হৃদয়গ্রাহী #পর্ব_০৪,০৫

0
668

#হৃদয়গ্রাহী
#পর্ব_০৪,০৫
#সারিফা_তাহরিম
০৪

কিছু বলার আগেই পেছন থেকে কেউ তাকে ঝাপটে ধরতেই সে চমকে উঠলো। হাত থেকে মোবাইল ছুটে বিছানায় পড়ে গেছে। পূর্ণতা পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখল অবন্তী তাকে জড়িয়ে ধরেছে। আর মৌনতা পেছনে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি করে হাসছে। অবন্তী বলল,

‘কী ভাবিজি? রুমে এসে আমার ভাইয়ের সাথে প্রেম করা হচ্ছে বুঝি?’

পূর্ণতা অবন্তীর দিকে ফিরে অপ্রস্তুত হেসে বলল,

‘আরে না এমনি কল দিয়েছিল তোমার ভাইয়া।’

‘থাক আর কৈফিয়ত দিতে হবে না। তুমি ভাইয়ার সাথে কথা বলা শুরু করো। আমার ভাই বেচারা তোমার সাথে কথা বলতে না পেরে ছটফট করছে।’

অবন্তী ফোনটা নিয়ে লাউড স্পিকারে দিয়ে পূর্ণতার মুখের সামনে ধরল। তার চোখে মুখে চঞ্চলতা ভীড় করছে। ওপাশ থেকে অরিত্র ‘হ্যালো হ্যালো’ বলছে। পূর্ণতা কাঁপা স্বরে হ্যালো বলতেই অরিত্র ঠান্ডা গলায় বলল,

‘প্রেয়সী, তুমি কি রেগে আছো এখনো? রাগটা কি একটু কমানো যায় না? তোমার রাগের উত্তাপে যে এই শীতল মানবটা বাষ্প হয়ে যাচ্ছে। একটুও কি মায়া হচ্ছে না আমার জন্য?’

অরিত্রের কথা শুনে অবন্তী আর মৌনতা শিস বাজালো। কিন্তু সেই আওয়াজ ফোনের ওপাশে যাওয়ার আগেই পূর্ণতা তাড়াতাড়ি ফোনটা নিয়ে কেটে দিল। অবন্তী আর মৌনতা দুজনেই খুব হাসছে। এই মুহূর্তে পূর্ণতা লজ্জায় জড়োসড়ো হয়ে যেতে লাগল। ইশ! এই লোকটা কেমন নির্লজ্জ! এই বিচ্ছু দুটো শুনে ফেলেছে কথাগুলো। এবার সারাদিন ক্ষেপাবে পূর্ণতাকে। অবন্তী পূর্ণতাকে বলল,

‘ইশ! ভাবি আমার রাগ করেছে। আর ভাইয়া সেই রাগে একেবারে বাষ্প হয়ে যাচ্ছে! প্রেম তাহলে এতদূর গড়িয়েছে! একদিন আসেনি বলে আমার ভাইটার সাথে রাগ করেছে ভাবি। তাহলে এই ছয়মাস কাটাবে কিভাবে? তুমি তো আমার ভাইকে রীতিমতো চোখে হারাচ্ছো। তোমাদের প্রেম জমে ক্ষীর হয়ে গেছে আর আমরা ঠিক মতো কিছু জানি না। এটা তো ভারি অন্যায়। কী বলো মৌনতা?’

মৌনতা সায় দিয়ে বলল,

‘একদম ঠিক। শতভাগ ঠিক। আপু তুই যে গভীর জলের মাছ, তা তো আগে জানতাম না। বিয়ে হতে না হতেই কত ভালোবাসা! আমার জিজুও কত রোমান্টিক! ইশ! আপু জানিস, আমার না ভীষণ আফসোস হচ্ছে। তুই তো আমার একটামাত্র বোন। আমার একটা রোমান্টিক দুলাভাই। কিন্তু তার কোনো রোমান্টিক ভাই নেই। আজ যদি তোর একটা রোমান্টিক দেবর থাকতো তাহলে আমি সাতপাঁচ না ভেবে তার গলায় ঝুলে পড়তাম। কিন্তু আমার কপালটাই খারাপ।’

