁড়ায়।
একজন তড়িতে এগিয়ে এসে বলে,,,
ও মাইয়া তুমি এইহানে কেম্মে আইলা মা?বিয়ালডা (বিকালটা)হইতে খুঁজতেয়াছি।দলের লগে আইয়া কেম্মে ছুইট্টা গেলা?লও লও তোমার দাদু খুব পেরেশানিতে আছে(কাঁদছে)
বনলতাকে একপ্রকার বগলদাবা করেই নিয়ে গেলো লোকটা।মেঠো কাঁদাযুক্ত পথে অন্য দিকে বাঁক নিলো।
বিরূপাক্ষ নিজের গন্তব্যে পা চালায়। তখনি মনে পরে আসল কাজটাই সমাপ্ত হয়নি।ভাবাবেগে পরে বনলতার ঠিকানটা ই নেওয়া হলো না। অন্ধকার পথে কাউকেই আর দেখা যায় না।বুকের ভেতর টা হুঁ হুঁ করে ওঠে।কিভাবে পাবে বনলতাকে?

ঘুমের ঘোর কাটিয়ে হঠাৎ করে উঠে বসে বিরূপাক্ষ,,অস্পষ্টে বার দুই উচ্চারণ করে, বনলতা,,,
পাশের টেবিলে রাখা জলের গ্লাস নিয়ে জল খায়।মনে মনে ভাবে,যেতে হবে এবার পূজোটা মিটুক আগে। কিন্তু মা বাবাকে মানাবে কি করে? হ্যা একমাত্র রিতিই পারবে সবকিছুর সমাধান করতে ,,,

****
রিতি বিছানায় আধশোয়া হয়ে ল্যাপটপে কাজ করছিলো রঘুনাথ দরজায় টোকা দিলো।হালকা খোলা দরজার দিকে তাকিয়ে আবার ল্যাপটপ স্কিনে দৃষ্টি দিয়ে বললো রিতি,, দাদাভাই দরজা খোলা।তুমি আবার কবে থেকে এত ফরমাল হলে? রঘুনাথ এগিয়ে এসে বিছানায় বসতে বসতে বললো,, তুই এখন বড়ো হয়েছিস একটু প্রাইভেসি তো দিতেই হয়।
তাই?উঠে বসে বলে রিতি।

কাল তো তোর সমস্ত মালের ডেলিভারী তাইনা?

আশা করা যাচ্ছে দাদাভাই। সবকিছু ঠিক থাকলে কালই হবে।

তা ভালো।একটা কথা বলার ছিলো।বলবো?

না।আমি রাতভর বসে ভাবি তারপর সকালে জানাবো বলবে কি না?

রিতির ঠাট্টা ধরতে পেরে বললো রঘুনাথ ,,তুই কিন্তু দিন দিন খুব পাকনা হচ্ছিস।
শব্দ করে হাসে রিতি,,
তোমরা সবাই এমন ব্যবহার করলে আমি কি করবো? আচ্ছা বলো তোমার দরকারী কথাটা‌‌।

তুই বললি না সেদিন তোর কাজের ওখানে হিসাব দেখার জন্য একজন লোক লাগবে?সুমি একা পারে না।

হ্যা।হলে তো ভালোই হয়।আমারো সামনে পরীক্ষা। পড়াশোনার দিকটাও দেখতে হবে!পেয়ছো কাউকে দাদাভাই?

রূপ সন্ধ্যায় ফোন করেছিলো।ওর কোন বন্ধুর নাকি একটা কাজের বিশেষ দরকার আপাতত।তাই বললো,ওতো আর জানে না যে, “অন্নপূর্ণা তাঁত এন্ড বুটিক” এর মালিক তুই।নিয়োগ ও বিয়োগ দুটোই তোর মর্জিতে এবং হাতে চলে।গর্বের হাসি হাসছে রঘুনাথ।
রিতি ভাবুক হয়ে বলে,,, তুমি কি বলো দাদাভাই?

