হৃদয়_পথে_এ_কার_ছায়া (পর্ব ৫)

0
369

#হৃদয়_পথে_এ_কার_ছায়া (পর্ব ৫)
নুসরাত জাহান লিজা

শায়না একটু কনফিউজড ধরনের মেয়ে৷ বিশেষ করে কেনাকাটা করতে গেলে কাপড় বাছাই করতে গিয়ে ধন্দে পড়ে যায়। সেজন্য ওর শাড়ি, সালোয়ার কামিজ থেকে শুরু করে সবকিছু নীরব পছন্দ করে দেয়। এক্ষেত্রে নীরবকে রীতিমতো ভরসা করা যায়, ওর পছন্দ করার সক্ষমতা দারুণ।

শায়নার বন্ধুরা তো সবসময় বলে, ওর বর ভাগ্য নাকি ঈর্ষণীয়। যে হাজব্যান্ড বউয়ের জন্য নিজে ঘুরে ঘুরে শপিং করে, কোনোরকম উচ্চবাচ্য ছাড়া, সে নিঃসন্দেহে মহান মানুষ। তাদের হাজব্যান্ডরা সপ্তাহান্তে ঘুরতে নিয়ে যায়, ভালোবাসাতেও কমতি রাখে না। কিন্তু শপিং করার বেলায় তাদের দৌড় নাকি টাকা দেয়া পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। কেউ কেউ সাথে গেলেও ঝক্কি না পোহানোর জন্য নানা টালবাহানার আশ্রয় নেয়।

এসব কথা বাতাসে ভেসে নীরবের কানেও আসে। প্রশংসা পেয়ে মনে মনে বিগলিতও হয়। মা আর নওমীর জন্যও কিনতে হলে নিজে নিজেই কেনে সে মাঝেমধ্যে। নওমীকে এই জন্মদিনের উপহার হিসেবে বেশ ঘুরেফিরে একটা সালোয়ার-কামিজ কিনে দিয়েছিল৷ তাই রংটা স্পষ্ট মনে আছে।

আজ রেস্টুরেন্টে বসার পর ঘাড় ফিরিয়ে ওয়েটারের খোঁজ করছিল। তখন একটা মেয়েকে সেই একই রঙের ড্রেস পরে বেরিয়ে যেতে দেখল। একই ড্রেস নাহয় আরও অনেকের থাকল, কিন্তু মেয়েটার শারীরিক গড়নও নওমীর মতোই। দ্বিধা-দ্বন্দের যেটুকু বাকি ছিল, পাশের ছেলেটাকে দেখতেই তা নিমিষেই উবে গেল। মিফতার সাথে নওমী রেস্টুরেন্টে কী করে! যতদূর জানে, আজ এই দুটো প্রাণীর একসাথে দেখা হবার মতো কোনো কারণ নেই।

সে তবুও নিশ্চিত হবার জন্য শায়নাকে কল করে জিজ্ঞেস করল, “নওমী কই?”

“ইরাদের বাসায় গেছে। কেন?”

“আচ্ছা, কোন ড্রেস পরেছে জানো?”

“কেন বলোতো?”

“বাসায় এসে বলব। তুমি ওর..”

“ওই যে বেগুনি রঙের সালোয়ার কামিজ, যেটা ওর জন্মদিনে কিনলে, ওইটা। কী হইসে বলো না!”

আবারও বাসায় এসে বলবে জানিয়ে মোবাইল নামিয়ে ফেসবুকে লগ-ইন করল। বিয়ে করবে না, করবে না করছে। আবার একসাথে বাইরে দেখা করছে, তাও আবার বাসায় মিথ্যে কথা বলে। এর একটাই অর্থ দাঁড়ায়। বোন বিয়ে ভাঙার জন্য তার কৌশল খাটাচ্ছে।

কিন্তু মিফতা? ওর তো নওমীর সাথে জোট বাঁধার বিন্দুমাত্র কারণ নেই। একজন প্রত্যাখ্যাত যুবকের কোনোদিনও সেই মেয়ের সাথেই কোনো অভিসন্ধিতে যোগ দেবার কারণ নেই। নাকি সবার চোখে ধূলো দিয়ে ডুবে ডুবে জল খাচ্ছে দুটোতে! বিষয়টা খতিয়ে দেখতে হবে, ভাবল নীরব।

নওমী যাতে অস্বীকার না করতে পারে, সেজন্য প্রমাণ স্বরূপ সে ইরাকে কল করল। গতবছর ট্যুরে গিয়েছিল নওমীরা। তখন ইরার নম্বরটা সে নিয়েছিল। যাতে বোনের ফোন কোনো কারণে বন্ধ হয়ে গেলে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন না হয়।

***
নওমী বাসায় ফিরল মাথায় জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি নিয়ে। আজ ওই ব্যাটার সাথে বাইরে যাওয়াই ঠিক হয়নি। বলে কি-না বাটি হাতে ঘুরতে হবে।

