হৃদয়_পথে_এ_কার_ছায়া (শেষ পর্ব – শেষ অংশ)

0
818

#হৃদয়_পথে_এ_কার_ছায়া (শেষ পর্ব – শেষ অংশ)
নুসরাত জাহান লিজা

একদিন নওমী আর মিফতা জো/ট গঠন করেছিল বিয়ে ভাঙার নিমিত্তে। আজ তারা যে করেই হোক বিয়ে হতেই হবে এই মর্মে দুই সদস্য বিশিষ্ট ঐক্য জো ট গঠন করল।

দুজনের মিটিং চলছিল কী করে ওদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করা যায়। প্রথমেই যার নাম এতে সংযোজিত হলো, তিনি জহির। মিফতার চাচা, নওমীর বাবার বন্ধু। একমাত্র তিনিই আছেন, যে এই দুই পক্ষের মধ্যে মধ্যস্থতা করতে পারেন। তাই তারা একমত হলো, এই বিয়ে বাস্তবায়ন কমিটিতে যে করেই হোক, তাকে টানতেই হবে।

“জহির আঙ্কেল এখন কই? কল দেন তো!”

নওমীর কথায় মিফতা বলল, “তার আগে আরেকটা কথা, তুমি এখনো আপনি আপনি করতেসো কেন?”

“আরে, একেবারে হয় নাকি! আস্তে আস্তে হয়ে যাবে। আগের কাজ আগে করা উচিত।”

“এটাও আগের কাজ।”

“ঠিক আছে। তুমি জহির আঙ্কেলকে কল দাও।”

মিফতা মৃদু হেসে জহির সাহেবের নম্বর ডায়াল করল। জানা গেল, তিনি কী একটা কাজে রংপুর গেছেন। আগামীকাল আসবেন। শুক্রবারে বাসায় থাকবেন কিনা জেনে নিল। নওমীর কথা এখনই আর তাকে জানানো হলো না।

নওমীকে ওর বাসার গলির সামনে পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এসেছে মিফতা। বিদায় বেলায় বলল,

“মরিচা পড়া বুদ্ধিতে একটু শান দাও এবার। বুঝলে?”

মিফতা দু’ধারে মাথা নেড়ে বলল, “তোমার বুদ্ধিতে তো অতিরিক্ত ধার। ছোঁয়ানোর আগেই ঘ্যাঁচঘ্যাঁচ ঘ্যাঁচাং।”

“তাও ভালো।”

আজ ঝগড়াও মধুর লাগছে মিফতার। বাসায় আসতেই মালা এসে বললেন, “শোন না, তোর ছোট খালুর কলিগের এক মেয়ের কথা বলল। আমি ভাবতেসি একবার গিয়ে দেখে আসব।”

“মা, বলছিলাম কি, নওমী…”

“শোন, আমি জানি তুই ওরে পছন্দ করে ফেলছিলি। কিন্তু ওর কথা আর মুখে না আনাই ভালো।”

মিফতা হতাশ চিত্তে ঘরে ঢুকল। কী যে হবে। রাতে ঘুমানোর আগে আজ নওমীকে কল করল নিঃশঙ্ক চিত্তে। ভবিষ্যতের শঙ্কার মেঘ কী করে কাটানো যায়, তাই নিয়ে নানা কথার ফাঁকে জমে উঠল পুরোনো চেনা খুঁনসুটি।

***
জহিরকে বুঝিয়ে শুনিয়ে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে রাজি করানো হলো। কারণ তার বহু আগে থেকেই সুপ্ত বাসনা ছিল যেন বিয়েটা হয়। তিনি দুই পরিবারকে আকারে ইঙ্গিতে কিঞ্চিৎ আভাস দিয়ে একসাথে বসতে রাজি করালেন।

সকল পক্ষের অংশগ্রহণে বৈঠক বসল জহিরের বাসাতেই।

তিনি বোঝালেন, “দেখো, পোলাপান মানুষ ওরা। রক্ত টগবগে। হয়তো অনেককিছু সহজেই মাথায় ঢুকে, আবার অনেককিছু সহজে বুঝতে পারে না। প্রথমদিকে কোনো কারণে ওদের ম্যাচ হয় নাই। এখন ওরা নিজেরাই চাইতেসে বিয়েটা করতে। যা হইসে ঠিক হয় নাই। কিন্তু এখন ওইসব না ধরে রাখলেই ভালো হয় না?”

