হৃদয়ও_মাঝারে-১২,১৩

0
728

#হৃদয়ও_মাঝারে-১২,১৩
তন্বী ইসলাম
১২

-আরেহ, তুমি তিথী না? তা এখানে কি করছো? এ বাসাতেও কি কাজ করো নাকি?

ইনামের কথায় থমকে দাঁড়ালো তিথী। রবিন অবাক হলো। বিস্ময়ে বললো
“এ বাসাতেও কাজ করে মানে? এ কথার মানে কি?
তিথী কিছু বলতে যাবে তার আগেই রিয়ানা চলে আসে সেখানে। হাসিমুখ করে ইনামকে বলে
“ইভানার টিচার সে।
ইনাম যথেষ্ট অবাকই হলো এবার। একজন বাসার মেইড কি করে কারো টিচার হতে পারে? ওর মনে নানা ধরনের প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকে। রিয়ানা তিথীর দিকে ফিরে মুচকি হেসে বলে
“তোমার স্টুডেন্টরা তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।
তিথী আরেকবার ইনামের দিকে তাকিয়ে চলে গেলো ইভানার রুমে। তিথীর পিছু পিছু রিয়ানাও যেতে নিলো। ইনাম সেটা খেয়াল করে ইভানাকে ডেকে বললো
“রিয়ানা।
রিয়ানা ফিরে তাকালো। একগাল হেসে বললো
“কিছু বলবেন ভাইয়া..
ইনামের মুখের হাসিটা উধাও হয়ে গেলো হঠাৎ। সে সামান্য বিরক্তির স্বরে বললো
“ওহ রিয়ানা, তোমায় আর কতবার বলবো আমাকে ভাইয়া ডাকবে না, নাম ধরে ডাকবে। কিন্তু তুমি তো আমার কোনো কথাই শুনো না। তুমি কি বলো তো!
“কিন্তু আপনি তো আমার থেকে যথেষ্ট বড়। আপনাকে আমি নাম ধরে কিভাবে ডাকতে পারি?
“তো? একেও তো তুমি নাম ধরে ডাকো। ও কি তোমার থেকে ছোট? আমরা কিন্তু একই বয়সের বুঝেছো। রবিনের দিকে ইশারা করে বললো ইনাম।

রিয়ানা হেসে রবিনের দিকে তাকালো। রবিনের মনোযোগ তখনো মোবাইলের দিকে। রিয়ানা বললো
“ওর কথা বাদ দেন, ওরে আমি জীবনেও ভাইয়া ডাকবো না। তা সে যতই আমার নানা দাদার বয়সী হোক।

রিয়ানা আর কোনো কথা না বাড়িয়ে চলে এলো ইভানার রুমে। তিথী ইভানা আর মিথীলাকে ম্যাথ বুঝিয়ে দিচ্ছে। রিয়ানা এসে তার পাশে বসে তাকিয়ে রইলো তিথীর দিকে। ম্যাথটা বুঝানো হলে সে শান্ত গলায় তিথী কে প্রশ্ন করলো
“তোমার সাথে কি ইনাম ভাইয়ার আগে থেকেই পরিচয়? মানে তোমরা কি আগে থেকেই পরিচিত?
“পরিচিত নয় আমরা। একবার দেখা হয়েছিলো এই যা।
“কোথায় দেখা হয়েছিলো?
রিয়ানার এ প্রশ্নে তিথী কিছুটা ইতস্তত বোধ করলো। রিয়ানা সেটা বুঝতে পেরে বললো
“তুমি কি বলতে দ্বিধা করছো? সমস্যা থাকলে বাদ দাও, বলা লাগবে না।
তিথী কৃতজ্ঞতার হাসি হেসে বললো
“ধন্যবাদ রিয়ানা। কিন্তু উনি এখানে কি করছে? উনি কি হোন তোমাদের?
“আমার দুলাভাইয়ের কাজিন সে।
“ওহ।
রিয়ানা চলে আসার সাথে সাথেই মোবাইল থেকে চোখ সরিয়ে ইনামের দিকে তাকালো রবিন। ভারী গলায় বললো
“তুই যেনো তখন কি বললি ইনাম?
“কি বলেছি?
“তিথী’র ব্যাপারে একটা কথা বললি শুনলাম। এখানেও কাজ করে মানে? কোন কাজের কথা বললি? আর ও কি আরো কোথাও কোনো কাজ টাজ করে নাকি?
ইনামের মনে হলো তিথীর এই ব্যাপারটা ঢেকে রাখাই ভালো। সে কথা ঘুরিয়ে বললো
“আরে নাহ। ভুলটা আমারই। আমি অন্য একজনকে ভেবে এই কথাটা বলেছিলাম। পরে বুঝতে পেরেছি, এ মেয়ে সে মেয়ে নয়।
“তাহলে ঠিকঠাক নামটা বললি কিভাবে? সন্দিহান গলায় বললো রবিন।
ইনাম হেসে বললো
“হয়তো কাকতালীয় ভাবে মিলে গেছে।

