#হৃদয়_পথে_এ_কার_ছায়া (পর্ব ২)
নুসরাত জাহান লিজা
মিফতা ঘুম ভেঙে দেখল সাড়ে দশটা বাজে। অথচ আজ মা তাকে খাবার জন্য ডাকেননি। মালা শুক্রবারেও ওকে সকাল আটটা থেকে ডাকতে শুরু করেন। সে আরেকটু সময় বিছানায় গড়াগড়ি করে নয়টার দিকে ওঠে। এরপর ধীরেসুস্থে খেয়ে দেয়ে আবার শুয়ে পড়ে। জুম্মার নামাজ শেষে সে কোনোদিন দুপুরে খেয়ে কোনোদিন না খেয়ে বেরিয়ে পড়ে। যেসব বন্ধুদের সাথে এখন আড্ডা দেয়া হয় না তাদের সাথে দেখা করতে যায়, কোনোদিন তারাও আসে। আজ যাবার কথা শাফির বাসায়।
হাত-মুখ ধুয়ে বেরিয়ে এসে মা’কে ডাকল মিফতা। মালা আসতেই সে বলল, “মা খাবার দাও। আজ ডাকোনি যে!”
“আজ তুই বিকেলে নওমীর সাথে দেখা করতে সময়মতো রেস্টুরেন্টে যাবি। ওকে অপেক্ষা করাবি না।”
“সে কোথাকার রাজকন্যা যে তার সাথে দেখা করতে গেলে ঘড়ি ধরে যাওয়া লাগবে! ওই মহারানীর সাথে দেখা করার জন্য আমি মরে যাচ্ছি না।”
“তুই যাবি না?”
“না।”
পাশ থেকে জামিল এসে বললেন, “দেখা না করতে গেলে তোর খাবার বন্ধ।”
পাশ থেকে চামেলি বলল, “খালাম্মা কইসে আইজকা হ্যার সাথে দ্যাহা করবার না গেলে আফনের কাপড়চোপড় আর না ধুইবার।”
এমনিতে অগোছালো হলেও জামাকাপড় সে ময়লা হলে পরতে পারে না। খাওয়া নাহয় বাইরে থেকে ম্যানেজ করা যাবে। লন্ড্রিতে প্রতিদিন কে দৌড়োবে! কখন কোন শার্ট-প্যান্ট পরা হবে এখনো মা সব রেডি করে রাখেন। মিফতা কেবল পরেই যায়। এমন হলে তো সর্বনাশ।
ভবিতব্য ওর জন্য এত কষ্ট জমিয়ে রাখবে জানলে আরামপ্রিয় স্বভাব একটু কমিয়ে টুকিটাকি কাজকর্ম শিখে রাখত। তাহলে আজ এমন হুমকি ধামকি দিয়ে কেউ কাজ বাগাতে পারত না।
ওই মেয়ে কি জাদু টোনা জানে নাকি! নিজের বাড়িতে বসে ওকে নাজেহাল করে যাচ্ছে। শরীর বন্ধ করার কোনো তাবিজ কবজ নেবে কিনা ভাবল মিফতা। নিজের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে ওর পৃথিবীটা বনবন করে ঘুরতে থাকল।
***
নওমীর হাতে বানানো দুধ চা নীরব ভীষণ পছন্দ করে। আজ শুক্রবার, সবাই বাসায়ই। তাই সকাল সকাল সে রান্নাঘরে এসে চা বানিয়ে নীরবের মগ ভর্তি করে নিয়ে তাদের ঘরে এলো। শায়না ভেতরে নেই। নীরব চেয়ারে গা এলিয়ে বসে টেবিলে কী যেন একটা করছিল।
নওমী এসে মগটা টেবিলে রেখে ডাকল, “ভাইয়া, তোর চা নে।”
নীরব ওর দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, “মেঘ না চাইতেই জল! তা আজ তোর এই উদারতার কারণ জানতে পারি?”
নওমী পৃথিবীর সব মিষ্টতা গলায় ঢেলে বলল, “তুই আমার একমাত্র ভাই। তোর পছন্দের একটা জিনিস আমি বানিয়ে দিতে পারব না?”
নীরব চায়ে আয়েস করে দু’টো চুমুক দিল, এরপর ওর দিকে তাকিয়ে বলল, “এটা তোর কোনো আবদার করার সময়-ই কেবল মনে পড়ে। তুই মহা উদার, তাই না?”
