হৃদয়গ্রাহী #পর্ব_ ০৮,০৯

0
530

#হৃদয়গ্রাহী
#পর্ব_ ০৮,০৯
#সারিফা_তাহরিম
০৮

বৃহস্পতির চন্দ্ররাজ সূক্ষ্ম রেখায় কৃষ্ণবর্ণ আকাশে আলোর পরশ বুলাচ্ছে। রাত্রির গভীরতা বাড়ার সাথে সাথে আলোর প্রখরতা কমছে যেন। তবে বাতাসে একটা স্নিগ্ধ ঘ্রাণ ভেসে আসছে। এই বুঝি বর্ষার আগমনী বার্তা! অরিত্র সব ব্যস্ততা আর কাজ শেষে বারান্দার মেঝেতে বসে আছে। গায়ে পাতলা টি-শার্ট জড়ানো। শান্ত সেই দৃষ্টি গ্রিলের ফাঁক গলে আকাশে নিবদ্ধ। এই মুহূর্তে তার চোখে চশমা নেই। হাতে গিটার নিয়ে মাঝেমধ্যে টুংটাং সুর তুলছে আনমনেই। পাশে রাখা ফোনটা মেসেজ টোনে বেজে উঠতেই অরিত্রের ঘোর ভাঙলো। ফোন হাতে নিয়ে পূর্ণতার মেসেজটা ভেসে উঠতেই বিস্মিত হলো অরিত্র। কিয়ৎক্ষণ পরে নিজের বিস্ময় ভাবটা কাটিয়ে উঠতেই প্রশান্তির হাসি হাসলো।

____

গতকালের আবহাওয়ার রেশ ধরে আজকেও শীতল আবহাওয়া বিরাজ করছে। সূর্যের তাপ আজ নরম। হাসনাহেনা ফুলের সুবাস ভাসছে চারপাশে। পূর্ণতা চুপচাপ দাঁড়িয়ে তার মায়ের কার্যকলাপ দেখছে। নাজিবা হাসান খুব যত্নসহকারে মেয়েকে শাড়ি পড়াতে ব্যস্ত। নীল রঙের ইন্ডিয়ান মসলিন জামদানী শাড়িটা পূর্ণতার ধবধবে শরীরে বেশ ভালো লাগছে। নাজিবা হাসান মনোযোগ দিয়ে কুচিগুলো গুছাচ্ছেন। আজ হুট করেই যেন তিনি চঞ্চল কিশোরী হয়ে উঠলেন। সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর বিষয়গুলো খেয়াল করে মেয়েকে সুন্দর করে সাজিয়ে দিচ্ছেন। আর নিজের কাজ সুন্দরভাবে হচ্ছে দেখলেই চঞ্চল হাসি ফুটে উঠছে তাঁর মুখে। মায়ের এমন কর্মকাণ্ডে হালকা হাসলো পূর্ণতা। মা বাবার মুখের হাসিটাই তো দেখতে চায় সে।

নাজিবা হাসান পূর্ণতাকে শাড়ি পড়িয়ে দিলেন সুন্দর করে। একবার মেয়েকে দেখে নিয়ে মুগ্ধ হয়ে হাসলেন। তারপর সূরা পড়ে পূর্ণতার গায়ে ফুঁ দিলেন যেন কুনজর না পড়ে। তারপর বললেন,

‘ বাকিটা তুমি করো, সেজে নাও। আমার কাজ আছে। অরিত্র আসবে আর আমি এত কাজ ফেলে এখানে পড়ে থাকলে হবে!’

‘ মা, সাজগোজ নিয়ে থাকতে অস্বস্তি হবে আমার। তাও আবার গরমকালে!’

