হৃদয়াবেগ #পর্বঃ০৬,০৭

0
1376

#হৃদয়াবেগ
#পর্বঃ০৬,০৭
#রূপন্তি_রাহমান (ছদ্মনাম)
০৬

শব্দহীন ভাবে অধর জোড়া প্রসারিত করে তাহমিদ বলল,

‘আমার অর্ধাঙ্গী।’

‘অর্ধাঙ্গী’ ধ্বনিটা শ্রবণ গ্রন্থিতে ধাক্কা দেওয়া মাত্রই উনি চমকিত, স্ফুরিত নয়নে তাকায় তাহমিদের দিকে।

‘বিয়ে করে ফেলেছো?’ হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ে তাহমিদ। নিতুর মা কিছুটা মন খারাপের অভিনয় করে বলে,

‘বিয়ে করে ফেললে অথচ দাওয়াত দিলে না। এটা কিন্তু ঠিক না। আমরা নিরীহ মানুষদেরও তো একটা হক আছে।’

মুখে হাসি বজায় রেখে তাহমিদ বলে,

‘আনুষ্ঠানিকতা কিছুই হয়নি। শুধু আকদ হয়েছে। বিয়ে হয়েছে এতটুকুতেই সীমাবদ্ধ। সংসার জীবনে পা রাখতে বহু দেরি।’

নিতুর মা বিস্মিত হয়ে বলে,

‘তাহলে এখানে নিয়ে এলে যে?’

‘আসলে ভাবি গ্রামে ওর জীবটা হুমকির মুখে আছে। তাই সাথে করে নিয়ে এসেছি। তাই একটু সাহায্যের জন্য এসেছিলাম। আমি বা ফাহিম তো দিনের বেশির ভাগ সময় বাসায় থাকবো না একটু যদি তাদের সময় দিতেন। নিতু গিয়ে নাযীফাহকে সময় দিলেই চলবে।’

নিতু সময় দেওয়ার কথা বলতেই কপালে ভাঁজ পড়ে নিতুর মায়ের।

‘নিতু সময় দিবে? ও তো বাচ্চা মেয়ে।’

নির্বেদ গলায় তাহমিদ বলে,

‘বউ আমার গায়ে গতরে বড় হয়েছে। শিরা উপশিরায় শুধু বাচ্চামি। নিতু গেলে আর কাউকে ওর লাগবে না।গ্রামীণ পরিবেশে বড় হয়েছে তো হঠাৎ করে শহুরে পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে পারবে না। উপরন্তু বাড়ির জন্যও মন খারাপ করবে। নিতু গিয়ে সময় কাটালে ওসব নিয়ে ভাবার সময় পাবে না।’

নিতুর মা প্রশস্ত হেসে জবাব দিলো,

‘সমস্যা নাই নিতুর স্কুল ছুটি হলে তোমার বাসায় পাঠিয়ে দিবো। দরজায় দাঁড়িয়ে কথা বলছো ভেতরে এলে না?’

‘না ভাবি, নিচে যাবো। সবার জন্য নাস্তা আনতে হবে।’

‘আচ্ছা যাও তাহলে।’ নিতুর মা দরজা আঁটকাতে নিলেই তাহমিদ অবিলম্বে বলল,

‘ আরে ভাবি যেটার জন্য এসেছিলাম, একটা বুয়ার ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন? টাকা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।দাদিকে তো রান্না করতে দিবো না। আমার বউ তো বাচ্চা। ও আরো আগে রান্না করবে না। আমিও দিবো না রান্না করতে। দুই একদিনের ভেতরে একজন বুয়ার ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন?’

উনি স্মিত হেসে জবাব দিলেন,

‘তুমি চিন্তা করো না আমার ছুটা বুয়া আসলে আমি জিজ্ঞেস করবো এই ব্যপারে।’

