হৃদয়ও_মাঝারে-১৪,১৫

0
639

#হৃদয়ও_মাঝারে-১৪,১৫
তন্বী ইসলাম
১৪

“কোথায় গিয়েছিলে সেটা তো এটলিস্ট বলতে পারো নাকি।

তিথী যেতে যেতেই উত্তর দিলো
“গিয়েছলাম একটা গ্রামে। গ্রামের নাম ফুলপুর….

তিথী আর পেছনে তাকায় নি, তাকালে হয়তো দেখতে পেতো ফুলপুর নাম শোনার পরে রবিনের মুখাবয়ব টাই পালটে গেছে। এক যায়গায় স্তব্ধ হয়ে জমে গেছে রবিন নামের সেই ছেলেটি।

আগের দিন সারাদিন জার্নি প্লাস অনেক রাত করে ফেরার কারণে বেশ ক্লান্ত হয়ে গেছিলো তিথী। ফেরার পর ফ্রেশ হয়ে খাওয়া দাওয়া সেড়ে শুতে শুতে অনেক রাত হয়ে যায়। যে কারণে সকালে আর ঘুম থেকে উঠতে পারেনি। যখন উঠেছে তখন প্রায় সাড়ে আটটার মতো বাজে। তিথী ধরফরিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে। ফারিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চুল আঁচড়াচ্ছিল। তিথী কিছুটা অবাক হয়ে বললো
“কোথাও যাচ্ছো?
“হুম। হাসিমুখে উত্তর দিলো ফারিন।
“কোথায়?
ফারিন তিথীর সামনে এসে চুপিসারে বললো
“বয়ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি।
তিথী মুচকি হেসে বিছানা ছেড়ে নেমে বললো
“তোমার বয়ফ্রেন্ড নেই সেটা আমি জানি। যাচ্ছো কোথায় সেটা বলো।
ফারিন তৈরি হতে হতে বললো
“বাড়ি থেকে মা কল করেছে, জরুরি ডাক পরেছে আমার। তাই বাড়ি যাচ্ছি।
মুহুর্তেই তিথীর মুখখানা কালো হয়ে গেলো। আজ যদি তারও একটা পরিবার থাকতো, তাহলে তো সেও যেতে পারতো।
তিথী ওয়াশরুমের দিকে হাঁটা দিয়ে বললো
“সাবধানে যেও। আর আমাকে সকালে ডাকতে পারতে। প্রাইভেট টা মিস হয়ে গেলো।
“ডেকেছি দুইবার, কিন্তু তুমি এতটাই গভীর ঘুমে ছিলে, যে আমার ডাক তোমার কান পর্যন্ত যায় নি।

তিথী আর ফারিন একসাথেই বাসা থেকে বের হলো। গেইটের বাইরে এসে ফারিন চলে গেলো একদিকে আর তিথী চলে গেলো আরেকদিকে। তিথীর গন্তব্য ভার্সিটি যাওয়া। ভার্সিটিতে গিয়েও আজ মন টিকছে না তিথীর। না ক্লাসে আর না ক্যান্টিনে। বার বার নিজের কাছে নিজেকে একা মনে হচ্ছে। দুটো ক্লাস কোনোমতে শেষ করে তিথী কলেজ থেকে বেরিয়ে পরে। তবে কোথায় যাবে সে ভেবে পাচ্ছেনা। হোস্টেলে ফিরতে ইচ্ছে করছে না। ফারিন নেই সেখানে। ভার্সিটিতেও ভালো লাগছে না। কোথায় যাবে সে? শেষে ডিসাইড করলো ইভানাদের বাসায় যাওয়া যাক। কিছুটা সময় ওখানে কাটিয়ে একেবারে ইভানাকে পড়িয়ে তারপর বাসায় ফিরবে। যেহেতু অনামিকার বাসায় যাওয়ার ঝামেলা নেই, তাই কোনো চিন্তাও নেই।

যেই ভাবা সেই কাজ। তিথী চলে গেলো ইভানাদের বাড়ি। একবার কলিংবেল বাজাতেই রিয়ানা এসে দরজাটা খুলে দিলো। তিথী তার হাস্যজ্বল মুখে বললো
“কেমন আছো রিয়ানা?
“ভালো আছি। তুমি কেমন আছো? আজ এতো আগে আগে চলে এলে যে।
তিথী ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বললো
“আসলে ভার্সিটিতে মন টিকছিলো না, হোস্টেলে ফিরতেও ইচ্ছে করছেনা। আমার একটা ফ্রেন্ড আছে, যার সাথে আমি হোস্টেলে থাকি, সে আজ বাড়ি চলে গেছে। খুব একা লাগছিলো, তাই চলে এলাম এখানে।
রিয়ানা হেসে বললো
“খুব ভালো করেছো তিথী। ভেতরে এসে বসো। আমি আপাকে ডেকে দিচ্ছি।

