#হৃদমোহিনী,১৬,১৭
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১৬
তারপর নীরবতায় কেটে গেলো অনেকটা সময়। আমি ভাবলাম, ভাবতে ভাবতে ঘাম ঝড়িয়ে ফেললাম। ধূসরের প্রতি একটা আলাদা অনুভূতি কাজ করছে। ভালোবাসা, মায়া না করুণা জানিনা। ধূসরমানব যে এতটুকু বুঝতে পেরেছে তাতে কি আমার খুশি হওয়া উচিৎ? অর্নি সত্যিই চায় আমি ওনার কাছে ফিরে যাই? সেও কী আরুণী হিসেবেই আমাকে চায়? অন্য স্বত্ত্বার কাউকে ভেবে নয়? তাঁর হৃদয়ের দ্বিতীয় মোহিনীটার জায়গা কি সত্যিই পেয়ে গেছি! সেদিনের কথা মনে হলো। ছাদে বসে থাকার সময় অর্নির কন্ঠস্বরে বলা কথাটা, ভালোবাসিস ধূসরকে! আমার চোখ ভিজে গাল বেয়ে পানি পড়লো। কিন্তু এতো সহজে যে ধূসরমানবের কাছে ফিরবোনা আমি। আমাকে যে এতো কষ্ট সহ্য করতে হলো তার জন্য তো তাঁকে শাস্তি দিতে হবে! সেতো বাচ্চা চায়না, আমিও তো ঠিক করেছিলাম কোথাও যাবোনা ওনার সাথে। ধূসরের অভিব্যক্তি পরীক্ষা করার জন্য খুব সহজভাবেই ওনার হাতটা নিয়ে পেটের ওপর রাখলাম আমি। ওনি ভ্রু কুঁচকে তাকালেন।
-কিছু টের পেলেন? বুঝতে পারছেন কিছু?
-তোমার পেটব্যথা করছে?
-না।
-তাহলে?
-গেস করুন।
কিছুক্ষণ পর ওনি ভূত দেখার মতো চমকে বললেন, ‘আর ইউ প্রেগন্যান্ট আরুণী?’
আমি মিষ্টি হেসে বললাম, ‘জি। এখন অবশ্যই বুঝতে পারছেন আমি কেন আপনার কাছে ফিরবোনা।’
ধূসরের গলায় যেন জোর নেই। কোনোমতে বললেন, ‘এটা কী সত্যি?’
-ইয়েস আই এম প্রেগন্যান্ট এন্ড আ’ম গোয়িং টু বি দ্যা মাদার অফ ইউর চাইল্ড ও’ম ইউ ডু নট ওয়ান্ট!
ধূসর নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো। চেহারায় খুশি খুশি ভাব। ওনার মনোভাব বোঝার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলাম। তাঁকে বোঝার ক্ষমতা আমার নেই। সে কখন কী চায় সে-ই ভালো জানে। আমি উঠে চলে আসলাম। নিচে এসে রান্নাঘরে মোড়া ফেলে বসলাম। সেদ্ধ আলোর খোসা ছাড়াচ্ছি আর ছোটচাচীর সাথে বকবক করছি। এর মধ্যে বনরুটিতে জেলি মাখিয়ে কয়েক টুকরো পেটে চালান করে বসে আছি। আজ ছোটমাছের ঝোল আর মুড়িঘণ্ট হবে। জিভে জল চলে আসার মতোন অবস্থা আমার। রান্নাবান্না, খাওয়াদাওয়ার পর্ব শেষ হতে হতে দুপুর তিনটে বেজে গেলো। ধূসরমানব খেতে আসেনি, তার খাবারটা দিয়ে আম্মু জোর করে আমাকে পাঠালেন। আমি ঘরে গিয়ে দেখি তিনি শূন্য দৃষ্টিতে আয়নার দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবছেন। আমি ডাকতেই চমকে উঠলো। ওনার খাবারগুলো সামনে রেখে বললাম, ‘খাওয়ার ইচ্ছে হলে খান, নয়তো ফেলে দিন। ভুলেও ফেরত পাঠাবেন না।’
-কেন?
-উফফ…
-বিরক্ত লাগছে? শরীর খারাপ হচ্ছে?
-আপনার এতো ভাবতে হবেনা।
-হবে।
আমি ঠোঁট টিপে হেসে ফেললাম। তাচ্ছিল্য করে বললাম, ‘হবে? তো কেন হবে?’