____________________________________________

দুপুরের দিকে ধানি জমি দেখতে গিয়েছিল খালেদ মোশাররফ। বাড়িতে আসার পর শরীর ক্লান্ত থাকায় বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই গভীর নিদ্রায় তলিয়ে গেলেন উনি। ঘুম ভাঙে মেঘের গর্জনে। চোখ মেলে খালেদ মোশাররফ দেখতে পান বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। বক্ষস্থলে মোচড় দিয়ে উঠলো। আজ দু’দিন হলো বাড়িটা একেবারে নিরব। দু’দিন আগেও কেউ একজন খিলখিল করে হাসতো আর আজ? হতাশা মিশ্রিত শ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ান তিনি। দুপুরে খাওয়া হয়নি ঘুমিয়ে ছিলেন বিধায়। নিশ্চয়ই নাযীফাহ’র মাও কিছু খায়নি। হাত মুখ ধুয়ে তিনি বসার ঘরে আসলেন। বসার ঘরে এসেই খালেদ মোশাররফের চোখ ছানাবড়া। ফাহমিদা বেগম এই ঝুম বৃষ্টির মাঝে দরজা খুলে স্থির দৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। বৃষ্টির বিন্দু বিন্দু ফোঁটা ঘরে এসে সব ভিজিয়ে ফেলছে। উনি তড়িৎ গতিতে দরজা বন্ধ করলেন। ফাহমিদা বেগমকে বললেন,

‘নজর কই তোমার ফাহমিদা? ঘরের সব ভিজে গেলো যে।’

ফাহমিদা বেগম বিবশ চক্ষুতে তাকালেন খালেদ মোশাররফের অভিমুখে। আঁখি পল্লবে অশ্রু টলমল করছে। এই আকাশের ন্যায় তার চোখেও বর্ষণ হবে।

‘আজ তো দরজা খুলে বসে ছিলাম। অথচ কেউ এসে অনুনয় করলো না বৃষ্টিতে ভিজবে বলে।কেউ বললো না, ওমা যাই না শুধু পাঁচ মিনিট ভিজবো। ওমা যেতে দাও না। পুরো বাড়িটা খাঁ খাঁ করছে। একটা ফোন দাও না মেয়েটাকে। সামনাসামনি তো দেখতে পারবো না গলার স্বরটাই না হয় শুনি।

খালেদ মোশাররফের অন্তস্তল থেকে নির্গত হলো ভারী শ্বাস। স্ত্রীর পাশে বসে হাতটা মুঠোয় নিয়ে বললেন,

‘মেয়ের জন্যও তো আমারও ভিতর পুড়ছে। কিন্তু কিছু করার নেই। এখন ফোন দিলে মেয়ে কথা বলবে না। অবুঝ মেয়ের অভিমান সম্পর্কে তো জানোই। রাগ পড়লে দেখবে নিজেই ফোন দিবে।’

‘মেয়ের জন্য যে ভিতরটা পুড়ছে।মন যে মানছে না।’

____________________________________________

নিগূঢ়, দুর্ভেদ্য, নিস্তব্ধ নিশি। রাস্তায় সোডিয়ামের হলদেটে আলোয় ঝলমল করছে চারপাশ।মাঝে মাঝে রাস্তার কুকুরগুলো হাঁক ছেড়ে ডাকছে। মাঝরাতে চাপা কান্নার মৃদু শব্দে নিদ্রা হালকা হয়ে আসে আমেনা বেগমের। বয়স হয়েছে তাই ঠাহর করতে পারছেন না। নাযীফাহ’র গায়ে হাত দিতেই অনুভব করলো তার শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। আমেনা বেগম বুঝতে পারলেন মেয়েটা নিঃশব্দে কাঁদছে। হয়তো এই মাঝরাতে মা বাবার কথা খুব মনে পড়ছে। তিনি বার কয়েক ডাকলেন। কোনো সাড়াশব্দ নেই। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মমতার সাথে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। পরক্ষণেই পাশা ফিরে আমেনা বেগমকে ঝাপটে ধরে নাযীফাহ। আমেনা বেগমও সহ্লাদে আগলে নিলেন। কান্নার মাত্রাটা কয়েকগুণ বাড়লো।

‘মা-বাবার কথা কি খুব মনে পড়ছে?’

কোনো জবাব দিলো না নাযীফাহ।

‘তাহমিদ কে বলবো কল দিতে?’ বাঁধন আলগা করে দূরে সরে গেলো নাযীফাহ।

‘আমি আর তাদের সাথে কখনো কথা বলবো না। তাঁরা কেউ আমাকে ভালোবাসে না। ভালোবাসলে কখনো এভাবে এইখানে পাঠাতো না।’

অক্রূর হাসলেন আমেনা বেগম।

‘ভালোবাসে বলেই তো এইখানে পাঠিয়েছে। সন্তানের বিপদের কথা শুনলে কোনো মা-বাবাই স্থির থাকতে পারে না। মনে কর এতেই তোর ভালো।’

