হৃদয়গ্রাহী #পর্ব_০১

0
1933

#হৃদয়গ্রাহী
#পর্ব_০১
#সারিফা_তাহরিম

বিয়ের ভারি জামা পড়ে নিজের রুমে বসে এক লোকমা ভাত মুখে তুলতেই সজোরে এক চড় পড়লো পূর্ণতার গালে। সোফা থেকে খানিকটা ছিটকে পড়লো সে। গালে হাত দিয়ে উপরে তাকাতেই দেখলো তার বাবা মঈনুল হাসান অগ্নিমূর্তি ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছেন। বাবাকে দেখে পূর্ণতার চোখজোড়া অভিমানে ছলছল করে উঠলো। মঈনুল হাসান চিৎকার করে বললেন,

“খুব বাড় বেড়ে গেছে না তোমার? আদর দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলে ফেলেছি তাই এসব কর্মকাণ্ড ঘটাচ্ছো তাই না?”

পূর্ণতার চোখ বেয়ে টুপটাপ করে অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়ছে। সে আদৌ বুঝতে পারছে না তার বাবা এসব কী বলছে। ততক্ষণে পূর্ণতার মা দৌঁড়ে এসেছেন মেয়ের দিকে। পূর্ণতাকে মেঝে থেকে উঠালেন তিনি। মঈনুল হাসানের উদ্দেশ্যে বললেন,

” কী করছোটা কী তুমি? বাড়ি ভর্তি মেহমান আর তুমি মেয়েটাকে মারছো কেন? ও তো বিয়ে করছেই। তাহলে এখন এসব ঝামেলা কেন করছো?”

“কেন এমন করছি তা তো তোমার মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেই ভালো জানতে পারবে। এত আদরে বড় করে বাদর বানিয়েছ। এতদিন ‘বিয়ে করব না করব না’ করে বিলাপ করেছে। কিন্তু তার পেছনে যে এত বিরাট কারণ লুকিয়ে আছে তা তো জানতাম না। তোমার মেয়ের কাণ্ড সম্পর্কে বিন্দু পরিমাণ ধারণাও আছে তোমার?”

“আরে কী হয়েছে তা বলবে তো।”

“তোমার মেয়ে এক বখাটের সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়েছে। তার প্রেমিক এখন বাহিরে দাঁড়িয়ে যাচ্ছেতাই করছে। এসব বখাটেকে কখনো আমি আমার পরিবারের সদস্য করব না। তোমার মেয়ে কিভাবে তাকে বিয়ে করে আমি শুধু তা ই দেখব৷ এখনই আমি এই ছেলের একটা ব্যবস্থা করছি।”

মঈনুল হাসানের কণ্ঠে আগুন ঝলসে পড়ছে। তিনি এবার পূর্ণতার দিকে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে বললেন,

“বিয়ে তো তোমার অরিত্রকেই করতে হবে। ওর সাথে তোমার বিয়ে আমি দিয়েই ছাড়ব। বাই হুক ওর বাই ক্রুক।”

মঈনুল হাসান পূর্ণতা র মা নাজিবাকে টেনে বাহিরে নিয়ে গেলেন। নাজিবা হাসানও এসব কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে ছিলেন। মঈনুল হাসান পূর্ণতার রুমের বাহির থেকে দরজা লাগিয়ে দিলেন। পূর্ণতা এখনো কিংকর্তব্যবিমূঢ়
হয়ে সোফায় বসে আছে। এতক্ষণ ঘরের মাঝে বয়ে যাওয়া ঝড়ের সূত্র বুঝতে তার খানিকটা বেগ পেতে হলো। মনে হলো কোনো দুঃস্বপ্নের ঘোরে আছে। ঘোর কাটতেই সে ভাবতে লাগলো এর মানে কী? তার বাবা এসব কী বলে গেল? পূর্ণতার গায়ে তার বাবা হাত তুলেছে! এটা কিভাবে সম্ভব? যে বাবা তাঁর মেয়েদেরকে কখনো ফুলের টোকাও দেননি, আজ সে বাবা চড় মারল! তাও আবার পূর্ণতাকে! যে কিনা তার হৃদয়েরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিশ্বাস হচ্ছে না পূর্ণতার। সে ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে আয়নায় তার গালটা দেখল। পাঁচ আঙুলের ছাপ স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। অভিমানে পূর্ণতার বুক হুহু করে উঠলো।

