হৃদমোহিনী,০৪,০৫

0
1087

#হৃদমোহিনী,০৪,০৫
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৪

-অসহ্য।
বলেই আমি নিচে বিছানা করে শুয়ে পড়লাম। ওনি রাগী চোখে তাকিয়েই রইলেন। আমার মাথাব্যথা হচ্ছে প্রচুর। ঘুমের কারণে চোখ বন্ধ করার আগে দেখলাম ওনি বোতল নিয়ে বসেছেন। রাগ হলেও আমি কিছু বললামনা! নেশাখোরের সাথে একঘরে থাকা! ও মাই গড। যা কখনো কল্পনা করিনি সেটাই আজ বাস্তব হচ্ছে।

মাঝরাতে ঘুম ভাঙতেই দেখলাম ওনি আমার পাশে। কাঁথার ভিতর ঢুকে আমায় জড়িয়ে ধরে আছেন। আমার চুলে মুখ গুঁজে চোখেমুখে হাত বুলাচ্ছেন। আচমকা পেটের ওপর থেকে শাড়ি সরিয়ে চুমু খেতেই আমি ফ্রিজড হয়ে গেলাম। ঘোরের মাঝেই অর্নি অর্নি বলে ডাকছেন। বিশ্রি মদের গন্ধে আমার দম বন্ধ হয়ে যাবার যোগাড়। আমি ওনাকে দূরে ঠেলে দিলাম। কিন্তু ওনি নিজের কাছে টেনে নিলেন আমায়। ভয়ে, বিস্ময়ে আমি কী করবো বুঝে উঠতে পারছিলামনা। কোনোমতেই চাইছিলাম না দুজনের মধ্যে কিছু হয়ে যাক। প্রাণপণে ওনাকে সরানোর চেষ্টায় মত্ত হলাম। কিন্তু ওনার শক্তির সাথে আমি পেরে ওঠলামনা। আমাকে কোলে তুলে বিছানার দিকে অগ্রসর হতেই আমি ওনার বুকে,পিঠে কিল-ঘুষি দিতে লাগলাম। ওনি আমার হাতদুটো মুঠোয় আটকে বললেন, ‘হুশশশ..শব্দ করোনা।’
আমি ব্যহত কন্ঠে বললাম,
-আমি অর্নি নই।
-তুমিই অর্নি।
-আমি আরুণী।
ওনি আমার কোনো কথাই কানে ঢুকালেননা। তখন অবশ্য কানে ঢুকানোর মানসিক অবস্থাতেই ছিলেন না। আমার শত অনুরোধ, আর্তনাদ কিছুই ওনাকে আদিম খেলায় মেতে ওঠা থেকে আটকাতে পারলোনা। ওনার শক্তির কাছে আমাকে হার মানতেই হলো। জমজ হওয়ার কী যন্ত্রণা আমি হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছিলাম। নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগছিলো, ঘৃণা হচ্ছিলো খুব। বারবার মনে হচ্ছিলো আমি অর্নির জায়গায় এসে পড়েছি, ওর অধিকার কেড়ে নিয়েছি, ওর ভালোবাসায় ভাগ বসিয়েছি। নিজেকে নিজের কাছেই অপরাধী মনে হচ্ছিলো। ধূসর তো স্বাভাবিক অবস্থায় ছিলোনা, কিন্তু আমি? আমিতো ছিলাম! এবং সম্পূর্ণ ব্যাপারটা ওনার মনেও থাকবেনা, ভুলে যাবে! তখন দোষ আমার হবে। এর দায় আমারই হবে। কিছুতেই মানতে পারছিলাম না এই বিষয়টা। ওনি আমায় শক্ত করে জাপটে ধরেছিলেন। আদুরে বেড়ালের মতো বুকে নিয়ে ঘুমালেন। যেন ছাড়লেই আমি পালিয়ে যাবো, না না..আমি নয়, ওনার অর্নি! আরুণীকে তো ওনি পছন্দই করেননা। সারারাত চোখের পানি ফেললাম, আমার বুঝি এমন নিষ্ঠুর নিয়তি? ভাগ্যে এটাই লিখা ছিলো? এতোটা অসহায় কখনো বোধ করিনি আমি!

