#হৃদয়াবেগ
#পর্বঃ০২,০৩
#রূপন্তি_রাহমান (ছদ্মনাম)
০২
মায়ের কথা শুনে তপ্ত শ্বাস ফেলল তাহমিদ।
‘এসব কথা বলে কি আর কোনো লাভ আছে? যা হওয়ার তো হয়েই গিয়েছে।’
ছেলের কথা শুনে থমকালেন ওয়াহিদা।
‘তার মানে কি তোর মতামত না নিয়ে আমরা আমাদের সিদ্ধান্ত তোর উপর চাপিয়ে দিয়েছি? তোর নিশ্চয়ই কোনো পছন্দ আছে, তাই না?’
মায়ের কথায় স্মিত হাসলো তাহমিদ। মায়ের হাত থেকে বিরিয়ানির বক্সটা নিয়ে মাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরলো।
‘নাতো আমার কোনো পছন্দ আছে আর না তোমরা তোমাদের মতামত আমার উপর চাপিয়ে দিয়েছো। আসলে আমি বিয়ের জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত ছিলাম না। সেটেল্ড হয়ে নিজেকে একটু গুছিয়ে তারপর এসব নিয়ে ভাবতাম আমি। বিয়ে তো আর ছেলেখেলা না। অনেক বড় দায়িত্ব। একটা মেয়ের বাবার পরে দায়িত্বটা কিন্তু তার স্বামীর কাঁধে এসে পড়ে। আর তোমার যে ভাইঝি মাশা-আল্লাহ। আল্লাহ রক্ষা করো। সে যতই ওই বাড়ি থাকুক না কেন ঢাকা গিয়ে কিন্তু আমায় টেনশনে থাকতে হবে। কারণ সে আমার স্ত্রী। তিন কবুল বলে তাকে আমি গ্রহণ করেছি। কখন কি করে বসে সেই আতংকে থাকতে হবে আমায়। সে যে কবে ম্যাচিউরড হবে আল্লাহ জানে।’
‘বড় ছেলে বিয়ে করতে চায় না। তাকে জোর করে বিয়ে দিলে। এইদিকে তোমার ১৯ বছর বয়সী ছোট ছেলে বিয়ের জন্য মরিয়া হয়ে আছে সেদিকে কি তোমাদের কোনো নজর আছে?’ দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে হামি দিতে দিতে বললো তাহমিদ এর ছোট ভাই ফাহিম।
ফাহিম এডমিশন ক্যান্ডিডেট। ভাইয়ের আকদ এর জন্য বাড়িতে এসেছে। সেও তার ভাইয়ের সাথেই ঢাকা থাকে।
ফাহিম এর কথায় ভ্রুকুঞ্চন করে তাকায় ওয়াহিদা।
‘মাত্র এইচএসসি দিলি। এখনো ভার্সিটিতে এডমিশন নিলি না। এখনি বিয়ে? এই তোর বিয়ের বয়স হয়েছে?’
‘ওহ্ মা একটু আপডেট হও। আমার বয়সী অনেক ছেলে এক বাচ্চার বাপ হয়ে গেছে। আর আমি? বইয়ের সাথে সংসার করছি। জীবনটা ভাজা ভাজা।’
ওয়াহিদা দাঁত কিড়মিড় করে বলে,
‘ আমার বাথরুমের স্যান্ডেল জোড়া কইরে?’
‘ভাইয়া আমি নিচে আছি। তুমি তাড়াতাড়ি এসো।এই সাতসকালে জু’তার বারি খাওয়ার কোনো শখ নাই আমার।’ দৌড়ে বাড়ির বাইরে চলে গেলো ফাহিম।
মা আর ভাইয়ের কান্ডে শব্দ করে হাসলো তাহমিদ।
‘মা ছাড়ো তো ওর কথা। দাদি কি এখনো ঘুমোচ্ছে? আর বাবা?’
