হৃদয়ও_মাঝারে-১৮,১৯

0
789

#হৃদয়ও_মাঝারে-১৮,১৯
তন্বী ইসলাম
১৮

ইনাম মেঝে থেকে উঠে দাঁড়ালো। তিথীর দিকে বিষন্নতার চোখে তাকিয়ে অপরাধীর গলায় বললো
“রিয়ানার সাথে আজ যার বিয়ে, সেই রবিনই তোমার ইভান।
তিথী থমকে গেলো, বাকশক্তি হারিয়ে ফেললো কিছু সময়ের জন্য। সারা শরীরটা যেনো তার পাথরে পরিণত হয়ে গেছে। ইনাম ভেজা গলায় তিথীকে ডাকলো। তিথী অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকালো ইনামের দিকে। ইনাম তিথীকে জোর গলায় বললো
“এতদিন পর নিজের ভালোবাসাকে ফিরে পেয়েছিস, এখানো সময় আছে, ভালোবাসা আদায় করে নে। নাহয় পরে পস্তাবি।
তিথী কোনো কথা বলছে না৷ সে পাথরের ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে শক্ত হয়ে।
তিথীর মাথায় হাত বুলিয়ে ইনাম বললো
“আমি ও বাড়ি যাচ্ছি, ওকে নিয়ে যাচ্ছি। তুইও চলে আয় তোর ভালোবাসাকে আদায় করেতে। আমি অপেক্ষায় থাকবো তোর।

রিয়ানাকে পার্লার থেকে বউ সাজিয়ে নিয়ে এসেছে বেশ কিছুক্ষণ আগেই। বিয়েটা নিয়ে সে খুব এক্সাইটেড। ইভানার মাকে দেখা গেলো ব্যস্ত সময় পার করছেন তিনি। একমাত্র বোন আর একমাত্র দেবর… দুজনেই তার খুব আদরের। প্রথম অবস্থায় রিয়ানার মতের বিরুদ্ধে থাকলেও পরে তিনিও রাজি হয়েছেন এ বিয়েটায়, এবং প্রচন্ড খুশিও তিনি। রিয়ানার চারপাশে মানুষজন ভীড় করে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর তার বিয়ে, রিয়ানার বান্ধবীরা ওকে নিয়ে মজা করছে। বেশ মজাই পাচ্ছে রিয়ানা। বেশ কিছুক্ষণ পর রিয়ানার মনে হলো তিথী আসেনি। সে তার বোনকে ডাকলো। রিয়ানার ডাক পেয়ে ইভানার মা দ্রুত পায়ে সেখানে এসে বললেন
“কিছু বলবি?
“তিথী এলো না যে এখনো।
ইভানার মা কিছুটা দুশ্চিন্তা গ্রস্ত হয়ে বললেন
“হ্যাঁ তাইতো। কাজের চাপে ভুলেই গেছিলাম ওর কথা। তুই চিন্তা করিস না, ও যখন বলেছে আসবে তো আসবেই। বড়ই লক্ষ্মী একটা মেয়ে তিথী। কথা দিয়ে কথার খেলাপ করবে না সে।।
ইভানার মায়ের কথায় রিয়ানা মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো।

বেশ অনেক্ষণ হয়ে গেছে, বিয়ের সময়ও হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু রবিনকে এখনো তৈরি করানো যায় নি। সে এখনো আপসেট হয়ে নিজের রুমের দরজা বন্ধ করে বসে আছে। রবিনের বড় ভাই সহ কিছু বন্ধুবান্ধব বেশ খানিক সময় ধরে তাকে ডেকেই চলেছে অবিরামভাবে। সে ডাক যেনো রবিনের কান পর্যন্ত গিয়ে পৌছুচ্ছে না। রবিন হতভম্ব, বার বার মনে হচ্ছে সে নিজেকে ঠকাচ্ছে, প্রিয় মানু্ষটিকে ঠকাচ্ছে। যদি কখনো সে ভালোবাসার দাবী নিয়ে ফিরে আসে সেদিন রবিন তার কাছে কি জবাব দিবে?
রবিনের চোখদুটো লাল বর্ণ ধারণ করেছে ততক্ষণে। চোখ দিয়ে আগুনের ফুল্কি ঝরছে। না পারছে এ বিয়েটা করতে আর না পারছে বিয়েটা ভেঙ্গে দিতে৷ সেই ছোটবেলায় মা মারা গেছে, তারপর থেকেই এ ভাই তাকে বড় করেছে, মানুষের মতো মানুষ করে তৈরি করেছে৷ সমস্ত আবদার পুরণ করেছেন তিনি। আর ভাবী, মায়ের আদর কাকে বলে সেটা’তো ভুলেই গেছিলো সে। এই ভাবি তাকে মায়ের আদরে বড় করেছে৷ কি করে এই ভাই ভাবীকে কষ্ট দিবে সে? ওদেরকে সুখী করতে নিজের সুখটাকে বিসর্জন দিতে হচ্ছে আজ।

রবিন দুহাতে মাথা চেপে ধরলো, ইচ্ছে করছে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করুক, ঘরের জিনিসপত্র ভাংচুর করুক। কিন্তু না, পারছে না সে।