ভোরের আলো ফোটার আগেই আমি ওনাকে অনেক কষ্টে সরিয়ে উঠে পড়লাম। শাড়িকাপড় প্যাঁচিয়ে এক দৌড়ে ওয়াশরুমে চলে গেলাম। ভাবতেই কষ্ট হচ্ছিলো আমার সাথে এটা কি হলো! দীর্ঘক্ষণ সময় নিয়ে গোসল সেরে বেড়িয়ে এলাম। নামাজ পড়ে নিলাম। ঘরটাকে ভালোমতো গুছিয়ে দিলাম। ওনার বুকে, পিঠে নখের আঁচড় দেখে আঁৎকে উঠলাম। এসব দেখলে ভাববে আমি ওনার অসহায় অবস্থার সুযোগ নিয়েছি! চাদর দিয়ে ভালোকরে ওনাকে ঢেকে দিলাম। এলোমেলো চুলগুলো কপাল থেকে সরিয়ে দেওয়ার সময় আমার মনে হলো, ওনিতো আমারই স্বামী! ওনার ভালোবাসা প্রয়োজন! এবং সেই মুহূর্তে মনের কোণে বারবার উঁকি দিচ্ছিলো অর্নির জায়গা অর্নিরই থাকুক, আমার নিজের একটা জায়গাও তৈরি করতে হবে আরুণী হিসেবে।

ধূসর ঘুম থেকে উঠার আগেই আমি ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। মাথাটা ভীষণ ভার হয়ে ছিলো, মা আমায় চা বানিয়ে দিলেন। ধূসরের খোঁজ নিলেন। রাতে কোনো নেশা করেছে কিনা আর আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে কিনা বাবা জানতে চাইলেন। যদিও দুটোই ওনি করেছেন কিন্তু আমি ওনাদের বুঝতে দিলামনা কিছু। চা খেতে খেতে বাবা জানালেন ওনারা দুজন আজ বোনের বাড়ি বেড়াতে যাবেন। কয়েকদিন থাকবেনও। আমি সবকিছু একা সামলাতে পারবো কিনা জিজ্ঞেস করলেন। আমিও হ্যাঁ বলে দিলাম। মজার ব্যাপার হলো ওনাকে ছাড়া সামলানোর মতো আর কিছুই নেই!
অবশ্য কাল রাতের পর ওনার প্রতি একটু হলেও আমার অনুভূতি জাগ্রত হয়েছে তবে সেসবের কোনো দাম ওনার কাছে নেই। মায়ের কাছ থেকে জেনে ওনার পছন্দের খাবার তৈরি করলাম। খিচুড়ি আর অমলেট। এগুলো কর‍তে অনেকসময় লেগে গেলো। কিন্তু আমার অতি যত্নে রান্না করা খাবারগুলো ওনিতো মুখেই তুললেন না, উল্টো সেগুলো নিয়ে ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দিলেন। আংকেল রেগে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ফেললে কেন?’
-ওর রান্না করা খাবার আমায় দিলে কেন? কোনো স্বার্থপর মেয়ের রান্না আমার গলা দিয়ে নামবেনা। আর কখনো এরকম ভুল যাতে না করে সেটা ওকে বলে দাও, নইলে খুব খারাপ হয়ে যাবে!
-ও তোমার স্ত্রী, সেটা ভুলে যেওনা ধূসর।
বাবা কড়া গলায় ধমকি দিয়ে ওনাকে বেশকিছু কথা শুনিয়ে দিলেন। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে
ওনি না খেয়েই ঘরে চলে গেলেন। আমার কান্না পেয়ে গেলো। ওনার জন্য আমার সবকিছু বিসর্জন দিয়ে স্বার্থপর তকমা পেলাম? এটাই আমার প্রাপ্য? যার জন্য সকাল থেকে কষ্ট রাঁধলাম আর সে-ই ফেলে দিলো? এই কাজটা যদি অন্য কেউ করতো তাহলে তাঁকে কড়া কথাও শুনিয়ে দিতে পারতাম। ওনি বলেই কিছু বলতে পারিনি। মা আমাকে বললেন, ‘ওর কথায় কষ্ট পেওনা মা। ওর মাথার ঠিক নেই।’
আমি শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে নিলাম। হাসি ফুটানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে বললাম,
-আমি কিছুই মনে করিনি।
বাবা হতাশ হয়ে বললেন, ‘আমাদের কোথাও যাওয়া বোধহয় ঠিক হবেনা।’
কথাটা শুনে আমি উৎকন্ঠিত হয়ে বললাম, ‘না না আপনারা যান।’
-কীভাবে যাবো বলোতো? ধূসর তোমার সাথে প্রতিনিয়ত খারাপ ব্যবহার করেই যাচ্ছে।’
-এটা এমন কিছুই নয়। আসলে হঠাৎ করেই অর্নির জায়গায় এসে গেছি সেটা তিনি মানতে পারছেননা।
-পারবে ওকে সামলাতে?
-চেষ্টা করতে দোষ কি!

