হৃদমোহিনী,১৮,১৯

0
973

#হৃদমোহিনী,১৮,১৯
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১৮

আমার যখন জ্ঞান এলো তখন নিজেকে বিছানায় আবিষ্কার করলাম। মাথায় পাশে নিকিতা নিকিতা মা। আমি চোখ খুলতেই উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ঠিক আছিস তুই? এভাবে পড়ে গেলি কী করে? খাওয়াদাওয়ার এতো অনিয়ম করিস যে….’

আমি ডুকরে কেঁদে উঠলাম। মা হতভম্ব হয়ে গেলো। বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগলো কি হয়েছে, আমি কিছু বলতে পারছিলাম না। শব্দ বেরুচ্ছিলোনা গলা দিয়ে। অনেক কষ্ট করে শুধু বলতে পারলাম, ‘ওনার এক্সিডেন্ট হয়েছে মা।’
-কার?
-ধূসরের!
মা অবিশ্বাস ভরা চাহনিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। পরক্ষনেই আমি বিছানা থেকে নেমে মাকে নিয়ে বেরিয়ে এলাম বাসা থেকে। আসার পথে বাবাকেও ফোন করলাম। আব্বু-আম্মুকেও খবর পাঠালাম তারা যেন দ্রুত হাসপাতালে পৌঁছে। নিজেকে সামলাচ্ছিলাম খুব কষ্টে! এই অবস্থায় আমাকে ভেঙ্গে পড়া চলবেনা। নিজের জন্য, ধূসরের জন্য, আমার সন্তানের জন্য হলেও শক্ত থাকতে হবে। এই প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে!

হাসপাতালে পৌঁছে তিনতলায় পৌঁছালাম লিফটে করে। লিফট থেকে বেরুতেই করিডোরে আব্বু-আম্মু আর বাবাকে দেখতে পেলাম। আমি একপ্রকার দৌড়েই সেদিকে ছুট লাগালাম। আব্বু আমাকে ধরে রাখলেন। আমি অনেক কষ্টে কান্না আটকালাম। সবার মুখ থমথমে আর ভীষণ চিন্তিত! ভেতরে ডাক্তাররা ধূসরকে দেখছেন। আমরা বাইরে অপেক্ষা করতে লাগলাম। আধঘন্টা অপেক্ষা করার পরে ডাক্তার বেরিয়ে এলেন এবং জানালেন ওনার পাজরের হাড় মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেই সাথে বাঁ-হাত আর পায়ে আঘাত পেয়েছে। মাথায়ও আঘাত আছে। কিভাবে এসব হলো কেউ বল্পতে পারলোনা। এক্সিডেন্টের পর ধূসরকে আহত অবস্থায় কয়েকজন পথচারী হসপিটালে নিয়ে আসে। আপাতত এটুকুই তারা জানে। ধূসরমানবের জ্ঞান ফিরলেই এক্সিডেন্টের ঘটনা ভালোভাবে বোঝা যাবে। তাছাড়া অনেক ব্লিডিং হওয়ার কারণে সমস্যাটা গুরুতর। আব্বুর সাথে ধূসরের ব্লাড গ্রুপ ম্যাচ করায় আব্বু ওনাকে রক্ত দিলেন। সারারাত আর জ্ঞান এলোনা ওনার। তবু্ও আমার স্বস্তি! ফোন করে ডাক্তারটা যেভাবে বলছিলো আমিতো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। এসব কী? হুম? একজন মৃতপ্রায় মানুষকে চিকিৎসা না করে মৃত বলে দেওয়াটা কতটা জঘন্য মানসিকতার পরিচয় বহন করে তিনি বোধহয় সেটা জানেনা। এই কাজটা নাকি নিউ এক ডাক্তার করেছেন। আমি ভীষণ বিরক্ত হলাম এই ঘটনা শুনে। ওই ডাক্তারকে সামনে পেলে চড়িয়ে দাঁত ফেলে দেব এমন একটা ভাব। আম্মু অনেক কষ্টে আমার মুখ বন্ধ করার চেষ্টা চালালেন, তাও আমার অশ্রাব্য গালিগালাজ বন্ধ হলোনা। পরে অবশ্য ওই ডাক্তারের হয়ে হসপিটাল কর্তৃপক্ষ ক্ষমা চান।