নওমী প্রত্যুত্তরে বলেছে, “এক যাত্রায় পৃথক ফল কী করে হয় বলুন! চিন্তা করবেন না, তখন না-হয় আপনার হাতেও একটা বাটি ধরিয়ে দেয়া যাবে।”

তবে এটা মোক্ষম জবাব মনে হচ্ছে না। কড়া ভাষায় কথা না শোনালে ওই হতচ্ছাড়া ব্যাটা সোজা হবে না। ইচ্ছে তো করছিল রড দিয়ে ব্যাটার হাতে পায়ের গিঁটে গিঁটে কয়েকটা দিতে।

বাসায় ঢুকতে না ঢুকতেই আরেক আপদ এসে হাজির। নীরবের হাসির ধরনেই সব বোধগম্য হলো ওর। একটু আগে ইরা কল করে জানিয়েছে,

“নীরব ভাইয়া কল করসিলো একটু আগে। আমি বললাম তুই ওয়াশরুমে। উনি বললেন, ‘আমি বাসার সামনে অপেক্ষা করতেসি। ওরে পাঠায়ে দিও আপু।’ আমি তখন বলসি তুই আমার বাসায় আসিস নাই। স্যরি রে।”

তখন থেকে ওর মেজাজ সপ্তমে চড়ে আছে৷

“তুই ইরার বাসায় কি মিফতারে সাথে নিয়ে গেছিলি?”

“তুই আমার উপরে স্পা -য়িং করার চেষ্টা করতেছিস ক্যান?”

“কারণ সত্য কথা বলা শুরু করছিস তো, সেজন্য।”

“তুই তো মহা সত্যবাদী, তাই না?”

“কাহিনী কী হইসে বল তো?”

নওমী কটমট করে তাকিয়ে বলল, “আমার ঠ্যাকা পড়ে নাই। গোয়েন্দাগিরি করে বাইর কর, যা। এখন বিরক্ত করিস না।”

“আমি মাত্রই আসলাম, তুইও তাই, রেস্ট নে। পরে বসি আমরা।”

নওমী আর উত্তর দিল না, মাথা ব্যথা করছিল। রুমে ঢুকবে সেই মুহূর্তে মা এসে জিজ্ঞেস করলেন, “হ্যাঁ রে, তুই নাকি আজ মিফতার সাথে দেখা করতে গেসিলি? আজকে কেমন মনে হইল?”

“সেদিন আতা ফল গাছ মনে হইসিলো, আজ বেল গাছ মনে হইসে। কাঁটা আর কাঁটা। খুশি?”

মা আরও কথা বলতে যাচ্ছিলেন বুঝতে পেরে দায়সারা উত্তর দিয়ে ভেতরে যেতে যেতে শুনল তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “এভাবে বলিস কেন? আর তোর পায়ে এরকম ময়লা লেগে আছে কেন?”

“সিটি কর্পোরেশন আমার জন্য সোনা রূপা মুড়ায়ে রাস্তা বানাইয়ে দিসে, স্পেশাল রোড ফর মি। আমি তো ওইরকম রাস্তায় চলে অভ্যস্ত না, তাই বলসিলাম ধূলাবালি লাগবে। ওরা সুন্দর করে সেটা এনে রাস্তায় বিছায়ে দিসে। আমি সেই ধুলোয় পা রেখে হেঁটেছি। তাই ময়লা লাগল।”

কথা শেষ করে বাবার গলার আভাস পেয়ে বাথরুমে ঢুকে পড়ল। পা দুটো আগে আচ্ছা মতো ধুতে হবে। না জানি কত জীবাণু পায়ে গিজগিজ করছে। নিজেকে কেমন অশূচি মনে হচ্ছে।

***
মিফতা বাসায় ফিরেই বিছানায় গা এলিয়ে দিল। মালা এসে বললেন, “বাইরে থেকে এসে হাতমুখ ধোয়ার কথা তোকে বলে দিতে হবে?”

“একটু পরে। অনেক টায়ার্ড মা।”

“তাই বলে ভর সন্ধ্যায় শুয়ে থাকবি? ওঠ!”

বলতে বলতেই মাগরিবের আযান ভেসে এলো। এবার মিফতাকে উঠতেই হলো। নামাজ শেষ হতেই ওর বন্ধু রেদোয়ান কল দিল।

“কী রে, সেরা প্রেমিক, আমি তোর বন্ধু হয়ে এতদিন জানলাম না। আমারে জানতে হইল ফেসবুক থেকে!”

“কী কছ এগুলা! বুঝি নাই কিচ্ছু।”

“ডুইবা ডুইবা ম্যালা মানুষ জল খায়। তুই তো এক্কেবারে মারিয়ানা ট্রেঞ্চের তল ছুঁয়ে ফেললি দোস্ত। কদ্দিন চলে এইসব?”

