হৃদয়গ্রাহী #পর্ব_০৬,০৭

0
652

#হৃদয়গ্রাহী
#পর্ব_০৬,০৭
#সারিফা_তাহরিম
০৬

সময় বহমান। সত্য, মিথ্যা, সুখ দুঃখের আশ্রয়ে একেক মুহূর্ত একেক রূপ ধারণ করে প্রবাহিত হতে থাকে। আর সময়ের পরিবর্তনের সাথে প্রতিটি মানুষের জীবনের ধরণ, গঠনও পরিবর্তিত হতে থাকে। পূর্ণতার জীবনেরও পরিবর্তন হয়েছে। বিয়ের প্রায় এক মাস গড়ালো। প্রথম প্রথম মা বাবার অবহেলা, এড়িয়ে চলা খুব বেশি ব্যথিত করত তাকে। সে সবকিছু ঠিক স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে আনার জন্য মরিয়া হয়ে উঠতো। কিন্তু আর সেই সময় কই! সামনে একটা পরীক্ষা এগিয়েছে। ফাইনাল পরীক্ষার আগে একটা টেস্ট হবে। সবকিছুর পড়া পড়তে বাড়তি সময় ও শ্রম দিতে হচ্ছে। প্রতিদিন ভার্সিটিতে যাওয়া না হলেও খুব বেশি মিস দেয় না। না যাওয়ার কারণ হিসেবেও দেখা যায়, বেশি রাত অবধি পড়ার কারণে সকালে ঘুম থেকে উঠতে পারেনি। ভার্সিটির পরে একটা কোচিং থাকে। ভার্সিটির একজন স্যার পড়ান। মাস দুয়েক আগে ভর্তি হয়েছিল সেখানে। মিফতা আর দিনাও পড়ে সেখানে। সেই সুবাদে একসাথে যায়।

পূর্ণতা তার বাবা মায়ের মধ্যেও বেশ খানিকটা পরিবর্তন করছে। আগে থেকে কঠোরতা কমেছে বলে মনে হলো পূর্ণতার। কিন্তু ব্যাপারটা আসলে কতটা ঠিক তা সে জানে না। তবে এখন ক্লান্ত শরীরে এসে মাকে কিছু এনে দিতে বললে তিনি দ্বিরুক্তি করেন না। মেয়ের হাতে দেন। কোমল স্বরে দু একটা কথা বলেন। পরিস্থিতি কি স্বাভাবিক হওয়ার পথে! জানে না পূর্ণতা। সে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য কিছুই করতে পারছে না। সারাদিনের ব্যস্ততার পরে পড়াশোনা করে ক্লান্ত হয়ে থাকে শরীর। রাতে আর এই বিষয়ে কথা বলতে ইচ্ছে করে না। চোখে ঘুম নেমে আসে। এই ব্যাপারটা যদি স্বাভাবিক হওয়ার পথে হয়ে থাকে, তাহলে সেই ক্ষেত্রে অবদানটা মিফতার আম্মুর।

মিফতার আম্মু প্রাণখোলা স্বভাবের মানুষ। মিফতার সাথে বন্ধুসুলভ সম্পর্ক তার। মিফতা সবকিছু তার মায়ের সাথে শেয়ার করে। আর তিনি কোনো সময় মা হিসেবে সেই বিষয়ের সমাধান বলে দেন বা কোনো সময় বন্ধু হয়ে তার পাশে থাকে। মিফতার বাবা মা তাকে খুব ভালোবাসে। পূর্ণতার বাবা মাও পূর্ণতাকে অনেক বেশি ভালোবাসে। কিন্তু তাদের মধ্যে পার্থক্য হলো, মিফতার প্রতি তার বাবা মায়ের অগাধ বিশ্বাস আছে। কিন্তু পূর্ণতার উপর তার বাবা মায়ের বিশ্বাসের খুটিটা খুব ঠুনকো। এমনটা নয় যে পূর্ণতা কোনো সময় তাদের অবাধ্য হয়ে কিছু করেছে। তবুও কেন জানি উনিশ থেকে বিশ হলেই পূর্ণতার প্রতি তাদের অবিশ্বাসের মাপকাঠিটা গা ঝাড়া দিয়ে দৃশ্যমান হয়ে উঠে। এই ক্ষেত্রে তারা অনেক সময় সেই সন্দেহের সত্যতা যাচাই করার প্রয়োজন বোধও করেন না।

