হৃদমাঝারে,একাদশ_পর্ব

0
520

#হৃদমাঝারে,একাদশ_পর্ব
#দেবারতি_ধাড়া

-হ্যাঁ এই তো শোবো.. দিদিয়া? তুই শুবি না?
-আমি একটু পরে শোবো রে জিয়া। তুই ঘুমিয়ে পড়..
-কেন দিদিয়া? তুই কী করবি এখন?
-আমার একটু কাজ আছে রে। আর তাছাড়া আমি অন্য দিন এতো তাড়াতাড়ি ঘুমাইও না।
-আরে দিদিয়া তোকে এতো তাড়াতাড়ি ঘুমাতে কে বলেছে? আমিও কী এতো তাড়াতাড়ি ঘুমাই নাকি? কতোদিন পর তোর সাথে দেখা হলো আমার। আজ সারারাত আমি আর তুই গল্প করবো! তোর হবু বরের কথা শুনবো। তোর হবু বরকে কেমন লাগলো সেসব কথা শুনবো..
-সেসব কথা পরে হবে জিয়া। তোকে দেখে মনে হচ্ছে তুই খুব টায়ার্ড হয়ে গেছিস। আজ বরং ঘুমিয়ে পড়, কাল নাহয় সারারাত জেগে গল্প করবো আমরা..

শিয়া ঘরের বড়ো আলোটা নিভিয়ে দিয়ে নাইট ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে দেওয়ার পর টেবিলের ওপর রাখা টেবিল ল্যাম্পটা জ্বেলে টেবিলের সামনে চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসে গল্পের বই নিয়ে পড়তে শুরু করছিলো। তখনই জিয়া বিছানা থেকে উঠে এসে পিছন থেকে শিয়াকে জড়িয়ে ধরলো। হঠাৎ করে এভাবে জড়িয়ে ধরতে দেখে শিয়া বললো,

-কী হলো বোন? তোর ঘুম আসছে না?
-দিদিয়া তোর এখনও সেই গল্পের বই পড়ার অভ্যাসটা আছে, তাইনা? কই দেখি দেখি কী গল্পের বই পড়ছিস রে?

জিয়া টেবিল থেকে বইটা নিয়ে পাতা উল্টোতে শুরু করলো। গল্পের বই তো দূরের কথা, নিজের পড়ার বইয়ের সাথেই কোনো দিন ওর সেভাবে সখ্যতা ছিলো না। তাই অত্যন্ত নাম করা কোনো ঔপন্যাসিক বা ঔপন্যাসিকার নামও ওর অজানাই। কোনো এক অপরিচিত লেখকের উপন্যাসের বই দেখে জিয়া বইটা বন্ধ করে টেবিলে রেখে দিলো। তারপর শিয়াকে জড়িয়ে ধরেই বললো,

-ওই দিদিয়া শোন? তোকে আর আজ গল্পের বই পড়তে হবে না। আমি জানি তুই কোনো উপন্যাস পড়তে শুরু করলে সেটা যতোক্ষণ না পড়া শেষ হয়, তোর ঘুম আসে না! কিন্তু প্লিজ আজ আমি আর তুই গল্প করবো। চলনা রে দিদিয়া?
-আচ্ছা ঠিক আছে জিয়া, তাই চল..

শিয়া জিয়ার সাথে বিছানায় গিয়ে বসলো। তারপর জিয়া বললো,

-আচ্ছা দিদিয়া, তুই এতো চুপচাপ থাকিস কী করে বলতো? আমার তো বেশি বেশি কথা না বললে পেটের ভিতরটা কেমন যেন গুড়গুড় করে! যতোক্ষণ না কথা বলে সবটা উগরে দিই, ততোক্ষণ পেটটা ক্লিয়ার হয় না!