ইভানাদের পড়ানো শেষ করে বেরিয়ে আসার প্রস্তুতি নিলো তিথী। এতটা সময়ের মধ্যে ইভানার মায়ের সাথে একটাবারের জন্যও দেখা হলো না তার। তিনি ইনামের জন্য নাস্তা রেডিতে ব্যস্ত। তিথী সেদিকে মাথা ঘামালো না। তার মন সেদিকেই, যে কাজে সে এসেছে। ইভানার রুম থেকে বেরোতেই ইভানার মাকে দেখতে পেলো সে। উনি রবিন আর ইনামের সাথে বসে কথা বলছেন। তিথী ইভানার মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসছিলো। তখনও উনারা কথোপকথনে ব্যস্ত।
“এহসান মামার শরীরটা এখন কেমন ইনাম?

ইভানার মায়ের এ কথাটা কানে আসতেই আবারও থমকে গেলো তিথী। মুহুর্তেই পেছনে ফিরে তাকালো সে। তার চোখেমুখে বিস্ময়ের ছাপ। ওকে এভাবে ফিরে তাকাতে দেখে ইভানার মা বললো
“কিছু বলবে তিথী?
তিথী নিজেকে স্বাভাবিক করে নিলো। নরম গলায় বললো
“কই না’তো।
তিথী দাড়িয়েই রইলো আবারও। রবিন সেটা খেয়াল করে বললো
“সবসময় তো দেখি দৌড়ের উপর থাকো। তা আজ কি কোনো তাড়া নেই?
রবিনের কথায় হুশ এলো তিথীর। তাকে আবারও অনামিকার বাসায় যেতে হবে। সে কোনো কথা না বলেই তারাহুরো করে বেরিয়ে গেলো সেখান থেকে। ইনাম বেশ অবাক হয়েই খেয়াল করলো ব্যাপারটা।

অনামিকার বাসায় এসে একদফা ঝাড় খেতে হলো তিথীকে। উনার ভাষ্যমতে আজ পুরো দশ মিনিট দেরি হয়েছে। এ কাজের পানিশমেন্ট হিসেবে তাকে অন্যদিনের চেয়ে আধঘন্টা বেশি সময় কাজ করতে হবে। নয়তো বেতন কাটা যাবে।
তিথী কথার প্রতিবাদ করে বললো
“আমিতো প্রতিদিনই নির্দিষ্ট সময়ের চেয়ে বেশি কাজ করে দিয়ে যাই আপনাকে। কই, তখন তো বেতন বাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন না! অল্প কিছু সময় লেট হলে সেটা একভাবে না একভাবে ঠিকই পুষিয়ে নেন। এটা কি ধরনের নিয়ম? অনামিকা রেগে গিয়ে বললো
“এই মেয়ে, তোর তো সাহস কম না। তুই আবারও আমার মুখের উপর কথা বলিস। আমার টাকায় চলিস, আবার আমাকেই কথা শোনাস।
“দেখুন, মুখের ভাষা ঠিক করে কথা বলুন। আমি মোটেও আপনার টাকায় চলি না। নিজে খেটে কাজ করে যে টাকা উপার্জন করি, সে টাকাতেই দিন চলে আমার। আর আমার কাজেরর টাকা মানে আমার টাকা, মোটেও আপনার নয়।
“যত বড় মুখ নয়, তত বড় কথা। যা, এই মাসের পুরো বেতনটাই তোর কাটা। আমার সাথে তর্ক করার বিনিময়ে এটা তোর পানিশমেন্ট।