পূর্ণতার বিষয়টা মিফতা তার মায়ের সাথে শেয়ার করেছিল। মিফতার আম্মু বিচক্ষণ মানুষ। তিনি পরিস্থিতি কিভাবে সামলাতে হয় সেই ব্যাপারে খুব ভালো জানেন। একদিন খোঁজ খবর আর টুকটাক কথার উদ্দেশ্যে পূর্ণতার আম্মুকে কল করেন তিনি। পূর্ণতার আম্মু সরল মনের মানুষ। তিনি সহজেই সবাইকে সব কথা বলে ফেলেন৷ মিফতার আম্মু ব্যাপারটা জানেন। তাই তিনি পূর্ণতার বিয়ে সম্পর্কে খতিয়ে জিজ্ঞেস করার এক পর্যায়ে নাজিবা হাসান নিজেই সব কথা বললেন। একটা ছেলে নাকি পূর্ণতার বিয়ের দিন তাদের বাড়ির নিচে দাঁড়িয়ে ছিল। মঈনুল হাসানকে দেখে সে নাকি খুব কান্নাকাটি করে বলেছিল, সে পূর্ণতাকে ভালোবাসে। তাকে বিয়ে করতে চায়। পূর্ণতাকে যাতে অন্য কোথাও বিয়ে না দেয়। পূর্ণতার বাবা মায়ের ধারণা হয়েছিল সেই ছেলেটার সাথে পূর্ণতার সম্পর্ক ছিল। তা নাহলে সে কিভাবে জানবে পূর্ণতার বিয়ের কথা? যেখানে পূর্ণতা রাগের বসে তার বান্ধবীদেরকেও জানায়নি যে সেদিনই তার আগদ্, সেখানে ঐ ছেলেটা কিভাবে জানল? এছাড়াও পূর্ণতা প্রথমে বিয়ে করতে চাইছিল না তাই তাঁরা ধরেই নিয়েছিলেন যে ছেলেটা পূর্ণতার প্রেমিক। নাজিবা হাসানের কথা শুনে অবাক হয়েছিলেন মিফতার আম্মু। তিনি নাজিবা হাসানকে বুঝানোর জন্য বলেছিলেন,

“আপা কি বলছেন এসব? সামান্য এই ঘটনার জন্য আপনারা মেয়েটাকে এতটা অবিশ্বাস করলেন! ভাই পূর্ণতার গায়ে হাত তুলল! এটা মোটেও ঠিক হয়নি। দেখুন আপা, একজন মেয়েকে অনেক ছেলেই পছন্দ করতে পারে। আর পূর্ণতা তো দেখতে মা শা আল্লাহ খুব সুন্দর। তাকে ছেলেরা পছন্দ করতেই পারে। বিয়ের প্রস্তাব দিতেই পারে। এটা তো অস্বাভাবিক কিছু না। কিন্তু তাই বলে মেয়েও যে তাকে পছন্দ করে সেটা কিভাবে নিশ্চিত হলেন? ছেলেটা বিয়ে থামাতে বলেছে বলেই আপনারা ধরে নিলেন যে ছেলেটার সাথে পূর্ণতার প্রেমের সম্পর্ক আছে? কোনো যাচাই বাছাই না করে এরকম ভাবাটা কি ঠিক হয়েছে?

আপা, পূর্ণতা আপনার মেয়ে। আপনি তার মা। আর আমি হলাম অনেক দূরের মানুষ, বান্ধবীর মা। আপনার চেয়ে আমি কখনোই তাকে বেশি ভালোবাসতে পারব না। এটা সত্য কথা। কিন্তু আমি তাকে এত বেশি ভালোবাসতে না পারলেও কখনো এতটা অবিশ্বাস করিনি। আপনাদের ভালোবাসায় বিশ্বাসের ঘাটতি আছে আপা। যে মেয়েকে এত বেশি ভালোবাসেন তাকে একটু বিশ্বাস করতে পারেন না? আপনারা সামান্য বিষয়ে সন্দেহ করবেন বলে মেয়েটা সবসময় ভয়ে তটস্থ থাকে। নিজেকে কতটা গুটিয়ে রাখে তা কি একটাবার খেয়াল করেছেন? এমন গুটিয়ে রাখার কারণ আপনাদের অবিশ্বাস। অবিশ্বাস করলেও কখনো কি মেয়েটাকে বোঝার চেষ্টা করেছেন আদৌ?

