হৃদয়_পথে_এ_কার_ছায়া (পর্ব ৯)

0
365

#হৃদয়_পথে_এ_কার_ছায়া (পর্ব ৯)
নুসরাত জাহান লিজা

নওমী ডান হাতে বাতাসে এলোমেলো নিজের অবাধ্য চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিতে দিতে বলল,

“আপনি কি আমার সাথে আছেন? নাকি আপনার মধ্যে ঘাপলা আছে?”

মিফতা থতমত খেয়ে গেল, এই মেয়ে মাইন্ড রিড করতে জানে নাকি! পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে পাশের বেঞ্চিতে হেলান দিয়ে বসে দুই হাত ছড়িয়ে দিল দু’দিকে। আয়েশী ভঙ্গিতে বসতে বসতে মনে মনে নিজেকে শাসিয়ে নিল,

“এই ধুরন্ধর মেয়ে তোকে বাজিয়ে দেখতে চাইছে মিফতা। একটু রয়েসয়ে বুঝেশুনে কথা বলতে হবে কিন্তু।”

এরপর নওমীর দিকে তাকিয়ে মিফতা বলল, “কীসের ঘাপলা বুঝলাম না!”

“এই যে উপরে উপরে ভাব ধরছেন, আপনি বিয়ে করতে রাজি নন। কিন্তু মনে মনে ঠিকই কবুল বলার জন্য এক পা বাড়িয়ে রেখেছেন?”

নওমীর অন্তর্ভেদী দৃষ্টির সামনে নার্ভ ধরে রাখা মিফতার জন্য ভীষণ কঠিন হয়ে দাঁড়াল। তবুও সামলে নিতে পারল।

“এত সহজ না, হুহ হু। মিফতা টোপ গেলে না। ছিপ ফেলতে থাকো, লাভ নাই।” নিজেকে চাঙ্গা করতে মনে মনে আবারও কথাগুলো আওড়াল সে। এরপর বলল,

“আপনার এই অহেতুক সন্দেহের কারণ কী?”

মিফতার ছড়িয়ে রাখা বাম হাত যে পর্যন্ত ঠেকেছে, তার থেকেও খানিকটা দূরত্ব রেখে বেঞ্চিতে বসে নওমী বলল,

“আপনাকে কতটা বিশ্বাস করা যায় ভাবছি।”

“তাহলে আমি চললাম। শুধু শুধু ডেকে আনসেন কেন? তার চাইতে দুইজন কবুল বলে ফেলি। তারপর একসাথে সংসার করি।”

নওমী এবার বলল, “এমন ওভাররিয়্যাক্ট করার দরকার কী? আমদের দুইজনেরই যেহেতু একটাই প্রবলেম, আমদেরই ডিসকাশনের মাধ্যমে এটা সলভ করা লাগবে।”

মিফতা দম ফাটানো হাসিটুকু সন্তর্পণে গোপন করল। এরপর আরেকবার আয়েশ করে হেলান দিয়ে আগের মতো হাত ছড়িয়ে দিল। পায়ের উপর আরেক পা দিয়ে সেটা সামনে বাড়ানো ছিল। এবার পা দুটো তুলে দিল সামনের গাছের সাথে। হাই তুলে বলল, “বলুন দেখি এবার।”

“বলব, তার আগে আপনি সোজা হয়ে ভদ্রভাবে বসুন।”

“কেন? এখানে অভদ্রের মতো কী দেখলেন?”

“এই যে একটা মেয়ে আপনার পাশে বসে আছে, আর আপনি হাত পা ছড়িয়ে এভাবে বসে আছেন। লজ্জা লাগতেসে না?”

“আশ্চর্য, লজ্জার কী হইল তাই তো বুঝলাম না। আমি যথেষ্ট শালীনভাবে বসে আছি। পোশাক পরিচ্ছদ ঠিকঠাক আছে।”

“আপনার সাথে এসব কথা বলাই বৃথা। সবকিছুর একটা ম্যানারিজম আছে। কখন, কোথায়, কীভাবে বসতে হয়, তারও একটা ম্যানারিজম আছে। এত বড় দামড়া হইসেন, এইসব শেখেন নাই?”

“একটা কাজ কইরেন, ম্যানারিজম বিষয়ক শিশু শিক্ষা ধরনের কোনো বই থাকলে আমারে গিফট কইরেন। না থাকলে আপনি নিজে লিখবেন একটা এ-ফোর সাইজ কাগজে। ঝামেলা শেষ।”

নওমীর পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য এখন সবচাইতে বেশি প্রয়োজন মিফতার সাহায্য। তবে এই ঘাড়ত্যাড়া গবেট রাজি হবে কিনা যথেষ্ট সন্দেহ আছে। একবার রাজি করাতে পারলেই কেল্লাফতে।

“ঠিক আছে। আমাকে কাগজ কিনে দিয়েন।”

“আপনি এত কৃপণ?”

“না, মিতব্যয়ী। অপাত্রে দান করা পছন্দ করি না।”

নওমীর কথায় স্মিত হেসে মিফতা বলল, “আপনার ম্যানারের লেসন দেয়া শেষ হলে কাজের কথা বলতে পারেন।”

নওমী খানিকটা ইতস্তত করছিল, এরপর বলল, “দেখুন, সমস্যায় যেহেতু আমরা পড়েই গেছি। আপনি সেদিন বলছিলেন, বিয়ে ভাঙতে আপনি যেকোনো কিছু করতে প্রস্তুত। একজন আরেকজনের নামে বদনাম করে, মানে অপছন্দের কথা আরকি, তাদের জানিয়ে লাভ হয় নাই। আমরা যেহেতু আগে মিথ্যা করে হলেও জানাইনি যে আমাদের পছন্দের মানুষ আছে, তাই এখন সেটা বললেও লাভ হবে না। তাই না?”

