#হৃদয়ঙ্গম
#সূচনা_পর্ব
#তুষার_আব্দুল্লাহ_রিজভী
“আপনাকে আমি ভালোবাসি। আমি আপনাকে আমার করে পেতে চাই। আপনাকে আমার লাগবেই, দুলাভাই।”
একমাত্র শালির মুখে কথাটা শুনে চমকে উঠল পাবেল। যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত পড়ল ওর মাথার উপর। এটা কী করে সম্ভব! শালির দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “তুমি কী পাগল হয়ে গেছো মায়া! তোমার আমার সম্পর্ক কী ভুলে গেছো? আমি এটা করতে পারব না৷ আমার পক্ষে সম্ভব না। আমি এভাবেই ভালো আছি। আমার কাউকে লাগবে না।”
“দেখুন, আমার আপু মারা গেছে দুবছর। আপনাদের একটা ফুটফুটে ২ বছরের মেয়ে সন্তানও আছে। ওকে আপনি একা মানুষ করতে পারবেন? মায়ের ভালোবাসা দিয়ে পরিপূর্ণ করে তুলতে পারবেন? তাছাড়া আমি আপনাকে ভালোবেসেও ফেলেছি৷ আমি এই দুটো দায়িত্ব নিতে চাই, ব্যাস।” কথাগুলো বলার পর উল্টো দিকে ঘুরে দাঁড়ানোর সাথে সাথে চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়েও পড়ল মায়ার।
“আহা! কাঁদছো কেন মায়া?” কয়েক পা এগিয়ে গেল মায়ার দিকে। মায়াকে স্পর্শ করতে গিয়ে করল না। “আচ্ছা, আমি ভেবে দেখব।” বলেই ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল পাবেল।
শেষের বাক্য গুলো শুনে কিছুটা স্বস্তি পেল মায়া। কিন্তু স্বস্তিটা কত সময়ের! ও যে পাবেলকে চায়। খুব করে চায়!
***
পাবেলের বিয়েটা ভালোবেসে হয় নীলার সাথে। ৫ বছরের ভালোবাসার পরিণতি খুব স্বার্থক ভাবেই হয়ে যায়। নীলার বাড়ি থেকেও পাবেলকে প্রথম দেখায় পছন্দ করে নেয়। তাছাড়া নীলার কথা কখনো ফেলে না ওর বাবা মা। বিয়েটা খুব ধুমধামেই হয়ে যায় এক প্রকার। দুটো পরিবারই খুশি অনেক। সব ঠিকঠাক ভাবেই চলতে থাকে।
নীলা আর পাবেলের ভালোবাসার প্রখরতা এত বেশি ছিল যে, কখনো কোনো কষ্ট তাদের সুখকে পেছনে ফেলতে পারেনি। ওরা ওদের চোখের দিকে তাকিয়েই যেন ওদের সব কষ্ট ভুলে যেত। ওদের ভালোবাসা এতটাই গভীর।
পাবেল একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে কাজ করে। নীলা অবশ্য জব করতে চেয়েছিল বিয়ের পর। এতে আরো টাকা আসবে ওদেরি উন্নতি হবে। কিন্তু সেটা আর হয়ে উঠেনি। পাবেলই না করে দেয়। সে থাকতে নীলা কেন কষ্ট করবে। পাবেল নিজেকে আরো উন্নতির দিকে নিয়ে যেতে থাকে। এতে অবশ্য নীলার কোনো আক্ষেপ ছিল না। স্বামীর মতামতের গুরুত্ব বরাবরই তার নিকট ছিল।
নীলা পুরো শ্বশুরবাড়িটাকে মাথায় করে রাখত। শ্বশুর শ্বাশুড়ি আর তার একমাত্র ননদকে আদর যত্মে রাখত। একাই সকল কাজ সামলে নিতো। কাউকে কোনো কাজের দিকে ঝুঁকতেও দিতো না। কেউ আগ্রহ দেখিয়ে কাজ করতে আসলে নীলার একটাই কথা চলত, “আমি আছি না? আমি থাকতে তোমার কেন এসব করতে হবে?” নীলার রাগের আশে পাশে কেউ থাকতে চাইতো না। সেই সাহস করতোও না। খুব ভালোবাসত নীলা তার এই নতুন পরিবারকে।