আপা, একটা মেয়ের কাছে তারা মা সবচেয়ে আপন হয়। মায়ের যেমন মেয়েকে শাসন করাটা দায়িত্ব, তেমনই বন্ধুসুলভ আচরণ করে তার সুখ দুঃখের সময়ে তার পাশে থাকাটা তার দায়িত্ব। আমাদের ক্ষেত্রেই দেখুন না, আমি আর আমার মেয়ে মিফতার মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্কটা খুব ভালো। আমার মেয়েকে আমি যেমন শাসন করি, তেমন বন্ধুর মতো তার পাশে থাকি৷ যার কারণে মিফতা সব কথা আমার সাথে শেয়ার করে। কোন ছেলে কবে প্রপোজ করেছে, কিভাবে করেছে সবকিছু সঙ্গে সঙ্গেই জানায়৷ এমনকি তার প্রথম ভালো লাগা সম্পর্কেও প্রথম জানিয়েছিল আমাকে। আমি তো কথাটা নেতিবাচকভাবে নিয়ে তাকে বকাঝকা বা মারধর করিনি। বরং বন্ধুর মতো আচরণ করে কলাকৌশলে বুঝিয়েছি এগুলো খনিকের আবেগ। আর আমার মেয়েও বুঝেছে। আমি আমার মেয়েকে বিশ্বাস করি। তাকে পড়তে পারি আমি। আমি যদি তাকে বুঝতেই না পারি তাহলে কি মায়ের সংঙ্গাটা পূর্ণ হবে কি করে?

আপনার আর পূর্ণতার মাঝে এটুকু দূরত্ব আছে। আর এই দূরত্ব আছে বলেই এত ভুল বুঝাবুঝি। আপনি কি আদৌ জানেন আপনার মেয়েকে কতজন ছেলে প্রেম নিবেদন করেছে? জানেন না। কিন্তু আমি অনেকটাই জানি। মিফতা আমাকে বলতো। এমনকি বেশ কয়েকটা ছেলেকে আমি নিজেও দেখেছি। অনেক সুদর্শন ছেলে তাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছে। পূর্ণতা চাইলেই প্রেমের সম্পর্কে জড়াতে পারত। কিন্তু পূর্ণতা সেটা করেনি। কেন জানেন? কারণ সে আপনাদেরকে ভালোবাসে। পূর্ণতা সবসময় বলতো, ‘আমার বাবা মায়ের চেয়ে বেশি কেউ কখনো আমাকে ভালোবাসতে পারবে না। আর সেই দুজন মানুষের পছন্দ ব্যতিরেকে যদি অন্য কাউকে আমি পছন্দ করি তাহলে তাঁরা কষ্ট পাবেন। আমার বাবা যে সেই কষ্ট সহ্য করতে পারবেন না! একদমই না। এই দুজন মানুষকে কষ্ট দিয়ে আমি কিভাবে ভালো থাকব? আমিও যে তাদেরকে নিজের জীবনের চেয়ে বেশি ভালোবাসি। আমার বাবার মুখের হাসির জন্য আমি আমার জীবন কুরবানি করতেও রাজি। সেখানে এই বিষয়টা তো একেবারেই ঠুনকো।’

