হৃদমাঝারে,অন্তিম_পর্ব

0
1681

#হৃদমাঝারে,অন্তিম_পর্ব
#দেবারতি_ধাড়া

-মা আর বাবাকে তো আমি অনেক কিছুই গিফট করেছি। কিন্তু তোকে কখনো কিছু উপহার দিতে পারিনি রে দিদিয়া। উপরন্তু আমি বরং তোর থেকে সব সময় সব কিছু কেড়ে নিয়েছি। কিন্তু তুই কোনো দিনের জন্যও আমার ওপর একটুও রাগ করিসনি কিংবা আমার দিকে কোনো অভিযোগের আঙুল তুলিসনি। বরং নিজের জিনিস গুলোকে জোর করে আমাকে দিয়ে দিয়েছিলি প্রতি মুহূর্তে। আর সেই জন্যই আজ এই উপহারটা শুধু তোর জন্য! এটা শুধুমাত্র তোর। এটাতে তুই ছাড়া আর অন্য কারোর কোনো অধিকার নেই দিদিয়া। আমার তরফ থেকে এটা শুধুমাত্র তোর উপহার…
-কিন্তু…
-উঁহু! আর কোনো কিন্তু নয় দিদিয়া। এটার মধ্যে কী আছে খুলে দেখবি না?

জিয়ার কথা শুনে শিয়া উপহারের বাক্সটা খুলে দেখতেই ওর চোখ ভিজে উঠলো। উপহারটা বুকের মধ্যে চেপে ধরে ও হুহু করে কেঁদেই চললো অনবরত। জিয়া তখনই শিয়ার কান্না থামানোর চেষ্টা করলো না। অন্য কেউ শিয়ার কান্না থামাতে গেলেও বরং জিয়া তাদেরকে আটকালো। বেশ কিছুক্ষণ কান্নার পর শিয়া দৌড়ে এসে জিয়াকে জড়িয়ে ধরলো। আর কম্পিত গলায় বললো,

-থ্যাংক ইউ জিয়া, থ্যাংক ইউ.. থ্যাংক ইউ… থ্যাংকস আ লট বোন… এটা আমার জীবনের সেরা উপহার জিয়া… আমি কোনোদিন ভাবতে পারিনি রে। আমি সত্যিই কোনোদিন ভাবতে পারিনি যে, আমার বই..
-আমি তো জানি দিদিয়া, আর সেই জন্যই তো সবার জন্য অন্যান্য অনেক উপহার কিনলেও তোর জন্য শুধু এই উপহারটাই আছে।
-এই উপহারটার থেকে বড়ো উপহার যে আর কিছু হয় না রে বোন। আমার যে কি ভালো লাগছে তোকে কি বলবো… কিন্তু তুই কি করে জানলি যে আমি লেখালিখি করি বলে? আমি তো আমার লেখার কথা কাউকে বলিনি!
-তুই কী আমাকে না বললে আমি জানতে পারবো না? শোন দিদিয়া, তুই যেমন আমাকে সারপ্রাইজ দিতে পারিস, তেমনটা আমিও পারি। বুঝলি?
-হুম! বুঝলাম..
-এবার বলতো, বইয়ের কভারটা কেমন হয়েছে?
-দারুণ দারুণ! সত্যিই কভারটা ভীষণ সুন্দর হয়েছ রে…
-এই ছবিটা দার্জিলিং-এর একটা ছোট্ট শহরে আমারই তোলা রে দিদিয়া। আমি জানতাম তোর ঠিক পছন্দ হবে!

ঠিক তখনই শিয়ার ফোনটা বেজে উঠলো। শিয়া ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো ওর খুব কাছের এক বন্ধু কল করেছে। কলটা রিসিভ করতেই অপর প্রান্ত থেকে বন্ধুটি বলে উঠলো,

-কংগ্ররচুলেশন আরুশি! তোর যে এতো বড়ো একটা ট্যালেন্ট আছে, সেটা তো তুই কখনও আমাদের বলিসনি!
-মানে?কিসের ট্যালেন্ট?
-আরে কিসের ট্যালেন্ট মানে? এই যে তুই এতো ভালো লিখিস, এমনকি তোর বুকও পাবলিশ হয়ে গেলো, সেটাও জানালি না আমাদের! ভাগ্যিস তনুময় আমাদের জানালো। ও ঠিক তোর সব খবরাখবর রাখে!

