হিয়ার মাঝে লুকোচুরি ২য় পর্ব

0
1776

হিয়ার মাঝে লুকোচুরি
২য় পর্ব
Musfikun Nesa Tanjin

একদিন বিকেলে, গোধুলির সময় ছাদের কর্নিশে বসে নীরব গিটার বাজাচ্ছিল, আর আনমনে গান গাইছিল।কার জন্য গাইছিল জানি নাই।
” তোমার জন্য নীলচে তারার একটু খানি আলো ভোরের রঙ রাতের মিশকালো।
কাঠগোলাপের সাদার মায়া মিশিয়ে দিয়ে ভাবি আবছা নীল তোমায় লাগে ভালো।”
হয়তো ওর হিয়ার মাঝে লুকোচুরি দেয়া ওই প্রতিবিম্বের জন্য যার ধরা এখনো মেলে নি।
হঠাৎ চোখ আটকে গেসে, এ কি,কে এই গোধুলির অসময়ে। তবে ওর চোখ ভুল দেখছে। এ এক আকাশ থেকে নেমে আসা লাল পরী, লাল শাড়ি আটপৌরে করে পরা, হাতে লাল চুরি,চুল ছাড়া।কোমড়ের আর কাধের মাঝ অবধি চুল, চুলগুলো উড়ছে যেন আজ কোনো বাধ মানবে না। মুখের উপর ছোট চুলগুলো মুখ ঢেকে দিয়েছে,বারবার সরাচ্ছে কিন্তু আবার একই কাজ করছে। দৃষ্টি তার আকাশ পানে। নীরবের ঠিক উলটো পাশে পরীটি। মুগ্ধতার সাথে নীরব পরীটিকে দেখছে কিন্তু মুখটা দেখতে পেলে ভালো হত। এটাকেই বলে হয়তো বয়ঃসন্ধিকালের হরমোনাল চেঞ্জ।এতোদিন বুঝি এই পরী ওর হিয়ার মাঝে লুকোচুরি খেলছিল।
হুট করে নীরব কিছু একটা ভেবে ভয় পেলো৷ এই বাড়িতে মেয়ে বলতে শুধু নীশি। কারন নীরব একা সন্তান আর নীশির শুধু একটা ছোট ভাই আছে। আর নীশি পরী কম নানা পাটেকার বেশি। এটা ও হওয়ার কোন প্রশ্নই উঠে না। তবে এ সত্যি কোন পরী নাকি নাকি ভূত। এসময় তো অশরীরীরা ঘুরে।আশেপাশে তাকিয়ে এই পরী আর নিজেকে বাদে কাউকে পেলো না নীরব।তবে কি এই পরী নিজের রুপে মোহিত করে ছাদ থেকে ফেলে দিবে ওকে। কিছুক্ষণ পরই তো মাগরিবের আযান দিবে।
-এ আল্লাহ কি হবে আমার
মনে মনে ভাবছে আর দোয়া ইউনুস পড়ছে নীরব। ভয় আর সংকা পেরিয়ে ধীরে ধীরে পরীর কাছে গেলো। গলা খাকাড়ি দিতেই মেয়েটি তার দিকে ফিরলো। ওর মুখটা দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস তো ফেললো নীরব কিন্তু এটাও কি সম্ভব। মেয়েটি কেউ না নীশি,নীরবের ওই নানা পাটেকার। কোন মেকাপ নেই শুধু চোখে কাজল আর ঠোঁটে লাল লিপস্টিক। এতো অপরুপ লাগতে পারে কোন মেয়েকে। গোল মুখ, গোল গোল চোখ,তার উপরে গোল গোল চশমা যা ওর মুখ আরোও গোল করে দিয়েছে।হয়তো ৫ ফুট হবে হাইট। নীরব ভাবছে নানা পাটেকার এমন পরী কিভাবে হলো,তবে কি এটাকেই বলে শৈশব থেকে কৈশোরত্তীর্ণ হওয়া। বুকের বাম পাশটা খুব জোরে জোরে ঢোল বাজাচ্ছে হাত দিয়ে থামাতে পারছে না নীরব। তবে কি এই সেই প্রতিবিম্ব, ওর মনেও বসন্ত এসেছে। হুশ এলো নীশির ডাকে,
– নীরব ভাইয়া কিছু বলবা?
– হ্যা??(নীরব)
– কিছু বলবা?(নীশি)
– না (নীরব)
– আচ্ছা তবে আমি যাই,টাটা। (নীশি)
নিরব এখনো হাদারামের মত তাকিয়ে আছে,কি বললো নীশি ওকে!! ভাইয়া!! ওর প্রেম কাহিনি কি শুরু হওয়ার আগে শেষ!!
-ধুর!কি ভাবছি!! ও আজ সেজেগুজে ছিলো তাই মোহে পড়ে গেছিলাম। ও আমার প্রিয়শী না।সম্ভবই না। কি সব ভাবছি।