‘তোর দাদি রাতে ঘুমের ঔষধ খেয়ে ঘুমিয়েছে। শেষ রাত অব্দি ছটফট করছেন। আর তোর বাবা ফজরের নামাজে গিয়েছে। এখনো আসেনি।’
‘তাহলে তো বাবার সাথে আর দেখা হবে না। এখন বের না হলে প্রথম শিফটের বাসে উঠতে পারবো না। আর আমি ঢাকা পৌঁছে দাদির সাথে কথা বলে নিবো।’
ওয়াহিদা দোয়া পড়ে ছেলের গায়ে ফু দিলেন।
‘সাবধানে যাবি বাবা। আর ওই বাঁদরটাকেও দেখেশুনে রাখিস। আল্লাহ আল্লাহ করে বেরিয়ে পড়।’
কিছু পথ এগিয়ে গিয়েও তাহমিদ ওর মাকে পিছু ফিরে ডাকলো। ছেলের ডাকে তাকালো ওয়াহিদা।
‘কিছু বলবি বাবা?’
‘তোমার ভাইঝিকে নিজের যত্ন নিতে বলো। আর মন দিয়ে যেন পড়াশোনা করে। পাড়ার বাচ্চাদের সাথে খেলতে গিয়ে নিজের পড়াশোনার ক্ষতি না করে বসে।’
আর দাঁড়ালো না তাহমিদ হনহনিয়ে বাড়ির বাইরে চলে গেলো। ওয়াহিদা ছেলের এমন সুপ্ত অস্থিরতা দেখে নিঃশব্দে হাসলো।
____________________________________________
নাযীফাহ এবং তাহমিদের বিয়ের দু’দিন পার হয়ে গেছে। কোচিং সেন্টারে ক্লাস শেষ করে বাসায় যাবে তাহমিদ। আকাশে মেঘ ডাকছে। চারপাশ কেমন অন্ধকার হয়ে গেছে। রিক্সার জন্য দাঁড়িয়ে আছে সে। হঠাৎই কেউ একজন বলল,
‘আসসালামু আলাইকুম স্যার। কেমন আছেন?’
‘আরে সাবিহা যে, আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। তুমি কেমন আছো।?’
‘ আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আমি তো ঢাবিতে চান্স পেয়েছি শুনেছেন নিশ্চয়ই?’
‘হুম, আতিফ ভাই বললো।আমাদের কোচিং সেন্টার থেকে অনেকেই চান্স পেয়েছে। চান্স পেয়েছো বলে বসে থাকলে হবে না মন দিয়ে পড়াশোনা করো।’
সাবিহা ব্যাগ হাতরে কিছু একটা বের করলো। তারপর তাহমিদের দিকে বাড়িয়ে দিলো সেটা।
‘ এটা আপনার জন্য স্যার। আপনি এভাবে গাইড না করলে কখনো এটা সম্ভব হতো না। তাই আমার তরফ থেকে ছোট্ট উপহার।’
‘এসবের দরকার ছিল না সাবিহা। তুমি মন দিয়ে পড়াশোনা করেছ। সে অনুযায়ী ফল পেয়েছো।’
‘উপহারটা নিলে আমি খুব খুশি হবো স্যার।’
অগত্যা তাহমিদ সাবিহার হাত থেকে গিফট বক্সটা নিলো। একটা রিক্সা আসতেই দ্রুত উঠে পড়লো।রিক্সায়। তাহমিদের যাওয়ার পানে তাকিয়ে আছে সাবিহা। সাবিহার সাথে থাকা মেয়েটি জিজ্ঞেস করলো,
‘এটাই কি তোর সেই ক্রাশ?’
জবাবে মাথা নাড়লো সে। মেয়েটি পুনরায় বলল,
‘ কি এটিটিউড। আমার দিকে তাকলো না পর্যন্ত। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মনের কথা বলে দে। না হলে এই এটিটিউড কিং কে অন্য কেউ নিয়ে যাবে।’
সাবিহা হেসে জবাব দিলো,
‘কেউ নিবে না। উনার কারো সাথে কোনো সম্পর্ক নেই। মেয়েদের দিকেও ভালো করে তাকায় না।’
‘তাহলে বলছিস না কেন?’