পূর্ণতারা দুবোন। পূর্ণতা বড়। তার বয়স ঊনিশ পেরিয়ে বিশ হতে চলেছে। অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্রী সে। ফর্সা রঙ আর ছিপছাপ গড়নের ছোট্ট পুতুল সাইজের একটা মায়াবী কন্যা। শান্ত স্বভাবের অধিকারী সে। পূর্ণতার ছোট বোনের নাম মৌনতা। সে এবার ক্লাস সেভেনে পড়ে। ফর্সা, নাদুসনুদুস মৌনতা বেশ চঞ্চল ও প্রাণবন্ত। বাবা, মা আর ছোট বোন মৌনতাকে নিয়েই পূর্ণতার ছোট্ট পরিবার। পূর্ণতার বাবা মঈনুল হাসান কলেজের শিক্ষক। মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে পূর্ণতা। কিন্তু তাদের কোনো ইচ্ছের কমতি রাখেননি মঈনুল সাহেব। দুই মেয়ে হলো তাঁর দুই নয়নের মণি। কোনোদিন একটা ফুলের টোকা অবধি দেননি মেয়েদেরকে। কিন্তু আজ তিনি পূর্ণতাকে চড় মেরেছেন! এ যেন পূর্ণতা মেনে নিতে পারছে না।

পূর্ণতা প্র‍থম সন্তান হওয়ার কারণে তার প্রতি মঈনুল হাসানের ভালোবাসাটা আরও বেশি ছিল। পূর্ণতা এই ব্যাপারটা খুব ভালোভাবে অনুভব করতে পারতো। তাই ছোট থেকে জেনে শুনে এমন কোনো কাজ করেনি যেটাতে তার বাবা মা কষ্ট পাবে। বাবা মায়ের সব কথা মেনে চলতো সে। বড় হয়ে যখন সবকিছু বুঝতে শুরু করে, তখন সে একটা জিনিস খুব করে বুঝতে পারল যে সে যদি তার বাবার পছন্দের ছেলেকে বিয়ে না করে তাহলে তার বাবা খুব কষ্ট পাবেন। তাই কখনো কোনো ছেলের দিকে ফিরে তাকায়নি পূর্ণতা। কোনো ছেলে তাকে প্রপোজ করলে তাকে সূক্ষভাবে এড়িয়ে যেত। তার আশেপাশের প্রত্যেকটা মানুষ খুব ভালো করে জানে যে পূর্ণতা কখনোই কোনো রিলেশনশিপে জড়াবে না। কিন্তু আজ তার বাবা এত বড় অপবাদ দিল!

মঈনুল হাসান মাস খানিক আগে অরিত্র আহসান নামের এক ছেলের সাথে পূর্ণতার বিয়ের কথাবার্তা বলেন।অরিত্র এক সময় পূর্ণতার বাবার কলেজের ছাত্র ছিল। মঈনুল হাসানের খুব স্নেহের ছাত্র সে। তাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুব ভালো। বেশ ভালো ও ভদ্র পরিবারের ছেলে অরিত্র। অরিত্র, তার ছোট বোন আর বাবা মা নিয়ে ছোট্ট পরিবার। অরিত্রের বাবা মাকে মঈনুল হাসান আগে থেকেই চিনতেন। তাঁরা খুব ভালো মানুষ। অরিত্রের বাবা পূর্ণতার জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসতেই মঈনুল হাসান বেশ অবাক হয় এই ভেবে যে অরিত্র বা তার পরিবার পূর্ণতাকে কিভাবে দেখেছে তা তিনি জানতেন না। তবুও তিনি উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন অরিত্রের মতো ভালো ছেলে পেয়ে। কিন্তু পূর্ণতা জানল, সে বিয়ে করতে চায় না। কারণ সামনে তার ফার্স্ট ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা, সে চায় না তার পড়াশোনায় কোনো প্রভাব পড়ুক। পড়াশোনা শেষ করে করে তারপর বিয়ে করবে বলে জানায় সে। এই কথাটা সে তার বাবা মাকে জানায়।