রূপ তো বললো ও যতদিন বেকার আছে ততদিন পর্যন্ত ওর বন্ধু এখানে কাজ করবে পরে ও নাকি ফ্যাশন হাউস না কি করবে সেখানেই নিয়ে নেবে।কয়েকটা মাস শুধু।তবে আমি তোকে কোনো গ্যারন্টি বা ওয়ারেন্টি দিতে পারবো না।ছেলেটা রূপের সাথেই আসবে ।একটু দেখে শুনে বুঝে নিবি।

আচ্ছা আচ্ছা তুমি একটু দেখে শুনে বুঝে দিও ক্যমন?হাসছে রিতি

তুই কিন্তু সীমাহীন ফাজিল হচ্ছিস বুড়ি,,তোকে শায়েস্তা করতে দেখছি বিজয়া দেবীর শরনাপন্ন হতে হবে।ভয় দেখায় রঘুনাথ।
আহ্ দাদাভাই ভাই বোনের মাঝে আবার পরের বাড়ির মেয়েকে টানছো ক্যানো বলোতো? রঘুনাথকে মানানোর চেষ্টা করছে রিতি।
ঠিকাছে বাবা টানলাম না।হাসছে রঘুনাথ।

হয়েছে?এখন শুভ রাত্রি। আমার কাজ আছে যাও।
রঘুনাথ কথা বাড়ায় না। তাড়াতাড়ি শুয়ে পরতে বলে বেরিয়ে যায় দরজা টেনে দিয়ে।

রিতি কাজ সেরে সুই,সুতা আর পাঞ্জাবিটা নিয়ে বসেছে।আর একদিন ধরলে হয়ে যাবে।বিরূপাক্ষের দেশে ফেরার কথা শুনে শত ব্যাস্ততার মধ্যেও এই কাজটুকু সে করে অতি যত্নে নিজের,হাতে।পূজায় গিফ্ট করবে বিরূপাক্ষকে। বিরূপাক্ষ কি ওর দেওয়া উপহার টা পরবে?ভাবে রিতি আর সুঁচটা এফোঁড় ওফোঁড় করে। পরলে খুশি হবে, না পরলেও মনক্ষুণ্ণ হবে না রিতির।চন্দন রঙের পাঞ্জাবির সমগ্র জুড়ে রঙবেরঙের সুতোর বুনন আর মন কাড়া কারসাজি দেখে চোখ ফেরানো দ্বায়।রিতির কল্পনার চোখে ভেসে ওঠে বিরূপাক্ষের এই পাঞ্জাবী পরিহিত সুঠাম সুগঠিত দেহখানি ‌।

****
আসসালামুয়ালাইকুম আপা,,,

নারী কন্ঠে সালাম শুনে খাতা থেকে মুখ তুলে তাকায় রিতি।বুটিক হাউসের ছোট্ট অফিস ঘড়ে খাতা পত্তর দেখছিলো সে।

এইতো খাদিজা আপা কি খবর আপনার? স্বভাব সুলভ ভাবে হেসে বললো রিতি।

আফা সেইদিন কইছিলাম না একজনের কামের কথা? কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে বললো খাদিজা।

রিতি একটু চিন্তা করে বলে,,আপা কার কথা যেনো বলেছিলেন? আমার ঠিক মনে নেই।আর আপনি এখানে এসে বসে কথা বলেন।
রিতি হাতের ইশারায় টেবিলের অপর পাশের কাঠের চেয়ারটা দেখায়।
খাদিজা ইতস্তত করে অবশেষে গুটিয়ে বসে,,
আফা আফনেরে আমার বোইনের মাইয়ার কথা কইছিলাম না?মাইয়াডা বড়ো দুঃখী একটা কাম পাইলে বাইচ্চা যাইবো আফা। মাইয়ার হাতের কাম খুবই সোন্দর।ফালাইতে পারবেন না।খাদিজার চোখ ছলছল করছে।
ওহ্ ,,,আপা মনে পরেছে।ঠিকাছে একদিন নিয়ে আসেন।আর আমি সুমিকে বলে দেবো।ও ই দেখে নেবে।

