#হৃদয়গ্রাহী
#পর্ব__১৪,১৫
#সারিফা_তাহরিম
১৪
জীবন স্রোতে পাল তুলে সময় বইতে থাকে নিজ গতিতে। সুখ দুঃখের নানা মহরাকে সাক্ষী করে নিয়ে চলে বহুদূর। চোখের পলকেই কেটে যেতে থাকে অজস্র মুহূর্ত। দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেছে ছয় মাস। পূর্ণতার প্রথম বর্ষের পরীক্ষা ইতি টেনেছে গত দুদিন আগে। এতদিনের ব্যস্ততা কাটিয়ে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারল সে। সময়ের সাথে অনেক কিছুরই পরিবর্তন হয়েছে। পূর্ণতা আর অরিত্রের সম্পর্কেরও। এই মানুষটার প্রতি পূর্ণতার বিরক্তি নয়, বরং প্রেমাসক্তি কাজ করে। চোখ বুজলেই মুহূর্তের মধ্যে অরিত্রের ছবি আঁকতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে রংতুলিরা। অরিত্রের সাথে সময় কাটাতে ভালোই লাগে তার। আজও অরিত্র দেখা করার কথা বলতেই পূর্ণতা নিমিষেই রাজি হয়ে গেল। তার বৈধ প্রেমিকের সাথে প্রেম করতে ভালোই লাগে বেশ। বিকেলের দিকে হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা পথ এগিয়ে একটা পার্কে এলো অরিত্র আর পূর্ণতা। চারপাশে জোড়ায় জোড়ায় কপোত-কপোতীরা বসে গল্প করছে। কয়েকটা বন্ধুমহলের দল মিলে পিকনিক করছে। পরিবেশটা মনোরম লাগছে। চারপাশে শীতের রাজত্ব চলছে বিধায় পূর্ণতা গায়ে একটা পাতলা শাল জড়িয়ে আছে। আর অরিত্রের গায়ে কালো জ্যাকেট৷ পূর্ণতা আড়চোখে বারবার অরিত্রের দিকে তাকাচ্ছে। জ্যাকেটের হাতা হালকা উঠিয়ে রাখায় অরিত্রের ঘড়ি পড়া লোমশ হাত খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। ঈর্ষা হচ্ছে পূর্ণতার। যখন তখন উনাকে এত সুন্দর দেখাতে হবে কেন! পূর্ণতার দৃষ্টি পরখ করতেই অরিত্র চাপা হেসে বলল,
‘এভাবে দেখো না সুন্দরী, প্রেমে পড়ে যাবে।’
পূর্ণতা থতমত খেয়ে চোখ সরিয়ে নিল। তারপর বলল,
‘মোটেও না। আমি আপনার দিকে তাকাইনি। আমি তো এমনি ঐদিকের রাস্তাটা দেখছিলাম।’
অরিত্র হাসতে হাসতে বলল,
‘চোর ধরা পড়লে এমনই বলে।’
পূর্ণতা ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বলল,
‘কী! আপনি আমাকে চোর বললেন? আমি চুরি করলাম কবে?’
‘এই যে লুকিয়ে লুকিয়ে আমার মতো নিরীহ পুরুষটার দিকে কেমন ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছো! এটা তো এক প্রকার চুরি-ই।’
‘আপনি আরও নিরীহ পুরুষ! আর কতকিছু শুনতে হবে এই দুনিয়ায়! আর তাছাড়া আমি তাকিয়ে থাকলে এটা মোটেও চুরি হবে না। আমার অধিকার আছে তাকিয়ে থাকার।’
অরিত্র পূর্ণতার কাছ ঘেষে ফিসফিসিয়ে বলল,
‘ তাই নাকি? মিসেস অরিত্র আহসান তবে আজকাল পড়াশোনার হিসাব নিকাশের বাহিরে অধিকারের হিসাব নিকাশও রাখা শুরু করেছে! ভালোই পরিবর্তন দেখছি। এই তুমি আমার প্রেমে ট্রেমে পড়ে গেলে না তো?’