তিথী সোফায় বসে আছে। এমন সময় ইভানার মা ভেতর রুম থেকে বেরিয়ে আসলো। তিথীকে দেখে মুচকি হেসে বললো
“কি খবর তিথী? আজ আসো নি যে সকালে?
তিথী লজ্জাসুচক হাসি হেসে বললো
“আসলে কি হয়েছিলো সে জানে, সকালে উঠতেই পারিনি। আপনারা ভাববেন না, আমি এখন সকালের পড়াটাও পড়িয়ে যাবো।
“ইটস ওকে তিথী৷ তোমাকে তো আমরা জরিমানা ধরি নি যে সকালের পড়াটাও এখন পড়িয়ে যেতে হবে। জাস্ট জিজ্ঞাসা করছিলাম।
“ইভানা কোথায় ভাবী?
“ঘুমোচ্ছে। তুমি দুপুরে খেয়েছো তিথী?
তিথী আমতা-আমতা করে বললো
“নাহ মানে, সকালে খেয়ে বেরিয়েছিলাম।
ইভানার মা হেসে বললো
“তারমানে তুমি দুপুরে কিছু খাও নি। এসো আমার সাথে, খাবে তুমি।
তিথী লজ্জিত গলায় বললো
“না না, আমার খিদে নেই।
“এসো তো বলছি। রিয়ানা তিথীকে এক প্রকার টেনে নিয়ে খাওয়ার টেবিলে বসালো। তিথীর বেশ লজ্জা পেলো এবার। এভাবে এই দুপুর টাইমে এখানে আসাটা তার উচিত হয় নি।
তিথী যখনই খাবার থেকে এক লোকমা মুখে তুলে নিলো তখনই রবিন আর ইনাম এসে বাসায় ঢুকলো। ডাইনিং রুমে তিথীকে এই বেলা খেতে দেখে অবাক হলো তারা দুজনেই। দুজন দুজনার মুখের দিকে একবার তাকিয়ে ড্রয়িং রুমের দিকে এগিয়ে গেলো। সোফায় হেলান দিয়ে বসে ইভানার মাকে ডাকতেই রিয়ানা দৌড়ে গেলো সেখানে। হাসিমুখে রবিনের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো
“কি লাগবে তোমার?

রবিন রিয়ানার দিকে একবার তাকিয়ে বিরক্তির সাথে বললো
“তোমায় ডেকেছি আমি? এতো লাফাও কেন? আমার কিছু দরকার নেই, হয়তো ইনামের দরকার আছে। ওকে জিজ্ঞাসা করো কি লাগবে।
রিয়ানা মুখ বাকা করে বললো
“তুমি সবসময় আমার সাথে এভাবে কথা বলো কেন?
“তো কিভাবে কথা বলবো আমি?
হুট করে রবিনের মাথা গরম হয়ে গেলো। সে প্রচন্ড রাগে সেখান থেকে উঠে নিজের রুমের দিকে চলে গেলো। ইনাম বসে রইলো আগের যায়গাতেই। রিয়ানা বিস্ময়ে তাকিয়ে বললো রবিনের যাবার দিকে। রবিন যখন রুমের ভেতর ঢুকে ভেতর থেকে দরজাটা লাগিয়ে দিলো তখন অটোমেটিক ভাবেই রিয়ানার চোখদুটো ভিজে গেলো। যে মানুষটাকে সে এতটা ভালোবাসে, সে মানুষটা তাকে ঠিক ততটাই ইগ্নোর করে।