তনুময়ের কথা শুনেই একদম চুপ করে গেলো শিয়া। এই ছেলেটা সেই কলেজ জীবন থেকে ওর পিছনে পড়ে আছে। ওকে কতোই না দূর ছাই করেছে শিয়া, তবুও শিয়ার সব খোঁজ খবর রাখতে তনুময়ের কোনো ভুল হয় না। শিয়া জিয়ার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকাতেই জিয়া বললো,

-এতো অবাক হওয়ার কিছু নেই দিদিয়া। তুই যে এতো ভালো লিখিস, সেটা এতোদিন শুধু তুই-ই জানতিস। কিন্তু এবার থেকে সবাই জানবে যে তুই এতো ভালো লিখিস। তোকে আরও অনেক ভালো ভালো লিখতে হবে দিদিয়া! আরও বহু মানুষ তোর লেখা পড়বে। তোকে চিনবে, ভালোও বাসবে…
-উঁহু! আর কোনো কিন্তু নয়। তুই আগে আমাকে কথা দে, যে তুই লিখবি? আমার জন্য না হলেও, তুই নিজের জন্য লিখবি?
-লিখবো জিয়া, আমি তোকে কথা দিচ্ছি… আমি নিজের জন্যই লিখবো…

কেটে গেছে কয়েকটা মাস। জিয়া আর আয়ান কলকাতা থেকে শিলিগুড়িতে ফিরে এসে গুছিয়ে সংসার পেতেছে। জিয়া এখন ধীরে ধীরে পাকা গৃহিণী হয়ে উঠতে শুরু করেছে। তবে ঘরের বেশিরভাগ কাজ আয়ান নিজেই করে নেয়। জিয়াকে সেভাবে কিছুই করতে দেয় না ও। আয়ান চায়না যে, জিয়া গৃহিণী হয়ে উঠুক। ও চায় জিয়া আগে যেমনটা ছিলো, তেমনই থাকুক। সেই ছেলেমনুষী, ছটফটে, দৌরাত্ম্য করে বেড়ানো মেয়েটাকেই আয়ান ভালোবাসে। তাই ও চায় না যে, জিয়ার মধ্যে থেকে সেই সমস্ত কিছু হারিয়ে যাক। তাই জিয়া শুধু নিজের অফিস আর ফটোগ্রাফি নিয়েই ব্যস্ত থাকে সারাক্ষণ। আর আয়ান নিজের অফিসের সাথে সাথে ঘরের সমস্ত কাজও সামলায়। কোনো কোনো সময় ফটোগ্রাফি নিয়ে ব্যস্ত থাকার দরুণ জিয়া খেতে ভুলে গেলে ওকে সময়মতো খাইয়েও দেয় আয়ান। জিয়ার সাথে পাল্লা দিয়ে আয়ানও এখন বেশ ভালোই পটু হয়ে উঠেছে ফটোগ্রাফিতে। জিয়ার তোলা একের পর এক ছবি সম্মানিত হচ্ছে বিভিন্ন বড়ো বড়ো চিত্র প্রদর্শনীতে। জিয়ার ইচ্ছে মতো আয়ানও দেশ বিদেশে ঘুরে ঘুরে ওর ফটোগ্রাফিতে সাথ দেয়।

-কীরে পোলো? কী ভাবছিস এতো মন দিয়ে?
-এটাই ভাবছি যে, ভাগ্যিস সেদিন তুই আমাকে সত্যিকারের ভালোবাসার আর ইনফ্যাচুয়েশনের আসল মানেটা বুঝিয়েছিলি। তা নাহলে তো এ.আর.সির বিয়ের কথা শুনে আমি সেদিন মরেই যাচ্ছিলাম রে।
-একদম চুপ কর তুই পোলো! তুই মরে গেলে আমার কী হতো শুনি? আমি কী নিয়ে থাকতাম?
-এতো ভালোবাসিস আমায়?
-এটা এখনও অজানা তোর? সন্দেহ আছে কোনো?
-জানি না, যা তো!
-তাহলে আর জানতেও হবে না! এই নে কিটক্যাট খা…
-দে! কি হলো? দিবি তো?
-উঁহু! আগে আমারটা!

