-নীর, আমি তোমাকে ভালোবাসি।খুব বেশি ভালোবাসি। তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবো না। আমাকে বিয়ে করো।
হুট করে নীশি নীরবকে জরিয়ে ধরে বলে।
প্রচন্ড বৃষ্টি, নীরব আর নীশি পাশাপাশি দাড়িয়ে ছিল। মাথা যেনো হ্যাঙ্গ হয়ে গেছে নীরবের, কি বলতেছে নীশি।পাগল হয়ে গেলো নাকি।কোনো মতে নীশির কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে দৌড়ে নিচে নেমে এলো। নিচে নেমে এসে দেখে নীরবের মা ডলি বেগম আর নীশির মা শান্তা বেগম গল্পে মশগুল। নীরব মায়ের কাছে এসে প্রায় কেদেই দিলো।
-মা দেখ না, নীশি কি বলছে। ও নাকি আমাকে ভালোবাসে। বলো মা এ কি সম্ভব?
শান্তা আর ডলি কিছুক্ষন মুখ চাওয়া চাওয়ি করে হেসে দিল। নীরব নিরাশ হয়ে ডলির পাশে বসে পরলো। আর নীশি গুটি গুটি পায়ে শান্তার কোলে বসে নীরবকে চোখ টিপ মারলো। দাড়ান দাড়ান কনফিউজড হওয়ার কিছু নেই,এই হচ্ছে নীরব আর নীশি। নীরবের বয়স এখন ৮ বছর, ক্লাস টুতে পড়ে আর নীশি ওর চাচাতো বোন বয়স ৬ বছর, মাত্র কেজিতে উঠেছে। এই ৬ বছরের পিদ্দি মেয়ে কিনা নীরবকে প্রোপজ করছে। নীরব আমাদের সোজাসাপ্টা একটা ছেলে যে কিনা ভালোবাসা কি জিনিস তাই বোঝে না। টম এন্ড জেরির মারপিট, টিনটিন আর চাচা চৌধুরীর গন্ডি থেকে যে কিনা এখনো বের হয় নি,ভালোবাসার মতো কঠিন শব্দ তার আয়ত্তের বাইরে। নীরব যখন স্বপ্ন দেখে সে অ্যাস্ট্রোনোট হয়ে আকাশে উড়বে বা ফেলু মিত্তিরের মত গোয়েন্দা হয়ে দুষ্টের দমন করবে আমাদের নীশি তখন টিভির সামনে বসে সিরিয়াল দেখে আর ভিলেনের মত ছক কষে কিভাবে নীরবকে বিয়ে করা যায়। নীরবের নীশিকে বড্ড বিরক্ত লাগে। সারাদিন বউ বউ খেলবে আর নীরবের সাথে চিপকাবে। এত কেমনে একটা মেয়ে ন্যাকা হতে পারে। ওর নাকি স্বপ্ন নীরবের বউ হওয়া। নীরবের ওর থেকে দু বছরের বড় কিন্তু এই মেয়ে ভাই তো দূরে থাক সারাদিন নীর নীর করে মাথা খাবে। অহেতুক হাত পা ছড়িয়ে নাচবে যদিও দেখে মনে হয় সাপ মোচড়াচ্ছে, তবুও এ বাড়ির সবার চোখের মনি। নীরবের মা-বাবা নীরবের থেকে নীশিকে বেশি ভালোবাসে।বলে রাখি নীরব আর নীশি একই বাড়ির উপর নিচে থাকে৷ নীরবের একদমই সহ্য হয় না নীশি কে। শুধু নীরব আর পরিবারের সামনেই ইনোসেন্ট সাজে, বাইরে পুরো ডন এই পিচ্চি।স্কুলের সবাইকে কামড়ে বেড়ায়, বদের হাড়ি। যদিও নীরব জানে কিন্তু বাড়ির কেউ তো বিশ্বাস করে না। একদিন নীরবের বাবা রাতুল সাহেব আর নীশির বাবা রিশাদ সাহেব নীরবদের ড্রয়িং রুমে বসে আড্ডা দিচ্ছিলো। সামনে টিভি চলছে আর নীশি ঘর ঘর খেলছিলো। নীশি দুইটা খালি চায়ের কাপ এনে ওদের সামনে দিলো আর বলল,
-জ্যাঠুমনি,আব্বু খেয়ে দেখ কেমন হয়েছে?
