#হৃদয়গ্রাহী
#পর্ব_০২,০৩
#সারিফা_তাহরিম
০২
গালে আবারও সেই শক্তপোক্ত হাতের স্পর্শ পেতেই স্তব্ধ হয়ে গেল পূর্ণতা। এইবার ঘুম পুরোপুরি ছুটে গেল। কিন্তু নড়ল না। অরিত্র তো তখন বের হয়ে গিয়েছিল। এখন কি আবার ফিরে এসেছে? প্রশ্নটা মাথায় আসতেই মস্তিষ্ক নেতিবাচক সায় দিল। অরিত্র আসার কোনো সম্ভাবনা তো নেই। কারণ সে যাওয়ার পরপরই পূর্ণতা দরজা লক করেছিল। স্পষ্ট মনে আছে পূর্ণতার। অরিত্র যদি না-ই হয়ে থাকে তাহলে এই মুহূর্তে কে বসে আছে? তখনই মনে হলো পূর্ণতার গালের উপর শীতল স্পর্শ হলো। গালটা ভিজে উঠলো। পূর্ণতা চমকে উঠলো। ঘুমের ভান করেই চোখ আলতো করে খুলল যাতে বুঝা না যায় যে সে জেগে গেছে।
ড্রিম লাইটের হলদে টিমটিমে আলোয় দেখতে পেল একটা আবছা অবয়ব তার গালে আদর করতে করতে হালকা হালকা কেঁপে উঠছে। পূর্ণতা আৎকে উঠলো। এ যে তার বাবা! বাবা এত রাতে এসে কান্না করছেন! তাও আবার গালে হাত বুলিয়ে! পূর্ণতা বুঝতে পারল দুপুরের সেই চড় দেওয়ার জন্য কষ্ট পাচ্ছেন। মুহূর্তেই পূর্ণতার অভিমানের পাহাড় ভেঙে গুড়িয়ে অশ্রুকণায় রূপান্তরিত হতে চাইল।
বাবা নামক মানুষগুলো এত যত্নশীল হয় কেন? সন্তানকে একটা চড় মেরে বাবা তো আরও বেশি কষ্ট পাচ্ছেন। পূর্ণতার মন সিক্ত হয়ে উঠলো। বাবাকে জড়িয়ে ধরে অঝোর ধারায় অশ্রু বিসর্জন দিতে ইচ্ছে করছে তার। কিন্তু সে নিজেকে অতি কষ্টে সামলে নিল। বাবা যদি জানতে পারেন যে পূর্ণতা জেগে গেছে তাহলে তিনি হয়তো অস্বস্তিতে পড়ে যাবেন। কারণ নিজেদের কষ্টকে কখনো দৃশ্যমান হতে দেন না, বরং গাম্ভীর্যতা ও কঠোরতার আড়ালে লুকিয়ে রাখতে চায়। পূর্ণতা নিজের অশ্রুকণাকে আড়াল করতে থাকল। মঈনুল হাসান কিছুক্ষণ পর মেয়ের মুখে হাত বুলিয়ে কপালে চুমু দিয়ে চলে গেলেন। প্রতিটা রুমের একটা এক্সট্রা চাবি তাঁর কাছে সবসময় থাকে। তাই পূর্ণতার রুমে আসতে কষ্ট হয়নি। মঈনুল হাসান বেরিয়ে যেতেই পূর্ণতা অপর পাশে ফিরে বালিশে মুখ গুজে কাঁদতে লাগলো। অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে মনে মনে বারকয়েক একটা কথা আওড়াল যা কখনো প্রকাশ্যে বলা হয়নি। সেটা হচ্ছে,
‘আমি তোমায় ভীষণ ভালোবাসি বাবা’