মিফতা এবার সোজা হয়ে বসেছে, মনোযোগ দিয়ে শুনছে। মাথা নেড়ে সম্মতি প্রকাশ করল সে।

নওমী আবারও বলতে শুরু করল, “একটা সহজ সমাধান আছে। তবে আপনাকে একটু এক্টিং করতে হবে।”

“কেমন?”

“ধরুন আমরা দু’জনেই বললাম যে আমাদের আপত্তি নেই। এরপর আপনি হুট করে একটা বড়সড় এমাউন্টের যৌতুক চাইলেন। এটুকুই আপনার কাজ। দেখবেন বিয়ে কী করে হয়! বিয়ে ভাঙার জন্য হান্ড্রেড পার্সেন্ট গ্যারান্টি যুক্ত।” নওমীর গলায় কিঞ্চিৎ উল্লাসের আভাস।

মিফতা ততক্ষণে ছিটকে উঠে দাঁড়িয়েছে। চোয়াল শক্ত করে বলল, “আমি কেন যৌতুক চাইতে যাব? আমার কি আত্মসম্মান নাই? মেরুদণ্ড নাই?”

এবার নওমীও উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “এত উত্তেজিত হইতেসেন কেন? আরে সত্যি সত্যি চাইবেন নাকি? আমাদের বিয়েটা ভাঙলে আমাদের ফ্যামিলির কেউ-ই আপনার খোঁজও করতে যাবে না আর কোনোদিন। তাই নো টেনশন।”

মিফতা এবার নিজের উদগত উত্তেজনা কমিয়ে কয়েকবার শ্বাস টেনে বলল, “তাইলে আরেকটা কাজ করতে পারেন। আপনি আমার মা’য়ের কাছে গিয়ে বলবেন, বিয়ের পরে আপনি আমাকে নিয়ে আলাদা থাকতে চান। এটুকুই আপনার কাজ। আমি যেহেতু তাদের একমাত্র সন্তান, দেখবেন বিয়ে কী করে হয়! বিয়ে ভাঙার জন্য এইটাও হান্ড্রেড পার্সেন্ট গ্যারান্টি যুক্ত প্ল্যান।” নওমীর বলা কথাগুলোই ওকে ফেরত দিল মিফতা।

এতে ওর সুন্দর মুখাবয়বে ক্রোধের ছাপ পড়ল। নওমী খানিকটা গলা উঁচিয়ে বলল, “ফাজলামো করেন?”

মিফতা আরেকবার নওমীর বলা কথাগুলোই ফিরিয়ে দিল ব্যাঙ্গাত্মক সুরে, “এত উত্তেজিত হইতেসেন কেন? আরে সত্যি সত্যি মা’কে এসব বলবেন নাকি? আমাদের বিয়েটা ভাঙলে আমাদের ফ্যামিলির কেউ-ই আপনার খোঁজও করতে যাবে না আর কোনোদিন। তাই নো টেনশন।”

“আপনি যে একটা মহা ধড়িবাজ লোক, সেটা আমি খুব ভালো মতো জানতাম। শুধু শুধু সময় নষ্ট করলাম।”

“আর আপনি যে স্বার্থপরের মতো কেবল আমাকে ফাঁসিয়ে দিতে চাইলেন তার বেলা?”

“সামান্য একটা কথাই বলতে বলেছি।”

“আমিও তাই।”

নওমী বলল, “অদ্ভুত তো। আপনার মা’য়ের সাথে আমি কেন শুধু শুধু ঝামেলা করতে যাব। উনি গুরুজন।”

“ও তাই? তাহলে আপনার বাবার কাছে আমি কেন যৌতুক দাবি করব? মিথ্যামিথ্যিও সম্ভব না।”

“আমার পক্ষেও সম্ভব না।” নওমীও দৃঢ় গলায় বলল।

মিফতা ডুবন্ত গোধূলি সূর্যের দিকে পলকের জন্য চোখ রেখে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে সরাসরি নওমীর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,

“তাহলে কি বিয়েটা হচ্ছে?”

“একদম নয়। আপনার মতো অপরিচ্ছন্ন, ম্যানারলেস লোককে বিয়ে করার চাইতে ডুবে মরা ভালো।”

“এক্সকিউজ মি, অপরিচ্ছন্ন মানে? আমি রেগুলার গোসল করি, পরিষ্কার জামা কাপড় পরি।” প্রতিবাদের সরব হলো মিফতা।

“শুধু নাক খুঁটে খাবার বেলায় হাত ধুতে ভুলে যান।”

“একদম বাজে কথা বলবেন না। আপনি কোথাকার কোন মহারানী?”

নওমী এবার মৃদু হেসে তাচ্ছিল্য ভরে বলল, “কেন ভুলে গেলেন, মহারানী এলিজাবেথের ভূত তো। আপনারই দেয়া নাম। মনে রাখবেন জ্যান্ত মানুষের চাইতে ভূতের পক্ষে ঘাড় মটকানো সহজ। সন্ধ্যা হয়ে গেছে, আসি।”

আর এক মুহূর্ত দাঁড়াল না নওমী। হতভম্ব মিফতা সেই গমন পথের দিকে তাকিয়ে রইল। যে করেই হোক, বিয়েটা ভাঙতে দেয়া যাবে না।

“মামার বাড়ির আবদার আরকী, যৌতুক চাইব। এই মেয়ের মাথায় নির্ঘাত ছিট আছে।”
………….
(ক্রমশ)
কেমন লাগছে? আট-দশ পর্বের কথা বলেছিলাম, কিন্তু কিছু পর্ব বেশ ছোট হওয়ায় হয়তো বারো-তেরো পর্ব পর্যন্ত যেতে পারে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here