#হৃদমাঝারে,প্রথম_পর্ব
#দেবারতি_ধাড়া
গাড়িটা চলেছে “হোটেল স্নো হোয়াইট”-এর উদ্দেশ্যে। চারিদিক তখন শ্বেতশুভ্র বরফে আবৃত। সকাল প্রায় সাড়ে সাতটা বেজে গেলেও সূর্যদেবের কোনো দেখাই মেলেনি এখনো পর্যন্ত। ড্রাইভারের পাশের জানলাটা মাঝে মাঝে অল্প খুলে রাখার কারণে কাঁচের ফাঁক দিয়ে আসা কনকনে ঠান্ডা বাতাস মাঝে মাঝেই কাঁপিয়ে দিয়ে যাচ্ছিলো গাড়ির ভিতরে থাকা মানুষ গুলোকে। অফিসের কয়েকজন কর্মচারীকে নিয়ে ছোট্ট একটা ট্যুরে বেরিয়েছে গাড়িটা। অনেক ভোরে উঠতে হয়েছে সবাইকে। শিলিগুড়ি থেকে প্রায় ভোর পাঁচটা নাগাদ বেরিয়েছিলো গাড়িটা। মাঝে শুধু রাস্তায় একটা চায়ের দোকানে চা খেতে নেমেছিলো সবাই মিলে। তারপর আবারও গাড়িতে উঠে বসেছে। মেঘ গুলো গাড়ির কাঁচে এসে ধাক্কা মারছে বহুক্ষণ আগে থেকেই। একমাত্র ড্রাইভারের কাছের জানলার কাঁচটা মাঝে মাঝে একটু খোলা থাকলেও গাড়ির বাকি সব কাঁচ গুলো তোলাই ছিলো বাইরে থেকে কনকনে ঠান্ডা হাওয়া ঢোকার কারণে। চা খেয়ে আবার গাড়িতে উঠে প্রায় সবারই একটু চোখ লেগে গিয়েছিলো একমাত্র জিয়ার ছাড়া। হঠাৎ করেই জিয়া নিজের পাশের জানলার কাঁচটা নামিয়ে দেওয়ার কারণে একরাশ হিম শীতল ঠান্ডা বাতাস এসে সবার মুখে আর সারা শরীরে লাগতেই একে একে ঘুম ভেঙে গেলো বাকিদের। সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠলো জিয়ার অফিস কলিগ সুলেখা…
-উফ্! কী ঠান্ডা হাওয়া রে বাবা! এই জিয়া! তুমি কাঁচটা নামালে কেন? তাড়াতাড়ি আগে কাঁচটা ওঠাও প্লিজ! ঠান্ডায় এবার আমি হার্ট ফেলই করবো মনে হচ্ছে!
-কেন গো সুলেখাদি? তুমি তো মাথায় চাপা দিয়েই আছো! এই দেখো কী সুন্দর মেঘ গুলো আমাদের গাড়িতে ঢুকছে…
-ধুর এসব কে দেখবে! দিলে তো আমার কাঁচা ঘুমটা ভাঙিয়ে! আমি এর আগে অনেকবার দার্জিলিং এসেছি। এইসব দৃশ্য আমার দেখা…
-যতোই দেখা হোক না কেন! সেতো আমিও আগে দুবার দার্জিলিং এসেছিলাম। তবে সেই ছোট্টবেলায়! কিন্তু এখন অনেক কিছু বদলে গেছে গো। সবাই মিলে ঘুমিয়ে তো এই সব সুন্দর সুন্দর দৃশ্য গুলোই মিস করে যাচ্ছো তোমরা! আরে ঘুমাতে তো বাড়িতেও পারবে! এখানে এখন ঘুরতে এসেছো, ভালো করে ঘোরো, এনজয় করো! এখানে তোমাদের এতো ঘুম কীসের বলোতো শুনি?!