এবার বলুন আপা আপনাদের ওরকম ধারণা করাটা কি ঠিক ছিল? পূর্ণতা তো মঈনুল ভাইয়ের কলিজা। তাহলে তিনি কিভাবে পারলেন সবটা বিবেচনা না করে মেয়েটাকে কষ্ট দিতে? যাই হোক, আপনারা বাবা মা। আপনারা কখনো পূর্ণতার খারাপ চাইবেন না। কিন্তু এই বিষয়টা নিয়ে না বলে পারলাম না। পারলে আমার কথাগুলো বিবেচনা করে মেয়েটাকে আর কষ্ট দিবেন না। আমি যদি ভুল কিছু বলে থাকি তাহলে ক্ষমা করে দিবেন। সবশেষে বলব, পূর্ণতার মতো মেয়ে পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার।”

মিফতার আম্মুর কথা কাজে দিয়েছিল। নাজিবা হাসান সবকিছু বিশ্লেষণ করে দেখলেন, আসলেই তো! তারা মেয়েটাকে এত কষ্ট দিয়ে ফেলেছে! তাও সবকিছু বিচার বিশ্লেষণ না করে! নাজিবা হাসানের মনে অনুতপ্ততা কাজ করা শুরু করল। নিজের স্বভাব নরম করে কয়েকদিন মেয়েকে পর্যবেক্ষণ করেন। আসলেই মেয়েটা তাদের সাথে কথা বলার জন্য কেমন অসহায় হয়ে চেয়ে থাকে! দিন শেষে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত পূর্ণতার অসহায় মুখশ্রী দৃষ্টিগোচর হতেই হৃদয় হু হু করে কেঁদে উঠে।

____

আঁধারিয়া ধরণীর নীলাভ আভার রাত্রি আকাশে এক ফালি চাঁদ উঁকি দিয়েছে। গ্রীষ্মের রাত হলেও আজ সন্ধ্যা থেকে মৃদুমন্দ শীতল হাওয়া বইছে। একটা ভেজা মাটির ঘ্রাণ নাকে এসে লাগছে যেন! এই বুঝি বৃষ্টি নামল! সারাদিন তপ্ত রোদের গ্লানিতে হাঁপিয়ে উঠেছে পূর্ণতা। কোচিং এর পড়াগুলো শেষ করে আর বসে থাকার শক্তি পেল না। বইয়ের উপরেই মাথাটা এলিয়ে দিল। ঘড়িতে রাত নয়টা বেজে পয়ত্রিশ মিনিট। চোখে ঘুম নেমে আসছে যেন! ঠিক সেই মুহূর্তে মাথায় একটা হাতের আলতো স্পর্শ অনুভব করল। ধীরে ধীরে মাথায় হাত বুলিয়ে যাচ্ছে হাতটা। স্পর্শটা চিনতে পারল পূর্ণতা। সারাদিন ক্লান্ত হয়ে চোখজোড়া ঘুমে জড়িয়ে আসার সময় তার বাবা এভাবেই তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। এখন কি তাহলে বাবা এসেছে! এতদিন পরে কি বাবা আবারও তাকে আদর করছে! তবে কি সবকিছু ঠিক হয়ে গেল! ঝট করে মাথা তুলল পূর্ণতা। হ্যাঁ, তার বাবা দাঁড়িয়ে আছেন। পূর্ণতা মাথা তুলতেই তিনি বললেন,

‘ ক্লান্ত লাগছে বাবা?’

পূর্ণতার চোখ জলে চিকচিক করছে। সে বলল,

‘ হ্যাঁ বাবা। আমি ভীষণ ক্লান্ত।’

মেয়ের মুখ দেখে হয়তো মঈনুল হাসানের মন সিক্ত হয়ে উঠলো। নিজেকে সামলানোর জন্য তিনি বেরিয়ে যেতে যেতে বললেন,

‘ শুয়ে থাকো বাবা। সারাদিন অনেক ধকল গেছে। এখন আর পড়তে হবে না। রেস্ট নাও।’

পূর্ণতা বিছানায় গিয়ে বসল। ঘুম আসলে প্রায় সময়ই তার বাবা তার মাথায় বিলি কেটে দিতেন। সে বাবার পানে চেয়ে বলল,

‘ বাবা, আজ আমার মাথায় বিলি কেটে দিবে না?’