নীরব কেবল নওমীর কানে কানে প্রবাদ বাক্য আওড়াল, “ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না। মনে রাখিস কিন্তু।”

নওমী অবশ্য আজ নীরবের সাথে কোনো উচ্চবাচ্যে গেল না। এসএসসি পরীক্ষার আগেও ওর এতটা চিন্তা হয়নি, যতটা আজ হচ্ছিল। অন্য প্রান্তে মিফতা বসে আছে, আঁড় চোখে নওমী দেখল, সে-ও অস্থির বোধ করছে। আনমনেই মাথা চুলকাচ্ছে, নাকে হাত দিতে গিয়ে চকিতে একবার ওর দিকে তাকিয়ে হাত নামিয়ে নিল। এত চিন্তার পাহাড় নিয়েও মনে একটা অদ্ভুত ভালো লাগা তৈরি হলো। কাঙ্ক্ষিত মানুষের চোখে নিজেকে পাবার জন্য অস্থিরতা দেখতেও যেন অন্যরকম এক প্রশান্তি থাকে। তারমধ্যে যদি দেখা যায় এতসব চিন্তার ভিড়েও অপরের স্বস্তি, অস্বস্তি গুরুত্ব পাচ্ছে, তখন সেই ভালো লাগা যে বাঁধনহারা হয়।

নানা যুক্তি পাল্টা যুক্তির মিছিলে অবশেষে সকলেই সম্মত হলো বিয়েতে। দুই সপ্তাহে পরেই বিয়ের দিন ধার্য্য করা হলো।

***
বিয়ের পরে এবাড়িতে আসতে মালা আর জামিল যেভাবে নওমীকে বরণ করে নিলেন, তাতে ওর মনে মেঘের ঘনঘটা মিলিয়ে ঝলমলে রোদের ঝিলিক দেখা দিল।

প্রত্যেকেই দারুণ মজার মানুষ। মালা বললেন, “তোমদের এখন বিয়ে হইসে। ম্যাচিউর্ড মানুষ। মিফতার মধ্যে কিছু ছেলেমানুষি আছে, অলস, কিন্তু সারল্য আছে। তোমাকেও আমার প্রথম থেকেই ভালো লাগত। সংসারে দুইজনরেই একটু মানিয়ে চলতে হয়। আমার কোনো উপদেশ দেবার নাই। শুধু প্রাণভরে আশীর্বাদ করি, তোমরা সুখী হও।” নওমী সেই আশীর্বাদটুকু হৃদয়ে ধারণ করল।

নওমী মিফতার বিছানায় বসে আছে। ড্রেসিংটেবিলের আয়নার নিজের ফুটে উঠা প্রতিবিম্ব দেখছে। সত্যিই আজ সে বিবাহিত। কেমন অবিশ্বাস্য লাগছে সবকিছু!

এরমধ্যে চামেলি এলো ঘরে। হাতে কিছু খাবার। এসে বলল, “খালাম্মা পাঠাইল। রাইতে খিদা লাগতে পারে।”

নওমী মৃদু হেসে সম্মতি জানালো, আয়না থেকে চোখ সরিয়ে নিল।

“একটা কতা কমু ভাবি? ভাইজান তো পুরা দেবদাস হয়ে গেসিল কয়দিন।”

নওমী এবার প্রশ্ন করল, “তুমি দেবদাসকে চেনো?”

“চিনুম না মানে? শারুক খানে কী এক্টিংডাই না করসে। ছ্যাঁক খাইয়ে মাতাল হইসে। তয় ভাইজান কিন্তু মদ খায় নাই৷ এইজন্যই মনে হয় বিয়াডা হইসে।”

নওমী এবার মৃদু শব্দ করে হাসল। তখনই মিফতা ঘরে প্রবেশ করল।

“কী হইসে চামেলি?”

চামেলি মুখ খোলার আগে নওমী বলল, “ছ্যাঁকা খেয়ে কেমন দেবদাস হইসিলা, তাই বলল।”

ওদিকে চামেলি বিদায় নিতে নিতে বলল, “এট্টুর লাইগে ফেল মারসেন দেবদাস হইতে। বোতল ধরলেই এক্কেবারে খাপে খাপ।”

মিফতার চেহারাটা হয়েছে দেখার মতো। সে ধমক দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু নওমীর হাসিতে তা বাধাপ্রাপ্ত হলো।

“চমৎকার মেয়ে তো চামেলি!”

“হ্যাঁ, তবে কথা একটু বেশিই বলে।”

“আমার ভালো লেগেছে এই বাড়ির সবাইকে। মা, বাবা, চামেলি।”

এটুকু বলে নওমী থেমে গেল। মিফতা নিজের নাম না শুনতে পেয়ে হতাশ গলায় নিজেই প্রশ্ন করল, “আর মা-বাবার একমাত্র ছেলে কেমন?”