ঠান্ডা বাতাসের স্পর্শে সবার সারা শরীর শিহরিত হয়ে উঠলো বারংবার। কিন্তু সত্যিই সবার খুব ভালোও লাগতে শুরু করলো। একে একে সবাই নিজেদের পাশের জানলার কাঁচ গুলো নামিয়ে দিলো। একদিকের জানলা দিয়ে একরাশ মেঘ এসে অপরদিকের জানলা দিয়ে বেরিয়ে যেতে শুরু করলো। জিয়ার মতো সবাই-ই ওই ভেসে আসা মেঘ গুলোকে নিজের হাতের মুঠোর মধ্যে ধরে রাখার জন্য বৃথাই চেষ্টা করতে লাগলো। হঠাৎই গাড়ির ড্রাইভার অতনু গাড়িটা থামিয়ে দেওয়ায় জিয়া বলে উঠলো,
-কী ব্যাপার অতনুদা, গাড়িটা থামালে কেন?
-স্নো হোয়াইট হোটেল তো এসেগেছে ম্যাডাম! এই তো সামনে লেখাই আছে “হোটেল স্নো হোয়াইট”…
গাড়ির জানলা থেকে হোটেলটার দিকে একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করেই আনমনে বলে উঠলো জিয়া,
-ওয়াও! দ্যাটস গ্রেট! সত্যিই বরফের মতো সাদা আর সুন্দর হোটেলটা! দারুণ দারুণ! চলো চলো সবাই নেমে পড়ো গাড়ি থেকে! আমাদের হোটেল তো এসে গেছে! বাইরে থেকে হোটেলটা এতো সুন্দর দেখতে, ভিতর থেকে হোটেলটা কেমন সেটাও দেখতে হবে তো নাকি!
বলেই গাড়ির দরজাটা খুলে গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে পড়লো জিয়া। একে একে বাকিরাও নেমে এলো গাড়ি থেকে। অতনু গাড়ি থেকে সমস্ত লাগেজ আর ব্যাগপত্র নামিয়ে দিয়ে গাড়িটা পার্কিং জোনে পার্ক করতে চলে গেলো। এদিকে জিয়া নিজের ট্রলিব্যাগটার দিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ না করেই, হোটেলটাকে বন্দী করলো ওর হাতে থাকা ক্যামেরার মধ্যে। গাড়িতে আসতে আসতেও নিজের ক্যামেরার মধ্যে বন্দী করেছে একাধিক প্রাকৃতিক দৃশ্যের সুন্দর সুন্দর ছবি।
-নাহ! ভিতর থেকেও হোটেলটা ভীষণ সুন্দর আর কম্ফরটেবলও! কী বলো সুলেখাদি?
-হ্যাঁ জিয়া। হোটেলটা সত্যিই ভীষণ সুন্দর। তবে আমার ভীষণ খিদে পেয়ে গেছে এবার! কখন যে আমাদের ব্রেকফাস্টটা দিতে আসবে কে জানে! এই নরম বিছানায় আমার ঘুমানোর তো কোনো অসুবিধা হবে না। কিন্তু সময়মতো খাবার গুলো প্রোভাইড করলেই হয়!
-সত্যি সুলেখাদি! তুমি পারোও বটে। ঘুরতে এসেও টাইম মতো খাওয়া আর ঘুম না হলে তোমার চলে না বলো?
-তুমি তো জানোই জিয়া, আমি খাওয়া আর ঘুমের ব্যাপারে বড্ড খুঁতখুঁতে! আর সেই জন্যই তো রিসেপশনের পরের দিনেই নিজের শ্বশুরবাড়ি ছাড়তে হয়েছে আমাকে। ওখানে আবার সবাইকে ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে পড়তে হয়! আর আমি সকাল ন’টার আগে বিছানাই ছাড়তে পারি না! বর বেডটী-টা দিলে তবেই বিছানা ছাড়ি। তারপর বাকি সব কাজ! শ্বশুর বাড়িতে আমি কী করে থাকতাম বলো? আজ যে এখানে আসার জন্য কী কষ্ট করে ভোররাতে ঘুম থেকে উঠেছি, সে একমাত্র আমার বরটাই জানে। ওই তো ডেকে ডেকে ঘুম থেকে তুলেছে আমায়!
-এটা কিন্তু মানতে হয় সুলেখাদি, তুমি খুব লাকি যে এরকম একটা ভালো হাজব্যান্ড পেয়েছো! তা নাহলে রিসেপশনের পরের দিনই কেউ বউকে নিয়ে নিজের বাড়ি ছাড়তে পারে?