‘আজ অতো গরম নেই। আবহাওয়া স্বাভাবিক আছে। আর তাছাড়া শাড়ির সাথে একটু না সাজলে ভালো লাগে না। তোমার যখন অস্বস্তি হবে তাহলে অল্প করেই সুবিধা মতো সাজো।’

নাজিবা হাসান চলে গেলেন। পূর্ণতা মুখে পাউডার দিয়ে চোখে কাজলের রেখা টানলো। তারপর ঠোঁটে ম্যাজিক লিপস্টিক দিল, যার কারণে ঠোঁটজোড়া পুরোপুরি রঙিন না হলেও হালকা গোলাপি আভা ধারণ করল। মেক আপ শেষে কোমর ছাড়িয়ে পড়া চুলে চিরুনি চালালো কয়েকবার। মা বলেছেন চুল খোলা রাখতে। সব শেষে নিজেকে একবার আয়নায় দেখে নিল পূর্ণতা। সুন্দর দেখাচ্ছে তাকে। হয়তো মায়ের পড়িয়ে দেওয়া শাড়িটার কারণেই সৌন্দর্য ক্রমিক হারে বেড়েছে। এমনটাই ধারণা হলো পূর্ণতার। রেডি হয়ে চুপচাপ বসে রইলো বিছানায়। ঘড়িতে দশটা বাজার চার মিনিট বাকি। অরিত্র বলেছে দশটায় আসবে।

আজ প্রথমবারের মতো অরিত্রের সাথে ঘুরতে বের হবে ভাবতেই কেমন জানি লাগছে। আগে কখনো ঠিকমতো কথা অবধি বলেনি আর আজ সারাদিন তার সাথে কাটাবে! অস্বস্তি, ভয় আর সংকোচ একসাথে মিলিত হচ্ছে। কিছুক্ষণ পরে কলিং বেল বেজে উঠলো। পূর্ণতা দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকাল, দশটা বাজছে। এত পারফেক্ট টাইমিং! অরিত্র কি তবে এসে গেছে! অস্বস্তিতে ঢোক গিলল পূর্ণতা। অল্প কিছুক্ষণ পরে মৌনতা এসে লাফাতে লাফাতে বলল,

‘ ও আপু রে… আমার জিজু এসে গেছে। ইয়াহু…।’

পূর্ণতা আড়চোখে তাকিয়ে বলল,

‘ তো? কী হয়েছে তাতে? মনে হচ্ছে মাউন্ট এভারেস্ট জয় করে ফেলেছিস?’

‘ আরে তুই কি করে বুঝবি আমার আনন্দ! আমার জিজু না বরং আমার বড় ভাইটা এসেছে। আমি খুশি হবো না? ভাইয়ার সাথে তো আমার কথা হয়, আমি সেই কবে থেকে অপেক্ষা করছিলাম আমার ভাইটা আসবে! অবশেষে আমার ইচ্ছা পূর্ণ হলো। জানিস আপু, অরিত্র ভাইয়া আমার বড় ভাইয়ের অভাবটা ঘুঁচিয়ে দিয়েছে। অবশ্য এতে তোর অবদানও আছে, কিন্তু তোকে কোনো প্রকার ধন্যবাদ জানাতে আমি রাজি নই। যাই হোক, কিছুক্ষণের মধ্যে বাহিরে চলে আসিস। মা ডেকেছে। ভাইয়াকে নাস্তা দিবে। আমার অনেক কাজ পড়ে আছে, আমি যাই।’

মৌনতার এমন উত্তেজনা আর দরদ দেখে পূর্ণতা চোখ ছোট ছোট করে তাকাল। খানিকটা ঈর্ষান্বিত হলো মনে হয়। কই মৌনতা তো নিজের বোনের জন্য এতটা মমতা দেখায় নি! তবে অরিত্র যে মৌনতাকে স্নেহ করে তা বেশ ভালো করেই বুঝতে পারল। একটা মেয়ে সবসময় চায় তার স্বামী যেন তার বাবা মাকে নিজের বাবা মায়ের মতো সম্মান আর শ্রদ্ধা করে, ভাই বোনদেরকে নিজের ভাই বোনের মতো স্নেহ করে, ভালোবাসে। পূর্ণতার ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম নয়। অরিত্র তার বোনকে খুব স্নেহ করে ব্যাপারটা জেনে খুব ভালো লাগলো। আর পূর্ণতার বাবা মাকে সম্মান আর শ্রদ্ধা করার কথা তো বলাই বাহুল্য। পূর্ণতার ভাবনার সুতো ছিড়ল কারো কাশির আওয়াজে। পূর্ণতা পিছনে ফিরে দেখল অরিত্র রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। পূর্ণতার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য একটু কাশি দিয়েছিল। পূর্ণতা তার দিকে ফিরতেই অরিত্র বলল,

‘আসবো?’

