#হৃদমোহিনী
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৩
আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম, ‘অর্নি আমার বোন ছিলো!’
-ও তোমাদের কেউ ছিলোনা। নইলে এতো সহজে ওর জায়গা নিতে চলে আসতে পারতেনা। ইউ ব্লাডি গার্ল, অলওয়েজ ভালোমেয়ে সেজে থাকার অভিনয় করে গিয়েছো। এবার তোমার মুখোশ পুরোপুরি বেরিয়ে এলো। মাথায় ভালো করে ঢুকিয়ে নাও,তোমার এই কাজের জন্য কখনোই ক্ষমা করবোনা আমি, আর না শান্তি দেবো! সবকিছু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে তোমার জীবন আমি নরকে পরিণত না করলে আমি সাঈদুল ফাইয়াজ ধূসর না..’
ওনার কথা শুনে আমার গা জ্বলে উঠলো। এই লোকটা কী আমায় বোকা বা অবলা ভাবছে? ভাবছে আমি খুবই সাধারণ, কথা বলতে বা প্রতিবাদ করতে পারিনা? বিছানার একপাশে পড়ে থাকা চশমাটা উঠিয়ে চোখে দিলাম। তারপর খুব শান্তভাবে ওনার সামনে দাঁড়ালাম। ওনি আকস্মিক আমাকে এভাবে দেখে ভড়কে গেলেন। আমি চুলগুলো হাতখোঁপা করে সাহস সঞ্চার করে জিজ্ঞেস করলালাম, ‘বলা শেষ আপনার?’
যদিও আমার ভেতরে ভেতরে খুব ভয় করছিলো তবুও তা প্রকাশ করলামনা। ওনি বললেন, ‘না।’
-তাহলে বলে ফেলুন।
-মানে?
-মানেটা আপনি জানেন। এই যে আমাকে এত এত ডায়লগ শুনাচ্ছেন আর কয়টা বাকি আছে?
ওনি রেগে গিয়ে বললেন, ‘আমি মজা করছিনা।’
-আমিও মজা করছিনা। ইভেন মজা জিনিসটা আমার একদমই পছন্দ না।
-বেশি কথা ফুটছে দেখছি!
-আসলে আপনার সাথে এর আগে আমার বেশি কথা বলার প্রয়োজন পড়েনি, তাই দেখেননি। কেন অর্নি আপনাকে বলেনি যে আমি একটা ডেঞ্জারাস?
আমার মুখে অর্নির নাম শুনে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকালেন। চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, ‘অর্নির নাম মুখে আনবেনা একদম! বেরুও ঘর থেকে।’
আমি ওনার সাথে আর কথা বাড়ালামনা। মেজাজ খারাপ হচ্ছে আমার। সঠিক সময় মুখের উপর সঠিক কথা না বলতে পারাটাই আমার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। এই সমস্যা কাটিয়ে তারপর আমার উচিৎ ঠান্ডা মাথায় ওনাকে বোঝানো। অর্নির শূন্যতা বুঝতে দেওয়া যাবেনা। নেশা থেকে ফিরে আসুক আর ভালোভাবে বাঁচুক। অর্নিকে আজীবন ভালোবাসুক আমিও এটাই চাই। কিন্তু এর জন্য নিজের সুন্দর জীবন নষ্ট করার কোনো মানে হয়না, আর নিকিতা আন্টিরা তো কোনো দোষ করেনি। তাহলে ওরা কেন কষ্ট পাবে? এখন থাকুক আর যা-ইচ্ছা করুক। আমার তাতে কিচ্ছু যায় আসেনা। আমার কিছুদিন সময় নিতে হবে। নিজের সাথে বোঝাপড়া করতে হবে! কারণ আমিও এখন তাঁর অর্ধাঙ্গী। ওনার জীবনের সাথে আমিও জুড়ে আছি। বিয়ে হয়েছে আমাদের। সেটা আমরা মানি না না-মানি। সত্যটা পাল্টাবেনা কখনোই!