‘এখন নিজের মনের কথা প্রকাশ করলে বলবে এগুলো আমার আবেগ। তাই অপেক্ষা করছি সঠিক সময়ের।’
____________________________________________
জানালা কিঞ্চিৎ ফাঁক করে ঝড়ের তান্ডব দেখছে নাযীফাহ। বজ্রপাতের আওয়াজে কেঁপে কেঁপে উঠছে সে। হঠাৎই কিছু একটার কথা মনে পড়তেই দৌড় লাগালো সদর দরজার দিকে। বসার ঘরে নকশিকাঁথায় ফুল করছিলো নাযীফাহ’র মা ফাহমিদা। মেয়ের এমন দৌড় দেখে ভ্রু কুঁচালেন তিনি। নাযীফাহকে দরজার ছিটকিনি খুলতে দেখে দৌড়ে গেলেন মেয়ের কাছে।
‘নাযীফাহ এই ঝড়ের মধ্যে তোমাকে ভিজতে হবে না। সব সময় পাগলামি করে না।’
‘আমি বৃষ্টিতে ভিজবো না মা।’
‘বৃষ্টিতে ভিজবে না তাহলে বাইরের দিকে ছুটছো কেন?’
রান্নাঘরের সামনে বিলম্বো গাছে ঘুঘু পাখির বাসা। দু’টো বাচ্চা আছে। আমি ওগুলো নিয়ে চলে আসবো। নাহলে এই ঝড়ের মাঝে পাখির বাচ্চা দুইটা ম’রে যাবে মা।’
মেয়ের এমন কথায় তেতে উঠলেন ফাহমিদা বেগম। চোখ রাঙানি দিয়ে বলেন,
‘সব সময় তোমাকে পাগলামি করতে হবে। বাইরে ঝড় হচ্ছে। বজ্রপাতের শব্দে ঘরে থেকেও ভেতর কেঁপে উঠছে। আর তুমি বাইরে যাবে। যাও নিজের রুমে যাও।নাহলে তোমার বাবাকে ডাকবো।’
মন খারাপ করে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো সে। প্রায় ঘন্টা খানিক তান্ডবের পরে ঝড় থামলো। প্রকৃতি তার ভয়ংকর রূপ দেখিয়ে ধীরে ধীরে শান্ত হতে শুরু করেছে। ঝড় থামতেই নাযীফাহ একছুটে ঘর থেকে বের হলো। রান্নাঘরের সামনে গিয়ে হাঁপাতে শুরু করলো সে। বিলম্বো গাছের নিচে তাকাতেই কান্না করার উপক্রম হলো তার। পাখির বাসাটা উল্টে নিচে পড়ে আছে। পাশেই মা পাখিটার নিথর প্রাণহীন দেহ পড়ে আছে। মা পাখিটা চাইলেই উড়ে যেতে পারতো। সন্তানের মায়ায় এখানেই থেকে গেছে। মা বুঝি এমনই হয়। নাযীফাহ যতই বাঁদরামি করুক না কেন পশুপাখি কে কখনো কষ্ট দেয় না।
পাখির জন্য মন খারাপ করে সেদিন আর কারো সাথে কথা বলেনি নাযীফাহ।
____________________________________________
গিফটের বক্সটাকে অবহেলায় খাটের এককোণে রাখল তাহমিদ। ধূলোবালিময় ক্লান্ত দেহটা নিয়ে ওয়াশরুমে গেলো।শাওয়ার নিয়ে বাইরে আসতেই দেখতে পেলো ফাহিম গিফট বক্সের রেপিং পেপার খুলছে। সেসবে পাত্তা দিলো তাহমিদ। বক্সটা খুলেই ফাহিম বলল,
‘ওয়াও ব্র্যান্ডেড ওয়াচ। কে দিলো ভাইয়া?’
‘স্টুডেন্ট।’
‘কি উপলক্ষে?’
‘ঢাবিতে চান্স পেয়েছে তাই।’
‘যাই বলো ভাইয়া চয়েসটা কিন্তু সেই।’
‘তোর ভালো লাগলে তুই রেখে দে।’
‘তোমার স্টুডেন্ট তোমাকে গিফট করেছে৷ আমি কেন নিবো?’