কৃতজ্ঞতায় গলা ধরে আসে খাদিজা বানুর।কত শত দোয়া করে দেয় এক নিঃশ্বাসেই।

ভাবি আরেকটা কথা,,খাদিজা তটস্থ হয়।
আপনার স্বামী কি এখন একটু ভালো হয়েছে নাকি এখনো ঐসব করে?
খাদিজার ছলছলে চোখে এক ঝলক ঘৃনা ছুটে আসে,,

আফা,হেয় না মরলে ঐ সব ছাড়তে পারবো না।আল্লায় মাফ দিবো না অরে।ছমির শেখের বড়ো পুলায় আইছে চট্টগ্রাম থেইকা হুনছি হেয় নাকি ঐ ভাঙা কেলাবে (ক্লাবে)রাইতে গাঞ্জা ব্যাচে।আফনে কিছু একটা করেন আফা।গেরামডাতো খাইয়ালাইবো।

ও আচ্ছা। ঠিকআছে আপনি এখন কাজে মন দেন গিয়ে।
পুনরায় সালাম দিয়ে বেরিয়ে যায় খাদিজা বানু।
রিতি চিন্তিত হয়ে ভাবতে থাকে দুই বছর আগের সেই দিনটার কথা।তখনো এই বুটিক বা তাঁত কলের তেমন কোনো পরিচিতি হয়নি। কর্মীদের সংখ্যাও নিতান্ত কম।রিতি,সুমি আর পাঁচ সাতজন মিলে আশে পাশে গ্রামে বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে কাপড়,সুই,সুতা দিয়ে আসতো বৌ ঝি দের এবং কাজ হয়ে গেলে নিয়ে আসতো। সেদিন ও গিয়েছিলো এখান থেকে দুই গ্রাম পরের গ্রামে ।যে বাড়িতে কাজ দেওয়া ছিলো তার পাশের বাড়িতে একজন নেশা করে বৌকে পিটিয়ে আধমরা করে রেখেছে।হুশ নেই মাঝ বয়সী মহিলার।রিতি কৌতুহল বশত এগিয়ে যায় সেদিকে। আশপাশের লোকজন বলছিলো লোকটা নাকি যা আয় করে চাল কম গাঁজা কেনে বেশী।চার মেয়ের সংসারে ছেলে আনার জন্য পুনরায় বিয়ে করতে চাওয়ায় স্ত্রী বাঁধা দেওয়ায় এই বিপত্তি।ঘড়ের মধ্যে মাটিতে পরে আছে মহিলা,পাশে তিন বছরের বাচ্চাটা কাঁদছে। টিনের দোচালা ঘরের সামনে বারন্দা। দুই দিকেই বেড়া নেই।চার মেয়েই আছে সেখানে তবে বড়োটার বয়স দশের বেশি হবে না কিছুতেই।সে ছোটবোনকে টানছে কিন্তু কিছুতেই মাকে ছেড়ে যাবে না।সেই লোকটা মানে রমিজ মিয়া দুয়ারের পাশে পায়ের স্যান্ডেল পাছার তলায় দিয়ে বসে একমনে বিড়ির মাথায় আগুন দিয়ে পাছায় সুখের টান দিয়েই চলেছে।রিতির প্রচন্ড রাগ হলো রমিজ মিয়াকে দেখে আর তার চেয়ে বেশী মন কেঁদে উঠলো ও অসহায় বাচ্চাদের আর তাদের অচেতন মা মানে খাদিজা বানুকে দেখে।
সেদিন রমিজ মিয়ার সাথে বিরোধ করে খাদিজা বানুকে নিয়ে গিয়েছিলো উপজেলা স্বাস্হ কেন্দ্রে আর রমিজ মিয়ার ব্যাবস্থা হয়েছিলো ঐ ইউনিয়নের মেম্বার সাহেবকে দিয়ে সেটা অবশ্য রঘুনাথ ই করেছিলো।
খাদিজা সেই থেকে নিজের বয়সের অর্ধেক বয়স হওয়া সত্ত্বেও রিতিকে ফেরেশতা মনে করে। মেয়েরাও স্কুল মাদ্রাসায় পড়ে রিতির খরচে।

