হৃদমোহিনী,পর্ব-২

0
1253

#হৃদমোহিনী,পর্ব-২
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া

ধূসর বিছানায় শুয়ে থেকেই হু হা করে হেসে বললেন, ‘আসো আমার কাছে অর্নি, আজ আর পালাতে পারবেনা…’
এতো দেখি পুরাই পাগল হয়ে গিয়েছে। এই সাইকো আমাকেই সাইকো বানিয়ে দেবে, একে আমি কীভাবে ঠিক করবো! অর্নির বিরহে বেচারা এতোটাই মেন্টালি সিক যে আমাকেই চিনতে পারছেনা? অদ্ভুত! ভাবনার মাঝেই উঠে এলেন ওনি। আমাকে টেনে ধরার আগেই আমি পেছনে সরে গেলাম, তবুও সুবিধা করতে পারলাম না। ওনি আমার আঁচল টেনে ধরলেন। ধীরে ধীরে আমার দিকে এগুতে লাগলেন। এলোমেলো পা ফেলে আমাকে ধরতে আসার আগেই আমি পর্দার আড়ালে চলে গেলাম। আঁচলটা তখনো ওনার হাতে। শক্ত করে ধরে রেখেছেন। বুঝতে পারছিলাম না কী করবো। নিকিতা আন্টি বোধহয় ঘরের দিকেই আসছেন তাই আমি আড়াল থেকে বেরিয়ে ওনার সামনে দাঁড়ালাম। ওনি মিটমিট করে আমার দিকে তাকালেন। দাঁড়াতেই পারছেনা ঠিকমতো।
আমি ক্ষীণ কন্ঠে বললাম, ‘আসুন, এখানে বসুন।’
ওনি কাঁপানো গলায় বললেন,
-বসলেই পালিয়ে যাবে তাইনা?
আমি বললাম,
-কোথাও যাবোনা আমি।
ছোটছোট চোখ করে বললেন,
-মিথ্যা বলছো।
-মিথ্যা বলে লাভ কী আমার?
ওনি পড়ে যেতে নিলেই আমি ধরে নিলাম। নাকমুখ কুঁচকে বললাম, ‘ ইশ, কী বাজে গন্ধ। কীভাবে খান এসব? ইয়াক…’

ওনি বাচ্চাদের মতো হাসতে লাগলেন। আমি বিছানায় বসিয়ে দিলাম। ওনি আমার হাত ছাড়লেননা, অগত্যা আমাকেও বসতে হলো। আন্টি খাবার নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। ওনাকে এমন উদ্ভ্রান্তের মতো দেখে আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। আমি ইশারায় ওনাকে চুপ থাকতে বলে ধূসরকে বললাম, ‘রাতে খাননি! খাবার খাবেন উঠুন।’
-খাবোনা।
-না খেলে কীভাবে হবে, আপনি দুর্বল হয়ে পড়বেন।
আন্টি বললেন, ‘খেয়ে নে বাবা। এরকম করছিস কেন?’
-অর্নি তুমি খেয়েছো?

আমি থতমত খেয়ে আন্টির দিকে তাকালাম। নেশার ঘোরে আমাকেই অর্নি ভাবছেন। কিন্তু আমি যে আরুণী! পরিস্থিতি আজ কোথায় এনে দাঁড় করালো আমায়? নিজের পরিচয়টুকু বদলে ফেলতে হচ্ছে। অবশ্য আমরা দু’বোন তো একই রক্ত, একই প্রাণ। সেই প্রাণকে এই ঠুনকো নামধাম আর পরিচয় দিয়ে আলাদা করা যাবেনা। ধূসরের চোখের দিকে তাকিয়ে আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালাম, যদিও তখন আমার খাওয়া হয়নি। ওনি বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, ‘আমি অর্নির হাতে খাবো।’

আমি চমকে উঠলাম। আমার হাতে খাবেন মানে! ততক্ষণে আংকেলও এসে দাঁড়িয়েছেন ঘরে। ধূসরের বাবা-মায়ের অসহায় চাহনি আমার নজর এড়ালোনা। ছেলের এই দশায় ওনারা কতোটা কষ্টে আছেন সেটা বোধহয় আমি অনুভব করতে পারবোনা। অগত্যা ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে ওনাকে খাইয়ে দিতেই হলো। ওনার চোখমুখ বুজে আসছিলো। আংকেল ওনাকে ওনার ঘরে পৌঁছে দিলেন অনেক কষ্টে, তবে ধূসর আমাকে সাথে করে নিয়ে এলো। কিছুতেই আমাকে চোখের আড়াল হতে দেবেন না। অর্নির নামটা ওনার মুখ থেকে সরছেইনা। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। কেন এতো সুন্দর, সাজানো একটা সংসার ফেলে তুই চলে গেলি? তোর ভালোবাসা মানুষটা আজ কত কষ্ট পাচ্ছে তুই দেখতে পাচ্ছিস? আমি কি কখনো তোর মতো এতো ভালোবাসতে পারবো ওনাকে? বড্ড নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিলি তুই অর্নি, এমনটা না করলেও পারতিস!