ওনি মাথা চুলকাতে চুলকাতে বোকার মতো বললেন,
-কারণ আমার একটা বাবু আসবে। তাই।
আমি অবাক হলেও সেটা প্রকাশ করলাম না। জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনার বাবু?’
-হুঁ।
-আপনার বাবু কোথা থেকে আসবে। আপনি তো মেয়ে নন। অতিরিক্ত নেশাভাং করার ফল এটা বুঝলেন? নিজেকে এখন মেয়ে ভাবা শুরু করেছেন।
ওনি ছোট ছোট চোখ করে তাকিয়ে রইলেন।
-ফাজলামো করো আমার সাথে?
-সেই দুঃসাহস আমার নেই।
-আবার মজা করো!
-রাগলে আপনাকে কেমন দেখায় জানেন? একটা গন্ডারের মতো, যাঁর নাকের ওপর শিং আর দেখতে ভীষণ কুৎসিত।
ওনি ক্যাটকেটে স্বরে বললেন, ‘একটা অবলা প্রাণীকে তুমি কুৎসিত বলতে পারোনা!’
-আল্লাহর সৃষ্টি সবই সুন্দর। আমিতো ওটা আপনাকে বললাম।
ধূসর রেগে আমার হাত চেপে ধরলেন। আমি ঝটকা মেরে হাত সরিয়ে হুমকি দেওয়া গলায় বললাম, ‘নেক্সট টাইম আমাকে ছোঁয়ার আগে দশবার ভাববেন। নয়তো যা করিনি কখনো তাই হবে।’
-কী করবে তুমি?
-নারী নির্যাতনের মামলা ঠুকে দেব। একেবারে চৌদ্দবছরের জেল। বলবো যে, প্রেগ্ন্যাসি টাইমে ধূসর নামক নেশাখোর এক লোক আমার গলা চেপে ধরে আমাকে মেরে ফেলার জঘন্যতম ষড়যন্ত্র করেছে।
-তোমার এই সো কল্ড কথাবার্তা কেউ শুনবে কেন? তাছাড়া তোমাকে মেরে ফেলার কোনো কারণই তো নেই। অলরেডি দু-দুটো বিয়ে করে বসে আছি আর যন্ত্রণায় ভুগছি। থার্ড টাইম বিয়ে করার ইচ্ছে থাকলে তা নয়তো একটা কথা ছিলো, তোমার যুক্তিটা মেনে নেওয়া যেতো। বাট আমি তো এখন তোমাকে নিয়ে যেতেই এসেছি। এছাড়া… উম..আর কোনো কারণ তো নেই…
আমি শক্ত গলায় বললাম,
-কারণ আছে। এই বাচ্চার বাবা আর তাঁকে মেনে নিতে চায়না। তাই আমাকে মেরে প্রমাণ লোপাট করতে চায়!
ধূসর একটা হম্বিতম্বি ভাব নিয়ে বলল, ‘কে বললো?’
-এক নিষ্ঠুর লোক।
-তাই বুঝি?
-হুঁ।
ধূসর আমাকে একটানে নিজের কাছে নিয়ে আসলেন। আমি নিজেকে সামলানোর আগেই ওনি আমার ঘাড়ে মুখ রেখে বললেন, ‘আমার একটা ছোট্ট বেবি থাকবে যাকে আমি কোলে নিয়ে ঘুরবো, বুকে নিয়ে ঘুম পাড়াবো তাইনা আরুণী?’
আমি বিরক্তিতে কটমট করে বললাম, ‘ইনডাইরেক্টলি বোঝাতে চাইছেনটা কী আপনি?’
ধূসর ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় বলল, ‘ওই তোমার পেটের ভেতর থাকা ছোট্ট পুঁচকুটাকে আমার লাগবে।’
-বললেই হলো? এতো সহজ?
-বাচ্চার বাবা আমি, বুঝলে?
-না। তাছাড়া কোনো প্রুফ তো নেই যে আপনি আমার বেবির বাবা। আপনার তো কিছুই মনে নেই। এটাতো নেশাগ্রস্ত অবস্থায় থাকা আপনার একটা ফল্ট। দায়টা বয়ে বেড়াতে হচ্ছে আমাকে! ছাড়ুন আমায়..