‘ আসসামু আলাইকুম। জ্বি আসুন।’

‘ওয়ালাইকুম আসসালাম।’

বলে অরিত্র পূর্ণতার রুমে প্রবেশ করল। পূর্ণতা অস্বস্তিতে জড়োসড়ো হয়ে আছে। দৃষ্টি মেঝেতে নিবদ্ধ। অরিত্র পূর্ণতাকে দেখে ‘মা শা আল্লাহ’ বলল। এতে পূর্ণতা কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। অরিত্র বলল,

‘কেমন আছো? ‘

‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো।’

অস্বস্তি নিয়ে চাপা স্বরে বলল পূর্ণতা। অরিত্র লক্ষ্য করল আজ পূর্ণতার মধ্যে আগের সেই রাগটা নেই। যা আছে তা হলো সংকোচ আর অস্বস্তি। অরিত্র হেসে বলল,

‘ কেউ কারো থেকে কেমন আছে জিজ্ঞেস করলে সৌজন্যমূলকভাবে তার কথা জিজ্ঞেস করতে হয়।আমাকে জিজ্ঞেস করবে না আমি কেমন আছি?’

অরিত্রের কথায় পূর্ণতা লজ্জায় পড়ে গেল। আসলেই তো! অস্বস্তিতে পড়ে কেমন বোকামি করে ফেলল সে! জড়তা নিয়ে জিজ্ঞেস করল,

‘ আপনি কেমন আছেন?’

মৃদু শব্দে হাসলো অরিত্র। গতকাল অন্যমনস্ক হয়ে পূর্ণতা প্রথম তাকে ‘কেমন আছেন’ জিজ্ঞেস করেছিল। এছাড়া আগে কখনো জিজ্ঞেস করেনি। এই নিয়ে অরিত্র কৌতুক করেনি। সে জানতো কিছু বললে হয়তো পূর্ণতা রেগে যাবে। তাই আর কিছু বলেনি। অরিত্র বলল,

‘ আমিও আলহামদুলিল্লাহ খুব ভালো আছি। মা তোমাকে বাহিরে যেতে বলেছেন। তাই ডাকতে এলাম।’

অরিত্র বের হয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। পূর্ণতার মা’কে সে ‘মা’ বলে ডাকছে! অবাক হলো পূর্ণতা৷ অরিত্র হাঁটা থামিয়ে পেছন ফিরে বলল,

‘ তোমার কোনো কিছুতে অসুবিধা বা অস্বস্তি হলে আমায় বলবে। তোমার একটু ভালো থাকার উপায় যে করেই হোক আমি বের করব।’

____

ব্যস্ত নগরীর রাস্তায় আজ গাড়ি তুলনামূলক হারে কম। শুক্রবার সকাল হওয়ার কারণেই হয়তো এমন। সময় বাড়তে বাড়তে রাস্তাঘাট আবারও জনমানবে পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে। অরিত্র আর পূর্ণতা দাঁড়িয়ে আছে। অরিত্র কিছুটা সামনে দাঁড়িয়ে কপাল কুচকে সিএনজি খুঁজছে। তার পড়নে শুভ্র রঙের পাঞ্জাবী। পেছন থেকে চোরা চোখে এটুকুই লক্ষ্য করল পূর্ণতা। এখন অবধি এই মানুষটাকে ভালো করে দেখা হয়নি তার।

খানিকটা দূরে একটা মেলা বসেছে। আপাতত সেখানে যাবে তারা। সেখানে ঘুরাঘুরি করে অরিত্রের এক বন্ধু আসাদের বাসায় যাবে। আসাদদের বাড়িটা খানিকটা গ্রাম সাইডে। নদীর ধারের বেশ সুন্দর ছোট্ট একটা বাড়ি। এখানের মেলাটা ছোট খাটো হলেও খুব সুন্দর। প্রতিবছর এই সময়ে মেলাটা বসে। আসার সময় অরিত্র অবন্তী ও মৌনতাকে নিয়ে আসতে চেয়েছিল, কারণ এরা দুজন থাকলে পূর্ণতা কিছুটা স্বাভাবিক হবে। কিন্তু তাদের মায়েরা কড়া কণ্ঠে নিষেধ করে দিলেন। তাঁরা চান অরিত্র আর পূর্ণতা একটু একান্তে সময় কাটাক।