আংকেল ওনাকে খাটে শুইয়ে দিলো। ওনি তন্মধ্যেই ঘুমে বিভোর হয়ে গেলেন। আংকেল আমায় ওনাকে দেখে রাখার অনুরোধ করে অশ্রুসিক্ত চোখ নিয়ে চলে গেলেন। আন্টি এসে আমার সাথে কিছুক্ষণ গল্প করলেন, দুঃখের কথা শেয়ার করলেন। তারপর আমাকে একটা শাড়ি আর ধূসরের প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস দিয়ে আর আমাকে বিভিন্ন কথাবার্তা বলে চলে গেলেন। ওনার পরণে এখনো বিয়ের সেই পোশাক। আমাকে আজ এই ঘরেই থাকতে হবে৷ আজ আমার বাসর রাত। অথচ ঘরটাতে কোনো ফুলের বালাই নেই। হয়তো ওনি সাজাতে দেননি। নিজে তো মদ খেয়ে টাল হয়ে ঘুমাচ্ছেন আর ওদিকে আমার শ্বশুর-শ্বাশুড়ি ছেলের বিরহে কেঁদেকেঁদে মরছেন। ডিভানে বসে এই কথাগুলো ভাবার সময় অর্নির উপর আমার প্রচন্ড রাগ হলো, খুব স্বার্থপর মনে হলো ওকে। আমাকে এরকম বিপাকে ফেলার জন্য শুধু ও-ই দায়ী। কিছুক্ষণ কাঁদলাম বসে বসে। তারপর নিজেকে সামলে ওনার কাছে গেলাম। পোশাক পালটে দিতে হবে। লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাচ্ছে। পাঞ্জাবির বোতামে হাত দিতেই নড়েচড়ে ওঠলেন ওনি। আমি দূরে সরে গেলাম। আবারও ঘুমে মগ্ন হয়ে গেলে আমি পাঞ্জাবি খোলার চেষ্টা করলাম, কিন্তু তার আগেই ওনি জেগে উঠলেন। আমি ভয়ে আছি, সেন্স এখনো ফিরেনি বেচারার, যদি একবার বুঝতে পারে আমি তার অর্নি নয় তাহলে নির্ঘাত তুলকালাম বাঁধিয়ে ছাড়বেন।

আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে আচমকা উঠে বসলেন। হুট করে বমি করে দিলেন আমার শাড়িতে। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি হতভম্ব হয়ে বসে গেলাম। ওনাকে বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছিলো, আমি পারিনা তখন ঘর থেকে পালাতে। আমার ওসিডি আছে প্রচন্ড রকম। গা ঘিনঘিন করে উঠলো, একপ্রকার কেঁদেই ফেলি আমি। তবুও মানবিকতার খাতিরে ওনাকে সাহায্য করলাম। ওয়াশরুম থেকে পানি আনলাম। শেরওয়ানি খুলে দিয়ে পুরো গা মুছে দিলাম। ওনি আমার দিকে তাকিয়ে হেসে যাচ্ছে আর আমি চোখ বন্ধ করে আছি। অর্নি বোন আমাকে কোথায় ফেলে গেলি তুই!!

পোশাক পাল্টে ওনাকে বিছানায় শুইয়ে দিলাম। আবারও গভীর ঘুমে ডুব মারলেন৷ আমি একরাশ বিরক্তি নিয়ে সব পরিষ্কার করে শাওয়ার নিতে গেলাম। দীর্ঘক্ষণ যাবৎ শাওয়ার নিতে নিতেই ঘরে থাকা মানুষটার আর্তনাদ শুনতে পাচ্ছিলাম আমি। ঘুমের ঘোরেই সে অর্নিকে খুঁজছেন, ডাকছেন। ওকে আটকে রেখে দেবে এই-সেই বলেই যাচ্ছেন। বেরিয়ে এসে দেখলাম পানি খেতে চাইছে, আমি এগিয়ে দিলাম পানি।