রবিন যখন পুরোনো স্মৃতিচারণে ব্যস্ত, তখনই খুব জোরে একটা শব্দ হলো, তাতে ঘোর ভাংলো রবিনের। রক্তবর্ণ চক্ষু নিয়ে সে তাকালো দরজার দিকে। দরজাটা ততক্ষনে ভেঙ্গে নিচে পরে আছে। ভাঙ্গা দরজা ডিঙ্গিয়ে ওর বড় ভাই ধীরপায়ে এগিয়ে আসলো রবিনের কাছে। রবিন অসহায় ভরা চাহনিতে তাকিয়ে আছে তার ভাইয়ের পানে। বড় ভাই রবিনের পাশে বসলো। পিঠে হালকা চাপড় দিয়ে মৃদু গলায় বললো
“তোর মনের কষ্টটা আমি বুঝতে পারছি রবিন। কিন্তু আর কত কাল তুই এভাবে বসে থাকবি বল? তোর ওতো নিজের একটা জীবন আছে, জীবনটাকে সুন্দর করে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অধিকার তোরো আছে। সে যদি আসার হতো, তাহলে অনেক আগেই চলে আসতো। ইনফ্যাক্ট, সে তোকে এভাবে রেখে যেতোই না। মামা তো বলেছিলেন তিনি ওকে অনেক বুঝিয়েছিলেন বিদেশে না যাওয়ার জন্য। কিন্তু সেতো মামার কোনো কথায় কানে তুলেনি, নিজের চিন্তা মাথায় নিয়েই সে চলে গেছে, একবারো ভাবেনি তোর কথা। তাহলে তুই কেন খামোকা তোর জীবনটা এভাবে নষ্ট করবি বল।

রবিন শক্ত গলায় বললো
“মামাকে আমি বিশ্বাস করি না ভাইয়া, আর না করি তার বলা কথাকে।।
ওর ভাই ওকে আবারও মাথায় হাত বুলিয়ে বললো
“খামোখা মামার উপর রেগে আছিস তুই। মামা কেন আমাদের সাথে মিথ্যে বলবে বল, এতে উনার কি স্বার্থ থাকতে পারে?
“স্বার্থের কথা আমার জানা নেই, শুধু জানি উনি ওর সাথে নিশ্চয়ই খারাপ কিছু করেছেন।
“মানুষটা মারা গেছে রবিন, দোহাই লাগে তাকে নিয়ে আর কোনো উল্টাপাল্টা কথা বলিস না।
রবিন চোখ সরিয়ে নিলো অন্যদিকে। কান্না পাচ্ছে খুব তার। তবে সে তো ছেলেমানুষ। কান্না করা যে ছেলেদের জন্য বারণ।।
বড় ভাইয়ের অনেক অনুরোধের পর রবিন রাজি হলো তৈরি হবার জন্য।

বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে ছাদের উপর। একপাশে স্টেজ বাধা হয়েছে। রিয়ানা আর রবিনকে স্টেজে পাশাপাশি বসানোও হয়েছে। রিয়ানার মুখটা যতটাই হাস্যজ্বল, রবিনের মুখ ততটাই কালো আধাঁরে ছেয়ে আছে। রিয়ানা কিছুক্ষণ পর পর রবিনের দিকে ফিরে তাকাচ্ছে, হয়তো মনে মনে চাইছে রবিনও একবার তাকে দেখুক। কাজী সাহেব কাবিন লেখা শুরু করেছেন। লেখা শেষ হলেই বিয়ে পড়ানো হবে। ইনামকে দেখা গেলো সেও হাতে হাতে কাজ করছে। রিয়ানার চোখে পরলো সেটা। ইনাম বেশ হাসিখুশি আজ। মনে কিছুটা খটকা লাগলো রিয়ানার। সে’তো রিয়ানাকে পছন্দ করতো, ভালোবাসতো খুব। আজ’তো তার দেবদাস হয়ে ঘুরে বেড়ানোর কথা ছিলো, কিন্তু নাহ, সে’তো যথেষ্ট স্বাভাবিক। এরমধ্যে ইনামের নজর এলো রিয়ানার দিকে। রিয়ানাকে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মুচকি হাসলো সে। রিয়ানা বিস্ময়ের সাথে চোখ সরিয়ে নিলো। ইনাম আবারও স্মিত হাসলো।

গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে চলছে তিথী। পুরোটা শরীর কাঁপছে তার, চোখ বেয়ে পানি ঝরছে৷ পা দু’টো সামনে এগুতেই চাইছে না। জোর করে সিড়ি বেয়ে বেয়ে উপরে উঠছে সে। প্রায় অনেকটা সময় উঠার পর অবশেষে ছাদে এসে পৌছুলো সে। তিথী সামনে এগুচ্ছে, অনেক মানুষ সেখানে। সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত। হাঁটতে হাঁটতে তিথী স্টেজের কাছাকাছি পৌঁছে গেলো। রবিনকে বসে থাকতে দেখলো রিয়ানার ঠিক পাশেই৷ আবারও বুক চিরে কান্না আসছে তার। এই সেই মানুষ, যাকে সে এতটা বছর খুঁজে বেড়িয়েছে। এই সেই মানুষ, যে তার হৃদয় মাঝারে এতটা কাল বসত করে এসেছে। তিথীর গাল বেয়ে দু’ফোটা পানি গড়িয়ে পরলো। এতটা দিন তাকে দেখে আসছে সে, ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি সেই তার মনের মানুষ। আজ যখন জানলো, তখন সব শেষ হওয়ার পথে।