ধূসরের জ্ঞান এলো সকালে। ডাক্তার চেকআপ করে জানালেন ওনি মোটামুটি ঠিক আছেন। তবে একমাস ফুল বেডরেস্টে থাকতে হবে। হসপিটালেও কয়েকদিন কাটাতে হবে। সবাই কেবিন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরে আমি ডিভানে বসে রইলাম। ধূসরের সাথে এখন পর্যন্ত একটা কথাও বলিনি। কেন বলবো? সে নাকি আমার উপর রাগ করে বাড়ি আসার পথেই এক্সিডেন্টটা হয়েছে। একটা মাইক্রোবাসের সাথে ওনার গাড়ি ধাক্কা খায় প্রচন্ডভাবে আর ওনি গুরুতর আহত হন। এই কথা শুনে আমি সেই কখন থেকে গাল ফুলিয়ে বসে আছি। কান্না পাচ্ছে আমার। দু’দিন ধরে বক্ষপিঞ্জরের খাঁচায় আটকে রাখা কষ্টগুলো একসাথে বেরিয়ে আসতে চাইছে। আমি ডুকরে কেঁদে উঠলাম।ধূসর শুয়ে থেকেই কাঁপা গলায় আস্তে করে বলল, ‘কাঁদছো কেন আরু?’

ওনার কন্ঠ শুনে মাথায় রক্ত চড়ে গেলো আমার। ন্যাকা! কাঁদছো কেন আরু! যেন জানেনা কেন
কাঁদছি। আমি ভীষণ রেগে বলে উঠলাম, ‘একদম চুপ। একটা কথাও বলবেননা আমার সাথে।’
-হয়েছেটা কী আরু? মুড সুইং হচ্ছে? আমাকে বলো….

আমি তেড়ে ওঠলাম। বললাম, ‘মুড সুইং? আমাকে দেখে আপনার এরকম মনে হচ্ছে?’
-হুঁ। খেয়েছো?
এই কথাটা যেন আগুনে ঘি ঢালার মতো হলো। এই লোকটা কি পাগল? হাত-পা, হাড্ডিগুড্ডি ভেঙ্গে পড়ে আছে বিছানায় আর আমাকে জিজ্ঞেস করছে খেয়েছি কিনা! অদ্ভুত! প্রচন্ড রাগে আমি তখন কাঁপছি। ওনি ক্ষীণ কন্ঠে বললেন, ‘এতো রাগারাগি করেনা সোনা…আমাদের বেবিটার ক্ষতি হবে।’
আমি ফোপাঁতে ফোপাঁতে বললাম,’এই কথাটা একবারও ভেবেছেন আপনি? তাহলে আমার সাথে রাগ করে এতো জোরে গাড়ি চালাতেন না।’
-আসলে আমার তখন মাথা ঠিক ছিলোনা। রাগ হচ্ছিলো খুব!
-অতিরিক্ত রাগ মানুষের ধ্বংসের কারণ। আপনি যতোবারই রাগারাগি করেন ততবারই কিছু না কিছু ঘটেই।
-আচ্ছা আচ্ছা, আর এরকম করবোনা হ্যাপি?
আমি বললাম, ‘সত্যি তো?’
-হুম।
ওনি ইশারা করে কাছে ডাকলেন আমায়। আমি এগিয়ে গিয়ে বেডের সাইডে রাখা টুলের উপর বসলাম। ওনার হাতে-পায়ে প্লাস্টার করা। ডান হাত দিয়ে আমার গাল ছোঁয়ার চেষ্টা করলেন। ফলে হাতে খানিকটা ব্যথা পেয়ে উফ করে চেঁচিয়ে উঠলেন। আমি রেগে তাকালাম। নড়াতেই পারেন না আবার ঢং!