ধূসর আমাকে ছেড়ে দিলো। বলল, ‘যত যা-ই হোক বাচ্চাটা আমার।’
আমি তেড়ে উঠে বললাম, ‘মেলোড্রামা বন্ধ করুন আপনি। রেডিমেড বাচ্চা পেয়ে এখন দরদ উতলে পড়ছে বুঝি? একটা সন্তান হলো বাবা-মায়ের ভালোবাসার ফসল, কোনো ভুলের ফসল নয়। আর আ..আমি যদি ওকে নষ্ট করে ফেলি তাহলেও আপনার কিছু বলার থাকতে পারেনা। আপনার বরং খুশি হওয়া উচিৎ, কারণ আপনি যা চেয়েছেন তাই হচ্ছে…’
ধূসর অসহায় মুখে তাকিয়ে থাকলো। আমি প্লেটে খাবার তুলে দিয়ে বলে উঠলাম, ‘খেয়ে নিন।’
-তুমি যে এসব বললে একবারও খারাপ লাগলোনা?
-আপনার কী একবারও বুক কাঁপেনি? যখন বলেছিলেন বাচ্চা দরকার নেই? বলুন..
-রাগের মাথায় বলে ফেলেছি। তখন আমি নিজের মধ্যে থাকতাম না ভালো করেই জানো তুমি…
-বাহ! আপনি সবকিছু অজান্তেই রেগে রেগে বলেন তাইতো। রাগের মাথায় কাউকে আঘাত করে কথা বলা ঠিক নয়। হয়তো বলতে চাননি, কিন্তু বলে তো ফেলেছেন। আপনাকে মেনে নিতে গেলে প্রতিবার এই কথাটাই মনে আসে আমার। কিছুতেই বিশ্বাস করে উঠতে পারিনা।
বলেই আমি চলে আসি। এখনো বাড়ির কাউকে ঘটনাটা বলা হয়নি। কিন্তু জানানোটা দরকার। প্রথমে মেজচাচীকে খুলে বললাম। বলতে গিয়ে লজ্জায় আমার কন্ঠরোধ হয়ে আসছিলো, কোনো শব্দ বেরুচ্ছিলোনা। মেজচাচী হেসে ফেললো আমার অবস্থা দেখে। বাড়ির সবাইকে যখন সবটা খুলে বললো আমি লুকিয়ে রইলাম। বিশেষ লাভ হলোনা, কারণ পুনম খুঁজে খুঁজে ঠিকই বাথরুম থেকে বের করলো আমায়। সবাই তো দারুণ খুশি। আমাকে নিয়ে সে কী আহ্লাদীপনা। ধূসরবাবু হৈচৈ শুনে উপরের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছেন৷ মুখ গম্ভীর। আব্বু আমাকে নিজের পাশে বসিয়ে বললেন, ‘এবার তো নিজের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে মা।’
আমি মাথা নাড়লাম। আব্বু মাথাটা নিচু করে প্রশ্নভরা চোখে আমার দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, ‘এবার আর রাগ করে থেকোনা আরু’মা। বাচ্চার বাবা হিসেবে ধূসরের কিন্তু একটা অধিকার আছে। আর তুমি ভুলেও ভেবোনা যে বাচ্চা নিয়ে একা জীবন পার করে দেবে। ধূসরকে তোমার না-ই দরকার হতে পারে, কিন্তু যে আসতে চলেছে তাঁর দরকার আছে। বুঝতে পারছো তো আমি কী বলছি?’
-জি বুঝতে পেরেছি।
আমার শ্বশুর-শ্বাশুড়ি এই খবরটা পেয়ে পরদিনই আমাদের বাড়ি এসে পড়লেন, আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু আমি বিভিন্ন কৌশলে আম্মুকে রাজি করিয়ে এ বাড়িতে রয়ে গেলাম। যদিও আমার ওই বাড়িতে ফিরে যাওয়া নিয়ে অন্য একটা প্ল্যান আছে। ভালোবেসে তো ক্ষমা করে দিলাম ধূসরকে; কিন্তু কিছুটা শাস্তি তো ওনার প্রাপ্য! ওই যে বললাম দিনদিন বড্ড সেলফিশ আর আবেগী হয়ে যাচ্ছি। চাইলেও বাস্তবতা দেখাতে পারছিনা। ভালোবেসে মানুষ নাকি অনেকক্ষেত্রে পাগল হয়ে যায়, আমার হয়েছে সেই দশা। ওফ…আরুণী তুই এমন কেন হয়ে যাচ্ছিস? প্রেমে মরা জলে ডুবেনা টাইপ প্রেমিকা হয়ে যাচ্ছিস যে, ধূসরের শত শত ভুল ক্ষমা করে দিয়ে একটা আত্মসম্মানবোধহীন নারীর পরিচয় দিচ্ছিস! এমনটা কি হওয়ার ছিলো আদৌ? ছিঃ আরুণী ছিঃ! মনের কোণে উঁকি দেয় অর্নির ডায়েরিতে কালো কালিতে লিখা, সেই ধূসর চিরকুটের পঙক্তিমালা,
‘বৃষ্টিস্নাত বর্ষা
সাত রঙের রংধনু,
তুমিই ধূসর মেঘের
নিঝুম ধারার বৃষ্টি…’
চলবে…ইনশাআল্লাহ!
