হৃদমোহিনী,১৪,১৫

0
1162

#হৃদমোহিনী,১৪,১৫
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১৪

-কেন এরকম বলছেন? আপনি তো আমায় ভালোবাসেন না?
-ভালোবাসি কিনা জানিনা। তোমাকে আমার প্রয়োজন?
-আমি কি সবার প্রয়োজন মেটানোর জন্য পৃথিবীতে জন্ম নিয়েছি?
-জানিনা। তবে বুঝতে পারছি তোমাকে ছাড়া আমার গতি নেই।
-গতি করে নিলেই পারেন।
-সেটাই তো কর‍তে চাই। তোমাকে আমার চাই।
আমি ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদে দিলাম।
-আমি চাইনা আপনাকে।

ধূসর বলল, ‘কেন চাওনা? আমি কি তোমায় খুব কষ্ট দিয়ে ফেলেছি?’
-আপনি জানেন না?
-না। আমি শুধু জানি অর্নি চলে যাওয়ার পর তুমি আমায় সামলিয়েছো।
-হুঁ। এখন আমার প্রয়োজন থাকার কথা নয়।
-তুমি আমায় ডিভোর্স দিতে পারবেনা।
আমি অবাক কন্ঠে বললাম, ‘কেন?’
-আমি বলছি তাই। কোন সাহসে বারবার এই কথাটা বলো? যতোবার বলো ততোবার আমার দম বন্ধ হয়ে আসে।
-বাহ! এজন্য এসেছেন? এতো প্রেম?
-মজা করছো?
-না।
-আপনার সমস্যাটা কী জানেন? আপনি আমায় ভালোবাসেন না। এখন যদি ডিভোর্স দিই তাহলে আপনি অপমানিতবোধ করবেন! শুধু এজন্য আমার কাছে এসেছেন যাতে অর্নির মতো দেখতে মেয়েটা সারাজীবন আপনার চোখের সামনে থাকে। আপনি অর্নির স্মৃতি নিয়েই বাকি জীবন কাটিয়ে দিবেন।

ধূসর মুখটা উঁচু করে বলল,
-একবার বললাম, অর্নির মতো বউ কখনো হতে পারবেনা তুমি। আমি আরুণীকেও চাই।
-আসলে, আপনি আমার মায়ায় পড়ে গেছেন। সব চাওয়া সবসময় পূরণ হয়না। এই যেমন একটা সময় আপনাকে মনেপ্রাণে স্বামী হিসেবে মেনে নেওয়ার চেষ্টা করেছি।
-এখন?
-আঁশ মিটে গেছে।
-ভালোবাসোনা আমায়?
-ভালোবাসা এতো সহজ নয়। অপাত্রে ভালোবাসা দান করিনা আমি, আমায় তো আপনি ভালোবাসেননি! যেটুকু মায়ায় পড়েছেন সেটাও একসময় ফুরিয়ে যাবে।
ধূসর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
-এতকিছু জানিনা আমি। আমাকে ছাড়তে পারবেনা কোনোদিন, বলে দিলাম।
-দেখা যাবে!

সেই রাতে ধূসরের বলা কথাটা হৃদয়ে গেঁথে গেলেও পরে মনে হলো অর্নিকে ধূসর ভুলে গিয়েছে। বিয়ের তিনমাসের মাথায় কেউ যদি তার পাঁচ বছরের ভালোবাসাকে ভুলে যেতে পারে তাহলে আমাকে ভুলতে কতোদিন? আমায় তো ভালোবাসেনি। ভালোবাসাকে ভুলে যেতে পারলে মায়াটাকে ভুলতে কদ্দিন? কোনোদিন যদি আমি মারা যাই?