তিথী রেগে গিয়ে বললো
“আমার এ মাসের পুরো টাকাটা আপনাকে আমি ভিক্ষা দিয়ে গেলাম। এ টাকার কোনো প্রয়োজন নেই আমার। আর হ্যাঁ, আপনার কাজটা আমি এই মুহূর্ত থেকে ছেড়ে দিলাম। পেট যেহেতু আছে, খাবারটা একভাবে না একভাবে ঠিকই যোগার হবে। কিন্তু সম্মান, সেটা সব যায়গাতে পাওয়া যায় না। আর যেখানে সম্মান নেই, সেখানে নির্লজ্জের মতো কাজ করে যাওয়ার কোনো মানেই নেই।
তিথী হনহন করে বেরিয়ে আসতে লাগলো। দরজার সামনে এসে আবারও দাঁড়িয়ে পরলো সে। কড়া গলায় বললো
“আমি তিথী, এতিমখানায় বড় হওয়া শক্ত মনের একটা মেয়ে। ননীর পুতুল নয়, যে সহজেই কারো বশ হয়ে যাবো। আপনি একদিন আমায় বলেছিলেন, ভাত ছিটালে কাকের অভাব হয় না। আজ আপনার সেই কথাটাকে সম্পুর্ন রুপে ভুল প্রমান করে আমি বলছি, গায়ে শক্তি, মাথায় মেধা আর ইচ্ছেশক্তি থাকলে এ দুনিয়ায় কোনো কিছুরই অভাব হয় না।
রাগের চোট এতটাই ছিলো যে তিথী কোনোদিকে না তাকিয়ে সোজা নিজের রাস্তা ধরে এগিয়ে যেতে থাকলো। আসেপাশে কি আছে না আছে দেখার বা জানার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে তার হয় নি। অনামিকা এখনো বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে আছে। এইটুকু একটা মেয়ে তাকে আজ এতগুলো কথা বলে গেলো? এতটা অপমান করলো? রাগে মাথা ছিড়ে যাচ্ছে উনার। নিজের মাথার চুলগুলো হাতের মুঠোয় পুরে টানতে লাগলেন উনি। এতটা অপমানিত তিনি এই জীবনে কখনোই হোন নি। রাগে দুঃখে তিনি সোফাতে হেলে পরেন।

হোস্টেলে ফিরেও রাগে গজগজ করতে লাগলো তিথী। ফারিন আজ অবাক, এতো তারাতাড়ি তিথী কখনোই ফিরে না। ফারিন তিথীর পাশে গিয়ে বসলো। শান্ত গলায় বললো
“তোমার আজ কি হয়েছে তিথী? এত তারাতাড়ি ফিরে এলে, মেজাজটাও ঠিক নেই দেখছি!!
তিথী নিজেকে শান্ত করে বললো
“অনামিকার বাসার কাজটা ছেড়ে দিয়ে এসেছি আজ।
“হঠাৎ কাজ ছেড়ে দিলে?
“কি করবো বলো, মহিলা খুবই খিটখিটে। যা নয় তা বলে অপমান করে প্রতিনিয়ত। কথায় কথায় বেতন কেটে রাখার হুমকি দেয়। হজম করে এসেছি এতদিন, কিন্তু আর পারছি না। আমি এতিম হতে পারি, কিন্তু অপমান সহ্য করার একটা লিমিট আমারও আছে।
ফারিন তিথীর পিঠে হাত রাখলো। শান্তনা দিয়ে বললো
“নিজেকে সামলাও তিথী। তুমি বেশ ভালো করেছো এই কাজটা ছেড়ে। আসলে তোমাকে দিয়ে কাজ করিয়ে নেওয়ার মতো যোগ্যতা উনার নেই।
তিথী চিন্তিত গলায় বললো
“রাগের ঝোঁকে কাজ তো ছাড়লাম, কিন্তু চলবো কিভাবে? দুটো টিউশন করে যে টাকাটা পাই, সে টা দিয়ে আমার হোস্টেল খরচটা হয়ে যাবে। সরকারি কলেজে পড়ি, তাই সেখানে তেমন কোনো খরচ নেই, কিন্তু আমার ব্যক্তিগত কত কিছুরই তো প্রয়োজন পরে। শুধু হোস্টেল খরচ চালিয়ে তো দিন যাবেনা। কি করবো এখন আমি?
“আল্লাহ একদিক থেকে নিয়ে গেলে আরো কয়েকদিক থেকে ব্যবস্থা করে দেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ এরচাইতেও ভালো কিছুর ব্যবস্থা তোমার জন্য করে রেখেছেন।