-অনেক মজা হয়েছে মা।(নীরবের বাবা)
নীরব বুঝে পাচ্ছে না চায়ের কাপে তো চা নেই কেনো ওর বাবা মিথ্যে বলছে? তারপর রাতুল সাহেব রিশাদ সাহেবকে বললেন,
-বুঝলি, রিশাদ তোর মেয়েটাকে আমায় দিয়ে দে,আমি আমার বাড়ি নীরবের বউ করে নিয়ে যাই।
একথা বলতে দেরী নাই নীশির গাল যেনো টমেটোর মত লাল হয়ে গেলো। নীরব ভেবে পাচ্ছে না এই মেয়ে এমন কেন, ওর বিয়ের কথা শুনে কান্না পাওয়ার কথা যেমনটা নীরবের কান্না পাচ্ছে।
এভাবেই দিন কাটতে থাকলো,নীশির গা ঘেসা স্বভাব বেড়ে গেলো আর নীরবের ওর প্রতি বিরক্তিও ধীরে ধীরে বাড়তে লাগলো।বড় হতে লাগলো দুজন। কিন্তু নীরবের প্রতি নীশি আকর্ষণ কমে নি। তার ধারণা সিনেমাতে যেমন ভালোবাসি বললেই বিয়ে হয়ে যায় আর তারা সারাজীবন একসাথে থাকে হয়তো বাস্তব জীবনেও তেমন। কিন্ডারগার্টেন শেষে নীরব বয়েজ স্কুলে ভর্তি হলো। আর নীশি গার্লস স্কুলে। কিন্তু নীশির এখানে ভালো লাগে না কারন নীরব নেই,নীরবের নীশিকে বিরক্ত লাগলেও নীশির একটাই ভালো ফ্রেন্ড সে হলো নীরব। নীশি চায় সারাজীবন নীরবের সাথে থাকতে।আর নীরব ছেড়ে দে মা কেদে বাঁচি টাইপ ফিল করে।
নীরব যখন ক্লাস সিক্স এ পড়ে তখন একদিন স্যারের কাছে পড়ছিল৷ স্যারের কেন জানি সেদিন নীরব কে বীজগণিত করতে দেওয়ার শখ জেগেছে। সেটাও বেপার না, তেনার ৮৩ পৃষ্ঠার ৪.১ অনুশীলনীর ৩ নম্বর অংক দেয়ার শখ জাগছে। যেই না বইটা খুললো অমনি টুপ করে একটা কার্ড টেবিলে পড়লো। কার্ডটা স্যার মহাশয় খুলেই চক্ষু চরাগগাছ। এতো প্রেমপত্র,তাও নীরবকে লেখা।
” তোমাকে ছারা জিবন বিথা, তোমাকে নিয়ে সারাদিন ভাবি, তুমি হ্যা বললে বউ হয়ে আসবো, নিজেকে মনে হচ্ছে কবি।”
লেখাটা পড়ে স্যারের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো।এ কেমন লেখা একে বানান ভুল উপরে এতো বাজে হাতের লেখা আর কি ভাষা। নীরবের আম্মুকে ডাকলো, কার্ড দেখালো আর নীরবের যা কীত্তন গাইলো তাতে নীরব সিওর আজকে ওর পৃথিবীতে শেষ দিন। কিন্তু নীরবের এখনো অজানা যে তার দোষ কি!বিদায় পৃথিবী।