অরিত্র সিএনজি ভাড়া করার জন্য একটা সিএনজি থামালে পূর্ণতা একটু এগিয়ে এসে চাপা স্বরে বলল,

‘মেলা তো এখান থেকে কাছে। সিএনজি নেওয়ার দরকার কী? রিকশা দিয়েই তো যাওয়া যাবে।’

অরিত্র এক পলক তার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট চেপে বলল,

‘যাওয়া তো যাবে ঠিকই, কিন্তু সেই যাত্রা যে আপনার জন্য মঙ্গলকর হবে না ম্যাডাম। একই রিকশায় আমি আপনার পাশে বসলে অস্বস্তি আর সংকোচে একপাশে চাপতে চাপতে কোন সময় রিকশা থেকে পড়ে যান তার কোনো ঠিক নেই। এর দায় ভার আমি নিতে পারব না। তাই সিএনজি করে যাওয়াটাই শ্রেয়।’

আবারও লজ্জায় পড়ে গেল পূর্ণতা। লোকটা কি জানে না এভাবে বলতে হয় না? মনে মনে চাপা রাগ পোষার চেষ্টা করল পূর্ণতা। কিন্তু পারল না। চুপচাপ সিএনজিতে উঠে বসল। অরিত্র সিএনজিতে উঠে বসতেই সিএনজি চলা শুরু করল। তাদের দুজনের মধ্যে এক হাত দূরত্ব। বাতাসে পূর্ণতার চুলগুলো উড়ছে। সে গম্ভীর মুখে বাহিরে তাকিয়ে আছে। অরিত্র দৃশ্যটা উপভোগ করল। আজ তার হৃদয়াক্ষীকে হৃদয়ের গভীর নয়ন দিয়ে দেখতে আরও স্নিগ্ধ লাগছে। নাকের ছোট্ট ডায়মন্ডের নাকফুলটা যেন সৌন্দর্যকে কয়েক ধাপ বাড়িয়ে দিয়েছে। অরিত্র বলল,

‘ আমাদের বিয়ে হয়েছে, একটা সুন্দর সম্পর্ক হয়েছে ঠিক, কিন্তু আমরা কি আদৌ সেই সম্পর্কের আওতায় এসেছি? আমরা তো এখনো একে অপরকে ঠিক মতো জানলামই না। তুমিই দেখো, আমার পুরো নামটাও হয়তো জানো না। আর আমি তোমাকে জানলেও পুরোপুরি জানি না।’

পূর্ণতা এবার গম্ভীরতা ঠেলে চিন্তা করল। আসলেই সে অরিত্রের পুরো নামটা জানে না। কখনো জানার প্রয়োজনবোধ করেনি। তবে এখন কৌতুহলী হয়ে উঠেছে। অরিত্র আবারও বলল,

‘ বৈবাহিক বন্ধনের কারণে না হলেও অন্তত বন্ধুত্বের কারণে সম্পর্কটা এগিয়ে যাক? একটা নতুন মায়ার পরাকাষ্ঠা গঠিত হোক? চলো না দুজন বন্ধুত্বের মাধ্যমে পরিচিত হই আবারও। আমি অরিত্র আহসান। আপনার দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছি। আপনি আমায় বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করে কৃতার্থ করুন হে সুন্দরী তনয়া।’

অরিত্র হাত বাড়িয়ে দিল। পূর্ণতা অরিত্রের হাতের দিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিল। তার মুখে লাজুক হাসি। এই হাসিটা অরিত্রের চোখ এড়ালো না। সম্পর্কটা হয়তো স্বাভাবিক হচ্ছে। পূর্ণতা হাতটা না ধরলেও তার অপ্রকাশিত সম্মতিতে প্রশান্তির হাসি হাসলো অরিত্র। আর পূর্ণতা ভাবছে,

‘ বন্ধুত্বতার ছদ্মবেশ ধরে হলেও আপনার প্রতিটি কথা যে প্রেমের পরাকাষ্ঠা গঠন করতে ব্যস্ত তা কি আপনি জানেন জনাব?’