ফারিনের কথায় জোরপূর্বক হাসলো তিথী। কিন্তু ওর মাথায় এবার আরেক নতুন চিন্তার উদয় হলো। ইভানার মায়ের মুখ থেকে শুনলো তিনি এহসান নামের কারো কথা বললেন। এহসান হচ্ছেন সেই ব্যক্তি, যিনি তিথীর জীবনটা নরকে পরিণত করেছিলেন। আর উনার ছেলের নামই ছিলো ইনাম। তাহলে তিথী যা ভাবছে তাই-ই ঠিক? এ ইনামই কি সেই ইনাম? না না, এটা কাকতালীয়ও তো হতে পারে। দুনিয়াতে একই নামের কত্ত কত্ত মানুষ আছে। তিথী যতই এইসব চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে চাইছে, চিন্তাগুলো যেনো ততটাই তীব্র গতিতে মাথায় দলা পাকাচ্ছে। তিথী আর নিতে পারছে না। মাথা ব্যথা করছে প্রচন্ড পরিমাণে। মাথাটাকে একটু রেস্ট দেওয়া দরকার। তিথী শুয়ে পরলো বিছানায়। চোখ বুজে একটু ঘুমানোর চেষ্টা করছে সে।

ইভানার মা গেছে নিজের রুমে। রবিন, ইনাম আর রিয়ানা একসাথে বসে গল্পগুজব করছিলো। ইনামের সাথে কিছুক্ষণ বাদে সে বাইরে বেরোবে যে কারণে সে ফ্রেশ হয়ে তৈরি হওয়ার জন্য নিজের রুমে চলে গেলো। বসে থাকলো শুধু ইনাম আর রিয়ানা। রিয়ানা স্বাভাবিকভাবেই কথা বলছিলো, তবে ইনামের কথার মাঝে একটা অন্যরকম রেশ আসছিলো। তার নজর ছিলো রিয়ানার দিকে। এ মেয়েটাকে সে যতই দেখে, ততই যেনো নতুন করে প্রেমে পরে যায়। এত্ত কিউট একটা মেয়ে। মনটাও অনেক সুন্দর। যেকোনো ছেলেই তার প্রেমে পরতে বাধ্য। ইনাম ওকে ভালোবাসে, অনেক আগে থেকেই ভালোবাসে। তবে সেটা বলার সাহস এখনো পর্যন্ত তার হয়ে উঠেনি। কথায়, ব্যবহারে সে রিয়ানাকে বার বার তার ভালোবাসার কথাটা বুঝানোর চেষ্টা করে গেছে যদিও, তবে রিয়ানা যথেষ্ট বুদ্ধিমতী হওয়া সত্বেও সেটা বুঝতে পারেনি। নাকি বুঝেও না বুঝার মতো থাকে কে জানে।

রিয়ানার হাসিমুখটার দিকে এক নজরে তাকিয়ে রইলো ইনাম। রিয়ানা খেয়াল করে বললো
“কিছু বলছেন না যে ভাইয়া।
ইনাম নিজেকে ধাতস্থ করলো। কিছুটা সময় নিয়ে সে বললো
“একটা কথা বলবো তোমায়?
“আমায় কিছু বলবেন, আর তার জন্য অনুমতি চাইছেন? এমনটা তো কখনো হয় নি!! কি ব্যাপার ভাইয়া? দুষ্টু হাসি হেসে বললো রিয়ানা। ওর এই হাসিটায় আবারো ঘায়েল হচ্ছে ইনাম। এটা কি করে বুঝাবে সে রিয়ানাকে? ইনামকে নিশ্চুপ দেখে রিয়ানা আবারও বললো
“আবারও চুপ করে আছেন যে? আপনি তো কিছু বলবেন বলেছিলেন।
“বলছিলাম… আগামীকাল আমি একটু বেরোবো। চাইলে তুমিও আমার সাথে যেতে পারো।
“সে’তো আপনি সবসময়ই বেরোন। এবার তো তা নতুন কিছু নয়। তা আমি আপনার সাথে গিয়ে কি করবো?
“ইয়ে, মানে.. তুমি চাইলে আমি তোমাকে নিয়ে লং ড্রাইভেও যেতে পারি।

______________
পরেরদিন সকাল সকাল বেরিয়ে পরলো তিথী। না, ইভানাদের বাসার উদ্দেশ্যে নয়। অন্য এক যায়গার উদ্দেশ্য। গ্রামের নাম ফুলপুর। এটা সেই গ্রাম, যে গ্রাম তাকে শৈশবের স্মৃতি মুছে দেওয়ার জন্য এতিমখানায় পাঠিয়েছিলো। আর এর পেছনে ছিলো এহসানুল হক নামের এক মানুষ। যিনি উপরের ভদ্রতার আড়ালে অভদ্রতাকে পুষতেন। দূর সম্পর্কের চাচা হতেন তিনি তিথীর। গতকাল রাতে হঠাৎ ই তিথীর মনে হলো এবার তার প্রিয় মানুষটার খোঁজ করা উচিত। ভাগ্যের উপর বসে থাকলে তো আর ভাগ্য ঘরে এসে তার প্রিয় মানুষটিকে দিয়ে যাবে না। চেষ্টা করতে হবে প্র‍্যক্টিক্যাল ভাবে। যেহেতু অনামিকার বাসার কাজটা সে ছেড়ে দিয়েছে তাই তেমন কোনো ঝামেলা হলো না। কলেজও বন্ধ আছে দুদিনের জন্য। ইভানার মায়ের কাছে একদিনের ছুটি নিয়েই সে সকালে বেরিয়ে পরেছিলো।।
লম্বা পথ পেরিয়ে একটা সময় সে এসে উপস্থিত হলো নির্দিষ্ট গন্তব্যে। কিন্তু একি…!!!
এখানে এসে সে এমন কিছু দেখবে, তা ছিলো তার কল্পনারও বাইরে।