রবিনের মুখপানে তাকালো তিথী। ফিরে গেলো কিছুটা সময়ের জন্য অতীতে।

গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যায় তিথীর বাবা মা, ভাগ্যক্রমে তিথী সেই গাড়িতে থাকা স্বত্বেও বেঁচে যায় সেদিন। তার বাবা ছিলো একা, উনার ছিলো না কোনো ভাই। তাই তিথীর নিজের বলতে ছিলো না কেউ। নানুর বাড়িতে এক মামা ছিলো, সেও ছিলো সৎ মামা। মামার তিথীর প্রতি কিছুটা টান থাকলেও মামীর দুচোখের বিষ ছিলো সে। ঠাঁই হয়নি সেখানেও। শেষে এহসানুল হক সাহেব তিথীকে নিলেন ঠিকই, তবে তিথীকে মানুষ করার জন্য নয়, ওর বাবার সম্পত্তি হাতানোর জন্য। রবিনের বাবা ছিলো নেশাখোর, প্রতিনিয়ত মারধোর করতো ওর মাকে। একসময় অত্যাচার অনাচার সহ্য করতে না পেরে তিনিও মারা যান। নেশাখোর বাবা রবিনের কোনো খেয়ালই নিতেন না, ঠিকমতো খাবার দিতো না। রবিনের বড় ভাই তখন যথেষ্ট বড় ছিলো, একটা ছোটখাটো চাকরি করতো শহরে। রবিনেরও আশ্রয় হয় এহসানুল হকের বাড়িতে। আপন ভাগ্নের প্রতি উনার ছিলো অগাধ টান। নিজের ছেলের মতোই ভালোবাসতে তিনি রবিনকে।

যেদিন তিথী ও বাড়ি প্রথম যায়, রবিন আগে থেকেই সেখানে ছিলো। রবিন আর ইনাম প্রায় সমবয়সী, কিন্তু তিথী ছিলো তাদের থেকে বেশ ছোট। প্রথম প্রথম তিথী ওদের ধারেকাছেও ঘেষতো না, পরে রবিনই তাকে প্রথম ডাক দেয়। খুব ছোট দুটি মানুষের মধ্যে বন্ধুত্ব তৈরি হয় অল্প সময়েই। ইনামের সাথেও ভালো বন্ধুত্ব হয় তিথীর। তবে ইভানের সাথে খেলতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতো তিথী। তিথী ইভান কে ছোট করে ইভু বলে ডাকতো। ইভানও বেশ মজা পেতো সেই নাম শুনে। খেলার ছলে তারা পুতুল বিয়ে থেকে শুরু করে নিজেদের বিয়ে নিয়েও কত আলাপ করেছে।
ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, সেই এহসানুল হক একদিন ইভান আর ইনামকে শহরে পাঠিয়ে দেয়, তিথীকে যাওয়ার সুযোগটুকুও দেয় না। ওরা চলে যাবার পর তিথীর বাবার সমস্ত সম্পদ হাতিয়ে তিথীকে রেখে আসে এতিমখানায়। ব্যাস, কষ্টের জীবন তখন থেকেই শুরু।

তিথীর গাল বেয়ে পানি পরছে, পলকহীন চোখে তাকিয়ে আছে সে রবিনের দিকে। হঠাৎ ইনামের ডাকে ঘোর ভাঙ্গে তার।
“চলে এসেছো তিথী?
তিথী নামটা শুনে চমকে সামনে তাকায় রবিন। রিয়ানাও তাকায় সেদিকে। তিথীর দুচোখ ভরা পানি। ইভানার মা কোত্থেকে এসে ব্যস্ত গলায় তিথীকে বলে
“এতক্ষণে তোমার আসার সময় হলো তিথী। সেই কখন থেকে অপেক্ষায় আছি তোমার। তিথী কথা বললো না কোনো, ইভানার মা হঠাৎ ঘাবড়ে গিয়ে বললো
“কি হয়েছে তিথী? কাঁদছো কেন?
তিথী সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে আবারও রবিনের দিকে তাকালো। রবিনের নজর এলো এবার তিথীর হাতের দিকে। হঠাৎ সে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো, চোখমুখে বিস্ময়। সে বড় বড় পা করে কিছুটা দৌড়ানোর মত করে এগিয়ে এলো তিথীর কাছে৷ রিয়ানা সহ বাকিরা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে রবিনের দিকে।

তিথীর কাছে এসেই সে ছোঁ মেরে তিথীর হাত থেকে সেই পুতুলটা ছিনিয়ে নিলো। বিস্মিত গলায় ব্যতিব্যস্ত হয়ে সে বললে লাগলো
“এটা, এটা কোথায় পেলে তুমি?
তিথী রবিনের দিকে তাকিয়ে আছে, নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলছে সে। রবিন আবারও বাজখাঁই গলায় বললো
“কি হলো, কথা বলছো না কেন তুমি? প্রশ্ন করছি তোমায়, এটা পেলে কোথায়?
তিথী এবারেও নিশ্চুপ। রবিনের যেনো তর সইছে না। সে তিথীর দু’বাহুতে খানিক চেপে ধরে চেচিয়ে উঠলো
“তোমার সমস্যাটা কোথায়, আমি প্রশ্ন করছি তো। পেলে কোথায় এটা?