পাবেল রাত্রিরে অফিস থেকে ফিরলে স্বামীর খেদমতে লেগে যেতো একদম। পাবেলও কম যেতো না। বাড়িতে ফ্রি সময় পেলেই সে রান্না করত। নীলাকে আরামে পাঠিয়ে দিয়ে সব কাজ সে করত। যেদিন নীলার গর্ভবতী হওয়ার প্রথম নিউজ পাবেলের কানে আসে সেদিন থেকে নীলাকে রাণীর মতো করে রাখা শুরু করে আরো। শ্বশুর শ্বাশুড়ি আর একমাত্র ননদ কেউই ভালোবাসার কমতি রাখেনি তখন। এত ভালোবাসা পাওয়ায় নীলা সবসময় খুব গর্ভই করত। কে পায় সবার এত ভালোবাসা। নীলার কখনো মনে হয়নি ও কোনো নতুন পরিবার পেয়েছে। ওর একদম নিজের পরিবার মনে হতে থাকে।
কথায় আছে না? সুখ বেশিদিন ভালো মানুষের কপালে সয় না। এক্ষেত্রেও নীলা আর পাবেলের ভাগ্যে এরকমটাই হলো। নিজেদের প্রথম সন্তানের মুখ দেখলেও পাবেল হারায় নীলাকে। বাচ্চা প্রসবের কিছু সময় পর নীলা মারা যায়। নীলা ওর সন্তানকে নিজ চোখে দেখেও যেতে পারেনি। সেই সুযোগ সে পায়নি। কিন্তু ও যাওয়ার আগে স্মৃতি হিসাবে নিজের সন্তানকে রেখে যায়। আটবছরের মাথায় একটা সুখী জীবনের ভালোবাসা ইতি ঘটে।
নীলা চলে যাবার পর পাবেল এলোমেলো কেমন জানি হয়ে যায়৷ নিজের উপর মাঝে মাঝে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলতে থাকে পাবেল। কোনো কাজে মন বসাতে পারে না। তবুও নিজেকে পাথর বানিয়ে সামলে নিতে থাকে পাবেল। একসময় কষ্টকে মেনে নিয়ে জীবনকে এগিয়ে নিতে শুরু করে পাবেল। নিজের সন্তানকে নিয়েই কাটিয়ে দিবে বলে সিদ্ধান্ত নেই। সিঙ্গেল বাবা হয়েই থাকবে। কখনো নিজের সন্তাকে কোনো প্রকার ভালোবাসার কমতি না হোক, সেইভাবেই থাকবে ও।
দুইটা পরিবারই অনেকটা ভেঙে পড়ে। কী করবে তারা বুঝতে পারে না। নীলার সন্তানকে কাদের কাছে রাখবে এ নিয়েও কোনো ঝামেলা হয়নি। নীলার বাবা-মার কাছে শুরুতে রাখার সিদ্ধান্ত হয়। ছোট্ট বাচ্চার উপর কখনো কোনো ধরণের চাপ না পড়ুক সেভাবেই আগাতে থাকে তারা। এই নবজাতকে ঘিরেই সুখী ভাবে আগাতে থাকে দুটো পরিবার।
প্রায় দিনই অফিস থেকে বেরিয়েই আগে যায় পাবেল ওর শ্বশুর বাড়ি। নিজের সন্তানের সাথে কিছু সময় কাটিয়ে পরে নিজের বাড়ি ফিরে আসে। এইতো কিছুদিন আগে মেয়ের ২ বছর পড়ল। ওই বিশেষ দিনটাকে পাবেল একসাথে কষ্ট ও সুখ পাওয়ার অনুভূতি বুকে নিয়ে বাঁচতে থাকে। নিজের মেয়ের জন্মদিন ও নিজের ভালোবাসার মানুষটার মৃত্যুবার্ষিকী। দুটো বিষয় ওর কাছে আনন্দ আর বেদনার।