চলবে….

#হৃদয়ও_মাঝারে-১৩
তন্বী ইসলাম

[বোনাস পর্ব]

এহসানুল হক সাহেবের বাড়িটা ঠিক যে যায়গাতে ছিলো, সে যায়গাতে এখন বাড়িঘরের কোনো চিহ্নও নেই। একটা ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়ে আছে যায়গাটি। মাঝে মাঝে দু চারটে বড় বড় গাছে। তিথী চিন্তায় পরে গেছে, সে কি ঠিক যায়গাতে এসেছে? হ্যাঁ, এটাই তো সেই যায়গা। তিথীর ভুল হতেই পারেনা। অন্তত পক্ষে এ যায়গাটির ব্যাপারে তো নয়ই।
তিথী ছন্নছাড়ার মতো চারপাশটা ভালো করে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো। এমনটা হবার কারণ কি? উনারা কোথায়? কি এমন হয়েছিলো যে কারণে যায়গাটির আজ এমন করুণ দশা। তিথী চারপাশটায় ভালো করে তাকালো একবার। আশেপাশে কাউকে দেখতে পেলে হয়তো জানা যাবে এমনটা হবার কারণ। তিথী একটা সরু রাস্তা ধরে সামনে এগুতে লাগলো। গ্রামটা আর আগের গ্রামের মতো নেই, শহরের ছোয়া লেগে কিছুটা হলেও শহুরে ভাব নিয়েছে। তিথীর ভালো লাগছেনা এ গ্রাম, গ্রাম হবে গ্রামের মতো। গ্রামে থাকবে টিনের ঘর, মাটির ঘর… চারিদিকে সবুজ ঘাস। ঘাসের বুকে বিরাজ করবে গরু, ছাগল। মাটির গন্ধে মন জুরাবে… তবেই না গ্রামকে গ্রাম মনে হবে।
কিছুটা সময়ের জন্য ছোটবেলার প্রকৃতিকে খুজতে লাগলো তিথী। হারিয়ে যেতে মনে চাইলো সে প্রকৃতির মাঝে।

“আপনি কে বোন? আগে তো কখনো এ গ্রামে দেখেছি বলে মনে হয় না। কাউকে খুজছেন মনে হয়?

কোনো এক প্রাপ্ত বয়স্ক ছেলের বিশুদ্ধ বাংলা কথায় ঘোর ভাংলো তিথীর। সামনে তাকিয়ে দেখলো এক সাতাশ আঠাশ বছরের ছেলে দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। তিথী নিজেকে ধাতস্থ করে বললো
“আচ্ছা, ওখানে যে পরিত্যক্ত যায়গাটা পরে আছে ওটার সম্পর্কে আপনি কিছু জানেন?
“কোন যায়গার কথা বলেন? আর কার যায়গা?
তিথী দুইবার কি যেনো চিন্তা করে বললো
“এহসানুল হক সাহেবের বাড়ির কথা বলছি।
“ওহ! এই বাটপারের বাড়ির কথা বলেন! আমি তো ভাবলাম কার না কার বাড়ির কথা বলছেন।
তিথী সংকুচিত হলো। বিস্ময়ে বললো
“বাটপার মানে?
“ওই লোক তো আস্ত একটা চিটার বাটপার ছিলো। অন্যের যায়গা জমি, বাড়ি ঘর ছলে বলে দখল করাই ছিলো তার কাজ।
তিথী শক্ত গলায় বললো
“সেটা আমি জানি। তবে তাদের এখন এই অবস্থা কেন?
“বছর দশেক আগে একজনের জমিজমা বে-আইনিভানে দখল করতে দিয়ে ব্যাটা পুরাই ফেসে গেছিলো। এলাকার মানুষজনও সুযোগ খুজতেছিলো তাকে শায়েস্তা করার। তো এই সুযোগে বেটাকে সবাই মিলে গণধোলাই দেয়। একালার ক্ষিপ্ত ছেলেরা বাড়িঘর ভাংচুর করে, উনাকে তোপের মুখে ফেলে যারা যারা সম্পত্তি হারিয়েছিলো, সবাই নিজেদের সম্পত্তি ফেরত নেয়।
তিথী অবাক হয়ে বললো
“উনি সবার সবকিছু ফিরিয়ে দিয়েছিলো?
“দিতে কি আর রাজি ছিলো? কিন্তু পাব্লিকের মার বলে কথা, বেটাকে এমন ধোলাই এর মুখে রাখা হয়েছিলো যে তখন নিজের জীবন বাচাঁনোটাই বড় ছিলো তার কাছে।। সেদিন রাতে একটা ঘরে তাকে আটকে রাখা হয়েছিলো পরের দিন পুলিশে দেওয়া হবে এই ভেবে। কিন্তু কিভাবে যে পালিয়ে গেলো কেউ টেরই পেলো না।