ডাক্তার এসে দেখে গেলেন ওনাকে। বাসা থেকে খাবারদাবার নিয়ে আসা হলো। ধূসর আর মা মিলে আমাকে বাসায় পাঠিয়ে দিতে চাইলো কিন্তু আমি গেলামনা। কান্নাকাটি করে মায়ের সাথে রয়ে গেলাম। পাঁচদিন পর ধূসরকে বাসায় নিয়ে আসা হলো। মূলত আমার জন্যই। কারণ হসপিটালের ওইরকম পরিবেশে আমি নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছিলাম না আর ধূসরকেও ছেড়ে আসছিলাম না। তাই একপ্রকার রাগারাগি করেই ওনি ঠিক করলেন যে বাসায় চলে আসবে। ওনার কথাই কথা, আমাকে ধমকিয়ে সারা! তাই আমিও আর কিছু বলিনি। ধূসর লোকটা যে আমার অস্তিত্বের সাথে মিশে আছে তা আমি খুব ভালো করেই বুঝতে পারি ওই দুর্ঘটনায় পর!

________________

জুন মাসের তপ্ত গরমে চারদিক বিষন্নতার চাদরে ছেয়ে আছে। বারান্দায় বসে বাইরে দৃষ্টি মেললেই দেখা যায় ব্যস্ত নগরীর, ব্যস্ত মানুষের আনাগোনা। সবাই ছুটে চলছে। দু-দন্ড এদিক-ওদিক তাকানোর সময়ও যেনো নেই কারোর। বাতাসের সঙ্গে ভেসে আসে মন খারাপের খবর। মেঘেরা দল বেঁধে হারিয়ে যায় দূরে। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই আমার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে। চোখ থেকে দু’ফোটা জল গড়িয়ে পড়ে গাল বেয়ে। শ্বাশুড়িমা এসে পেছনে দাঁড়ায়। আমার হাতে ভেজা তোয়ালেটা দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঢুকে যান ঘরে। আমি দড়িতে তোয়ালেটা মেলে দিয়ে রুমে চলে এলাম।

এসে দেখি ধূসর আস্তেধীরে উঠে বসার চেষ্টা করছে। নিকিতা মা ঘরে নেই, হয়তো রান্নাঘরে গিয়েছে আর এই লোকটা আবারও পাগলামি শুরু করে দিয়েছে। আমি ওনাকে গিয়ে ধরলাম। রেগে বললাম, ‘সমস্যাটা কী আপনার? হাত-পা ভেঙ্গেও ক্ষান্ত হননি?’
-বকছো কেন?
-তা নয়তো কি আপনাকে আদর করবো?
ওনি মুখটা বিকৃত করে বললেন, ‘ওফ..পিঠে ব্যথা পাচ্ছি।’
আমি উদ্বিগ্ন হয়ে ওনাকে বালিশে হেলান দিয়ে শুইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলাম। ওনি চোখ দুটো বন্ধ করে রইলেন। ডান হাতটা টেনে আমাকে নিজের পাশে বসালেন। তারপর কাঁধে মাথা রেখে নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘খেয়েছিলে দুপুরে?’
-খেয়েছি!
কথাটা মিথ্যা বললাম। কারণ আমি খাইনি। ওনার এই অবস্থায় খাবার আমার গলা দিয়ে নামতে চায়না। মা ও আমাকে জোর করে খাওয়াতে পারেনা। যদিও এই সময়ে এটা ঠিক নয়।
-মিথ্যা বলে লাভ নেই। যাও খাবার নিয়ে আসো। আমি খাইয়ে দেব!
-আপনি কীভাবে খাওয়াবেন? নিজেই খেতে পারেননা আবার অন্যকে….
-এতো কথা কেন বলো আরু?
-বিরক্ত হলে আমি চুপ করে আছি। নো প্রবলেম!

ধূসর নিকিতা মাকে ডেকে খাবার আনতে বললেন। তারপর নিজে সামনে বসে থেকে খাওয়ালেন আমায়। রাতে ঘুমাতে গিয়ে কোনো কারণ ছাড়াই আরও একদফা ঝগড়া করে ফেললাম। একপর্যায়ে আমি ঝগড়ায় হেরে গেলাম। ওনার সাথে না পেরে আমি প্রচন্ড রাগে কেঁদে দিলাম। ঠিক করলাম এই লোকের সাথে এক বিছানায় ঘুমানো তো দূর এই ঘরেই থাকবোনা আমি। আমি বিছানা থেকে নেমে ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে নিলেই ওনি একটা ছোট্ট চিৎকার দিয়ে চোখমুখ কুঁচকে ফেললেন। আমি ভয় পেয়ে ওনাকে ধরে আতঙ্কিত গলায় জিজ্ঞেস করলাম, ‘ক ক্ক কী হয়েছে আপনার? এই, বলুন না কী হয়েছে…. ‘

