হৃদমোহিনী,০৬,০৭

0
1208

#হৃদমোহিনী,০৬,০৭
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৬

দিগন্তজুড়ে আঁকা সাতরঙা হাসিমাখা রংধনু। ভোরবেলায়ই আকাশের এমন রুপে মুগ্ধ হলাম। শেষ রাতের দিকে বৃষ্টি হয়েছিলো। ঠান্ডায় জমে যাবার মতো অবস্থা তখন। কম্বল মুড়ি দিয়েও দুচোখের পাতা এক করতে পারিনি৷ হঠাৎ কফির তৃষ্ণা পেলো আমার, উঠে নিচতলার রান্নাঘরে গেলাম। কাউকে দেখতে না পেয়ে নিজেই একমগ কফি তৈরি করলাম। চিনি ছাড়া ব্ল্যাক কফি, খেতে দারুণ লাগে আমার। আজকের ধোঁয়া উঠা গরম কফিটার দিকে তাকিয়ে ওর খুব ইচ্ছে করছে ধূসরের উপর ছুঁড়ে ফেলতে। কিন্তু তিনি এখন সামনে নেই। নাহলে ঠিকই ওনার হাতে ফেলতাম আর পোড়া লাল চামড়াটা দেখতাম মন ভরে। ব্যাটা আমার সাথে পাঙ্গা নিস? নেশাখোর! মনে মনে হাজারো গালি দিয়ে আবিষ্কার করলাম আমার নিজেকে খুব হালকা লাগছে। কেমন পৈশাচিক আনন্দ হলো আমার। কিন্তু ভাবনাটাকে দমিয়ে রেখে আকাশের সৌন্দর্য দেখায় মনোযোগী হলাম। পূর্ব দিকে লালচে-সোনালি সূর্যদেব উঁকি দিচ্ছে। বৃষ্টিতে সতেজ হওয়া প্রকৃতি বাতাসে দুলছে। বাগান থেকে ভুরভুর করে আসছে হাসনাহেনার সুবাস। ধূসরের নাকি খুব অপছন্দ এই সুবাসটা। কারণ তিনি জানেন আমার খুব ভালোবাসে হাসনাহেনার সুগন্ধ। আর যেটা আমার পছন্দ সেটা ধূসরের কোনোদিনই পছন্দ নয়। বিপরীত মেরুর একজন মানুষ সে। আজকের ভোরটা আমার জীবনের সেরা সকালের সূচনাগুলোর একটি যেন! মনটা আজ ভীষণ উৎফুল্ল কোনো এক অজানা কারণেই।

বাবা-মা ফিরেছেন তিনদিন হলো। ওদের সামনে ধূসর আমার সাথে কোনো খারাপ ব্যবহারই করেননি। তিনি বুঝাতে চান যে ওনি ভালো হয়ে গেছেন। এমনকি আমাকে ওনার ঘরে থাকার পারমিশন অবধি দিয়েছেন। যদিও সম্পর্কটা আমাদের ভেঙ্গে যাওয়ারই মতোন। আমি ওনার খুব করে খেয়াল রাখছি, ওনার পোশাক-আশাক ধুয়ে দিই, পছন্দের খাবার তৈরি করি, ভালো ব্যবহারও করি। ওনি এগুলোর কোনো দামই দেননা। দুপুরে মায়ের সাথে হাতে হাতে ঘর গুছিয়ে দিচ্ছিলাম, ধূসর বাবার সাথে এক আত্মীয়ের বিয়ে খেতে গেছে। যেতে তো রাজিই হননি, জোর করেই নিয়ে যাওয়া হয়েছে। মা জিজ্ঞেস করলেন, ‘ধূসর কী এখনো আগের মতোই?’