“মাথার কিঞ্চিৎ স্ক্রু ঢিলা। তবে তাকেও ভালো লাগে বলেই তো আজ এখানে। এটা আবার জিজ্ঞেস করতে হয়?”

“আবারও অফেন্সিভ কথাবার্তা!”

“আচ্ছা, ইরেজার দিয়ে ঘষেমেজে মুছে দিলাম মন থেকে। তোমার সারল্য আমার বেশি ভালো লাগে। আমার ক্ষেত্রেও যদি একই প্রশ্ন করি?”

মিফতা একমুহূর্ত না ভেবে উত্তর দিল, “অকপটতা আর স্পষ্টবাদিতা। ঝগড়াটাও৷”

মিফতা জানালার পর্দা সরিয়ে দিল। জানালার ফাঁক গলে ঘরে প্রবেশ করল চাঁদের রূপালী আলো। ওদের মনেও বোধহয়।

মিফতা আচমকা বলল, “তুমি ঠিক ওই চাঁদের মতোই স্নিগ্ধ।

প্রত্যুত্তরে নওমী বলল, “আর তুমি কি চন্দ্রগ্রহণ?”

“না, আমি চাঁদের ওই চন্দ্রবিন্দুটা। যা ছাড়া চাঁদ অসম্পূর্ণ।”

কথাগুলো হয়তো ক্লিশে, অনেক প্রেমিক তার প্রেয়সীর মুখপানে চেয়ে হয়তো বলেছে। তবুও একটা অদ্ভুত শিহরণ খেলে গেল নওমীর মধ্যে।

সে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল মিফতার দিকে। কেমন যেন ধ্বক করে উঠল ভেতরে! হৃদয়ে কি সে এই মানুষটার ছায়া এঁকেছিল এতকাল ধরে? হৃদয় পথে যে ধূলো উড়িয়ে হেঁটে চলে যায়, ধরা দেয়নি কোনোদিন, এই কি সেই! নিশ্চয়ই তাই! নইলে এমন লাগছে কেন!

নওমী লজ্জায় উত্তর দিল না, নিজেকে ধাতস্থ করে বলল,

“বাব্বাহ, ঝগড়া ছাড়াও দেখছি অনেক ট্যালেন্ট আছে তোমার!”

“যাক, কিছুটা হলেও তো বুঝলে। বুদ্ধির উন্নয়ন হচ্ছে।”

এই আকাঙ্ক্ষিত রাত ওরা স্মরণীয় করে রাখতে চায়, এমন দারুণ মুহূর্তে জীবনে বারবার বারংবার ফিরে আসুক, সেই চাওয়া নিয়ে সংসার জীবন শুরু হলো ওদের।

পরিশিষ্টঃ
বিয়ের পরে পাঁচ মাস গত হয়েছে। সময়টা যেন দেখতে দেখতে চলে গেল। ওদের মনে হলো এই তো সেদিন দেখা হলো! কেউ নওমীকে যদি জিজ্ঞেস করে, ওদের লাভ নাকি এরেঞ্জ ম্যারেজ?

নওমী উত্তর দেয়, “হাফ এরেঞ্জ, হাফ লাভ। লাভেরেঞ্জ বলা যায় আরকি!”

আজ ওরা এসেছে নওমীদের বাড়িতে। শায়না আর নীরবের সাথে ওরা এসেছে ছাদে। এখানে আজ সারারাত আড্ডা হবে।

সপ্তাহ খানেক হলো জানতে পেরেছে শায়না মা হবে। তাতে নীরবসহ বাড়ির সকলেই ভীষণ খুশি।

নওমী চাপা গলায় পাশে বসা মিফতাকে বলল, “আমার ভাইয়ের কাছ থেকে টিউটোরিয়াল নিবা, বুঝলা!”

কথাটা শায়নার কানে আসতেই সে বলল, “মিফতাও তো তোরে কত্ত ভালোবাসে।”

“ভালো তো অবশ্যই বাসে। কিন্তু আমাকে তেমন একটা খেয়ালই করে না।”

“মানে?” মিফতা বিস্ময়াভিভূত গলায় বলল।

“আমি আজকে পাঁচদিন হলো, হেয়ার স্টাইল চেঞ্জ করসি। ভাবি তুমি বিশ্বাস করবা? ও বাসায় আসলে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘আজকে আমাকে কেমন লাগতেসে?’ সে গদগদ হয়ে কথায় মধু মিশায়ে বলল, ‘তুমি তো সবসময় ভীষণ সুন্দরী। আজও তেমনই চমৎকার লাগছে।’ আমি বললাম, আমার মধ্যে কোনো চেঞ্জ আসছে কিনা! বলে, ‘কই না তো!”