কথাটি বলেই মুখ ফুলিয়ে বসল মৌনতা। অবন্তী তার পাশে বসে একই সুর ধরে বলল,

‘সেই দুঃখ তো আমারও হয় মৌনতা। আমার একটামাত্র ভাই। কিন্তু তার কোনো শ্যালক নেই। কত কত গল্পে পড়েছি ভাইয়ের শ্যালকের সাথে টুকটাক ঝগড়া হয়, কথা-কাটাকাটি হয়, তারপর ধীরে ধীরে প্রেম হয় অবশেষে বিয়ে। আমার ছোট থেকে আসা ছিল ভাবির ভাইয়ের সাথে প্রেম করব। কিন্তু আফসোস! আমার ভাবির তো কোনো ভাই ই নেই। প্রেম না হোক, অন্তত একবার শয়নে স্বপ্নে তাকে ভেবে ভেবে আমার দিন পার করার জন্য হলেও ভাবির একটা ভাইয়ের দরকার ছিল।’

মৌনতা একটু কিছুক্ষণ ভেবে বলল,

‘ অবন্তী আপু, আমাদের না এত আফসোস থাকতো না যদি তুমি ছেলে হতে। তখন তুমি ভাবির রোমান্টিক ভাইয়ের পরিবর্তে রোমান্টিক বোন খুঁজতে। আর সেই রোমান্টিক বোন আমি। আর আমার দুলাভাইয়ের রোমান্টিক ভাই তুমি হতে। সবকিছু খাপে খাপ মিলে যেত। কিন্তু আফসোস, তুমি মেয়ে। এবার আমরা রোমান্টিক, হ্যান্ডু হাসবেন্ড কোথায় পাব?’

অবন্তী আর মৌনতা গালে হাত দিয়ে বসে রইলো। প্রথম দিকএর কথায় পূর্ণতা লজ্জা পেলেও, তাদের পরের কথোপকথন শুনে বিস্মিত হলো। দুজন গালে হাত দিয়ে দেবদাস স্টাইলে গভীর বিষন্নতায় ডুব দিতেই শব্দ করে হেসে উঠলো পূর্ণতা।

______

চারপাশে নিস্তব্ধতা হাতছানি দিচ্ছে। এসির শীতল হাওয়া গ্রীষ্মের গরম ছাপিয়ে ঠান্ডা পরশ বুলাচ্ছে ঘরময়। ঘড়িতে রাত আটটা বেজে সতেরো মিনিট। অরিত্র কিছু ফাইল সামনে নিয়ে বসে আছে। অফিসে কয়েকজন স্টাফ, পিয়ন ও গার্ড ছাড়া আর কেউ নেই। আজ কাজের চাপ তেমন ছিল না। তাই প্রায় সবাই চলে গেছে। অরিত্রও ভেবেছিল সেও বাসায় চলে যাবে। তারপর পূর্ণতাদের বাসায় যাবে। কিন্তু পূর্ণতা বারণ করার পরে বাসায় জানালো আজ তার মিটিং আছে তাই পূর্ণতাদের বাসায় যেতে পারবে না। এই সময়টায় সে ফ্রি ছিল। চাইলে বাবা মা চলে যাওয়ার পরে বাসায় চলে আসতে পারত সে। কিন্তু সে ভাবল এই সময়টুকু কাজে লাগিয়ে অফিসের কাজ আরও কিছুটা কমিয়ে রাখা যেতে পারে। তাই আর বাসায় গেল না।

অরিত্র সময় দেখে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। এখন বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে তাদের বাসা বেশ কিছু দূরে রফিক মামার টঙ দোকানে যাবে। এই জায়গাটা তার প্রাণের বন্ধুদের আড্ডাস্থল। আগে প্রায় প্রতিদিন সন্ধ্যার দিকে সবাই মিলে একবার হলেও চা খেয়ে যেত। অল্প কিছুক্ষণের জন্য হলেও আড্ডা দিত। মাঝেমধ্যে আড্ডা দিতে দিতে কখন যে রাত হয়ে যেত কেউ টেরই পেত না। কিন্তু এখন সময়ের পরিক্রমায় অনেক কিছুর পরিবর্তন হয়েছে। সবাই নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত হয়ে পেড়েছে, প্রত্যেকের চাকরি ব্যবসা আর পরিবার নিয়ে অনেকটা সময় পার হয়ে যায়। আগের মতো তেমন আড্ডা দেওয়া হয় না। কিন্তু বন্ধুদের টান এখনো কেউ ছাড়তে পারেনি।