পূর্ণতা মুখ ঘুরিয়ে বলল,
‘বললেই হলো! আমি ওতো সহজে প্রেমে পড়ব না। আর পড়লেও বা কী? আপনার প্রেমে পড়ার অধিকারও আমার আছে। আর এই অধিকার শুধুমাত্র আমারই।’
এবার অরিত্র শব্দ করে হেসে ফেলল। মেয়েটা এখন অস্বস্তির গণ্ডি পেরিয়ে চঞ্চল হয়ে উঠেছে। প্রতিটি কথায় চঞ্চলতামিশ্রিত জবাব দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে থাকে। সামনে একজন মধ্যবয়স্ক লোককে হাওয়াই মিঠাই ফেরি করতে দেখে অরিত্র বলল,
‘হাওয়ায় মিঠাই খাবে?’
পূর্ণতার চেহারায় উৎফুল্লতা খেলে গেল। আহ্লাদী হয়ে অরিত্রের কাছ ঘেষে তার এক হাত জড়িয়ে ধরে হাস্যোজ্জ্বল মুখে মাথা নাড়ল। অরিত্র সাদা আর গোলাপি রঙের দুটো হাওয়াই মিঠাই কিনে পূর্ণতার হাতে ধরিয়ে দিল। পূর্ণতা বলল,
‘আপনি সাদাটা খাবেন নাকি গোলাপিটা?’
‘আমি এত মিষ্টি জিনিস খেতে পারি না। নেহাৎ তোমার ভীষণ পছন্দের বলে নিয়ে দিয়েছি নাহলে নিয়ে দিতাম না। এগুলো খাওয়া ভালো না। তবুও তোমার মতো কিছু বাচ্চার জন্য নিতেই হয়।’
পূর্ণতা পাত্তা দিল না অরিত্রের কথায়। স্বচ্ছ প্যাকেটটা খুলে খাওয়া শুরু করল। সব ধরনের মিষ্টি জিনিসের প্রতি খুব বেশি লোভ তার। হাওয়াই মিঠাই হলে তো কথাই নেই৷ একটা শেষ হতেই অরিত্রের দিকে তাকিয়ে হাসলো সে। অরিত্র নিজ দায়িত্বে মুখ মুছিয়ে দিয়ে বলল,
‘সামনে একটা লেক আছে। আর ওদিকে একটা বাগানের মতো করে ছোট্ট টিলা আছে। কোথায় যাবে?’
‘টিলাটাতেই চলুন। একটু পাহাড়ে চড়ার অনুভূতি আসবে।’
‘তোমার কি পাহাড় পছন্দ?’
‘হ্যাঁ। পাহাড় আমার ভীষণ পছন্দ। পাহাড় থেকে প্রকৃতিকে খুব কাছ থেকে অনুভব করা যায়। সবুজ স্নিগ্ধ সেই অনুভূতি।’
‘তাহলে চলো ওখানে যাই। রিসিপশনের পর আমাদের প্রথম ভ্রমণে পাহাড়ি এলাকায়ই যাব। কোথায় যাবে সেটা ঠিক করার দায়িত্বটা তোমায় দিলাম।’
এবার পূর্ণতা খানিকটা লজ্জা পেল। কোনো কথা বলল না সে। দুজনে বাগানের মতো দেখতে গাছপালায় ঘেরা টিলাটাতে উঠলো। এখান থেকে চারপাশে খুব সুন্দর দেখা যায়। দূর দূরান্ত পর্যন্ত সবুজের সমারোহ। একপাশ থেকে নিচের লেকটি দেখা যাচ্ছে। একটা ইউক্যালিপটাস গাছের ছায়াতলে বসল দুজন। পূর্ণতা হাতে থাকা দ্বিতীয় হাওয়াই মিঠাইটি শেষ করল। অরিত্র বলল,
‘পূর্ণতা, একটা সত্য কথা বলবে?’
‘অবশ্যই। আপনি প্রশ্ন করুন।’
‘তুমি আগে কাউকে ভালোবাসোনি?’
‘এই প্রশ্নের উত্তর তো বহু আগেই দিয়েছি। আমি আসলেই কাউকে ভালোবাসিনি।’
‘হ্যাঁ দিয়েছ ঠিক। কিন্তু কারণটা অজানা। তাই আবারও জিজ্ঞেস করলাম। তোমাদের বয়সের মধ্যে প্রেম হওয়াটা অতি স্বাভাবিক। প্রেম আসতেই পারে, প্রেমে জড়াতেই পারে। কিন্তু তুমি কারো প্রেমে না পড়া বা কাউকে ভালো না বাসার কারণটা কী? প্রেমবিদ্বেষী নাকি?’