বলেই নিজের গালটা পৌলমীর দিকে এগিয়ে দিলো নিশান। নিশানের গালে আলতো করে একটা আদুরে চর মেরে ওর হাত থেকে কিটক্যাটটা কেড়ে নিলো পৌলমী।

-এই যে প্রফেসর! আজ আমি তোমার ফেভারিট ডিশ বানিয়েছি। খেয়ে বলোতো কেমন হয়েছে…
-কই দেখি দাও দাও, তাহলে তো টেস্ট করে দেখতেই হচ্ছে। এই প্রথম আমার বউ আমার জন্য আমার ফেভারিট ডিশ বানিয়েছে বলে কথা!

জিয়া প্লেটে খাবার সাজিয়ে প্লেটটা এগিয়ে দিলো আয়ানের দিকে। আয়ান প্লেট থেকে কিছুটা খাবার মুখে নিয়ে মুখের এমন একটা অভিব্যক্তি করলো, যেনো খাবারটা মুখে দেওয়ারই যোগ্য হয়নি। সেটা দেখে জিয়া মুখ ঝামটা দিয়ে বলে উঠলো,

-এই যে প্রফেসর দেখো! তুমি খুব ভালো করেই জানো আমি ঠিক মতো রান্না করতে পারি না। তাই যেমন পেরেছি, তেমনই করেছি। যা করেছি মুখ বুজে খেয়ে নেবে! আর না খেলে উঠে হাত ধুয়ে কলেজে চলে যাও! এর থেকে ভালো রান্না আমি আর করতে পারবো না। হুঁ!

কথা গুলো জোরে জোরে এবং এক নিশ্বাসে বলেই মুখ বেঁকিয়ে জিয়া রান্না ঘরের দিকে চলে গেলো। ও চলে যাওয়ার পর প্লেট থেকে পুরো খাবারটা চেটে পুটে খেয়ে প্লেটটা হাতে নিয়েই রান্নাঘরে গেলো আয়ান। রান্না ঘরে এসে জিয়াকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো ও। তারপর খালি প্লেটটা জিয়ার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,

-আর একটু পাওয়া যাবে ম্যাডাম? আমার ফেভারিট ডিশ আর তার সাথে আমার বউয়ের গরম গরম মুখ ঝামটা?
-মানে? তুমি পুরোটা খেলে? কিন্তু তুমি যে তখন খাবারটা মুখে দিয়ে মুখটা ওরকম করলে?
-আসলে তো আমি ইচ্ছে করেই মুখটা ওরকম করেছিলাম। যাতে তুমি আমার ফেভারিট ডিশের সাথে আমার ফেভারিট মুখ ঝামটাটাও দাও! তুমি তো জানোই জিয়া, তোমার মুখ ঝামটা না শুনলে আমার দিনটাই ভালো যায় না! সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে তোমার থেকে একটু বকা খেলে, তবেই যে আমার দিনটা ভালো যায়। আর আজ সকাল থেকেই দেখছি তোমার মুডটা ভালো আছে, আমাকে একটুও বকাও দাওনি। তাই তোমার থেকে একটু মুখ ঝামটা শোনার জন্যই তখন খাবারটা মুখে দিয়ে মুখটা অমন করলাম.. আমার বউটার সাথে কি একটু ইয়ার্কিও করতে পারবো না নাকি? আসলে তো খাবারটা অসাধারণ খেতে হয়েছে বললেও কম হবে! সত্যি জিয়া রান্নাটা কিন্তু তুমি ভালোই শিখে গেছো। অবশ্য কার কাছ থেকে শিখছ সেটা দেখতে হবে তো!
-তবে রে! দাঁড়াও তোমার দেখাচ্ছি মজা! মেরে তোমার ইয়ার্কি আমি বের করছি! এই রান্নাটা আমি তোমার থেকে নয়, ইউটিউব দেখে শিখেছি..