-নাহ৷ পাল্টেছে তো খানিকটা।
-কবে যে পুরোপুরি শোক কাটিয়ে উঠতে পারবে!
-খুব দ্রুতই। আমি চলে গেলেই বোধহয় ওনি ঠিক হয়ে যাবেন।
মা চমকে বলল, ‘তুমি চলে গেলে মানে?’
আমি হেসে বললাম, ‘আসলে ওনিতো আমার জন্যই এমন করে। তাই বলছি আমি দূরে চলে গেলেই ভালো।’
-এটা হয়না কিছুতেই। সে মানুক আর না মানুক তোমাদের দুজনের বিয়ে হয়েছে। অর্নির প্রতি ও যতোটা সিরিয়াস ছিলো, তোমার প্রতি ততোটাই থাকা উচিৎ।
-ওনি সিরিয়াস হবেননা মা।
মা আর্তনাদ করে বললেন,
-তাই বলে তুমি চলে যাবে? তুমিও কী মানোনা ও তোমার স্বামী?
আমি খানিক চুপ থেকে ক্ষীণ কন্ঠে বললাম, ‘বিয়ে যখন হয়েই গেছে আমি মানিয়ে নিতে চেষ্টা করেছি এবং করছি। কিন্তু ওনি তা করছেননা। আর এমন হলে কোন সম্পর্ক টিকবে আপনিই বলুন?’
-তুমি কী বিয়েটা ভেঙ্গে দিতে চাও?
আমি বললাম, ‘নাহ, শুধু দূরে চলে যেতে চাই।’
-কেন মা?
-যেখানে আমার সম্মান নেই সেখানে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে।
মা অপরাধী গলায় বললেন, ‘আমাদের প্রতি তোমার কোনো অভিযোগ থাকলে নিদ্বির্ধায় বলে ফেলো মা, শুধরে নেওয়ার চেষ্টা করবো। আসলে ছেলের জন্যই আমাদেরকে স্বার্থপর হতে হয়েছে।’

আমি মায়ের কাছে গিয়ে ওনার হাতদুটো মুঠোয় নিলাম। হাসিমুখে বললাম, ‘আপনাদের প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই আর কেনই-বা থাকবে বলুন তো? আপনারা যথেষ্ট ভালোবাসেন আমায়, আমি শুধু আপনার সাইকো ছেলেটার কথা বলছি। দেখেন না আমাকে দেখলেই এমন করে তাকায় যেন চিবিয়ে খেতে পারলে ওনার মন-মস্তিষ্ক শান্তি পাবে। রাত হলেই মাতাল হয়ে আমার কাছে আসবে, দিন হলেই বলবে তোমাকে আমার চাই-না! বলুন তো আমি কী এতোই ফেলনা?
কথাগুলো বলেই খেয়াল করলাম ওনার চোখে পানি। কেঁদে কেঁদেই আমাকে বললেন,
-তুমি যা-ই বলো, আমাদের ছেড়ে কোথাও যাবেনা। নাহলে আমিই এবার ঘর-সংসার ছেড়ে বনবাসী হবো। ছেলে থাকুক তার ইগো নিয়ে।
-আপনারা কেন ছেড়ে যাবেন? এটা আপনার বাড়ি, আপনার সংসার।
-আমার দিন ফুরিয়ে গেছে এখন তো সবই তোমার।
আমার ছেলেকে ভুল বুঝোনা তুমি মা, দরকার হলে আমি ওকে বোঝাবো।
-তার দরকার নেই৷ ওনি ওনার মতো চলুক। জানেন সেদিন আমায় কী বললো?
মা উৎসুক কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী?’

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাকে সেদিনের ঘটনাটা খুলে বললাম। শুনেই মা রেগে গেলো। তীক্ষ্ণস্বরে চেঁচিয়ে বলল, ‘মানে? কী ভেবেছেটা কী ও? জীবনটা এতোই সহজ? তোমাকে সে বিয়ে করেছে আর বাচ্চা মানবেনা? আরুণী? তুমি কী ওকে বলোনি যে সেদিন রাতে কী হয়েছে তোমাদের মধ্যে?’