________
গ্রীষ্মের তীক্ষ্ণ রোদ আকাশের বুক চিড়ে উঁকিঝুঁকি মারছে ধরনীর বুকে। বাহারি রকমের ফুলের সুবাস ঘরময় বিচরণ করছে। বাড়ির পাশের ইউক্যালিপটাস গাছ থেকে কয়েক জোড়া পাখির কিচিরমিচিরে ঘুম ছুটে গেল পূর্ণতার। জানালার পর্দা ভেদ করে আসা তীক্ষ্ণ আলোকরশ্মির কারণে চোখ মেলা দায় হয়ে পড়েছে। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে পিটপিট করে চোখ খুলল পূর্ণতা। আড়মোড়া ভেঙে দেয়াল ঘড়িতে চোখ বুলাতেই দেখল সকাল দশটা বেজে গেছে। পূর্ণতা ঘুমপ্রিয় মানবী হলেও ভার্সিটি যাওয়ার জন্য প্রায় সময় ই তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে। আজও ভার্সিটি যাবে ভেবেছিল। সামনে পরীক্ষা তাই কোনো ক্লাসই মিস দিতে ইচ্ছুক নয় পূর্ণতা। কিন্তু গতকাল এত ধকল যাওয়ার পরে শরীর পুরোই নেতিয়ে পড়েছিল পূর্ণতার। তাই আর ঘুম থেকে উঠতে পারেনি। আর মাও আজ তাকে ডাকল না! ভারি অবাক হলো পূর্ণতা। ফ্রেশ হয়ে রুম থেকে বেরুতেই দেখল তার বাবা বসার ঘরে বসে পেপার পড়ছেন। চোখে চশমা, মুখে গাম্ভীর্যতা। ডাইনিং রুমে মা আর মৌনতা বসে গল্প করছে আর নাস্তা করছে। পূর্ণতা সেদিকে যেতেই মা খানিকটা গম্ভীর হয়ে গেল। মৌনতা বলল,
“আপু, বয় তাড়াতাড়ি। কত বেলা হয়ে গেল তুই এখনো কিছু খাসনি। তাড়াতাড়ি খেয়ে নে। আমি পরোটা ভেজে আনছি দাড়া।”
মৌনতার কথার মাঝে পূর্ণতা চেয়ারে বসতেই মা উঠে চলে গেলেন রান্নাঘরে। ব্যাপারটা বোধগম্য হলো না পূর্ণতার। মা কি তার উপর কোনো কারণে রেগে আছে? সে মৌনতাকে বলল,
“তোর কষ্ট করতে হবে না মনাপাখি। তুই বয়। আমি নিজেই পরোটা ভেজে আনছি। ”
পূর্ণতা পরোটা ভাজার উদ্দেশ্যে রান্নাঘরে গেলেও তার মূল উদ্দেশ্য মায়ের ভাব ভঙ্গিমা পরখ করে দেখা। সে রান্নাঘরে গিয়ে মাকে সবসময়ের মতো স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,
“মা, খিদে পেয়েছে ভীষণ। পরোটা কোথায় রেখেছ? তাড়াতাড়ি বলো। খিদেয় পেটের ভেতর ছুঁচো দৌড়াচ্ছে।”
অন্যদিন হলে এতক্ষণে পূর্ণতা বেশ কয়েকটা বকা শুনতো খাভারের অনিয়মের কারণে। কিন্তু মা আজ কোনো কথা বললেন না। চুপচাপ পরোটা এনে পূর্ণতার সামনে দিলেন ভেজে নেওয়ার জন্য। মায়ের এমন নিরবতা মেনে নিতে পারল না পূর্ণতা। মা কী তাকে এড়িয়ে যাচ্ছে? গতকাল নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে হলেও বিয়েটা করেছে, বাবা মেরেছে কতটা ধকল গেছে! মানসিকভাবে ভালো নেই পূর্ণতা। কিন্তু বাবা মায়ের খুশির জন্য ভালো থাকার অভিনয় করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। কিন্তু তার বদলে মা তার সাথে এমন ব্যবহার করছে? তিনি কি আদৌ জানেন পূর্ণতার মনে কতটা কষ্ট হচ্ছে?