কি রে এত কি ভাবছিস?বাড়িতে যাবিনা ?
সুমির কথায় চিন্তা ভাবনা গুলো গুটিয়ে নেয় রিতি।ফাইলের কিছু একটাতে আন্ডারলাইন করে বন্ধ করে দিয়ে বলে,,হ্যা রে যাবো।সাড়ে পাঁচটা বাজে।সবাই চলে গেছে?
না আছে এখনো।তুই বের হ।ওদের হলে শিবু কে দিয়ে তালা লাগিয়ে তবেই আমি বেরোবো।
এককাজ কর, চল বাইরে শিবুকে বলে একসাথেই বেরোবো দুইজনে। কতদিন দুজনে একসাথে হাঁটা হয়না।নাকি কেউ বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে?দেরাজ বন্ধ করতে করতে বললো রিতি।

তোরা কিন্তু বেশি বেশি করছিস। দেখেছিস কখনো আমাকে বাইকে চড়তে?কপট রাগ দেখায় সুমি।

তোরা বলতে কাকে কাকে বুঝালি রে?

অত আমি বুঝায় দিতে পারবো না।গেলে চল।

হ্যা হ্যা চল।রিতি তো ঠিকই বুঝেছে, সুমিকে আর ঘাটালো না।

শোন সুমি দিলরুবা ম্যামের সাথে দুপুরে কথা হলো। নতুন কিছু সেলাই শেখাবে।

তাহলে তো ভালোই হয়। নতুন বেশ কয়েকজন মেয়ে এসেছে না।ওরাও শিখবে।

হুম।পূজার পরে আসতে বলেছি।তুইও অফিসিয়ালি নোটিশ দিয়ে দে। দশমীর পর থেকে অস্থায়ী কাউকে আর নেওয়া হবে না।

ঠিকাছে দিয়ে দেবো।

***
নিজের ঘড়ে ঢুকতেই বিছানায় কয়েকটা শপিং ব্যাগ দেখলো রিতি ব্যাগের নিচে শো_রুমের ঠিকানা পড়ে বুঝলো এসব কে রাখতে পারে। ছোঁবেনা ভেবেও কৌতুহল দমিয়ে রাখতে না পেরে ব্যাগের ভেতরের জিনিস বের করে দেখতে লাগলো।দামী শাড়ির সাথে ম্যাচিং পেটিকোট, ব্লাউজ এমন কি অন্তর্বাসও বাদ পরেনি। লজ্জা আর ভালো লাগা মিশেলে যে অন্যরকম একটা অনূভুতি হয় রিতির মধ্যে তা অচিরেই ঢাকা পরে অপমানের অতলে। শেষের ব্যাগটা খুলতেই বেরিয়ে আসে সেই শাড়িটা যেটা সেদিন বিরূপাক্ষ সবার সামনে থেকে একপ্রকার কেড়েই নিয়েছিলো।সেই শাড়ি পুনরায় তাকে দেওয়া রিতি মেনে নিতে পারলো না। তাচ্ছিল্য ভরে ব্যাগগুলো সোফায় ফেলে রেখে ফ্রেশ হতে চলে গেলো ওয়াশরুমে।এমন ভাবে ব্যাগগুলো তুললো যেনো বিছানায় রাখলে এখনি বিছানাটায় আগুন লাগবে।ভস্ম হয়ে যাবে।
রিতি শুনেছে জয়ার মুখে বিরূপাক্ষ তার এক বন্ধুকে সাথে নিয়ে এসেছে। কিন্তু সন্ধ্যা থেকে তাদের টিকিটি দেখলো না রিতি।অবশ্য দেখার জন্য উন্মুখ হয়ে না থাকলেও ড্রইংরুম বা কিচেনে থাকা কালীন বার বার দৃষ্টি চলে গিয়েছে দরজায়। নিজের ঘড়ের ব্যালকনিতে আজ অকারনে বেড়েছে যাতায়াত,দৃষ্টি বাড়ির মূল ফটকে।