-হে হে! এসব ট্রেনিং দিতে হয় বস! সব বিয়ের আগে বলেই রেখেছিলাম। আর সেই জন্যই তো আমার বরটা আগে থেকেই শ্বশুর বাড়ি থেকে একটু দূরে ফ্ল্যাটটা নিয়ে রেখেছিলো। আর আমার শ্বশুর শাশুড়িও অবশ্য তাতে আপত্তি করেননি। শুধু মাঝেসাঝে একটু গিয়ে ওনাদের দেখে আসলেই হয় আর ওনাদের জন্য ভালোমন্দ খাবার দিয়ে এলেই হয়। এই জিয়া শোনো, আমি কিন্তু আর খিদে সামলাতে পারছি না! প্লিজ তুমি একটু দেখে এসো না গো, কখন আমাদের ব্রেকফাস্টটা রুমে দিতে আসবে!
সুলেখাকে এমন খিদের জ্বালায় ছটফট করতে দেখে জিয়া বললো,
-ওকে সুলেখাদি, তুমি বসো। আমি দেখে আসছি কেন ব্রেকফাস্ট দিতে এতো লেট হচ্ছে!
-হ্যাঁ প্লিজ!
-তুমি বিস্কিট খেতে চাইলে খেতে পারো.. আমার ব্যাগের এই সামনের চেইনটা খুললেই পাবে…
-ওকে ওকে, থ্যাংক ইউ গো!
জিয়া হোটেলের রুম থেকে বেরিয়ে নীচে রিসেপশনের দিকে এগিয়ে গেলো ব্রেকফাস্ট কখন দেবে সেকথা জিজ্ঞেস করার জন্য। জিয়া আর সুলেখা একই রুমে আছে। বাকি আর দুজন মেয়ে একটা রুমে। আর তিনটে ছেলে আর ড্রাইভার একটাই রুম নিয়েছে। জিয়া বেরিয়ে যাওয়ার পরেই হোটেলের রুম সার্ভিসের কোনো একজন স্টাফ সবার রুমে ব্রেকফাস্ট দিতে এলেন। জিয়া রিসেপশনে গিয়ে জানতে পারলো ব্রেকফাস্ট এতোক্ষণে রুমে সার্ভ করে দেওয়া হয়েছে। ও মনে মনে ভাবলো, “তার মানে সুলেখাদি খেতেও শুরু করে দিয়েছে এতোক্ষণে। এখন আর আমার রুমে না গেলেও চলবে!” জিয়ার গলায় ওর ডিএসএলআর ক্যামেরাটা ঝোলানোই আছে। তাই ও আরও কিছু সুন্দর মুহূর্ত ক্যামেরা বন্দী করার জন্য বেরিয়ে গেলো “হোটেল স্নো হোয়াইট” থেকে। হোটেল থেকে বেরিয়েই বরফে ঢাকা প্রাকৃতিক পরিবেশের কয়েকটা সুন্দর সুন্দর ছবি তুলে নিলো জিয়া। তখনই হঠাৎ ওর চোখে পড়লো দুজন অল্প বয়সী ছেলে-মেয়ের দিকে। তারা নিজেদের ফোনেই একাধিক সেলফি তুলতে ব্যস্ত। আশেপাশে কেউ না থাকার কারণে তারা বেশ কয়েকটা কাপল পিকও তোলার চেষ্টা করছিলো। কিন্তু নিজেদের একার পক্ষে সেটা সম্ভব হচ্ছিলো না। ছবি তুলতে অসুবিধা হচ্ছে দেখে ওদের দিকে এগিয়ে এলো জিয়া। ওদের একেবারে সামনে এসে ও ছেলেটিকে উদ্দেশ্য করে বললো,
-ক্যান আই হেল্প ইউ বাই টেকিং পিকচারস?
ছেলেটি প্রথমে একটু দ্বিধাবোধ করলেও, পরক্ষণেই নিজের মোবাইলটা জিয়ার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
-ইয়া.. আওয়ার প্লেজার!
ছেলে মেয়ে দুটোর কয়েকটা সুন্দর সুন্দর কাপল পিকচার তুলে দেওয়ার পর ওদের দিকে ফোনটা এগিয়ে দিয়ে জিয়া বললো,
-দেখো, তোমাদের ছবি গুলো পছন্দ হয়েছে কিনা…
-ওয়াও! দারুণ! থ্যাংকস্ দিদি!