তাহমিদ বিড়বিড় করে বলে,
‘শিক্ষক হিসেবে দিয়েছে নাকি অন্য কিছু হিসেবে দিয়েছে আমি ভালো করেই জানি। মানুষের চোখ দেখলে বোঝা যায়। এতটুকু বোঝার ক্ষমতা আমার হয়েছে।’
ফাহিম ভ্রুকুটি করে বলে,
‘কিছু বললে ভাইয়া?’
দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাহমিদ বললো,
‘আমি ঘড়ি হাতে দেই না তুই রেখে দে।’
____________________________________________
ঘনিয়ে এলো নাযীফাহ’র এসএসসি পরীক্ষা। হাতে গুনে আর মাত্র চার দিন। আজ অংক প্রাইভেটে স্যার বুঝিয়ে দিয়েছেন কিভাবে ওএমআর শিট পূরণ করতে হবে, কিভাবে লিখতে হবে। প্রাইভেট শেষ করে বাড়ি এসে দেখে ফাহিম আর তার দাদি এসেছে। ফাহিমের দাদি আমেনা বেগম নাযীফাহ কে দেখেই ডাকলো। নাযীফাহ নাকমুখ কুঁচকে বলল,
‘তোমার সাথে ঝগড়ার মুড আমার নাই বুড়ি।’
‘কেন কি হয়েছেরে ছুড়ি?’
‘স্কুল জীবন শেষ গো বুড়ি। আমার আর স্কুল থেকে আম চুরি করে খাওয়া হবে না।’
দন্তহীন মুখে আমেনা বেগম বললেন,
‘বেঁচে থাকা আমার সার্থক। এই প্রথম শুনলাম কোনো মেয়ে তার শ্বশুরবাড়ির লোকদের সামনে চুরি করতে পারবে না বলে আফসোস করছে।’
‘যাও তো বুড়ি এজন্য তোমার সাথে আমি কথা বলি না।’
‘এই বুড়ি যখন আর থাকবে না তখন এই বুড়ির মর্ম বুঝবি। বুড়ির জন্য কাঁদবি সারাক্ষণ।’
আমেনা বেগমের কথা শুনে নাযীফাহ্ উনার পাশে গিয়ে বসল।
‘আমি তোমাকে বুড়ি বলে ডাকি, সারাক্ষণ ঝগড়া করি বলে তুমি রাগ করো?’
নাযীফাহ’র মাথায় হাত বুলিয়ে আমেনা বেগম বলেন,
‘রাগ করলে কি আর তোকে নাতবউ করি? তোর সাথে ঝগড়া করতে আমার বেশ লাগে।’
‘তাহলে তুমি ম’রা’র কথা বললে কেন?’
‘আর কত থাকবো? আমার সাথের কেউ আর বেঁচে নেই। তোর দাদা শ্বশুরের জন্য মাঝে মাঝে ভেতরটা হুঁহু করে উঠে। কতদিন দেখিনা সেই মুখ।’
‘দাদা তোমায় খুব ভালোবাসতো?’
দুই পলিথিন চিপস, চানাচুর, চিড়াভাজা চকলেট নাযীফাহ’র কাছে রেখে বলল,
‘দুই পেত্নী আবেগের কথা বাদ দাও। আপা এই যে নেন এগুলো আপনার জামাই জান পাঠাইছে।এগুলো গ্রহণ করে আমাকে উদ্ধার করেন।’
‘বলবো একশোবার বলবো তাতে তোর কি ফাহিম্মা?’
‘পাইলাম না ইজ্জত পাইলাম না। বয়সে বড় হওয়ার পরও তুই করে বলে।’
নাযীফাহ দাঁত কেলিয়ে বলে,
‘সম্মান দিয়ে কথা বলবি ফাহিম্মা। আমি তোর একমাত্র শহুরে বড় ভাইয়ের বউ।’
‘এ্যাহ্ আইছে আমার ভাবি সর সামনের থেকে।’
ফোন বেজে উঠলো ফাহিমের। ফাহিম কিছুক্ষণ কথা বলে ফোন বাড়িয়ে দিলো নাযীফাহ’র দিকে। নাযীফাহ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো ফাহিমের অভিমুখে। ফাহিম চোখের ইশারায় বলল কথা বলার জন্য। কানে ধরে হ্যালো বলতেই ওপাশের কণ্ঠস্বর শুনে হৃদপিণ্ড তড়িৎ গতিতে লাফাতে শুরু করে নাযীফাহ’র।
#চলবে
#হৃদয়াবেগ
#পর্বঃ০৩
#রূপন্তি_রাহমান (ছদ্মনাম)
তাহমিদ কোমল গলায় বলল,
‘নাযীফাহ, কেমন আছিস?’