_____

সকালবেলা ঘুম ভাঙলো মেঘের গর্জনে। কাউচ থেকে উঠে চারদিকে চোখ বুলিয়ে পাল্টে যাওয়া পরিবেশটা মনোযোগ দিয়ে দেখলাম। বেশ বড় একটা ঘর। আভিজাত্যের ছাপ সবকিছুতেই। অর্নি নিজহাতে সবকিছু সাজিয়েছে। ধূসর বিছানায় এলোমেলো ভঙ্গিতে পড়ে আছে। আমি দ্রুত ঘর থেকে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলাম। ওনি যদি একবার আমাকে ঘরে দেখতে পায় তাহলে না জানি কি করে। দ্রুত ফ্রেশ হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। রান্নাঘরে নিকিতা আন্টি ব্রেকফাস্ট তৈরি করছেন। আমাকে দেখে অল্প হাসলেন।
-ঘুম কেমন হয়েছে মা?
-জি ভালো।
-ধূসর কোনো সমস্যা করেছে রাতে?
-বমি করেছে একবার।
ওনি উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, ‘সে কী?’
-ঘাবড়াবেন না আন্টি। অতিরিক্ত নেশাদ্রব্য গ্রহণের ফলেই এমন হয়েছে।
-উঠেছে ঘুম থেকে?
-দশটার আগে মনে হয়না ঘুম ভাঙবে!
ওনাকে চিন্তিত দেখে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কিছু ভাবছেন?’
-তোমাকে দেখে রাগারাগি করলে তুমি কিছু মনে করোনা মা।
-না না আমি কী মনে করবো! কী করছেন?
-নাস্তা বানাই।
-আমাকে দিন আমি করছি।
-করবে?
-জি। বাসায় তো আমিই করতাম।
ওনি হেসে বললেন, ‘ঠিক আছে। রুটি বানাতে পারো?’
-খুব ভালো করেই।
-তাহলে রুটিগুলো বেলে দাও, আমি সেঁকে নিবো।

সকালের নাস্তা আমরা দুজন মিলে তৈরি করলাম। আংকেলকে চা দিয়ে এলাম। এ বাড়িতে কোনো কাজের মানুষ নেই। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। বাসায় ফোন দিয়ে সবার সাথে কথাবার্তা বললাম। তারপর ধূসরকে ছাড়াই ডাইনিংয়ে বসে পড়লাম ওনার বাবা-মায়ের সাথে। খাওয়ার মাঝামাঝি পর্যায়ে আসতেই সিঁড়ি দিয়ে ওনাকে নামতে দেখে আমি চুপসে গেলাম। ওনি আমাকে দেখেই রেগে গেলেন। বড় বড় পা ফেলে আমার কাছে এসে গ্লাসের পানিটা আমার মুখে ছুঁড়ে দিলেন। শ্বাসরোধ হয়ে এলো আমার। আন্টি অবাক হয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে আছেন। আংকেল রেগে গেলেন প্রচন্ড। চিৎকার করে বললেন, ‘এটা কী করলে তুমি?’
ধূসর রেগে বললেন,
-অর্নির জায়গা নিতে এলে এমনই হবে।
-ও কারো জায়গা নিতে আসেনি। আমাদের কথায় তোমাকে সে বিয়ে করেছে। তাই যা বলার আমাদের বলো!
ধূসর তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন, ‘মানবদরদী সাজতে এসেছে? শুনো আমার অর্নির আমি কাউকে দেবোনা।’
-মানবদরদী বলেই তোমার মতো সাইকোকে সে বিয়ে করেছে। অন্য কোনো মেয়েই তোমাকে বিয়ে কর‍তোনা বুঝলে?
ধূসর আমার দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালেন। সেই দৃষ্টি যেন আমাকে ভস্ম করে দেবে। ওনি পাগলের মতোই চিৎকার করে বললেন, ‘আমাকে দয়া করেছে এটাই বুঝাতে চাচ্ছো?’
আংকেল ছেলের বেয়াদবিতে রেগে আগুন। তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, দয়াই করেছে!’
এই কথা শুনে ধূসর জ্বলে উঠলেন। আমাকে খাওয়া থেকেই টেনে নিয়ে গেলেন ওনার ঘরে। বাবা-মায়ের শত অনুরোধ উপেক্ষা দরজা বন্ধ করে আমার দিকে তেড়ে এসে বললেন, ‘আমাকে দয়া করেছো? আমাকে? তোমার এতো সাহস?’
আমি সাহস নিয়ে বললাম, ‘আপনি অসুস্থ একজন মানুষ, তাই।’
বলার আগেই এক থাপ্পড়ে আমার গাল লাল করে দিলেন। হিংস্র গলায় বললেন, ‘বেশি সাহস দেখিয়েছো, এর পরিণাম মোটেও ভালো হবেনা।’
আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম, ‘অর্নি আমার বোন ছিলো!’
-ও তোমাদের কেউ ছিলোনা। এতো সহজে ওর জায়গা নিতে চলে আসতে পারতেনা। ইউ ব্লাডি গার্ল, অলওয়েজ ভালোমেয়ে সেজে থাকার অভিনয় করে গিয়েছো। এবার তোমার মুখোশ পুরোপুরি বেরিয়ে এলো। মাথায় ভালো করে ঢুকিয়ে নাও,তোমার এই কাজের জন্য কখনোই ক্ষমা করবোনা আমি, আর না শান্তি দেবো; জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেবো।’

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here