তিথী শব্দ করে কেঁদে উঠলো এবার। রবিন চমকে তিথীর বাহু ছেড়ে দিলো। কিছুটা সময় হতভম্বের মতো তাকিয়ে রইলো তার দিকে। এরপর মলিন গলায় বললো
“তুমিই আমার তিথী তাইনা? সেই হারিয়ে যাওয়া তিথী, যে আমাকে ছেড়ে অনেক দূরে চলে গেছিলে!

বিয়ে বাড়িটা মুহুর্তেই অন্যরকম হয়ে গেলো। রিয়ানা অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছে রবিন আর তিথী’কে। ইভানার মা ও হতবাক। রবিনের বড় ভাই আকরাম, সেও ততক্ষণে অবাকের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে গেছেন। কিছুটা সময় নির্বাক সময় পার করার পর রবিন হঠাৎ বলে উঠলো
“কেন চলে গেছিলে তুমি আমায় ছেড়ে?
তিথী কান্না বিজড়িত গলায় বললো
“ইভু..!
রবিন এবার প্রচন্ড হুংকারে চিৎকার করে বলে উঠলো
“আমার কথার উত্তর কেন দিচ্ছো না তুমি? কেন ছেড়ে গেছিলে আমায়?

তিথী কিছু বলার মতো ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। এ মুহুর্ত টা তাকে একটা পাথরে পরিণত করে তুলেছে। আকরাম চৌধুরী এগিয়ে এলেন এবার। তিথীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ভারী গলায় বললেন
“তুমি তো আমার ইভানার টিচার তাইনা?
তিথী নতদৃষ্টি করে মাথা নাড়ালো। তিনি আবারও বললেন
“আমরা তো জানতাম, তুমি তোমার কোনো আত্মীয়ের সাথে বিদেশ চলে গিয়েছিলে। তা ফিরলে কবে? আর ফিরেছোই যখন এতদিন নিজের পরিচয় কেন গোপন করে রেখেছো?
তিথী এ কথার উত্তর দিলো না। কিন্তু ঠোঁটজোড়া থরথর করে কাঁপতে লাগলো তার। এমন সময় ইনাম পেছন থেকে বলে উঠলো
“ও কোত্থাও যায় নি।

ইনামের কথায় রবিন আর আকরাম দুজনেই পেছনে ফিরে তাকালো। ইনাম ওদের কাছে এগিয়ে এসে অপরাধীর গলায় বললো
“এতদিন রবিন যখন আমার বাবার উপর রেগে থাকতো, খুব খারাপ লাগতো আমার। বুঝে আসতো না ওর রেগে থাকার কারণ। ভাবতাম, বিনা কারণে সে আমার বাবাকে খারাপ জানে। কিন্তু বিনা কারণ নয়, যথেষ্ট কারণ ছিলো।
“মানে? বিস্ময়ে বললো আকরাম।
ইনাম রবিনের দিকে তাকালো। এরপর তিথীর দিকে চোখ ফিরিয়ে বললো
“ও বিদেশে নয়, এতিমখানায় ছিলো এতদিন। আর ওকে এতিমখানাতে আমার বাবাই পাঠিয়েছিলো, শুধুমাত্র ওর বাবার সম্পত্তির জন্য।

চারিদিকে থমথমে ভাব। তিথী দাঁড়িয়ে আছে, ওকে ধরে আছে ফারিন। রিয়ানা বিস্মিত হয়ে এগিয়ে এসেছে রবিনের পাশে। সবকিছু মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে তার। তবে এতটুকু বুঝতে পেরেছে, রবিন তাকে এতদিন এই তিথীর জন্যই ইগ্নোর করতো। রিয়ানা রবিনের দিকে তাকালো। বললো
“আমাদের বিয়েটা কি হবে না?
রবিন রাগী চোখে রিয়ানার দিকে তাকালো। এর পর কোনো কথা না বলে হ্যাচকা টানে তিথীকে টেনে নিলো নিজের কাছে, তিথী হতবাক। রবিন তিথীকে জড়িয়ে ধরে রিয়ানার দিকে তাকালো। শক্ত গলায় বললো
“বিয়েটা হবে। তবে তোমার সাথে নয়, তিথীর সাথে।।
তিথী হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো এবার। এতদিনের বাধ আজ যেনো ভেঙ্গে গেছে। রবিন তিথীকে নিজের সাথে চেপে ধরে ভাই আর ভাবীর দিকে তাকালো। প্রশ্ন করলো
“তোমাদের কোনো আপত্তি আছে?

আকরাম সাহেব কিছু বলার আগে ইভানার মা বললো
“মোটেও না। বরং ওর মতো একটা মেয়েকে নিজের জা হিসেবে পাওয়াটা তো আমার জন্য ভাগ্যের ব্যাপার।

রিয়ানা বেজায় রেগে গেলো এবার। চিৎকার করে বলে উঠলো
“তোমাদের সবার মাথা খারাপ হয়ে গেছে? আজ আমার বিয়ে। এমনটা কি করে করতে পারো তোমরা? রিয়ানার প্রশ্নের জবাবে ওর বোন বললো
“তোর সুখের কথা চিন্তা করে ওদের দুজনের জীবনটা তো আর নষ্ট করে দিতে পারি না।