তিথী বিস্ময়ে বললো
“আজো কেউ জানেনা উনি কোথায়?
“নাহ। কারো ঠেকাও পরেনি তার খবর নেওয়ার।
তিথী চিন্তিত গলায় আবারও প্রশ্ন করলো
“উনার পরিবারের বাকি সদস্যরা?
ছেলেটি চিন্তিত হয়ে বললো
“বাকিরা তো তখন কেউ বাসায় ছিলো না। আমি যতটুকু জানি, তিনি একাই থাকতেন বাসায়।
তিথীকে আবারও নিশ্চুপ দেখালো। ছেলেটি সেটা খেয়াল করে বললো
“তা আপনি কে? সেই বাটপারের খোঁজ খবর কেন নিচ্ছেন আপনি? আপনিও কি ভুক্তভোগী নাকি? তিনি কি আপনারো কিছু কেড়ে নিয়েছিলো?
তিথী চমকে তাকালো লোকটির দিকে। লোকটি জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে আছে তিথীর দিকে। তিথী আচমকা বললো
“জ্বি, আমিও ভুক্তভোগী। তবে আমার থেকে সে যেটা কেড়ে নিয়েছে, সেটা সবার চাইতে আলাদা, সবার চাইতে দামী। আমার জীবনের সবচেয়ে দামী জিনিসটাই আমি তার কারণে হারিয়েছি।
লোকটি অবাক চোখে তাকিয়ে আছে তিথীর দিকে। তিথীর চোখের কোনে পানি চিকচিক করছে। লোকটি বললো
“আপনি কাঁদছেন?
“ও কিছু না।
মুচকি হেসে চোখের পানি মুছে সেখান থেকে হাঁটা ধরলো তিথী। সে বাড়ির কাছে আবারও গেলো সে। এ বাড়িটায় সে একসময় নিজের প্রিয় মানুষটার কাছাকাছি থাকতো, কত ভালো ভালো সময় তারা কাটিয়েছে তার হিসেব নেই। যদিও ভালোবাসা কি সেটা তখন তাদের দুজনার কাছেই অজানা ছিলো। তবে বয়স যত বেড়েছে, ভালোবাসাটা ততই মনের মধ্যে নাড়া দিতে থাকতো।

তিথী এগিয়ে গেলো সেই মেহগনি গাছটার কাছে। এ গাছটা তখনও ছিলো, এখনও আছে। পার্থক্য, তখন এটা ছোট ছিলো, আর এখন বড় হয়ে গেছে। ছোটবেলায় সে মজার ছলে গাছের গায়ে ধারালো যন্ত্র দিয়ে আঁকাবাঁকা করে নিজের নামের প্রথম অক্ষর ‘ই’ আর তিথীর নামের প্রথম অক্ষর ‘ত’ লিখেছিলো। অক্ষরগুলো এখনো আছে, তবে অস্পষ্ট। তিথী সেগুলোতে হাত বুলালো বারংবার। তিথীর কানে ভেসে আসলো তখনকার সেই কথাগুলো—

‘আমার আর তোর নামের অক্ষর এখানে লিখে রাখলাম তিথী।
‘কেন লিখেছো?
‘প্রমাণ রাখলাম, যদি বড় হয়ে ভুলে যাস আমাকে বিয়ে করার কথা সে কারণে।
‘যদি ভুলে যাই তখন কি হবে?
‘কি আর হবে, আমি আমার বর পুতুলটাকে তোর কাছ থেকে নিয়ে যাবো এই যা।
তিথী আতংকিত গলায় বললো
‘না, আমি দিবো না আমার পুতুল।
ছেলেটি হেসে বললো
‘ভুলে গেলে জোর করে নিয়ে যাবো বলে দিলাম।
‘প্রমিস, ভুলবো না। তুমি আমার বর পুতুলটা নিও না প্লিজ।
‘আচ্ছা, নিবো না।