চলবে…

#হৃদয়গ্রাহী
#পর্ব_ ০৯
#সারিফা_তাহরিম

‘ বন্ধুত্বের ছদ্মবেশ ধরে হলেও আপনার প্রতিটি কথা যে প্রেমের পরাকাষ্ঠা গঠন করতে ব্যস্ত তা কি আপনি জানেন জনাব?’

বলা হলো হলো না কথাটা। পূর্ণতা বাহিরে তাকাল আবারও। মনে মনে অরিত্রের দিকে বন্ধুত্বের হাতটা ঠিকই বাড়িয়ে দিয়েছে সে। অরিত্র কি সেটা খেয়াল করেছে?

মেলার কাছে আসতেই অরিত্র ভাড়া চুকিয়ে নেমে পড়ল। পূর্ণতাও সাবধানে নামল। অরিত্র পূর্ণতার দিকে ফিরতেই গভীর নেত্রযুগলের মিলন হলো। কালো ফ্রেমের চশমার আড়ালে থাকা অরিত্রের গভীর চোখগুলোতে যেন সম্মোহন মেশানো। পূর্ণতা তড়িৎ গতিতে চোখ সরিয়ে নিল। ঐ চোখে তাকিয়ে থাকার সাহস তার নেই। অরিত্র বলল,

‘ এবার তাহলে যাওয়া যাক?’

পূর্ণতা সম্মতিসূচক মাথা নাড়লো। অরিত্র পূর্ণতাকে নিয়ে এগিয়ে চলল। টিকিট কিনে মেলায় ঢুকল। অন্যদিন সকালবেলা মেলায় মানুষ থাকে না বললেই চলে। তবে আজ শুক্রবার হওয়ায় মোটামুটি মানুষ এসেছে। দোকানের তিনটা সারি দেখা যাচ্ছে। অনেকগুলো স্টল বসেছে। বিশেষ করে মেয়েদের চুরি, কানের দুল ও বিভিন্ন সাজ সরঞ্জামের স্টলই বেশি। ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল অরিত্র আর পূর্ণতা। সামনে একটা আচারের স্টল দেখা গেল। হরেক রকমের আচার বিক্রি করছে। অরিত্র জানে আচারের প্রতি বেশিরভাগ মেয়েদের অদ্ভুত লোভ কাজ করে। পূর্ণতাও নিশ্চয় তার ব্যতিক্রম হবে না। পূর্ণতার দিকে তাকাল অরিত্র। তারও দৃষ্টি আচারের স্টলটার দিকে। আচারের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে পূর্ণতা জড়তার জন্য তাকে কিছু বলবে না সেটা খুব ভালো করেই জানে। তাই কিছু না বলেই অরিত্র স্টলের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,

‘ পূর্ণতা, কোন আচারগুলো ভালো? আমি তো আচার খাই না। তবে আজ ভাবছি একটু খেয়ে দেখি। তোমরা মেয়েরা তো খুব আচারপ্রেমী হও, তাই তোমার কাছে জিজ্ঞেস করলাম।’

পূর্ণতা চঞ্চল স্বরে বলল,

‘ তেতুল চাটনিটা বেশ ভালো। টক স্বাদের হওয়ায় ভালোই লাগে খেতে। চালতা আর জলপাইয়ের আচারও মজা। আর রইল আমের আচার, আচারের মধ্যে এটা বেস্ট।’

অরিত্র পূর্ণতা, মৌনতা আর অবন্তীর জন্য আচার কিনল। এত এত আচার দেখে পূর্ণতার চোখে খুশির ঝিলিক দেখা দিল। এখনই খেতে ইচ্ছে করছে তার। তবে লজ্জায় কিছু বলল না অরিত্রকে। অরিত্র ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে নিল। এগারোটা বেজে পনেরো মিনিট। দুপুরে আসাদের বাসায় দাওয়াত হওয়ায়, লাঞ্চ ওখানেই করবে। জুমার নামাজ পড়ে তারপর টুকটাক কথাবার্তা বলে খেতে বসতে সময় লাগবে। সব মিলিয়ে লাঞ্চ করতে দেরি হবে। আর পূর্ণতা নাস্তা করেছে সেই সকালে। এতক্ষণ না খালি পেটে কিভাবে থাকবে মেয়েটা!