“ও, তাই তো বলি, কী যেন একটা চেঞ্জ!” মিফতা এবার সব বুঝতে পেরেছি ভঙ্গিতে কথাটা বলল।

“ভাবি, দেখলা? এইবার বলো, ও খেয়াল করে আমাকে?”

শায়না কিছু বলার আগেই মিফতা বলল, “আমার কাছে তোমার সবই ভালো লাগে। তাই আলাদা করে… ”

“হইসে! কত সে আমি জানি!”

মিফতা এবার বলল, “আর তুমি যে সারাক্ষণ জ্ঞান দাও! এইখানে এইভাবে বসো। এইখানে আস্তে কথা বলো। খাবার আগে কয়বার করে হাত ধোয়া লাগে। তার বেলা?”

“সেটাতে কি তোমার খারাপ হয়? ঠিক আছে, আমি মাসখানেক বাসায় থেকে যাই। তুমি রবিবারে এখান থেকে অফিস করে বাসায় চলে যাইয়ো।”

এবার মিফতা আঁতকে উঠল। সে তড়িঘড়ি করে বলল, “এই না না! এক মাস? তাইলে আমি কী করব? মাসের অর্ধেক ঘরজামাই থাকা লাগব।”

“সেটা কেন? আমি তো জ্ঞান দেই৷”

“জ্ঞান ভাণ্ডার জ্ঞান বিতরণ করবে না তো কে করবে! তাই বলে রাগ করতে হবে! আরে, আমার তো এখন তোমার আদর্শলিপি শুনতেই ভালো লাগে।”

নীরব নীরব ভূমিকা নিয়েছিল। তবে শায়না হাসি আটকে রাখতে পারল না। হো হো করে হেসে বলল,

“তোদের লাভস্টোরি কিন্তু ইউনিক। একসাথে থাকলে ঝগড়া ছাড়া থাকতে পারিস না, আবার কেউ কাউরে ছাড়া থাকতেও পারিস না।”

শায়নার এই সময় বেশি রাত জাগা ঠিক নয় বলে নীরব ওকে নিয়ে চলে গেল।

মিফতা নওমীর কাঁধে মাথা এলিয়ে দিয়ে বলল, “আমরাও এবার একটা বাবু নিয়ে নিই চলো।”

নওমী বলল, “তুমি আগে বড় হও, বুড়োখোকা।”

“বুড়োখোকার বউ, বাচ্চা খোকা বা খুকি এলে ঘর ভরবে যে!”

নওমী উত্তর দিল না, ওর মুখে স্মিত হাসি। সকালের সূর্য সব ঋতুতে যেমন সারাদিনের পূর্বাভাস দেয় না, তেমনি একটা মানুষের সাথে পরিচয়েই ধারণা করা যায় না, মানুষটা কেমন!

জীবনে এখন অব্দি ওরা সুখী। মিফতার ছেলেমানুষি কর্মকাণ্ডে রাগ দেখালেও মনে মনে সে চায়, এই ছেলেমানুষিটুকু থাকুক। কেন যেন মিফতার ভেতরের এই অদ্ভুত মনকে নওমী স্পর্শ করতে পারে, পড়তে পারে! এভাবেই চলুক না!

নওমী অস্ফুটস্বরে আওড়াল, “ভালোবাসি।” প্রথমবার বলল কথাটা৷

মিফতার কান পর্যন্ত পৌঁছাল কিনা ঠিক বোঝা গেল না, তবে নওমী একটা আবেগী আলিঙ্গনে আবদ্ধ হলো।
……..
(সমাপ্ত)

যারা সবসময় কমেন্ট করে উৎসাহিত করেছেন, তাদের জন্য অজস্র ভালোবাসা। যারা কখনো কমেন্ট করেননি, তারাও অনুপ্রেরণা দেবেন সেই আশায় রইলাম।

এটা আপনারা চইলে ওদের সংসারের খুঁনসুটিতে মাখা একটা দুটো বিশেষ পর্ব সামনে কখনো আসবে ইনশাআল্লাহ। তবে এটা এখানেই সমাপ্তি টানলাম, কারণ ‘টক ঝাল মিষ্টি’ আর ‘মাইনাসে মাইনাসে প্লাস’ মিলেমিশে না ফিরে আসে আবার। অনেক অনেক ভালোবাসা রইল। ঈদের শুভেচ্ছা সবাইকে। ‘জোনাকি প্রদীপ’ নিয়ে ঈদের পরের কোনো একটা সময় থেকে আবারও আনার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here