#হৃদমোহিনী
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১৭
ধূসরকে শাস্তি হিসেবে যা দিয়েছিলাম তা হলো, আমার সাথে দুইমাস কোনো যোগাযোগ রাখতে পারবেনা। আমাদের বাড়িতে আসতে পারবেনা, ফোন দিতে পারবেনা, লুকিয়েও কোনো খোঁজ নিতে পারবেনা। আমি অসুস্থ হয়ে পড়লেও সে আসতে পারবেনা। মোটকথা, আমার ব্যাপারে কোনোকিছুই ওনি জানার চেষ্টা করতে পারবেন না। অবশ্য নিকিতা মা আর শ্বশুর মশাইয়ের বেলায় এই শর্ত প্রযোজ্য নয়। শুধু চাইছিলাম ধূসর আমার শূন্যতাটুকু বুঝতে পারুক। সবকিছু ভালোই ভালোই চলছে। রাতের বেলা আমি নিকিতা মাকে ফোন করলাম। ওনি ধরেই আনন্দময় কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেমন আছিস রে?’
-ভালো। বিকেলেই না কথা বললাম। এখন আবার জিজ্ঞেস করছো!
-তুই বুঝবিনা। আমার চোখের সামনে রাখতে পারলে, দু দন্ড চোখের দেখা দেখতে পারলে তবেই শান্তি পেতাম রে মা।
আমি হেসে বললাম, ‘এতো টেনশন করোনা।’
-তোর বাবা তো পারলে এক্ষুনি গিয়ে নিয়ে আসে। সারাক্ষণ আরু আরু করে জান যায় অবস্থা। অফিসে গিয়ে দশবার ফোন করবে আমায়। নিজে দিতে লজ্জা পায়!
আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম, ‘কেন লজ্জা পায়?’
-তার গুণধর পুত্রের জন্যই তো তুই এখানে আসিসনি তাই।
-ওহ। বাবাকে বলবে আমাকে ফোন দিতে, আমি নিজে কথা বলবো। আর তাছাড়া সমস্যা তো তার পুত্র করেছে, ওনি কেন লজ্জা পাবে!
মা হেসে বললেন ‘আচ্ছা।’
আমি মিনমিন করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ওনি কোথায়?’
-কে কোথায়?
-ধূসরমানব ছাড়া আর কে?
-সে কাজ করে।
আমি কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী কাজ?’
-কাঁথা সেলাই করে।
আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘কাঁথা সেলাই? আই মিন বাচ্চাদের…?’
-হুম। কোন ভূত মাথায় চেপেছে আল্লাহ জানে। অফিস থেকে ফিরে খেয়েদেয়েই কাঁথা সেলাইয়ের কাজে নেমেছে। তোর বাবাও সাহায্য করছে ছেলেকে। বাপ-ব্যাটা মিলে ভালোই সেলাচ্ছে।
এদিকে আমি এই দৃশ্যটা কল্পনা করতে গিয়ে হেসে ফেললাম। ফ্লোরে বসে ধূসরমানব মেয়েদের মতো বাচ্চাদের কাঁথা সেলাই করছে৷ ইশ, কি কেয়ারিং জামাই আমার। ওনার চেহারাটা নিশ্চয়ই দেখার মতো হয়েছে! উফ..অর্নি তুই খুব লাকি ছিলি বোন! এই লোকটা এমন কেন? ওনার আচার, ব্যবহার সবকিছু বলে দিচ্ছে ওনি আমাকে কতোটা ভালোবাসেন, তবুও মুখ ফুটে কিছু বলছেনা। এতো মুখচোরা কেন ওনি?