তাহমিদের এমন কোমল কন্ঠস্বর শুনে দম আটকে আসার উপক্রম নাযীফাহ’র। এপাশ থেকে কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে তাহমিদ আবার বলল,
‘কি হলো উত্তর দিচ্ছিস না যে।’
নাযীফাহ কাঁপা কাঁপা গলায় উত্তর দিলো,
‘ভ্ভভাল।’ জড়তার জন্য আর জিজ্ঞেস করেনি, ‘আপনি কেমন আছেন তাহমিদ ভাই?’
নাযীফাহ’র এমন কাঁপা কাঁপা কন্ঠস্বর শুনে নৈঃশব্দে হাসলো তাহমিদ। তারপর দুইজনই চুপ। কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পরে দুজনের এই নিরবতাকে বিদায় জানালো তাহমিদ।
‘পরীক্ষার তো আর চারদিন বাকি।পরীক্ষার প্রস্তুতি কেমন?’
‘ভভভাল।’
এবার মৃদু শব্দে হাসলো তাহমিদ।
‘শুধু ভালো?’
কোনো উত্তর দিলো না নাযীফাহ। নাযীফাহ’র উত্তর না পেয়ে তপ্ত শ্বাস ফেলল তাহমিদ।
‘ভালো করে পরীক্ষা দিস। খুব মনযোগ দিয়ে পড়বি। তোর অংক আর ইংরেজি পরীক্ষার আগে এসে আমি তোকে অংক আর ইংরেজি পড়াবো। এখন রাখছি।’
তাহমিদ কল কাটতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল নাযীফাহ। এতোক্ষণ যেন সে দম আটকে রেখেছিল।ফাহিমের দিকে তাকাতেই দেখল ফাহিম ওর দিকে ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে আছে। ফাহিমের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে নাযীফাহ বলল,
‘এভাবে তাকিয়ে আছিস ক্যান?’
নাযীফাহ’র হাত থেকে মোবাইল নিয়ে ফাহিম বলল,
‘একটা দস্যি মেয়ের কাঁপা-কাঁপি দেখলাম। ভাগ্যিস ভাইয়ার সাথে তোর বিয়ে হয়েছিলো। নাহলে এই বিরল দৃশ্য আমার দৃষ্টি গোচর হতো না।’
সোফা থেকে একটা কুশন ফাহিমের দিকে ছুড়ে মে’রে নাযীফাহ বলল,
‘শুন ফাহিম্মা তোর ভাইকে আমার সাথে মোবাইলে কথা বলতে নিষেধ করবি। আর একটু হলে আমি দম আটকে ম’রে যেতাম।’
নাযীফাহ’র কথা শুনে ফাহিম শব্দযোগে হাসতে লাগলো।
‘এই চুপ একদম হাসবি না। ঝগরুটে বুড়ি কই গেলো?’