গা জুড়ানো বাতাসে আলোড়িত হলো তিথী। দুপুরের কড়া রোদ সরে গিয়ে বিকেলের মৃদু আলো গায়ে ঠেকেছে। তিথীর মনে হলো এবার তার যাওয়া উচিত। সে পা বাড়ালো শহরের উদ্দেশ্যে।

সারাদিন অনেক অনুনয় করার পরেও রিয়ানাকে লং ড্রাইভে যাওয়ার জন্য রাজি করাতে পারেনি ইনাম। রিয়ানার এক কথা, সে কেন বিনা কারণে উনার সাথে লং ড্রাইভে যাবে? যাওয়ার হলে সে তার সাথেই যাবে যাকে সে ভালোবাসে। আর রিয়ানার ভালোবাসার মানুষটি নিশ্চয়ই ইনাম নয়। ইনাম ব্যর্থ হয়ে মন খারাপ করেই বসে রইলো রবিনের পাশে। রবিন জানে ইনাম রিয়ানাকে ভালোবাসে। কিন্তু এখানে রবিনেরও কিছু বলার নেই। কাউকে জোর করে তো আর ভালোবাসানো যায় না। রবিন নিজের মতই বসে রইলো।।

ইনাম ওকে ধাক্কা দিয়ে বললো
“তুই কিছু বলবি না?
রবিন বিরক্তি নিয়ে বললো
“আমি কি বলবো? ও যদি তোকে পছন্দ না করে তাহলে সেখানে আমার কি করার আছে?
“তুই করবি না তো কে করবে? তোর জন্য আমি কম করেছি?
রবিন রেগে গিয়ে বললো
“কি করেছিস আমার জন্য?
ইনাম ভারী গলায় বললো
“এতো তাড়াতাড়িই ভুলে গেলি বেইমান?
রবিনের মুখটা চুপসে গেলো হঠাৎ। ইনাম আবারও বলতে লাগলো
“রিয়ানা তোকে কেন পছন্দ করতে গেলো রে? আমি কি তোর চেয়ে কম সুন্দর?
রবিন ঠোঁট উল্টিয়ে বললো
“মোটেও না।
“তাই তো, তাহলে ওর আমাকে ভালোবাসতে অসুবিধাটা কোথায়? আমার তো এখন ভয় হচ্ছে।
“কিসের ভয়? কপালে ভাজ টেনে বললো রবিন।
ইনাম আহতস্বরে বললো
“কোনদিন না জানি তুই রিয়ানাকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যাস।

রবিন হঠাৎ বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। চোখেমুখে ভাজ পরলো তার। গম্ভীরমুখে বললো
“সেটা কখনোই হবার নয়।
রবিন ইনামের দিকে তাকিয়ে আবারও ভারী গলায় বললো
“আমার মনে কে আছে সেটা তুই ভালো করেই জানিস। এ জীবনে তাকে আমি ভুলিনি, এ জীবন থাকতে তাকে কখনোই ভুলবো না। আমার জীবনটা শুধুই তার জন্য রাখা। ইনাম দাঁড়িয়ে রবিনের পিঠ চাপড়ে বললো
“বেটা, এতো ইমোশনাল কেন হচ্ছিস বলতো? আমিতো ফাইজলামু করে বললাম।
“সব যায়গায় ফাইজলামু চলে না ইনাম।
রবিন হনহন করে বেরিয়ে গেলো বাসা থেকে।

রাত তখন সাতটা কিংবা সাড়ে সাতটা। তিথী সবেমাত্র বাস থেকে নেমেছে। বাসা পর্যন্ত যেতে আরো প্রায় ঘন্টাখানেক লেগে যাবে। তবে রাস্তায় যদি জ্যাম থাকে, তাহলে আরো বেশিও লাগতে পারে। তিথী সিএনজির অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। রাত হওয়ায় প্রচুর ভাড়া চাচ্ছে তারা। তিথীর কাছে যথেষ্ট টাকা আছে যাওয়ার মতো। তবে সে চাইছে আরেকটু কমে যাওয়ার। যদি কিছু সময় চেষ্টা করে কমে যাওয়া যায় তবে ক্ষতি কি!
তিথী এদিক ওদিক কিছু সিএনজির খোঁজ করলো। অনেকে রাজি হলো নিয়ে যাওয়ার জন্য, তবে ভাড়ার জন্য যেতে পারছেনা সে। একসময় বাধ্য হয়েই বেশি ভাড়ার এক সিএনজি তে উঠার সিদ্ধান্ত নিলো তিথী। তিথী সাইড ব্যাগটা কাধে ঝুলিয়ে সিএনজি তে উঠার জন্য পা বাড়ালো তখনই পেছন থেকে ডাক এলো