রাত সাড়ে দশটায় ডাইনিং টেবিলে দেখা মিললো বিরূপাক্ষের।অখিলেশের সাথে রিতির পরিচয় করিয়ে দিলো জয়া।অখিলেশ যখন শুনলো রিতি রূপের স্ত্রী তখন গরম দৃষ্টিতে একবার তাকালো বিরূপাক্ষের দিকে। বিরূপাক্ষ চোখ নামিয়ে আহারে মন দিলো এমন ভাবে যেনো সে,,,,,,,ই “ছিয়াত্তরের মন্বন্তর”থেকে আজ অবধি সে অভুক্ত উদর বয়ে চলেছে।
রিতির চোখ এড়ালো না বিরূপাক্ষের বাংলার পাঁচ মার্কা মুখশ্রী খানি।সে অধিক আত্মপ্রসাদ লাভের আশায় প্রফুল্ল চিত্তে বেশি ঝাল দিয়ে রান্না করা সয়া বড়ির তরকারী খানিকটা উঠিয়ে দিলো বিরূপাক্ষের পাতে।তার একটু গালে দিয়েই আর সহ্য হলো না বিরূপাক্ষের নিজের গ্লাসভর্তি জলটুকু উদরপূর্তি করে রঘুনাথের গ্লাসটা ভাত তরকারি সমেত প্লেটে ঢেলে দিয়ে উঠে গেলো।জব্দ করতে পেরে খুশিতে স্থান কাল ভেদে শব্দ করে হেসে উঠতেই চোখ পরলো প্রভাকর রায় চৌধুরীর দিকে,, তিনি হতবুদ্ধি হয়ে আছেন।

আমি আবার কি করলাম।বিরূপাক্ষের উদ্দেশ্যে বিরক্তি প্রকাশ করলো রঘুনাথ।গ্লাসে জল ঢালতে ঢালতে আবার বিরক্ত,,তোর আবার কি হলো রিতি?
পাগলা ভূতে ধরেছে নাকি সব?

রিতি বুঝতে পারে একমাত্র রেগে গেলেই দাদাভাই তাকে রিতি ডাকে।সে হাসি চাপাতে কিচেনে আড়াল হয়,,
বৌদিদি ডাইনিংয়ে যাও।আমি দুধের উতড়ানো ঠেকাচ্ছি।

রাত বারোটা পেরিয়েছে মাত্র। বিরূপাক্ষ এবং অখিলেশ ছাদে গিয়েছিলো সুখ দুঃখের কথা বলতে।অখিলেশের স্মোকিং এর অভ্যাস আছে।ছাদে যাওয়ার মূল উদ্দেশ্য সেটাই।অখিলেশকে তার জন্য বরাদ্দকৃত রুমে দিয়ে নিজের ঘড়ে ঢুকলো বিরূপাক্ষ।বোতল থেকে কয়েকঢোক জল গলাধঃকরণ করে স্টাডি টেবিলে বসে ল্যাপটপ অন করে অনির্দিষ্ট ভাবে একেক দিকে ঘুরতে লাগলো সোস্যাল মিডিয়ায়। নিজের মোবাইলের ক্যামেরাটা অন এমন ভাবে রেখেছে সামনে যে,দরজা দিয়ে কেউ প্রবেশ করলে দেখতে পারবে।অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো যখন, তখন মোবাইলের ঘড়িতে বারোটা বেজে আটচল্লিশ মিনিট। কিন্তু কফির বদলে রিতির হাতে বিকেলের সেই শপিং ব্যাগগুলো।এক মুহুর্তে যা বোঝার বুঝে নিলো বিরূপাক্ষ।চেয়ারে হেলান দিয়ে আরাম করে বসে এমন ভাব করছে মনে হচ্ছে কাজে সে ভীষণ ব্যস্ত।রিতি আজ নক না করেই ঢুকে গেল বিরূপাক্ষের শয়নকক্ষে।বিরূপাক্ষের পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে মাত্র,,