ইনামের নজর এড়ালো না কিছুই। নিজের ভালোবাসার মানুষের চোখের অন্য একজনের জন্য পানি দেখে তার ভেতরটাও খা খা করে উঠলো। তবুও নিজেকে স্বাভাবিক করে রিয়ানা কে ডাকলো ইনাম।
“রিয়ান..
রিয়ানা তার ছলছল চোখে ইনামের দিকে ফিরে তাকালো। ইনামের সহ্য হলো না দৃশ্যটা। ইনাম বললো
“বসো এখানে।
রিয়ানা বাধ্য মেয়ের মতো সোফায় বসলো। তবে চোখের কোনে পানি এখনো আছে। ইনাম বেশ আবেশে বললো
“আমি এখন তোমায় যে কথাগুলো বলবো, হয়তো কথাগুলো শুনতে তোমার কাছে বেশ খারাপ লাগবে। তবে কষ্ট সারাজীবন পাওয়ার চেয়ে একবারে পেয়ে যাওয়াটাই ভালো। আমার মনে হচ্ছে, তোমার জানা উচিৎ ।
রিয়ানা অবাক হয়ে তাকালো ইনামের দিকে। বিস্ময়ে প্রশ্ন করলো
“কিসব বলছেন আপনি?
“আমি জানি তুমি ওকে ভালোবাসো। ভালোবাসাটা স্বাভাবিক, অস্বাভাবিক কিছুই নয়। তবে এটা স্বাভাবিক হওয়া সত্বেও চাইলেই সবাইকে ভালোবাসা যায় না। সবারই নিজস্ব একটা পছন্দ আছে, নিজস্ব চাওয়া পাওয়া আছে।

ইনাম এবার কয়েক সেকেন্ডের জন্য থামলো। জোরে জোরে কয়েকটা নিশ্বাস ছেড়ে আবারও রিয়ানার দিকে তাকালো। কন্ঠ ভারী হয়ে আসছে তার। ইনাম আবারও বললো
“আমার বলতে কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু এটা তোমার জেনে রাখা উচিৎ, ওকে তুমি কখনোই পাবে না।
রিয়ানা চোখমুখ শক্ত করে বললো
“কেন পাবো না তাকে?
“কারণ সে অন্য কাউকে ভালোবাসে।
রিয়ানা চমকে উঠলো। বিস্ফোরিত গলায় বললো
“কাকে?
“একটা মেয়েকে সে জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসে। কাকে জানতে চেও না।

রিয়ানা সোফায় হেলান দিয়ে শুয়ে পরলো। তার দেহ থেকে আত্মাটা যেনো বেরিয়ে যাচ্ছে। ইনাম বললো
“তুমি কি চাও সে তার ভালোবাসার মানুষটাকে ছেড়ে তোমায় বিয়ে করুক? যদি কখনো এমনটা হয়ও, তবে কি তুমি সুখী হতে পারবে? হয়তো জোর করে ওকে বিয়ে করতে পারবে তুমি, কিন্তু মনটা পাবে না। মনটা পরে রবে ওর ভালোবাসার মানু্ষটার কাছেই। এখন তুমিই ডিসাইড করো, কি করবে তুমি!
রিয়ানা কিছুটা সময় নির্বাক দৃষ্টিতে উপরের দিকে তাকিয়ে রইলো। এরপর হঠাৎ ই ইনামের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বললো
“তারপরও আমি ওকেই ভালবাসি। আমি ওকেই চাই।
ইনাম আশাহত হলো, রিয়ানা আর একদন্ড সেখানে না দাঁড়িয়ে চলে গেলো ইভানার মায়ের কাছে। তিনি তিথীকে পরিবেশন করাচ্ছেন।

রিয়ানাকে এমন ছন্নছাড়ার মতো দেখে অবাক হলেন তিনি।
“রিয়ানা, এ কি হাল তোর চোখে মুখের? কিছুক্ষণ আগেও তো দেখলাম সব ঠিক আছে। হঠাৎ কি হয়ে গেলো?
রিয়ানা তিথীর দিকে তাকিয়ে বলল
“তোমার সামনে যদি কিছু ব্যক্তিগত কথা আপুর সাথে বলি তুমি মাইন্ড করবে তিথী?
তিথী বিস্ময়ে বললো
“আমার খাওয়া শেষ রিয়ানা। আমি এখান থেকে সরে যাচ্ছি, তোমরা কথা বলো।
তিথী সেখান থেকে সরে ড্রয়িংরুমের দিকে এগিয়ে এলো। রিয়ানা কিংবা ওর বোন কেউ তেমন বাধা দিলো না।

ইনামকে ড্রয়িংরুমে নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকতে দেখে অবাক হলো তিথী। এ কখন এসেছে? আর মন খারাপ করেই বা আছে কেন? তিথী এগিয়ে গেলো ইনামের কাছে। তিথীকে দেখে মাথা তুলে সামনে তাকালো ইনাম। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো
“ওহ তুমি। এসো এখানে, বসো।
তিথী গিয়ে সোফার এক মাথায় জড়োসড়ো হয়ে বসে পরলো। ইনাম ধীরস্থির গলায় প্রশ্ন করলো
“ও বাসার কাজটা ছেড়ে আসলে কেন?
তিথী অবাক হয়ে বললো
“আপনি জানেন?
“হুম। অনামিকা আন্টি বলেছে আমায়। উনার সাথে বেশ রাগারাগি করে নাকি চলে এসেছো।
তিথী নরম গলায় বললো
“যেখানে সম্মান নেই সেখানে কাজ করার মানে নেই। আমি কাজ করি পেটের দায়ে, তার মানে এই নয়, নিজের সম্মান বিসর্জন দিয়ে আমাকে সেখানে পরে থাকতে হবে। প্রতিনিয়ত আমি উনার কাছে অপমানিত হই, উনি আমাকে যা ইচ্ছে তাই বলে কথা শোনায়। আর সহ্য হচ্ছিলো না আমার।