পূর্ণতা দুহাতে ভাঁজ করা হাটুজোড়া জড়িয়ে বেশ মনোযোগী আর দায়িত্বশীল বক্তার ভঙ্গিতে বলা শুরু করল,
‘আসলে প্রেম বা ভালোবাসা ব্যাপারটা আপাত দৃষ্টিতে আমরা যতটা সহজভাবে দেখি, ব্যাপারটা ততটা সহজ না। ‘ভালোবাসা হুট করে হয়ে যায়’ এমন চিরচারিত কথাটা আমার দৃষ্টিভঙ্গিতে সম্পূর্ণ ভুল। ভালোবাসা হুট করে আসার কোনো বিষয় না। এর জন্য সময় লাগে, বোঝার ক্ষমতা লাগে আর ভালোবাসার মনোভাব লাগে। হুট করেই যেই ভালো লাগাটা কাজ করে সেটা আকর্ষণ বা মোহ ছাড়া আর কিছুই না। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে ভালো লাগাটা থেকেই ভালোবাসার জন্ম হয়। কিন্তু তাই বলে এই ভালো লাগাটা ভালোবাসা না। এই যে এখনকার যুগের কথাই ধরুন না। কিশোর কিশোরী, যুবক যুবতী সব ছেলে মেয়েরাই উঠতে, বসতে, চলতে, ফিরতে প্রেমে পড়ছে। যাকে বলা হয় ক্রাশ। এই ক্রাশটা নিছক মোহ ছাড়া আর কিছুই না। যার কারণে এই মোহ কিছু সময় পর কেটে যায়।
মায়া জিনিসটা অনেকটা চোরাবালির মতো। যতই এর ভেতর থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করা হয় ততই এটা নিজের বেড়াজালে মানুষকে ঝাপটে ধরতে থাকে। আর সেই মায়া যদি অনুরক্তির অংশ হয়ে থাকে তাহলে তো তা থেকে বেরিয়ে আসা অসম্ভব প্রায়।
এই মায়ার জন্য ঐ মানুষটার সান্নিধ্য, সময় সেই সাথে ভালোবাসার দৃষ্টি থাকতে হয়। যদি কেউ ঠিক করেই রাখে যে সে কখনো কাউকে ভালোবাসবে না বা কাউকে দেখে যদি তার প্রতি ভালো লাগাটা প্রেমের ভালো লাগা না হয়ে থাকে তাহলে ভালোবাসাটা কি আদৌ সম্ভব? এই ক্ষেত্রে অনেকটা মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার কাজ করে। যারা এই ধরনের মায়াকে সহজেই প্রশ্রয় দিয়ে থাকে, তাদের ক্ষেত্রে ভালোবাসতে খুব একটা সময় লাগে না। কিন্তু আমি কখনো সেই মানসিকতা রাখিনি আর না রেখেছি কোনো মায়া। এর পেছনেও আরেকটা কারণ আছে।’
একটু থামল পূর্ণতা। ছোট থেকে গুছিয়ে রাখা অসংখ্য কথাকে আজ প্রকাশ করবে সে। একটু জিরিয়ে আবার বলা শুরু করল,
‘বাবা মা অনেক কষ্ট করে আমাদের লালন পালন করে বড় করেন। কখনো নিজেদের কষ্ট বুঝতে দেন না। তাঁরা সন্তানের কল্যাণের জন্য সবকিছু উৎসর্গ করেন। অথচ অনেক সন্তানেরা বড় হয়ে সেই কষ্টের মূল্য দেয় না। সেই সময় বাবা মায়েরা নিজেদের মনে যেমন কষ্ট পান, সমাজের অনেক কটু কথাও শুনতে হয়। আর মেয়েদের ক্ষেত্রে তো আরও বেশি। আমাদের কথা ই ধরুন। আমার বাবা মায়ের দুজন মেয়ে। কোনো ছেলে নেই। এই নিয়ে সমাজের নানান লোকের নানান কথা। আমার বাবা মায়ের আফসোস না হলেও তাদের যেন খুব কষ্ট হয়। ছোট থেকেই শুনতাম সবাই বাবা মাকে বলছে, দুই মেয়ে দিয়ে তো জীবন যাবে না। মেয়েরা তো কখনো কামাই রুজি করে খাওয়াতে পারবে না। যত পড়ালেখা করুক না কেন সেই তো পরের বাড়ির চুলায় কাঠি ঘোরাতে হবে। একটা ছেলে প্রয়োজন। ছেলে থাকলে আর কোনো চিন্তা নেই। কিন্তু আমার বাবা মা সবসময় বলতেন, আমাদের মেয়েরাই আমাদের সব। আমাদের দুই মেয়েরাই একদিন আমাদের সুখ শান্তির কারণ হবে। বাবা মা আমার ছোটবেলা থেকেই খুব কষ্ট করতেন। দুই বোনকে খুব আদরে মানুষ করেছেন।