__________________
দিনগুলো এভাবেই কাটছিলো। একটু সুখ আর অনাবিল শূন্যতা নিয়ে। ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছে আমার ভেতরে থাকা ছোট্ট প্রাণ, আমার সন্তান। একজন মায়ের কাছে এই বিষয়টা কতোটা ভালোলাগার তা বলে বোঝানো যাবেনা। কয়েকদিন পর, আমি ঘরে ঘুমাচ্ছিলাম,হঠাৎ একটা অচেনা নাম্বার থেকে ফোন এলো। তাও রাতেরবেলা। আমি বিরক্ত হয়ে ফোনটা হাতে নিতেই স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করা ধূসরের নামটা দেখতে পেলাম। কয়েক মুহূর্ত থম মেরে বসে থাকলাম। বাসার কারো কিছু হয়নি তো? এতো রাতে ওনার ফোনই বা কেন? হাজার প্রশ্ন মাথায় নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে ফোন রিসিভ করলাম। আমি কিছু বলার আগেই ওপাশ থেকে ধূসর তাড়াহুড়ো করে জিজ্ঞেস করতে লাগলো, ‘হ্যালো হ্যালো…আরু বলছো? হ্যালো আরু তুমি ঠিক আছো?’
আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘কী হয়েছে?’
-তু তুমি ঠিক আছো? ভালো আছো? কিছু হয়নি তো তোমার?
-আমার কী হবে। আমি ঠিক আছি। আপনি এরকম করছেন কেন? কী হয়েছে?
-তার আগে বলো তুমি সুস্থ আছো কিনা?
আমি এবার বিরক্ত গলায় বললাম, ‘উফ, থামবেন আপনি? নইলে রাখছি!’
এবার ধূসর থামলেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে রইলেন। আমি প্রশ্ন করলাম, ‘আপনি ঠিক আছেন?’
ধূসর ধরে আসা গলায় বলল, ‘আমি ঠিক নেই।’
-কী হয়েছে বলবেন তো!
-আমি ঘুমাচ্ছিলাম।।হঠাৎ দেখলাম তুমি সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়েছো!
-এমন কিছুই নয়৷ আমিও ঘুমাচ্ছিলাম আর ঠিক আছি।
-আমি এখন আসছি।
আমি হতভম্ব হয়ে বললাম, ‘কোথায়?’
-তোমার কাছে।
-আপনি কি আমার শর্ত ভুলে গিয়েছেন?
ওনি রেগে বললেন,
-ওসব শর্ত বাদ দাও। তোমাকে আর দূরে রাখছিনা।
-আমি আর কখনোই ফিরবোনা আপনার কাছে। আপনি শর্ত ভঙ্গ করতে চাইছেন।
ওনি ফোনের মাঝেই আমায় এমন ধমক দিলেন যে আমি কেঁপে উঠলাম। ওনি গমগমে স্বরে বলতে লাগলেন, ‘তোমার এসব শর্তটর্ত বাদ দাও। আমি ভুল করেছিলাম তাই ক্ষমাও চেয়েছি। তোমার কথা মেনে এতদিন ওই বাড়িতে থাকতে দিয়েছি। আমার সাথে একটা কথা বলা দূর ফোন পর্যন্ত করোনি, তোমার খোঁজ নেওয়ার কোনো স্কোপ রাখোনি। আব্বু-আম্মু পর্যন্ত তোমার খবরটুকু দেয়না, অবশ্য সেটা তোমার ইন্ধনেই। এভাবে কতোদিন থাকা যায়? প্লিজ চলে এসো। আমি এক্ষুনি আসছি তোমার কাছে। তোমার কোনোকিছু হতে দেবোনা আমি, অর্নির মতো ফাঁকি দিতে দেবোনা। কিছুতেই না…সবাই আমাকে ছেড়ে যাওয়ার চিন্তা করে কেন? আমি কি মানুষ না? আমার কষ্ট তোমরা কেউ বোঝার চেষ্টা করোনা, মজা পাচ্ছো? এসব করে, আমায় কষ্টে রেখে খুব আনন্দ পাচ্ছো, তাইনা?’
আমি খানিক চুপ থেকে বললাম, ‘কাঁদছেন কেন আপনি?’
-আমি কাঁদছিনা।
-মিথ্যা বলে লাভ নেই। আমি বুঝতে পারছি!
ওনি কথাটা এড়িয়ে গেলেন। শান্ত স্বরে বললেন, ‘কী করছো?’
