#হৃদমোহিনী,১২,১৩
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১২
গেস্টরুমের দিকে যাওয়া উচিৎ বলে গেলাম। কাজিনরা সবাই ওখানেই। কি সাজানো হচ্ছে দেখে আসা দরকার। কিন্তু ঘরে পা দিয়েই আমার চোখ ছানাবড়া। ওমা! এ আমি কাকে দেখছি? ধূসর! ও মাই গড। ওনি এখানে কীভাবে? আর কখন এলেন?
আমি ঘরে ঢুকতেই এক পল্টন মানুষ আমার দিকে তাকালো যেন ফিল্ম ইণ্ডাষ্ট্রির একজন আইকন আমি। আমি বিব্রত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন তোরা?’
সবাই সমস্বরে বলে উঠলো, ‘দুলাভাই অনি আপুর ফুলসজ্জার খাট সাজিয়েছে। কেমন হয়েছে এবার বলো!’
আমার মাথা ঘুরছে। মনে হচ্ছে অতলে তলিয়ে যাচ্ছি। একী শুনলাম আমি? আমি একটু পেছনে সরে দেয়ালে হাত রেখে নিজের ভরটুকু সামলে নিলাম। ধূসর! অনির ফুলসজ্জার খাট সাজাচ্ছে আর আমার বেলায় নেশাভাং করে কি না কি করেছে! ভাবা যায়?
-এই আপু? কী হলো তোমার?
আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,’কিছুনা। আমি যাই।’
-আরে বসো তো।
বলে পুনম আমায় জোর করে চেয়ারে বসিয়ে দিলো। আমি বিরক্ত গলায় বললাম, ‘আমার এখানে কি দরকার?’
-বারে, ভাইয়া এতো সুন্দর সাজালো আর তুমি দেখবেনা?
-না দেখবোনা।
-সে তোমার বর। বরের প্রতি এতো নিষ্ঠুরতম আচরণ করা ভালো নয়।
পুনমের কথা শুনে আমার মাথা ঘুরছে। বলে কি এই মেয়ে? সেদিনের পুচকির কি কথা রে বাবা! ধূসর শয়তানটাকে দেখো আলাভোলা মানুষের মতো চেহারা করে বসে আছে। যেন সে এই দুনিয়ার সবচেয়ে নিরীহ প্রাণী। একটা মানুষ এতো ইনোসেন্ট ফেইস নিয়ে কীভাবে বসে থাকতে পারে? দেখে তো মায়া লেগে যাবে! আমার ভেতরে থাকা আরেকটা আরুণী বলে উঠলো এর দিকে ভুলেও তাকাবিনা। গিরগিটি কোথাকার। ভালো মানুষ সাজতে এসেছে। আমি বিরক্ত চোখে তাকাতেই ওনি হাত দিয়ে চুলগুলো পেছনে ঠেলে টাইয়ের নটটা ঢিলে করে পুনমকে সহজ গলায় বললেন, ‘গিভ মি ওয়াটার প্লিজ!’