পূর্ণতা নিজেকে স্বাভাবিক রেখে পরোটা ভেজে নিল। মাকে বলল,
“মা, চা টা তুমি বানিয়ে দাও না প্লিজ। আমার না ভীষণ আলসেমি লাগছে৷”
‘এই মেয়ের জ্বালায় শান্তি পাব না আমি। এত বড় ধাড়ী মেয়ে হয়ে গেল কিন্তু মায়ের উপর বসে খাওয়ার অভ্যাসটা গেল না। বলি কি, শ্বশুরবাড়িতেও কি মাকে সাথে নিয়ে যাবি নিজের কাজ করানোর জন্য? তখন নিজের কাজগুলো কে করে দিবে? শ্বাশুড়ি যদি বিচার নিয়ে আসে তাহলে কিন্তু আমি সামলাতে পারব না বলে দিলাম।’
পূর্ণতা প্রতিদিন সকালের মতো এমনই একটা উত্তর আশা করছিল। কিন্তু না, আজ আর তা হলো না। মা কোনো জবাব দিলেন না। চায়ের ফ্লাক্স এনে পূর্ণতার সামনে রাখলেন। মায়ের ব্যবহার অবাক হলো এবং কষ্টও পেল। মা এমন কেন করছে তার সাথে? কী দোষ তার? কান্না পেল পূর্ণতার। কিন্তু সে স্থির রইলো। খাবার টেবিলে মৌনতা পূর্ণতার বিয়ে সংক্রান্ত অনেক কথা বললেও পূর্ণতা আর তার মা শুধু শুনেই গেল। কেউ কোনো কথা বলল না। খাওয়া শেষে টেবিল থেকে ওঠার সময় নাজিবা হাসান পূর্ণতার উদ্দেশ্যে বললেন,
“আজ বিকেলে অরিত্রের পরিবার আসবে তোমাকে দেখতে। নতুন নতুন বিয়ে হয়েছে তাই একটু পরিপাটি হয়ে থাকবে। সুন্দরভাবে কথা বলবে তাদের সাথে, বিশেষ করে অরিত্রের সাথে। কোনো ঝামেলা যেন না হয় আগেই বলে দিলাম।”
মায়ের কণ্ঠস্বর পেয়ে পূর্ণতা মনে মনে আলোড়িত হলেও তার কথা শুনে সেখানে ঠাঁই দাঁড়িয়ে পড়ল। আবারও সেই অসহ্যকর মানুষটার সাথে দেখা হবে? ভাবতে পারছে না সে। তার উপর মায়ের কথাগুলো কেমন যেন ছিল। কেমন কড়া কণ্ঠ, রাগী আর যত্নহীন মনে হলো। পূর্ণতা রুমে এসে পড়লো। তার চোখ থেকে দু ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ল। সে আসলেই বুঝতে পারছে না কী হচ্ছে এসব। এই অরিত্র নামক মানুষটা তার জীবনে আসার পর থেক্বি সবকিছু কেমন উলোট পালোট হতে শুরু করলো যেন। ফোন তীব্র স্বরে বেজে উঠলো। পূর্ণতা বিরক্ত হলো। অচেনা নাম্বার দেখে ফোন রিসিভ করলো না। আরও কয়েকবার ফোন আসার পর পূর্ণতা আকাশসম বিরক্তি নিয়ে ফোন রিসিভ করল।
“আসসালামু আলাইকুম। কে বলছেন?”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম। আমি অরিত্র। কেমন আছেন মিসেস? এখনো অবধি আমার নাম্বার সেইভ করেননি?”
অরিত্রের কণ্ঠ শুনে গা জ্বালা করে উঠলো পূর্ণতার। যে মানুষটাকে এতক্ষণ রাগে গালি দিচ্ছিল সে মানুষটাই কিনা এখন কল করেছে। পূর্ণতার পাহাড়সম রাগ হলো। গম্ভীর আর কিছুটা রাগী স্বরে বলল,
“আপনি আমার জীবনে আসার পর যেমন থাকার কথা ঠিক তেমনই আছি। আর আপনার নাম্বার থেকে তো আমার নাম্বারে কখনো কল আসেনি তাই সেইভ করার প্রশ্ন আসছে না।”
অরিত্র স্মিত হাসলো। ফোনের এপাশ থেকে তা বোঝা গেল না। সে নরম সুরে বলল,
“ম্যাডাম রেগে আছেন বুঝি?”
পূর্ণতা প্রতুত্তর করল না। অরিত্র বলল,
“ইশ! কত্ত রাগ আমার পিচ্চি বউটার। এত পিচ্চি একটা মেয়ে হয়ে এত এত রাগ নিয়ে কিভাবে চলেন বলো তো। এত রাগ কিন্তু স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তাই রাগ করে না থেকে হাসো। রাগ ঝেড়ে ফেলো। তারপর দেখবে ভালো লাগছে।”
পূর্ণতা কপট রাগ দেখিয়ে বলল,
“তা রাগ কার উপর ঝাড়বো? আপনার উপর?”