এই পৃথিবীতে আমাদের বাবা মার চেয়ে বেশি কল্যাণকামী কেউ হয় না। মা নিজের জীবন বাজি রেখে সন্তানকে জন্ম দেন, বাবা রাত দিন খেটে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে সন্তানদের বড় করেন। তাঁরা তো কখনোই চাইবেন না যে তাঁদের সন্তানেরা অমঙ্গল হোক। সন্তানরা যেন বিপথে না যায়, তাই তো তাঁরা প্রেম থেকে দূরে রাখতে চান। অনেক ছেলে মেয়েই তো ভুল মানুষের প্রেমে পড়ে অনিষ্ট ডেকে আনে। দেখা যায়, একটা ভুল মানুষের জন্য তারা নিজের বাবা মাকে ছাড়তে পর্যন্ত বাধ্য হয়। এই জিনিসটা সবচেয়ে বেশি হৃদয়বিদারক। এজন্যই বাবা মা সন্তানদের কল্যাণার্থে এসব প্রেমের সম্পর্ক থেকে দূরে রাখতে চান। আমার বাবা মায়ের ক্ষেত্রেও ভিন্ন হয়নি।
হ্যাঁ আমার ক্ষেত্রে হয়তো একটু বেশিই চাওয়া ছিল। আমার বাবার পছন্দ করা ছেলেকেই আমার বিয়ে করতে হতো। তাঁরা যে জোর করতেন এমন না। তবুও আমি যদি বাবার পছন্দের বিরুদ্ধে গিয়ে অন্য কাউকে পছন্দ করে থাকি তাহলে বাবা হয়তো মনে মনে খুব কষ্ট পেতেন। এজন্য ছোট থেকেই আমার মাথায় এসব প্রেম ভালোবাসার প্রতি ঘোর বিরোধিতা জন্মাতে থাকে। আমাদের সকল আবদার রাখতে যাঁরা সারাজীবন বিলিয়ে দেন, তাঁদের পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করার সামান্য চাওয়া পূরণ করতে পারব না? আর বাবা মা তো কখনো খারাপ চাইবেন না। নিশ্চয়ই ভালো ছেলের সাথে বিয়ে দিবেন। এসব নিয়ে ছোট থেকেই মাইন্ড সেট ছিল যে আমি প্রেম করব না।
এছাড়া আরেকটা বিষয় হচ্ছে, আমি যদি কাউকে ভালোবেসেও ফেলতাম, আর তাকে যদি আমার বাবা মা মেনে না নিতেন তখন আমি নিজেই বিপর্যয়ে পড়ে যেতাম। আমার বাবা মাকে আমি কখনোই কষ্ট দেওয়ার কথা ভাবতেও পারি না। আল্লাহর কাছে দোয়া করতাম যেন আমি বাবা মাকে কষ্ট দিয়েছি, এমন দিন যেন কখনো না দেখান। এই ক্ষেত্রে আমি বাবা মার কথা চিন্তা করে হয়তো ছেলেটাকে ছাড়ার কথা ভাবতাম। কিন্তু সে যদি আমাকে সত্যি সত্যি ভালোবেসে থাকতো, তাহলে কি সে বিনাদোষে শাস্তি পেত না? তার সাথেও প্রতারণা করা হতো। কারও মন ভেঙে আমি নিজেও কখনো সুখী হতে পারতাম। আর ধর্মীয় বিষয় তো রয়েছেই। বিয়ে পূর্ববর্তী প্রেম হারাম। তাই সবগুলো কারণ মিলিয়ে আমি সবসময় লাভ আফটার ম্যারেজে বিশ্বাসী।
যদি প্রশ্ন করেন, এখন কাউকে ভালোবাসি কিনা, তাহলে উত্তরটা হবে জানি না। হ্যাঁ আমি সত্যিই জানি না আমি ভালোবাসি কিনা। তবে আমার এই একান্ত ব্যক্তিগত মানুষটার সাথে অবিচ্ছেদ্য মায়ায় পড়ে গেছি। অনুরক্তির সম্পৃক্ততাই আমি আমাকে ভাবতে গেলেই তাকে মনে পড়ে।’
চলবে….