দেখো না, কথার ছিরি দেখো। সারাদিন ইংরেজিতে কথা বলতে বলতে ঘরেও ইংলিশের বুলি ঝাড়ছে। গা পিত্তি জ্বলে যায় ন্যাকামি দেখলে। অর্নি তুই একে পছন্দ করেছিলি? একে? আর ঠ্যাকায় পড়ে আমাকেও পছন্দ করতে হলো। নইলে তো কোনোদিন এর দিকে ফিরেও তাকাতাম না। নেহাৎ বর বলে কথা। কিন্তু আমাকে কি তার চোখে পড়েনি? আমি কি পানিতে বিষ মিশিয়ে দেব? যত্তসব! পুনম হলো বাচ্চা মানুষ ওকে বলার কি দরকার ছিলো? বিয়েতে আনন্দ করছে সেটায় বাগড়া দিচ্ছে। আরে এতোই যদি তেষ্ঠা পায় তাহলে নিজে গিয়ে খেয়ে নে না। তোর তো শ্বশুরবাড়িই থাকবে আজীবন। আমি ডিভোর্স দিলেও অর্নির বর হিসেবে এই বাড়ির দরজা সবসময় খোলা, আমার পরিবারের লোকেরা এতোটাও নির্দয় নয়, বুঝলি! বিরক্ত হয়ে আমি পুনমকে বললাম তুই বস। আমি নিয়ে আসছি। সবাই আমার দিকে ‘হা’ করে তাকিয়ে থাকলো।
পানি এনে ওনাকে দিতেই দেখলাম ওনি মিটিমিটি হাসছে। ঢকঢক করে পানিটা খেয়ে আমাকে গ্লাসটা ফেরত দিলেন। রাত বারোটার কাছাকাছি। আড্ডা দেওয়া শেষে অনি, আরাফাতকে রেস্ট করার জন্য ধূসর সবাইকে বেড়িয়ে যেতে বললো। নিজেই হাসি-ঠাট্টা করলো। সবার সাথে কি ফ্রি ভাবে কথা বলছে দেখো! আমি শুধু দেখে যাচ্ছি! আমাকে একটু ফাঁক পেয়েই অসহায় কন্ঠে বললেন, ‘প্লিজ আরেক গ্লাস পানি দাও।’
-এক্ষুনি তো খেলেন।
-আবার লাগবে।
-কেন? আপনার কি ডিহাইড্রেশন হচ্ছে? পানি না পেয়ে মারা যাচ্ছেন?
-এতো বাজে কথা বলছো কেন? আমি মরে গেলে তো তুমি বিধবা হয়ে যাবে, তাইনা? সো এসব অপয়া কথা বন্ধ করো।
আমি হতভম্ব হয়ে বললাম, ‘বিধবা হবো মানে?’
ওনি মুচকি হেসে বললেন,
-ওয়েল, বুঝিয়ে দিচ্ছি৷ এক্ষুনি তো তুমি বললে যে আমি পানি না পেয়ে মারা যাচ্ছি। আর আমি মারা গেলে আমার বউ হিসেবে তুমিই তো বিধবা হবে। আর দেশের একজন সচেতন নাগরিক হয়ে আমিতো আর তোমাকে বিধবা হতে সাহায্য করতে পারিনা। সো যাও পানি খাইয়ে আমাকে বাঁচাও।
এ কে? আদৌ ধূসর? ও আল্লাহ! কি বলছেন ওনি? এতো এতো রুপ ওনার? আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘আপনি আজ এতো কথা বলছেন কেন?’
ওনি আমার কথা যেন শুনতেই পেলেন না এমন একটা ভাব নিয়ে বললেন, ‘আমার ইচ্ছা।’
-আপনার ইচ্ছেই বা আমি শুনছি কেন? একটা নেশাখোর লোক!
ওনি টাইয়ের নটটা আরো ঢিলে করে আমার দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালেন। আমি চুপচাপ পানি এনে ওনাকে দিলাম। ওনি পানি খেয়েই একটা মুচকি হাসি দিলেন। গ্লাসটা রেখে আচমকা আমাকে কাছে টেনে নিলেন। এলোমেলো চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিতে দিতে বললেন, ‘আহা! এরকম করে কথা বলে নাকি কেউ? স্বামীর সাথে বেয়াদবি আল্লাহ মাফ করবেনা। এখন থেকে সংযত হয়ে কথা বলবে কেমন?’
ভীষণ অবাকে আমি তখন কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। নিজেকে সামলে কথার উত্তর দিতে গিয়েই দেখি গলা দিয়ে আওয়াজ বেরুচ্ছেনা। তোতলাতে তোতলাতে বললাম, ‘ছ ছাড়ুন ন…’
ওনি ছেড়ে দিলেন আমায়। অতঃপর বললেন, ‘আম্মু কোথায়?’