একা একা কথাগুলো নিজেকে বলে নিজেকে শান্ত করলো। এর মাঝে মাগরিবের আযান দিয়ে দিয়েছে। নিজের ঘরে যেয়ে নামাজ পড়ে শুয়ে আছে। কিন্তু নীশির মুখ চোখ থেকে সরছে না। নীশি যেন ওর প্রতিটি অনুভূতির সাথে লেপ্টে আছে। কিন্তু কেন!!
নির্ঘুম রাত পার করলো নীরব। ওদিকে নীশি তো প্রশান্তির ঘুম দিচ্ছে। নীরবের আনাগোনা তার মনে বন্ধ করে দিছে। তাইতো নীর থেকে নীরব ভাইয়া হয়েগেছে। তবে মনের মাঝে নীরবের বইটা আজ ও আছে। কখন যে খুলে যাবে জানে না। এখন নিরব বাদেও নীশির অনেক বন্ধু। গার্লস স্কুলে ও যদিও টম বয় কিন্তু ভেতরের মেয়েলি ভাবটা শুধু বাসায়ই প্রকাশ করে৷ যা আজ নীরবের চোখে পরে গেছে।
দুদিন নির্ঘুম কাটিয়ে নীরবের নিজেকে মাতাল মাতাল লাগছে। ছাইপাশ না খেয়েও হাই সে। মা এক কথা বললে শুনে আরেক। তবে সে নিশ্চিত যে তার জীবনে বসন্ত এসে গেছে।আর তার প্রিয়শী আর কেউ নয় নীশি। হ্যা নীশিকে তার ভালোলাগছে শুধু নীশি তার মনে বিচরণ করছে। একটু আবার দেখতে পেতো। হুট করে মার কথায় ওর মনে হাজার লাড্ডু একসাথে ফুটলো। মা বললো,
– যা না বাবা, মামনিকে এই ডিব্বাটা দিয়ে আয়, আর বলবি নীশির জন্য হালুয়া আছে। আমি যেতাম কিন্তু কাজ আছে আমার। তুই তো খালি বাসায় আসলে খাস আর ঘুমাস যা।
– হ্যা যাচ্ছি, দাও
এক পায়ে রাজি আজ নীশির বাড়ি যেতে, নীশিকে দেখবে, আর আগের দিন এসময়ে নীশি ছাদে ছিল মানে আজও বাড়ি থাকতে পারে। ছুটে চলে গেলো নীরব নীশিদের বাসায়।নীরবের মা একটু সন্দেহ করলো তাও পাত্তা দিলেন না। দরজা যেন নীশি খুলে, কিন্তু সব স্বপ্নে পানি ঢেলে দিল নীশির ছোট ভাই নীলয়। একেই বুঝি শালা বলে।
– ও মা দেখো, সেলেব্রিটি আসছে। (নীলয়)
– ষাড়ের মতো চেচাচ্চিশ কেন?( নীশির আম্মু)
– দেখে যাও না কে এসেছে, নীরব ভাইয়া। ও তো সেলেব্রিটিই কোনোদিন নিজে আসে আমাদের বাসায়! (নীলয়)
– তোর কান ছিড়ে ফেলবো ঢুকতে দে। ( নীরব)
– নীরব বাবা, তুই কষ্ট করে এলি, ডাকতি আমি নীলয়কে পাঠিয়ে দিতাম।( নীশির আম্মু)
– তুমিও শুরু করলে মামুনি। কেন আমি আসতে পারি না?
আচ্ছা নীশি কই গো, ওর জন্য মা এই হালুয়া পাঠিয়েছে। (নীরব)
– নীশি এখানে আয়, বড় মা তোর জন্য হালুয়া পাঠিয়েছে। ( নীশির আম্মু)
নীশি বেড়িয়ে এলো ওর রুম থেকে একটা নীল রঙের গেঞ্জি আর কালো স্কার্ট পড়া ছিল। ওরনাটা কালো, পুরো শালের মত ঘেরাও দিয়ে পড়া। না আজ ও মায়াবি লাগছে। চুলগুলো এক পাশে বেনী করা আর ছোট চুলের সাথে কিছু চুল খুলে গেছে। এলোমেলো চুলে যেন অপ্সরি লাগছে। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নীরব।
-আয় আয় তুই ও দেখে নে সেলেব্রিটিকে।
নীলয়ের এই কথায় হুশ ফিরলো নীরবের। দেখে নীশি মিটিমিটি হাসছে। কোনো মতে ওর হাতে ডিব্বা দিয়ে দৌড়ে নিজের বাসায় চলে এলো। শালার শালা মান ইজ্জত আর রাখছে না। বাসায় এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। চোখে শুধু নীশির মুখ ভাসছে। তবে কি নীশিকে মন দিয়ে দিল? মনের মধ্যে কি তবে নীশির বাস এখন থেকে।