#হৃদয়গ্রাহী
#পর্ব_১৫
#সারিফা তাহরিম
‘যদি প্রশ্ন করেন, এখন কাউকে ভালোবাসি কিনা, তাহলে উত্তরটা হবে জানি না। হ্যাঁ আমি সত্যিই জানি না আমি ভালোবাসি কিনা। তবে আমার এই একান্ত ব্যক্তিগত মানুষটার সাথে অবিচ্ছেদ্য মায়ায় পড়ে গেছি। অনুরক্তির সম্পৃক্ততাই আমি আমাকে ভাবতে গেলেই তাকে মনে পড়ে।’
একনাগাড়ে কথাগুলো বলে থামলো পূর্ণতা। ছোটকাল থেকে এই মনোভাব পোষণ করে আসছে সে। প্রেমে না জড়ানোর প্রতিজ্ঞায় দৃঢ়ভাবে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল। মিফতা আর দিনা ছাড়া আর কেউ পূর্ণতার এই মনোভাব সম্পর্কে তেমন জানে না। মূলত পূর্ণতাই বলেনি কাউকে। আজ অনেকদিন পরে কথাগুলো আবারও কাউকে মন খুলে বলেছে। মানুষটা যে তার খুব আপন! তার সাথে মন খুলে কথা বলতেও এক প্রকার শান্তি কাজ করে। অরিত্র শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত খুব মনোযোগ দিয়ে পূর্ণতার কথা শুনলো। এই বিষয়টা অবশ্য নতুন না। অরিত্র সবসময়ই তার প্রতিটা কথা মনোযোগ সহকারে শুনে। তাই এই মানুষটার কাছে সব কথা বলে পূর্ণতা তৃপ্তি বোধ করে। এই মুহূর্তে পূর্ণতার কথা শুনে অরিত্রের মনেও প্রশান্তি বয়ে গেল। ভালো লাগার শীতলতা খানিকটা গ্রাস করল তাকে। চোখ বন্ধ করে প্রাণখোলা শ্বাস ফেলল। তারপর পূর্ণতার দিকে চেয়ে বলল,
‘আজকালকার ছেলে মেয়েরা উন্নত বা স্মার্টনেস বলতে প্রেমকে সমর্থন করাকেই বোঝে বলে মনে করতাম। কিন্তু তুমি আমার ধারণাটা পাল্টে দিলে। আসলে সবাই প্রেমে জড়ালেও এর পরিণতি কি হতে পারে তা নিয়ে খুব একটা ভাবে না। যদ ভাবতো তাহলে এত শত প্রেমঘটিত আত্মহত্যা ঘটত না। বাবা মা কষ্ট পেতেন না। তাদের জীবনটা হয়তো আরও সুন্দর হতো। কিন্তু এত কিছু ভাবার সময় কোথায় তাদের? দিনের পরদিন কোনো কিছু বিবেচনা না করে প্রেম করতে থাকে। এক প্রেমে ব্যর্থ হলে তার বিরহ কাটাতে আরেকটা প্রেমে জড়িয়ে পড়ে। এভাবেই কাটতে থাকে জীবন। এই যুগের মেয়ে হয়েও এতকিছু ভাবো, বিষয়টা সত্যিই প্রশংসনীয়। আমি ভাগ্যবান এমন একজনকে অর্ধাঙ্গিনী হিসেবে পেয়ে।’
অরিত্র একটু থেমে হালকা হেসে বলল,
‘আজকাল বেশ সুন্দর গুছিয়ে কথা বলো দেখছি। কিছু রোমান্টিক কথাবার্তা। আমার তো ভীষণ সন্দেহ হচ্ছে পূর্ণতা। তুমি কি রোমান্টিকতার ট্রেনিং নিচ্ছো নাকি?’