-ঘুমিয়ে আছে।
-উপস শিট….
-কোনো দরকার?
-হুঁ।
-আমাকে বলতে পারেন।
ওনি আমার দিকে চাইলেন। আমি থতমত খেয়ে বললাম, ‘বউয়ের অধিকার দেখাচ্ছিনা। ডিভোর্স তো দিয়েই দেবো। শত হলেও আমাদের গেস্ট আপনি, সুবিধা অসুবিধা দেখতেই হয়।’
ওনি প্রথমে রাগী তারপর শান্ত গলায় বললেন, ‘ওকে ওকে। তা তুমি যে আমায় ডিভোর্স দেবে তোমার ফ্যামিলির লোকেরা জানে তো? শুনেছি তোমার বাবা আই মিন আমার শ্বশুর নাকি এসব পছন্দ করেন না? ওনার নাকি দু’বার স্ট্রোকও হয়েছে? এইতো অর্নির নিউজ শুনেও একবার স্ট্রোক করেছে ক’দিন আগে। এখন যদি শুনে তার মেয়ে জামাইকে ছেড়ে দিতে চায় তাহলে ওনি নিশ্চয়ই চিন্তিত হবেন! আর চিন্তা করতে করতে আবার অসুস্থ হয়ে যাবেন। ডাক্তার বলবে এবার কিন্তু লাস্ট…. ‘
আমি ওনাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, ‘আপনাকে কেউ এসব ভাবতে বলেনি!’
-দেশের একজন সচেতন জামাই হিসেবে এটা আমার দায়িত্ব কর্তব্যের মধ্যে পড়ে! আচ্ছা বাদ দাও।
তারপর হাই তুলতে তুলতে বললেন, ‘আমার অনেক ঘুম পেয়েছে৷ আমি ঘুমাবো। অফিস থেকে এসেছি তো খুব টায়ার্ড লাগছে।’
-ঘুমান। আমিতো আপনাকে ধরে রাখিনি।
-আহা, এতো ঝগড়া করো কেন তুমি!
এমন সময় আম্মু এদিক দিয়েই কোথাও একটা যাচ্ছিলো। হাতে দুটো বালিশ। আমাদের দেখে কাছে এসে বললেন, ‘কিরে এখনো জামাইকে নিয়ে ঘরে যাসনি? আরে তোর আব্বু দেখতে পেলে বকাবকি করবে। যা যা ওকে ঘরে নিয়ে যা। বাবা খেয়েছো?’
-জি খাওয়া হয়েছে।
আম্মু মুচকি হেসে চলে গেলেন। আমার রাগ উঠছে। সবাই ইচ্ছাকৃতভাবে এসব করছে কিনা বুঝতে পারছিনা। কিন্তু ওনাকে খেতে দিলো কে? তাহলে কি ওনি আরো আগেই এসেছিলেন? সন্দেহপ্রবণ মন নিয়ে আমি ওনাকে জিজ্ঞেস করলাম,
-আপনাকে কে খেতে দিয়েছে?
-আমার কী হাত নেই? নিজে নিজেই খেয়েছি!
-আপনি কখন এসেছেন? আমিতো দেখতে পাইনি?
-সন্ধ্যের একটু আগে আগে। সব কাজটাজ তো আমিই করে দিলাম।
ওনার কথা শুনে আমি আকাশ থেকে পড়লাম। কী বলছে লোকটা। এত আগে এসেছে আর আমি ওনাকে দেখতেই পাইনি কি যে হলো আমার আজকাল চোখের মাথা খেয়ে বসে আছি৷ সব দোষ এই লোকটার। আমি রেগে বললাম, ‘আমার ঘুম পেয়েছে। আপনি কোথাও একটা গিয়ে শুয়ে পড়ুন। আমি যাচ্ছি।’
ওনি ভারী অবাক হওয়ার ভান করে বললেন, ‘কোথাও গিয়ে শুয়ে পড়বো মানে? শ্বাশুড়িমা তো তোমার ঘরে থাকতে বলে গেলো!