ধূসররা অনির রিসেপশন পর্যন্ত আমাদের বাড়িতেই থেকে গেলো। এর মধ্যেই সপ্তাহখানিক কেটে গিয়েছে। আমার এক্সামও শেষ। ধূসর ফোন দিলেও আমি ধরিনা। ম্যাসেজ করে, রিপ্লাই করিনা। আমার প্রচুর রাগ হলো কেন অর্নির প্রতি এতোটা উদাসীন হয়ে গেলো। আসলে আমি অর্নির প্রতি জেলাস বা হিংসুটে নই। সে আমার কলিজার একটা অংশ। শুধু ওর ভালোর জন্য, ওর ধূসরটাকে সামলানোর জন্য আমি আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। সংসারটা টিকিয়ে রাখতে চেয়েছিলাম। সময় পরিবর্তনশীল! এতোদিন তো আমি চাইতাম ধূসরকে, সেও চায়। তবে ভালোবেসে নয়। আফসোস!

এদিকে আমার স্বাস্থ্য, খাওয়াদাওয়ার পরিবর্তন বাসার সবার চোখেই পড়তে লাগলো। ভাবলাম চুপিচুপি গিয়ে একদিন ডাক্তার দেখিয়ে আসবো, আব্বু-আম্মু জানলে চিন্তা করবে, তারপর শরীর খারাপ!

যেই কথা সেই কাজ। একদিন ডাক্তারের কাছে গেলাম৷ কয়েকটা টেস্ট দেওয়া হলো করলাম। পরে গিয়ে রিপোর্ট নিয়ে আসতে বললো। আমি ডাক্তার মিথিলার কাছে সেলফোন নাম্বার দিয়ে এসেছিলাম কিন্তু সেদিন আর যাওয়া হয়নি। দুপুরে দিকে হঠাৎ ধূসরমানবের আগমন। তখন সবে আমাদের খাওয়া শেষ। সবাই অবাক হলো। ওনি দুপুরের খাবারও খেলেন না। কেমন একটা হম্বিতম্বি ভাব, আমি এড়িয়ে গেলাম ওনাকে। একটু পর ঘরে চলে এলাম। ওনিও পেছন পেছন এলেন। আননোন নাম্বারে একটা ফোন এলো সেইসময়। হসপিটালের নাম্বার,আমিই দিয়ে এসেছিলাম যাতে রিপোর্ট না আনলেও ফোন করে জানিয়ে দেয়। আম্মু ডেকে ধূসরের জন্য বানানো কফিটা নিয়ে যেতে বললেন আমাকে। আমি ফোনটা কেটে দিলাম। কফি এনে ধূসরের হাতে দিতেই সে অগ্নিচোখে আমার দিকে তাকালো। কটমট করে বলল, ‘কী সমস্যা তোমার?’
-আমার কোনো সমস্যা নেই।
-তাহলে ফোন ধরোনা কেন? ম্যাসেজ দিলেও কথা বলোনা!
-আমার মুড নেই।
-কাল রেডি হয়ে থাকবে। সকাল সকালই বাড়ি যাবো আমরা।
আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওনাকে বললাম, ‘আমি কেন যাবো? আমি যাবোনা।’
ওনি রেগেমেগে মগটা আছাড় মারলেন ফ্লোরে। চিৎকার করে বললেন,
-যাবেনা? তোমার ঘাড়ও যাবে। হাত-পা বেশি লম্বা হয়ে গেলে কেটে নদীতে ভাসিয়ে দেবো বুঝলি!

আমি ভয় পেয়ে গেলাম। এমন তুইতোকারি ব্যবহার কেন! ওনার চিৎকারে ততক্ষণে বাসার সবাই এসে দরজায় দাঁড়িয়েছে। আব্বু বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হয়েছে?’
ধূসর বলল, ‘আপনার এই বেয়াদব মেয়েটা আমার সাথে যেতে চাচ্ছেনা।’
-কোথায় যেতে চায়না?
-আমাদের বাসায়।
আব্বু আমাদের দুজনকে কথা বলতে দিয়ে সবাইকে নিয়ে চলে গেলেন। স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়ায় ওরা কী করবে? নিজেদের মধ্যে খোলাখুলি কথা বলে মীমাংসা করে নেওয়াই ভালো। তাছাড়া বাসার কেউওই জানেনা আমি যে ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আব্বুকে তো বলাই যাবেনা আমি ধূসরের সংসার করবোনা! সবাই চলে গেলো। ধূসর আমাকে জড়িয়ে ধরে অনুনয়ের স্বরে বলল, ‘চলোনা আরু, প্লিজ। দেখো তোমাকে ছাড়া আমি চলতে পারবোনা।’