ধূসর চোখজোড়া খুলে ডান হাতে আমাকে চেপে ধরলেন নিজের সাথে। তারপর প্রগাঢ় এক চুমু খেলেন আমার ঠোঁটে। জলহস্তির মতো শক্তি ওনার। আমি ঠেলে সরাতে পারছিলাম না। বেশ কয়েক মিনিট পর আমাকে ছেড়ে দিয়ে বাঁকা হাসলেন। হাঁপাতে হাঁপাতে রাগী স্বরে বললেন, ‘কেমন লাগলো।’

আমি রাগে ঠোঁট মুছতে মুছতে বললাম, ‘থাকবোনা আমি এই ঘরে। যাচ্ছি আমি!’

কথাটা বলতে দেরি ওনার চুমুথেরাপি দিতে দেরি নেই। আমি ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বিছানা থেকে নামতে নিলেই ওনি চেঁচিয়ে বললেন, ‘রাতে যদি আমি এই ভাঙ্গা হাত-পা নিয়ে ফ্লোরে পড়ে যাই, রক্ত বেরিয়ে মরে যাই তার জন্য দায়ী থাকবে তুমি। আমি হার্ট-অ্যাটাক করে মরলেও তুমি দায়ী থাকবে৷ রাতে যদি ভূত এসে আমায় মেরে ফেলে তাহলেও তোমার দোষ। আমি একা ঘরে থাকতে ভয় পাই সেটা জেনেও তুমি এমন করেছো..জাস্ট মাইন্ড ইট!’

বলেই উল্টোদিকে মুখ করে বিছানায় শুয়ে পড়লেন।
আমি দরজার কাছে কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। ভ্রু দুটি আপনাআপনি কুঁচকে এলো। আচ্ছা ফ্যাসাদে পড়া গেলো তো। এই লোকটা এতো মরে যাওয়ার কথা বলে আমাকে ভয় দেখায় কেন? জানেনা বুঝি, আমার যে কষ্ট হয়! নির্দয় ধূসরমানব একটা!

চলবে…. ইনশাল্লাহ!

#হৃদমোহিনী
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১৯

ছোট ছোট কেয়ার, একটুখানি প্রেম সব মিলিয়ে দিনগুলো এবার ভালো মতোই কাটতে লাগলো।
দিনে দিনে আমাদের প্রেম গভীর থেকে গভীর হচ্ছে। ধূসরও ততোদিনে সুস্থ হয়ে গিয়েছে। আশেপাশের সবকিছু, মানুষের স্বভাব সবকিছু পাল্টেছে। আমাদের ঘরের রুপটাও পাল্টেছে। অর্নির ব্যবহৃত জিনিসপত্র দিয়ে সাজানো হয়েছে ঘরটা। বরাবরই ওর পছন্দের জিনিসপত্র ইউনিক ছিলো। আমার পছন্দ আবার ততোটা ভালো নয়। কিন্তু এতো সুখের মাঝে থেকেও মাঝে মাঝে আমি অর্নির শূন্যতা অনুভব করি। তখন কষ্টে বুক ভেঙ্গে কান্না আসে। কিন্তু ধূসরের সামনে কাঁদিনা। বেচারা তাহলে খুব কষ্ট পাবে। আমার এই বোনটাকে আমি আমার হৃদয়ের একটা অংশে খুব যতনে রেখে দিয়েছি। আর ওর ভালোবাসাটাকে আগলে আমি বেঁচে আছি। এটাই নিয়তির কারুকাজ। কেউ পেয়েও পায়না, আর কেউ না চাইতেই পেয়ে যায় সবকিছু!