অরিত্র আবারও হাসলো। অমায়িক সেই হাসি। সে নরম স্বরে বলল,
“বউটাও আমার, রাগটাও আমার উপর। তাই আমার উপরই রাগ ঝাড়ো। যত খুশি তত রাগ ঝাড়ো। আমি সবটা সয়ে নিব। তবুও তুমি দিন শেষে একটু মন খুলে কথা বলো, একটু হাসো, একটু নিজের মতো করে বাঁচো। এটাই চাই।”
পূর্ণতা কিছু বলল না। এই লোকটার সাথে কথা বলার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে তার নেই। মুখের উপর ফোন কেটেও দিতে পারছে না। বেশ কিছুক্ষণ পর অরিত্র বলল,
“আজ তোমাদের বাসায় যাব। আমার রাগী বউটার পাহাড়সম রাগ গলানোর জন্য কী করতে হবে বলো।”
পূর্ণতা যেন এবার একটা সুযোগ পেল। বারান্দা দিয়ে বাহিরের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেঁসে বলল…
চলবে…
#হৃদয়গ্রাহী
#পর্ব_০৩
#সারিফা_তাহরিম
“আজ তোমাদের বাসায় যাব। আমার রাগী বউটার পাহাড়সম রাগ গলানোর জন্য কী করতে হবে বলো।”
পূর্ণতা যেন এবার একটা সুযোগ পেল। বারান্দা দিয়ে বাহিরের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেঁসে বলল,
” এতই যখন রাগ ভাঙানোর শখ, তখন আপনি না আসলেই পারেন। আপনার উপস্থিতি আমার সহ্য হয় না। রাগ ভাঙাতে আসলে উল্টো রাগটা বেড়ে যাবে। তাই বৃথা চেষ্টা না করে অন্তত আমায় একটু শান্তিতে থাকতে দিন প্লিজ।”
“বেশ! তবে তাই হোক। আপনার হুকুম শিরোধার্য পূর্ণতারাণী।”
একটু থেমে শ্বাস ফেলে বলল,
“এখন রাখছি তাহলে। নিজের খেয়াল রেখো। আল্লাহ হাফেজ। ”
পূর্ণতা বিদায়বাণী না জানিয়েই ফোন রেখে দিল। পড়ার টেবিলে বসে বইয়ে মুখ গুজল। সামনে পরীক্ষা তাই পড়ায় মনোনিবেশ করার চেষ্টা করল। কিন্তু বিশেষ লাভ হলো না। ঘুরে ফিরে বাবা মায়ের কঠোর ব্যবহারের কথা মনে পড়ছে। বাবা মা এমন কেন করছে তার জানা নেই। সেদিন বাবা কোন ছেলের কথা বলেছিলেন তাও জানে না পূর্ণতা। সে শুধু এটুকুই জানে তার জীবনে হুট করেই এই নতুন রূপী ঋতুর আবহাওয়া তার ভালো লাগছে না।
____
এদিকে পূর্ণতা ফোন রাখতেই অরিত্র রিভলভিং চেয়ারটায় মাথা এলিয়ে দিল। টাইয়ের নটটা হালকা ঢিলে করলো। প্রেয়সীর রাগের উত্তাপে এই এসি রুমের মধ্যে থেকেও ঘেমে সিক্ত হয়ে উঠেছে অরিত্র। নিজের চেয়ে বয়সে অনেক ছোট একটা মেয়ের এতখানি রাগে অবাক হয় অরিত্র। এইতো সবে নতুন জীবন শুরু হলো। এমন রাগেতপ্ত প্রেয়সীর রাগের আগুনে বরফ পানির মতো শীতল অরিত্র না আবার বাষ্প হয়ে যায়! নিজের ভাবনায় আনমনেই হাসলো অরিত্র। এই মেয়েটাকে দেখার পর থেকে তার অদ্ভুত অসুখ হয়েছে। যেখানে সেখানে পূর্ণতাকে দেখতে পায় সে। রংতুলিরা হুটহাট হৃদয় ক্যানভাসে সেই মেয়েটার প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তুলে। তার যেন হৃদয় নামক তৃতীয় নয়ন উৎসর্গ হয়েছে মেয়েটিকে দেখার জন্যে। তাই তো তার তুষার রাঙা অর্ধাঙ্গিনীর নাম,
‘হৃদয়াক্ষী’