বাবা-মাকে অভয় দিলেও আমার নিজেরই ভয় করতে লাগলো। যে লোকটা আমাকে দুচোখে দেখতেই পারেনা ওনাকে কি করে ঠিক করবো আমি? বিকেলে ধূসর ওনাদের ড্রপ করে দিয়ে এলো। আমি একটু অবাকই হলাম। আসার পর থেকে দেখছি ওনি যতই পাগলামো করুক না কেন বাবা-মায়ের প্রতি আলাদা একটা শ্রদ্ধাবোধ আর ভালোবাসা আছে। সবাই চলে যাওয়ার পর বাড়িতে নিজেকে খুব একা একা লাগছিলো। নিচে বসে টিভি দেখছিলাম হঠাৎই আমার ফোন বেজে উঠলো। নিকিতা আন্টি ফোন দিয়েছেন। রিসিভ করে অনেকক্ষণ কথাবার্তা বললাম। মা সবকিছু রান্না করে দিয়ে গেছে। কোথায় কি রাখা আছে, ধূসরের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কোথায় আছে সবকিছু আমাকে জানিয়ে দিলেন। আচমকা জিজ্ঞেস করলেন, ‘একটা কথা বলি মা?’
-জি বলুন।
-আমার কাছে কিছু লুকাবেনা কিন্তু।
-জি আচ্ছা।
-কাল রাতে ধূসরের সাথে তোমার কিছু হয়েছে? আই মিন..আমি যা মিন করছি তুমি বুঝতে পারছো নিশ্চয়ই?
মায়ের কথায় আমি বিষম খেলাম। ওনি বলতে থাকেন..আসলে আজ সকালে দেখলাম তোমার গলায় দাগ। তখন আসলে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারিনি। আমার ছেলেকে তো আমি চিনি, ওর সম্মতিতেই হয়েছিলো?
আমি শুকনোকন্ঠে বললাম, ‘না।’
-মানে?
-ওনি নেশারঘোরে ছিলেন। অর্নি ভেবেই..
নিকিতা আন্টি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘আমাদের ক্ষমা করে দিও মা। শুধুমাত্র আমাদের কথা রাখতেই তুমি এতবড় স্যাক্রিফাইস করলে!’
-এসব কথা থাক মা। এবার বলুন, বোনের বাড়িতে কেমন লাগছে?
-ভালোই। তবুও তোমার জন্য চিন্তা হচ্ছে খুব।
-চিন্তা করবেননা তো। সব ঠিক হয়ে যাবে!