-কিছুনা।
-বারান্দায় আসতে পারবে?
আমি অবাক গলায় বললাম, ‘এতো রাতে বারান্দায়? না বাবা..আমার ভয় করে।’
-একটু আসো!
আমি সন্দেহ নিয়ে বললাম, ‘হঠাৎ বারান্দায় আসতে বলছেন কেন?’
-তোমাকে দেখবো। বাসার গেইট বন্ধ, অনেকক্ষণ ধরে নিচে দাঁড়িয়ে আছি!
আমি কম্পিত কন্ঠে বললাম, ‘আ আপনি আমার বাসায়?’
-হুম। রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি। তোমার বারান্দা বরাবর।
-আপনি পাগল? এতো রাতে রাস্তায় এসে দাঁড়িয়ে আছেন। ওহ গড..
আমি একপ্রকার দৌড়ে বারান্দায় গেলাম। রাস্তার ওপাশে একটা গাড়ি দাঁড় করানো। ল্যাম্পপোস্টের মৃদু আলোয় একটা অবয়বকে দেখা যাচ্ছে। ওটা ধূসর। গাড়ির দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছেন। পরণে হাফ প্যান্ট আর টি-শার্ট, পায়ে স্যান্ডেল। আমি বললাম, ‘দেখেছেন আমি ঠিক আছি, এবার বাসায় চলে যান।’
ওনি দূর থেকে একদৃষ্টিতে আমাকে দেখেই চলেছেন। আমি অস্বস্তিতে গাঁট হয়ে আছি। আমাকে অবাক করে দিয়ে ওনি ফোনের ওপাশ থেকে বলে উঠলো,
-ভালোবাসি তোমাকে খুব।
-কী বললেন?
-ভালোবাসি অর্নির বোনটাকে।
আকাশে আজ চাঁদ নেই, তারা নেই। দূর দূরান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে রাতের আঁধার। ঢাকা শহরের ব্যস্ত মানুষজন ঘুমে বিভোর। তার মাঝে জেগে আমি আর ধূসর। কিশোরী বয়সের প্রেমের মতোন রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভালোবাসার আদানপ্রদান করা হচ্ছে। এই মুহূর্তটা খুব উপভোগ্য। আমার জীবনের অন্যতম সেরা রাত বোধহয় এটাই। লোকটা আমায় ভালোবাসে! আমাকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে এতো রাতে ছুটে এসেছে এখানে। তাঁকে কি আর ফিরিয়ে দেওয়া যায়?
_______________
এভাবেই নানা অভিমান, অভিযোগের পালা শেষ করে আমি ফিরে গিয়েছিলাম ধূসরমানবের সাথে। তারপর.. তারপর আমাদের সুখের একটা সংসার! অর্নির স্মৃতি, নিকিতা মা, শ্বশুর মশাই সবাইকে নিয়ে আমার ভালো থাকার চেষ্টা! সবকিছু সুন্দরমতোই এগুচ্ছিলো। আগে না বুঝলেও এখন বুঝতে পারি ধূসরের পক্ষে সত্যিই ওই দিনগুলোতে আমাকে মেনে নেওয়া কষ্টকর ছিলো, স্বাভাবিক ছিলো খারাপ ব্যবহার করাটা। কিন্তু প্রতিদান হিসেবে সে আমাকে এতো এতো ভালোবাসা দিয়েছে যার ফলে তাঁকে ছাড়া বেঁচে থাকাটা আমার পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিবার সবসময় আমাদের ভালোর জন্যই সবকিছু করে। আজ যদি ধূসরকে ছেড়ে দিতাম বা অন্য জায়গায় বিয়ে করতাম তাহলে হয়তো আমি এই ভালোবাসাটুকু উপভোগ করতে পারতামনা। আমার প্রেগন্যান্সি টাইমে ধূসরের মতো কেয়ার কেউ করেনি। আমাকে খাইয়ে দেওয়া, অসুস্থ হলে সেবা করা, মুড সুইংয়ের সময় আমার তিক্ত মেজাজ এবং বাজে গালাগালিও বেচারা হজম করেছে হাসিমুখে। প্রায়ই বমি সামলাতে না পেরে ওনার গায়ে বমি করতাম আর তিনি কত সুন্দরভাবে, হাসিমুখে সেগুলো পরিষ্কার করে আমাকে বুকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়তো। মাথা আঁচড়ানোর কাজটা পর্যন্ত ওনি করে দিতো। নিকিতা মা এগুলো দেখে আড়ালে হাসতো আর আমি মজা নিতাম। ওনি রেগে গিয়ে বলতেন, ‘হাসাহাসির কিছু নেই আম্মু। আমি তোমার পেটে থাকাকালীন আব্বুও তোমাকে এভাবে যত্ন করতো।’
মা বলতো, ‘কে বলেছে তোকে?’