আমি ড্রইংরুমে গিয়ে বসে রইলাম। কোনো কাজটাজ না পেয়ে শ্বাশুড়ি মায়ের সাথে গল্প করে কাটালাম। বিকেলে বাগানে ঘুরাঘুরি করলাম, গাছে পানি দিলাম। বাসায় ফোন দিয়ে কথা বললাম। আমার সহপাঠীরা বিয়ের খবর শুনে একের পর এক ফোন দিতে লাগলো, তাঁদের সাথেও স্বাভাবিকভাবে কথা বললাম। সন্ধ্যায় চা আর স্নেকস তৈরি করলাম শ্বাশুড়ি-বৌমা মিলে। রউফ আংকেল মানে আমার শ্বশুর ওনি বেশ আড্ডা জমালেন। টিভিতে নিউজ দেখতে দেখতে সন্ধ্যার নাস্তার পর্ব শেষ হলো। রাত আটটার সময় হঠাৎ কলিংবেল বেজে উঠলো। শ্বাশুড়ি মা দরজা খুলতে গেলেন। ধূসর এসেছে। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে দরজায় দাঁড়িয়ে আছে, মানে এখন সেন্সেই আছে। তাঁর পরণে ট্রাউজার আর টি-শার্ট। এই প্রথম আমি ভালোভাবে ওনাকে লক্ষ্য করলাম এবং ওনাকে বেশ সুদর্শন বলেই বোধ হলো। মা-বাবা দুজনেই ঘরে চলে গেলেন, তাঁদের চোখেমুখে আলতো খুশির ঝিলিক।
অর্নি নিজে অনেক বেশি স্মার্ট ছিলো। ধূসরও তা-ই। ওদের জুটিটা আসলেই বেস্ট ছিলো। আটকে রাখা নিঃশ্বাসটা ফেলে আমি আবারও টিভিতে মনোযোগ দিলাম। দেখার মতো কিছু না পেয়ে একটা হিন্দি সিরিয়াল দিলাম। যদিও কখনোই আমি এসব দেখিনা, এককথায় মাথা ধরে যায় এসব দেখলে। কিন্তু এখন একপ্রকার সময় কাটানোর জন্য রগরগে সিরিয়ালটাতে চোখ বুলাচ্ছি আর রিমোটটা শক্ত করে চেপে ধরে আছি। আমাকে চমকে দিয়ে ধূসর এসে বিপরীত দিকের সোফায় বসলো। তখনই কিসিং সিন শুরু হলো সিরিয়ালে। পড়ি কি মড়ি করে রিমোট চাপতে লাগলাম, সে আমার সাথে বেইমানি করলো। কিছুতেই কাজ করলোনা। লজ্জায় আমি শেষ। আমার অবস্থা দেখে ধূসর গলা চড়িয়ে ধমক দিলেন, ‘এমন করছো কেন?’
উত্তর না পেয়ে ওনি চুপ হয়ে গেলেন। বোধহয় বুঝতে পেরেছে আমি লজ্জা পাচ্ছি। তাই বেশ স্বাভাবিক স্বরেই বললেন, ‘ইট’স নরমাল। এসব দেখ্র লজ্জায় মরে যাওয়ার মতো কিছু হয়নি।’
-আপনি চুপ করুন।
-আমাকে চুপ করতে বলার তুমি কে?
আমি কড়া গলায় জবাব দিলাম, ‘আপনি কী বাংলা সিনেমার হিরোদের মতো স্মৃতি হারিয়ে ফেলেছেন? আপনার কি কিছুই মনে নেই? ওহ! ভেরি ব্যাড…’
ওনিও অগ্নিচোখে আমাকে দেখলেন। পরক্ষণেই টিভির দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বললেন, ‘এসব কি হচ্ছে?’
আমি মাথা নিচু করে বললাম, ‘রিমোট কাজ করছেনা।’
-আমাকে পাস করো, রাইট নাও!
সিনটা দেখে আমার কাল রাতের কথা মনে হয়ে গেলো। ইয়া আল্লাহ! কাল রাতে তো ধূসর ভাই আমাকে অর্নি ভেবে কিসও করেছেন, পুরোটাই নেশার ঘোরে! মনে হতেই ওনার হাতে রিমোটটা দিয়েই আমি এক দৌড়ে রান্নাঘরের দিকে যেতে চাইলাম। বিধিবাম, চৌকাঠে উষ্ঠা খেয়ে পড়ে গেলাম ফ্লোরে। অট্টহাসিতে মেতে উঠলেন ধূসর। আমাকে সাহায্য করতে এলেননা। আমার কষ্ট দেখে ওনার খুব আনন্দ হচ্ছে! পায়ের ব্যথায় আমার চোখে জল চলে এলো। কোনোমতে উঠে খুড়িয়ে খুড়িয়ে পৌঁছোলাম রান্নাঘরে। শ্বাশুড়ি মা দেখে আতঙ্কিত গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হয়েছে মা? এভাবে হাঁটছো কেন?’