-বললেই আমি আপনাকে ঘরে জায়গা দিয়ে দেবো এটা ভাবা ভুল।
-বাহ! উপকারীর উপকারের এই প্রতিদান দিচ্ছো তুমি? আমার ঘরে কি তোমাকে জায়গা দিইনি? কয়েকটারাত আমার খাটে শোবার সুযোগ করে দিইনি? কাঁথা, বালিশ, মাদুরটা দিয়ে বুঝি তোমাকে হেল্প করিনি? আর আজ তুমি আমায় যেখানেসেখানে শুয়ে পড়তে বলছো, তুমি বেশ ভালো করেই জানো আমি কতোটা খুঁতখুঁতে, ওসিডি আছে।
-আমারও আছে। বাই।
বলেই আমি উপরে চলে এলাম। পেয়েছেটা কি উনি? আমি মগা? উহু একদমই না। ঘরে এসে দরজা আটকাতে গেলেই ওনি পা দিয়ে দরজা ঠেলে ধরলেন। আমি ওনার শক্তির কাছে হার মেনে সরতেই ওনি ঠুস করে ঘরে ঢুকে ঠাস করে দরজা বন্ধ করে দিলেন। আমি সেই শব্দে কেঁপে উঠলাম। আমার সাথেই থাকবেন নাকি ওনি? বাড়ির লোকেরা এমন একটা ভাব করছে যেন আমাদের মধ্যে সব স্বাভাবিক। অসহ্য! ও মাগো..একা পেয়ে যদি এখন আমার টুটি চেপে ধরে! আমি দুআ ইউনূস পড়তে লাগলাম। ওনি বিছানায় ধপ করে শুয়ে পড়লেন। আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘এটা বুঝি তোমার ঘর?’
আমি উত্তর দিলাম না। ওনি উঠে ঘরের নানা জিনিসপত্র ঘেঁটেঘুঁটে দেখছে আর প্রশ্ন করছে। আমি রাগ আর বিরক্তি নিয়ে সব শুনছি আর কটমট করছি। একটা কথার উত্তরও দিলামনা। আমার বেয়াদবিতে একপর্যায়ে ধূসর রেগে গেলেন। আমাকে ধাক্কা দিতেই ওনাকেসহ বিছানায় পড়ে গেলাম আমি। ইশ, কি লজ্জা! ওনি সেই অবস্থায়ই রেগে আমার উপর চিল্লাচ্ছেন।
-কি কথা কানে যায়না? আমি কী বোকা? নাকি তোমার চাকর? এতো এতো প্রশ্ন করছি আর তুমি এটিটিউড দেখাচ্ছো? এই ধূসরকে এটিটিউড দেখাচ্ছো, ইডিয়ট চাশমিশ কোথাকার!
-আমি কোনো এটিটিউড দেখাইনি।
-একদম চুপ। আমার সাথে লাগতে আসলে বেশি ভালো হবেনা। তোমার এটিটিউড ভেঙ্গে তোমার গলায় ঝুলিয়ে দেবো। মিসেস ধূসর!
আমি বললাম, ‘মিসেস ধূসর হলো অর্নি। আমি আরুণী, শুনতে পাচ্ছেন আপনি? মিস্টার ধূসর? আমি আরুণী। আর আরুণীই থাকতে চাই।’
ধূসরের চোখ লাল। দেখে মনে হচ্ছে তার বুকে হাজারো ব্যথার বাস। ওনার চেহারার ওরকম সুরত দেখে আমি একটু ভয় পেয়ে গেলাম। তিনি হঠাৎ আমার নাকে নিজের নাক ঘষে গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলেন, ‘আমার তো ওটাকেই চাই!’