-চলতে না পারার কিছুই নেই।
-কেন এরকম করছো? আমিতো চাই তোমাকে।
-আমিতো ভালোবাসা চাই৷
-তো কী হয়েছে আরু? আমি তোমাকে ভা…

সম্পূর্ণ কথাটা বলতে না দিয়েই আমি ওনার মুখ চেপে ধরলাম। কোনো ইমোশনাল কথা শুনতে রাজি নই আমি। এই লোকটাকে অসহায়ের মতো দেখতে ভালো লাগেনা। ভালো না বেসে আমাকে চায়, আমিতো তা চাইনা। মাঝপথে কথা বন্ধ করায় ধূসর রাগে ফুঁসছে। কয়েক সেকেন্ড নিজেকে সামলে নিয়ে এবার সাহসী কন্ঠে বললাম, ‘শুনুন ধূসর! আমি যাবোনা আপনার সাথে বাসায়। আমি আপনার সংসার করতে ইচ্ছুক নই।’

ঠাস করে একটা চড় পড়লো আমার গালে। আমার গাল চেপে ধরে ধূসর বলল, ‘আর একবার ওই কথা বললে জিব টেনে ছিঁড়ে ফেলবো।’
-আপনি কিন্তু বেশি বাড়াবাড়ি করছেন।
-করবোই।
-আপনার কোনো অধিকার নেই আমার সাথে এরকম করার। কে হন আপনি আমার…..কেউ না…

ধূসর আমার ঠোঁট কামড়ে ধরলো। রাগে, দুঃখে এক ধাক্কায় ওনাকে সরিয়ে দিলাম। উফ, পাগল হয়ে যাবো আমি। এই লোকটা আমাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছে। কাঁদতে কাঁদতে দরজা খুলে একদৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলাম। সবাই ওখানেই বসা। আমি সরাসরি গিয়ে আব্বুকে বললাম, ‘আমি আর ধূসরের সাথে থাকতে চাইনা৷ আমি ডিভোর্স চাই!’
কথাটা বলতে দেরি দ্বিতীয় থাপ্পড়টা খেতে দেরি হয়নি আমার। আব্বু রেগে বললেন, ‘এই কথাটা বলার দুঃসাহস কোথায় পেলে আরুণী? আমাদের বংশের মেয়েদের একবারই বিয়ে হয়, সংসার হয়। তারা স্বামী, সংসার নিয়ে সুখে থাকে। আর তুমি এতগুলো দিন বাপের বাড়িতে পড়ে আছো। আমি তোমায় খোঁটা দিচ্ছিনা, শুধু বলে দিচ্ছি বিয়ের পর বরের বাড়িটাই তোমার আসল বাড়ি। আমার কলিজা মেয়েটাই তুমি, তোমাকে আমি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি। অর্নি কলিজাটার সুখ দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি। তোমার সুখ-শান্তি দেখতে চাই। সামান্য কারণে সংসার ভেঙে যাবে এটা কখনো হতে পারেনা। ধূসর মোটেও খারাপ ছেলে নয় যে ডিভোর্স দিবে৷ আর আজ পর্যন্ত যা হয়নি তুমি সেই রীতি ভাঙার সাহস দেখাচ্ছো? আমি মানতে পারছিনা!’

আমি কাঁদতে কাঁদতে নিচে বসে পড়লাম। ধূসর সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আছে। তার হাত বেয়ে রক্ত গড়াচ্ছে, হয়তো কেটে গেছে। কারোরই নজর সেদিকে নেই। আমি আব্বুর কথার পরিপ্রেক্ষিতে বলে উঠলাম,
-তো কী করবো আমি? ওই সাইকো লোকটার সাথে থাকবো? যাকে এতোদিনেও ঠিক করতে পারিনি, আমাকে যে ভালোবাসেনা তার মুখ ঝামটা খেয়ে পায়ের নিচে পড়ে থাকবো?