আরও কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরি করলো তারা। অরিত্র পূর্ণতাকে বেশ কয়েকবার বলল কিছু পছন্দ হলে বলতে। কিন্তু পূর্ণতা কিছুই বলল না। একজোড়া অ্যান্টিকের কানের দুল খুব সুন্দর লাগলো অরিত্রের। সে পূর্ণতার জন্য কানের দুল জোড়া আর কয়েক ডজন চুড়ি কিনল। নীল চুড়িগুলো পড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু পূর্ণতার কথা ভেবে নিজের ইচ্ছাকে ধামাচাপা দিল। একটা স্টল ছিল দেশীয় শাড়ির। অরিত্র বলল,

‘আম্মুদের জন্য কোন শাড়িগুলো ভালো হবে দেখো তো?’

পূর্ণতা দুটো বেগুনি রঙের শাড়ি বেছে নিল। দুটো প্রায় একই ধরনের। শাড়ি দুটো বেশ সুন্দর। অরিত্রেরও পছন্দ হলো। শাড়িগুলো নেওয়ার পর অরিত্র একটা বাসন্তী রঙের শাড়ি নিল। পূর্ণতা বলল,

‘শাড়ি দুটো তো নেওয়া হয়েছে। অবন্তী তো শাড়ি পড়ে না। তাহলে এটা কার জন্য?’

‘তোমার জন্য। কেন সুন্দর লাগছে না এই শাড়িটা?’

পূর্ণতা পুলকিত হেসে চাপাস্বরে বলল,

‘আপনার পছন্দ করা জিনিসগুলো সুন্দর।’

অরিত্র মৃদু শব্দে হেসে বলল,

‘ আমার পছন্দের তালিকায় কিন্তু আপনিও লিপিবদ্ধ আছেন ম্যাডাম।’

পূর্ণতা লজ্জা পেল। লোকটা কি ইনিয়ে বিনিয়ে তাকে সুন্দর বলল? নাকি সে যে পূর্ণতাকে পছন্দ করে সেটা জানাল? ঠিক বুঝতে পারল না পূর্ণতা। এই মানুষটা যে কেন প্রতিবার কথার বেড়াজেলা তাকে ফাঁসিয়ে ফেলে! মেলায় ঘুরার বেশ অনেকটা সময়ই তাদের মধ্যে টুকটাক গল্প চললো। গল্প চললো বললে ভুল হবে। মূলত অরিত্রই তার ছোটবেলার কিছু ঘটনা বলেছে। আর পূর্ণতা চুপচাপ শুনলো তার কথা। বাসার বাকিদের জন্য টুকটাক জিনিস নিয়ে মেলা থেকে বেরিয়ে এলো প্রেমীযুগল। অরিত্র সময় দেখে নিল। পৌনে বারোটা বাজছে। পূর্ণতাকে নিয়ে রাস্তার ওপারের রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসল। পূর্ণতাকে কিছু খাওয়াতে হবে। অরিত্র তো সকালে নাস্তা করার পর পূর্ণতাদের বাসায়ও খেতে হয়েছে। যার কারণে তার খাওয়ার মতো অবস্থা নেই। পেট ভরপুর। কিন্তু পূর্ণতার জন্য তাকেও অল্প করে খেতে হবে। নাহলে মেয়েটা খেতে সংকোচবোধ করবে।

রেস্টুরেন্টটা বেশ উন্নত মানের। কিন্তু অবেলা হওয়ার কারণে মানুষ নেই তেমন। কয়েকজন মেয়ে বসে গল্প গুজব করছে আর কফি খাচ্ছে। তাদের দেখে কলেজ পড়ুয়া মেয়ে মনে হচ্ছে। অরিত্র আর পূর্ণতা রেস্টুরেন্টে ঢুকতেই সবাই যেন কৌতুহলী চোখে তাকাল তাদের দিকে। পূর্ণতাকে খানিকটা বিচলিত দেখাল হয়তো। সে অরিত্রকে বলল,