‘দাদি ওয়াশরুমে গেছে।’
দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পরই ফাহিম আর আমেনা বেগম বিদায় নিলো। হাজার বলা সত্বেও থাকেনি।
____________________________________________
যথারীতি নাযীফাহ’র দু’টো পরীক্ষা শেষ হয়ে গিয়েছে। পরশু অংক পরীক্ষা। আজ রাতে তাহমিদ বাড়ি আসবে।
পরদিন সকালে নাযীফাহদের বাড়িতে এসে উপস্থিত হয় তাহমিদ। তাহমিদকে দেখে ফাহমিদা বেগম ব্যস্ত হয়ে পড়ে। একদিন বন্ধ বলে আরামে ঘুম দিয়েছিলো নাযীফাহ। মায়ের মুখে তাহমিদ আসার খবর শুনে একলাফে ঘুম থেকে উঠে। ক্ষনিকের মধ্যে রুম গুছিয়ে ওয়াশরুমে দৌড় দেয়। মেয়ের কান্ড দেখে আহাম্মকের মতো তাকিয়ে থাকেন ফাহমিদা বেগম। তারপর মৃদু হেসে বসার ঘরের দিকে পা বাড়ান তিনি। জামাই আপ্যায়ন করার জন্য নানা পদের রান্না করছেন।খালেদ মোশাররফ একটু পর পর গিয়ে জিজ্ঞেস করছে আর কি লাগবে।
পড়ার টেবিলে বসে আছে তাহমিদ আর নাযীফাহ। তাহমিদ অংক বুঝাচ্ছে আর নাযীফাহ জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। ঘন্টা দুয়েক পড়ার পর তাহমিদ বলল একটু ব্রেক নেওয়ার জন্য। দরজার দিকে এগিয়ে গেলো তাহমিদ। চেয়ারে বসে আছে নাযীফাহ। বহুকষ্টে তাহমিদকে ডাকলে সে।
‘তাহমিদ ভাই?’
পিছন ফিরে তাকালো তাহমিদ। নাযীফাহ এক নিঃশ্বাসে বলল,
‘আপনি আর কখনো আমার সাথে মোবাইলে কথা বলবেন না।’
জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো তাহমিদ। চোখ বন্ধ করে নাযীফাহ বলল,
‘সামনাসামনি থেকে মোবাইলে আপনার কন্ঠস্বর ভয়ংকর লাগে। দম আটকে আসে আমার।’
তাহমিদ নাযীফাহ’র দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলল, ‘অজ্ঞেয় অনুভূতি।’
____________________________________________
ইংরেজি পরীক্ষা অব্দি থাকার কথা থাকলেও দরকারী কাজে তাহমিদকে ঢাকায় ফিরে যেতে হয় নাযীফাহ অংক পরীক্ষার দিন। পরীক্ষা শেষে যখন নাযীফাহ বাড়ি এলো তখন তাহমিদও এই বাড়িতেই ছিলো। ফাইলপত্র রেখে সোফায় চোখ বন্ধ করে গা এলিয়ে দিয়েছিলো সে। হঠাৎ মাথায় কারো স্পর্শ পেয়ে চোখ মেলে তাকায়। চোখের সামনে তাহমিদকে দেখে সোজা হয়ে বসল সে। তাহমিদ ওর মাথায় হাত রেখে বলল,
‘আমাকে এখনই ঢাকা যেতে হবে। বাকি পরীক্ষা গুলোও একটু মন দিয়ে পড়াশোনা করিস। আর নিজের যত্ন নিবি। ঠিকমতো খাবি।’
ঘর থেকে বের হতে নিলে নাযীফাহ বলল,
‘মা বাবার সাথে দেখা করবেন না?’
‘ওনাদের থেকে বিদায় নিয়ে নিয়েছি। তোর অপেক্ষা করছিলাম। আসি আমি।’ মাথা নাড়লো নাযীফাহ। দরজা অব্দি গিয়ে তাহমিদ আবার ডাকলো,
‘নাযীফাহ?’ তার ডাকে নাযীফাহ তাকালো।
‘মোবাইলে কথা বলতে নিষেধ করে এই আমিটার সাথে কোনো একদিন মোবাইলে কথা বলতে মরিয়া না হয়ে যাস।’ বলেই হনহনিয়ে চলে গেলো সে।’
____________________________________________
ফাইলপত্র হাতে একটা অফিসের নিচে দাঁড়িয়ে আছে তাহমিদ। রিক্সা ধরে বাসস্ট্যান্ড অব্দি যেতে হবে। বার বার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে সে। সামনে কোনো মেয়েকে দেখে চমকিত হয় সে।
‘আসসালামু আলাইকুম স্যার।’
‘ওয়ালাইকুমুস সালাম৷ তুমি এখানে কি করছো সাবিহা?’
‘এটা আমার বাবার অফিস স্যার। ইন্টারভিউ দিতে এসেছেন?’