-ব্যথা পেয়েছি।
-কীভাবে?
-চৌকাঠে পা বেঁধে পড়ে গিয়েছিলাম।
এই কথা শুনে মা বেশ আহত হলো। আমাকে ডাইনিংয়ের চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে ফ্রিজ থেকে বরফ এনে পায়ে লাগিয়ে দিলেন। আমার শত বারণ কানে না নিয়ে তিনি রাতের খাবারটাও নিজ হাতে আমাকে তুলে খাইয়ে দিলেন। আমাকে খাইয়ে দেওয়ার সময় ধূসর ব্যাটার চেহারা দেখে মনে হচ্ছিলো কেউ ওনার গলায় বিষ ঢেলে দিয়েছে। আমাকে উদ্দেশ্য করে গা জ্বালানো কয়েকটা কথা বলে তিনি ঘরে চলে গেলেন। মা হেসে বললেন, ‘বুঝোনি? সহ্য হচ্ছেনা ওর!’
ওনার কথা শুনে আমিও হাসলাম।
রাত সাড়ে এগারোটা। খোলা আকাশে মস্ত বড় চাঁদ। বাতাস ঠান্ডা এবং আরামদায়ক। পায়ের ব্যথা কিছুটা কমতেই ঘুমাতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে ওনার ঘরে গেলাম। কাল তো মাতাল ছিলো তাই আমি যে ওনার ঘরে থেকেছি সেটা বুঝতে পারেননি। কিন্তু আজ তো জ্ঞানে আছেন, যদি আমাকে ঘর থেকে বের করে দেয়? যাইহোক, এক বস্তা সাহস জোগাড় করে ঘরে গিয়ে দেখি ওনি ল্যাপটপে কি যেন করছেন। আমাকে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখানে কী চাই?’
আমি ঝটপট উত্তর দিলাম, ‘ঘুমাতে চাই।’
ওনি দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
-ঘুমাও, মানা করেনি কেউ।
আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘সত্যি?’
-হুম। কিন্তু আমার ঘর থেকে বেরিয়ে যাও।
যা ভেবেছিলাম তাই। এই সাইকো কোনোভাবেই আমার থাকাটা এলাউ করবেনা। কিন্তু যত যাইহোক এখন তো সে আমার স্বামী। ওনার সবকিছুতে অর্নির যেমন অধিকার ছিলো আমারো তাই। এই বাড়িতে পা রাখার পর থেকে সে আমার সাথে দুর্ব্যবহার করে গিয়েছে, যা আমি পছন্দ করিনা। একপ্রকার রেগেই ওনাকে আমি বললাম, ‘বিয়ে যেহেতু আপনার সাথেই হয়েছে তাই আমি এখানেই ঘুমাবো।’
-তুমি চাইলেই তো আর হবেনা। এটা আমার ঘর, আর ডিসিশন নেওয়ার অধিকার শুধুই আমার।
-দেখুন, আপনার সাথে ঝগড়া করার কোনো ইচ্ছে আমার নেই। তাই বেহুদা কথা বাড়াবেননা৷ আমি এই ঘরেই ঘুমাবো। বেডে শোয়ার কোনো ইচ্ছে যেহেতু আমার নেই, আমি ফ্লোরেই বিছানা পেতে নেবো।
ওনি ল্যাপটপটা কোলের উপর থেকে নামিয়ে চিৎকার করে বললেন, ‘একবার বললে কি কথা কানে যায়না?’
-না যায়না।
-এই ঘর আমার অর্নির। আরুণী নামক কোনো মেয়ের নয়। তাই শুধু শুধু আমার মেজাজ খারাপ করাবেনা।
-অসহ্য।
বলেই আমি নিচে বিছানা করে শুয়ে পড়লাম। ওনি রাগী চোখে তাকিয়েই রইলেন। মাথাব্যথা হচ্ছে প্রচুর। চোখ বন্ধ করার আগে দেখলাম ওনি বোতল নিয়ে বসেছেন। রাগ হলেও আমি কিছু বললামনা!
চলবে…ইনশাআল্লাহ!