‘ চলুন কর্নারে বসি।’

অরিত্র দ্বিরুক্তি না করে কর্নারে গিয়ে বসল। এদিকে মেয়েগুলোর কৌতুহলী দৃষ্টি তেমনটা পড়বে না। হাফ ছাড়ল পূর্ণতা। ওয়েটার অর্ডার নেওয়ার জন্য আসতেই অরিত্র পূর্ণতাকে জিজ্ঞেস করল। পূর্ণতার কথামতো রামেন আর কোল্ড কফি অর্ডার করল দুজনের জন্য। রেস্টুরেন্টটার একটা ভালো দিক লক্ষ্য করা গেল। অর্ডার দেওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যে খাবার চলে এলো। খাওয়া শুরু করতে করতে অরিত্র বলল,

‘ পূর্ণতা, একটু তাড়াতাড়ি খেতে হবে। এখান থেকে আবার আসাদের বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হবে। সেখান থেকে আসাদের সাথে নামাজ পড়তে যাব। আজ আরও জুমাবার। দেরি করা যাবে না।’

‘জ্বি৷ বুঝতে পেরেছি।’

অরিত্রের খাওয়ার মুড নেই। সে ধীরে ধীরে কোল্ড কফিতে চুমুক দিতে দিতে বলল,

‘এতদিন রেগে থাকার কারণটা এখনো জানতে পারিনি ম্যাডাম।’

পূর্ণতা আড়চোখে তাকিয়ে ক্ষীণ কণ্ঠে বলল,

‘কিসের রাগ? কে রাগ করেছে?’

পূর্ণতার কথায় সশব্দে হেসে উঠলো অরিত্র। হাসতে হাসতে বলল,

‘এতদিন ধরে যে রাগে আমার ছায়াটাও দেখতে পারত না, কণ্ঠটাও শুনতে পারত না সে আজ বলছে কিসের রাগ! ব্যাপারটা অদ্ভুত না? আসলেই নারীমনের মতো বিশাল রহস্য এই পৃথিবীতে দ্বিতীয়টা নেই। যতই এর রহস্য উদঘাটন করার জন্য আলোক রশ্মি প্রেরণ করা হোক না কেন, ব্ল্যাকহোলের মতো সবকিছুই অন্ধকার দেখায়। আর যেসকল পুরুষ এই রহস্য সত্যিই উদঘাটন করতে পারে, তারা মহাজ্ঞানীর তালিকায় স্থান পাওয়ার যোগ্য।’

পূর্ণতা কিছু না বলে চুপচাপ খেতে লাগলো। অরিত্র আবারও জিজ্ঞেস করলো,

‘ আচ্ছা তোমার সেই না করা রাগ অর্থাৎ গম্ভীরতার কারণটা কী?’

পূর্ণতা এবার খানিকটা ইতস্তত হয়ে বলল,

‘ আসলে বিয়েটা আমার জন্য পুরোপুরি আনএক্সপেক্টেড ছিল। হুট করে বিয়ে হয়ে যাবে তা কস্মিনকালেও ভাবিনি আমি। মূলত পড়াশোনা শেষ হওয়ার আগে বিয়ের কল্পনা মাথায় আনার কথা ভাবিওনি। তবুও বাবা মায়ের খুশির জন্য রাজি হয়ে গিয়েছিলাম। এমনিতেই আমার কোনো পছন্দের কেউ ছিল না, বাবার পছন্দের ছেলেকেই বিয়ে করতাম। তাই ভাবলাম বিয়েটা নাহয় কিছুদিন আগেই হবে। নিজেকে বুঝালাম। কিন্তু বিয়ের দিন বাবা মা আমাকে ভুল বুঝলেন। সেদিন থেকে গত কয়েকদিন আগে পর্যন্ত বাবা মা আমার সাথে ঠিক মতো কথা অবধি বলেননি। আমি অনেক চেষ্টা করেও এতদিন উনাদের ভুল দূর করতে পারিনি। এজন্য মন মেজাজ খারাপ থাকতো সবসময়। তাই আপনাকে দেখলেই কেন জানি রাগ হতো খুব।’

শেষের কথাগুলো বলার সময় গলার স্বর আরও মিইয়ে গেল পূর্ণতার। অরিত্র বলল,

‘ বিনা অপরাধে শাস্তি পেলাম তাহলে?’