আব্বু আমাকে নিচ থেকে তুলে দাঁড় করালেন। তারপর সোফায় নিজের পাশে বসিয়ে আমাকে বলতে লাগলেন, ‘দেখো আরুণী, অর্নি আর ধূসর দুজন দুজনকে খুব ভালোবাসতো। এতো বছরের ভালোবাসার মানুষটাকে হারিয়ে ফেলার যন্ত্রণা সে ছাড়া আর কেউ-ই বুঝতে পারবেনা। ধূসরের বেলায়ও ব্যতিক্রম নয়। আর কোনো মা-বাবা কী চায় তার ছেলে উচ্ছন্নে যাক? তাইতো ওর বাবা-মা যখন তোমার সাথে ওর বিয়ে দেওয়ার কথা বললো আমি রাজি হয়ে যাই। আমি জানতাম অর্নির জন্য হলেও ধূসরকে তুমি সামলাতে চেষ্টা করবে, ওকে বুঝবে। অন্য কোনো মেয়ে হলে সেটা করতো বলে আমার মনে হয়না। ধূসরের এরকম ব্যবহার করাটা নরমাল। কেননা অর্নির জায়গায় তুমি চলে এসেছো হঠাৎ করে। ও মানতে পারেনি। কিন্তু এখন যখন মেনে নিতে চাচ্ছে তুমি বেঁকে বসেছো। ওর ভুলগুলো ক্ষমা করে একবার সুযোগ দেওয়া যায়না? আর বিচ্ছেদই সব সমস্যার সমাধান নয়।’

আমি তখন কোনোকিছুই শুনতে রাজি নই। ধূসর আমার পাশে এসে বসেছে ততক্ষণে। রাগে গা জ্বলে উঠলো। গেস্টরুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে বসে পড়লাম। পুনমকে আমার ফোনটা দিয়ে যেতে বললাম। ধূসরের কোনো দোষ নেই মানলাম। তাই বলে এতো সহজে ওর ক্ষমা হয়ে যাবে আর মেয়ে বলে আমাকে সেটা সহ্য করে নিতে হবে? মরে গেলেই ভালো হতো৷ বেঁচে থাকা মানে প্রতিনিয়ত কষ্টে পিষ্ট হওয়া। এই কষ্টে পিষ্ট হওয়া থেকে যে বেঁচে যায় সে-ই এই পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবান। কাঁদতে কাঁদতে চোখমুখ ফুলিয়ে ফেললাম। বাইরে থেকে মা-চাচীরা একনাগাড়ে ডেকেই চলেছে। আমি বিরক্ত করতে মানা করলাম। একা থাকতে চাই, ব্যস! মোবাইলটা হাতে নিয়ে অন করলাম। হোয়াটস অ্যাপে ম্যাসেজ করেছে ডাক্তার মিথিলা। আমি সাথে সাথে ফোন লাগালাম। ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। চারদিকে নিরব, নিঃস্তব্ধতার খেলা। এই অসময়ে ফোন করেও ডাক্তার মিথিলাকে পাওয়া গেলো। ওনি যা জানালেন সেটার জন্যও আমি প্রস্তুত ছিলামনা। ডাক্তার মিথিলা হেসে হেসে বললেন, ‘ইউ হ্যাভ বিন কনসিভিং ফর সেভেন উইকস!’

ড্রয়ারের উপর ফোনটা রাখলাম। হাত-পা অনবরত কাঁপছে। আমি মা হতে চলেছি! সত্যিই? খবরটা শুনে যেন আমি পাথর হয়ে গিয়েছি। এই শরীর খারাপ, বমি পাওয়া, খেতে না পারা এইজন্য যে আমার সন্তান আসতে চলেছে? খুশি হবো নাকি অখুশি বুঝতে পারছিনা। তখন শুধু ধূসরমানবের বলা সেই কথাটাই আমার কানে বাজছিলো বারবার। যেন চিৎকার করে বলছে, আমি তোমার কোনোকিছুই চাইনা৷ আর বাচ্চা? অভিয়াসলি সেটা নয়ই। তোমার থেকে কেউ সন্তান চায়নি। আমার সন্তান শুধু অর্নির হবে, অন্যকারোর নয়। মনে রেখো আরুণী। হ্যাঁ, মনে রেখে দিয়েছি। রাখলাম ও! অভিমান হলো খুব। এখন কেন নিতে এসেছে আমায় নিষ্ঠুরটা? নিষ্ঠুর ধূসরমানবের সাথে কোত্থাও যাবোনা আমি.. কোত্থাওনা!

