#হৃদয়_পথে_এ_কার_ছায়া (শেষ পর্ব – প্রথম অংশ)
নুসরাত জাহান লিজা
কাঁদতে কাঁদতেই সহসা নওমীর মনে হলো, সে শুধু শুধু কাঁদছে কেন? কান্নার মধ্যে তো কোনো সমাধান নেই। তারচাইতে সময়টুকু কাজে লাগালে বরং ফলাফল কিছু একটা আসবে। হয় প্রাপ্তি নয় শূন্য। কিন্তু বসে বসে কান্নাকাটি করতে থাকলে ফল শূন্য বই আর কিছু হবে না।
নিজেকে ধাতস্থ করে চোখ মুছতে মুছতে পরবর্তী ইতিকর্তব্য ঠিক করার চেষ্টা করল। কিন্তু বাবা মায়ের সাথে এটা নিয়ে আলোচনা করতে পারবে না।
ওর উদ্ধার কর্তা হিসেবে প্রথমেই মনে হলো শায়না আর নীরবের কথা। কিন্তু নিজের ভাইকে সে হাড়েমজ্জায় চেনে। তাকে তেল দেবার ইচ্ছে ওর এই মুহূর্তে নেই। বাকি রইল শায়না। একমাত্র তাকেই নওমী সুস্থির হয়ে নিজের নতুন অনুভূতি জানাতে পারবে।
সে চলে গেল ওদের ঘরের দিকে। শায়নাকে ডেকে নিয়ে এসে বলল,
“ভাবি, তোমরা এত তাড়াতাড়ি ওদের না করে দিলা কেন?”
“তো কী করবে? ওদের আরও ঝুলাইয়ে রাখার পরে না করলে বিষয়টা কেমন না? যেহেতু কোনো আশা নাই, তাই…”
“যদি পয়েন্ট জিরো জিরো জিরো ওয়ান পার্সেন্টও পসিবিলিটি থাকে, সেটাও তো আশা তাই না!”
“তুই কি বলতে চাস পরিষ্কার করে বল তো?”
বলতে বলতেই শায়না পূর্ণ দৃষ্টিতে নওমীর দিকে তাকাল। এরপর দুই হাতের তালুতে আলতো করে ওর চিবুক একটু উঁচিয়ে বলল,
“নওমী, তুই প্রেমে পড়েছিস মনে হচ্ছে! আরে মুখ নামাইস না, দেখি একটু! লজ্জা পাইতেছিস নাকি! ওরে লজ্জাবতী ননদিনী, শেষ পর্যন্ত ঘাড়ত্যাড়া নাকখোঁটা গবেটের জন্যই এমন উতলা!”
কোথা থেকে যেন হুড়োহুড়ি করে এক পৃথিবী লজ্জা ওকে গ্রাস করে নিচ্ছিল। এবার ধাতস্থ হয়ে শায়নার হাত সরিয়ে দিয়ে বলল,
“ঠাট্টা করো না তো ভাবি। তবে কথাটা সত্যি। তুমি একটু ব্যবস্থা করো না প্লিজ।”
শায়না বলল, “সময় গেলে সাধন করে কি লাভ হয়? তাও আমি চেষ্টা করে দেখি।”
শায়না বেরিয়ে যাবার কিছুক্ষণ পরেই সবাই নওমীর ঘরে এলেন৷ মাহমুদ বললেন,
“দেখো, ওদেরও তো একটা মান-সম্মান আছে। একবার না করে দিয়ে আবার প্রস্তাব দেয়া বিষয়টা কেমন দেখায় না? তুমি নিজেই বুঝতে পারছ তো!”
নওমী উত্তর দেয় না। আসলেও তো, কোন মুখে ওর জন্য তারা নতুন করে প্রস্তাব দেবেন। তাই এখন আর উচ্চবাচ্য করল না।
সারারাত ভেবে সকালে গিয়ে নীরব আর শায়নাকে বলল, “আমি নিজেই একবার চেষ্টা করব। এরপর হইলে হইলো না হইলে…” এপর্যন্ত বলে থেমে গেল, বাকিটা সে আর ভাবতে চায় না।
নীরব কেবল বলল, “বাবা জানলে খুব রাগবে দেখিস।”
“ভাইয়া, আমি আমার সম্মান তোদের কারো সম্মান নষ্ট করব না, এটা তো বিশ্বাস করিস?”
“সেজন্যই তোরে বাঁধা দিলাম না। শুধু বুঝতে একটু দেরি করিস সবসময় আর মাথা হুটহাট গরম করিস। এছাড়া আর কোন বদ অভ্যাস আছে আমার বোনের?”