শাড়ি পছন্দ হয়নি তোর?নাকি ওগুলো মাপে খাটেনি। আমার আন্দাজ তো ভুল হওয়ার কথা নয়।অবশ্য তোকে দেখে গায় গতরে বোঝার উপায় রাখিস না।দিদিমনি কি না?রিতির সামনে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বললো বিরূপাক্ষ। ঠোঁটে মৃদু হাসি।
রিতি বিস্ময়ে হতভম্ব।একটা মানুষ কিভাবে হাসতে হাসতে আরেকজনকে এমন ইঙ্গিত করতে পারে।ক্রোধে সহসা কথা জোগায় না রিতির মুখে।

কি হলো রোবট হয়ে আছিস ক্যানো?সমস্যা কি?বল?ভ্রু নাচায় বিরূপাক্ষ। দারুন জব্দ করেছে রিতিকে।
আপনার মতো এমন বাজে এবং অসভ্য আমি জীবনেও দেখিনি।রাগে গলা কাঁপছে রিতির।
কি করলাম আবার?তোর সাথে এমন একটু আধটু কথা তো বলতেই পারি তাইনা?রিতির রাগ বাড়িয়ে দিতে বললো বিরূপাক্ষ।
আপনি নিজে যেমন অশ্লীল, মুখের বাক্যও তেমন অশ্লীলতায় ভরা। আপনার সাথে কথা বলতে আমার রুচিতে বাঁধা উচিত ছিলো।

এবারের কথায় বিরূপাক্ষের খুব প্রেষ্টিজে লাগলো।রিতির বা হাতটা চেপে ধরে বললো দাঁতে দাঁত পিষে,,অসভ্যতা কাকে বলে জানিস তুই?অশ্লীশতা কি চিনিস তুই।রিতি একঝটকায় নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে চরম উষ্মার সাথে বললো,, লজ্জা করেনা বারবার আমার হাত ধরতে?এমন অশালীন বাক্য প্রয়োগ করতে কিসের অধিকার আপনার?আর কখনো যদি এমন করেছেন তার ফল ভালো হবে না।ঘুরে পা বাড়াতেই খেয়াল হলো হাতের শপিং ব্যাগ গুলো এখনো বহাল তবিয়তে আছে।বিরূপাক্ষের বুক বরাবর সেগুলো ছুড়ে দিয়ে দ্রুত বেগে ঘড় থেকে বেরিয়ে আসে রিতি।
কথায় আছে ঝগড়া ঝাটি বা মনোমালিন্যে একপক্ষকে একটু চুপ থাকতে হয় কিন্তু সে বিষয়টা রাগের মাথায় কারো মাথায় থাকে কি?বিরূপাক্ষ কখনো অমূলক ক্রোধ বা প্রতিশোধ পরায়ণতা কারো সাথে দেখায় না কিন্তু এই মুহূর্তে তার উষ্ণ মস্তিস্কে সে কথা মনেও থাকলো না।রাগের মাথায় দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটে গেলো রিতির ঘড়ে,,,

রিতি ড্রেসিংয়ের বৃহতাকার দর্পনে নিজের প্রতিবিম্বকে ছি চিৎকার করছে,,
এত অধৈর্য তো তু ছিলি না?ক্যানো এমন করলি।অযথা রোষানলে মানুষটাকে ক্যানো জ্বালাতে গেলি। কতগুলো কুকথা বলে দিলি এর পাপের ভাগ কে নেবে বল??
আয়নার রিতির কাছে উত্তর চায় রক্ত মাংসের রিতি,,
এমন কিছু যে ঘটে যাবে রিতি ঘুনাক্ষরেও বুঝতে পারেনি।সে তো গিয়েছিলো শুধু মাত্র বিরূপাক্ষের দেওয়া জিনিসগুলো ফিরিয়ে দিতে কিন্তু কি হতে কি হয়ে গেলো ?একটু বেশিই হয়ে গেল।