মঈনুল হাসান পেছন ফিরলেন না। বেরিয়ে যেতে যেতে বললেন,

‘ এখন বিলি কেটে দিলে তুমি ঘুমিয়ে পড়বে। তখন আর ডিনার করা হবে না। তাই একেবারে খাওয়া দাওয়া শেষে ঘুমুনোর সময় বিলি কেটে দিব।’

মঈনুল হাসান ড্রিম লাইট জ্বালিয়ে দরজাটা ভিড়িয়ে চলে গেলেন। পূর্ণতার চোখ থেকে দু ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। এই যে আনন্দাশ্রু! পূর্ণতা স্নিগ্ধ হাসি হাসল। এমন সময় তার ফোন বেজে উঠলো। ‘অরিত্র’ ফোন করেছে। এই মুহূর্তে কোনো রাগ কাজ করছে না পূর্ণতার। সবকিছু ঠিক হওয়ার খুশিতে যেন সে সব রাগ ভুলে বসেছে। সে ফোন রিসিভ করে বলল,

‘আসসালামু আলাইকুম।’

‘ ওয়ালাইকুম আসসালাম। কেমন আছেন পূর্ণতারাণী?’

অরিত্রের কথায় হাসলো পূর্ণতা। এই মুহূর্তে তার মাথায় নেই যে সে কার সাথে কথা বলছে। এক প্রকার ঘোরের মধ্যে আছে। সে হেসে জবাব দিল,

‘ পূর্ণতারাণী খুব ভালো আছে। আপনি কেমন আছেন? ‘

প্রেয়সীর হাস্যার ঝংকার আর প্রফুল্ল কথায় থমকাল অরিত্র। এতদিন অবধি পূর্ণতা তার সাথে ঠিকমতো কথা বলতে চাইতো না। আর আজ তার কিনা এত পরিবর্তন! বিস্ময় আর খুশিতে অদ্ভুত অনুভূতি হলো অরিত্রের। ঠোঁটে সেই ঘোর লাগা মুচকি হাসি লেপ্টে রবীন্দ্রনাথের লেখা থেকে আবৃত্তি করে বলল,

‘আছে আমার হৃদয় আছে ভরে,
এখন তুমি যা খুশি তাই করো।
এমনি যদি বিরাজ’ অন্তরে
বাহির হতে সকলই মোর হরো।
সব পিপাসার যেথায় অবসান
সেথায় যদি পূর্ণ করো প্রাণ,
তাহার পরে মরুপথের মাঝে
উঠে রৌদ্র উঠুক খরতর।
এই যে খেলা খেলছ কত ছলে
এই খেলা তো আমি ভালবাসি।
এক দিকেতে ভাসাও আঁখিজলে,
আরেক দিকে জাগিয়ে তোল’ হাসি।
যখন ভাবি সব খোয়ালাম বুঝি
গভীর তাহারে খুঁজি,
কোলের থেকে যখন ফেল’ দূরে
বুকের মাঝে আবার তুলে ধর’।’

তারপর নিজেই বলল,

‘প্রেয়সীর সেই হাসিতেই যে আমার প্রাণটা যায় ভাসি,
মিষ্টি মুখের হাসিটা যে বড্ড ভালোবাসি।’

চলবে…

#হৃদয়গ্রাহী
#পর্ব_ ০৭
#সারিফা_তাহরিম

‘ প্রেয়সীর সেই হাসিতেই যে আমার প্রাণটা যায় ভাসি,
মিষ্টি মুখের হাসিটা যে বড্ড ভালোবাসি।’

অরিত্রের আবৃত্তিতে ঘোর ভাঙলো পূর্ণতার। এতক্ষণ পরে খেয়াল হলো, সে অরিত্রের সাথে কথা বলছে। পরক্ষণেই ভাবলো এটা তার ভ্রম নয় তো! একবার কান থেকে ফোন নামিয়ে স্ক্রিনে চোখ বুলালো। না, এই মুহূর্তে সে অরিত্রের সাথেই কথা বলছে। কোনো ভ্রম নয়। কিছুক্ষণ আগে নিজের বলা ‘পূর্ণতারাণী খুব ভালো আছে। আপনি কেমন আছেন?’ কথাটা মনে পড়তেই খানিকটা অস্বস্তিতে পড়ে গেল। ইশ! পূর্ণতা খুশির জোয়ারে ভেসে কিসব বলে ফেলেছে! এখন অরিত্র নিশ্চয়ই ভাবছে পূর্ণতা তার সাথে কথা বলতে পেরে অনেক খুশি হয়েছে৷ কিন্তু আসলে ব্যাপারটা তো ভিন্ন। এই মুহূর্তে নিজের করা বোকামির জন্য নিজেরই কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করছে। অরিত্রের কথায় পূর্ণতার ভাবনায় ছেদ পড়লো। অরিত্রের স্নিগ্ধ শীতল কণ্ঠে বলল,