জিয়ার কথা শুনে স্মিতহাসি হাসলো শিয়া। তারপর বললো,

-আসলে আমার কথা বলার থেকেও শুনতে বেশি ভালো লাগে জিয়া। ভালো বক্তা তো সবাই হতে পারে, কিন্তু ভালো শ্রোতা আর কতজন হতে পারে বল? তাই আমি চেষ্টা করি একজন ভালো শ্রোতা হওয়ার। সবার কথা শুনে তাদের সমস্যা গুলো বোঝার চেষ্টা করি আমি। বুঝলি?
-সত্যি দিদিয়া! তুই কী সুন্দরভাবে কথা বলতে পারিস রে। আর আমি তো যা মনে আসে তাই বলে দিই, কে কী ভাববে না ভাববে সেসব একবারও ভাবিও না। আমি চাইলেও কিছুতেই তোর মতো হতে পারবো না!
-সেটা কী খুব জরুরী জিয়া? সবার মধ্যেই তো নিজের একটা সত্তা থাকে, তাইনা? আর সেটাই তো তার নিজের পরিচিতি। এই পরিচিতিটা যদি না থাকে, তাহলে তো নিজের নিজস্বতাটাই হারিয়ে যাবে বোন..

শিয়ার কথা শুনে হাঁ করে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো জিয়া। এতো আস্তে, এতো ধীরে আর সুন্দরভাবে কথা বলতে জিয়া কোনো দিন পারে না। ও যেমন সবসময় ছটফট করে, দৌড়াদৌড়ি করে, ওর কথা বলার ধরনটাও সেই একইরকম। কিন্তু শিয়া একেবারে তার উল্টোটা। শুধুমাত্র ওদের দুজনকে দেখতেই যা হুবহু একরকম। তবে আধুনিকতার সাথে তাল মিলিয়ে জিয়া নিজেকে আধুনিক করে তুললেও, শিয়া নিজেকে সেভাবে বদলে ফেলতে বা নিজেকে আধুনিকমনস্ক করে তুলতে পারেনি। হালকা টিমটিমে আলোয় প্রথম দিকে ওদের মুখ গুলো স্পষ্টভাবে বোঝা না গেলেও আলোটা একটু চোখে সয়ে যাওয়ার পর ভালোই বোঝা যাচ্ছে ওদের মুখ গুলো। জিয়া অনেক্ষণ ধরে শিয়ার দিকে একভাবে তাকিয়ে থাকার পরে শান্ত স্বরে বললো,

-ওই দিদিয়া! তুই প্লিজ এতো কঠিন কঠিন কথা বলিস না! আমি এতো কঠিন কঠিন কথা কিছুতেই বুঝি না! আচ্ছা দিদিয়া, তোর মা-বাবার সাথে কথা হয়েছে?

জিয়ার মুখে মা-বাবার কথাটা শুনেই শিয়ার চোখে জল চিকচিক করে উঠলো। অস্পষ্ট আলোয় মুখটা আবছা লাগলেও, শিয়ার চোখের জলটা ভালোই দেখতে পেলো জিয়া। ও বুঝতে পেরেছে মা-বাবার কথা শুনে ওর দিদিয়া কষ্ট পেয়েছে। কিন্তু কীসের যে এতো কষ্ট সেটা ও বুঝে উঠতে পারে না, সেই ছোটোবেলা থেকেই জিয়া বুঝতে পারে না। জিয়া অনেকবার শিয়াকে জিজ্ঞেস করেছে যে ও মা-বাবার সাথে সেভাবে কথা বলে না কেন, কেন ও জিয়ার মতো মন খুলে মা-বাবার সাথে মিশতে পারে না, কথা বলতে পারে না। কেন যে শিয়ার সাথে ওর মা-বাবার এতোটা দূরত্ব গড়ে উঠেছে, তার কারণও জিয়ার অজানা। জিয়া যখনই কলকাতায় আসে, তখনই শিয়াকে বলে বাবা-মায়ের বাড়িতে গিয়ে কয়েকদিনের জন্য থাকতে। কিন্তু শিয়া কিছুতেই যায়নি কোনো এক দিনের জন্যও। তাই জিয়া-ই ওর পিসির বাড়িতে এসে থাকে শিয়ার সাথে। জিয়া অবশ্য কোনো দিন সেসব কারণ খোঁজার চেষ্টাও করেনি। কিন্তু আজ কেন জানে না, জিয়ার খুব ইচ্ছে করতে সেই কারণ গুলো খুঁজে বের করতে। তখন শিয়া আসার আগে ওর ডায়েরিটা সেভাবে পড়তেও পারেনি জিয়া। আর শিয়া এসেই তাড়াহুড়ো করে ডায়েরিটা তুলে দিয়েছে আলমারির মধ্যে। তবে যেটুকু পড়েছে, সেটুকুতে কিছুই বোঝেনি ও। তাই ও মনে মনে ভাবলো, ওই ডায়েরির মধ্যেই নিশ্চয়ই এমন কিছু আছে, যার থেকে জিয়া কিছুটা হলেও বুঝতে পারবে। তখন শিয়ার ডায়েরির একটা কবিতা পড়তে শুরু করেছিলো জিয়া। কবিতাটা পড়ার পর থেকেই যেন কিছু একটা চিন্তা বারবার ভাবাচ্ছিলো জিয়াকে। সবটা মনে না পড়লেও কবিতার প্রথম কয়েকটা লাইন ওর মনে আসছিলো। সেগুলো কিছুটা এরকম-