রিয়ানা নিরব। কিছুটা সময় পর রিয়ানা মৃদুস্বরে বললো
“ওর জন্য আমি ইনাম ভাইকে কষ্ট দিলাম, উনার ভালোবাসা প্রত্যাখ্যান করলাম, আর শেষে কিনা আমি নিজেই প্রত্যাখ্যান হলাম!
রিয়ানা কাঁদছে। ইনাম একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। রিয়ানার হঠাৎ কি মনে হলো, সে আচমকা ইনামের কাছে গেলো। শক্ত গলায় বললো
“আপনি তো আমায় বিয়ে করতে চান, ভালোবাসেন আমায়। তবে আমি ফিরিয়ে দিয়েছিলাম আপনাকে। ভালোবাসা হারানোর ব্যথা আজ আমি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। আজ বুঝতে পারছি, আপনি কতটা কষ্ট পেয়েছেন। আপনার কষ্টের অবসান ঘটাতে চাই আমি। চলুন, আমরা এই স্টেজেই বিয়ে করবো।
রিয়ানার কথায় প্রথমে অবাক হলেও পরে মৃদু হাসলো ইনাম। ঠান্ডা মাথায় মুখে হাসি টেনে মৃদুস্বরে বললো
“ওহ রিয়ানা, আই এম সো স্যরি। তোমার মতো সুন্দরী মেয়েকে না বলতে আমার কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু কি করবো বলো, আমি যে বিবাহিত। আমার সুন্দরী একটা বউ আছে। আমার তাকে দিয়েই চলবে, তোমাকে আমার কোনো প্রয়োজন নেই।

চলবে…..

#হৃদয়ও_মাঝারে-১৯
তন্বী ইসলাম

“ওহ রিয়ানা, আই এম সো স্যরি। তোমার মতো সুন্দরী মেয়েকে না বলতে আমার কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু কি করবো বলো, আমি যে বিবাহিত। আমার সুন্দরী একটা বউ আছে। আমার তাকে দিয়েই চলবে, তোমাকে আমার কোনো প্রয়োজন নেই।
রিয়ানা অবাক হলো ইনামের কথায়। বাকিরাও যেনো থমকে গেলো হঠাৎ। এই ছেলে কি বলে এইসব? ইভানার মা এগিয়ে এলেন ইনামের কাছে। নরম গলায় বললেন
“ভাই, এই সময় এমন করে মজা কেন করছো বলো। রিয়ানা এমনিতেই মানসিকভাবে ভেঙে পরেছে। সে চাইলে রবিন আর তিথীর সম্পর্কটা নিয়ে এখন ঝামেলা করতে পারতো। কিন্তু সেটা’তো সে করেনি, সবটা মেনে নিয়ে এবার তোমাকে সঙ্গী করে চাইছে। তাছাড়া তুমি নিজেও তো ওকে ভালোবাসো অনেক।

ইনাম কিছু সেকেন্ড নিরব থেকে মৃদু গলায় বললো
“ভালোবাসতাম ভাবী। আর আপনার বোন এখন বিকল্প হিসেবে চাইছে আমায়, যেহেতু রবিনকে সে পায় নি। আর মজার কথা বলছেন, মজা তো এখন আপনার বোন করছে, আমি করিনি। আমি বিবাহিত এটা সত্যি। ইভানার মা আবারও চমকালো। আকরাম সাহেবে এগিয়ে এলেন ইনামের কাছে। ভারী গলায় বললেন
“আমি তোমার বড়ভাই, সো মিথ্যা কথাটা যেনো আমার সাথে না বলা হয়। তুমি বিয়ে করলে আমরা সবাই জানতে পারতাম।
“কাউকে জানাই নি আমি, এমন একটা দিনের জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। শক্ত গলায় বললো ইনাম।
এবার ধীরপায়ে এগিয়ে এলো রিয়ানা। ইনামের মুখোমুখি দাঁড়ালো সে। তীব্র দৃষ্টিতে সে ইনামের দিকে তাকিয়ে আছে। ইনাম রিয়ানার দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিলো অন্যদিকে। মৃদু হাসলো রিয়ানা। বললো
“আপনার বউ’কে আমাদের সাথে পরিচয় করাবেন না?
ইনাম ফিরে তাকালো রিয়ানার দিকে। রিয়ানার চোখে পানি, দৃষ্টিতে হাহাকার। ইনাম বুঝতে পারলো রিয়ানার মনে কি চলছে। কিন্তু তারও কিছু করার নেই। সময় কারো জন্য অপেক্ষা করে না, সময়ের সাথে সাথে মানুষকেও বদলাতে হয়। ইনাম নিঃশব্দে হাসলো, বলল
“পরিচিত হতে চাও তার সাথে? আচ্ছা, তাহলে পরিচয় করিয়েই দেই। ওই যে আমার ওয়াইফ…
হাত দিয়ে নিজের থেকে বেশ খানিকটা দূরে ইশারা করলো ইনাম। রিয়ানা ওর হাতের ইশারা বরাবর তাকালো। একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে অদুরে। মেয়েটা দেখতে খুবই সুন্দরী। রিয়ানা মেয়েটির কাছে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো, তখনই ইনাম তাকে ডাক দিয়ে বললো
“এদিকে এসো ফারিন।
গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে এলো ফারিন। ইনামের ঠিক পাশে এসে দাঁড়ালো সে। কাছে আসতেই ইনাম ফারিনের হাত নিজের হাতের মুঠোয় পুরলো। রিয়ানা অবাক হয়ে তাকালো সে হাতের দিকে। ইভানার মা’সহ বাকিরা হতবাক। রিয়ানা কিছু বললো না, কিন্তু ইভানার মায়ের মনে প্রশ্ন জাগলো। তিনি ইনামকে বললেন
“এর সাথে তোমার কি করে পরিচয়? বাড়ি কোথায় ওর? আর তুমি বিয়ে করেছো সেটা আমাদের কাছ থেকে কেন গোপন করলে?