অরিত্র অফিস থেকে বেরিয়ে এসে রিকশা নিল। এই মুহূর্তে তার মাথায় অন্যকিছু ঘুরছে। তখন পূর্ণতা কিছু না বলে কল কেটে দিল কেন? অরিত্রের কথায় কি তার রাগ বাড়ছে? অরিত্র দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এত কিসের রাগ পূর্ণতার? শুধুমাত্র তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ে হয়েছে বলে? কিন্তু এই বিয়েকে সম্পূর্ণরূপে ইচ্ছের বিরুদ্ধেও বলা চলে না৷ কারণ তাকে তার বাবা মা বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজি করিয়েছি। বারবার বলতে বলতে রাজি করিয়েছেন। পূর্ণতা শেষ পর্যন্ত রাজি হওয়াতেই তো বিয়েটা হয়েছে। অরিত্রের জানামতে পূর্ণতার বাবা মা তাকে মারধর বা বকাঝকা করেও বিয়ে দেয়নি। তাহলে? আর পূর্ণতার বাবা মা জোর করলেও তাদের সাথে রাগ করার কথা। কিন্তু অরিত্র গতকাল দেখল সে তার বাবা মায়ের প্রতি কোনো রাগ সম্বলিত আচরণ করেনি। তাহলে অরিত্রের সাথে কেন রাগ দেখাচ্ছে? তার দোষটা কী?

আবারও একটা চাপাশ্বাস ফেলল অরিত্র। পরক্ষণে ভাবল, সে হয়তো বেশি বেশি ভেবে ফেলছে। হুট করে বিয়ে হওয়াতে মানসিকভাবে চাপে আছে হয়তো। তার উপর সামনে পরীক্ষা। আর যাই হোক, মেয়েটা পড়াশোনার ক্ষেত্রে বেশ মনোযোগী। এজন্যই হয়তো বেশি চাপ মনে করছে। আর তাছাড়া অরিত্রও হয়তো প্রেমময় সম্পর্ক শুরু করার ক্ষেত্রে খুব বেশিই উদগ্রীব হয়ে উঠেছে। এত দ্রুত সবকিছু করাটা ঠিক হবে না। এভাবে জোরপূর্বক রাগ কমানোর কথা বললে বিরক্তিতে রাগটা বাড়তে থাকবে। তাই পূর্ণতাকে একটু সময় দিতে হবে। একজন প্রেমিক হওয়ার আগে একজন বন্ধু হতে হবে। তাহলেই ধীরে ধীরে সবঠিক হবে। নিজের ভাবনায় একটা উপায় বের করতেই প্রশান্তির হাসি হাসলো অরিত্র।

______

কড়া রোদের তেজে চারপাশ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। মাঠের ধুলোবালি উড়ছে ক্রমাগত। পূর্ণতা, মিফতা আর দিনা বসে আছে ভার্সিটির ক্যাফেটেরিয়াতে। এক তপ্ত গুমোট ভাব বিরাজ করছে। পূর্ণতা গম্ভীর মুখে বসে আছে। পূর্ণতার দুই বেস্ট ফ্রেন্ড মিফতা আর দিনা তার মুখোমুখি বসে আছে। মিফতা নিরবে পূর্ণতার ভাবভঙ্গি বোঝার চেষ্টা করছে। দুজনের নিরবতায় চঞ্চলতাপূর্ণ শ্যামকন্যা দিনা বিরক্ত হয়ে উঠলো। বিরক্তিসূচক ‘চ’ এর মতো ধ্বনি উচ্চারণ করে বলল,

‘কিরে ভাই, তোরা এরকম বোবার মতো বসে আছিস কেন? কেউ কি মুখে সুপার গ্লু চিপকায় দিসে? মুখ দিয়ে কথা বাইর হয়না তোদের?’