জিয়ার খুন্তির তাড়া খেয়ে সিংকের ওপরে প্লেটটা রেখে হাতটা সামান্য ধুয়ে নিয়েই রান্নাঘর থেকে দৌড় দিলো আয়ান। জিয়াও আয়ানের পিছন পিছন ঘরে এলো ওর হাতের কাছে সমস্ত প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুলো এগিয়ে দেওয়ার জন্য। একে একে আয়ানের সমস্ত প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এগিয়ে দেওয়ার পর জিয়া ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময়ই ওর হাতটা ধরে টেনে নিয়ে একদম নিজের বুকের সঙ্গে মিশিয়ে নিলো আয়ান। তারপর জিয়ার কোমরটা দুই হাতে জড়িয়ে ধরতেই জিয়া বললো,

-কী হলো? ছাড়ো আমাকে! আমার এখনও অনেক কাজ বাকি আছে প্রফেসর…

তখন আয়ান ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বললো,

-চলে যাবে বলছো যে? তোমার যে এখনও এখানে দুটো কাজ বাকি আছে! সেটা ভুলে গেলে নাকি?

-টিফিনটা রেডী হয়ে গেছে। আমাকে এক্ষুণি ওগুলো প্যাক করতে হবে। এর থেকে বেশী দেরি করলে তোমার আর আমার দুজনেরই অফিস পৌঁছাতে দেরি হয়ে যাবে! আর তাছাড়া তুমি তোমার এই অভ্যাস গুলো এবার বদলাও প্রফেসর! রোজ রোজ আমি আমার কাজ ফেলে এসে তোমার টাই বাঁধতে পারবো না।
-কিন্তু আমি তো নিজে নিজে টাই বাঁধতেই পারি না জিয়া…
-বিয়ের আগে কি করে নিজে নিজে টাই পরতে তুমি? এখন আমি এসেছি তাই তুমি ঘোড়া দেখে খোঁড়া হয়ে গেছো নাকি!
-তখন তো অর্ধেক দিন টাই পরতেই ভুলে যেতাম। আর মনে থাকলেও বেশিরভাগ দিন খাটনির ভয়ে টাই পরতাম না!
-তাহলে আজও পরতে হবে না! এবার ছাড়ো তো আমাকে!
-আচ্ছা, সে নাহয় বুঝলাম, টাই-টা নাহয় পরলাম না। কিন্তু তোমার আরও একটা কাজ যে বাকি রয়ে গেলো জিয়া!
-দেখো প্রফেসর, এমনিতেই অনেকটা লেট হয়ে গেছে আমাদের, এরপর আর লেট হলে কিন্তু বস আমাকে অফিসে ঢুকতে দেবেন না। আর তোমাকেও তোমাদের প্রিন্সিপল কলেজে ঢুকতে দেবেন না! তাই তোমার এই সব অসভ্যতামী গুলো শোনার মতো সময় আমার নেই! ছাড়ো বলছি আমাকে! প্লিজ প্রফেসর…
-না, ছাড়বো না!
-এই এক মিনিট, এক মিনিট! ছাড়বে না মানেটা কী হ্যাঁ? কলেজ যাওয়ার ইচ্ছে নেই নাকি তোমার?
-না!
-না মানে?
-না মানে, আজ আমি কলেজ যাবো না। আর তুমিও আজ অফিস যাবে না। বুঝলে?
-এই প্রফেসর! তুমি কী বলছো সেটা ভেবে বলছো তো? তুমি তো জানোই, এখন আমাদের অফিসের কাজের কেমন চাপ চলছে। তারপরেও তুমি কী করে আমাকে অফিস কামাই করতে বলছো? তোমার মতলবটা কী বলোতো?
-আমি আজ আগে থেকেই কলেজের ছুটি নিয়ে রেখেছি। তুমি শুধু অফিসে একটা কল করে বলে দাও যে তুমি আজ অফিস আসতে পারছো না। যাই হোক একটা নাহয় অজুহাত দিয়ে দিও!
-কিন্তু আমরা দুজনে একসাথে ছুটি নিয়ে বাড়িতে বসে করবো টা কী হ্যাঁ? আমি কিন্তু তোমার অসভ্যতামী সহ্য করতে পারবো না!
-কে বলেছে আমরা বাড়িতে বসে থাকবো? আজ আমরা একটা জায়গায় যাবো…
-কিন্তু কোথায় যাবো সেটা তো বলো…
-সে তুমি গেলেই দেখতে পাবে! আগে অফিসে বসকে কলটা করে তাড়াতাড়ি বাইরে এসো। প্লিজ বেশি লেট কোরোনা। আমি বাইরে ওয়েট করছি।