আমি মাথা নিচু করে না বোধক জবাব দিলাম। ওনি আমার কাঁধে হাত রেখে গাঢ় নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ‘বলে দাও মা।’
-বলে দেব?
-হুঁ। তারপর জানে ও কী করবে৷
-ওনি কিন্তু আমাকে কয়বার জিজ্ঞেসও করেছিলেন এ বিষয়ে।
-তুমি বলোনি কেন?
-যদি আমাকে সুবিধাবাদী ভাবে!
-ভাবাভাবির কিছু নেই৷ ওর উপর অবশ্যই তোমার অধিকার আছে। তুমি সুবিধার হও আর যা-ই হও সে কেন তোমাকে জোর করলো? দোষটা সম্পূর্ণ ধূসরের।
আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘মানে?’
-সে কেন নিজেকে সামলাতে পারলোনা!
-থাক মা।
-তোমাদের বিয়ে হয়েছে এতোদিন হলো। তোমার বাবা ফোন করেছিলো, ওই বাসায় তো যাওয়া হয়নি এখনো। ধূসর ফিরুক ওর সাথে কথা বলে দেখি!
-ওনি যাবেনা আমি নিশ্চিত।
-আমার উপর ছেড়ে দাও বিষয়টা।
-আচ্ছা।
রাতেরবেলা ঘুমানোর জন্য আমি নিচে বিছানা করছি এমন সময় ধূসর ঘরে আসলেন। চোখেমুখে বিরক্ত ভাব, যেন এই দুনিয়ার সব প্রাণী, আকাশ-বাতাস ওনাকে জ্বালাচ্ছে। দরজা লাগিয়ে সোজা ওয়াশরুমে ঢুকলেন। গোসল সেরে বেরুলেন। পরণে টাওয়াল। আমি চোখমুখ কুঁচকে বললাম, ‘আপনার কী কোনো লজ্জা নেই? নির্লজ্জ কোথাকার।’
ওনি রেগে বললেন,
– এখানে নির্লজ্জের কিছু নেই। বাট ইউ আর শেইমলেস ইউরসেলফ..
-আপনার মাথা।
-বাড়ি যাবে বলে খুব আনন্দ হচ্ছে তাইনা? যাবে তো যাও, মাঝখান থেকে আমায় ফাঁসিয়ে দিলে।
আমি ভাব নিয়ে বললাম,’বিয়ে করেছেন আর ফাঁসবেন না, এমনটা হয় নাকি? কিছুদিন পর তো আমার আঁচল ধরে বসে থাকবেন, চোখে হারাবেন!’
ওনি জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে বললেন,
-নো নেভার।
-দেখা যাবে।
ওনি হুট করে আমার চশমা খুলে নিয়ে মেঝেতে আছাড় মারলেন, যার ফলে সেটা ভেঙ্গে গেলো। আমি রেগে বিছানা থেকে উঠে ওনার সামনে দাঁড়িয়ে চিল্লিয়ে উঠলাম। একটানে ওনার টাওয়াল খুলে দিয়েই বুঝতে পারলাম কি ভয়ানক কান্ড করে বসেছি! ওনি আহাম্মকের মতো চেয়ে আছেন আমি ভয়ে উল্টো ঘুরে দাঁড়িয়ে আছি। মনে মনে সব সূরা আওড়াতে লাগলাম। ইয়া আল্লাহ মাফ করুন, এটা আমি কী করে বসলাম?

ওনি দ্রুত টাওয়ালটা পরে নিয়েই রেগে বললেন, ‘হোয়াট দ্যা হেল আরুণী? তোমার মাথায় কী সেন্স নেই? এতোবড় ধ্যাড়ি মেয়ে হয়েও এসব করতে তোমার লজ্জা করলোনা? আমার মানসম্মান নিয়ে টানাটানি! থাপ্পড় খাবার খুব শখ হয়েছে বুঝি? আন্সার মি…

আমি কাঁপতে কাঁপতে বললাম, ‘আপনি আমার চশমা ভাঙলেন কেন?’
-তেজ কমবেনা তাও। স্টুপিড কোথাকার।
আমি জ্বলে উঠলাম। কটমট করে বললাম, ‘আপনার নিজের দোষটা দেখে পরে আমার উপর চিৎকার করবেন বুঝলেন? ইউ আর সো..’
বাক্যটা শেষ না করেই চুপ করে গেলাম। গিয়ে মেঝেতে পাতানো বিছানায় শুয়ে পড়লাম। ওনি ভয়ংকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। আমি কাঁথার ভিতর মুখ লুকালাম। ওনি ততক্ষণে বিছানায় উঠে বসেছেন। ডিংক্স নেওয়ার পায়তারা করছেন। মায়ের কথাগুলো মনে হতেই কিছু একটা ভাবলাম।

হঠাৎ করেই আমি কাঁথার ভিতর থেকে মুখ তুলে বললাম, ‘রাতে এসব গিলবেননা। এইসময় আপনি নিজের মধ্যে থাকেননা। যদি কিছু ঘটে যায় তখন কিন্তু আমার দায় নেই, এই তিনদিনও আপনি মাতাল হয়ে কতকিছু করেছেন। এবার এসব বন্ধ করুন।’
ওনি অবাক হয়ে বললেন, ‘কতকিছু করেছি মানে?’