পূর্ণতা দিনার কথা কানে না নিয়ে স্প্রাইটের বোতলে চুমুক দিয়ে বাহিরে চোখ রাখলো। মিফতাও তেমন পাত্তা দিল বলে মনে হলো না। সেও বার্গার চিবুতে চিবুতে পূর্ণতাকে পরখ করছে। এই মেয়েটা বেশ বুদ্ধিমতী। শান্তভাবে অনেক কিছু সামলে নেওয়ার মতো ক্ষমতা আর ধৈর্য আছে তার। আর তার ডাগর ডাগর দুই চোখে যেন দুনিয়ার সকল সৌন্দর্য নিহিত। দিনা তার কথার কোনো উত্তর না পেয়ে বলল,

‘কিরে ফকিন্নি তোরা দুইটা কি পঁচা ইন্দুরের রক্ত খাচ্ছিস যে মুখ থেকে কথা বাইর হইতেসে না?’

দিনার এমন কথায় দুজনের মুখ থেকেই স্প্রাইট ছিটকে বেরিয়ে এলো। দুজনেরই বমি হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। বারবার মুখ চেপে ধরছে। দিনা কিছুটা ভড়কে গেল তাদের এমন অবস্থা দেখে। দুজনের পিঠে হাত বুলিয়ে পানি এগিয়ে দিল। দুজনে পানি খেয়ে স্বাভাবিক হতেই দিনা পানসে মুখে বলল,

‘তোরা ঠিক আছিস?’

মিফতা রাগান্বিত হয়ে বলল,

‘তোর মুখে এসব জঘন্য কথা ছাড়া ভালো কথা আসে না! আমার তো এখনো বমি পাচ্ছে।’

পূর্ণতা বলল,

‘ আমার এখন তোকে পঁচা ইন্দুরের রক্ত খাওয়াইতে ইচ্ছা করতেসে দিনা।’

দিনা কাচুমাচু করে বলল,

‘সরি। তোরা বোবা হয়ে ছিলি তাই ওরকম বলেছিলাম।’

মিফতা দিনার কথায় পাত্তা না দিয়ে পূর্ণতাকে জিজ্ঞেস করল,

‘ অবশেষে তাহলে বিয়েটা হয়েই গেল। কিন্তু এরকম মনমরা হয়ে আছিস কেন? এমনটা তো না যে তুই কাউকে ভালোবাসিস তাই এই বিয়ে মেনে নিতে পারছিস না। তাহলে মুখে এমন মেঘের ছায়া কেন? কোনো ঝামেলা হয়েছে? অরিত্র ভাইয়া কিছু বলেছে?’

পূর্ণতা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

‘নারে, ওরকম কিছু না। ব্যাপারটা হচ্ছে মা বাবা আমাকে অবিশ্বাস করছে। তাঁরা ভাবছেন আমার সাথে কারও রিলেশন ছিল তাই আমি প্রথমে বিয়েটা করতে চাইছিলাম না প্রথমে। আর সেই ছেলেটা নাকি আগদ্ এর দিন বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। সেইদিন থেকেই বাবা মা আমার সাথে কথা বলছেন না। অবিশ্বাস করছেন। একটাবারের জন্য ব্যাপারটা সত্য নাকি মিথ্যা তা বিবেচনা করে দেখলেন না। আর তার উপর কোন ছেলে দাঁড়িয়ে ছিল আমি জানি না।’

‘কী বলিস এসব! আর কী কী হয়েছে খুলে বল।’

পূর্ণতা মিফতা আর দিনাকে সবকিছু খুলে বলল। কথাগুলো বলতে বলতে তার চোখে পানি চলে এলো। বাবা মায়ের ব্যবহার মেনে নিতে পারছে না পূর্ণতা। এখনও তাঁরা পূর্ণতাকে এড়িয়ে চলেন। আর নাজিবা হাসান প্রায় সময় তাকে কথা শোনায়৷ দিনা চিন্তিত মুখে বলল,

‘ আঙ্কেল আন্টি এমন কেন করছে? একটু বোঝার চেষ্টা করলেই তো হয়। আচ্ছা আমরা নাহয় আন্টি আঙ্কেলকে বুঝিয়ে বলব?’

মিফতা তড়িৎ গতিতে বলল,

‘আরে না না। এতে হিতে বিপরীত হয়ে যেতে পারে। আমার মনে হয় পূর্ণতা, তুই আঙ্কেল আন্টির সাথে খোলাখুলিভাবে কথা বল। ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা না করলে সমাধান হবে না। তোর প্রতি বাজে সন্দেহ রয়েই যাবে।’

‘হু, তা ই করতে হবে। কিন্তু কিভাবে করব বল? বাবা মা তো আমাকে সহ্যই করতে পারছেন না।’

দিনা বিরক্তি মুখে বলল,

‘ আমি না বুঝতে পারছি না। কে এই ছেলে?’