চলবে…ইনশাআল্লাহ!
#হৃদমোহিনী
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১৩
-কী? কথা কানে যায়না? আমি কী বোকা? নাকি তোমার চাকর? এতো এতো প্রশ্ন করছি আর তুমি এটিটিউড দেখাচ্ছো? এই ধূসরকে এটিটিউড দেখাচ্ছো, ইডিয়ট চাশমিশ কোথাকার!
-আমি কোনো এটিটিউড দেখাইনি।
-একদম চুপ। আমার সাথে লাগতে আসলে বেশি ভালো হবেনা। তোমার এটিটিউড ভেঙ্গে তোমার গলায় ঝুলিয়ে দেবো। মিসেস ধূসর!
আমি বললাম, ‘মিসেস ধূসর হলো অর্নি। আমি আরুণী, শুনতে পাচ্ছেন আপনি? মিস্টার ধূসর? আমি আরুণী। আর আরুণীই থাকতে চাই।’
ধূসরের চোখ লাল। দেখে মনে হচ্ছে তার বুকে হাজারো ব্যথার বাস। ওনার চেহারার ওরকম সুরত দেখে আমি একটু ভয় পেয়ে গেলাম। তিনি হঠাৎ আমার নাকে নিজের নাক ঘষে গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলেন, ‘আমার তো ওটাকেই চাই!’
আমি ওনাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বললাম, ‘ওটাকে চাই মানে? ওটা কী?’
ধূসর আমার কপালে বেশ অনেকটা সময় নিয়ে চুমু খেলো। তারপর উঠে ওয়াশরুমে চলে গেলো। আমি হতভম্ব! এই লোকটা মনে হচ্ছে আমায় পাগল বানিয়ে দিবে। আমি কপালে আঙুল ছোঁয়াতেই কেমন ভেজা আর চটচটে লাগলো। ছিঃ ধূসরের লালা আমার কপালে লেগে…ইশ,,নেশাখোর লোক। এতো বাজে একটা কাজ কেন করলেন ওনি?? তার উপর অদ্ভুত ব্যবহার….
যাইহোক এখন বিছানা কোথায় করবো? এই লোক তো কাটলেও ফ্লোরে শোবেনা, আর ফ্লোরে বিছানা পাতানোর জন্য আমার ঘরে যথেষ্ট জায়গাও নেই, সোফা নেই। ওনি ফ্রেশ হয়ে এলেন একটা টাওয়াল শুধু পরণে। আমাকে চিন্তায় মগ্ন দেখে চুপ করে দাঁড়িয়ে পড়লেন ড্রেসিং টেবিলের সামনে। আমি ইতস্তত করে বললাম, ‘আপনার ঘুম পেলে শুয়ে পড়ুন।’
ওনি আয়না দিয়েই আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি বললাম, ‘হুঁ।’
-তাহলে শুয়ে পড়ো!
– আপনি বিছানায় শুয়ে পড়ুন।
-আর তুমি?
-আমি দেখছি কি করা যায়। পুনমের ঘরে….
ওনি গম্ভীর কন্ঠে বললেন, ‘কোথাও যাওয়ার দরকার নেই। এখানেই আমার সাথে, আমার পাশে ঘুমাবে। ওকে?’
-আমি কেন আপনার পাশে শুবো? আমার কোনো ইচ্ছে নেই।
-আমার আছে।
আমি তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললাম,
-খুব মজা পেলাম। বউ মানেন না আবার এক বিছানায় শুতে….
ওনি আয়নার সামনে থেকে সরে এলেন। ভ্রু কুঁচকে আমাকে অবাক করে দিয়ে বলে উঠলেন, ‘কে বললো মানিনা?’
-আপনি। ভুলে গেলেন?
-উপস..
-তাহলে?
-আমিতো তোমাকে বউ মানি।
-হাসালেন…অর্নিকে এতো তাড়াতাড়ি ভুলে গেলেন? এটাই আপনার ভালোবাসা??