কিন্তু আরেকটা কারণ তার মনের মধ্যে চাপা পড়ে ছিল। আর তা হলো, অরিত্রের বয়স। অরিত্রের বয়স একত্রিশ। পূর্ণতার চেয়ে প্রায় বারো বছরের বড়। নিজের চেয়ে বয়সে এত বড় কাউকে বিয়ে করতে ইচ্ছে করছিল না। এক প্রকার জেদের বসে সে অরিত্রের ছবি পর্যন্ত দেখেনি। মনের মধ্যে অভিমান ছিল, তার বাবা কিনা শেষ পর্যন্ত একজন বুড়োর সাথে তার বিয়ে ফিতে চাইছে! কিন্তু তার বাবার পছন্দ করা ছেলেকে তার নিজের পছন্দ হয়নি বিষয়টি জানলে বাবা কষ্ট পাবেন। এই ভেবে কারণটি নিজের মধ্যে চেপে যায়। সে পড়াশোনার কারণ দেখিয়ে বিয়েটা ঠেকাতে চেয়েছিল। কিন্তু অরিত্রের পরিবার জানায়, তারা এখন শুধু আগদ্ পড়াবে। রিসিপশন পূর্ণতার ফার্স্ট ইয়ার ফাইনাল এক্সামের পরেই হবে। আর বিয়ের পরে পূর্ণতার পড়াশোনায় কোনো ঝামেলা হবে না। পূর্ণতার বাবা মা খুশি হলেন খুব। অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে পূর্ণতাকে রাজি করালেন তারা। পূর্ণতা দেখল তার পরিবার খুব খুশি। তাই বিয়েতে রাজি হয়ে গেল। কিন্তু পূর্ণতার বাবার বলা কথাগুলো এখনো অবধি বোধগম্য হয়নি পূর্ণতার। কান্না করতে করতে চোখমুখ ফুলে উঠলো পূর্ণতার। কিছুক্ষণ পরে পার্লারের মেয়েরা এসে তাকে হালকাভাবে সাজিয়ে দিল। একে একে বিয়ে সম্পন্ন হলো। পূর্ণতা যেন একটা ঘোরের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। আশেপাশে মেহমান গিজগিজ করছে। বিয়ের কার্যক্রম শেষ হওয়ার পরে পূর্ণতাকে নিয়ে তার রুমে বসানো হলো। তার সাথে অবন্তী কিছুক্ষণ কথা বলল। অবন্তী অরিত্রের ছোট বোন। পূর্ণতার এক বছরের ছোট সে। খুব মিশুক একটা মেয়ে সে। তার সাথে কথা বলতে বলতে পূর্ণতার মন যেন একটু হালকা হলো। একটা সময় পূর্ণতার এক ভাবি এসে সবাইকে রুম থেকে বের হতে বলল। একে একে সবাই বের হয়ে যেতেই ভাবি পূর্ণতাকে ‘বেস্ট অফ লাক’ বলে চোখ মেরে চলে গেল। পূর্ণতার মুখটা চুপসে গেল। মন খারাপ হয়ে গেল আবারও। কিছুক্ষণের মধ্যে রুমের মধ্যে কারও আগমন ঘটলো। পূর্ণতা বুঝতে পারল এটা অরিত্র। কিন্তু সে স্থিরভাবে বসে রইলো। এই মুহূর্তে তার অরিত্রের উপর রাগ হচ্ছে। ভীষণ রকমের রাগ। অরিত্র যদি তাকে বিয়ে করতে না চাইতো তাহলে হয়তো এতো কিছু হতো না। অরিত্র পূর্ণতার মুখোমুখি বসল। বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে রইল পূর্ণতার দিকে। পূর্ণতার রাগের পরিমাণ বাড়ছে। অরিত্র কিছুক্ষণ পরে বলল,

“আমার উপর খুব রাগ হচ্ছে পূর্ণতা? রাগ একটুও কমেনি?”
পূর্ণতা কিছু বলল না। চুপচাপ মাথা নুইয়ে বসে রইলো। সামনে বসে থাকা মানুষটার দিকে তাকাতেও ইচ্ছে করছে না। পূর্ণতার নিরবতায় হালকা হাসলো অরিত্র। একটু এগিয়ে পূর্ণতার চিবুক ধরে বলল,

“কান্নাকাটি করে তো চোখ মুখ লাল করে ফেলেছেন মিসেস অরিত্র আহসান। ওমন টমেটোর মতো লাল লাল মুখ করে রাখলে আপনাকে বাঁচাবে কে? এখন রাত বারোটা। রাতের নিস্তব্ধতাটা অনুভব করতে পারছেন?”

পূর্ণতা ভয়ার্ত চোখে তাকালো অরিত্রের দিকে। তার চোখ দুটো পানিতে ঘোলাটে হয়ে উঠেছে। এই প্রথম সে তার সামনের পুরুষটির দিকে তাকিয়েছে সে। সাদা পাঞ্জাবি পড়া এক সুপুরুষ বসে আছে তার সামনে। আবারও হাসলো অরিত্র। সে এটাই চাইছিল যে পূর্ণতা তার দিকে তাকাক। পূর্ণতার ভয়ার্ত চোখ দেখে সে বলল,

” বিয়েটা হয়তো তোমার মনের বিরুদ্ধে হয়েছে পূর্ণতা। কিন্তু এরপর থেকে কোনো কিছু তোমার মতের বিরুদ্ধে হবে না।”

কথাটি বলে পূর্ণতার ঘেমে উঠা নাকের ডগায় একটা চুমু খেল অরিত্র। তারপর সোজা রুম থেকে বেরিয়ে গেল। পূর্ণতা স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর দরজা লাগিয়ে শুয়ে পড়লো। মাঝ রাতে মনে হলো সে গালে কারও স্পর্শ অনুভব করছে। অরিত্র তো চলে গেছে। আর সে তো দরজা লাগিয়ে শুয়েছিল। তাহলে তার রুমে কে?

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here