চলবে…ইনশাআল্লাহ!

#হৃদমোহিনী
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১৫

ড্রয়ারের উপর ফোনটা রাখলাম। হাত-পা অনবরত কাঁপছে। আমি মা হতে চলেছি! সত্যিই? খবরটা শুনে আমি যেন পাথর হয়ে গিয়েছি। এই শরীর খারাপ, বমি পাওয়া, খেতে না পারা এইজন্য যে আমার সন্তান আসতে চলেছে? খুশি হবো নাকি অখুশি বুঝতে পারছিনা। তখন শুধু ধূসরমানবের বলা সেই কথাটাই আমার কানে বাজছিলো বারবার। যেন চিৎকার করে বলছে, আমি তোমার কোনোকিছুই চাইনা৷ আর বাচ্চা? অভিয়াসলি সেটা নয়ই। তোমার থেকে কেউ সন্তান চায়নি। আমার সন্তান শুধু অর্নির হবে, অন্যকারোর নয়। মনে রেখো আরুণী। হ্যাঁ, মনে রেখে দিয়েছি। রাখলাম ও! অভিমান হলো খুব, কেন নিতে এসেছে আমায়? নিষ্ঠুর ধূসরমানবের সাথে আমি কোত্থাও যাবোনা.. কোত্থাওনা!

পেটের ওপর হাত রেখে হু হু করে কান্না পেলো আমার। আমার সন্তানকে তার বাবা চায়না, এটা আমি কীভাবে সহ্য করবো? যাকে চায়না তাকে নিয়ে ওইবাড়িতে ফেরার আমার কোনো ইচ্ছে নেই। বাবার বাড়ির সবাইও আমাকে বুঝতে পারছেনা। আমি কোথায় যাবো? প্রেগ্ন্যাসির এই খবরটা কী সবাইকে বলা উচিৎ? হ্যাঁ, উচিৎ। আমি কোনো চুরি, ডাকাতি করিনি যে কথাটা লুকাবো। দোষ করলে সেটা ধূসরমানব করেছে। আমার কী! সত্য বলতে আমি ভয় পাইনা। চুপচাপ শুয়ে রইলাম। অর্নি..তুই কোথায় বোন। এভাবে আমাকে একা করে দিলি! আমার যে নিজেকে খুব অসহায় লাগছে! আচ্ছা, আমাকে কী ভালোবাসা যায়না? ধূসর কেন ভালোবাসলোনা আমায়? তোর ভালোবাসায় ভাগ বসাতে চাইনি, তোরটা তোরই থাকবে। শুধু তাঁর হৃদয়ের কোণে একটু জায়গা চেয়েছিলাম। দেয়নি রে..তাও মানলাম। কিন্তু যেদিন সে আমাকে জানিয়ে দিলো আমার কিছুই সে চায়না এমনকি বাচ্চাও না, সেদিনই ঠিক করে নিয়েছিলাম আমি ধূসরের কাছে ফিরবোনা। তবে কেন এখন এতো ঝামেলা ক্রিয়েট হচ্ছে রে বোন। তুই জানিস আমি কতোটা সেল্ফ রেসপেক্টিং ছিলাম আর এখন কতোটা সেলফিশ! আমি, ধূসর দুজনেই পরিস্থিতির শিকার। কিন্তু এখন কী করবো আমি!