ওনি হুট করে দাঁড়িয়ে পড়ে বললেন, ‘অর্নির সম্বন্ধে কোনো কথা আমি শুনতে চাইনা। শুয়ে পড়ো যাও, আর এটা নিয়ে কোনো ইস্যু তৈরি করবেনা। আমার ঘুম পেয়েছে, ঘুমাবো!’
ওনি বিছানায় শুয়ে অন্যদিকে মুখ করে শুয়ে পড়ে আলোটা নিভিয়ে দিতে বললেন। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাতি নিভিয়ে ওনার থেকে একহাত দূরত্ব বজায় রেখে শুয়ে পড়ি৷ চোখে ঘুম নেই আমার। হাজারো ভাবনা মাথায় উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। আচমকাই ধূসর আমার দিকে ফিরে তাকালেন আর বাঁ হাত দিয়ে টেনে নিজের কাছে নিয়ে নিলেন। আমি হাত-পা ছুঁড়াছুঁড়ি করতেই আমাকে শক্ত করে বিছানায় চেপে ধরে কপালে ঠোঁটের ছোঁয়া দিলেন। আমি বিরক্ত গলায় বললাম, ‘ছাড়ুন আমায়, হচ্ছেটা কি এসব? আমি অর্নি নই আর আপনিও মাতাল নন। ডিভোর্স দিয়ে দিব আপনা…..’
ওনি আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বলে উঠলেন,
-হুঁশশশ.. চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়ো। বেশি লাফালাফি করলে আর ডিভোর্স ডিভোর্স করলে এখন কিন্ত বাসর করে ফেলবো!
আমি শুধু চুপ হয়ে ওনার কান্ড দেখলাম। এভাবে না নড়তে পারছি না কথা বলতে পারছি। ধূসর ততক্ষণে ঘুমিয়ে কাদা। বিরক্তিতে মাথা ভনভন করছে। ইচ্ছে করছে এই দুনিয়া ছেড়ে চলে যাই। কেন এতো কষ্ট আমার? আমি কী করবো? শত ভাবনায় আচ্ছন্ন মস্তিষ্ক নিয়ে একটা সময় ঘুমিয়ে পড়লাম।
সকালবেলা ঘুম ভাঙলো পাখির কিচিরমিচির ডাক শুনে। ধূসরকে দেখতে পেলাম না। হয়তো নিচে চলে গেছে। আমিও হাতমুখ ধুয়ে নিচে নেমে এলাম। নাস্তার পর্ব চলছে। অনি, আরাফাতরা এবার চলে যাবে। ধূসর বাগানে ডেকোরেশনের লোকজনদের সাথে কথা বলছে। সাদা টি-শার্ট আর ট্রাউজার পরণে। আমি উঁকিঝুঁকি দিয়ে রান্নাঘরের ভেতরে এসে বসে রইলাম। পিঠা, ফলটলের ঝুড়ি সাজানো হচ্ছে। এগুলো দিয়ে দেওয়া হবে আরাফাতদের বাড়িতে। আম্মু আমায় খাবার বেড়ে দিলো। নিকিতা মা আমায় খাইয়ে দিলেন। অর্ধেক খেতেই কেমন কেমন লাগলো তাই না করে দিলাম, তাও মা জোর করলেন। মনে হচ্ছে সব বেরিয়ে আসবে ভেতর থেকে। আমি না পেরে আচারের বয়াম খুঁজে নিয়ে ঘরে এসে খেতে লাগলাম। উফ, কি যন্ত্রণা। পোলাও-কোর্মা, কাবাব, চিকেন টিক্কা রেখে কিনা জলপাইয়ের আচার খেতে হচ্ছে! রুচিটা বোধহয় নষ্টই হয়ে গেলো আমার। ডাক্তার দেখাতে হবে মনে হচ্ছে, এভাবে এতো আচার খাওয়া ঠিক না। পরে পেটের সমস্যা হয়ে যাবে!