ইনাম নরম গলায় বললো
“উনার ক্যারেক্টর আমার বেশ ভালোই জানা আছে। উনাকে আমার কাছেও তেমন সুবিধার মনে হয় না। বাবার বিজনেস পার্টনার, তাই না চাইতেও উনাকে সহ্য করতে হয়।
বাবা কথাটা শুনে তিথীর মনে হলো উনার বাবার ব্যাপারে একটু জানার দরকার। তিথী বিচলিত হয়ে প্রশ্ন করলো
“আচ্ছা আপনার বাবা কোথায় থাকে? দেখিনি তো কখনো। আর আপনার বাবা করেই বা কি? বাড়ি কোথায় আপনাদের?
ইনাম অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো তিথীর দিকে। তিথী লজ্জা পেয়ে বললো
“আমি কি কিছু ভুল প্রশ্ন করেছি?
ইনাম হাসলো, বললো
“নাহ! তবে একসাথে অনেকগুলো প্রশ্ন করে ফেলেছো।
তিথীও হাসলো, লজ্জার হাসি।

ইনাম বললো
“আমার বাবা এহসানুল হক, বিজনেসের কাজে বিদেশেই থাকে বেশি। কিছুদিন আগে দেশে ফিরেছে। আপাতত বাসাতেই আছে, রেস্টে। বয়স হয়েছে, কিছুটা অসুস্থও তিনি।
তিথী লম্বা নিশ্বাস ছেড়ে মনে মনে ভাবলো, ‘এ এহসানুল হক সে এহসানুল হক হতেই পারেনা। তিনি তো নিঃস্ব হয়ে পালিয়ে এসেছিলেন।
ইনামের কথায় ঘোর কাটলো তিথীর।
“কিছু কি ভাবছো?
তিথী মাথা তুলে তাকালো। মৃদু হেসে বললো
“আচ্ছা আপনার গ্রামের বাড়ি কোথায়?
ইনাম কিছু বলতে যাবে তার আগেই রবিন এসে উপস্থিত হলো সেখানে। কড়া গলায় বললো
“তুই যদি রিয়ানাকে সত্যিই ভালোবেসে থাকিস তাহলে ওকে তুই সামলা। আমার ঘাড়ের উপর ছেড়ে দিস না বলে দিলাম।

ইনাম অবাক হলো, হঠাৎ ও এমন কথা কেন বলছে। তিথীর মুখ থেকে বিস্ময়ে বেরিয়ে এলো
“আপনি রিয়ানাকে ভালোবাসেন?
ইনাম খানিক সময়ের জন্য অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। কি বলবে না বলবে মাথায় আসছে না তার। তারচেয়ে বড় কথা, ও হঠাই তার উপরই কেন রেগে গেলো? কি এমন হয়েছে?
ইনাম রবিনকে কিছু বলার জন্য উঠে দাঁড়াতেই দেখতে পেলো রিয়ানা বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে ইনামের দিকে। ইনাম ঘাবড়ে গিয়ে বললো
“রি-রিয়ানা…
রিয়ানা ছলছল চোখে ইনামের দিকে দৃষ্টিপাত করে ভারী গলায় বলে উঠলো
“আপনি ভালোবাসেন আমায়?

চলবে….