একা একা কথা বলতে বলতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম মনে নেই। ঘুম ভাঙলো একেবারে সকালে। বিছানা থেকে উঠতে ইচ্ছে করছেনা। শরীর ম্যাজম্যাজ করছে। হাত-পা ব্যথা হয়ে গিয়েছে। চুলগুলো হাতখোঁপা করে গায়ের ওড়না গোছাতে গোছাতে আয়নার সামনে দাঁড়ালাম। কাল রাতে কিছুই খাইনি, ক্ষিধেয় পেট চোঁ-চোঁ করছে। আমার ভেতর একটা প্রাণ আছে, তাঁকেও তো খেতে দিতে হবে! ভাবতেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটলো। ওর তো মা আছে। নিষ্ঠুর বাবার প্রয়োজন নেই। কাউকে লাগবেনা আমাদের। আমি জানি আমাদের পাশে সবসময় অর্নি আছে, আমার বাচ্চা আছে আমার জন্য। সারা ঘরময় আমার অনাগত সন্তানের সঙ্গে কথা বলে কাটালাম। মনটা বেশ ফুরফুরে লাগছে। মা হওয়াটা সত্যিই চমৎকার এবং আনন্দদায়ক। বাঁচার ইচ্ছে হাজারগুণ বাড়িয়ে দেয়, সাহসী করে তুলে, শক্তি আর প্রাণ যোগায়!

ঘর থেকে বেরুলাম খুব স্বাভাবিক ভাবেই। সবাই আমার দিকে তাকিয়ে রইলো যেন চিড়িয়াখানার চিড়িয়া আমি। দোতলায় না গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে টেবিলে বসে নাস্তা খাচ্ছি। পরিমাণের চেয়ে বেশিই খাওয়ায় মেজোচাচী হেসে বললেন, ‘আজ খাবার বুঝি খুব ভালো হয়েছে?’
-হুম হয়েছে তো।
-তাহলে আরেকটু নে।
-দাও।
ধূসরকে সিঁড়িতে দেখা গেলো। ঘুমুঘুমু চোখে উপর থেকে নামছে। ওমা! ওনি যায়নি? রাতে কি এখানেই থেকেছে? যাকগে আমার কি! এত ঠ্যাকা পড়েনি ওনার কথা ভাবার। খুব করে খাওয়ায় মনোযোগ দিলাম। ধূসর এসে আমার পাশের চেয়ারে বসলো। আম্মু খাবার বেড়ে দিচ্ছেন ওনাকে। আর ধূসর ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি খাওয়া সেরে পাতে পানি ঢেলে উঠে পড়লাম। ছাদে উঠে রেলিঙের উপর বসে থাকলাম। পাশের কচুরিপানার ডোবাটায় ঢিল মারি। কেন জানিনা মজা পাচ্ছি এসব করে। আচ্ছা সবাই যখন জানবে আমি মা হতে চলেছি তাঁদের রিয়েকশন কেমন হবে?

হঠাৎই কাঁধে কারোর হাতের ছোঁয়া লাগতেই পেছনে ফিরে তাকালাম। ধূসর! ইতর লোক একটা! আমি কথা না বলে বিরক্ত হয়ে সামনে তাকালাম। বড্ড অস্বস্তি হচ্ছে। এখানে কি চায় সে?
-কথা বলবেনা?
-আমাকে একা থাকতে দিন দয়া করে।
-স্যরি। কাল ওভাবে থাপ্পড় দেওয়ার জন্য।
-এখন কি আরও মারতে ইচ্ছে করছে? তাহলে মেরে দিন। আমি কিচ্ছু মনে করবোনা।
-স্যরি বললাম তো!
আমি কথা না বাড়িয়ে কাঠ কাঠ গলায় বললাম, ‘ইটস ওকে।’
-থ্যাংক ইউ। ওই যে নদীটা দেখা যাচ্ছে সেখানে গিয়েছো কখনো?
-না।
-কেন?
-সাঁতার জানিনা বলে ওদিকে যাওয়া বারণ। আব্বু কখনোই যেতে দেয়নি কাউকে।
-আমি অর্নিকে নিয়ে গিয়েছিলাম। নৌকো করে ঘুরে বেড়িয়েছি!
-আপনার মনে আছে অর্নিকে?
ওনি অবাক হয়ে বললেন, ‘ভুলে যাবার প্রশ্নই আসেনা।’
-সত্যি বলছেন?
-ডাউট আছে?
-জি।
ধূসর চেহারাটা কালো করে ফেললো। এক নিদারুণ ব্যথা তার চোখমুখে ফুটে উঠে দপ করে নিভে গেলো। তারপর ঢোক গিলে আমাকে প্রশ্ন করলো, ‘আমাকে দেখে খুব রাগ হচ্ছে তোমার তাইনা?’
আমি শান্ত গলায় বললাম, ‘হুঁ।’