অরিত্রের সেই দিনটা ভীষণ মনে পড়ে যেদিন সে পূর্ণতাকে প্রথম দেখেছিল। দিনটার কথা ভাবতেই অরিত্রের মনে প্রশান্তি ছুঁয়ে যায়। কারণ এখন সেই রমণী তার অর্ধাঙ্গিনী। মেয়েটাকে রাজি করাতে বেশ কাঠ খড় পোড়াতে হয়েছিল তার কোনো ইয়াত্তা নেই। মঈনুল হাসানও বেশ কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছিলেন পূর্ণতাকে সে কিভাবে চিনে। কিন্তু অরিত্র সেই প্রশ্ন সূক্ষ্মভাবে এড়িয়ে যায়। রুমের দরজায় নক পড়তেই অরিত্রের ভাবনার সুতো ছিড়ে। সোজা হয়ে বসে বলল, ‘আসুন’। তখন একজন পিয়ন এসে কিছু ফাইল দিয়ে গেল টেবিলে। সেই সাথে এক কাপ ধোঁয়া ওঠা চা। পিয়ন যেতেই অরিত্র চায়ের কাপে চুমুক বসিয়ে ফাইলে মনোনিবেশ করল। একটা মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানির ম্যানেজার র্যাঙ্কে নিয়োজিত আছে। পরিবারের সব কাজের মতো অফিসের সকল কাজের ক্ষেত্রেও বেশ মনোযোগী আর দায়িত্বশীল। এজন্যই হয়তো সকলের পছন্দের পাত্র হয়ে উঠেছে সে।
______
বিকেল গড়িয়ে আসতেই সূর্য খানিকটা পশ্চিম আকাশে নেতিয়ে পড়েছে। বারান্দার মেঝেতে নরম সূর্যালোক এসে লুটোপুটি খাচ্ছে। এই মুহূর্তে পূর্ণতার ঘরে শীতলতা বিরাজ করছে। সে আয়নার সামনে বসে আছে। পড়নে বেগুনি রঙের একটা শাড়ি। কিছুক্ষণ আগে মা এসে তাকে শাড়িটা পড়িয়ে দিয়ে গেছেন। সেই ফাঁকে পূর্ণতা খানিকটা ভাব জমাতে চাইলো মায়ের সাথে। কিন্তু বিশেষ লাভ হলো না। নাজিবা হাসান একটা কথাও বললেন না মেয়ের সাথে। সকাল থেকে মঈনুল হাসানও তাকে এড়িয়ে যাচ্ছে। এসব কথা ভাবতেই দুচোখ ভিজে উঠল। নিজেকে তাড়াতাড়ি সামলে নিল পূর্ণতা কিছুক্ষণের মধ্যেই অরিত্রের পরিবার চলে আসবে। কিন্তু পূর্ণতার মধ্যে একটা চাপা ভয় ইয়াজ করছে। সে তো মুখের উপর অরিত্রকে আসতে নিষেধ করলো ঠিকই, কিন্তু না সার কারণ জানতে চাইলে সে যদি তার পরিবারকে সত্যি কথা বলে দেয় তাহলে ব্যাপারটা খারাপ দেখাবে। পূর্ণতা আর তার পরিবার ছোট হয়ে যাবে তাদের সামনে। এই মুহূর্তে পূর্ণতা নিজের করা কাজের জন্য পস্তাচ্ছে।
কিছুক্ষণ পরে মৌনতা এসে বলল অরিত্রের পরিবারের সবাই চলে এসেছে। পূর্ণতা একটু অস্বস্তিতে জড়িয়ে গেল। মৌনতা তাকে বসার ঘরে নিয়ে গেল। এক পাশের সোফায় অরিত্রের মা বাবা আর অবন্তী বসে আছে। আরেকটা সিংগেল সোফায় মঈনুল হাসান বসে আছেন। তার ঠিক পেছনে নাজিবা হাসান দাঁড়িয়ে আছেন। পূর্ণতা সালাম দিল। মৌনতা তাকে সোফায় বসিয়ে দিল। অরিত্রের বাবা মা প্রসন্ন হেসে সালাম নিলেন। অরিত্রের মা আনিকা ইসলাম পুত্রবধূর পাশে এসে বসলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“কেমন আছো আম্মু?”
“জ্বি আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি আন্টি। আপনি কেমন আছেন?”
“আমিও আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। এত মিষ্টি একটা মেয়েকে ঘরের বউ করার পর কি কেউ খারাপ থাকতে পারে? তবে এখন থেকে আন্টি ডাকলে চলবে না। মা ডাকতে হবে। অবন্তী যেমন আমার মেয়ে তুমিও তো আমার মেয়ে। তাই আন্টি ডাকলে হবে না। বুঝলে আম্মু?”
পূর্ণতার হালকা লাজুক হেসে বলল,
“জ্বি আম্মু।”
মঈনুল হাসান জিজ্ঞেস করলেন,
” অরিত্র বাবা আসেনি যে?”