“জানি আমি ছুঁড়ে ফেলা কোনো এক মূল্যহীন ফুল,
ফুটেছিলাম খাদের ধারে, বলো কীই বা মোর ভুল?
না চাইতেই এসেছি পৃথিবীতে, এটাই কী আমার অপরাধ?
তবে তোমরা ক্ষমা করো মোরে, কথা দিলাম আমি বিসর্জন দেবো নিজের সব শখ-সাধ!
এক ফুল পূজার থালায়, গাঁথা হবে মালা;
আর অপরটি মাটিতে পড়ে, বোঝো কী তার জ্বালা?”

শিয়াকে চুপ থাকতে দেখে কথাটা ঘুরিয়ে দিয়ে জিয়া বললো,

-কীরে দিদিয়া? তোর ঘুম পাচ্ছে নাকি? তাহলে চল আমরা এখন ঘুমিয়ে পড়ি। কাল সকালে উঠে খুব গল্প করবো।
-আচ্ছা ঠিক আছে, তুইও ঘুমিয়ে পড়! গুড নাইট!
-হ্যাঁ, গুড নাইট দিদিয়া!

শিয়া কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লেও জিয়ার চোখে কিছুতেই ঘুম আসছিলো না। বারবার ওর শিয়ার লেখা কবিতাটার কথাই মনে পড়ে যাচ্ছিলো। আর ভীষণ চাপা একটা কষ্টও হচ্ছিলো। তার ওপর আয়ানের সাথে শিয়ার বিয়ের ঠিক হওয়াটাও কেমন যেন ভাবাচ্ছিলো জিয়াকে। এতো কিছুর মাঝে নিজের ফোনের সুইচটা অন করতেই ভুলে গিয়েছিলো জিয়া। ওর হঠাৎ করেই শিয়ার ডায়েরিটা পড়তে ইচ্ছে হলো। ওর ভীষণ জানতে ইচ্ছে হলো কেন শিয়া খুব প্রয়োজন ছাড়া নিজের মা-বাবার সাথে কথা বলে না। কেন ওই বাড়িতে যেতে চায় না শিয়া। আর এরকম একটা কষ্টের কবিতাই বা কেন লিখেছে শিয়া। এসব ভাবতে ভাবতেই উঠে বসে বালিশের পাশে রাখা চশমাটা চোখে পড়ে নিয়ে বিছানা থেকে নামলো জিয়া। তারপর ধীর পায়ে নিয়ন আলোতেই আলমারি খুলে শিয়ার ডায়েরিটা বের করলো। ডায়েরিটা হাতে টেবিলে গিয়ে টেবিল ল্যাম্পটা জ্বেলে ডায়েরির পাতা উল্টোতে শুরু করলো জিয়া। প্রতিটা ডায়েরির পাতাতে প্রতিদিনের যাবতীয় অভিজ্ঞতার কথা লিপিবদ্ধ করে রেখেছে শিয়া। ওর মনের দুঃখ গুলো, কষ্ট গুলো, আনন্দ গুলো, ভালো লাগা আর খারাপ লাগার সব মুহূর্ত গুলো লিখে রেখেছে। আর তার মাঝে মাঝে অনেক গুলো কবিতাও রয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে জিয়া ডায়েরির লেখার শেষের দিকে পৌঁছে গেলো। আজ সারাদিনের অভিজ্ঞতা গুলো পড়ে শিয়ার মনের কথা জানার জন্য। পড়তে শুরু করলো জিয়া,