আমি শান্তস্বরেই বললাম, ‘একজন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যা হয়, আপনি তা-ই করেছেন। তাই আজ সতর্ক করে দিলাম। ডোন্ট কাম টু মি…’

ওনি তৎক্ষনাৎ আমার কাছে এসে আমাকে টেনে তুললেন। বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘তার মানে বিয়েরদিন রাতে…’
-হুঁ। সেদিনও।
ওনি আমাকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিলেন। মাথা চেপে ধরে জোরেই বললেন, ‘তুমি সত্যিই একটা সুবিধাবাদী লোভী মেয়ে আরুণী। তোমার প্রতি আমার ধারণাগুলো একটু হলেও পাল্টেছিলো কিন্তু সেসব তুমি নিজেই ভুল প্রমাণ করে দিলে। আমি বারবার তোমাকে জিজ্ঞেস করার পরেও তুমি আমাকে প্রশ্নের উত্তর দাওনি আর আজ এসব বলছো! কী করে পারলে আমার অসহায় অবস্থার সুযোগ নিতে? বলো..

চলবে…ইনশাআল্লাহ!

#হৃদমোহিনী
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৭

ওনি তৎক্ষনাৎ আমার কাছে এসে আমাকে টেনে তুললেন। বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘তার মানে বিয়েরদিন রাতে…’
-হুঁ। সেদিনও।
ওনি আমাকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিলেন। মাথা চেপে ধরে জোরেই বললেন, ‘তুমি সত্যিই একটা সুবিধাবাদী লোভী মেয়ে আরুণী। তোমার প্রতি আমার ধারণাগুলো একটু হলেও পাল্টেছিলো কিন্তু সেসব তুমি নিজেই ভুল প্রমাণ করে দিলে। আমি বারবার তোমাকে জিজ্ঞেস করার পরেও তুমি আমাকে প্রশ্নের উত্তর দাওনি আর আজ এসব বলছো! কী করে পারলে আমার অসহায় অবস্থার সুযোগ নিতে? বলো.. ‘