জিয়া আয়ানের কথার কিছু বুঝতে না পেরেই অফিসে বসকে কল করে বলে দিলো যে, ওর শরীরটা আজ খুব খারাপ লাগছে। তাই ও আজ অফিসে আসতে পারবে না। তারপরই নিজের ব্যাগ আর ফোনটা হাতে নিয়েই ঘর থেকে বেরিয়ে দেখলো আয়ান আগে থেকেই স্কুটিতে উঠে বসে রয়েছে। শুধু জিয়া গিয়ে বসার অপেক্ষা। তারপরই স্টার্ট দিয়ে দেবে ও। অন্য দিন আয়ান পিছনে বসে আর জিয়া চালায়। কিন্তু আজ আয়ান সামনের সীটে বসে থাকলেও আর কোনো প্রশ্ন না করেই জিয়া গিয়ে স্কুটিতে উঠে আয়ানের পিছনে বসে পড়লো। তারপর ওর একটা হাত রাখলো আয়ানের পেটের কাছে। ওই হাত দিয়েই আয়ানকে হালকাভাবে জড়িয়ে রাখলো জিয়া।

বেশ কিছুক্ষণ পর ওরা গিয়ে পৌঁছলো ওদের গন্তব্য স্থলে। স্কুটি থেকে নেমে জিয়া দেখলো সামনেই বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখা রয়েছে শিলিগুড়ি আন্তর্জাতিক বই মেলা। আয়ান স্কুটিটা পার্কিং জোনে পার্ক করতে গেলো। স্কুটি পার্ক করে ফিরে আসতেই জিয়া বললো,

-কী ব্যাপার প্রফেসর? তুমি আমাকে অফিস অফ করতে বললে বই মেলায় নিয়ে আসার জন্য? আমরা তো বিকেলেও আসতে পারতাম! শুধু শুধু আমার অফিসটা কামাই হয়ে গেলো! কত কাজ জমা হয়ে যাবে জানো? সব কাজ পেন্ডিং রয়ে গেলো!
-আগে তো ভিতরে চলুন ম্যাডাম, তারপর নাহয় আমাকে এসব বলবেন…

আয়ানের হাত ধরে বই মেলার ভিতরে প্রবেশ করতেই জিয়ার চোখ পড়ে গেলো বড়ো বড়ো ব্যানার গুলোতে। ওখানে শিয়ার ছবির সাথে বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখা আছে “আজ আমাদের সাথে থাকছেন বিশিষ্ট এবং সনামধন্যা লেখিকা আরুশী সেন!” দেখেই জিয়ার মনটা আনন্দে ভরে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে ওর কানে এসে পৌঁছলো মাইকে অ্যানাউন্স করা হচ্ছে, “এই মুহূর্তের সবচেয়ে বড়ো খবর হলো, আজ আমাদের মধ্যে থাকছেন বিশিষ্ট এবং সনামধন্যা লেখিকা আরুশী সেন মহাশায়া। আমাদের এবং সকল পাঠক পাঠিকা বন্ধুর অনুরোধে উনি সেই সুদূর কলকাতা থেকে আজ আমাদের মধ্যে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে উপস্থিত হবেন।” কথাটা শুনেই জিয়া লাফিয়ে উঠে জড়িয়ে ধরলো আয়ানকে। তারপর বললো,