‘কেন আমি বুঝি গুছিয়ে কথা বলতে পারি না?’
‘এক সময় যে রাগে ফোঁপাতে ফোঁপাতে কথাই বলতে পারত না সেই মেয়ে পরবর্তীতে অস্বস্তিতে মুড়িয়ে গেল। লজ্জা আর অস্বস্তিতে গলার স্বর বের হতে ভীষণ কষ্ট হতো। আর বর্তমানে সেই মেয়ে প্রেমময় কথা বলছে, নিজের অনুভূতিগুলোকে জানান দিচ্ছে, বিষয়টা কি আশ্চর্যজনক না?’
‘মোটেও আশ্চর্যজনক না। প্রথম প্রথম আপনার প্রতি একটা অযাচিত রাগ ছিল ঐজন্য কথা বলতে ইচ্ছে করত না। পরে নিজের বোধশক্তি ফিরে পেয়ে যখন নিজের ভুল বুঝতে পারলাম তখন অস্বস্তি হতো আর পরবর্তীতে আপনার কথাবার্তায় লজ্জা পাওয়ার কারণে কথা কম বলতাম। সেই সময় একটা দূরত্ব ছিল। তাই জড়তা কাজ করতো। সময় গড়িয়ে যেতেই দূরত্বটা ঘুচে গেছে। তাই কোনো জড়তা ছাড়াই সব কথা বলতে পারি। বুঝলেন জনাব?’
‘বুঝতে পেরেছি আমার বেগম সাহেবা।’
দুজনেই হাসলো। পূর্ণতা অরিত্রের একটা বাহু জড়িয়ে কাঁধে মাথা এলিয়ে দিল। এই কাঁধটাতে মাথা রাখলে প্রশান্তির ছায়া জেঁকে বসে মনে। একটা অধিকারবোধ কাজ করে। এটা পূর্ণতার নিজস্ব অধিকার! কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর পূর্ণতা বলল,
‘আচ্ছা আপনি তো এখনো আমার সেই প্রশ্নের জবাব দিলেন না।’
‘কোন প্রশ্ন?’
‘আপনি আমাকে চিনেছেন কিভাবে, কবে দেখেছেন? আমি তো আগদের আগে আপনাকে দেখিনি। অবশ্যই মা ছবি দিয়ে গিয়েছিলেন, আমি ইচ্ছে করেই দেখিনি। কিন্তু সরাসরি আপনার সাথে তো দেখা হয়নি। তাহলে কবে দেখেছিলেন আমায়? এই প্রশ্নগুলো আপনাকে আগেও করেছি উত্তর দেননি।’
‘সেই এক বিস্তর কাহিনী। এর আগে যখন প্রশ্ন করেছ তখন তোমার মনের অনুভূতি নিয়ে সংশয়ে ছিলাম তুমি কি না কি ভেবে বসো, তাই বলিনি।’
‘এখন তো নিশ্চয়ই কোনো সংশয় নেই। তাহলে এখন বলুন।’
অরিত্র মুচকি হেসে দূর আকাশের দিকে দৃষ্টি রেখে বলা শুরু করল,
‘ঘটনাটা আজ থেকে প্রায় পাঁচ বছর আগের। আমি তখন মাস্টার্স কমপ্লিট করে জবে ঢুকেছি। সেই সুসংবাদটা দেওয়ার জন্য কলেজের সকল স্যারদের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। কলেজের অফিস রুমে সবাই ছিল কিন্তু তোমার বাবা ছিলেন না। আমি আবার উনাকে খুব পছন্দ করতাম। তাই স্যার অর্থাৎ বাবার সাথে দেখা করা ছাড়া যাব না ভেবে ছিলাম। অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করেছিলাম। পরে জানতে পারি, স্যার ডিসি অফিসের কাজে ওখানে গিয়েছেন। কখন আসবেন ঠিক বলতে পারছিলেন না কেউ। তাই হতাশ হয়ে ফিরে আসছিলাম। ভেবেছিলাম পরেরদিন এসে দেখা করে যাব। তাই নিচে নেমে এলাম।