ফোন রেখে উঠতেই উপরের ঘর থেকে ধূসরের চিল্লানি শুনতে পেলাম। চিৎকার করে পুরো বাড়ি মাথায় তুলে ফেলছে যেন। আমি তড়িঘড়ি করে ওপরে গেলাম। ঘরে ঢুকতেই অগ্নিদৃষ্টি বর্ষিত করলেন আমার উপর। গোসল সেরে বেরিয়েছে, পরণে টাওয়াল। আমাকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে বললেন, ‘এসব কী?’
আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে৷ মিনমিন করে বললাম, ‘কী?’
ওনি ওনার বুকেপিঠের নখের আঁচড় দেখিয়ে হুংকার দিয়ে বললেন, ‘হোয়াট..??’
-আমি কী করে বলবো? আমি কি আপনাকে খিমচি দিয়েছি নাকি! আজব।
আমার গলায় দৃষ্টি পড়তেই বললেন, ‘ওখানে কী?’
আমি দাগটা ঢেকে নিলাম দু’হাতে। চশমাটা নাকের ডগায় এনে সরাসরি বললাম, ‘আপনার নজর তো খুব বাজে।’
ওনি থতমত খেয়ে বললেন, ‘মানে?’
আমি সন্দেহজনক গলায় বললাম,
-আপনি আমার দিকে বাজে নজরে তাকাচ্ছেন আর বাজে ইঙ্গিত ও দিচ্ছেন। ছিঃ!
-কীসব বলছো আরুণী? মাথা গেছে পুরাই?
আমি ভাব নিয়ে বললাম, ‘ধরা পড়ে এখন..?’
ওনি রেগে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কীসের ধরা?’
-এইযে আপনি খালি বাড়িতে, গায়ে শুধুমাত্র টাওয়াল পরে আমাকে একা ঘরে ডেকেছেন। আবার আমাকে কীসব দেখাচ্ছেনও। ছিঃ লজ্জ্বা করছেনা আপনার? সারাদিন অর্নি অর্নি করে মরে যান আর রাতেরবেলা নিজের আসল রুপ দেখান। আবার আমাকেই বলেন আমি মুখোশধারী। আজ প্রমাণ হয়ে গেলোতো কে মুখোশধারী..?
ওনি বিস্ময় নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বোঝার চেষ্টা করছেন। কিন্তু আগামাথা কিছুই ওনার মস্তিষ্কে ঢুকছেনা। আমি হতবিহ্বল করে আমি ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।

চলবে…ইনশাআল্লাহ!

#হৃদমোহিনী
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৫

ওনি বিস্ময় নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বোঝার চেষ্টা করছেন। কিন্তু আগামাথা কিছুই ওনার মস্তিষ্কে ঢুকছেনা। ওনাকে হতবিহ্বল করে আমি ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। একটু একটু হাসিও পাচ্ছে। ওনার মুখটা দেখার মতোই হয়েছিলো। রাতের খাবারটা আমি বেড়ে দিলাম ওনাকে, গম্ভীর চাহনিতে আমাকে দেখছেন আর কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করছেন। বারবার নজর যাচ্ছে আমার গলার দিকে। আমি তাকে কিছুই বুঝতে না দিয়ে বলে উঠলাম, ‘কী হয়েছে? বসে আছেন কেন?’
-তোমাকে তার কৈফিয়ত কেন দেব? কে তুমি?
-কারণটা বারবার বলতে ভালো লাগছেনা।
-তুমি কি সবসময় এমনই ত্যাড়া?
-যে আমার সাথে যেরকম ব্যবহার করে আমি ঠিক সেরকম ব্যবহার ফিরিয়ে দিই। কারো হাতের পুতুল হয়ে থাকতে আমার মন চায়না, শুধু আপনার বেলায়ই কেন যে পুতুল হয়ে আছি বুঝতে পারছিনা।
ওনি খাবার মুখে দিয়ে বললেন, ‘তাহলে চলে গেলেই পারো।’
আমি ওনাকে আড়চোখে দেখলাম। বললাম, ‘ছেড়ে যেতে চাইলেই কি ছেড়ে যাওয়া যায়?’
-কেন যাবেনা?
-আপনি তো পুরুষমানুষ, তাই আমার কষ্টটা বুঝবেননা।