ছুটি শেষের দিকে, নীরবের যেতে হবে অথচ এখনো নীশির সাথে যে একটু কথা বলবে তা না। নীশি যেন ওর সাথে লুকোচুরি খেলছে। ওর সামনেই আসে না। নীরব ওকে দেখার জন্য উত পেতে থাকে কিন্তু বান্দির দেখা পায় না। অবশেষে একটাই উপায় হ্যা একটাই উপায় সেটা হল শালা মানে নীলয়। নীলয় পাকা একটা ছেলে, মাত্র ক্লাস সিক্সে পড়ে কিন্তু নীরবকে কিনে আবার বেঁচে দিতে পারবে। কোনোভাবে ওকে মেনেজ করলো। অনেক ঘুষ নিয়ে রাজি হল যে বোনের উপর নজর রাখবে যাতে কেউ আশেপাশে না ভিড়ে আর কেউ যদি ভিড়েও না নীরবকে জানাবে,নীরব বাড়িতে আসলে। এভাবেই ভালোই চলছিল নীরব আর নীশির লুকোচুরি। নীরব নীশির অজান্তেই ওর আশেপাশে একটা বলয় তৈরি করলো যাতে কেউ ওর প্রিয়শীকে না নিতে পারে। দেখতে দেখতে এইস.এস.সি দিলো নীরব আর নীশি এস.এস.সি। নীশি এস.এস.সি এর পড়ে কম্বাইন্ড কলেজে ভর্তি হতে চেয়েছিল কিন্তু নীরব চালাকি করে গার্লস কলেজে ভর্তি করলো। আর নীরব ও এইস.এস.সি তে এ প্লাস পেল। এখন এডমিশন বাড়ি চলে এলো। আদা জল খেয়ে লাগলো বুয়েটে ভর্তি হওয়ার জন্য কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস ও বুয়েটে চান্স পেলো না এতো ভালো ছাত্র কিন্ত বুয়েটে চান্স হলো না, হলো কুয়েটে। আবার ঢাকা ছেড়ে যেতে হবে তাকে,আবার নীশিকে ছেড়ে যেতে হবে৷ ভর্তি হলো, যাওয়ার আগে বারবার নীশিকে বলতে চেয়েছিল,
“তোমাকে ভালোবাসি। তুমি কাউকে মনে ঠাই দিয় না। আমার মনে যে তোমার বসবাস।”
না বলতে পারলো না। কারন ওর ভালোবাসা যদি মাপা হয় তা ম্যাথ ইরোর মানে ইনফিনিটি দেখাবে কিন্তু ওর সাহস মাপতে গেলে তা টু দি পাওয়ার মাইনাস দেখাবে যা স্ক্র‍গজেও মাপা যাবে না। দিন কারোর জন্য থেমে থাকে না।