অনি, আরাফাতকে বিদায় দেওয়ার সময় সবার সে কী কান্না। অনিতো আমায় জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হবার যোগাড়। আমার চোখের কোণেও জল এসে গেছিলো। কোনোমতে গাড়িতে বসিয়ে দিলাম। তারপর আরাফাত উঠলো। একে একে সবাই উঠলো। ওরা চলে যাওয়ার পরে বাড়িটা বেশ খালি খালি লাগলো। অবশ্য আমাদের মেহমান সবাজ রয়ে গিয়েছে। দুদিন পরই রিসেপশন। কেউ আর গেলোনা তাই। কাজিনদের হইচই সারাক্ষণ লেগে আছে। এই খেলা, সেই খেলা। আর তাদেরকে সঙ্গ দিচ্ছে আমার শ্রদ্ধেয় জামাই মিস্টার ধূসর!
বিকেলবেলা ছাদে বসে আছি একা একা। দৃষ্টি অনেক দূরে। ওইতো শহরের শেষ মাথায় রেললাইনের ওপারে মোহিনী নদীটা (ছদ্মনাম) দেখা যায়। আকাশে কালো মেঘ। নদীর পানি উত্তাল, বিশাল বিশাল ঢেউ। গাছপালা, আকাশ, নদী সব মিলিয়ে প্রকৃতি কী সুন্দর দেখাচ্ছে! এমন সময় একদল আন্ডাবাচ্চার দল নিয়ে ছাদে হাজির হলেন ধূসর মশাই। ওরা এখন কানামাছি খেলবে। এতবড় দামড়া ছেলে নাকি বাচ্চাদের খেলা খেলবে। যত্তসব ঢং….অর্নি তোর জামাই একটা পাগল, তুই জানিস? আবার মন খারাপ করে আমার স্বপ্নে এসে বকাবকি করিসনা রে বোন! কথাটা বলতেই টের পেলাম আমার মাথায় কে যেন হাত বুলিয়ে দিলো। আমি চমকে ওঠলাম। তারপর মুখেও কে যেন হাত বুলিয়ে দিলো। অথচ কেউ নেই এখানে। ওপাশে ধূসর আর পুনমরা কানামাছি খেলছে। বাতাস বইছে জোরে। আমার খুব কাছেই বুনোফুলের সুবাস, কানের কাছে কেউ যেন হাসিমাখা কন্ঠে বলল, ‘ধূসর তো তোরও আরু। ভালোবাসিস ওকে।’
তারপরই কন্ঠটা বাতাসে মিলিয়ে গেলো। আমি স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। কারণ এটা আর কারোর নয় অর্নির গলা। কিন্তু ও তো আর নেই আমাদের মাঝে। তাহলে কি….এক চিৎকার দিয়ে আমি জ্ঞান হারালাম!