“তোর মাথা। কারোর ভালো করতে নেই।”
“ঢং না করে ঝেড়ে কাশ তো বোন, বাবাকে কী বলতে হবে?”
নওমীর মুখের হাসি এগাল ওগাল বিস্তৃত হলো। নিজের গূঢ় অভিলাষের কথাটা উৎসাহ নিয়ে শুরু করল,
“ওহ্ ভাইয়া, তুই বাবার সাথে কথা বলবি তাহলে, শোন…
ওকে থামিয়ে দিয়ে নীরব বলে উঠল, “আলবৎ বলব। তোর কোনো আবদার ফেলেছি আমি? বিয়ে ভাঙার কথা বাদ দিয়ে যা বলতে বলবি, বাবাকে সেটাই বলব।”
হাসি মিলিয়ে গেল নিমিষেই, নওমী আচমকা হ্যাঁচকা টানে নীরবের হাত থেকে মগটা নিয়ে নিল। এরপর চিৎকার করে বলল, “তোকে চা খেতে হবে না। বিনা শ্রমে আমার কাছ থেকে কেউই পারিশ্রমিক নিয়ে যেতে পারবে না। আমি হাতেম তাঈ নই।”
ঘুরে কয়েক কদম এগিয়ে আবারও ঘুরে তাকিয়ে নওমী বলল, “তোর মতো ভাই থাকলে কারোর শত্রুর দরকার হবে না।”
নীরবের কয়েক মুহূর্ত সময় লাগল বুঝতে আদতে ঘটনাটা কী ঘটল। যতক্ষণে বুঝতে পারল, ততক্ষণে নওমী দরজার কাছে চলে গেছে।
“তুই কী করিস? ভুলে গেলি? কথাটা আমিও বলতে পারি কিন্তু!” বলে অবশ্য লাভ কিছু হলো না, কারণ নওমী ততক্ষণে প্রস্থান করেছে।
শায়না সশব্দে হেসে ফেলল। বারান্দায় ছিল সে। ঘরে এসে ভাই-বোনের কীর্তিকলাপ দেখে বড্ড হাসি পেয়ে গেল তার। এরা পারেও।
“তুমি হাসছ?”
“হাসব না? উফ, নওমীটা না পারেও…”
একটু হাসি থামিয়ে আবারও বলল, “আচ্ছা, নওমী তো বড় হয়েছে। মাস্টার্স ভর্তি হবে। ওর মতামতটাকে ফেলে দিচ্ছ কেন তোমরা?”
“কারণ ওর জেদ আর রাগ অনেক বেশি। ইগোকে প্রাধান্য দেয় বলে ভালো-মন্দ ওর সবসময় চোখে পড়ে না৷ একরোখা সে। কিন্তু আমি মিফতাকে চিনি। ভার্সিটিতে আমার ডিপার্টমেন্টেই দুই ব্যাচ জুনিয়র ছিল। সেও খানিকটা ঘাড়ত্যাড়া গোছের, তবে ছেলে হিসেবে দারুণ।”
“ঘাড়ত্যাড়া মানে? এটা জেনেও..”
“আমার বোনের থেকে বেশি নয় অবশ্য।” হেসে বলল নীরব।
“এতে ওর ভালোই হবে। বাবা, আমি ওর খারাপ চাই না বুঝলে!”
শায়না এই টম এন্ড জেরি’র কেমিস্ট্রির আড়ালে ভাই-বোনের পরস্পরের প্রতি নিখাঁদ ভালোবাসাটুকু সবসময় দেখতে পারে, উপলব্ধি করতে পারে।
***
নওমী এসেছে ওই ছেলেটাকে পটিয়ে পাটিয়ে বিয়েটা যদি ভেস্তে দেয়া যায় সেজন্য। ও বিনাবাক্য ব্যায়ে এখানে এসেছে আজ। তবে ওই ছেলে শুধু যে ভয়ংকর অপরিষ্কার তাই নয়, সময়-জ্ঞান টাও তার মধ্যে অনুপস্থিত দেখা যাচ্ছে। সে কিন্তু একেবারে ঘড়ির কাঁটা ধরে এসেছে।
মিফতার চাচা জহির আঙ্কেল ওর নওমীর বাবার সবচাইতে কাছের বন্ধু। ভাবল তাকে কল করে বলে চলে যাবে কিনা। তখনই হেলেদুলে মিফতাকে এদিকে আসতে দেখল। মোবাইলে সময় দেখল ১৩ মিনিট পরে এসেছে।
ওর টেবিলে এসে উল্টো দিকের চেয়ারে আয়েসি ভঙ্গিতে বসল মিফতা। এরপর একগাল হেসে প্রশ্ন করল, “ভালো আছেন?”