“আজ আমার জীবনের একটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দিন। আজ আমার হবু শ্বশুর বাড়ি থেকে আমাকে দেখতে আসা হবে। আর যদি আমাকে দেখে ওনাদের ভালো লেগে যায়, তাহলে আজই বিয়ের পাকা কথা সাড়া হবে। কারণ পাত্রকে কিছুদিন পরেই নাকি শিলিগুড়ি ফিরে যেতে হবে। যদিও আমার ছবি দেখে ওনাদের খুব পছন্দ হয়েছে। তবুও আমি জানিনা আমাকে সামনে থেকে দেখে ওনাদের পছন্দ হবে কিনা। তবে আপনার যদি আমাকে পছন্দ নাও হয়, তাহলেও আমার কোনো কষ্ট হবে না। আসলে ছোটো থেকেই আমার ভালো লাগা বা খারাপ গুলোকে কখনোই গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। আমি সবার ইচ্ছে অনুযায়ী চলতে চলতে নিজের অস্তিত্বটাই হারিয়ে ফেলতে বসেছি। জানিনা আর কখনও নিজের অস্তিত্বটা খুঁজে পাবো কিনা! তবে আমার কারোর কাছে কোনো অভিযোগ নেই। আমি কাউকে কোনো দোষারোপ করিনি কখনও। আর করতেও চাই না। এই সব কিছুর জন্য আমি আমার নিজের ভাগ্যকেই দোষারোপ করতে চাই। ছোটো থেকে বাবা-মায়ের ভালোবাসা পাওয়াটা হয়তো আমার ভাগ্যেই ছিলো না। আর সেই জন্যই নিজের মা-বাবা থাকা সত্ত্বেও আমাকে মণি আর পাপানের কাছে থাকতে হয়েছে ছোটো থেকে। ওদের ইচ্ছে মতো মানুষ হতে হয়েছে। পড়াশোনা করতে হয়েছে বেঙ্গলী লিটারেচর নিয়ে। কখনোই মুখ ফুঁটে বলতে পারিনি আমি কী চাই। কোনটা আমার ভালো লাগা বা কোনটা আমার খারাপ লাগা! ভালো না লাগলেও, ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও প্রতিদিন রান্না ঘরে গিয়ে পিমণির থেকে রান্না শিখতে হয়। যাতে শ্বশুর বাড়ি গিয়ে রান্না না জানার কারণে কথা শুনতে হয়। নিজের ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও গ্র‍্যাজুয়েশনের পর আর মাস্টার্স করতে পারিনি। মণির কথায় “কী হবে মেয়েদের এতো পড়াশোনা করে? সেই তো বিয়ের পর শ্বশুর বাড়ি গিয়ে সংসার ঠেলতে হবে আর বাচ্চা সামলাতে হবে। বাচ্চাকে পড়াশোনা করানোর জন্য যেটুকু দরকার সেটুকু জ্ঞান থাকলেই যথেষ্ট। আমিও মুখ বুজে মেনে নিয়েছি সবটা। যদিও মা-বাবা আমাকে ওই বাড়িতে নিয়ে গিয়ে আরও পড়াশোনা করাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আমার আর ইচ্ছে হয়নি! আর আমার যে বাড়িতে বিয়ের কথা হচ্ছে, সেই বাড়িতে নাকি আমার খুব বেশি পড়াশোনা না করা থাকলেও কোনো অসুবিধে নেই। তাদের আমাকে পছন্দ হয়েছে। কেন পছন্দ হয়েছে? না, আমি শান্ত, নম্র, ভদ্র তাই! আমি ভীষণ চুপচাপ স্বভাবের তাই। কারণ একটু বেশি কথা বললেই যে নিজের ইচ্ছের পক্ষে কথা বলা হয়ে যায়। আর সেই ইচ্ছে গুলো হয়তো আমার অপর প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ গুলোর ইচ্ছের বিরুদ্ধও হতে পারে। তবে আমার চুপ করে থাকতে কোনো অসুবিধা নেই। আমি এরকমই ভালো আছি। যাক সেসব কথা! আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার হবু শ্বশুর বাড়ি থেকে আমাকে দেখতে চলে আসবে! জিয়া আমাকে তৈরী করার জন্য ডাকছে!”