***
আজও নিয়ম করে নীলার বাড়িতে যায় পাবেল। নিজের মেয়ের সাথে সময় কাটানোর পর মায়া ওকে ওর ঘরে নিয়ে যায় জরুরী কিছু কথা বলতে। নীলার বাবা মা এই সময় আজ বাড়িতে ছিল না৷ এই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে মায়া নিজের মৃত বোনের স্বামীকে ভালোবাসার কথাগুলো বলে ফেলে। এটা পাবেল মানতে পারেনি মম থেকে। অনেকটা আঘাত পায় ও। এরকমটা হবে কখনো মানতে পারেনি পাবেল। কীভাবে মানবে? শালির নিকট এমনটা কখনো আশাও করেনি।
পাবেল কথাগুলো শুনে কিছুটা হতভম্ব হয়ে আছে এখনো। ওই বাড়ি থেকে বেড়িয়ে একটা রিক্সায় চড়েছে পাবেল। নিজের বাড়ির দিকে যাচ্ছে। রিক্সায় বসে বসে ভাবছে মায়ার বলা কথাগুলো। এও কী সম্ভব! কিন্তু পাবেল তো এরকমটা চায়নি। না, মায়াকে না করে দিতে হবে। ওর বাবা মার সাথে কথা বলতে হবে আগামীকাল। এটা আমি করতে পারব না। মনের ভেতর ভালোবাসার পূণরাবৃত্তি ঘটাতে চায় না ও। কেন ঘটাবে? ভালোবাসা তো একজনকেই যায়। সম্পূর্ণ মন শুধু নীলার আর কারো না। কখনো হবেও না।
বাড়ি ফিরে সদর দরজার সামনে এসে দাঁড়াল পাবেল। কলিং বেল চাপ দিতেই ছোটো বোন নন্দিনী এসে দরজা খুলল। পাবেল দরজা পেরিয়ে গিয়ে সোফায় বসল৷ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে নিল। মানি ব্যাগে থাকা নীলার ছবিটা বের করে এক দৃষ্টিতে দেখতে লাগল পাবেল।
নন্দিনী এসে ভাইয়ের পাশে এসে বসল। ভাইয়ের অবস্থা দেখে বলল, “ভাই তোর কী ভাবীর কথা মনে পড়ছে খুব?”
পাবেল ছবিটা আবার মানিব্যাগে রেখে বলল, “আরে তেমন না রে।”
নন্দিনী আবার জিজ্ঞেস করল, “ভালোবাসতি খুব ভাবীকে তাই না?”
মুখে হাসি ফুটিয়ে পাবেল বলল, “সেটা আর বলতে!”
“ভাবীর মতো মানুষ হয় না রে। ভাবী কত সুন্দর একা হাতে এই সংসার গুছিয়ে নিয়েছিল৷ কী থেকে কী হয়ে গেল! আচ্ছা বাদ দে, তোকে দেখে খুব চিন্তিত মনে হচ্ছে। অন্যান্য দিন তো এত চিন্তা করিস না। কিছু হয়েছে কী?”
“আরে তেমন কিছু না বোন। ভাবিস না এত কিছু। কী রান্না করেছিস বলতো? খুব খুদা লেগেছে।”
“আজকে তোর জন্য গরুর মাংস রেঁধেছি আর ভাত।”
“তাহলে তো ভালোই খাওয়া হবে আজকে।”
“হ্যাঁ,” বলে একটু থেমে আবার বলল নন্দিনী, “আজকে তোর শ্বশুড় বাড়ির লোকেরা এসেছিল।”
“তাই নাকি? কিন্তু হঠাৎ না জানিয়ে? কি বিষয়ে রে জানিস কিছু? আমি তো ও বাড়ি হয়েই আসলাম। সব তো ঠিকই লাগল। তাদের অবশ্য দেখিনি। বাহিরে গিয়েছে বলল।”
“হ্যাঁ, জানি। তোর আর ভাবীর ছোটো বোন মায়ার বিয়ের ব্যপারে কথা বলতে এসেছিল। বাবা-মার সাথে কথা বলল। তারা হ্যাঁ বলে দিয়েছে।”
কথাটা শুনে সোফা থেকে দাঁড়িয়ে পড়ল পাবেল। ওর কন্ঠ দিয়ে চিৎকারের মাধ্যমে শুধু একটাই কথা বের হলো, “এসব হচ্ছেটা কী!”
চলবে…..