-পছন্দ না হলে বলো, আরও কয়েকটা তুলে দিচ্ছি..
-না না! খুব সুন্দর হয়েছে ছবি গুলো। আর তুলতে হবে না!
-ওকে! হানিমুন নাকি?
-এমা না না! আমরা কলেজ থেকে এক্সকারশনে এসেছি।
-ওহ! তাতে কী? ঘুরতে তো এসেছো! প্রি হানিমুন হয়ে যাচ্ছে। আর ছবি গুলোও প্রি ওয়েডিং শ্যুটে কাজে লেগে যাবে। দারুণ ব্যাপার কিন্তু!
-এসব আপনি কী বলছেন দিদি? আমরা এখন বিয়ে করবো না!
-আরে আমাকে আপনি বলার কী আছে? তুমি বলো! আর হ্যাঁ, তোমরা ওদিকটায় ছবি তুলেছো? না তুলে থাকলে এক্ষুণি যাও। কাপলদের ফটোশ্যুট করার জন্য দারুণ জায়গা। আর খারাপটা কী বলেছি শুনি? তোমরা এরকম হাঁ করে ওদিকে কী দেখছো?! যাও যাও ওই দিকটায় যাও… আমি যাবো নাকি আমার এই ক্যামেরায় তোমাদের কয়েকটা ছবি তুলে দিতে?! আর শোনো, এখন বিয়ে করবে না তো কী হয়েছে? একদিন না একদিন তো করবে! তখন এই এই ছবি গুলো স্মৃতি হয়ে থাকবে…
-এই না না! আমরা এখন আসছি দিদি!
ছেলে-মেয়ে দুটো দৌড়ে পালিয়ে গেলো ওখান থেকে। ওরা ওভাবে জিয়ার পিছনের দিকে তাকিয়ে থেকে দৌড়ে পালিয়ে যেতেই পিছন ফিরে জিয়া দেখলো ওর পিছনে একজন বেশ লম্বা-চওড়া পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে। খুব বেশি বয়স না হলেও, খুব একটা কমবয়সীও নয় ছেলেটা। দেখে মনে হয় খুব রাগীরাগী আর গম্ভীর ধরনের। তবে দেখতে বেশ হ্যান্ডসাম। জিয়ার চোখে যেমন গোল ফ্রেমের চশমা, ওই লোকটার চোখেও সেরকমই কালো গোল ফ্রেমের চশমা। গালে হালকা চাপ দাড়ি। গায়ের রং বেশ ফর্সা। একে অপরের অপরিচিত হলেও পুরুষটিকে ওর পিছনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিয়া নিজেই বলে উঠলো,
-আসলে ছেলেমেয়ে দুটো কলেজ থেকে এক্সকারশনে এসেছে। বাট ওরা দুজন একে অপরকে ভালোবাসে। মানে ওরা কাপল আর কি! আচ্ছা, আপনিই বলুন তো, কলেজ থেকে বেড়াতে এসেছে বলে কী নিজেরা একটু প্রেমও করতে পারবে না? নাকি কাপল ফটোশুটও করতে পারবে না? আরে এরকম সুযোগ কী আর বারবার আসে নাকি? এখন যখন একবার সুযোগ পেয়েছে বিয়ের আগে একসাথে দার্জিলিং-এ আসার, তাহলে তো একটু কাপলশুট করে নিতেই পারে। কী বলুন তাইনা?!
জিয়া একনাগাড়ে কথা গুলো বলেই চললো। ও যখন নিজের কথা গুলো থামালো, ঠিক তখনই অল্পবয়সী স্টুডেন্ট গোছের একটা ছেলে এসে পিছন থেকে ডাকতে এলো ওই পুরুষটিকে। দেখে মনে হলো ছেলেটি বেশ ভয়ে ভয়েই বললো,
-স্যার? ব্রেকফাস্ট রেডি হয়েগেছে! আপনাকে সবাই খেতে ডাকছে। আপনি তাড়াতাড়ি আসুন প্লিজ!
-হ্যাঁ, তুমি যাও। তুমি গিয়ে সবাইকে খাওয়া শুরু করতে বলো। আমি আসছি একটু পরে।
-আচ্ছা স্যার!