-আজ দিদিয়া আসবে সেটা তুমি আমাকে আগে বলোনি কেনো প্রফেসর? দিদিয়া আসবে শুনে আমার যে কি আনন্দ হচ্ছে আমি সেটা তোমাকে বলে বোঝাতে পারবো না গো..
-এবার বুঝেছ তো, যে কেনো আমি আজ তোমাকে অফিস কামাই করতে বললাম?
-হ্যাঁ গো প্রফেসর বুঝেছি আমি! কিন্তু তুমি কী করে জানলে যে আজ দিদিয়া আসছে বলে?
-শিয়া কাল রাতে তোমার ফোনে কল করেছিলো, তখন তুমি ঘুমিয়ে পড়েছিলে। তাই আমিই কলটা রিসিভ করেছিলাম। তখন শিয়া বললো আজ ও শিলিগুড়িতে বই মেলায় আসছে। ওর আসাটা নাকি হঠাৎ করেই ঠিক হয়েছে, তাই তোমাকে আগে থেকে জানাতে পারেনি। তাই রাত্রি বেলা কনফার্ম হতেই তোমাকে জানানোর জন্য কল করছিলো শিয়া। ওর আসার খবরটা পেয়ে যে, তুমি আনন্দে এরকমই লাফিয়ে উঠবে, সেটা আমি আগেই বুঝতে পেরেছিলাম। তাই তোমাকে আরো একটু বেশি খুশী করার জন্য আমি সেই খবরটা কাল রাতে না জানিয়ে এখন জানালাম। কেমন লাগলো আমার সারপ্রাইজটা? বলো বলো?
-এটা কিন্তু তুমি একদম ঠিক করোনি প্রফেসর! তুমি যখন আগে থেকেই দিদিয়ার আসার খবরটা জানতে, তখন তোমার আমাকে আগেই জানানো উচিত ছিলো! আমি তো তাহলে দিদিয়ার জন্য খাবার গুলো নিয়ে আসতে পারতাম।
-আরে বাবা তুমি কি ভাবছো? তোমার দিদিয়াকে আজ বাড়ি ফিরতে দেবে? কটা দিন তোমার দিদিয়াকে এখানেই রেখে দাও। তারপর দুজন মিলে কিছুদিন গল্প আড্ডা করে কাটিয়ে তারপর ওকে ছাড়বে! আমিও একটু তোমার মুখ ঝামটার থেকে বাঁচতে পারবো! হ্যাঁ একটা কথা, আজ যখন তুমি আমার জন্য ভালো ভালো রান্না করেছিলে, আমি তো ভাবলাম তুমি বোধহয় জেনেই গেছো তোমার দিদিয়া আসছে বলে! ভাবলাম তোমাকে দেওয়া আমার সারপ্রাইজটাই মাটি হয়ে গেলো বুঝি। কিন্তু তারপর দেখলাম না, জানতে পারোনি এখনও। তাই একটু নিশ্চিন্ত হয়েছিলাম। ওই তো মাইকে অ্যানাউন্স হচ্ছে শিয়া নাকি চলে এসেছে। চলো চলো তাড়াতাড়ি চলো!

জিয়া আয়ানের হাত ধরে এগিয়ে গেলো বই মেলার গেটের দিকে। শিয়া ফ্লাইটে এসেছে। এয়ারপোর্ট থেকে পাবলিশার্সের গাড়ি গিয়ে শিয়াকে নিয়ে আসতে গিয়েছিলো। ও এসে পৌঁছানো মাত্রই সবাই ঘিরে ধরেছে শিয়ার গাড়িটাকে। সেই ভিড় কাটিয়ে জিয়া গিয়ে জড়িয়ে ধরলো শিয়াকে।