তখন ছিল গ্রীষ্মের কাঠফাঁটা গরম। কিন্তু আকস্মিক চারপাশ আঁধার হয়ে ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়। ঝড়ো হাওয়া বয়ে যাচ্ছিল চারপাশে। সারাদিন বৃষ্টির কোনো আলামত ছিল না বলে সাথে করে ছাতাও নেইনি সেদিন। অগত্যা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল বৃষ্টি থামার অপেক্ষায়। কিন্তু সেই যে বৃষ্টি! থামার কোনো নামই ছিল না। খুব বিরক্ত হচ্ছিলাম। সারাদিন খাটাখাটুনির পরে দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছিল ভীষণ। কিন্তু পরক্ষণের ঘটনায় মনে হলো আল্লাহ বোধহয় এক অদ্ভুত অনুভূতির সাথে সাক্ষাৎ করানোর জন্য আমায় অপেক্ষা করাচ্ছিলেন। মাঠের বাম পাশের রাস্তা থেকে ছাতা হাতে একটা মেয়েকে খুব সাবধানে এগিয়ে আসতে দেখা যাচ্ছিল। তার পরণে ছিল লাল সেলোয়ার কামিজ। মাথায় ওড়না দিয়ে ছাতাটা নিয়ে এগিয়ে আসছিল সে। ঝুম বৃষ্টির দাপটে ছাতাটা ধরে রাখা সেই শুকনো মেয়েটির পক্ষে কষ্ট হয়ে যাচ্ছিল ভীষণ। কিন্তু সে থেমে না থেকে যত দ্রুত সম্ভব কলেজের দিকে এগিয়ে আসছিল। হ্যাঁ, মেয়েটা আর কেউ না। আমার হৃদয়াক্ষী। মেয়েটাকে দেখে সারাদিনের ক্লান্তি নিবারণ হয়ে অদ্ভুত শিহরণ হয়েছিল। লাল ওড়নায় জড়িয়ে থাকা চিন্তার রেখা টানা আধভেজা শুভ্র মুখটুকু দেখে এক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়েছিলাম। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম। একজন ব্যক্তি যে মেয়েটাকে এত গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে সেটা সে বিন্দুমাত্র আঁচ করতে পারেনি। সে কলেজ ভবনে ঢুকে ছাতা বন্ধ করে তড়িৎ গতিতে আমাকে এড়িয়ে দপ্তরি খালার কাছে যেতেই আমার ধ্যান ভাঙলো। নিজের কর্মকাণ্ডে নিজে অবাক হয়ে খানিকটা শাসিয়েছিলাম নিজেকে। কিন্তু তেমন একটা লাভ হয়নি। আবারও মেয়েটাকে দেখার জন্য অবাধ্য চোখজোড়া পিছু ফিরে চাইলো। মেয়েটা ভীষণ চিন্তিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
‘খালা লেকচারার মঈনুল হাসান স্যারকে দেখেছেন? কোথায় আছেন উনি?’
‘না উনারে তো দেহি নাই। তয় মনে অয় দুই তালার স্যারেগো রুমে থাইকতে পারে। আফনে কেডা?’
মেয়েটা খালার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে তাড়াহুড়ো করে দৌঁড়ে দ্বিতীয় তলার দিকে পা বাড়াল। আমারও কৌতুহলের মাত্রা বাড়ল। মঈনুল হাসান স্যারের সাথে মেয়েটার এত জরুরি কাজ কিসের? কে হয় সে? এত চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন? রহস্য উদঘাটনের উদ্দেশ্যে আমিও তার পিছু পিছু দ্বিতীয় তলায় গেলাম। মেয়েটা অনুমতি চেয়ে অফিস রুমে ঢুকল। আনার কি হয়েছিল জানি না। কারও কথা লুকিয়ে শোনার অভ্যাস আমার কোনো কালেই ছিল না। কিন্তু সেদিন হুট করেই বাচ্চামি করে বসলাম। আমি অফিস রুমে না ঢুকে এক পাশে আড়ালে দাঁড়িয়ে রইলাম কথা শোনার উদ্দেশ্যে। মেয়েটা ক্লাসে ঢোকার পর সালাম দিতেই একজন স্যার সালামের উত্তর দিয়ে বললেন,
‘আরে তুমি পূর্ণতা না? আমাদের মঈনুল স্যারের বড় মেয়ে? তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন মা? কিছু হয়েছে?’