ইনাম একবার ফারিনের দিকে তাকালো। এরপর মৃদু হেসে বললো
“ও তিথীর বান্ধবী।
“তিথী’র বান্ধবী? বিস্ময়ে বললো রিয়ানা।
“হুম।
“ওর সাথে পরিচয়টা আমার আকস্মিক ভাবেই হয়, তখন পরিচয় হয় তখন আমাদের দুজনার একজনও ভাবি নি, আমরা দুজন দুজনার জীবনের প্রিয়জন হয়ে উঠবো। ইনাম তিথীর দিকে তাকালো। মৃদু হেসে বললো
“তোকে অনেক থ্যাংকস তিথী, তোর কারণেই আমার জীবনে আমি এমন কাউকে পেলাম।
তিথী হাসলো। সে রবিনের বাহুবন্ধনী থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে ফারিনের কাছে এগিয়ে এলো। ফারিনকে জড়িয়ে ধরলো সে। কিছু সময়ের জন্য ফিরে গেলো কিছুদিন আগের সময়ে।

সেদিন হঠাৎ করেই ফারিনের মোবাইল থেকে তিথীর কাছে কল এলো। তিথী কলটা রিসিভ করতেই শুনতে পেলো ফারিনের কান্নাবিজড়িত গলা। তাকে বাড়ি থেকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তাই সে বাড়ি থেকে কোনোরকমে পালিয়ে চলে আসছে হোস্টেলে। তিথীর সাথে সেদিন ইনামও সঙ্গী হয়। সেও তিথীকে সাহায্য করার জন্য তিথীর সঙ্গে পা বাড়ায়। যেহেতু মেয়েদের হোস্টেলে ছেলেদের প্রবেশ নিষেধ, তাই তিথী আর ইনাম দুজনই বিচলিত হয়ে হোস্টেলের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে ফারিনের আসার অপেক্ষায় থাকে। দীর্ঘসময় পর বিধ্বস্ত অবস্থায় ফারিনকে আসতে দেখা যায়। তিথীকে দেখতে পেয়ে সে দৌড়ে এসে ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করে। তিথী কোনোরকমে ফারিনকে সামলে প্রশ্ন করলো
“কান্না থামাও ফারিন, কি হিয়েছে সেটা বলো। সবেমাত্র আজই গেলে। এর মধ্যে এতকিছু কিভাবে হলো?
ফারিন কান্নার জন্য কথাও বলতে পারছেনা৷ তবুও অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে বললো
“তুমি বোধহয় জানো না তিথী, আমার আপন মা নেই। ঘরে সৎ মা, তবে অন্যসব সৎ মায়ের মতো তিনি আমাকে এত এত অত্যাচার করতেন না। আমার বাবা সহজ সরল মানুষ, কৃষি কাজ করেন। অনেক কৃষি জমি আছে আমাদের। সেগুলো দিয়েই আমাদের সকল খরচ সুন্দর মতো হয়ে যায়। আজ ভোরে যখন বাবার কল পেলাম, বললেন তারাতাড়ি বাড়ি যাবার জন্য। আমি ভাবলাম হয়তো আমাকে উনাদের দেখতে ইচ্ছে হয়েছে। কিন্তু নাহ..

ফারিন আবারও কান্নায় ভেঙ্গে পরলো। তিথী ওকে সামলে বললো
“কান্না কোনো সমাধান নয় ফারিন, কান্না থামাও। তারপর কি হলো সেটা বলো।
“গিয়ে দেখলাম বাড়ি ভরা মেহমান। খুব অবাক লাগলো আমার কাছে। মায়ের কাছ থেকে জানতে চাইলে বললেন আমার বিয়ে। জানো তিথী, বিয়ের কথা শোনে অবাক হয়েছিলাম ঠিকই, তবে এতটাও খারাপ লাগেনি। পরে যখন জানলাম যার সাথে আমার বিয়ে হচ্ছে সে আমার চেয়ে তিনগুণ বয়সী একজন পুরুষ মানুষ। এর আগে উনার দু’দুটো বিয়ে হয়েছিল, কিন্তু একটাও টিকেনি। এই লোকের টাকা পয়সা অনেক, তাই মা আমাকে জোর করে সেখানে বিয়ে দিতে চাইছে।
ফারিন৷ আবারও কান্না করছে। তিথী অবাক হয়ে বললো
“তোমার বাবা কিছু বলেনি?
“আমি’তো আগেই বলেছি বাবা আমার সহজ সরল মানুষ, মা যেভাবে বাবাকে বুঝিয়েছে বাবা সেভাবেই বুঝেছে।
আমি অস্বীকার জানাই এই বিয়েতে। পরে মায়ের আসল রুপ বেরিয়ে আসে। উনি আমাকে অনেক খারাপ খারাপ কথা শোনাচ্ছিলো। আমার ছোট সৎ ভাই আছে। সে আমার চেয়ে বয়সে ছোট হলেও এমনিতে বড় হয়ে গেছে, সেও আমার উপর হাত তুলেছে জানো তিথী? দেখো, দেখো ওর মারের দাগ এখনও আমার গালে আর গায়ে আছে।