চোখ খুলে নিজেকে হাসপাতালের বেডে আবিষ্কার করলাম। আমাকে ঘিরে আছে একদল মানুষ। চোখ খুলতেই ছোটচাচ্চু বলতে লাগলো, ‘জ্ঞান এসেছে, জ্ঞান এসেছে আরুর।’
আম্মু তো কেঁদেকেটে শেষ। আমাকে জড়িয়ে ধরে বকাবকি শুরু করলেন। অবশ্য আমার তেমন কিছু হয়নি। শুধু ভয় পেয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছিলাম। অর্নির ঘটনাটা আর কাউকে বললাম না। নির্ঘাত আমাকে পাগল ভাবতো। ধূসর ব্যস্ত হয়ে কেবিনে ঢুকলো। তার চোখমুখ শুকিয়ে আছে। ওনিই নাকি আমাকে ছাদ থেকে কোলে করে হসপিটাল পর্যন্ত নিয়ে এসেছেন। আমার হাসি পেলো, বেচারা আমাকে এভাবে দেখে না জানি কী অবস্থা হয়েছিলো। আমি তো অর্নির মতো দেখতে! আরুণী বলে তো আর এতো কেয়ার দেখাতোনা। বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেলো আমাদের।
বাসায় ফিরতেই নিকিতা মা কেঁদে ফেললেন আর শ্বশুর মশাই চুপচাপ হয়ে রইলেন। খাইয়ে দাইয়ে আমায় ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। রাত এগারোটা। ধূসর মোবাইল টিপছে। আমি বারান্দায় গিয়ে বসে রইলাম দেখে ওনি বিরক্ত হয়ে উঠে গেলেন। এসে ধমক দিয়ে বললেন, ‘এখানে বসে আছো কেন? বেশি সাহস তোমার? কানের নিচে দুইটা দিলে ঠিক হয়ে যাবে তোমার এসব তিড়িংবিড়িং৷’
আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম, ‘এতো বকাবকি করছেন কেন আজব?’
-তোমার না শরীর খারাপ? তাহলে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ছোনা কেন?
-আপনাকে এতো কেয়ার দেখাতে কে বলেছে। গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন। আমি অন্য ঘরে থাকবো। আজ কয়েকটা রুম ফাঁকা আছে।
ধূসর রেগে গেলো এই কথা শুনে। কি আজব এতে রাগ করার কি আছে। আমাকে জোর করে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বাতি নিভিয়ে দিলেন। আমার কপালে ঠোঁটের পরশ দিতেই বিরক্ত কন্ঠে বললাম, ‘অর্নি না আমি কতবার বলবো? ভুলে যান কেন বারবার?’
ধূসর বললো, ‘অর্নির মতো বউ চাইলেও হতে পারবেনা,
তুমি যে ডাকিনী, সর্বনাশিনী আরুণী তা আমি খুব ভালো করেই জানি। তুমি আরুণীই থাকো। আমার তো এই আরুণীটাকেই প্রয়োজন!’
আমি রেগে এবং অবাক হয়ে বললাম, ‘কী বললেন আপনি? আমি ডাকিনী? সর্বনাশিনী? তো আমাকে এভাবে জড়িয়ে ধরে রেখেছেন কেন? ছাড়ুন আমায়!’
ওনি ভ্রু নাচিয়ে আমার গলায় মুখ ঘষতে ঘষতে বললেন, ‘তুমি আমার হৃদমোহিনী তো তাই জড়িয়ে ধরে আছি।’
ওনার কথাশুনে বিরক্ত হবার বদলে নাম না জানা এক অনুভূতি হানা দিলো মনে। ‘হৃদমোহিনী’ সত্যি হতে পেরেছি? নাকি মিথ্যে বলছে এই ধূসরমানবটা? ওনার চাপা দাঁড়ির খোঁচায় বিরক্ত হয়ে বলে উঠলাম,
-ইশ, ছাড়ুন। আমার গালে সুড়সুড়ি লাগছে। আপনার দাঁড়িগুলো কি বিচ্ছিরি,, ইশ!
ওনি আমার কথায় পাত্তা না দিয়ে গান গাইতে লাগলেন,
আমার হারিয়ে যাওয়া দিন
আর কি খুঁজে পাব তারে
বাদল- দিনের আকাশ- পারে-
ছায়ায় হল লীন।
কোন করুণ মুখের ছবি
পুবের হাওয়ায় মেলে দিল
সজল ভৈরবী।
এই গহন বনচ্ছায়
অনেক কালের স্তব্ধবাণী
কাহার অপেক্ষায়
আছে বচনহীন॥
মানে কী এর? এই ধূসরমানব এতো রহস্য করে কেন? কী চায় সে? আমাকে না অর্নিকে? সত্যিই কী তার হৃদয়ের মোহিনীটা আমি?
চলবে…ইনশাআল্লাহ!