“আপনি লেইট। একটা মেয়ে আপনার জন্য অপেক্ষা করছে বিষয়টা মাথায় রাখা উচিত ছিল।”
“কোথায় লেট। পাঁচ মিনিট কোনো সময়?”
“পাঁচ নয় তেরো মিনিট। তাছাড়া আমার জন্য পাঁচটা সেকেন্ডও ইম্পর্ট্যান্ট।”
“কেন? আপনার কীসের এত রাজকার্য ফেলে এসেছেন?”
“আপনার মতো লোকের সাথে কথা বলাই বৃথা। ধূর।”
মিফতা হাসিকে বিস্তৃত করে বলল, “ভুলে গিয়েছিলাম, আপনি স্বয়ং একটা ভ্রাম্যমাণ জ্ঞানভাণ্ডার। এই অধমের সেই অপরাধ নিজগুণে ক্ষমা করবেন।”
নওমী ক্রদ্ধ তবুও ধীর গলায় বলল, “ফাজলামো করছেন?”
“ছিঃ ছিঃ, আপনি হচ্ছেন মহারানী এলিজাবেথের ভূত। আপনার সাথে ফাজলামো করার মতো ধৃষ্টতা কি আমার মতো সামান্য মানুষের আছে। পরে দেখা গেল আমার গর্দান যাবে।”
বিরক্তিতে কপালের ভাঁজ গাঢ় হলো নওমীর। এই ব্যাটা কথায় কথায় বাজে তর্ক জুড়ছে, যা ওর সহ্য হচ্ছে না। সে রেগে গেলে পাশের জনও উল্টো খোঁচাবে এটা সে মেনে নিতে পারছে না।
“আপনার গর্দান নিতে পারলেই শান্তি পেতাম।”
মিফতা বলল, “তাহলে আমাকে বিয়ে করতে চাইছেন কেন?”
নওমী জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে বলল, “আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাইছি? আপনি কোথাকার কোন হনু এসেছেন?”
মিফতা আবারও গায়ে জ্বালা ধরানো হাসি হেসে বলল, “ভাব ধরছেন ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানেন না, অথচ, ওদিকে যে মাছ কাঁটাসহ চিবিয়ে ঝাঝড়া করে খেয়ে হজম করেছেন, সেটা বুঝি না ভেবেছেন?”
নওমী গলার স্বর প্রাণপণে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চেষ্টা করে বলল, “আমি ভাজা মাছ খাব নাকি সিদ্ধ করে খাব নাকি কাঁচা খাব, সেটা উল্টে খাব নাকি সিধে করে খাব সেটা নিয়ে আপনার এত মাথাব্যথা কেন? হু আর ইউ? আপনি আমার কে?”
“আপনার কিছু হতে চাইছে টা কে?”
“কিছু হতে চান না, তাহলে বিয়ে করতে নাচতে নাচতে চলে এসেছেন কেন?
“কারণ আমি খুব ভালো নাচতে পারি তো। প্রতিভা লুকিয়ে রেখে কী করব? তাই নাচতে নাচতে আপনাকে আমার ট্যালেন্ট দেখাতে এসে পড়লাম। খুশি?”
“হ্যাঁ খুশিতে দেখেন আমার দুইটা পাখা গজিয়েছে, আমি উড়ছি আকাশে।” গলা এবারে চড়েছে নওমীর। ওই ম্যানারলেস ছেলের সাথে কথা বলার ফল। সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে।
গর্বিত ভঙ্গিতে মিফতা বলল, “এটাও আমার ট্যালেন্ট বুঝলেন। আমার জন্যই বিনা এয়ার টিকিটে আপনার আকাশ ভ্রমণ হয়ে গেল।”
“হ্যাঁ সে তো বুঝলামই। আপনি ট্যালেন্টের ডেঁপো। কত কত ট্যালেন্ট। আচ্ছা ট্যালেন্ট বানান করেন তো?” দাঁতে দাঁত চেপে বলল নওমী।
“টি এ… এক মিনিট এক মিনিট.. আমি কেন বানান করতে যাব? আমি কী ভাইভা বোর্ডে এসেছি নাকি? আপনি কি এক্সামিনার?”