কপট রাগ দেখিয়ে নওমী বলল, “সুযোগ পাইলেই আমার নামে নিন্দা করার সুযোগ ছাড়ো না।”
বলতে বলতে খেয়ার করল নওমীর চোখ দুটো ভিজে আসছে, পরিবারের মানুষের বিশ্বাস, সাপোর্ট অনেক বড় অর্জন। যা সে দু-হাত ভরে পেয়েছে।
***
মিফতা যেহেতু নিজের হৃদয় খুলে দিয়েছিল একবার, নওমী সেটা তার হৃদয় দিয়ে পড়তে ব্যর্থ হয়েছিল, সেহেতু এবার হৃদয়ের কপাট খোলার পালা ওরই।
ভণিতা জিনিসটা নওমী জানে না। ঠিক করল সরাসরি মিফতার সাথেই কথা বলবে। অনুভূতির সাথে অন্যজনের অনুভূতি মিলেমিশে একাকার হলেই নাহয় বাসায় বড়দের সাথে কথা বলবে।
সেই ভাবনা মতো বিকেলে ইরাকে নিয়ে বেরিয়ে মিফতার অফিসের সামনে এসে নামল। অফিসের বিপরীত পাশেই একটা ক্যাফেটেরিয়া। সেখানে এসে বসল দু’জন। এরপর ইরার মোবাইল থেকে কল করল মিফতার নম্বরে। নিজের নম্বর থেকে কেন যেন করতে ইচ্ছে হলো না।
ভেতরে কেমন যেন একটা চিনচিনে ব্যথার মতো অনুভূতি হচ্ছিল। মিফতার সাথে কথা বলতে গেলে সে সবসময় বড্ড লাগামহীন হয়ে যেত। যা মুখে আসত বলে ফেলত। তখন অবশ্য বিরক্তি থেকেই বলত। কারণ অপর প্রান্ত থেকেও তিক্ত উত্তরই আসত।
দুজনের মধ্যকার এই টম এন্ড জেরি কেমিস্ট্রি কখন যেন এক আলোকবর্ষ দূরত্ব চুম্বকীয় আকর্ষণে, একটা হৃদয়কে অন্য হৃদয়ের ঠোকাঠুকি পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। হৃদয়ের বেগ আলোর বেগের চাইতে বেশি নাকি! নইল কী আর নিমিষেই বিরক্তি ভালোলাগা হয়ে ধরা দেয়! ভালোবাসার উষ্ণতা যেন মন্দবাসার কঠিন বরফ গলিয়ে টলটলে তরলে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। কখন হলো, সে নিজেও বুঝতে পারল না।
মিফতাকে নওমী গবেট বলে, অথচ সে-ই আগে নিজের হৃদয়কে পড়তে পেরেছে।
আকাশ-পাতাল ভাবতে ভাবতেই মিফতা কল রিসিভ করল।
“হ্যালো,..”
“আমি নওমী।” এটুকু বলতেই নিজের সাথে কসরত করতে হলো।
ওপ্রান্তে ক্ষণকালের নীরবতা। এরপর শোনা গেল, “ও, আপনি কল করেছেন? মানে, ঠিক বিশ্বাস হইতেসে না।”
“আপনার অফিস আওয়ার শেষ কয়টায়?”
“কেন?”
“কেন মানে? প্রশ্নের উত্তর দিলে আমি নিশ্চয়ই আপনার সম্পত্তি দখল করব না! অফিস আওয়ার কয়টা পর্যন্ত প্রশ্ন করলাম, আর আপনি এমন ভাব করতেসেন মনে হইতেসে স্ট্যাম্প পেপারে সই করায়ে আপনার সম্পত্তি লিখায়ে নিতেসি।”
“পাঁচটায়।” মিফতার গলার বিস্ময় স্পষ্ট বোঝা গেল।
“এখন বাজে তিনটা ছাপ্পান্ন। আপনি কি আজ একটু আগে আগে বেরুতে পারবেন? নাকি আমি অপেক্ষা করব?”
“আমি কিছুই বুঝতে পারি নাই।”
“একটু ম্যানেজ করে অফিসের বাইরে আসেন। আমি সামনের ক্যাফেটেরিয়ায়।”
“কিন্তু আমারে অফিস বারবার অকারণে ছুটি দিবে কীসের জন্য?”
“বিয়েটা বুঝি অকারণ? একেবারে বিয়ের জন্য ছুটি নিয়ে বের হতে পারেন।”
মিফতার অপ্রস্তুত কাশি ভেসে এলো।
“কার বিয়ে?”
“আগে নামুন না, এরপর বলছি।”
“আপনার ভাবভঙ্গি আমার ভালো ঠেকছে না। কী মতলব বলেন তো?” অবিশ্বাসের সুর মিফতার গলায়।
নওমী প্রাণান্তকর চেষ্টায় হাসি গোপন করে অত্যন্ত সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল, “মতলব? আপনি মনে করতেসেন আপনি নামলেই আপনারে কি ড ন্যা প করব? এরপর মাথায় রি ভ ল ভার ঠেকিয়ে কাজী অফিসে নিয়ে গিয়ে বলব, ‘বিয়ে কর নাইলে খালাস?’ এরকম কিছু?”