‘ আজ পূর্ণতারাণীর মন ভীষণ ভালো মনে হচ্ছে। খুশি খুশি লাগছে খুব। তা এই খুশির কারণ কী আমায় বলা যাবে?’

পূর্ণতার অস্বস্তি আরেক ধাপ বাড়ল। সে কী বলবে বুঝতে পারছে না। এই প্রথমবারের মতো অরিত্রের সাথে কথা বলার সময় তার রাগ হচ্ছে না। কেমন যেন অস্বস্তি ঘিরে ধরছে। এটা কী অরিত্রের ‘ পূর্ণতারাণী’ ডাকটা জন্য? হয়তো তাই। পূর্ণতা জড়ানো স্বরে বলল,

‘ না তেমন কিছু না। কোচিং এর পড়া তাড়াতাড়ি শেষ করে ফেলতে পেরেছি তো তাই খুশি লাগছে।’

কোনো রকমে মিথ্যা বলল পূর্ণতা। অরিত্র তা বুঝতে পারল ঠিকই, কিন্তু তাকে আর ঘাটাল না। কারণ অরিত্র জানে পূর্ণতা এখনো তার সাথে পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে পারেনি। এখনও পূর্ণতা তার সাথে মন খুলে সব কথা শেয়ার করবে না। অরিত্রও এই বিষয়ে জোরাজুরি করতে চায় না। সে চায় পূর্ণতা যখন পুরোপুরি স্বাভাবিক হবে তখন নিজ থেকেই যেন অরিত্রের সাথে কথা শেয়ার করে। কারো ইচ্ছের বিরুদ্ধে তার ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে নাক গলানো অরিত্রের স্বভাবের মধ্যে পড়ে না। পূর্ণতা তার অর্ধাঙ্গিণী হওয়ায় তার উপর অরিত্রের অধিকার আছে ঠিক, কিন্তু সে চায় পূর্ণতা যেমন তাকে দূরে রেখেছে তেমনই একটা সময় যেন নিজেই অরিত্রকে তার অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে তোলে। অরিত্র কথা ঘুরিয়ে বলল,

‘ তোমার পড়াশোনা কেমন চলছে?’

‘ এইতো মোটামুটি ভালোই।’

‘ পরীক্ষা কবে থেকে?’

‘ আগামী মাস থেকে।’

‘ ওহ আচ্ছা। তাহলে তো আরও বেশ কয়েকদিন সময় আছে হাতে। শুনেছি, তুমি নাকি এয়াত দিন এক করে পড়ছো। হাতে তো সময় আছে, একটু রিল্যাক্স হও। তুমি মা শা আল্লাহ ভালো স্টুডেন্ট। একটু মনোযোগ দিয়ে পড়ে নিলেই ভালো করতে পারবে। কিন্তু বেশি চাপ নিতে গেলে তুমি আবার অসুস্থ হয়ে পড়বে। নিজের একটু খেয়াল রাখবে প্লিজ।’

অরিত্রের কণ্ঠে অনুনয়। অবাক হলো পূর্ণতা। এই লোকটা তার খেয়াল রাখার জন্য তারই কাছে অনুনয় করছে! এই বিষয় নিয়ে তেমন না ঘাটালেও চাপা স্বরে বলল,

‘ এভাবে বলার কী আছে? আমি তো নিজের খেয়াল রাখছি।’

