হৃদয়_পথে_এ_কার_ছায়া (পর্ব ১০.২)

0
345

#হৃদয়_পথে_এ_কার_ছায়া (পর্ব ১০.২)
নুসরাত জাহান লিজা

শুয়ে শুয়ে একটা উপন্যাসে চোখ রাখছিল নওমী। তবে কেবল পাতা উল্টানোই সার, কিছু পড়া আর হচ্ছিল না। এত চমৎকার একটা বই অথচ কেমন পানসে লাগছিল। মাঝেমধ্যে অকারণ মন খারাপের একটা ছায়া অবচেতনেই পরশ বুলিয়ে যায়, তেমনই এক অকারণ বিষণ্ণতার সুর ওকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে সারাটাদিন ধরে।

এমনই এক ঘোর অবচেতনে নওমীর মনে হলো, মিফতার সাথে থাকলে রাগ হয়, জেদ চাপে, কিন্তু সময়টা ব্যস্ততায় কাটে। অন্তত পানসে হবার সম্ভাবণা ঘুণাক্ষরেও নেই। ঝগড়া করতে করতে সময় কোন দিকে কতটা গড়িয়ে যায় বোঝার উপায় থাকে না।

পরক্ষণেই সে চৈতন্যে ফিরল, কী ছাতা মাথা ঘোড়ার ডিম খেয়াল আঁকিবুঁকি করে যায় মনের সাদা শূন্য ক্যানভাসে, যে নিজের উপরেই বিরক্ত লাগে। ধূর ছাই!

এরমধ্যেই মা এসে ডেকে বললেন, “একবার আমাদের ঘরে আয়, তোর বাবা ডাকছে।”

নওমী একরাশ আলস্য ভেঙে বিছানা ছাড়ল। এরপর চলল বাবার সাথে কথা বলতে। এই একটা মানুষকে সে ভয় পায়, সমীহ করে। ওর এভাবে ডাক পড়ার কারণ সম্পর্কেও সে অবগত। ভয় পেলেও নওমী ঠিক করেছে নিজের অপছন্দের বিষয়টা খোলাখুলি বাবাকেই জানাবে।

মাহমুদ সাহেব অত্যন্ত রাশভারি গোছের মানুষ। কথা বলেন খুব কম, হাসেনও অল্প। তবে যা বলেন তা কার্যকর হয়। নওমী মনে করতে পারে না, কবে ওর সাথে তিনি গলা উঁচিয়ে কথা বলেছেন। তবে ভারিক্কি চালে শীতল গলায় বলা কথা অগ্রাহ্য করার মতো সাহস ওর কখনো হয়নি।

বাবাকে অবশ্য নওমী ভীষণ ভালোবাসে। তাকে এভাবে দেখতে দেখতে ওর একটা বদ্ধমূল ধারণা হয়েছে ব্যক্তিত্ব মানে কেবলই এমন গাম্ভীর্য। এর অন্যথা হলেই মানুষ যেন ব্যক্তিত্বহীন কিংবা ছ্যাবলা ধরনের কিছু একটা। মনে মনে বাবাকে নিয়ে সে গর্ববোধ করে।

নওমী কোথাও একটা শুনেছিল যে মেয়েরা তার বাবাকেই আদর্শ হিসেবে ধরে নেয়, জীবন সঙ্গী হিসেবে তেমন ব্যক্তিত্বের কাউকেই নাকি কল্পনা করে অবচেতনে। কথাটার সত্যতা সম্পর্কে সে সন্দিহান হলেও ফেলে দিতে পারে না।

নওমী এসে দেখল বাবা বারান্দায় চেয়ারে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন।

“নওমী, এসো মা। এখানে বসো। কথা আছে।” তার পাশের চেয়ারে বসতে ইঙ্গিত করে বললেন মাহমুদ।

নওমী গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে এসে বসল। বাবা ওদের দুই ভাইবোনকেই ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করেন।

“বলো বাবা।”

তিনি লম্বা চুমুকে চা শেষ করে ছোট্ট টি-টেবিলে এসট্রের পাশে কাপটা রেখে নওমীর দিকে তাকিয়ে বললেন, “দেখো মা, তুমি বড় হয়েছ। স্বাভাবিকভাবেই এখন তোমার বিয়ের কথাবার্তা চলছে। সব মানুষই চায় তার সন্তানকে যার হাতে সঁপে দেবে সে যেন সৎ হয়। সততার চাইতে বড় গুণ আর নেই। এটা তো স্বীকার করো?”

“জ্বি বাবা।”

“মিফতার মধ্যে আমি সততা দেখেছি। দেখো, জগতের প্রত্যেকটা মানুষই কিন্তু দোষে গুণের সমন্বয়ে তৈরি। হয়তো কিছু কারণে মিফতাকে তোমার পছন্দ হয়নি। সব মানুষের মধ্যেই ত্রুটি রয়েছে। আবেগ যেহেতু আছে, ভুল তো হয়েই যায়, তাই না? তোমার ওকে কেন পছন্দ নয় বলো তো?”

নওমী এবার খানিকটা নড়েচড়ে বসল। মনে হচ্ছে বাবা ওর কথা ধর্তব্যে নিতে চাইছেন। সে নিজের কথাগুলো মনে মনে গুছিয়ে নিয়ে বলল,

“তুমি নিশ্চয়ই আমার ভালো ভেবেই সিদ্ধান্ত নিয়েছ। কিন্তু আমি যার সাথে সারাজীবন থাকব তার সাথে আমার মেন্টালিটি যদি আকাশ-পাতাল ফারাক হয়, তবে একসাথে থাকা সম্ভব?”

“শুধু এটাই কারণ?”

নওমী নাক খোঁটার কথা কিংবা অন্যান্য ত্রুটির কথা বলতে পারল না। তবে বলল, “আরও কিছু কারণ আছে। মা, ভাইয়া আর ভাবিকে বলেছি।”

“ওদের সাথে আমার কথা হয়েছে। তুমি আরও একটু ভাবো। এরপর আমাকে জানাও। হাজার হোক, তুমি সারাজীবন সংসার করবে। তোমার মতামত এখানে সবচাইতে জরুরি। মিফতার সাথে আরেকবার দেখা করো, আরেকটু কথা বলে দেখো। এরপর তুমি যে সিদ্ধান্ত নেবে, সেটাই হবে।”

আলোচনা সেখানেই শেষ হলো। তার আগে বাবা জানিয়েছেন, “পরশু ওরা সবাই বাসায় আসবে।”

নওমী রাতে বিছানায় এপাশ-ওপাশ করতে করতে পরশু বাবাকে কী বলবে তা গুছিয়ে নিল। আরও একটা মিটিং নিশ্চয়ই ওর সিদ্ধান্তে পরিবর্তন আনবে না!
……..
(ক্রমশ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here