দুটো পাতা পড়ার পর একটু থেমে আবারও পড়তে শুরু করলো জিয়া,

“আজ আপনি আমাকে সামনে থেকে দেখলেন। আমিও আপনাকে সামনে থেকে দেখলাম। আমি জানিনা আপনার আমাকে দেখে কেমন লেগেছে, তবে আমার আপনাকে বেশ ভালোই লেগেছে। জানেন, আপনাকে না খুব চেনা লাগছে। কেন চেনা লাগছে ঠিক মনে করতে পারছি না। তবে আমি কয়েকদিন আগেই একটা উপন্যাস শেষ করেছি। সেই উপন্যাসের যে পুরুষটি আমার সবচেয়ে প্রিয় চরিত্র ছিলো, ঠিক যেন সেইরকম লাগলো। গালে হালকা চাপ দাড়ি, চোখে কালো ফ্রেমের চশমা, চেহারাটাও বেশ স্বাস্থ্যবান। গলার স্বরটাও বেশ গম্ভীর আর ভারী, শুনলে মনে হয় আরও বেশি বেশি শুনি। তবে আমার উপন্যাসের ওই প্রিয় পুরুষটির সাথে আপনার একটাই পার্থক্য! কী বলুন তো? আমার ওই প্রিয় পুরুষ চরিত্রটি আপনার মতো এতো লাজুক ছিলো না! প্রথম দেখাতেই তো সে তার প্রিয়তমাকে আলিঙ্গন করে তার শরীরে আদর মেখে দিয়েছিলো। কই, তার তো এতো লজ্জা ছিলো না! তবে আপনি কেন এতো লাজুক? আপনি তো ঠিক মতো কথাই বললেন না আমার সাথে! কিন্তু আপনি আমার দিকে ওভাবে তাকিয়ে ছিলেন কেন?! আমার কী লজ্জা করে না নাকি শুনি? আপনি তো আমার দিক থেকে চোখই সরাচ্ছিলেন না। তাহলে আমার সাথে ঠিক করে কথা বললেন না কেন শুনি? আচ্ছা, উপন্যাসের সাথে সত্যিই কী বাস্তবের কোনো মিল পাওয়া যায় না? প্রথমে কিন্তু আমার খুব রাগ হয়েছিল আপনার ওপর, আপনি ওভাবে কিছু না বলে চলে যাওয়াতে! খুব অভিমান হয়েছিলো আপনার ওপর। ভেবেছিলাম আর কথাই বলবো না আপনার সাথে। কিন্তু তারপর যখন আপনার মায়ের মুখে শুনলাম আপনি সত্যি সত্যিই হয়তো লজ্জা পেয়েছেন, তাই আর অভিমান করে থাকতে পারলাম না আপনার ওপর। তবে হ্যাঁ, এরপর কিন্তু আর এমন করবেন না বলে দিলাম! তাহলে কিন্তু আমি সত্যি সত্যি আর কথা বলবো না আপনার সাথে! আমি ছোটো থেকে আমার বাবা-মায়ের সাথে থাকতে পারিনি, পরিস্থিতির চাপে পড়ে। তাই নিজের সুখ-দুঃখ গুলোর কথা বাবা-মায়ের সাথে ভাগ করে নিতে পারিনি। এমনকি বোনের সাথেও ভাগ করে নিতে পারিনি। আমি আর আমার বোন দুজন একদম আলাদা রকমের। ও যেমন মন খুলে কথা বলতে পারে, আমি তেমনটা পারি না! আমি সব কথা সবাইকে বলতে পারি না। কিন্তু আমি আপনাকে বলতে চাই। আপনার সাথে আমার সব লুকানো কথা গুলো ভাগ করে নিতে চাই। অন্য সবার মতো আমিও চাই, আমারও একটা নিজের মানুষ হোক। ঠিক যেমন উপন্যাসে নারী-পুরুষরা একে অপরের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকে, আমিও সেরকমই জড়িয়ে থাকতে চাই আপনার সাথে। আমার নিজের পুরুষটার সাথে। একদম নিজের করে রাখতে চাই আনপনাকে। আর কয়েকদিন পরেই আপনার সাথে আমার বিয়ে। তার আগে আশীর্বাদ। আশীর্বাদের দিন আবারও আমি আপনার মুখোমুখি হবো। তখন যেন আর আপনি লজ্জা পাবেন না। আমার কাছে লজ্জার কী আছে শুনি? এতো কিছুর মাঝে আপনার নামটাই যে জানা হলো না। কী নাম আপনার? সে থাক, আশীর্বাদের দিনেই নাহয় জেনে নেওয়া যাবে। যাইহোক, আজ আর কিছু লিখছি না। আজ রাতেও হয়তো আর ডায়েরি লিখতে পারবো না। জিয়া রাতে আমার সাথেই শোবে। আবার কাল সকালে লিখতে বসবো।”