অরিত্র হালকা হেসে বলল,

‘ খেয়াল রাখাটা তো আমার দায়িত্ব। নিজের দায়িত্ব থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হচ্ছে। এই দূরত্বের কারণে তোমাকে নতুন করে বলতে হচ্ছে। নাহলে তোমাকে বলতে হতো না। আমার ব্যক্তিগত মানুষটার যত্ন আমি নিজেই করতাম।’

পূর্ণতা কিছু বলল না। চুপ করে রইলো। অন্যদিন রাগের উত্তাপে অরিত্রের কথা ঠিক মতো শুনতোই না। আজ চুপচাপ তার কথা শুনছে। মনোযোগ দিয়ে কথাটা শুনছে। আসলেই মানুষটা সুন্দর করে কথা বলে। কণ্ঠটা শান্ত, মনোমুগ্ধকর। নিরবতার রেশ ছিড়ল অরিত্রের দ্বিধান্বিত কণ্ঠের তোড়ে। সে বলল,

‘ পূর্ণতা, একটা কথা বলব? রাগ করবে না তো?’

পূর্ণতা অবাক হলো। এই প্রথমবারের মতো লোকটাকে দ্বিধায় পড়তে দেখছে। দেখছে বললে ভুল হবে, প্রথমবার শুনছে। সে নিচু স্বরে বলল,

‘ আমি অযথা রাগ করি না। আপনি বলুন।’

অরিত্র কৌতুকের স্বরে বলল,

‘ তাই নাকি ম্যাডাম? আপনি আরও রাগ করেন না! এই ব্যাপারটাও আমায় বিশ্বাস করতে হবে? আসলেই, মেয়েদের মন বোঝা খুবই কঠিন।’

একটু থেমে স্বাভাবিক স্বরে বলল,

‘ আমার মা আর তোমার মায়ের মধ্যে প্রায়সময় কথা হয়, সেটা নিশ্চয়ই অজানা নয়?’

‘ জ্বি, আমি জানি।’

‘ তাঁরা দুজন আলাপ করে ঠিক করেছেন আমাদেরকে বাহিরে কোথাও ঘুরে আসতে বলবেন। তাদের মতে, বিয়ের পর দেখা সাক্ষাৎ করতে হয়, টুকটাক ঘুরতে যেতে হয়। কিন্তু সেই হিসেবে আমাদের দেখা সাক্ষাৎ ই হয়নি, ঘুরতে যাওয়া দূরের ব্যাপার। গতকাল মা আমাকে বিষয়টি জানিয়েছেন। আমি স্পষ্ট কিছু জানাইনি তোমার মতামত নিব বলে। কিন্তু আজ জোর আদেশ দিয়েছেন, আগামীকাল শুক্রবারে যেন তোমাকে নিয়ে বের হই। ব্যাপারটা এতটুকু হলে তাও সামলানো যেত, কিন্তু তা হয়নি। তোমার আম্মুও ফোন করে বলেছেন যাতে তোমাকে নিয়ে ঘুরতে যাই। এতকিছুর পরে যদি মানা করে দিই, তাহলে বিষয়টা খারাপ দেখাবে। উনারা দুজনই কষ্ট পাবেন। তবুও আমি তোমার মতামত জানতে চাইছি। তুমি যেতে না চাইলে আমি ভেবে দেখব কিভাবে উনাদের ম্যানেজ করা যায়। এখন তোমার মতামতটা জানতে চাই।’

পূর্ণতা স্তব্ধ হয়ে রইল। মা ভেতরে ভেতরে এতকিছু ভাবছেন সে তা একেবারেই আঁচ করতে পারেনি। কী বলবে বুঝতে পারল না সে। সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। কিছুক্ষণ ভেবে বলল,

‘ আমার একটু সময় লাগবে। একটু ভেবে তারপর জানাই?’