অরিত্রের কণ্ঠ খানিকটা গম্ভীর শোনালো। পূর্ণতার মধ্যে অপরাধবোধ কাজ করল। এই প্রথমবার অরিত্র তার সাথে গম্ভীরভাব কথা বলেছে। কোনো এক অজানা কারণে ভীষণ খারাপ লাগছে পূর্ণতার। খাওয়া শেষে বিল চুকিয়ে দুজনই বেরিয়ে এলো রেস্টুরেন্ট থেকে। সিএনজি ঠিক করে আসাদের বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হলো। এর মধ্যে আর একটা কথাও বলল না অরিত্র। পূর্ণতার মনে বিষন্নতা নেমে এসেছে। মানুষটা কি রাগ করেছে তার সাথে? অরিত্রের এমন গাম্ভীর্যতা মেনে নিতে পারছে না পূর্ণতা ৷ কষ্ট হচ্ছে তার। পূর্ণতার মনের সাথে তাল মিলিয়ে আকাশেও মেঘ জমেছে। যখন তখনই মেঘ গলে বৃষ্টিরা পাড়ি জমাবে ধরনীতে।

বারোটা চল্লিশের দিকে আসাদদের এলাকার সামনে গিয়ে থামলো সিএনজি। অরিত্র আর পূর্ণতা দুজনই নেমে পড়ল। এখানে কাঁচা রাস্তা হওয়ায় কোনো গাড়ি না যাওয়াটাই শ্রেয়। আসাদদের বাড়ি অবধি হেঁটে যেতে হবে। কয়েক পা এগিয়ে গেল অরিত্র। তার পিছুপিছু পূর্ণতাও এগুলো। অরিত্র এখনো চুপচাপ। সে রেগে আছে ভাবতেই আরেক রাশ বিষন্নতা জড়ো হলো পূর্ণতার মনে। সে অরিত্রের পাশাপাশি গিয়ে বলল,

‘সরি’

কথাটা হয়তো অরিত্রের কান অবধি পৌঁছালো না। ততক্ষণে ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। অরিত্র পূর্ণতার হাত ধরে সামনের টং দোকানে গিয়ে দাড়ালো। পূর্ণতা আর অরিত্র দুজনই খানিকটা ভিজে গেছে। দোকানদার ছাড়া আর তেমন লোকজন নেই আশেপাশে। তবুও হালকা ভিজে উঠা ‘স্ত্রী’ নামক সুন্দরী এই রমণীকে লোকচক্ষুর আড়াল করতে এক হাতে জড়িয়ে নিল। যাতে দোকানদার বা বাহিরের কেউ তেমনটা খেয়াল না করে। আজানের সময় মাথায় সুন্দর করে আঁচল টেনে নিয়েছিল। এখনো সেভাবেই আছে। তাকে দেখে বউ বউ লাগছে। অরিত্রের শুভ্র পাঞ্জাবিটা ভিজে উঠেছে। অরিত্রের বুকের অনেকটা কাছাকাছি পূর্ণতা। সুন্দর একটা ঘ্রাণ ভেসে আসছে অরিত্রের পাঞ্জাবি থেকে। পূর্ণতা এবার পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল অরিত্রের দিকে। চোখে চশমা, গালে চাপ দাড়ি, সুঠাম দেহের এই পুরুষটা নিঃসন্দেহে সুদর্শন। পূর্ণতার একান্ত ব্যক্তিগত মানুষ। কিন্তু তিনি রাগ করে আছেন পূর্ণতার উপর। ভাবনাটা মাথায় আসতেই পূর্ণতা দৃষ্টিতে বিষন্নতা নামল। কাজলটানা চোখে তা স্পষ্ট ধরা দিল। তখনই অরিত্র তার কানের কাছে ফিসফিস করে,

‘কোনো এক নির্দিষ্ট মানুষের কাছে অপরাধের জন্য ‘সরি’ না, ‘ভালোবাসি’ বলতে হয়।’

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here