রাতে শালিসি বসলো, নীরবের আব্বু-আম্মু সাথে নীশির আব্বু আম্মু আর নীশি ও ছিল। ক্লাস সিক্সের বাচ্চাকে এমন পরিস্থিতির সাম্নে আনলে কি হয় তা জানা আছে সকলের।নীরবের দিকে তাকিয়ে ওর বাবা যখন কার্ডের সত্যিটা জিজ্ঞেস করলো তখন ভয়ের চোটে কেঁদেই দিলো। কাঁদতে কাঁদতে হিচকি উঠে গেলো।কাঁদবে না কেনো, যেই ছেলে কিনা এখন চাচা চৌধুরী থেকে আপগ্রেড হয়ে তিন গোয়েন্দায় এসে ঠেকেছে।ভবিষ্যতে কিশোর হতে চায় ও কিনা প্রেম পত্র রিসিভ করবে। ওর এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। ওর কান্না দেখে নীশি ভ্যা করে কেঁঁদে দিলো। তারপর স্বীকার করলো ওটা ও লিখেছে। ওদের কান্না দেখে এরা চার জন নিষ্ঠুরের মতো হাসছে। নীশি আজ স্বীকার করলো ও এই জঘন্য কাজটা করেছে,অথচ কেউ কিছুই বলে নি,বাচ্চামি ভেবে হেসে উড়িয়ে দিল।এটায় নীরবের ছোট হৃদয় হার্ট হল। সে সিদ্ধান্ত নিল ক্যাডেট কোচিং করবে আর চান্স পেলে চলে যাবে।এটায় প্রথমে ওর বাবা-মা নারাজ হলেও পরে মেনে নিল। আফটার অল, এটা ওর ভবিষ্যতের জন্য ভালো। নীরব চান্স ও পেল বরিশাল ক্যাডেট কলেজে। নীশি সেদিন খুব কেঁদেছিল। কেঁদেছিল কারন আর নীরবকে পাবে না,কেঁদেছিল ওর বেস্ট ফ্রেন্ড ওকে একা ফেলে চলে যাচ্ছে। নীরবকে জরিয়ে ধরে বলেছিল,
– নীর আমাকে একা ফেলে যেও না,আমি কার সাথে রান্না বাটি খেলবো? আমি আর তোমায় জ্বালাবো না।গুড গার্ল হব, তোমাকে আর বকা খাওয়াবো না, ও জ্যাঠুমনি বোঝাও না।
কে শুনে কার কথা নীরব ওর কাছ থেকে যেতে পারলেই বাঁচে। নীরবের ক্যাডেটে যাওয়ার পর বাসায় খুব বেশিদিনের জন্য আশা হতো না,খুব বেশি জোর ১মাস টানা।এর বেশি না। নীরবের সাথে প্রথমে প্রথমে নীশির সাথে খুব দেখা হত। কারন নীশি করতো।তারপর ওর বয়স বাড়ার সাথে বুঝটা হলো যে নীরব ওকে পাত্তা দেয় না।নীশি হাল ছেড়ে দিল, ভাবলো নীরবের সাথে এখন দেখা সাক্ষাত কমিয়ে দেয়াই ভালো। আর সেটা তখন হবে যখন ও ওর বাড়িতে যাওয়া বন্ধ করবে। তাই করলো। নীরব তিন বছর হল নীশির মুখ ঠিক মত দেখে নি। নীশিকে বাদে খারাপ তো নেই, হ্যা অপূর্ণতা আছে।কিন্তু তা বুঝার বয়স যে তার হয় নি।বলে না ছেলেদের বুঝ মেয়েদের তুলনায় পড়ে হয়। নীরব তখন ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে। হ্যান্ডসাম ছেলে, হাইট ৫ ফুট ৯ এ ঠেকেছে।মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি,চুল গুলা আর্মি ছাট, মায়াবি চেহারা,চশমা নিতে হয়েছে পড়াশুনার খাতিরে। গতবছর এস.এস.সি দিয়েছে, রেজাল্ট খুব ভালো করেছে, গোল্ডেন পেয়েছে সে।কলেজে উঠেছে, ইয়ার ফাইনাল দিয়ে ছুটিতে বাসায় আছে।
একদিন বিকেলে……..
চলবে
হিয়ার মাঝে লুকোচুরি
১ম পর্ব
Musfikun Nesa Tanjin