ধূসর মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকালো। টি-শার্টের কলারের বোতামটা খুলে চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে পেছনে ঠেলে দিলো। আমার বাঁ হাতটা টেনে ওনার বুকে ওপর রাখলো। ক্ষীণ কন্ঠে বলল, ‘জানো! অর্নির শূন্যতা কখনো পূরণ হবেনা। আমার প্রথম ভালোবাসা, প্রথম স্ত্রী হিসেবে ওকে কখনো ভুলতে পারবোনা। তবে এটাও মনে রাখো যে ধূসর কখনো তোমাকে ছাড়বেনা। চাই তোমাকে আমার। তবুও আমার আচরণে তুমি কনফিউজড হচ্ছো। আসলে কি বলোতো, মতের বিরুদ্ধে হলেও তোমাকে আমি বিয়ে করেছি। অর্নির মতো তুমিও আমার স্ত্রী। মাঝেমাঝে অর্নি যখন আমার কাছে আসে, শুধু তোমার কথাই বলে। জানি এটা স্বপ্ন, কিন্তু আমার অর্নির কথা তো! তাঁর কথা আমি কীভাবে ফিরিয়ে দিই? তুমি হয়তো ভাবছো এজন্য আমি তোমাকে চাই। কিন্তু না, আমি আসলেও তোমাকে চাই। যে ক’দিন আমার বাড়িতে ছিলে মনে হতো আমার অর্নিই বুঝি সারা বাড়িতে বাচ্চাদের মতো দৌড়ে বেড়াচ্ছে, হাসছে, গল্প করছে। বাট যখন চলে এলে তখন আমি আরুণী নামক মেয়েটাকেই মিস করতে লাগলাম। আরুণীর উঁচু গলায় বলা কথাগুলো, ঝগড়া করে মুখ ফুলিয়ে বসে থাকা, নাকের ডগায় চশমা এঁটে আমাকে হুমকি দেওয়া, আরুণীর ঘনকালো চুলের মাতাল করা সুবাস, ওর হেঁটে চলার শব্দ, কিশমিশের আম্মুটা, এলোমেলো ভঙ্গিতে ঘুমানো সেই আরুণীটা। অর্নির সাথে সাথে এবার আরুণীটাকেও বড্ড মিস করতে লাগলাম। ট্রাস্ট মি, এই ফিলিংসটা তুমি কখনো বুঝবেনা। অর্নিকে যেমন আমার প্রয়োজন, তোমাকেও আমার প্রয়োজন। ফিরবে তো?’
-ফিরে যাওয়া কী এতোই সহজ?

বলেই আমি একটু হাসলাম। বাড়তি একটা কথাও বললাম না। ধূসর আমার মুখের দিকে তাকিয়ে অভিব্যক্তি বোঝার চেষ্টা করছে। আমি নিরুত্তর। নীলাভ আকাশে রুপো রঙা সূর্য। অনেক উঁচুতে চিলেরা উড়ছে। কোথা থেকে ভেসে আসছে রবিবাবুর গানের কথামালা। এক মন্ত্রমুগ্ধ শ্রোতার মতো কান পাতলাম আমি।

‘তোমায় গান শোনাব; তাই তো আমায় জাগিয়ে রাখ
ওগো ঘুম- ভাঙানিয়া
বুকে চমক দিয়ে তাই তো ডাকে
ওগো দুখজাগানিয়া॥
এল আঁধার ঘিরে, পাখি এল নীড়ে,
তরী এল তীরে
শুধু আমার হিয়া বিরাম পায় নাকো
ওগো দুখজাগানিয়া॥
আমার কাজের মাঝে মাঝে
কান্নাহাসির দোলা তুমি থামতে দিলে না যে।
আমার পরশ ক’রে প্রাণ সুধায় ভ’রে
তুমি যাও যে সরে-
বুঝি আমার ব্যথার আড়ালেতে দাঁড়িয়ে থাক
ওগো দুখজাগানিয়া॥’