‘হুম।’
‘আপনি বললে আমি বাবার সাথে কথা বলতে পারি। আমার কথা বাবা ফেলবেন না।’
চোখমুখ কঠিন হয়ে এলো তাহমিদের। পরপর কয়েকটা শ্বাস ফেলে নিজেকে স্বাভাবিক করল সে।
‘দেখো সাবিহা চাকরিটা আমি আমার যোগ্যতায় করতে এসেছি। যদি তারা আমাকে যোগ্য মনে করে তাহলে ডাকবে। তাছাড়াও কর্মক্ষেত্রে অভিজ্ঞতারও প্রয়োজন আছে। কারো দয়া নিয়ে চাকরি করতে আসিনি।’
‘স্যার আমি ওভাবে,,,,’
সাবিহার কথা না শুনে চলে গেলো তাহমিদ। রাগে ফুঁসছে সে।
____________________________________________
পরীক্ষা শেষ নাযীফাহ’র। সে এখন মুক্ত পাখির মতো। তার দস্যিপনা আগের থেকে কয়েকগুণ বেড়েছে। এইতো সেদিন ষাঁড়ের তাড়া খেয়ে বাড়ি এসেছে। সব শুনে ওয়াহিদা মানে তাহমিদের মায়ের কি হাসি। গতকাল বিকেলের দিকে মধ্যপাড়ার হাসেম মিয়ার কলা বাগান থেকে নাযীফাহ আর তার গ্যাং একটা কলা ছড়ি চুরি করে এনেছে। রাত পোহাতেই হাসেম মিয়া এসে হাজির। বিচার দিলো খালেদ মোশাররফের কাছে। মাথা নিচু করে রইলেন তিনি। কারন অজানা নয় এসব কাজ তার মেয়ে ছাড়া আর কেউ করবে না। হাসেম মিয়া শাসিয়ে গিয়েছে এতো বড় ধিঙি মেয়ের বিচার যদি খালেদ মোশাররফ না করে তো এর শেষ দেখে ছাড়বে।
উবু হয়ে শুয়ে আচার খাচ্ছিলো নাযীফাহ। ফাহমিদা বেগম তার ঘরে প্রবেশ করেই নাযীফাহ কে একটানে তুলে দুইগালে সপাটে চড় মা’র’লে’ন। হতভম্ব হয়ে গেলো নাযীফাহ।
‘তুই এখনো ছোট? এখনো তোর বাচ্চামো করার বয়স আছে? নাকি তোকে জন্ম দিয়ে ভুল করেছি? যে মানুষটার দিকে কেউ আঙুল তুলতে পারবে না আজ তোর কারণে সেই মানুষকে পাড়ার লোকেরা বাড়ি বয়ে এসে অপমান করে যাচ্ছে। তোর এমন কার্যকলাপে অতিষ্ঠ হয়ে গেছি আমরা।’
গালে হাত দিয়ে মাথা নিচু করে মায়ের কথা শুনছে নাযীফাহ। নিরবে অশ্রুকণা গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে।
‘চুপ করে না থেকে উত্তর দে কেন তুই কলার ছড়ি চুরি করেছিস?’
হেঁচকি তুলে কাঁদছে নাযীফাহ।
‘হাফিজের বড় বোন কুলসুম আপুর বাবু হবে। আপু কাঁচকলার ভর্তা খেতে চেয়েছে। হাফিজ কোথাও কাঁচকলা না পেয়ে হাসেম চাচার কাছে গিয়ে বলতে উনি বললেন, কলা নাকি এখনো ছোট, পরিপূর্ণ হয়নি। আরো অনেক কিছু বলেছে। তাই আজ পুরো কলাগাছটাই উপড়ে দিয়েছি।’
সব শুনে ফাহমিদা বেগম শাসনের সুরে বললেন,
‘এমন পাগলামো এটাই যেন শেষ বার হয়। আর যদি কেউ বিচার নিয়ে আসে তো সেদিনই আমি তোকে জ’বা’ই করবো। ভুললে চলবে বা তুই বিবাহিত। এসব কথা তোর শ্বশুর বাড়িতে গেলে কি হবে ভেবে দেখেছিস? হাজার হউক সে তোর ফুফু।এখন কিন্তু শ্বাশুড়ি।’
____________________________________________
বাসায় এসে রাগে ফাইল ছুড়ে মা’রে তাহমিদ। অধ্যায়নরত ফাহিম ভাইয়ের এমন রাগ দেখে অবাক হয়ে গেলো। সে সচারাচর ভাইকে রাগতে দেখে না। মাথা ঠান্ডা করার জন্য সোজা ওয়াশরুমে চলে গেলো। ঘন্টা খানিকের মাথায় শাওয়ার নিয়ে বের হলো তাহমিদ। তাহমিদ বের হতে ফাহিম জিজ্ঞেস করলো,
‘কি হয়েছে ভাইয়া?’