“তোর মাথা খারাপ হইসে নাকি! ক্লিয়ার করে বল।”

“তুই একটু এফবিতে যা। তোর গার্লফ্রেন্ডের সাথে তোর ছবি ভাইরাল।”

মিফতা এবার হকচকিয়ে গেল, একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলল, “শালা, আমি গার্লফ্রেন্ড কই পাব? গার্লফ্রেন্ড-ই নাই। আবার তার সাথে ছবি। তোর মাথা গেছে।”

“আমার মাথা গেছে না তুমি শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করতেসো, তুমিই ভালো জানো মামা। যাও একটু দেইখে আসো।”

মিফতা রেদোয়ানের কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারেনি। সবসময় এভাবে ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে একটা অতি সাধারণ কথাও সাসপেন্স ক্রিয়েট না করে বলতে পারে না সে। তবে ওর কথা একেবারে উড়িয়ে না দিয়ে মিফতা ভাবল একবার ফেসবুকে গিয়ে যাচাই করেই দেখা যাক কাহিনী কী!

ফেসবুকে লগ-ইন করতেই ওর ত্রিশ বছরের জীবনের সবচাইতে বড় সারপ্রাইজটা পেল। নোটিফিকেশনের বন্যায় ওর কম ফলোয়ার যুক্ত আইডি ভেসে যাচ্ছে। ‘ট্রু লাভ’ নামের পেইজ থেকে আপলোড করা একটা পোস্ট দেখে ওর চোখ চড়কগাছ। সেই সাথে মনে মনে প্রমাদ গুনল মিফতা।

অনেকে বন্ধুরা সেটা শেয়ার করে ওকে ট্যাগ করেছে, ক্যাপশনে কেউ লিখছে, ‘অভিনন্দন বন্ধু।”

কেউ লিখেছে, “আমাদের ব্যাচ, সাথে লাভ ইমোজি।”

“আমাদের প্রেমিক পুরুষ।”

এরকম নানামুখী ক্যাপশন। মূল পোস্টের ক্যাপশন পড়ার সুযোগ পেল অনেক পরে। সেটা মাত্র দুই ঘণ্টায় শেয়ার হয়েছে সাড়ে তিন হাজার!

নওমী আর মিফতা দু’জন জুতা হাতে নিয়ে পাশাপাশি হাঁটছে, ছবিতে নওমীর মুখে চাপা অভিমানের সাথে কিঞ্চিৎ রাগান্বিত ভাব। মিফতার মুখে দিগ্বিজয়ী হাসি। যেন হাসিতেই অভিমানী প্রেয়সীর মান ভাঙানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। যদিও আসল কাহিনীটা মিফতা আর নওমী বাদে কেউই জানে না। ছবিটা কয়েক হাত দূর থেকে তোলা হলেও বেশ স্পষ্ট।

ক্যাপশন আরও মারাত্মক। যে পোস্ট করেছে, সে তার ক্রিয়েটিভিটির সর্বোচ্চ প্রয়োগ ঘটিয়েছে। একটা কাঠখোট্টা সম্পর্কতে প্রেমের ফুল ফুটিয়ে ছেড়েছে। লিখেছে,

“প্রেয়সীর জুতো ছিঁড়ে গেছে, তার দুঃখ কমাতেই নিজের জুতো হাতে তুলে নিল এক প্রেমিক। অভিমানীনীর অভিমান ভাঙাবার আপ্রাণ চেষ্টায় একজন সত্যিকারের প্রেমিক পুরুষ। তাদের এই শুদ্ধ ভালোবাসা অক্ষয় হোক। এমন আরও ট্রু লাভের সন্ধান পেতে ফলো করুন আমাদের এই পেইজটি।”

কমেন্ট বক্সে অনেক মেয়েরা ছেলেদেরকে ম্যানশন করেছে। অনেকে লিখেছে, ‘এমন প্রেমিক কই পাওয়া যায়? আমাদের কপালেও জুটুক।’

আবার অল্পসংখ্যক মানুষ লিখেছে, ‘এগুলো ফটোশ্যুট করেছে। সত্যি সত্যি এমন কেউ করে না-কি!’

কিছু কমেন্ট পড়তে পড়তে আরেকবার রিফ্রেশ করে দেখল, শেয়ার সংখ্যা পাঁচ হাজার, লাইক আঠারো হাজার। মুহূর্তে মুহূর্তে বাড়ছে।

জগত বিস্মৃত হয়ে যখন এই পোস্টে মিফতা ডুবে ছিল, তখন ওকে বাস্তবতায় আঁছড়ে ফেলল, ওর হাতে ধরা মুঠোফোনের রিংটোন। কলার আইডি দেখে পিলে চমকে গেল। নিমিষেই গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল।

নওমী নির্ঘাৎ এটা দেখেই কল করেছে। এই সাংঘাতিক মেয়েটা আজ মিফতার মাথাটাকে বেলের মতো করে ফাটাবে নাকি ধর থেকে মু ণ্ডু বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে কে জানে!

যাই হোক, ওর আজ রক্ষা নেই! একটা হ্যালমেট দরকার মনে হচ্ছে। সাথে একটা রোবোকপের শিল্ড। নিজেকে রক্ষা করার জন্য এটার বিকল্প কী থাকতে পারে!
…….
(ক্রমশ)
কেমন লাগছে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here