“আপনার বিশ্বাস নাই নওমী। করতেও পারেন!”
“খুব ডেঞ্জারাস বুঝি?”
“যাই হোক, আপনি নিজেই বিয়ে ভাঙছেন। আবার কেন আসলেন আজকে?”
“আপনি তো দেখছি ভালো রকম উজবুক আছেন। বোঝেন না? সেদিন তো তুমি বলতেসিলেন, আজ আবার আপনি যে?”
“সেদিন মনে হইসিল এই অধিকার বোধহয় পাইসি। আজ জানি, আমি সেদিন ভুল ছিলাম।” অভিমানে মিফতার গলা বুঁজে এসেছে।
“ভালোবাসলে বুঝি এত সহজে হাল ছেড়ে দিতে হয়?”
“ভালোবাসি বলেই যে তার অনিচ্ছায় তার পেছনে ঘুরব? সেটাও কি সম্ভব?”
“মিফতা, আমার ভীষণ সিরিয়াস একটা কথা আছে আপনাকে বলার। ফোনে বলতে চাই না। একবার আসুন প্লিজ।”
“ঠিক আছে। আসছি।”
নওমীর কাছে ওই ছোট্ট সময়টুকুকেই যেন মনে হচ্ছিল অনন্তকাল। অপেক্ষার সময় এত দীর্ঘ কেন হয়!
***
মিফতার এই কয়েকদিন কেটেছে বিক্ষিপ্তভাবে। জীবন থেকে যেন সব ছন্দ আচমকা মিলিয়ে গেছে। হৈ হৈ করতে ভালোবাসা মিফতা যেন ঢুকে পড়ছিল খোলসে। কিন্তু নওমীকে একবারও বিরক্ত করতে চায়নি। কী জানি যদি আবার হ্যাংলা ভেবে বসে! তবুও যেন ভেতরে ভেতরে দগ্ধাচ্ছিল সে।
সমস্ত আশা ভরসা তো সেদিনই চুকেবুকে গেল। তবে আজ আবার কেন এলো! দগ্ধ হৃদয়কে আরও উস্কে দিতে! প্রথমদিকের কথোপকথনে নওমীর হাস্যরসের ছলে বলা কথাগুলো সেটাই প্রমাণ করছিল। না করে দিয়ে যেন সে দিব্যি ভালো আছে। থাকবেই না বা কেন! ইচ্ছে-পূরণ হবার একটা আনন্দ আছে না!
তাই ভেবেছিল দেখা করবে না। কিন্তু নওমীর শেষ কথাটায় কেমন অন্যরকম সুর ছিল। মনে হচ্ছিল যেন, ওরা দু’জন যেন একই আগুনে জ্বলছে। ওই আহ্বান এড়ানোর সাধ্য ওর হলো না। একবার গিয়েই নাহয় দেখা যাক!
***
ওরা তিনজন একসাথে রাস্তায় নেমে এলো। মিফতার মনে হলো সহস্রবছর ধরে যেন ওর চোখ আর মন তৃষিত ছিল। আজ সেই অনন্ত তৃষ্ণা যেন কিঞ্চিৎ মিটল। বিক্ষিপ্ত মনটা একটু যেন শান্ত হলো। নওমী শাড়ি পরেছে, মিফতার ভাবতে ভালো লাগল এটুকু ওরই জন্য!
ওদিকে ইরার সাথে সৌজন্য সারতেই নওমী বলল, “থ্যাংস দোস্ত। তোরে আর দেরি করায়ে না দেই। রিকশায় তুলে দেই, পোঁছায়ে জানাইস।”
ইরা অম্লানবদনে বলল, “আমার দেরি না নিজের সেইটা তো বুঝতেই পারতেসি দোস্ত। আসি, অল দ্যা ভেরি বেস্ট।” এরপর মিফতার দিকে তাকিয়ে দুষ্টুমি মাখা হাসিতে বলল, “দাওয়াত টাওয়াত দ্রুত দিয়েন ভাইয়া।”
মিফতা এবার যেন খানিকটা আঁচ করতে পারছে, তবুও এবার সে আগ বাড়িয়ে ভাবতে চায় না। ক বললে ক বুঝবে, কা বললে কা। বাংলা অভিধানে ক, কা দিয়ে অজস্র শব্দ আছে৷ তাই বাড়তি কিছু ভাবতে বা বলতে চায় না।
ওরা হাঁটতে শুরু করল ফুটপাত ধরে। মনে পড়ল জুতা হাতে দুজন এভাবেই কাছাকাছি হাঁটছিল। ওদের ছবি ভাইরাল পর্যন্ত হয়েছিল। এটা মনে হতেই মিফতা প্রশ্ন করল,
“আচ্ছা, আপনি তো সেই ফটোগ্রাফারের সাথে কথা বলসিলেন। আমাদের ছবি সরালো যে এরপর। কী বলসিলেন?”