সপ্তাহখানিক পর, আল্লাহ তায়ালার অশেষ রহমতে সুস্থভাবেই আমার ছোট্ট সোনামণি পৃথিবীর আলো দেখলো। ছোট্ট একটা ধূসরমানবী আমার কোলজুড়ে এলো। আমার ক্ষুদ্র জীবনটাকে পরিপূর্ণতা দান করলো! মা হওয়ার আনন্দে আমি তখন সুখের ভেলায় ভাসছি। ধূসর তো পুরো হসপটালের সবাইকে মিষ্টি বিতরণ করেছিলো। তারপর এলো বাচ্চাকে কোলে নিতে। ওনি ঠিক করলেন তোয়ালে দিয়ে ওকে কোলে নেবেন না, নিজের সেলাই করা কাঁথাতেই কোলে নেবেন বলে সে কী ঝামেলা সিস্টারদের সাথে। ওনার এক কথা, ‘আমি সবকিছু জীবাণুমুক্ত করে এনেছি, আপনি ওখানেই রাখুন আমার পিচ্চুনিকে।’

সিস্টার বেচারি অসহায় গলায় বললেন, ‘আমাকে ডাক্তার বলে দিয়েছেন আপনার বাচ্চাকে যাতে কেয়ারফুলি রাখি। বাইরের জিনিসপত্র ইউজ যাতে না করি।’
ওনি চেঁচিয়ে বলে উঠলেন,
-বাইরের জিনিস? কোনটা বাইরের জিনিস? এটা আমার নিজের হাতে তৈরি করা জিনিস। আর ধূসর কখনো পুরোনো বাতিল জীবাণুযুক্ত জিনিস ইউজ করেনা।
সিস্টার এভাবে কিছুতেই ওনার কোলে দেবেনা। ভীষণ বিরক্ত হয়ে বলল,
-তবুও স্যার আপনি বোঝার চেষ্টা করুন….
ধূসর ওনাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,
-কিচ্ছু বোঝাতে হবেনা।
সিস্টার এবার বেশ বিরক্ত হলো। বললো,
-এতে আপনার বেবিরই প্রবলেম হবে।
একথা শুনে আমি ধূসরকে অনুরোধ করলাম এমন পাগলামো না করতে। ওনার পাগলামো দেখে সবাই হাসতে হাসতে খুন। তবু অনেক কষ্টে ওনাকে সবাই বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজি করালো। দুই পরিবারে যেন ইদের মতো আনন্দ লেগেছে। এভাবে সবাইকে দেখতে খুবই ভালো লাগছে। এক পৃথিবীর সকল সুখ আমার সামনে তখন নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করছিলো।