“না, কিন্তু আপনিই না মাত্র বললেন, ট্যালেন্ট দেখাতে চলে এসেছেন। তাই একটু বাজিয়ে দেখছিলাম আর কীসে কীসে ট্যালেন্ট আছে আপনার।”
একটু থেমে মিফতাকে একবার ভালো মতো পর্যবেক্ষণ করে আবারও মুখ খুলল নওমী, “কিন্তু আপনি আমাকে বড্ড হতাশ করলেন। পায়ে পারা দিয়ে ঝগড়া করা আর কিছু নোংরা অভ্যাস ছাড়া আপনার মধ্যে আর কিচ্ছু নেই।”
মিফতার হাসি মিলিয়ে গেছে। এমন ঘোরতর অপমান কাহাতক সহ্য করা যায়। সে বলল,
“আপনি কি জানেন যে আপনি একটা উন্মাদ। শুধু আপনি কেন, আমার চারপাশে পাগলের ছড়াছড়ি। আমি বাদে প্রত্যেকেই উন্মাদ।”
নওমী এবার শান্ত গলায় বলল, “আপনাকে এর এক্সপ্লেনেশন আমি দিতে পারি। দেব?”
“আপনি তো ভ্রাম্যমাণ জ্ঞান ভাণ্ডার। জায়গায় জায়গায় সেটা বিতরণ না করলে তো আপনার চলে না। বলেন, শুনি।”
“প্রত্যেকেই অন্যকে নিজের মতো মনে করে। তাই আপনার মনে হচ্ছে আপনি সুস্থ বাকি সকলেই পাগল। আসলে হবে উল্টো। বুঝলেন? একসাথে সবাই তো আর পাগল হতে পারে না। উল্টোটাই বরং সহজ।”
“আপনি একটা অভদ্র মেয়ে। এসব বলে পাগলদের পর্যন্ত আপনি অপমান করছেন। পাগলরাও মানুষ। তাদের অপমান করার রাইট আপনার নেই।”
“শুরুটা কে করেছে? আপনি নিজেই প্রথম পাগল আর উন্মাদ এই দুইটা ওয়ার্ড ইউজ করেছেন। তাই একটু ভেবেচিন্তে। অবশ্য ভাবনা চিন্তার জন্য মাথায় কিছু বুদ্ধিসুদ্ধি থাকতে হয়। সেটা আপনার নেই।”
“তা থাকবে কেন? সব বুদ্ধিশুদ্ধি কেবল আপনার মাথায় আছে। মাথায় না আটলে বাড়িতে একটা কোল্ড স্টোরেজের ব্যবস্থা করে তাতে জমা করবেন। কয়দিন পরে পাইকারি দরে বুদ্ধি বিক্রি করে কোটিপতি হয়ে যাবেন।”
“ঠিক আছে। আপনাকে ফ্রি-তে এক কেজি দেব কিনা ভাবছি। আচ্ছা, বুদ্ধি কেজিতে বিক্রি করা যায় নাকি অন্যকোনো একক আছে?”
“আমি কী করে জানব?”
“না জেনেই একটা বিজনেস আইডিয়া দিয়ে দিলেন কেন?”
এই কথার লড়াই আর কতক্ষণ চলত কেউ জানে না। কিন্তু একসময় খেয়াল করল আশেপাশের লোকজন একরাশ বিরক্তি নিয়ে ওদের দিকে তাকাচ্ছে, কেউ আবার মজা নিতে। তাই আজকের মতো সাঙ্গ করে উঠতেই হলো। পরস্পরের প্রতি বিতৃষ্ণার ঝুলি ততক্ষণে পূর্ণ হয়েছে।
……..
(ক্রমশ)
(এই গল্পে ব্যবহৃত যাবতীয় কথাবার্তা কেবল চরিত্রগুলোকে উপস্থাপনার স্বার্থে লেখা। কারো মনে কষ্ট দেবার জন্য নয়।)
বেশি বাড়াবাড়ি হচ্ছে নাকি? দুটো ছুটির দিন পেয়ে টানা দিতে পারলাম। অন্যকোনো ব্যস্ততাও এই সপ্তাহে ছিল না। এরপর থেকে একদিন পরপর আসবে ইনশাআল্লাহ। #অতঃপর_তাহারা পড়তে পারেন বইটই’তে।