“তেমন কিছু না, বললাম এক ঘন্টার মধ্যে ছবি না সরাইলে প্রাইভেসি হ্যাম্পার হবার দায়ে সাইবার ক্রাইমের আওতায় মামলা করা হবে। মিথ্যামিথ্যি মামা-চাচার পাওয়ার দেখাইলাম। সুড়সুড় করে কাজ হয়ে গেল।”
“যাক, আপনার হম্বিতম্বিতে কিছু ভালো কাজও হয় তাইলে!”
“কী বলতে চাইলেন? আমি অকাজে হম্বিতম্বি করি?”
মিফতা তর্কে গেল না আজ, নীরস গলায় বলল, “আমার বোধহয় শোনার কথা ছিল। সেজন্যই আসলাম। বলুন এখন।”
নওমী হাঁটার গতি শ্লথ করে মাথা ঘুরিয়ে মিফতার ঠিক চোখ বরাবর চোখ রেখে বলল, “যেই অধিকার ভুল মনে করে আবারও আপনি বলে সম্বোধন করতেসেন, সেই অধিকার আজ থেকে আপনার আছে ধরে নিন।”
মিফতার কয়েক মুহূর্ত সময় লাগল কথাটাকে আত্মস্থ করতে। এমন শ্রুতিমধুর কথা যেন সে আগে শোনেনি। মধুবর্ষিত হচ্ছিল যেন।
“শুধু তুমি বলার অধিকার?”
“কী বলতে চাইলাম বোঝেন নাই? আপনি আসলেই এমন উজবুক নাকি ভাব নিতেসেন?”
“আরে না বললে বুঝব কী করে?”
“আসলেই বুঝতে পারেন না? মেয়েরা সব কথা মুখ ফুটে বলে না কিন্তু। আমি তবুও অনেকটা বললাম।”
“আমার যে শুনতে ইচ্ছে করে! তুমি সত্যিই কোনো দ্বিধাদ্বন্দে নেই তো?”
“যা দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল সব বাষ্প হয়ে মিলিয়ে গেছে। এখন যা পড়ে আছে তা কেবলই সম্মতি। বুঝতে একটু দেরি হইল এই যা!”
“ভালোবাসো যে এটা বলবে না?”
“এখন না। বলব হয়তো কখনো। তবে আমি চাই মুখে না বললেও যেন ভালোবাসায় মাখামাখি থাকে আমাদের ঘর। আরও স্পষ্ট করে বলতে হবে ঘাড়ত্যাড়া গবেট মশাই?”
“কিঞ্চিৎ একটা ডাউট আছে, আমার কিছু জিনিস তোমার পছন্দ নয়। হুট করে অভ্যাস পাল্টানোও সম্ভব নয়। বদ অভ্যাসগুলো আমি নিজেই ছাড়তে চাই, তবে কিছু জিনিস আমার স্বকীয়তা। সেসব…”
“যেগুলোতে স্বাস্থ্যের ঝুঁকি আছে, সেসব বাদ দেয়াই উচিত। বাকি রইল স্বকীয়তা। সেসব আছে বলেই হয়তো একসাথে পথ চলতে ইচ্ছে করছে।”
“তুমি না করে দেয়ায় বাবা মা একটু কষ্ট পাইসে। ওদের ম্যানেজ করা একটু টাফ হবে।”
“আমরা চেষ্টা করব।”
মিফতার মন ভালো হয়ে গেল পুরোপুরি। শরতে যেন ওর হৃদয় জুড়ে একরাশ বসন্ত নেমে এসেছে। সেখানে পৃথিবীর সব ফুল যেন একসাথে ফুটছে। যেটুকু আশঙ্কা তা কেবল অভিভাবকরা।
………..
(এই পর্বের বাকি অংশ অনেক রাতে আসবে ইনশাআল্লাহ, একটা বাজতে পারে হয়তো। তাই অপেক্ষা না করে ঘুমিয়ে পড়তে পারেন৷ ঘুম ভেঙে পড়ে ফেলবেন ইনশাআল্লাহ। পুরোটা লিখেছি, তবে এডিট বাকি আছে৷ ঈদের ব্যস্ততায় এটুকু বিলম্ব। এই পর্ব কেমন লাগল?”
ছবি কৃতজ্ঞতাঃ Ifrat Akhter Popy