তখন পেছন থেকে কেউ একজন বলল,

‘আমি।’

চলবে…

#হৃদয়গ্রাহী
#পর্ব_০৫
#সারিফা_তাহরিম

‘আমি না বুঝতে পারছি না। কে এই ছেলে?’

তখন পেছন থেকে কেউ একজন বলল,

‘আমি।’

দিনা চকিতে পেছনে ফিরল। পূর্ণতা আর মিফতাও বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে তাকিয়ে রইলো। অচেনা এক ছেলে কিছুটা মুখে একটা হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটা সুন্দর দেখতে। দিনা তার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,

‘ কে আপনি? কেন এমনটা করেছেন? আমার ফ্রেন্ডের জীবনটাকে নরক বানানোর জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন?’

পূর্ণতারও রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। এই ছেলেটা সেই ছেলে জানতে পেরে রাগে হতবিহ্বল হয়ে পড়ছে। মিফতা ভ্রু কুচকে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে আছে। অবস্থা বোঝার চেষ্টা করছে। তবে দিনার প্রশ্নে ছেলেটাকে আরেকটু বিব্রত দেখাল। খানিক বিস্মিতও হলো। সে মাথা চুলকে বলল,

‘ দিনা, তুমি কী বলছো আমি আসলেই বুঝতে পারছি না। আমি তো এতদিন ধরে তোমাকে চিঠি পাঠাতাম। তোমার ফ্রেন্ডদেরকে না। চিঠিগুলো কি তুমি পাও নি?’

চিঠি! শব্দটা শ্রুতিপথে প্রবেশ করতেই এক অদ্ভুত শিহরণ বয়ে গেল দিনার মাঝে। প্রায় দুই মাস ধরে তার কাছে চিঠি আসছে। চিঠিগুলোতে প্রেরকের নাম থাকতো না। এক প্রকার উড়ো চিঠি বলা যায়। প্রথম প্রথম পাত্তা দিত না দিনা। ধীরে ধীরে চিঠিগুলো পড়া তার অভ্যাসে পরিণত হলো। চিঠিগুলো পেলে ভালো লাগতো। ক্রমান্বয়ে তা উত্তেজনায় রূপ নিতে থাকে। চিঠিগুলোর লেখায় এক ধরনের নেশা কাজ করতো। দিনার আসক্তি হয়ে গিয়েছিল সেই নেশায়। দিনার মনে পড়ে দুই মাস আগের সেদিনের কথা। ১৪ই ফেব্রুয়ারি ছিল সেদিন। সেই সময় বইমেলা চলছিল। সেদিন দিনা মিফতা আর তাদের আরেকজন বান্ধবী রুমি বইমেলায় গিয়েছিল। বেশকিছু বই কিনে বাসায় ফিরেছিল। বাসায় গিয়ে যখন বইগুলো বের করে দেখছিল, তখন সাদাত হোসাইনের ‘ছদ্মবেশ’ বইটি খুলে দেখতে নিতেই একটা চিরকুট বেরিয়ে এলো। ছদ্মবেশ বইয়ে তো এখন লেখকের চিরকুট দেওয়ার কথা না। তাহলে এটা কিসের চিরকুট! কৌতুহলী চোখে চিরকুটটা হাতে নিল দিনা। অন্য কারো চিরকুট ভুলবসত তার কাছে চলে আসেনি তো! কিন্তু চিরকুট খুলতেই তার ভ্রম ভেঙে গেল। শুরুতেই গোটা গোটা অক্ষরে লিখা, ‘প্রেয়সী দিনা’। অর্থাৎ চিরকুটটা ভুল করে আসেনি, বরং দিনার উদ্দেশ্যেই চিঠিটা লিখা হয়েছে। চিঠিটা ছিল এমন,