হসপিটালে দু’দিন কাটিয়ে পিচ্চুনিকে নিয়ে আমরা বাসায় চলে এলাম। তারপর জীবনটা আরো রঙিন হয়ে উঠলো। আমার ছোট্ট ধূসরমানবীটা ছোট্ট হাত-পা মেলে খেলা করে, মিটমিট করে আমাদের দেখে। এভাবেই মাস কয়েক কেটে গেলো। নিকিতা মা সংসার সামলাতে ব্যস্ত, আমি ধূসর আর পিচ্চুনিকে সামলাতে ব্যস্ত। একদিন রাতে আমি পিচ্চুনিকে নিয়ে ঘুমিয়ে আছি, ধূসর বাইরে থেকে ফিরে এসে আমাদেরকে এ অবস্থায় দেখে আর ডাকলোনা। সোজা ফ্রেশ হয়ে এসে আমার পেছনে শুয়ে পড়লো। আমি তখন ক্লান্ত হয়ে ঘুমে মগ্ন। ওনি আমার ঘুমন্ত অবস্থার সুযোগ নিয়ে আমার নাকে-মুখে সুড়সুড়ি দিচ্ছেন। এতে আমার পাকা ঘুমটা ভেঙে গেলো। আমি বিরক্ত হয়ে ওনাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলাম। তারপর আবার ঘুম। হঠাৎই ধূসর নাঁকি সুরে ভয়াবহ কন্ঠে আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বলতে লাগলো,
-এই আরু…আরু!!
আমি উত্তর না দিয়ে চুপ করে মিটমিটিয়ে হাসছি। দ্বিতীয়বারও একইভাবে বলতে লাগলো। আমি এবার ভয় পাওয়ার ভান করে বললাম,
-ক কে কে?
– ভূততত..
-তাই বুঝি?
-হ্যাঁ।
-কিন্তু আমি যে আমার ভূত বাবাজিকে ভয় পাইনা?
ধূসর চিকম সুরে ভ্রু কুঁচকে বলতে লাগলো,
-বড্ড সাহস তাইনা? বড্ড সাহস!
-আমিতো আর ভিতু নই, তাই পাঙ্গা নিতে আসবেন না ভূত মশাই। আপনি হয়তো জানেন না আমি একলা নই।
-একলা নন, তাহলে কি দোকলা?
-অভিয়েসলি মিস্টার ভূত মশাই। আমার সাথে আমার বোন অর্নি আছে..তার বোনকে ভয় দেখিয়ে আপনি পার পেয়ে যাবেন তা তো হতে পারেনা..
ধূসর ভাব নিয়ে বলল,
-তোমাদের দুটো বোনকে বোতলে করে আমার হৃদপিন্ডে ঢুকিয়ে রাখবো, ওকে? দ্যান মজা বুঝবে!
-হা হা হাসালেন আমায়! সেই স্পর্ধা আপনার নেই মিস্টার। এই যে দেখুন, আমার কোলে আমার পিচ্চুনি আছে, আমার মেয়ে তার মাকে বাঁচাবে!!
ওনি হুট করে উঠে বসে পড়লেন। ভ্রু কুঁচকে নাক টেনে বলতে লাগলেন,
-বাহ রে বাহ! পিচ্চুনিটা কী তোমার একলা নাকি? এতে বুঝি আমার কোনো অংশীদারীত্ব নেই?? আকাশ থেকে বুঝি পিচ্চুনিটা এসে পড়েছে?
-হ্যাঁ সেটাই।
ওনি রেগে গেলেন।
-কী বললে??
ওনার চিৎকারে আমি চুপ হয়ে গেলাম। ওনার রাগী কথাগুলো থেকে বাঁচার জন্য আমি মুখটা গম্ভীর করে বিষাদমাখা কন্ঠে বললাম, ‘আপনার ভূত ভূত খেলা বন্ধ হলে এবার দয়া করে একটু চুপ করুন ধূসরমশাই।’
ওনি উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন, ‘কেন কেন? তোমার কী শরীর খারাপ লাগছে?’
-না। ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। পিচ্চুনিটা এতোক্ষণ কেঁদে কেঁদেই ঘুমিয়েছে, বেশি জোরে কথা বললে উঠে পড়তে পারে!
-ঘুমাবে?
-আপনি তো ভাঙ্গিয়ে দিলেন। এখন আর ঘুম আসছেনা।
ধূসর কিছু একটা ভেবেচিন্তে বললেন,
-চলো বারান্দায় যাই। আজ জোৎস্না রাত।
-জোৎস্না রাত দিয়ে আমি কী করবো?
-জোৎস্না খাবে, তোমার জীবনটাও ধূসর থেকে জোৎস্নাময় হয়ে উঠবে। অর্নির ফেভারিট কাজের মধ্যে এটাও একটা, তুমি জানো!
আমি আলতো হেসে ধূসরের গালে হাত রাখলাম। নিদারুণ এক অনুভূতি টের পেলাম মনের কোণে। একটু নয়, অনেক বেশিই ভালোবেসে ফেলেছি এই মানবটাকে। আমি ক্ষীণ কন্ঠে বললাম, ‘আমি ধূসরহীন জীবন চাইনা, জোৎস্নাময় জীবন তো এটাই যেখানে আমার ভালোবাসা আছে। আমি এখন ভালোবাসার মানুষটার সাথেই সুখে আছি তাহলে কেন অন্যকিছু চাইবো!’
ধূসর হাসলো।
-চা করে নিয়ে আসি?
-হুঁ।
-পিচ্চুনিকে দেখবেন, যাতে উঠে না যায়!
-আচ্ছা আচ্ছা।

আমি রান্নাঘরে গিয়ে দু’কাপ চা করে নিয়ে এলাম। ঘরে এসে দেখি ধূসরমানব পিচ্চুনিকে নিয়ে খেলা করছে বিছানার উপর। ঘটনা বুঝতে পেরে আমি অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালাম ওনার দিকে। ওনি থতমত খেয়ে বললেন, ‘ইয়ে.. মানে!’
-মানে মানে করবেন না। আমি জানি আপনিই ওকে ঘুম থেকে উঠিয়েছেন। বাচ্চাদেরকে এভাবে ঘুম থেকে জাগানো ঠিক নয় আপনি জানেন না?