তিথী খেয়াল করলো ফারিনের গালে সত্যিই আঙ্গুলের ছাপ স্পষ্ট। ফারিন কাঁদতে কাঁদতে বললো
“আমি কোনোভাবে পালিয়ে এসেছি তিথী। কিন্তু মনে হয় না বেঁচে যাবো। ওরা এখান থেকেও আমায় ধরে নিয়ে যাবে আমি নিশ্চিত। ফারিনের কান্না দেখে চিন্তায় পরে গেলো তিথী। কি করা যায় সেটা তার মাথাতেও আসছে না। এতক্ষণ ইনাম চুপচাপ দাঁড়িয়ে সব কথা শুনছিলো। এবার মুখ খুললো সে
“তোমরা যদি কিছু মনে না করো, তবে আমি ওকে সাহায্য করতে পারি।
ইনামের কথায় তিথী তাকালো, ফারিনও এবার বিস্ময়ে তাকালো তারদিকে। এতটা সময়ের মধ্যে একবারও ইনামের দিকে তাকায় নি সে।, ইনফ্যাক্ট ওর অস্তিত্বও সে টের পায়নি, হয়তো বেশ টেনশনে ছিলো তাই। তিথী প্রশ্ন করলো
“কিভাবে সাহায্য করবেন আপনি?
“আমার একটা ছোট্র বাসা আছে, যেটাতে আমরা কেউই থাকি না। মেক্সিমাম সময় ভাড়া’ই দেওয়া থাকে। কিছুদিন আগে বাসাটা খালি হয়েছে। যদি তোমরা চাও তো ও সে বাসাতেও থাকতে পারে, চাইলে তুমিও থাকতে পারো তিথী। বর্তমানে এখানের চাইতে ওই বাসাটা তোমার বন্ধুর জন্য সেইফ হবে।

তিথী কিছু বলতে যাবে তার আগে ফারিন বললো
“উনি কে তিথী?
তিথী মৃদু হেসে বললো
“ধরে নাও আমার ভাই, কিংবা বন্ধুও বলতে পারো। সে যাইহোক, সবচেয়ে বড় কথা উনি একজন ভালো মনের মানুষ। এবার তুমি ডিসাইড করো, তুমি কি উনার অফারটায় রাজি হবে?
ফারিন বেশ কিছুক্ষণ কি যেন ভাবলো। এরপর বললো
“বর্তমানে আমার একটা সেইফ যায়গার বেশ প্রয়োজন। আমি রাজি তিথী, তা নাহলে ওরা আমাকে ধরে নিয়ে গিয়ে ওই বুইড়ার সাথে বিয়ে দিয়ে দিবে। ফারিন আবারও কাঁদতে শুরু করলো।
ইনাম বললো
“তাহলে চলো আমার সাথে।
“জিনিসপত্র? তিথী প্রশ্ন করলো ইনামকে। ইনাম হাসিমুখে বললো
“সে পরেও নিতে পারবে। আর তাছাড়া ওখানে কোনো কিছুরই অভাব নেই, তোমাদের প্রয়োজনীয় সব পাবে সেখানটায়। তাও তো হোস্টেলে তোমাদের পার্সোনাল জিনিস থাকতে পারে, আর হোস্টেল ছাড়তে হলে নিশ্চয়ই কিছু ফর্মালিটি পুরণ করতে হবে। আগে ওকে সেখানে গিয়ে রেখে এসো, বাকিগুলো নাহয় পরেই করবে৷
তিথী ভাবলো এটাই করা ঠিক হবে। কখন কে ফারিনের খোঁজে চলে আসে তার তো কোনো ঠিক নেই।

ওরা সবেমাত্র পা বাড়ালো ইনামের সেই বাসায় যাওয়ার জন্য। ঠিক তখনই ফারিন থমকে দাঁড়িয়ে পরলো । ওকে দাড়াতে দেখে বাকিরাও দাঁড়িয়ে গেলো। তিথী অবাক হয়ে বললো
“দাঁড়ালে কেন ফারিন?
ফারিনের চোখেমুখে ভয়। সে আতংকে তিথীকে সামনের দিকে দেখতে বললো। তিথী সামনে তাকিয়ে দেখলো একটা পাতলা দেহের লম্বা ছেলে আর তার সাথে কিছু লোক সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তিথীর বুঝতে বাকি রইলো না এরা ফারিনকে নিতে এসেছে।
ফারিন ভয়ে তিথীর পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো। সেই হ্যাংলা পাতলা গোছের ছেলেটা হঠাৎ রাগান্বিত গলায় বললো
“আমাগো মান ইজ্জত মাইরা তুই এইহানে আইয়া লুকাইছোস? মনে করছোস তোরে আমরা নিতে পারমু না? ভুল করছোস তুই, বড্ড ভুল করছোস। ভালোই ভালোই আইয়া পর আমাগো লগে। ওরা অহনো তোরে বিয়া করতে রাজি আছে।
ফারিন ভয়ার্ত গলায় বললো
“আমি বিয়ে করবো না। তোরা চলে যা এখান থেকে।
“যামু গা! যামু গা তো ঠিকই, তবে তরে নিয়াই যামু।