-আব্বু।
মা লজ্জা পেয়ে চলে যেতেন। কিন্তু পরে আবার ঠিকই হাসতেন ধূসরমানবের কান্ড দেখে। একদিন ওনি আমার চুলে বিনুনি করে দিতে দিতে অফিসের কিসব মজার মজার কথা বলছিলো। কোনো কলিগের প্রেম বিষয়ক কাহিনী। ধূসর আমাকে বললেন, ‘আচ্ছা আরু, তুমি তো আমাকে ভালোবাসি বলোনি! অথচ অর্নি দিনে দশবার এই কথাটা বলতো। তার মানে কী তুমি আমায় ভালোবাসোনা?’
আমি মজা করে বললাম, ‘অর্নি আমায় বলতে মানা করেছে।’
-কেন? মানা করবে কেন?
-কারণ আপনি আমায় অনেক কষ্ট দিয়েছেন।
ওনি চুপ করে গেলেন। গম্ভীর চেহারা করে মাথা নুইয়ে চুল বাঁধতে লাগলেন। আমি উঠে ওনার কোলে বসে পড়লাম। তারপর গাল টেনে ধরে বললাম, ‘ভালোবাসি এই ধূসরমানবটাকে, যার হৃদয়ের ধূসররঙা জায়গাটা শুধুই আরুণীর।’
ওনি ছলছল চোখে আমার দিকে তাকালেন। ক্ষীণ কন্ঠে বললেন, ‘হৃদয়ের বুঝি রঙ হয়?’
-হ্যাঁ হয় তো। এই যে, আপনার হৃদয়ের দুটো অংশ, লাল আর ধূসর! লালরঙা অংশটার অধিকারিণী অর্নি, ধূসররঙা অংশটা আরুণীর।
_________
তারপর অনেকটা সময়, অনেকগুলো দিন কেটে যায়। আমার ডেলিভারির সময়ের কিছুদিন আগে। ধূসর সেদিন অফিসে গিয়েছিলো কোনো জরুরি কাজে। সকালের দিকে দু’বার বমি হলো আমার। সেই খবর ধূসরকে দিতেই ওনি ফোন করে আমাকে কিছুক্ষণ ঝেড়ে ফেললেন। রেগে একাকার সে। কেননা আমি অতিরিক্ত টক খেয়ে পেটব্যথা বাঁধিয়েছি। যদিও বিষয়টা অতোটা গুরুতর ছিলোনা, কিন্তু ধূসর খুবই সিরিয়াসলি নিলো। কতোটা ভালোবাসে সেটাও বুঝিয়ে দিলো। হাজারো কথা আর বাক্যব্যয় করে রাগ করে ফোন রেখে দিলেন ওনি। সারাদিন আর খোঁজ নেই ওনার। বিকেলের দিকে আবারও কাঙ্ক্ষিত নাম্বার থেকে ফোন এলো! ভাবলাম মশাইয়ের বুঝি রাগ ভেঙেছে। খুশিখুশি মনে ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে অপরিচিত কন্ঠ বলে উঠলো, ‘এই ফোনটা যার তিনি এক্সিডেন্ট করেছেন। ওনার অবস্থা খুব আশঙ্কাজনক, অতিরিক্ত ব্লিডিং হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে ওনি আর বাঁচবেননা। আপনি যদি ওনার পরিচিত হন তাহলে খুব দ্রুতই এ্যাপেলো হসপিটালে চলে আসুন।’
ফোন কেটে গেলো। আমি মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে রইলাম। একজন ডাক্তার এতোটা নিষ্ঠুরভাবে কীভাবে এতগুলো কথা বলতে পারলো! সেদিনে এই ঘটনার পর আমার আর কিছুই মনে নেই। প্রতি মুহূর্তে কিছু একটার শূন্যতা গভীরভাবে অনুভব করছিলাম। সে আর নেই এই কথাটা আমার মন-মস্তিষ্ক মেনে নিতে পারছিলোনা!!
চলবে….ইনশাআল্লাহ!