#হৃদয়ও_মাঝারে-১৫
তন্বী ইসলাম

রিয়ানা ছলছল চোখে ইনামের দিকে দৃষ্টিপাত করে ভারী গলায় বলে উঠলো
“আপনি ভালোবাসেন আমায়?
ইনামের নিশ্বাস ভারী হয়ে গেলো, হাত পা কাঁপতে শুরু করলো তার। শেষ পর্যন্ত রিয়ানা জেনেই গেলো ইনামের ভালোবাসার কথা। ইনাম কিছু বলার আগে রিয়ানা আবারও বলে উঠলো
“কেন উত্তর দিচ্ছেন না আপনি?
ইনাম এবার লম্বা নিশ্বাস ছেড়ে ভারী গলায় বললো
“হুম।
রিয়ানা হেসে উঠলো এবার, সবাই অবাক হয়ে তাকালো রিয়ানার দিকে। ইভানার মা রিয়ানার দু বাহুতে চেপে ধরে বলল
“পাগলের মতো হাসছিস কেন?
রিয়ানা হাসি থামিয়ে আবারও ইনামের দিকে তাকালো। কটাক্ষের স্বরে বলল
“এবার বুঝতে পারলাম আপনি কিছুক্ষণ আগে ওকে নিয়ে এইসব কেন বলেছেন। আসলে আমায় ভালোবাসেন কিনা, তবে আমিতো ওকে ভালোবাসি, যে কারণে ওর নামে যা তা বলে আমার মন তার থেকে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন তাইনা? যদি এটাই হয়ে থাকে, তবে আপনার চিন্তাধারা সম্পুর্ন বিফলে গেলো। কারণ আমি আপনাকে কখনোই ভালোবাসিনি আর ভালো বাসবোও না।

ইনাম আশাহত হলো। তবে জবাব দেওয়ার মতো তার কাছে কিছুই নেই। যদি এখন সে নিজের কথাগুলোকে সত্য প্রমাণ করতে কিছু বলে তবুও রিয়ানা ধরেই নিবে, এটাও একটা মিথ্যা।

রবিন আক্ষেপে রিয়ানার দিকে তাকালো। বললো
“তুমি সত্যিই অনেক স্বার্থপর রিয়ানা।
রিয়ানা চিৎকার করে বলে উঠলো
“হ্যাঁ আমি স্বার্থপর, কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্বার্থপর হওয়া জরুরি। তা না হলে চলা যায় না। আমি তোমাকে পাবার জন্য স্বার্থপর হতেও রাজি আছি বুঝেছো তুমি? আর হ্যাঁ আপনি…
কথাটা বলে ইনামের দিকে তাকালো রিয়ানা। ইনাম আহত দৃষ্টিতে তাকালো রিয়ানার দিকে। রিয়ানা শক্ত গলায় বললো
“ঠিক এই মুহুর্ত থেকে আমাকে আপনি ভুলে যাবেন। আর না ভুললেও আমার কিছু যায় আসবে না। কষ্ট পেলে আপনি পাবেন, আমি না। সো, আপনি কি করবেন সেটা সম্পুর্নই আপনার ব্যাপার।

রিয়ানা রুমে যাবার জন্য পা বাড়ালো, দু পা এগিয়ে আবারও ফিরে তাকালো সে। নিজের বোনের দিকে তাকিয়ে বললো
“দুলাভাইকে ফোন করে বলে দাও বাসায় ফিরতে। ইভানার মা অবাক হয়ে সামান্য রাগতস্বরে বললো
“কেন?
“তোমার দেবরের সাথে আমার বিয়ে হবে তাই।
রিয়ানা কাউকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো। স চলে যাবার পর পরিবেশটা একদমই থমথমে হয়ে গেলো। কারো মুখে কোনো কথা নেই। সোফার একপাশে মেজাজ শক্ত করে রবিন বসে আছে। ইনাম আগের যায়গাতেই শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তিথীর নিজের কাছে মনে হচ্ছে, এমন পরিস্থিতিতে তার এখানে থাকাটা উচিৎ ছিলো না। ইনাভার মা এবার মুখ খুললো। লজ্জিত গলায় ইনামকে ডেকে বলল
“আমায় মাফ করো ভাই, আমার বোন তোমায় আজ ছোট করলো, অপমান করলো। আসলে ও হঠাৎ এমন কেন করছে সেটা আমারও মাথায় আসছে না।
ইনাম ধীরস্থির গলায় বললো
“ইট’স ওকে ভাবী। আমারও উচিৎ হয়নি একতরফাভাবে ওকে ভালোবাসা।

ইনামের কথায় অবাক হয়ে তাকালো রবিন। এর মধ্যে তিথী বলে উঠলো
“আজ নাহয় আমি চলেই যাই। এমন অবস্থায় ইভানার পড়াতেও আমি মন বসাতে পারবো না। আগামীকাল সকাল সকাল নাহয় চলে আসবো।।তিথীর কথায় সায় দিলো ইভানার মা। তিথী ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যখন বাসা থেকে বেরোতে যাচ্ছিলো তখনই তাকে পেছন থেকে ডাকলো ইনাম।
“তিথী!
“কিছু বলবেন?
“আমাকেও ফিরে যেতে হবে। চলো, দুজন এক সাথেই যাই।
তিথী আর না করতে পারলো না। লোকটার মনের ভেতর কি চলছে তিথী সেটা কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পারছে। তিথী মুচকি হেসে বললো
“আসুন তাহলে।