ধূসর বলল, ‘ভাবলাম আজ চন্দ্রবিলাস করবো তাই কন্যাকে সাথে নিয়েই করি।’

এটা বলতেই আমার গুণধর কন্যা হেসে হেসে বাবার কথায় সায় জানালো। ধূসর ওর গাল টেনে দিতেই খিলখিল করে হাসতে লাগলো। বাপ-বেটির আহ্লাদীপনা দেখে আমি মুখ টিপে হাসছি। আমি কড়া চোখে মেয়ের দিকে তাকাতেই সে ঠোঁট ভেঙ্গে কেঁদে দিলো। ধূসর আমাকে বিকট এক ধমক দিয়ে পিচ্চুনিকে কোলে করে বারান্দায় চলে গেলো। মেয়ের কান্না থামানোর চেষ্টা না করে ওনি দুনিয়ার হাবিজাবি কথা বলে চলেছেন আর ওর পিঠে হাত বুলাচ্ছেন, মেয়ে আমার এমনিতেই চুপ হয়ে গেলো। এই লোকটা এতো ফাজিল। সুযোগ পেলেই পিচ্চুনিকে ঘুম থেকে জাগানোর ফন্দি আঁটে। ওনার নাকি শান্তশিষ্ট বাচ্চাকাচ্চা পছন্দ নয়। বাচ্চারা থাকবে চঞ্চল, প্রাণোবন্ত, উচ্ছল। কিন্তু এটা শুধু ওনার মেয়ের জন্যই শিরধার্য! অন্য কারো বাচ্চা এমন হলে ধূসর প্রচুর বিরক্ত হন। এমনকি ফোনেও পিচ্চুনির কান্নার শব্দ রেকর্ড করে রেখে দিয়েছে। সময় সুযোগ পেলেই ওটা লাউডে দিয়ে বা মিউজিক বক্সে লাগিয়ে শুনেন। ওনার এই অদ্ভুত কর্মকান্ডে আমি প্রচুর বিরক্ত। অবশ্য আমার মেয়ে তার বাপের সব কর্মকান্ডই পছন্দ করে, যেমনটা অর্নি করতো! মাঝেমাঝে মনে হয়, আমার এই ছোট্ট পিচ্চুনির মাঝেই অর্নির বাস! সেই চোখ, সেই নাক, সেই অভ্যাসগুলো যা অর্নির মাঝে ছিলো সবই আমি আমার মেয়ের মাঝে দেখতে পাই। এমনও হয় আদৌ? একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমি ধীরপায়ে হেঁটে বারান্দায় গেলাম। নিকষকালো অন্ধকার ধুয়েমুছে দিচ্ছে মাথার উপরে থাকা বিশাল চাঁদটা। ধূসর মেয়েকে গান শোনাচ্ছে। এই লোকটা যে এতো ভালো গাইতে পারে, তাও আবার রবিবাবুর গান আমি সেটা জানতামই না। কী সুরেলা ওনার কন্ঠ, কত আবেগ দিয়ে প্রতিটি লাইনকে জীবন্ত করে তুলেন আমি বলে বোঝাতে পারবোনা।

———‘ওরে আমার হৃদয় আমার, কখন তোরে প্রভাতকালে
দীপের মতো গানের স্রোতে কে ভাসালে॥
যেন রে তুই হঠাৎ বেঁকে শুকনো ডাঙায় যাস নে ঠেকে,
জড়াস নে শৈবালের জালে॥
তীর যে হোথা স্থির রয়েছে, ঘরের প্রদীপ সেই জ্বালালো-
অচল রহে তাহার আলো।
গানের প্রদীপ তুই যে গানে চলবি ছুটে অকূল- পানে
চপল ঢেউয়ের আকুল তালে॥’

চলবে….ইনশাআল্লাহ!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here