ওনি কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। আমি আর কিছুই বললামনা। ওনি উঠে চলে গেলেন। বাবা-মা না থাকায় আমি আলাদা ঘরে থাকলাম, ওনিই আমাকে ঘরে জায়গা দিলেননা। সেদিনের পর অনেকগুলো দিন কেটে গিয়েছে। বাবা-মা প্রতিনিয়ত ফোন করে ছেলের খোঁজখবর নিচ্ছেন, আমারও নিচ্ছেন। ছেলের মাঝে এতোদিনে কী কী চেঞ্জ এসেছে সেগুলো আমি তাঁদের জানালাম। সেগুলো জেনে ওনারা ভাবলেন হয়তো খালি বাসায় আমার সাথে সময় কাটাচ্ছে তাই অর্নির ঘোর থেকে বেরিয়ে আসছেন ধীরে ধীরে। তাই ওনারা আর ফিরছেননা ইচ্ছে করেই। ধূসরের মূলত আমার সাথে চোখ রাঙিয়ে কথা বলাটা কমেছে আর কারণে অকারণে আমাকে উপর রেগে যাওয়াটা কমেছে। কারণ তিনি চাইলেও ওনার অর্নির প্রতি কঠোর দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে পারেননা। আর আমিতো অর্নিরই আরেক অংশ! নেশা করার স্বভাবটা কাটেনি বরং রাত হলেই এসবে বুঁদ হয়ে থাকেন। সেজন্য আমি ওনার আশেপাশেও যাইনা। এছাড়া বেশ ভালোভাবেই দিনগুলো কেটে যাচ্ছিলো, তিনবেলার খাবারটা ঘরেই খান। অবশ্য সুযোগ পেলে আমায় কটুক্তি করতেও ছাড়তোনা। পদে পদে বুঝিয়ে দিতো আমি খারাপ আর স্বার্থপর মেয়ে। মাঝেমাঝেই আমার দিকে অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে থাকতেন, আমি সামনে গেলেই কেমন ছটফট করে পালাতে চাইতেন! আমি বুঝতামনা কেন এমন হয় ওনার!

একদিন দুপুরে খেতে বসে ওনাকে বেশ অন্যরকম লাগছিল। ছটফট করছিলো যেন। পুরো খাবার না খেয়ে ওনি অর্ধেক খেয়েই উঠে গেলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘উঠলেন যে? খাবারটা শেষ করুন।’
ওনি ধপ করে আবার চেয়ারে বসে পড়লেন। চেহারায় ভীষণ অস্বস্তি। নতমুখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি, সঠিক জবাব দিবে।’
আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘জি,বলুন।’
-তোমার গলায় কীসের দাগ ছিলো?
আমি থতমত খেয়ে বললাম, ‘কই কীসের দাগ? ওটাতো এমনি।’
-তুমি সত্যটা বলছোনা আমায়, সেদিনও এড়িয়ে গেছো।
তারপর আবার চুপ করে থাকলেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠলেন, ‘দেখো। আমি অর্নিকে খুব ভালোবাসি। ও আমার ঠিক কতটা জুড়ে আছে সেটা বলে বোঝানো আমার দ্বারা সম্ভব নয়। ওর চলে যাওয়াটা আমি মেনে নিতে পারছিনা। তাই আব্বু-আম্মুর মুখের দিকে তাকিয়ে তোমাকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছি। আমি আজকাল নেশায় ডুবে গেছি, কখন কার সাথে কী-রুপ ব্যবহার করছি আমার মনে থাকছেনা। আমি আমার স্বত্ত্বাতেই নেই৷ তাই বলে রাখছি আমার পক্ষে কখনোই তোমাকে মেনে নেওয়া সম্ভব হবে কিনা জানিনা, কিন্তু আমাদের মধ্যে কিছু হতে দিওনা। কারণ আমি সেটা মানবোনা। আর তোমাকেও আমি খুব ঘৃণা করি কারণ তুমি খুব স্বার্থপর।’