রাস্তায় পাশাপাশি হাঁটছে তিথী আর ইনাম। দুজনেই নিশ্চুপ। ইনামের চোখদুটো লাল হয়ে আছে। যেকোনো সময় অঝোর ধারায় বর্ষণ শুরু হয়ে যেতে পারে। তিথী সবটাই লক্ষ করছে। এ অবস্থায় তার কি করা উচিৎ কিছুই মাথায় আসছে না। ইনামের মন মানসিকতা আগে ঠিক করা দরকার। কিন্তু কিভাবে?
তিথী ইনামের দিকে তাকালো। মুচকি হেসে বললো
“আজ দুপুরে খেয়েছিলেন কিছু?
ইনাম তিথীর দিকে তাকালো একবার। এরপর ঠোঁটের কোনে জোরপূর্বক হাসি টেনে বললো
“হ্যাঁ।
ওরা আবারও হাঁটছে। কিছুটা দূর এগিয়ে ইনাম বললো
“একটা কথা বলবো তোমায় তিথী?
“হুম বলুন..
“রাগ করবে না তো আবার?
“শুধু শুধু রাগ কেন করতে যাবো?
ইনাম এবার হাঁটা থামিয়ে দাঁড়িয়ে পরলো। তিথীও দাঁড়ালো।
“তুমি বিশ্বাস করবে কিনা জানিনা, তোমাকে আমার বেশ পরিচিত মনে হয়। মনে হয় কোথায় যেনো তোমাকে দেখেছি। জানিনা কোথায়, তবে এমন টা আমার মনে হয়। আর সবচেয়ে বড় কথা, আমার এক পরিচিত মানুষের নামের সাথে তোমার নামের হুবহু মিল। জানিনা এখন সে কোথায় আছে। আল্লাহ যদি তাকে সুস্থ রাখে, তাহলে বোধহয় সে এতদিনে তোমার মতই হয়েছে।

তিথী চমকে তাকালো ইনামের দিকে। তিথীও প্রথমদিকে ইনামের নাম আর ওর বাবার নামের কারণে কিছুটা সন্দেহ করেছিলো, এখন ইনামের মুখে এই কথা শোনে সন্দেহটা আরো তীব্র আকারে বেড়ে গেলো। তিথী হন্তদন্ত হয়ে বললো
“কে আপনি? গ্রামের বাড়ি কোথায় আপনার? আর আপনার বাবা, উনার সম্পর্কেও জানতে চাই আমি।
ইনাম জোরপূর্বক হাসিটা টেনে যখনই কিছু বলতে যাবে তখনই তিথীর ফোনটা বেজে উঠে। পরিস্থিতি সামলে তিথী পার্স থেকে ফোনটা বের করে। ইনামের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে ভদ্রতার সহিত ফোনটা রিসিভ করে সে। হাসি হাসি মুখ করে বলে
“আরে ফারিন, কি খবর? বাড়ি গিয়ে তো ভুলেই গেলে। তা ঠিকঠাক ভাবে গিয়ে পৌছেছো তো? বাড়ির সবাই কেমন আছে?

ওপাশ থেকে কি উত্তর আসলো তা অজানা। তবে তিথীর মুখটা হঠাৎ ই ফ্যাকাসে বর্ণ ধারণ করলো। মুখের অবয়ব পালটে সেখানে দেখা গেলো একরাশ আতংক। চোখেমুখে স্পষ্ট কালো ছায়া। ফোনটা রাখার পর তিথী থমথমে মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো আগের যায়গাতেই। ইনাম বুঝতে পারলো কিছু একটা হয়েছে। সে তিথীকে প্রশ্ন করলো
“এনি প্রব্লেম তিথী?
তিথী উত্তর দিলো না কিছু। সে আবারও জোরপূর্বক প্রশ্ন করলো
“আমায় বলো তিথী কি হয়েছে। তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? কোনো বিপদ হলো না তো?
তিথী ঘুরে তাকালো ইনামের দিকে। নিষ্পাপ চাহনি তার, তবে সে চাহনিতে তীব্র ব্যথা স্পষ্ট। তিথী তার মলিন গলায় বললো
“আমাকে যেতে হবে এখন।

তিথী একা ছুটতে লাগলো। ইনাম হঠাৎ তিথীর হাত ধরে বাধ সাধলো। নরম গলায় বললো
“তোমার কি হয়েছে আমাকে বলো, যদি কোনো বিপদ হয়ে থাকে, তবে আমি তোমার পাশে থাকতে চাই। এ বিপদে তোমায় সাহায্য করতে চাই।