‘প্রেয়সী দিনা,
ভালোবাসা দিবসের রঙিন সূচনায় ভালোবাসার প্রহর গুণে একটি আবদার নিয়ে এসেছি। তুমি কি আমার এলোমেলো মনের ছোট্ট আবদারটা রাখবে? প্রথম দেকগা থেকেই ভার্সিটির প্রাঙ্গণে তোমার প্রতিটি কার্যকলাপে আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলি। অচেতন মনে বারবার তোমাকে খুঁজি। চোখের পেলব এক হতেই তোমার ছবি ভেসে উঠে রঙিন ক্যানভাসে। শ্যামাঙ্গিনী, তুমি এত সুন্দর কেন? তোমার নয়ন জোড়ার তীব্র সম্মোহনী শক্তি যে আমাকে গ্রাস করে তা কি জানো? শ্যামাঙ্গিনী শুনো, প্রতিটি বসন্তের সন্ধ্যায় আমার কাঁধে মাথা এলিয়ে মুগ্ধ নয়নে তোমার মুখটা দেখার সুযোগ করে দিবে? আমার এই ছোট্ট আবদারটা রাখবে?’

এটুকুই ছিল প্রথম চিঠিটা। কোনো নাম ছিল না। কোনো ঠিকানা ছিল না। শুধু একটা নিঃসংকোচ আবেদন। ভারি অবাক হয়েছিল দিনা। প্রথমে ভেবেছিল কেউ হয়তো মজা করছে। এর কয়েকদিন পরে আবারও চিঠি আসলো। সেই চিঠির সারমর্ম ছিল এমন, চিঠিদাতা অর্থাৎ প্রেরক দিনার ভার্সিটিরই একজন। দিনার আশেপাশেই প্রায় সময় থাকে। তবে যতদিন অবধি দিনা তাকে খুঁজে বের করতে চাইবে ততদিন অবধি সে নিজের পরিচয় দিবে না। যখন সে বুঝতে পারবে দিনা তার পরিচয় জানতে চাইছে তখনই সে সামনে আসবে। এমন করে প্রায় সময়ই দিনা চিঠি পেত। কখনো বেঞ্চের উপর, কখনো খাতার ভাঁজে, কখনোবা সিনিয়র আপুদের হাত থেকে। মাঝে মাঝে বইও গিফট পেত, সেই বইয়ের ভেতরে থাকতো রঙিন কাগজে লিখা চিরকুট। দিনা সেই চিরকুটগুলো পড়ে লজ্জা পেত। পুলকিত হতো। সবগুলো চিঠি এন্টিকের সুন্দর একটা বক্সে জমিয়ে রেখেছে সে। দু একদিন চিঠি না পেলে আগের চিঠিগুলো আবার পড়তো।

হ্যাঁ বেশ কিছুদিন ধরে দিনা সেই ব্যক্তিকে খুঁজছিল। কিন্তু এখন হুট করে তার দেখা পেয়ে যাবে ভাবেনি। সে বিস্ময়ের সপ্তম আকাশে বিরাজ করছে। এই মানুষটাকে সে চিনে। তার নাম ইরাফ রহমান। ইংরেজি বিভাগে চতুর্থ বর্ষে পড়ে। দিনা নবীন বরণ প্রোগ্রামে তাকে প্রথম দেখেছিল। এই মানুষটার প্রতি কেন যেন একটা আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছিল মনের কোণে। সেই ব্যক্তি যে দিনাকে চিঠি দিত তা সে কস্মিনকালেও ভাবেনি। প্রথমে ব্যাপারটা বোধগম্য হলো না। পরক্ষণে ইরাফের কথা বুঝতেই শিরদাঁড়া এক শীতল শিহরণ বয়ে গেল। সে মিইয়ে যাওয়া কণ্ঠে বলল,

‘ চিঠিগুলো আপনি দিতেন?’

ইরাফ আলগোছে হেসে সম্মতি জানালো। আসলে দিনাদের আলোচনা পুরোপুরি শুনেনি। শুধু দিনার বলা ‘ আমি না বুঝতে পারছি না। কে এই ছেলে’ কথাটি শুনেছিল। সে মনে করেছে চিঠিদাতার কথা বলছে দিনা। তাই সে মনের মাঝে সাহস জুগিয়ে নিজের পরিচয় দিয়ে দিল। মিফতা আর পূর্ণতা চিঠির ব্যাপারে জানতো। অন্য সময় হলে এতক্ষণে পূর্ণতা আর মিফতা দিনার সাথে দুষ্টুমি করা শুরু করতো। কিন্তু একটু পরেই ক্লাস শুরু হয়ে যাবে দেখে তারা আর কথা বাড়াল না। দিনাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মিফতা তাড়া দিয়ে বলল,

‘ দিনু রে, দেরি হয়ে যাচ্ছে। ক্লাস শুরু হয়ে যাবে। চল তাড়াতাড়ি।’

দিনা যেন সম্বিৎ ফিরে পেল। তাড়াহুড়ো করে ক্যাফেটেরিয়া থেকে বের হতে যাবে তখন পেছন থেকে ইরাফ মিহি কণ্ঠে আবেগ জড়িয়ে বলল,

‘আমার আবদারটা রাখবে না শ্যামাঙ্গিনী?’