এবার আবারও মেয়েটার গলা শোনা গেল। সে বলল,
‘আঙ্কেল সকাল থেকে আমার বোনের ভীষণ জ্বর উঠেছে। স্কুল থেকে এসেই বিছানায় চোখ বুজে শুয়ে আছে। কিছুক্ষণ আগে মা হুট করে মাথা ঘুরিয়ে পড়ে গেছেন। প্রেশারটা মেপে দেখলাম, অনেক হাই। আম্মুর নাকি খারাপ লাগছে। বাবাকে ফোন করছি কিন্তু বাবার ফোন বন্ধ। এই ঝড়ের মুহূর্তে কোনো ডাক্তার পাওয়া যাবে না, আমারও আশেপাশে কোনো ফার্মেসি চেনা নেই। পাশের বাসায় শুধু একজন দাদু আছেন বাকিরা বাড়িতেই নেই। সেই দাদুকে মায়ের কাছে রেখে আমি এখানে এসেছি বাবার খোঁজে। আমার বাবা কোথায় আঙ্কেল?’
কথাগুলো বলতে বলতে মেয়েটা কান্না করে দেয়। খুব মায়া হচ্ছিল মেয়েটার জন্য। তখনই একজন ম্যাডাম বললেন,
‘তোমার বাবা তো ডিসি অফিসে গিয়েছেন। দাঁড়াও আমরা ডিসি অফিসে যোগাযোগ করছি। তুমি কান্না কোরো না।’
কিছুক্ষণ মেয়েটার হালকা হালকা কান্নার শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ পাওয়া গেল না। খানিকক্ষন পর সেই ম্যাডাম বললেন,
‘তোমার বাবা মিটিং এ ছিলেন আর ফোনের চার্জ শেষ হওয়ায় যোগাযোগ করতে পারেননি। আমি বিষয়টি জানানোতে তিনি এখনই আসছেন বলে জানিয়েছেন। তুমি চিন্তা করবে না। সব ঠিক হয়ে যাবে। চলো আমি তোমায় বাসায় নিয়ে যাচ্ছি। দপ্তরী রাসেলকে দিয়ে একজন ডাক্তার ডাকিয়ে নিলে হবে।’
ম্যাডামের কথা শুনে আমি নিজেও আশ্বস্ত হয়েছিলাম। ছোট মেয়েটার মনে কত ঝড় চলছিল কে জানে! আমার নিজেরই তো ঘটনাটা শুনে বেশ অস্থির লাগছিল। আমি এবার ধীর পায়ে নিচে নেমে আগের জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালাম। যেহেতু ম্যাডাম আর সেই মেয়েটি আমাকে দ্বিতীয় তলায় খেয়াল না করে। মেয়েটা বের হওয়ার সময় কান্না না করলেও হালকা হালকা ফোপাচ্ছিল। মূলত কান্নার রেশ ছিল ওটা। পারলে আমি নিজেই তাকে সাহায্য করতে যেতাম। কিন্তু এমন অপরিচিত কারো কাছ থেকে সাহায্য তো নিবে না বরং ভয় পেয়ে যেতে পারে। তাই আর যাইনি। আমি আরেকটাবারের মতো মেয়েটার চেহারা দেখতে পেলাম। কান্না করার কারণে টানা চোখগুলো লাল হয়ে গিয়েছিল। পুরো মুখ আর নাক হালকা ফুলে একদম লাল হয়ে উঠেছিল। শুভ্র রঙের মুখ আর লাল রঙের ছাপ, দুই মিলিয়ে পুরো বউ বউ লাগছিল তাকে।
অন্যকেউ হয়তো প্রেমের প্রস্তাব দিত বা একটু কথা বলতে চাইতো, কিন্তু আমার মনে কেন জানি তাকে আমার অর্ধাঙ্গিনী করার ইচ্ছে জেঁকে বসল। আল্লাহর কাছে আমি কখনো তাকে আমার প্রেমিকা হিসেবে চাইনি, সবসময় আমার বউ হিসেবে চেয়েছিলাম। আর সবশেষে আমি তাকে পেয়েছি। প্রথমবারই একবার খুব গভীরভাবে তাকিয়েছিলাম তার দিকে। একদম হৃদয়ের আঁখি দিয়ে। তাই তো মেয়েটি আমার ‘হৃদয়াক্ষী’।
চলবে…