“এতো রাতে তুমি এখানে কি করছো তিথী?
হঠাৎ এমন কথায় ঘাবড়ে গেলো তিথী। চট করে পেছনে তাকাতেই দেখতে পেলো বিস্মিত দৃষ্টি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রবিন। তিথী স্বস্থির নিশ্বাস ছেড়ে বললো
“আপনি এখানে?
“আমি এখানে থাকাতে কি তোমার কোনো সমস্যা হচ্ছে?
এমন রুক্ষ উত্তরে তিথীর মেজাজ খারাপ হলো। পাব্লিক প্লেস বিধায় নিজেকে সংযত করে বললো
“আমি এখানে থাকাতেও বোধহয় আপনার কোনো প্রব্লেম হচ্ছেনা!!
তিথী সিএনজিতে উঠার জন্য আবারও পা বাড়ালো তখন রবিন হ্যাচকা টানে তিথীকে টেনে নিলো। এবারে রেগে গেলো তিথী। রবিনের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বাজখাঁই গলায় বললো
“করছেন টা কি আপনি? বুদ্ধিসুদ্ধি লোপ পেয়েছে? রাস্তার মাঝখানে একটা মেয়ের সাথে কেমন বিহেভ করা লাগে ধারণা আছে আপনার? লোকে কি ভাববে ভেবে দেখেছেন একবার?
“লোকে যা ভাবার ভাবুক। তুমি এতো রাতে এখানে কি করছো সেটা বলো। এখানে এতদুর এসেও কি কাউকে পড়াও নাকি?

তিথী শান্ত হয়ে দাঁড়ালো এবার। সে চাইছে না উত্তেজিত হতে। রবিন আবারও তাকে তাড়া দিয়ে প্রশ্ন করলো। তিথী শান্ত গলায় বললো
“গিয়েছিলাম এক যায়গায়।
“কোথায়?
“আপনাকে কেন বলতে যাবো? অনেক রাত হয়েছে, আমাকে বাসায় যেতে হবে।
“আমার বাইকে এসো।
বাইকে উঠতে আপত্তি জানালো তিথী। এটা নিয়েও দু’দন্ড তর্ক বিতর্ক হয়ে গেলো তাদের মাঝে। শেষে নিরুপায় হয়ে তিথী উঠে বসলো রবিনের বাইকে।

ফুরফুরে হাওয়া বইছে, রাত হওয়ায় হাওয়াটা বেশ ঠান্ডা। বাইকের স্পিডে সেই বাতাশ গায়ে এসে বাড়ি দিচ্ছে, ভালোই লাগছে তিথীর। সারাটা রাস্তায় রবিনের নজর ছিলো শুধুমাত্র বাইকের দিকেই। বাড়তি কোনো কথা সে বলেনি। প্রায় পঁচিশ মিনিটের মাথায় এসে তিথীর হোস্টেলের সামনে এসে বাইক দাড় করালো রবিন। তিথী নিশ্বব্দে বাইক থেকে নেমে রবিনের দিকে ফিরে তাকালো।
“আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ, তবে আমি সিএনজি করেই চলে আসতে পারতাম।
“আমি’তো তোমাকে আনতে যাই নি সেখানে। এতো রাতে তোমাকে সেখানে দেখতে পেলাম তাই। শত হলেও তুমি আমার ইভানার টিচার, একা ফেলে আসি কি করে।
তিথী আর কথা বাড়ালো না। সে উল্টোদিকে ফিরে হোস্টেলের দিকে হাঁটা ধরলো। রবিন পেছন থেকে গলা ছেড়ে বললো
“কোথায় গিয়েছিলে সেটা তো এটলিস্ট বলতে পারো নাকি।

তিথী যেতে যেতেই উত্তর দিলো
“গিয়েছলাম একটা গ্রামে। গ্রামের নাম ফুলপুর….

তিথী আর পেছনে তাকায় নি, তাকালে হয়তো দেখতে পেতো ফুলপুর নাম শোনার পরে রবিনের মুখাবয়ব টাই পালটে গেছে। এক যায়গায় স্তব্ধ হয়ে জমে গেছে রবিন নামের সেই ছেলেটি।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here