দিনা পেছন ফিরে তাকাল। ইরাফের সুমধুর কণ্ঠে বলা কথায় সামান্য লজ্জা পেল দিনা। লাজুক হেসে বলল,

‘ভেবে দেখব মিস্টার।’

দিনা আর দাঁড়ালো না। তাড়াতাড়ি প্রস্থান করল। ইরাফ প্রসন্ন হাসলো। সম্মতিসূচক উত্তরের আভাস সে পেয়ে গেছে। আজ দিনটা একটু বেশি সুন্দর মনে হচ্ছে। চারপাশে যেন প্রতিধ্বনিত হচ্ছে,

‘বাতাসে বহিছে প্রেম, নয়নে লাগিল নেশা
কারা যে ডাকিল পিছে, বসন্ত এসে গেছে…’

_______

পূর্ণতা, দিনা আর মিফতা ক্লাস শেষে ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে এলো৷ পূর্ণতার বাসা ভিন্ন পথে তাই সে মিফতা আর দিনাকে বিদায় জানিয়ে রিকশার জন্য হাঁটতে শুরু করল। এই মুহূর্তে তার মন বেশ ফুরফুরে। তার বন্ধুমহলের সাথে থাকলে মন ভালো হতে বাধ্য। ইরাফ আর দিনার বিষয়টা নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ দুষ্টুমি করেছিল মিফতা আর পূর্ণতা। ইরাফ যথেষ্ট ভালো ছেলে। দিনা আর ইরাফের যে পরস্পরের প্রতি ভালো লাগা কাজ করে তাতে মিফতা আর পূর্ণতা মনে মনে বেশ খুশি হয়েছে। তাদের দুজনকে বেশ মানাবে। কথাটা ভাবতেই হালকা হাসলো সে। আরও কয়েক কদম এগিয়ে যেতেই দেখল কেউ একজন তার দিকেই এগিয়ে আসছে। আকাশি রঙের শার্ট আর কালো প্যান্ট। শার্টের হাতা কনুই অবধি সুন্দর করে গোটানো আর চাপ দাঁড়িতে ঘেরা মুখে স্নিগ্ধ হাসি। সুদর্শন এই পুরুষটিকে প্রথমে চিনতে পারলো না পূর্ণতা। কিয়ৎক্ষণ পরে মনে পড়লো, এই সেই ব্যক্তি যার সাথে পূর্ণতা সারাজীবন আবদ্ধ হয়ে আছে। কথাটি মনে পড়তেই গম্ভীর হয়ে উঠলো পূর্ণতা।

অরিত্রকে না দেখার ভান করে রিকশার জন্য দাঁড়াল। কিন্তু এই পাশে কোনো রিকশা দেখতে না পেয়ে বিরক্ত হলো পূর্ণতা। এখন আবার এত বড় রাস্তা পার হতে হবে। ততক্ষণে অরিত্র তার কাছে এগিয়ে এসে বলল,

‘আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছো পূর্ণতা?’

পূর্ণতা আর চোখে তাকালো। পরক্ষনেই চোখ সরিয়ে নিল। অরিত্রের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। রোদের আলোয় তা চিকচিক করছে। ক্লান্ত শরীরেও তাকে স্নিগ্ধ লাগছে। এই সময়ে এমন ক্লান্ত অবস্থায় অরিত্রকে দেখলে যে কোনো মেয়েরই ইচ্ছে করবে ওড়নার আঁচলটুকু দিয়ে দায়িত্ব সহকারে পরিশ্রান্ত মুখখানা মুছে দিতে। কিন্তু পূর্ণতা তা করল না। বরং খানিকটা রাগ হলো। লোকটাকে এমনিতেই দেখতে ইচ্ছে করে না। তবুও কেন সে দেখা করতে আসে! পূর্ণতার রাস্তার দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ওয়ালাইকুম আসসালাম। আসসালামু আলাইকুম। আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।’