আমি শুধু চুপ করে ওনার কথাগুলো শুনে গেলাম। ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দেওয়ায় খাটের কোণাতে পড়ে মাথায় বারি খেয়েছি, তার উপর চশমাও নেই। মাথাসহ পুরো শরীর বড্ড ব্যথা করছে, শরীর অসাড় হয়ে আসছে। মাথাটা ভার ভার লাগছে। আমি কাঁদছিনা একটুও। ভীষণ খারাপ লাগছে কিন্তু ওনাকে সেটা বুঝতে দিচ্ছিনা। ঠিক আগের জায়গায় গিয়ে শুয়ে পড়ে শরীরে কাঁথা টেনে নিলাম। আস্তে করে বললাম, ‘এখন কিছু বলতে পারছিনা। আমি ঘুমাবো।’
-বলার মতো কোনো মুখ নেই বলেই লুকাচ্ছো।
-আমি কথা বাড়াতে চাচ্ছিনা, আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন।
-ভালো মানুষ সাজা হচ্ছে তাইনা? বেশ ভালো এক্টিং!
-হুঁ। জানেন তো, আমার ভীষণ ইচ্ছে ছিলো হিরোইন হওয়ার। কিন্তু অভিনয় জিনিসটাকে আমার এতো অপছন্দ যে হিরোইন হওয়াটা আর হয়ে উঠেনি।
-ভিলেন হয়ে আমার জীবনে প্রবেশ করেছো..
-এতকিছু জানিনা। লাইটটা অফ করে দিন। ঘুম পাচ্ছে আমার।
ওনি আমার নরমাল বিহেভিয়ারে আরো রেগে গেলেন। একগ্লাস পানি এনে আমার উপর ছুঁড়ে মারলেন। আমি ধড়ফড়িয়ে উঠে দাঁড়ালাম। শাড়ি ভিজে একাকার। ওনার দিকে মিটিমিটি করে তাকানোর চেষ্টা করছি। জানিনা তখন আমার কী হলো আমি ওনাকে কাছে টেনে আনলাম এবং ওনার ঠোঁটে ঠোঁট বসিয়ে দিলাম। ওনাকে জাপটে ধরলাম এমনভাবে যে আমাকে ছাড়াতেই পারছেননা। নিজের এতো শক্তি দেখে আমিই অবাক। খানিকক্ষণ পরে ওনাকে ছেড়ে দিয়ে দেখলাম ওনি রাগী এবং বিস্মিত চাহনিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। ধমকে উঠে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এটা কী করলে তুমি আরুণী?’
-আদর করলাম।
-তোমার সাহস তো কম নয়!
-জি। আমি বড্ড সাহসী।
-এক থাপ্পড়ে দাঁত ফেলে দেবো অসভ্য মেয়ে।
আমি বিকারগ্রস্ত মানুষের মতো বললাম, ‘আমি কাছে গেলেই অসভ্য আর আপনি আমার কাছে এলে সেটা সভ্য বুঝি?’
-তোমাকে আমি এই অধিকার দিইনি যে আমার সাথে এমন করবে।
-আমিও দিইনি। ফ্রি-তে আমায় ইউজ করেছেন সবাই, এবার আমি খানিকটা উসুল করলাম।
-বাজে মেয়ে কোথাকার।
-যান তো। ঘুমিয়ে পড়ুন। বেশি রাত জাগা ভালো নয়।
-তোমার পারমিশন নিয়ে চলতে হবে নাকি?
আমি দুর্বোধ্য হাসলাম। মাথাব্যথা ক্রমশই বাড়ছে। ভীষণ ক্লান্তিতে আর এক পা-ও ফেলবার শক্তি নেই আমার। ধপ করে নিচে বসে পড়লাম। অবশেষে চারপাশ অন্ধকার হয়ে এলো আর আমি জ্ঞান হারালাম!

ড্রিম লাইটের নীলাভ আলোয় ঘরটাকে মায়াপুরী লাগছে। চারপাশের গুমোট অন্ধকার আর জানালা দিয়ে আসা ঠান্ডা বাতাসে আমি শিউরে উঠছি বারবার। মাথাটা ভার হয়ে আছে। শরীর নাড়ানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হলাম। একি! আমি নড়তে পারছিনা কেন? আরও একবার ঘরটা পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে পারলাম আমি।বিছানায় শুয়ে আছি। অবাকের চরম শিখরে পৌঁছালাম যখন দেখলাম আমি ধূসরের বুকে শুয়ে আছি। ঘেমেনেয়ে একাকার আমি। বেশ ভালোই লাগছিলো এভাবে থাকতে। মৃদু আলোয় ওনার মুখটাকে কি নিষ্পাপ দেখাচ্ছে। চুলগুলো কপালের কাছে লেপ্টে আছে। আমি হাত দিয়ে সরিয়ে দিলাম। খপ করে আমার হাত চেপে ধরে অস্ফুটস্বরে বলে উঠলেন, ‘ঘুমাও অর্নি!’

আমার মনে পড়ে গেলো কিছুক্ষণ আগের কথা। এখনো অর্নি? আরুণী তাঁর কিছুই নয়? তৎক্ষনাৎ আমি ওনাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বিছানায় উঠে বসলাম। তাতে ওনার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। চোখ কচলে উঠে বসে বাতি জ্বালালেন। উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, ‘ঠিক আছো এখন?’
-কেন? আমার কী হয়েছিলো যে আমি ঠিক নেই বলে মনে হলো?
-তুমিতো জ্ঞান হারিয়েছিলে!
-ওহহ! বিছানায় এলাম কীভাবে?
ওনি কাচুমাচু করে বললেন, ‘আমি নিয়ে এসেছি।’
আমি কড়া চোখে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেন?’
-তোমাকে অসুস্থ দেখাচ্ছিলো। ভাবলাম নিচে শুলে কষ্ট হবে, তাই নিয়ে এসেছি!