ছেলেটা এগিয়ে এলো ফারিনের দিকে। ফারিন একপা দু’পা করে পেছনে যেতে লাগলো। কিন্তু লাভ হলো না কিছুই । ছেলেটা একসময় ধরেই ফেললো ওকে। তিথী বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে রইলো, হতভম্বের মতো তাকিয়ে রইলো সেদিকে। তার মাথায় কিছুই আসছে না এই মুহূর্তে। এক পর্যায়ে নড়েচড়ে উঠলো তিথী। তার চোখের সামনে দিয়ে টেনে হিচড়ে নিয়ে যাচ্ছে ফারিনকে। ফারিন নিজেকে ছাড়ানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করেই যাচ্ছে। তিথী এবার খপ করে ধরলো ফারিনের হাত টা। ছেলেটা রাগী চোখে তাকালো তিথীর দিকে। কড়া গলায় বললো
“ওর হাতটা ছাইড়া দেন কইলাম।
“তুমি আগে ওর হাত ছাড়ো। কেন জোর করছো ওকে?
“হুনেন, এইডা আমাগো নিজেদের ব্যাপার। আপনে বাইরের মানুষ, বাইরের মানু্ষের মতই থাকেন। আমাগো কাজে নাক গলায়েন না।

ছেলেটা তিথীর হাতটা একটা ঝাকি দিয়ে সরিয়ে দিলো। ফারিনকে আবারও টেনে নিয়ে যেতে লাগলো। কিন্তু দু’পা এগুতেই ছেলেটা দাঁড়িয়ে পরলো। কেন যেনো সে সামনে এগুতে পারছে না। ছেলেটা বিস্ময়ে পেছনে তাকাতেই দেখলো ফারিনের হাতটা ইনাম ধরে আছে। ছেলেটার মেজাজ আবারও বিগড়ে গেলো। সে ফারিনের হাত ধরে টানতে লাগলো। কিন্তু ছাড়াতে পারছে না। অবশেষে সে বললো
“আপনে কেডা? আমার বোইনের হাত আপনে কেন ধইরা রাখছেন?
ইনাম মৃদু হাসলো। একপা এগিয়ে এসে ছেলেটার হাত থেকে ফারিনের হাত ছাড়িয়ে বললো
“আমার কোন পরিচয় দিলে তুমি খুশি হবে?
ছেলেটা নাকিস্বরে বললো
” আমার দেরি হইয়া যাইতাছে। হুদাই ঝামেলা কইরেন না কইলাম। আপনের পরিচয় জাননের ইচ্ছা আমার নাই। আমার বোইনের হাত ছাড়েন।
“যদি না ছাড়ি?
“তয় ওর বিয়া ভাইঙ্গা যাইবো। ওর বিয়া ভাংলে সমাজে আমাগো মানসম্মান যাইবো। মাইনষের সামনে মুখ দেহাইতে পারুম না।
“তোমাদের সম্মানের যদি এতই প্রয়োজন হয় তবে ভালো কোনো পাত্র দেখেও তো তোমার বোনকে বিয়ে দিতে পারো। এভাবে বুড়ো মানুষের কাছে কেন দিচ্ছো?
” হেইডা আমাগো ব্যাপার। এতকিছু আপনের কাছে কেন কমু।

ছেলেটা আবারও ফারিনের হাত ধরে টানতে লাগলো। এখনো ওর আরেকটা হাত ইনামের হাতে বন্দি। ছেলেটা এবার মেজাজ ঠিক রাখতে না পেরে বললো
“আপনে এমন কেন করতাছেন? ওর বিয়া ভাঙ্গলে তার দায়ভার কি আপনে নিবেন? এরকম কোনো ভালো ঘরে আমার বোইনের বিয়া দিয়া দিতে পারবেন?
ইনাম এবার নড়েচড়ে দাঁড়ালো। কিছু সেকেন্ড নিয়ে ফারিনের মুখের দিকে তাকালো। মেয়েটার মুখটা ভয়ে চুপসে আছে। ভয়ে কাচুমাচু করছে সে। ইনাম এক দুই না ভেবে বললো
“যদি এর চেয়েও ভালো ঘরে তোমার বোনের বিয়ে হয় তো?
“আগে এর চেয়ে ভালো ঘরের সন্ধান পাই, তার পরে দেহা যাইবো।

ইনাম মুচকি হাসলো। ফারিনের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বললো
“আমায় বিয়ে করতে তোমার কোনো আপত্তি আছে?
ফারিন বিস্ময়ে তাকালো ইনামের দিকে। ইনাম যথেষ্ট ধনী, তার উপর দেখতে সে অনেক হ্যান্ডসাম। এমন একজন সুদর্শন ছেলে যে কোনো মেয়েরই প্রত্যাশা। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে ফারিনের কাছে এটা একটা শান্তনা বাক্যের মতই শোনালো। ফারিন বললো
“প্লিজ, এমনিতেই আমি মানসিক চাপের মধ্যে আছি, তার উপর আপনি আর চাপ বাড়িয়ে দিবেন না। শান্তনা দেবার হলে অন্যভাবে দেন। এভাবে মজা করার সময় এটা না।

ইনাম ফারিনকে আর কিছু না বলে তিথীর দিকে তাকালো। বললো
“তোমার বন্ধুকে নিয়ে আমার সাথে এসো তিথী। আমরা আজই রেজিস্ট্রি করে বিয়ে করবো।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here