অরিত্র মৃদু হেসে বলল,

‘ওয়ালাইকুম আসসালাম। তোমার দৃষ্টি দেখে মনে হচ্ছে তুমি আমার সাথে না এই ব্যস্ত সড়কে চলমান গাড়িগুলোর সাথে কথা বলছো। যাই হোক, এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে রিকশা পাবে না। উল্টো এই গরমে ঘেমে নেয়ে ক্লান্ত হয়ে উঠবে। রিকশার জন্য রাস্তা পার হতে হবে। চলো।’

পূর্ণতা কথা না বাড়িয়ে কয়েক পা এগিয়ে গেল। রাস্তায় গাড়ি ছুটে চলেছে ব্যস্ত গতিতে। একটু অসাবধান হলেই মুহূর্তের মধ্যেই বিপদ ঘটে যেতে পারে। অরিত্র দুপাশে মাথা ঘুরিয়ে রাস্তার গাড়ি দেখে নিল। রাস্তা পার হওয়ার সময় দায়িত্বশীলভাবে আলতো করে পূর্ণতার হাত ধরলো। পূর্ণতা শিহরিত হলো। চমকে তাকালো অরিত্রের দিকে। না, মানুষটা দেখে শুনে রাস্তা পার হতে ব্যস্ত। অন্য কিছুর জন্য না বরং পূর্ণতার সাবধানতার জন্য তার হাত ধরেছে। পূর্ণতাও সাবধানে রাস্তা পার হলো। রাস্তা পার হয়ে বিপরীত পাশে আসতেই অরিত্র পূর্ণতার হাত ছেড়ে দিল। পূর্ণতা তার হাতটা গুটিয়ে নিল। আরেক হাতে মাথা থেকে হালকা সরে যাওয়া ওড়নাটা আরেকটু টেনে নিল। রিকশার জন্য অপেক্ষা করতে করতে অরিত্র বলল,

‘ আমার সাথে দেখা হওয়াটা হয়তো তোমার ভালো লাগেনি। কিন্তু সত্য কথা বলতে তোমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে তোমার সাথে দেখা করাটা আমার উদ্দেশ্য ছিল না। অফিসের কাজে সামনের ব্যাংকটাতে আসতে হয়েছিল। রিকশার জন্য হেঁটে আসতেই দেখলাম তুমিও রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে আছো। রিকশা নেওয়ার জন্য রাস্তা পার হতে হতো। আর এত বড় রাস্তা তুমি একা পার হওয়াটা সেফ না। তাই এগিয়ে আসলাম।’

পূর্ণতা মনে মনে বলল, ‘আমি কি বাচ্চা নাকি যে রাস্তা পার হতে পারব না?’ কিন্তু মুখে কিছু বলল না। একটু পরে একটা রিকশা পাওয়া গেল। পূর্ণতা রিকশা উঠে অস্বস্তি নিয়ে এক পাশে চেপে বসলো। এই লোকটার সাথে একই রিকশায় যাবে! ভাবতেই অস্বস্তি হতে লাগলো। বিষয়টা অরিত্রের চোখ এড়ালো না। সে স্মিত হেসে বলল,

‘তোমার পথসঙ্গী হতে আমার ইচ্ছে করে। ভীষণ ইচ্ছে করে। কিন্তু সেটা তোমাকে অস্বস্তিতে ফেলে নয়। আমার পথের সাথী হওয়ার ইচ্ছে পূরণের চেয়ে তোমার স্বস্তিটাই আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তোমার স্বস্তির জন্য প্রয়োজনে আমি বন্ধু হয়েই থাকব প্রেমিক পুরুষ হয়ে নয়। তুমি পারলে বন্ধু ভেবে হলেও আমার উপর রাগটা কমিয়ে এনো।’

শেষের কথাগুলো বলার সময় অরিত্রের হাস্যোজ্জ্বল মুখটা নিভু নিভু হয়ে এলো। অরিত্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে রিকশার ভাড়া দিয়ে দিল। পূর্ণতা বারণ করলেও শুনলো না। তারপর হালকা হেসে বলল,

‘ সাবধানে যাবে। বাসায় গিয়ে আমাকে কল করবে।’

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here