ওনার কথাগুলো শুনে কান্নাগুলো আমার গলায় আটকে আছে। যে-কোনো মুহূর্তেই তা উপচে পড়বে। তবুও স্বাভাবিকভাবেই বললাম, ‘আমি স্বার্থপর?’
-হুঁ। প্লিজ এটা নিয়ে কথা বাড়িওনা। আমি তোমার সাথে তর্কে যেতে চাইনা।
-আমিও চাইনা। কিন্তু আপনি বরাবর আমাকে সব দোষ দিয়ে যাবেন আর সেটা আমি মেনে নেব, তা-তো হয়না।
-কারণ ভুলটা তোমারই বেশি।
আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। ওনাকে কিছুক্ষণ অপেক্ষা কর‍তে বলে সব রান্নাবান্না গুছিয়ে আবার এলাম। ওনি সোফায় বসে আছেন চিন্তিতমুখে। আমি সেখানে গেলাম এবং ওনাকে কঠোর গলায় বললাম, ‘আজ এর একটা বিহিত হয়ে যাক!’
ওনি হতভম্ব হয়ে বললেন, ‘কীসের বিহিত?’
-দেখুন, আমি বরাবরই বাস্তবে বিশ্বাস করে গেছি। আবেগকে কখনোই পশ্রয় দিতে চাইনি, কিন্তু অর্নি চলে যাওয়ার পর থেকে না চাইতেও আমাকে আবেগকে বরণ করে নিতে হচ্ছে। এতে আমার নিজের কাছে নিজেকেই অচেনা লাগছে,আমার ভাবমূর্তি কমে যাচ্ছে। নিজেকে পনেরো বছরের কিশোরী মনে হচ্ছে। আমাদের বিয়ে হয়েছে এক মাসও হয়নি, কিন্তু আপনি প্রতিনিয়ত আমার সাথে রুডলি বিহেভ করে যাচ্ছেন। এর কারণটা আজও জানতে পারিনি, প্লিজ খোলাসা করে বলুন আমার দোষটা ঠিক কোথায়?

ওনি আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে চুপ করে বসে রইলেন। একপর্যায়ে উঠে চলে যেতে নিলেই আমি তাঁকে আটকালাম। পেছন থেকে ওনার হাত টেনে ধরে বেশ শান্তভাবেই বললাম, ‘উত্তর দিয়েই যেতে হবে।’
-তোমার দোষ তুমি স্বার্থপরের মতো আমায় বিয়ে করেছো।
-করে লাভটা কী হলো?
-লাভ/ক্ষতির হিসেবটা তুমি ভালো জানো।
-কিন্তু আমার লাভের লাভ কিছুই তো হলোনা, সবকিছু আপনি ভোগ করলেন একা। আর আমি হলাম দোষের পাত্রী। আমি কি এতোই ঠুনকো? আপনি কী ভাবেন যে আমি বানের জলে ভেসে এসেছি?
-কী করেছি আমি?
-আপনি কিছুই করেননি। আমিই বোকা ছিলাম। আপনাকে অর্নির ঘোর থেকে বের করে আনার জন্য আব্বু-আম্মু আমাকে ইউজ করে গেছেন। অর্নির কথা ভেবে আমিও সেটা করে গিয়েছি। বিনিময়ে আমি কী পেয়েছি? আপনার এই বিশাল সম্পত্তি? নাকি টাকাপয়সা? না..সেসব কিছুই পাইনি। পেয়েছি আপনার অবজ্ঞা, অবহেলা, বিষাক্ত কথাবার্তা আর হয়েছি ভোগের সামগ্রী। আমার সব স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে আপনার সেবায় মত্ত্ব ছিলাম বিনিময়ে আমাকে স্বার্থপর উপাধি পেতে হলো। ভালো অনেক, তাইনা? তারপর একটু থেমে অভিমানের ঠেলায় বললাম, সবকিছুর জন্য দায়ী অর্নি, আমি কখনোই ওকে ক্ষমা করবোনা৷ নিজে চলে গিয়ে আমায় এমন এক নরকে এনে ফেললো যে আমি তাঁর উত্তাপ সহ্য করতে করতে ক্লান্ত.. বড্ড ক্লান্ত!