হায়! ধূসর, আপনি শুধু আমার শারীরিক কষ্টটার কথাই ভাবলেন? আমার মনের উপর দিয়ে যে কালবৈশাখি ঝড় বয়ে যাচ্ছে সেটা বোঝার চেষ্টা করছেন না কেন? আপনার নামটার মতোই কি আপনার হৃদয়েও ধূসর মেঘের রুপ ধারণ করেছে? এতো নিষ্ঠুর কেন আপনি? কথাগুলো মনে আসতেই আমার চোখ ভিজে উঠলো। ছোট্ট করে বললাম, ‘থ্যাংকস।’
বলেই নিচে এসে শুয়ে পড়লাম। ওনি বললেন, ‘চাইলে ওপরে এসে শুতে পারো।’
-আমি এখানেই ঠিক আছি। আপনি আজ ছাইপাঁশ গিলেননি?
ওনি ধীর কন্ঠে বললেন, ‘না খাইনি।’
-ভালো।
খানিক নিরবতা পালন করে ওনি জিজ্ঞেস করলেন,
-তোমার কী শরীর খারাপ? জ্ঞান হারিয়ে ফেললে যে?

এত খোঁজ নেওয়ার কিছু নেই বলে আমি পাশ ফিরে শুলাম। সারাটারাত নির্ঘুম কাটলো। চোখের পানিতে বালিশ ভিজে একাকার। ধূসর বিছানায় ঘুমে মগ্ন। সব কথা বলে দিয়ে নিজেকে একটু হালকা লাগছে। কিন্তু আর নয়! আর কিছুদিন ধূসরের সামনে থাকলে আমি পাগল হয়ে যাবো। কাল বাড়ি যাবো ভেবেই কান্নাটা আরও গাঢ় হলো।

সকালবেলা খুব স্বাভাবিকভাবেই সবার সঙ্গে বসে নাস্তা খেলাম, ঘর গুছালাম। বাগানের গাছগুলোতে পানি দিয়ে এলাম। সম্প্রতি আমি একটা বিড়াল পুষি। নাম রেখেছি “কিশমিশ”। ও একমাত্র আমার সময় কাটানোর প্রধান মাধ্যম। ধূসর দুচোখে ওকে সহ্য করতে পারেনা। বিড়াল দেখতে পারেনা এমনটা নয়, শুধুমাত্র এটা আমার বলেই। তার উপর একদিন ওর কোলে উঠে মলত্যাগ করেছিলো, একদিন খিমচা দিয়েছে, বারান্দার গাছগুলো কামড়িয়ে ফালাফালা করেছে আর একবার ওনার ভাগের ইলিশ মাছটা খেয়ে নিয়েছিলো। তারপর থেকেই ” কিশমিশ” ওনার শত্রুতে পরিণত হয়েছে। কাল সন্ধ্যায়ও “কিশমিশকে” ধমক দিয়েছে কারণ বেচারির বেবি হবে। ওকে বাইরে কোথাও রেখে আসতে বলেছে। আমি আর মা ওনার প্রতিবাদ করেছি আর বাবার বকা শুনে ওনি “কিশমিশকে” বের করে দিতে পারেননি। আমি বিজয়ীর হাসি হাসছিলাম আর ওনি চোখ রাঙিয়ে বলেছিলেন, ‘কিশমিশের সাথে তোমাকে বের করে দিতে পারলে শান্তি পেতাম। দুজনেই অসহ্য!’