সাথে থাথেই ওই ছেলেটি এক দৌড়ে পালালো ওখান থেকে। এবার জিয়া বুঝতে পারলো, ওই ছেলে আর মেয়েটা তখন কেন ওভাবে পুরুষটিকে দেখে দৌড়ে পালিয়ে গেলো। নিশ্চয়ই স্যারকে দেখে ভীষণ ভয় পেয়ে গেছে। জিয়া সঙ্গে সঙ্গে বললো,
-ওহ! এবার বুঝেছি! আপনি তার মানে ওদের স্যার? আর সেই জন্যই ওই বাচ্চা ছেলে-মেয়ে দুটো আপনাকে দেখে ওভাবে দৌড়ে পালালো! আপনি কী খুব বদরাগী প্রফেসর নাকি? বাট প্লিজ! আপনি যতোই বদরাগী হন না কেন, প্লিজ ওই ছেলে-মেয়ে দুটোকে বকাবকি করবেন না! ওরা এই বয়সে মজা করবে না তো, আর কবে করবে তাইনা বলুন? আচ্ছা যাইহোক, আমি এখন আসি!
জিয়া আয়ানের পাশ কাটিয়ে চলেই যাচ্ছিলো। ঠিক তখনই আয়ান বলে উঠলো,
-আমাকে দেখে কী আপনার খুব বদরাগী বলে মনে হলো নাকি?
-হ্যাঁ, তা একটু হলো বটে। যেভাবে গম্ভীরভাবে আপনি আপনার স্টুডেন্টটিকে এখান থেকে যেতে বললেন! আর যেভাবে ওরা আপনাকে দেখে ভয় পেয়ে দৌড়ে পালালো, তাতে তো সেটাই মনে হওয়ার কথা!
জিয়ার কথা শুনে মুখ টিপে একটু হেসেই ফেললো আয়ান। তারপর বললো,
-আমি বদরাগী কিনা জানি না। তবে আমার স্টুডেন্টরা আমাকে দেখে যেহারে ভয় পায়, আমি কিন্তু ততোটাও রাগী নই! ওরা আমাকে দেখলেই এভাবে দৌড়ে পালায় কেন কে জানে! অথচ আমি ওদের কাউকে কখনও একটুও বকিনি পর্যন্ত। তবুও আমাকে দেখলেই ওরা ভয়ে কেমন যেন সিঁটিয়ে থাকে।
-না বকলেও নিশ্চয়ই খুব বড়ো বড়ো করে চোখ পাকান। আর আপনার সেই ভয়ানক চোখ পাকানো দেখেই ওরা ভয় পেয়ে যায়! আর আপনার এই গম্ভীর গলার স্বর শুনলেই ওরা সিঁটিয়ে যায়।
জিয়ার কথা শুনে আবারও একটু হেসে ফেললো আয়ান। তারপর বললো,
-না না। আমি এরকম কোনো চোখও পাকাই না।
-ও আচ্ছা, না পাকালেই ভালো। আপনি এখন যান, আপনার ব্রেকফাস্ট তো রেডি হয়ে গেছে বলে গেলো আপনার স্টুডেন্ট। আমিও যাই!
-হ্যাঁ, সে যাচ্ছি একটু পরে।
-হুম.. বুঝলাম!
-কী বুঝলেন?
-এটাই বুঝলাম যে, আপনার এখন খিদে পায়নি!
-হুম, ঠিকই বলেছেন আপনি। আমার এখন খিদে পায়নি। আপনি কী একা এসেছেন নাকি? আর কাউকে তো দেখছি না আপনার আশেপাশে!
-না না! আমরা অফিস ট্যুরে এসেছি। আজ সকালেই এলাম আমরা। আর আপনারা?
-আমরাও আজই এলাম। কলেজ থেকে স্টুডেন্টদের এক্সকারশনে নিয়ে এসেছি।
-হ্যাঁ, সেতো আগেই আপনার স্টুডেন্টদের থেকে শুনেছি। আপনি যে এখানে আপনার নিউলি ম্যারিড ওয়াইফের সাথে হানিমুনে আসেননি, সেটা আমি বেশ ভালোই বুঝতে পারছি!