কোনো উত্তর করলো না তাহমিদ। কপালে হাত ঠেকিয়ে শুয়ে পড়লো। ভাইয়ের এমন নিরবতা দেখে আর ঘাটলো না ফাহিম।
দুইদিন পর তাহমিদকে ডাকলো সেই কোম্পানি থেকে। কারন সে সিলেক্ট হয়েছে। সেখানে গেলো না তাহমিদ। রাতে আরো দুই জায়গায় এপ্লাই করে ফেসবুক স্ক্রল করতে লাগলো সে। একটা আননোন নাম্বার থেকে কল এলো তাহমিদের মোবাইলে। এতরাতে অচেনা নাম্বার থেকে কল আসায় কপালে ভাজ পড়লো তার। কল রিসিভ করে কানে ধরতেই মেয়েলি কন্ঠস্বর ভেসে এলো।
‘আসসালামু আলাইকুম।’
‘ওয়ালাইকুমুস সালাম। কে বলছেন?’
‘আমি সাবিহা স্যার।’
মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে গেলো তাহমিদের। সাবিহাকে বুঝতে না দিয়ে প্রশ্ন করলো,
‘আজ আপনি অফিসে এলেন না কেন স্যার? আমি বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। বলল আপনি নাকি অফিসের কল পেয়েও আসেননি।’
‘আমার ইচ্ছে হয়নি তাই যায়নি। আমি কোথায় চাকরি করবো এটা তো সম্পূর্ণ আমার ইচ্ছে তাই না। এসব নিয়ে আমি তোমাকে কিছু বলতে চাই না।’
‘আসলে স্যার আমি ভেবেছি আমার সেদিনের কথায় আপনি যাননি।’
‘বুঝতেই যখন পারছো আবার জিজ্ঞেস করছো কেন? তোমার বলা কথাগুলোর পরে আমি যতই নিজের যোগ্যতায় চাকরিটা পাই না কেন আমার কাছে মনে হবে তুমি তোমার বাবার কাছে আমার চাকরির কথা বলেছো। আমার যদি যোগ্যতা ইনশাআল্লাহ কোথাও না কোথাও আবার চাকরি হবে, রাখছি।’
বলেই কল কেটে দিলো তাহমিদ। তাহমিদ কল কাটতেই কান মোবাইল নামায় সাবিহা।তারপর বাঁকা হেসে বিড়বিড় করে বলে,
‘আপনার এই আত্মসম্মান বোধের কারনে আপনাকে আমার এতো ভালো লাগে। নিজের মনের কথা বলার অপেক্ষায় রইলাম স্যার। যেন আমার ভালোবাসাকে আবেগ বলে উড়িয়ে দিতে না পারেন।’
____________________________________________
সারাদিন কোচিংএ ক্লাস নিয়ে একটা ইন্টারভিউ দিয়েছে তাহমিদ। সন্ধ্যার পরে আরো দু’টো টিউশন করে বাসায় এসে মাত্রই গা এলিয়ে দিলো সে। ক্লান্তিভাব টা যেন একেবারে জেঁকে বসেছে। মোবাইলের রিংটোনে চোখ মেলে তাকায় সে। নাযীফাহ’র বাবা কল করেছে। রিসিভ করে কানে ধরতেই শুনতে পেলো খালেদ মোশাররফের আহাজারি। নাযীফাহ কে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বিকেলের পর আর কেউ দেখেনি। হৃদস্পন্দন থেমে গেলো তাহমিদের।
#চলবে