_________
আরো কিছুদিন পার হয়ে গেলো। তিথীর ভার্সিটি, টিউশন ঠিকঠাক ভাবেই যাচ্ছে। এরমধ্যে তিথী একটা কোচিং এ জয়েন করেছে। বিকেলে ইভানাকে পড়িয়ে সন্ধ্যায় তার কোচিং এ যেতে হয়। কোচিং টা ইনামের মাধ্যতেই পাওয়া। ইনামের সাথে একটা ভালো বন্ডিং তৈরি হয়েছে তার। সন্ধ্যায় কোচিং থেকে ফিরে ফারিনকে আবারও উপন্যাস পড়ায় দেখা গেলো। তিথী মাথা চাপড়ে বললো
“এই উপন্যাসের ভুত তোমার মাথা থেকে কবে যাবে শুনি?
ফারিন বইটা পাশে রেখে মুচকি হেসে বললো
“এই মুহূর্ত টা আমার জন্য খুব স্পেশাল। উপন্যাস পড়ে নিজেকে তৈরি করতে হবে তো নায়িকাদের মতো। রোমান্টিকতাটাও শিখতে হবে ঠিকঠাকভাবে।
তিথী হাসলো। বললো
“তুমি সত্যিই অনেক দুষ্টু হয়ে গেছো আগের থেকে।
“আগের ফারিন ছিলো শুধুই ফারিন, কিন্তু এখনকার ফারিন তো আর শুধু ফারিন নেই। অনেক পার্থক্য। ইশ, কবে যে সে আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাবে, ধুর ভাল্লাগে না।
তিথী তার হাস্যজ্বল মুখে বললো
“সময় দাও তাকে। ভালো সময় তোমার জন্য অপেক্ষায়।
ফারিন হাসলো।

ইদানীং রবিনদের বাসাতে বেশ ঝামেলা হচ্ছে। রবিনের ভাই ফিরে এসেছে দুদিন আগে। রিয়ানাকে তারও বেশ পছন্দ। তবে রবিন তাকে বিয়ে করতে নারাজ। এদিকে রিয়ানা অনশন করে বসেছে, সে রবিনকে বিয়ে করবেই। যদি সে তাকে বিয়ে না করে প্রয়োজন হলে আত্মহত্যা করবে, কিন্তু অন্য কাউকে সে রবিনের হতেও দিবে না, নিজেও রবিনকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করবে না। ইভানার মায়ের কাছে রিয়ানার এ পাগলামো মোটেও ভালো লাগছে না। রিয়ানার উপর যথেষ্ট বিরক্ত তিনি। নিজের বোন হওয়া সত্বেও তিনি রিয়ানার এ পাগলামোকে সাপোর্ট করছেন না। যদি রবিন রাজি থাকতো তাহলে সেটা অন্যরকম হতো। তবে প্রিয় দেবরের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে বোনের কথায় নাচার মতো মানুষ তিনি নন। রিয়ানা আর রবিন এখন আকরাম চৌধুরীর মুখোমুখি বসে আছে। আকরাম চৌধুরী হচ্ছেন রবিনের বড় ভাই। রবিনের চোখমুখ শক্ত, আকরামও বেজায় ক্ষেপে আছেন। তবে রিয়ানার উপর নয়, রবিনের উপর।

আকরাম রবিনের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন। বললেন
“রিয়ানাকে বিয়ে করতে তোমার অসুবিধা কোথায়? ও কি দেখতে অসুন্দর?
রবিন কড়া গলায় বললো
“এখানে সুন্দর অসুন্দরের প্রশ্ন না ভাইয়া। আমি ওকে বিয়ে করতে পারবো না.।
“কারণটা জানতে চাইছি।
“কারণটা তোমার অজানা নয়। তুমি সবটাই জানো।
“পাগলামো বন্ধ করো। তুমি যেটার আশায় দিন গুনছো, সেটা কেবলই মরীচিকা। মরীচিকার পেছনে অন্ধ্যের মতো পরে থাকার কোনো মানেই নেই৷
“সে মোটেও মরিচীকা নয়। আর যদি সে মরীচিকা হয়েও থাকে, তবে আমি সেই মরীচিকা নিয়েই সুখে থাকতে চাই।