রিতি আয়নার কাছে উত্তর পেলোনা ঠিকই কিন্তু পেটে অসম্ভ ব্যাথায় ককিয়ে উঠেই দেখলো আয়নার মাঝে তার মাথার উপরে আরেকটা মাথা।কপালে জোড়ভ্রুর নিচে জলন্ত চুল্লীর বহ্নি যেনো চোখ দুটো তে।বিরূপাক্ষ বাঁহাত দিয়ে রিতির শাড়ির ফাঁকে নগ্ন পেটে এমন ভাবে চেপে রেখেছে রিতির মনে হলে পাঁচ আঙুলের নখই বোধহয় চামড়া মাংস ভেদ করে নাড়ি ভুড়িতে গিয়ে ঠেকেছে। কিন্তু নড়তে পারছেনা।বিরূপাক্ষের ডান হাত রিতির বুকের উপর দিয়ে অন্য পাশ বেষ্টন করেছে।ফিস ফিস করে বললো বিরূপাক্ষ,,এই যে আয়নায় যে চেহারাটা দেখছিস না!সেটা এখনো আমার,যে মেদহীন পেটের ব্যাথায় কঁকিয়ে উঠেছিস সেখানে ও যা ইচ্ছে করার অধিকার শুধু মাত্র আমার।রিতিকে এমন ভাবে বুকের সাথে চেপে রেখেছে মনে হচ্ছে এখনি দমের অভাবে মারা যাবে। শেষ নিঃশ্বাস টুকু ছাড়ার ফাঁক নেই বোধহয়।

বিরূপাক্ষ এক ঝটকায় রিতিকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে কাঁধের দুপাশ দুই হাতে চেপে ধরে বললো পুনরায়,,যে বস্তুগুলোর জন্য আজ আমাকে ছোট মুখে বড়ো বড়ো কথা শুনিয়েছিস সেই বস্তু গুলো এখনি ইচ্ছা হলে তোকে আমি পরাতেও পারি আবার খুলতেও পারি।কেউ কিচ্ছু বলবে না ‌ আমার কথা মানতে তুই বাধ্য,,সেই অধিকার এখনো আমি রাখি সেটা তোর চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না।এত দেমাগ তুই কাকে দেখাস?যে বিরূপাক্ষ রায় চৌধুরী একবার তুড়ি বাজালে একশো মেয়ে এসে পায়ে পরবে তাকে তুই এত ঝাঁঝ দেখাস? সামান্য একজন স্বল্প শিক্ষিত প্রাইমারীর টিচার হয়ে?রাগে কাঁপছে বিরূপাক্ষ।রিতির মধ্যে পুনরায় ক্রোধ উৎপন্ন হলো সজোরে ধাক্কা দিলো বিরূপাক্ষের বুকে, ছিটকে সরে গেলো বিরূপাক্ষ,,,সতেজে বললো রিতি,,,যান আপনার শত সহস্র উচ্চ শিক্ষিত মেয়েদের কাছে !আমিতো ডাকিনি আপনাকে? কোনদিন ডাকবোও না।বিরহে পুড়ে পুড়ে মরলেও না। দৌড়ে ওয়াশ রুমে গিয়ে সজোরে দরজা লাগিয়ে দেয়। হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো বিরূপাক্ষ।কি করলো সে জেদের বশে। নিজের কাজে নিজেই ছোট হয়ে গেলো?এমন রাগ কোথা থেকে আসলো?এই ক্রোধের সাথে রূপের পরিচয় নেই।সেতো কখনো কোনো নারীর অবমাননা সহ্যও করেনি তবে আজ এই মুহূর্তে কি করলো?নিজেই একটা মেয়ের সন্মানে আঘাত করলো ?ভাবনা শক্তি তার কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে রূপের মধ্যে।

চলবে,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here