ওনি ভ্রুকুটি করে আমাকে দেখছেন। আমি কথাগুলো বলতে বলতে হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম। ওনি কী কখনো বুঝতে পারবেননা যে আমি ওনাকে একটু হলেও ভালোবেসে ফেলেছি? নাহ, কোনোদিন বুঝবেনা। কান্না থামাতে আমি দৌড়ে ঘরে চলে গেলাম। ওনি নির্বাক হয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলেন। ঘরে এসে কাঁদলাম অনেকক্ষণ। নিজের কষ্টটা আর একা বইতে পারছিনা আমি। ধূসরের কাছে আমি আজও একই রয়ে গেলাম, স্বার্থপর। চোখমুখ মুছে রাতের খাবার না খেয়েই আমি দোতলার কোণের একটা ঘরে শুয়ে পড়লাম। এখন আমি এটাতেই থাকি। দরজায় দাঁড়ালে বিপরীত দিকে থাকা ধূসরের ঘরটা দেখা যায়। কাল হাত থেকে পড়ে চশমাটা ভেঙ্গে গেছে, মাথাটা বড্ড ব্যথা করছে। কান্নাকাটি করার ফলে ক্লান্ত হয়ে গেছি, খুব তাড়াতাড়িই ঘুমিয়ে পড়লাম। ধূসরকে দেখার কোনো ইচ্ছেই হলোনা।