আকরাম রেগে গেলো হঠাৎ। চিৎকার করে বলে উঠলো
“অনেক সহ্য করেছি তোমার ছেলেমানুষী। আর নয়, যদি সে আসার হতো, তবে কবেই চলে আসতো। আমিও তোমাকে যথেষ্ট সময় দিয়েছি। কিন্তু এবার আর না। রিয়ানাকেই বিয়ে করবে তুমি, সেটাও খুব শীঘ্রই। ব্যাবসাতেও এবার হাত লাগাও, এতদিন লাগাম ছাড়া চলেছো। এখন থেকে এইসব আর হবেনা। আকরাম রিয়ানার দিকে তাকিয়ে বললো
“বিয়ের জন্য প্রস্তুতি নাও রিয়ানা।
রিয়ানা উল্লাসে মাথা নাড়ালো। রাগে দুঃখে সেখান থেকে উঠে নিজের রুমে চলে গেলো রবিন।

কিছুক্ষণ পরই ইনামদের বাসা থেকে কল এলো আকরামের ফোনে। আকরাম হাসিমুখে ফোন রিসিভ করলেও পরবর্তীতে হাসিটা মিলিয়ে যায়। ফোন রেখে বাসার সবাইকে ডেকে জড়ো করেন এক যায়গায়। সে সময়টায় রবিন বাসাতেই ছিলো। তাই ভাইয়ের ডাকে সেও এলো সেখানে। কেও কিছু বলছে না, আকরামের চোখেমুখে চিন্তা। রবিন প্রশ্ন করে
“কি হয়েছে ভাইয়া?
“আমাদেরকে এখনই ইনামদের বাসায় যেতে হবে।
“কেন?
“মামার শরীরের অবস্থা খুবই খারাপ। শীঘ্রই রেডি হয়ে নাও সবাই।
রবিনের মুখটা অন্ধকার হয়ে গেলো হঠাৎ। সে কঠোর ভাষায় ভাইকে বললো
“যাওয়ার হলে তোমরা যাও, আমি যাবো না। অন্তত মামা নামক এই মানুষটার জন্য তো নয়ই।
আকরাম আবারও ভাইকে ধমকে উঠে।
“সবসময় জিদ দেখাতে নেই। মানুষটা মৃত্যপথ যাত্রী। আমাদেরকে এক্ষুনি যেতে হবে সেখানে।

রবিন আবারও শক্ত গলায় বলে উঠলো
“উনি’তো সবেমাত্র মৃত্যুপথযাত্রী, তবে এই মানুষটার কারণে আমি সারাটা জীবন মৃত্যুর মতো বেচে আছি। যাওয়ার হলে তোমরা যাও, আমি যাবো না।
রাগে দুঃখে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো রবিন। আকরাম একা একা রেগে বিড়বিড় করে বলতে লাগলো
“দিনে দিনে ওর স্পর্ধা বেড়েই চলেছে। এবার ওর স্পর্ধায় লাগাম টানাটা বেশ জরুরি। মামাদের বাসা থেকে ফিরেই একটা ব্যবস্থা করছি। আকরাম রিয়ানার দিকে তাকালো। উৎসাহিত গলায় বললো
“ওকে সামলাতে পারবে তো রিয়ানা?
রিয়ানা হেসে বললো
“ভালোবাসার মানুষকে সামলাতে পারবো না তো আর কি পারবো দুলাভাই।
“দ্যাট’স গুড। মানসিক ভাবে প্রস্তুতি নাও। ভেবেছিলাম আরেকটু সময় দেই, কিন্তু নাহ! যা করার খুব তারাতাড়িই করতে হবে৷

______
ইনামের বাবার আকস্মিক মৃত্যুতে হতভম্ব হয়ে গেছে তিথী। সবেমাত্র কিছুক্ষণ আগেই খবরটা পেয়েছে সে। আর যখন খবর পেয়েছে তখন আর কিছুই করার ছিলো না। মৃত্যুর খবরটা যখন সে পেয়েছে ততক্ষণে দাফন কাফন সব হয়ে গিয়েছিলো। তাছাড়া ইনামদের বাসাটাও সে চিনে না, যে গিয়ে দেখে আসবে। তিথী বিষন্ন মন নিয়ে বাসায় ফিরলো। না জানি ইনামের মনের উপর দিয়ে এখন কি কি যাচ্ছে। বাবা মা হারানোর কষ্ট যে কতটা বেদনাদায়ক তা তিথী জানে। এই মুহূর্তে ইনামকে শান্তনা দেওয়ার ভাষাও নেই তার কাছে।
তিথী নিজের ব্যাগের কাছে গেলো। ব্যাগটা খুলতেই চোখের সামনে জ্বলজ্বল করতে লাগলো সেই পুতুলটা।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here