আনিকা ইসলাম বললেন,
“আর বলবেন না ভাই। এই ছেলেকে নিয়ে আমি আর পারি না। গতকাল মাত্র বিয়ে হলো। আমি বললাম আজ এখানে আসার পরে কোথাও ঘুরতে বের হতে। সে বলল অফিসের কাজ সেরে আসবে। কিন্তু কিছুক্ষণ আগে বলল হুট করে নাকি কিসের মিটিং পড়ে গেছে। তাই আসতে পারবে না। কাজের ক্ষেত্রে হেলাফেলা করা এই ছেলে একদমই পছন্দ করে না। আপনারা কিছু মনে করবেন না ভাই।
মঈনুল হাসানের মুখ উজ্জ্বল হলো। তিনি বললেন,
“আরে না না আপা কী মনে করব। অরিত্র বাবা একজন দায়িত্বশীল মানুষ। ব্যাপারটা শুনে তো আমার আরও ভালো লাগছে। আর পূর্ণতাকে নিয়ে নাহয় অন্য একদিন সময় করে বের হবে।”
আনিকা ইসলাম পূর্ণতাকে বললেন,
“তুমি করো না আম্মু। অরিত্র বাসায় এলে আমি ওকে বকে দিব। নতুন নতুন বিয়ে হলো এখনই তো ঘোরাঘুরির সময়। আমি অরিত্রকে বলবো অফিস থেকে ছুটি নিয়ে তোমাকে ঘুরতে নিয়ে যেতে।”
পূর্ণতা এবার লজ্জা পেল। অপ্রস্তুত মুখে একটু হাসার চেষ্টা করল। তার মাথায় এখন একটা কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে। অরিত্র তাহলে মিথ্যা বলেছে? কিন্তু কেন? পূর্ণতার দিকটা বিবেচনা করে নাকি সত্যিই মিটিং আছে? সবাই বেশ কিছুক্ষণ কথা বলল। শাড়ি পড়ে বসে থাকতে অস্বস্তি হচ্ছে পূর্ণতার। মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। আনিকা ইসলাম তা লক্ষ্য করে বললেন,
“আম্মু তুমি তো ঘেমে গেছ। শাড়ি পড়ে কষ্ট হচ্ছে মনে হয়। খারাপ লাগলে শাড়ি পড়তে হবে না, থ্রি পিছ পড়ে এসো। এখানে তো আমরা ঘরের মানুষই। তোমার এত আঁটসাঁট হয়ে থাকতে হবে না। যাও তুমি জামা পালটে এসো।”
আনিকা ইসলামের কথায় স্বস্তি পেল পূর্ণতা। এতক্ষণ ধরে হাসফাস লাগছিল তার। আনিকা ইসলামের কথায় সায় দিয়ে সে রুমের দিকে পা বাড়াল। মনে মনে কৃতজ্ঞতা জানাল। আসলেই মানুষগুলো ভীষণ ভালো। রুমে এসে বসতেই ফোন বেজে উঠলো। অরিত্র ফোন করেছে। পূর্ণতা বিরক্তিতে ভ্রু কুচকালো। ফোন রিসিভ করে কিছু বলল না। অরিত্র বলল,
” ম্যাডামের রাগ কমেছে?”
পূর্ণতা সেই কথার উত্তর না দিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” আপনি মিথ্যে বললেন কেন?”
“কোন ব্যাপারে মিথ্যা বললাম?”
” এখানে না আসার কারণ সম্পর্কে মিথ্যে বললেন কেন?”
অরিত্র স্মিত হেসে বলল,
“আমি ওতোটাও শ্রেষ্ঠ মানুষ না যে একটাও মিথ্যা কথা বলি না। ক্ষেত্রবিশেষে খুব বেশি প্রয়োজন হলে আমারও মিথ্যের আশ্রয় নিতে হয়। আর এই ব্যাপারে মিথ্যা বলার দুটো কারণ আছে। প্রথমত, সত্যিটা জানলে আমার বাবা মায়ের তুমি ও তোমার বাবা মা ছোট হয়ে যেতে। দ্বিতীয়ত, আমরা এখন বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ। এই সম্পর্কে কোনো সময় রাগ থাকবে কখনো ভালোবাসা কখনো অভিমান। এগুলো আমাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখাটাকেই আমি ভালো মনে করি।”
অরিত্রের কথা শুনে একটা শ্বাস ফেলল পূর্ণতা। কিছু বলার আগেই পেছন থেকে কেউ তাকে ঝাপটে ধরতেই সে চমকে উঠলো।
চলবে…