ডায়েরিটা পড়তে পড়তেই চোখে জল এসে গিয়েছিলো জিয়ার। শিয়ার কথা ভেবে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে ওর। ও মনে মনে বললো, “সত্যিই তো দিদিয়া মা-বাবার আদর, ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। আর কেনই বা দিদিয়া আমাদের সাথে না থেকে পিমণি আর পিসানের সাথে থাকে? কেন? আমাকে জানতেই হবে.. আমি বুঝতে পেরেছি দিদিয়া, আমি বুঝতে পেরেছি কেন তোর মনে এতো কষ্ট। আর কেনই বা তুই এতো চুপচাপ থাকিস সবসময়! এতোদিন কেন তুই আমাকে তোর কষ্ট গুলোর কথা আমাকে বলিসনি দিদিয়া? সরি দিদিয়া! আমি সত্যিই খুব সরি রে.. আমি যতো বারই তোর কাছে এসেছি, ততোবারই কেন তুই আমার কাছ থেকে দূরে থাকতে চেয়েছিস। কেন মা-বাবা তোর জন্য কিছু পাঠালেও তুই নিতে চাস না। আমি বুঝেছি দিদি, আমি বুঝেছি তোর কষ্টের কারণ গুলো। আমি তোকে কথা দিচ্ছি দিদিয়া, আমি তোকে কথা দিচ্ছি যে তোকে আর কোনো কষ্ট পেতে দেবো না। আমি কালই মা-বাবার সাথে কথা বলবো। আমি মা-বাবাকে জিজ্ঞেস করবো যে, কেন তোকে পিমণি আর পিসানের কাছে রেখে গিয়েছিলো। কেন মা-বাবার স্নেহ, মমতা আর ভালোবাসা থেকে তোকে বঞ্চিত হতে হয়েছে। মা-বাবা কেন আমাদের দুজনকে একসঙ্গে মানুষ করেনি! কেন ওরা তোকে এতো কষ্ট দিয়েছে। আমার এইসব প্রশ্নের উত্তর দিতেই হবে মা-বাবাকে। আর আমি প্রফেসর বাবুকেও বলবো, যাতে তোকে কোনো দিন কোনো কষ্ট পেতে না দেয়। সারাজীবন যেন তোর ওই উপন্যাসের প্রিয় পুরুষের মতো তোকেও আগলে রাখে। তোকে যেন খুব খুব ভালোবেসে যত্নে রাখে।”

ডায়েরিটা বন্ধ করে দিয়ে সযত্নে আলমারিতে তুলে রাখলো জিয়া। তারপর টেবিল ল্যাম্পটা নিভিয়ে দিয়ে শিয়ার পাশে গিয়ে শুয়ে পড়লো। ঘুমন্ত শিয়ার মুখটা দেখে বড্ড মায়া লাগলো জিয়ার। ওর চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা জলও গড়িয়ে পড়লো। জিয়া সযত্নে শিয়ার কপালে পড়ে থাকা এলোমেলো চুল গুলোকে সরিয়ে দিয়ে ওর কপালে একটা স্নেহের আদর এঁকে দিলো। তারপর সেই ছোটোবেলাকার মতো শিয়াকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়লো। ছোটোবেলা থেকেইে শিয়া জিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে ওকে ঘুম পাড়িয়ে দিতো। আজ জিয়া পরম স্নেহে ঠিক একইভাবে শিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো। তারপর কখন যে ঘুমন্ত দিদিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নিজেও ঘুমিয়ে পড়েছিলো সেটা ও বুঝতেই পারেনি।

সকালে সবার ওঠার আগেই জিয়া ঘুম থেকে উঠে পড়েছিলো। তারপর কাউকে কিছু না বলেই পিসির বাড়ি থেকে বেরিয়ে নিজের বাবা-মায়ের কাছে ছুটলো..

ক্রমশ…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here