ভোরের মিষ্টি রোদ চোখে পড়তেই আমার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলাম। শাড়ির আঁচল পিঠের নিচে পড়ে আছে। আল্লাহ! তাড়াতাড়ি তুলে নিলাম, শাড়িটা ঠিক করলাম। চুলগুলো হাতখোঁপা করে ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে এলাম। খুব স্বাভাবিকভাবেই চা-নাস্তা তৈরি করলাম। নয়টা বেজে গেলো কাজ করতে করতে। নাস্তা ডাইনিংয়ে রাখতেই ধূসর নেমে এলো। চুল উষ্কখুষ্ক, চোখমুখ ফোলা ফোলা। টলমল পায়ে সিঁড়ির রেলিং ধরে নামছে। আমি শুধু তাকিয়ে রইলাম। বললাম, ‘আপনার খাবার দিচ্ছি। খেয়ে নিন।’
ওনি ততক্ষণে নেমে এসে টেবিলে বসেছেন। বললেন, ‘আমি ফ্রেশ হইনি।’
-পরে ফ্রেশ হবেন। আগে খেয়ে নিন। আমিতো সারা সকাল আপনার জন্য বসে থাকবোনা।
ওনি অদ্ভুত কন্ঠে জবাব দিলেন, ‘অর্নি হলে বসে থাকতো।’
আমি কটমট করে বললাম, ‘আমিতো আপনার অর্নি নই। ইভেন আমি আপনার কিছুই হইনা। তাই আমার কাছে এসব আশা করবেননা।’
-জানো আমি কিন্তু বাবা হতাম।
এই কথা শুনে আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম। কী বলছে ওনি? আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম, ‘বাবা হতেন মানে?’
-হুঁ।
-অর্নি প্রেগন্যান্ট ছিলো?
-হুম।
-আপনি এটা আমাদের বলেননি কেন?
-বলে কী হতো? অর্নিকে ফিরিয়ে দিতে পারতে? আর আমাদের সন্তানকে?
-জানিনা আমি।
-এক্সিডেন্টের দু’দিন আগেই জানতে পারলাম আমাদের সন্তান আসতে চলেছে। বাসায় খবরটা জানাতে চেয়েছিলাম, কিন্তু অর্নি বললো ও সবাইকে সারপ্রাইজ দিবে। আর আসার পথেই তো আমাকে জীবনের সবচেয়ে বড় সারপ্রাইজটা দিয়ে দিলো, ছেড়ে চলে গেলো আমায়!
আমি হতবিহ্বল হয়ে বসে রইলাম। ওনি চায়ে চুমুক দিতে দিতে বললেন, ‘কাল রাতে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে।’
-কী?
-তোমাকে বলতেই তো নিচে এলাম।
-ওহহ। আপনি কিন্তু আজকাল আমার সাথে অনেক কথাও বলেন, অনেক ফ্রি মাইন্ডেড!
ওনি খোঁচাটা ধরতে পারলেন। রেগে বললেন, ‘বলি। কারণ বাসায় কথা বলার মতো কোনো মানুষ নেই।’
-আমাকে আপনার মানুষ মনে হয়? বাহ!
-স্যরি। মিস্টেক হয়েছে, আসলে তুমি মানুষ নও। তুমি একটা ডিমপাড়া মুরগী। হা হা।
আমি উঠে চলে যেতে নিলাম। ওনি ধমকে বললেন, ‘বসো এখানে৷ কথা শেষ হয়নি।’
আমি বসলাম। রাগটা গিলে নিয়ে শক্ত হয়ে বসে রইলাম। কথাগুলো বলার সময় ওনার চোখগুলো স্বপ্নালু হয়ে উঠলো। থমথমে গলায় বলতে থাকলেন,
-খুব সুন্দর একটা বাগান। মিঠা রোদ্দুরে ছেয়ে আছে চারপাশ। ঘাসের উপর আমি একা বসে আছি। হঠাৎই অর্নি এলো। ওর কোলে একটা ফুটফুটে বাচ্চা৷ আমাকে বললো বাচ্চাটার খেয়াল রাখতে। কিন্তু আমার কোলে না দিয়েই হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো।
আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘অর্নি এসেছে মানে? কোথায় ও?’
-স্বপ্ন ছিলো। কিন্তু অনুভূতিটা খুব বাস্তব। আমি বুঝতে পারছিনা ও কীজন্য এসেছে আর বাচ্চাটাকে আমার কোলে না দিয়ে কেনই-বা চলে গেলো। মানে কী এর?
আমি হেসে বললাম, ‘মানেটা আমি বলি?’
-বলো।
-আপনি বাচ্চা সামলাতে পারেননা, সেটা অর্নিও বুঝে গেছে। তাই আপনার কোলে না দিয়েই চলে গিয়েছে। হা হা…
ওনি রেগে বললেন, ‘স্টপ ইট। আমি জানি ওটা আমাদের সন্তান ছিলো। আমি দেখেছি বাচ্চাটা কি নিষ্পাপ। আমার দিকে তাকিয়ে হাসছিলো।’
আমি মজার ছলে বললাম, ‘আচ্ছা স্বপ্নের মেয়েটা অর্নি না হয়ে যদি আমি হই? কারণ আমাদের চেহারাতো এক। আপনি হয়তো ধরতে পারেননি ওটা অর্নি না আরুণী ছিলো। আর আরুণীর কোলে একটা বাচ্চা..’
ওনি আমার দিকে কড়া চোখে তাকালেন। গম্ভীর গলায় বললেন, ‘ওটা যদি তুমি হতে তাহলে আমি কখনোই বাচ্চাটাকে নিতে চাইতামনা।’
আমার মুখ থেকে হাসিটা উধাও হয়ে গেলো। বললাম, ‘কেন? নিতে চাইতেননা কেন?’
-আমি তোমার কোনোকিছুই চাইনা৷ আর বাচ্চা? হা হা.. সেটাতো নয়ই। তোমার থেকে কে সন্তান চেয়েছে! আমার সন্তান শুধু অর্নির হবে, অন্যকারোর নয়। মনে রেখো আরুণী।

চলবে…ইনশাআল্লাহ!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here