মুখের ওপর এভাবে হানিমুনের কথা বলায় একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো আয়ান। কিছু বলতে পারলো না ও। তখন জিয়াই আবার বললো,
-কী ব্যাপার? লজ্জা পেয়ে গেলেন নাকি মিস্টার.. মিস্টার..
-রায় চৌধুরী!
-ও আচ্ছা, মিস্টার রায় চৌধুরী! আপনি লজ্জা পেলেন নাকি?
-না!
-তারপর বলুন কতোদিন থাকা হবে এখানে?
-চারদিন! আর আপনারা?
-বাবা! অফিস ট্যুরে চারদিন? এতোদিন ছুটি দিতে রাজী হলেন আপনাদের অফিসের বস?
-হ্যাঁ! আর বলবেন না, অফিসে একভাবে কাজ করতে করতে আমরা সবাই-ই ভীষণ খিটখিটে হয়ে যাচ্ছিলাম, ঠিকমতো কাজই করতে পারছিলাম না। কাজে মনই বসছিলো না কারোর! আর সেই জন্যই তো বস নিজের থেকেই আমাদের দার্জিলিং ট্যুরটা স্পনসার করলেন। যাতে এই কদিন আমরা এখানে ছুটি কাটিয়ে আবার শিলিগুড়ি ফিরে গিয়ে খুব মন দিয়ে কাজ করতে পারি!
-বাহ! দারুণ মজার মানুষ তো আপনার বস!
-হ্যাঁ সে আপনি ঠিকই বলেছেন! আর মজার মানুষ না হলে আমি এই অফিসে একমাসের বেশি টিকতেই পারতাম না! আমার আবার ওই গম্ভীর, জেদি, রাগচটা মানুষ একদম পছন্দ নয়!
কথাটা শোনা মাত্রই আয়ানের নিজের মায়ের আয়ানকে বলা কথা গুলো মনে পড়ে গেলো। ওর মা সবসময়ই ওকে বলতেন আয়ান নাকি ছোটো থেকেই খুব জেদি, রাগচটা আর গম্ভীর ব্যক্তিত্বের মানুষ, দেখলে মনে হয় যেন রামগরুরের ছানা, মুখে কোনো সময়ই হাসি দেখা যায় না ওর। আয়ানকে চুপ করে থাকতে দেখে জিয়া বললো,
-কী ব্যাপার মিস্টার বদরাগী প্রফেসর? নিজের কথা ভাবছেন নাকি? আপনাকে তো দেখেই বোঝা যাচ্ছে আপনি কেমন গম্ভীর ধরনের! যাই হোক, আমি এখন যাই কেমন! আমার কলিগরা আবার আমার জন্য চিন্তা করছে হয়তো!
কথা গুলো বলেই জিয়া চলে গেলো হোটেল স্নো হোয়াইটের দিকে। আয়ান এরকম চঞ্চল, ছটফটে, হৈ-হুল্লোড় করা, জোরে, চেঁচিয়ে কথা বলা মানুষ একদমই পছন্দ করে না। ও যেমন খুব শান্ত, ধীর-স্থির, স্বল্পভাষী, সেরকমই ও নিজেও এই ধরনের মানুষদেরকেই পছন্দ করে। এতো জোরে চেঁচিয়ে আর তাড়াহুড়ো করে কথা বলা ছেলে-মেয়েদেরকে ও একদমই পছন্দ করে না। কিন্তু এই মেয়েটা এতোটা ছটফটে আর চঞ্চল হওয়া সত্ত্বেও ওর কথা বলার ধরনটা এমনই, যা ওর অপর প্রান্তে থাকা প্রতিটি মানুষকেই প্রভাবিত করার জন্য যথেষ্ট। আয়ান একবার পিছনে ফিরে জিয়ার চলে যাওয়ার দিকে লক্ষ্য করলো। দূরে তাকিয়ে দেখলো ওদিকটায় শুধু একটাই হোটেল আছে, আর সেটা হলো “হোটেল স্নো হোয়াইট”। জিয়া হোটেলে ঢুকে যাওয়া পর্যন্ত ওদিকেই তাকিয়ে ছিলো আয়ান। তারপরই ও এগিয়ে গেলো ওদের হোটেল “টপ ভিউ”-এর দিকে…
ক্রমশ…