আজ “কিশমিশকে” ফেলে যেতে হবে খুব খারাপ লাগছে। ওকে খাবার দিতেই ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে তাকালো যেন কিছু বলতে চায়। তখন ধূসর সিঁড়ি দিয়ে নামছিলো। “কিশমিশ” একবার ওনার দিকে একবার আমার দিকে তাকায়৷ ধূসরকে নামতে দেখে আমি সেখান থেকে চলে এলাম। আমাদের বাসার সবার জন্য মা নানারকম খাবার-দাবার, দই-মিষ্টি, দিয়ে দিলেন। ধূসরও যাবে। সন্ধ্যায় আমরা রওয়ানা হলাম। মা বারবার বলে দিলেন খুব তাড়াতাড়ি যেন ফিরে যাই।

গাড়িতে আমি পেছনের সিটে বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়েছিলাম। পুরোটা সময় সন্ধ্যাবেলার শহরটাকে উপভোগ করে রাত আটটায় আমাদের বাসায় এসে পৌঁছালাম। আব্বু-আম্মু, চাচীমা, ফুপিরা আমাদের দেখে খুব খুশি হলেন। ঘটা করে খাবারের আয়োজন করলেন। আমি স্বাভাবিকভাবেই সবার সাথে বসে খেলাম। ধূসরও। কথাবার্তা খুব কমই হলো সবার সাথে৷ কিন্তু ধূসরের সাথে আজ সারাদিনেও আমি একটা কথা বলিনি। আমার বকবক শুনে এতোদিনে অভ্যাস, হঠাৎ করেই কথা বন্ধ করে দিয়েছি এজন্য হয়তো ওনার খুব আনইজি লাগছিলো। দু’বার আমার সাথে কথা বলতে এসেছিলো। আমি এড়িয়ে গেছি। কি দরকার কথা বলে মায়া বাড়ানোর? রাতেরবেলা আমি আম্মুর সাথে ঘুমানোর বায়না করলাম। সবাই ধূসরের সাথে থাকতে জোর করছিলো, কিন্তু আমি সেকথায় পাত্তা না দিয়ে মায়ের সাথে ঘুমাবো বলে গো ধরলাম। বাধ্য হয়ে আব্বু অন্যঘরে চলে গেলেন। রাতেরবেলা আম্মুকে জড়িয়ে ধরে চোখের পানি ফেলছি। আম্মু গভীর ঘুমে মগ্ন, একহাতে আমায় আগলে রেখেছে। মনে জমে আছে ধূসরের প্রতি হাজারো অভিমান৷ ওনি তো একবার হলেও বলতে পারতো ওনার সাথে থাকতে! প্রতিরাতে নেশার ঘোরে হলেও আমাকে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাতেন। ওনি কি কখনোই বুঝতে পারবেননা আমি এতে কতোটা সুখী ভাবতাম নিজেকে? এই দুইমাসে আমার অভ্যাসে পরিণত হয়েছেন ওনি! এটা কী ওনি জানতে পারবেননা কোনোদিন?

মানুষের জীবন কতই-না বিচিত্র! ধূসরের মতো এরকম একটা মানুষকে সবাই নিজের জীবনসঙ্গী হিসেবে আশা করে, কিন্তু আমি কখনোই করিনি। এরপরও নিয়তির লিখন মেনে নিয়েছি। কিন্তু ওনার এই দুর্ব্যবহার আমার আর সহ্য হচ্ছেনা। অথচ আমাদের মেয়েদেরকেই সবসময় সবকিছু মানিয়ে চলতে হয়। কারণ আমাদের ধৈর্যশক্তি বেশি। এই ধৈর্যশক্তির কারণেই কি আমাকে সব অন্যায়,অবহেলা মুখবুজে সহ্য করতে হবে? একটা শিক্ষিত, স্টাবলিশ মেয়ে হয়েও আমাকে সবাই প্রতিনিয়ত ব্যবহার করে যাচ্ছে। কেন? আমার কি মন নেই? আমার চাওয়া-পাওয়া থাকতে পারেনা? সেটা কী অপরাধ? অর্নি তো মরে গিয়ে বেঁচে গেলো আর আমি? ওর বোন বলেই সব এসে আমার ঘাড়ে পড়লো। আমি এতসব যন্ত্রণা নিয়ে কি করে বেঁচে থাকবো? মরে যেতে ইচ্ছে করছে আমার। আমি মরে গেলে কি ওনি খুব সুখে থাকবে? ওনার হৃদয়ের মোহিনী তো অর্নিই থাকবে! আমি কখনো অর্নির সাথে ওনার হৃদয়ে জায়গা নিতে পারবোনা?

চলবে…ইনশাআল্লাহ!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here