থমথমে হয়ে আছে চারিপাশ। কয়েকটা কাক সেগুন গাছের নিচু ডালটাতে বসে একনাগাড়ে ডেকেই চলেছে। মৃদুমন্দ বাতাসের সাথে বিরিয়ানি আর কষা মাংসের ঘ্রাণ ভেসে আসছে। আমার জিভে জল চলে এলো। উঠতে নিলেই আমার হাত ধরে ফেললো ধূসর। নির্লিপ্ত কন্ঠে বলল, ‘বসো আরেকটু।’
-ওকে বসলাম। কী বলবেন বলুন।
ওনি রেগে আসা মেজাজটা গিলে খুব শান্তভাবেই বললেন, ‘রেডি হবে কখন? এখন না বিকেলে?’
-আচ্ছা। অর্নির মৃত্যুর সাড়ে পাঁচমাস মাত্র। আপনার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে কয়েকমাস। এতো দ্রুত আপনার মতিগতি পাল্টে গেলো কেন?
-পাল্টানোর কিছু নেই। সব ঠিকই আছে। সুযোগ দিতে চাই সম্পর্কটাকে কারণ তোমাকে আমার চাই।
-অর্নির সাথে অন্যায় করা হলোনা?
-একদমই নয়। সে বরং খুশি হবে।
-আপনি কীভাবে জানলেন?
-আমার মন বলে। অর্নি জানে তাঁকে ছাড়া আমি ভালো নেই, আরুণীকে ছাড়াও না। একচুয়েলি এতো বছরের সম্পর্কে অর্নিকে আমি ভালো করেই বুঝি, সেও বুঝে। একটা কানেকশন আছে আমাদের মধ্যে। তুমি ওসব বুঝবেনা।

তারপর নীরবতায় কেটে গেলো অনেকটা সময়। আমি ভাবলাম, ভাবতে ভাবতে ঘাম ঝড়িয়ে ফেললাম। ধূসরের প্রতি একটা আলাদা অনুভূতি কাজ করছে। ভালোবাসা, মায়া না করুণা জানিনা। ধূসরমানব যে এতটুকু বুঝতে পেরেছে তাতে কি আমার খুশি হওয়া উচিৎ? অর্নি সত্যিই চায় আমি ওনার কাছে ফিরে যাই? সেও কী আরুণী হিসেবেই আমাকে চায়? অন্য স্বত্ত্বার কাউকে ভেবে নয়? তাঁর হৃদয়ের দ্বিতীয় মোহিনীটার জায়গা কি সত্যিই পেয়ে গেছি! সেদিনের কথা মনে হলো। ছাদে বসে থাকার সময় অর্নির কন্ঠস্বরে বলা কথাটা, ভালোবাসিস ধূসরকে! আমার চোখ ভিজে গাল বেয়ে পানি পড়লো। কিন্তু এতো সহজে যে ধূসরমানবের কাছে ফিরবোনা আমি। আমাকে যে এতো কষ্ট সহ্য করতে হলো তার জন্য তো তাঁকে শাস্তি দিতে হবে! সেতো বাচ্চা চায়না, আমিও তো ঠিক করেছিলাম কোথাও যাবোনা ওনার সাথে। ধূসরের অভিব্যক্তি পরীক্ষা করার জন্য খুব সহজভাবেই ওনার হাতটা নিয়ে পেটের ওপর রাখলাম আমি। ওনি ভ্রু কুঁচকে তাকালেন।
-কিছু টের পেলেন? বুঝতে পারছেন কিছু?
-তোমার পেটব্যথা করছে?
-না।
-তাহলে?
-গেস করুন।
কিছুক্ষণ পর ওনি ভূত দেখার মতো চমকে বললেন, ‘আর ইউ প্রেগন্যান্ট আরুণী?’
আমি মিষ্টি হেসে বললাম, ‘জি। এখন অবশ্যই বুঝতে পারছেন আমি কেন আপনার কাছে ফিরবোনা।’

চলবে…ইনশাআল্লাহ!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here