নীশির কলেজ অবধি নীরব আর নীলয় পাহারা দিয়ে ঠেকিয়েছে। কিন্তু বিপত্তি হলো যখন নীশি কলেজ শেষ করলো। এত দিন যদিও নীশি গার্লস কলেজে স্কুলে পড়েছে আর প্রেম করার সুযোগ পায় নি কিন্তু এখন তো না নয় ভার্সিটিতে পড়বে, আবার ইঞ্জিনিয়ারিং এর কোচিং করছে। ওকে হারানোর ভয় জেকে ধরেছে। নীরব সেকেন্ড ইয়ার সেকেন্ড সেমিস্টার এ পড়ে নীশি বুয়েটে পরীক্ষা দিয়েছে এখন কুয়েটে দিতে আসবে। কাকুন(নীশির আব্বু) আর নীশি এসেছে খুলনায়। পরীক্ষা দেয়ার পর কাকুনের কিছু কাজ পড়ে যাওয়ায় ৫ ঘন্টার জন্য নীশিকে নীরবের কাছে রেখে খুলনার শহরে চলে গেলেন। ২টা বাজে খাওয়া দাওয়া হয় নি নীশির। ক্যাফেটেরিয়ায় খাওয়াতে নিয়ে গেলো নীরব, নীরবের কেন জানে আজকে ভালো লাগছে। নীরবের কাছে নিজেকে আর নীশিকে কাপল মনে হচ্ছে। হ্যা কুয়েটের অন্যান্য কাপলের মত ওরাও খেতে এসেছে। আহা যদি নীশি চান্স পেয়ে যায় তবে ওরাও অন্য কাপলের মত বিহেভ করতে পারবে।দুপুরে একসাথে ক্যাফেটেরিয়ায় খাওয়া ল্যাব শেষে ঘুরতে যাওয়া, বিকেলে রিকশায় ঘুরা,রুপসা ব্রিজে হাত ধরে হাঁটা, প্রেম পুকুরে বসে থাকা,নীশি ওর কাধে মাথা রাখবে আর ও নীশির হাত ধরে বসে থাকবে। আজ ওর কাছে অনেক সময় সময়। তাই আজকে ও কুয়েট কাপলের মত বিহেভ করবে। খেতে ভালো লাগসে না নীশির খুব টেনশন হচ্ছে, চান্স কি আদৌ পাবে। বুয়েটের রেসাল্টও দেয় নি। এর মধ্যে নীরবের পাগলামি, কি খাবি,আর কিছু লাগবে কিনা হাবিজাবি। খাওয়া শেষে যেখানে কাকুন আর নীশি থাকছে সে হোটেলে নিয়ে গেলো, নীশিকে ফ্রেশ হতে বললো। ফ্রেশ হয়ে দেখলো ৪ টা বাজতে চললো।
– চল তোকে ঘুরতে নিয়ে যাই, তোর মন ভালো হয়ে যাবে। (নীরব)
– কই যাবা? (নীশি)
– চলই না। (নীরব)
হোটেল থেকে বের হয়ে রিকশা ঠিক করলো। তারপর ২ ঘন্টা রিকশাতেই ঘুরলো। রিকশাতে নীশিকে নিয়ে ঘুরার ইচ্ছা যেন অনেকদিনের নীরবের কিন্তু হয় নি এই ৩ বছরে। যদিও ওর ইচ্ছা ছিল একটু কাছাকাছি বসবে কিন্তু নীশি এমনভাবে বসলো যেন এক ঝাকিতে গরিয়ে পরবে। অনেককিছু ভেবে নীরব নীশির কোমড় ধরে কাছে নিয়ে এলো। নীরবের এই কাজে হা হয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।
– এখনি তো ঝাকিতে পরে যাবি তখন কাকুনকে কে জবাব দিবে হ্যা
খুব রাগি ভাব নিয়েই বললো। নীশি শুধু মুখ চেপে হাসছে। ওর মন ভালো লাগছে এখন। ঠান্ডা বাতাসে মন চাইছে অজানায় মিলিয়ে যেতে। রুপসা ব্রিজে গেলো ওরা। অনেকক্ষন হাটলো।খুব ভালো লাগা কিছু মুহুর্ত কাটালো। নীরব বারবার মনের কথা বলতে চেয়েও বললো না। কিছু একটা এখন ও আটকাচ্ছে। তবে আজকের দিনটা বার বার উপভোগ করতে চায়। অনেক বার নীশির হাতটা ধরতে চেয়েও পারলো না। না জানি কবে পারবে???

চলবে

১ম পর্ব

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here