-তোকে কতো দিন পর দেখলাম রে দিদিয়া! এখন তো তুই সেলিব্রেটি হয়ে গেছিস। এই কয়েক মাসের মধ্যেই তোর কতো গুলো বই পাবলিশ হয়ে গেলো। কতো মানুষের কাছে আজ তুই পরিচিত মুখ! আজ আমার খুব আনন্দ হচ্ছে রে দিদিয়া.. আমার দিদিয়াকে এতো মানুষ ভালোবাসে, এটা ভেবেই যে আমার কী ভালোলাগছে তোকে কী বলবো..
-এই সব কিছুই তো তোর জন্যই সম্ভব হয়েছে বোন। তুই যদি সেদিন আমার প্রথম বইটা পাবলিশ না করতিস, তাহলে তো আমি নিজেই জানতে পারতাম না, যে আমি এতো ভালো লিখি বলে!
-সেসব কথা ছাড় তো! আমি সেদিন তোর বুক পাবলিশ না করলেও তোর লেখার গুণেই তোর বুক পাবলিশ হতো! এখন চল, ওদিকে তোর জন্য তোর অন্যান্য পাঠক পাঠিকারা অপেক্ষা করছেন। আমরা নাহয় বাড়ি ফিরে রাতে অনেক গল্প করবো। তোর কিন্তু এখন বেশ কিছুদিন কলকাতায় ফেরা হবে না। আমাদের কাছেই থাকবি কিছুদিন।
-না রে জিয়া, এখন তো আমি এখানে থাকতেই পারবো না! কাল, পরশু দুদিনই আমার পাবলিশার্সদের সাথে মিটিং আছে। সেগুলো ক্যান্সেল করা সম্ভব নয়। তাই এখান থেকেই আমাকে ফিরে যেতে হবে।

শিয়ার ফিরে যাওয়ার কথাটা শুনে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো জিয়ার। তবে শিয়ার এতো বিখ্যাত একজন লেখিকা হয়ে যাওয়ার আনন্দের কাছে সেই মন খারাপ বড়োই ফিকে হয়ে যায়। তাই সামান্য মন খারাপকে পাত্তা না দিয়ে আনন্দটাকেই প্রাধান্য দিলো ও। জিয়ার মন খারাপের কারণটা বুঝতে পেরে পাশ থেকে আয়ান বললো,

-আচ্ছা, তোমাদের দুই বোনের কথা বার্তা নাহয় পরে হবে। এখন চলো, বই মেলার ভিতরে সবাই শিয়ার জন্য অপেক্ষা করে আছে তো!
-হ্যাঁ চলো.. চল দিদিয়া…

তারপর ওরা সবাই এগিয়ে গেলো বইমেলার ভিতরে যেখানে শিয়ার জন্য অন্যান্য পাঠক, পাঠিকারা এবং পাবলিশার্সের মালিকরা অপেক্ষা করে আছেন।

বেশ কিছুক্ষণ ধরে শিয়া পাঠক, পাঠিকাদের উদ্দেশ্যে নিজের সাক্ষরসহ, শুভেচ্ছা বার্তা লিখে চলেছে ওরই লেখা নতুন বই গুলোর প্রথম পৃষ্ঠাতে। শিয়ার এক পাশে বসে রয়েছে জিয়া, আর অন্য পাশে বসে আছে আয়ান। শিয়া ডান হাত দিয়ে বইতে শুভেচ্ছা বার্তা লিখলেও, ওর বাম হাতটা টেবিলের ওপর রাখা বইটার ওপরেই আছে। হঠাৎই আয়ানের চোখ পড়ে গেলো শিয়ার বাম হাতের দিকে। ও দেখলো শিয়ার হাতে এখনও সেই আংটিটা রয়েছে, যেটা আয়ান আর শিয়ার আশীর্বাদের দিন আয়ান শিয়ার হাতে পরিয়ে দিয়েছিলো। আসলে আশীর্বাদের দিন রাত পর্যন্তও শিয়া আয়ানকে নিজের স্বামীর আসনেই বসিয়েছিলো। সেদিন রাতে সবটা জানার পরেও ওর পক্ষে আর আয়ানের পরিয়ে দেওয়া সেই আংটিটা নিজের হাত থেকে খুলে ফেলা সম্ভব হয়নি। যদিও জিয়া বা আয়ান কারোর প্রতিই ওর কোনো রাগ বা অভিমান নেই, তবুও ওই আংটিটা যেনো শিয়ার কাছে এখনও খুবই মূল্যবান রূপে সযত্নে রয়েছে। জিয়া সবটা জেনেও কিচ্ছুটি বলেনি শিয়াকে। শিয়া এখন ওর মণি, পাপান, বাবা এবং মা এই চারজনের সাথেই এক বাড়িতে থাকে। একই বাড়িতে এই পাঁচজন সদস্য ভীষণ সুখে বসবাস করে। এদিকে জিয়া আর আয়ানেরও খুব সুখের সংসার…

সমাপ্ত।।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here