‘ সমস্যা নেই, তুমি সময় নাও। তবে আজ রাত বারোটার মধ্যে জানিয়ে দিও প্লিজ। আমার আবার পরিকল্পনা করতে হবে মাকে কী বলব। ‘

‘ আচ্ছা ঠিক আছে।’

‘ এবার তাহলে রাখি। আল্লাহ হাফেজ। ‘

‘ আল্লাহ হাফেজ। ‘

ফোন রেখে অরিত্র চোখ বন্ধ করে প্রশান্তির হাসি হাসলো। এই প্রথমবার তার ‘হৃদয়াক্ষী’ তার সাথে এত শান্তভাবে কথা বলেছে ৷ তাও এত সময় ধরে। ভাবতেই শান্তি লাগছে। পরক্ষণেই অজুহাত কি দিবে তা নিয়ে ভাবতে শুরু করল। সে জানে, পূর্ণতা তার সাথে ঘুরতে যাবে না। এই কথা ভাবাটাও যেন তার জন্য বিলাসিতা।

_____

পূর্ণতা খাবার নাড়াচাড়া করছে৷ খেতে পারছে না ঠিক মতো। আজ অনেকদিন পরে পরিবারের সাথে একসাথে খেতে বসেছে পূর্ণতা। এতদিন যেন এক অদৃশ্য দেয়াল তৈরি হয়েছিল তাদের মধ্যে। আজ সেই দেয়াল ভেঙে আবার সেই আনন্দ রশ্মি উপোভোগ করছে পূর্ণতা। মা কিছুক্ষণ পরপর মা তার প্লেটে এটা সেটা তুলে দিচ্ছেন। পূর্ণতা মন ভরে সেই দৃশ্য দেখছে। খাবার শেষে রান্নাঘরের টুকটাক কাজে মাকে সাহায্য করতে যায় পূর্ণতা। নাজিবা হাসান বললেন,

‘ তোমার কাজ করতে হবে না। সারাদিন অনেক ধকল গেছে। এখন ঘুমিয়ে পড়ো। অল্প কিছু কাজ আছে, এগুলো আমি করে ফেলতে পারব।’

পূর্ণতা কথা বাড়াল না। আসলেই সে ক্লান্ত। এখন শুলেই ঘুম নেমে আসবে চোখে। পূর্ণতা রুমের দিকে পা বাড়াতেই নাজিবা হাসান বললেন,

‘পূর্ণতা, শুনো আম্মু।’

‘ জ্বি মা বলো।’

‘ কাল অরিত্র আসবে। তোমাকে নিয়ে একটু ঘুরতে বের হবে। ছেলেটা কাজের চাপে দেখা করতে পারে না। কাল সময় করে নিয়েছে তোমাকে নিয়ে বেরুবে বলে। কাল শুক্রবার হলেও সকালে একটু তাড়াতাড়ি উঠো। কাল নীল রঙের জামদানি শাড়িটা পোড়ো কেমন? আমি শাড়ি পড়িয়ে, সাজিয়ে দিব তোমাকে।’

পূর্ণতা কিছু বলল না। মাথা নাড়িয়ে নিজের রুমে চলে গেল। মায়ের আগ্রহ অনেক বেশি। কথাগুলো বলার সময় তাঁর মুখে চঞ্চলতা উপচে পড়ছিল। কাল ঘুরতে বের হলে বাবা মা দুজনই ভীষণ খুশি হবে। এসব ভাবছিল। খানিক বাদে আবার মনে হলো, সে যদি অরিত্রকে নিষেধ করে দেয়, তাহলে অরিত্র তা সরাসরি কাউকে জানাবে না। নিজের গড়া মিথ্যা অজুহাত দেখাবে। কিন্তু এতে পূর্ণতার মায়ের মনে তার ব্যাপারে একটু খারাপ প্রভাব পড়তে পারে। অরিত্রকে বলার পরেও সে পূর্ণতাকে নিয়ে ঘুরতে বের নাহলে কিছুটা অবাধ্যতার ঘ্রাণ পাবেন হয়তো। কিন্তু আজ কেন জানি পূর্ণতার সেটা ভালো লাগছে না। মানুষটা তো আসলে তেমন না৷ তাহলে তার ব্যাপারে কেউ খারাপ কিছু ভাববে? অরিত্রকে নিয়ে কারো মনে খারাপ চিন্তা আসবে তা পূর্ণতার মোটেও ভালো লাগল না। সে ফোন নিয়ে অরিত্রকে মেসেজ পাঠাল,

‘ আমি যাব ঘুরতে। আমাকে নিতে আসবেন।’

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here