নাযীফাহ’র অভিমানী গলা,

‘আমার এমন আদর ভালোবাসার দরকার নাই। যেই ভালোবাসায় বাবা মা কে ছেড়ে দূরে থাকতে হয়।’

কোনো উত্তর করলেন না আমেনা বেগম। এখন যতই বুঝাক না কেন নাযীফাহ কোনো বুঝ মানবে না।

____________________________________________

ক্লান্ত, অবসন্ন, পরিশ্রান্ত অপরাহ্ন। সারাদিনের প্রগাঢ় উষ্ণতার শেষে পরিবেশ একটু একটু করে শীতল হতে শুরু করেছে। পূর্বাভিমুখে আবার একটু একটু মেঘ জমছে। সারাদিনের প্রখর তাপদাহ আর সন্ধ্যা হলেই শুরু হয় ভারী বর্ষণ।

গেইটে প্রবেশ করেই মুখোমুখি হয় তাহমিদ আর নিতুর মা। দুজনেই সৌজন্য হাসলো। মুখে হাসি বহাল রেখেই নিতুর মা বলল,

‘আরে তাহমিদ তোমাকেই খুঁজছি। সময় করেই উঠতে পারছি না দেখা করার জন্য।’

তাহমিদও মুখে হাসি বহাল রেখে জবাব দিলো,

‘ধন্যবাদ ভাবি বুয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য। কিন্তু আমাকে খুঁজছেন কেন ভাবি?’

‘তোমার বউ তো দেখি একেবারে বাচ্চা। তোমার বউ সেদিন নিতুকে বলেছে খেলনা বাটি থাকলে নিয়ে যাওয়ার জন্য। ভাবা যায় তাহমিদের মতো বুঝদার ছেলে একটা বাচ্চা মেয়েকে বিয়ে করেছে।’

তাহমিদ স্মিত হাসলো। আকাশের দিকে আঙ্গুলিসঙ্কেত করে বলে,

‘সব উপরওয়ালার ইচ্ছা। তিনিই জোড়া মিলাইছে। তবে বউ আমার শুধু বাচ্চাই না প্রচন্ড অভিমানীও।’

শব্দযোগে হাসলো দু’জন।

‘তবে তুমি কিন্তু ভাগ্যবান। আজকাল প্রাপ্ত বয়সের মেয়েরা বেশির ভাগই হারাম সম্পর্কে লিপ্ত থাকে। সেক্ষেত্রে তোমার বউ বাচ্চা হয়ে ভালোই হয়েছে। সে যখন একটু একটু করে অনুভূতি বুঝতে শিখবে তার অনুরাগ আর স্পর্শেন্দ্রির শুরুতেই তুমি থাকবে। তার অনুভূতির অন্বেষণটাই হবে তোমাকে দিয়ে। তাকে একটু কেয়ার করবে,যত্ন নিবে, প্রতিকূল পরিবেশ থেকে আগলে রাখবে ব্যস এইটুকুই। কখনো অবহেলা করবে না। নাযীফাহ’র ভিতর বাহির সবখানেই থাকবে তোমার বিচরণ। মাঝে মাঝে বাসায় যাওয়ার আগে কিছু ফুল, চকলেট, চুড়ি যেও।এগুলো বেশি দামী না। তুমি যত ওকে কেয়ার করবে ও তত তাড়াতাড়ি অনুভূতির সাথে পরিচিত হবে। সে যখন তোমাকে উচ্ছ্বসিত হয়ে কিছু দেখাতে চাইবে বা বলবে তখন হাজার ব্যস্ত থাকা সত্বেও তার কথা মনযোগ দিয়ে দুই মিনিট শুনবে। মেয়েরা এই জিনিস গুলো খুব করে চায়।’

এতটুকু বলে থামলেন উনি।

‘কি বললাম বুঝতে পেরেছো তো?’

মাথা নাড়ায় তাহমিদ। তারপর উনি সহাস্যে বলেন,

‘তাহলে শুরু করে দাও অদৃশ্য প্রণয়। যে প্রণয় হালাল। আছে শুধু পবিত্রতা আর আল্লাহর রহমত। আচ্ছা যাই তবে।কিছু কেনাকাটা বাকি আছে।’

সামনে এগিয়ে গেলো নিতুর মা।তাহমিদ সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। নিতুর মা কিছুটা পথ এগিয়ে গিয়েও পিছু ফিরে ডাকলো তাহমিদকে।তাহমিদ তাকায় উনার দিকে।

‘অভিমানী মেয়েরা কিন্তু খুব করে ভালবাসতে জানে। এদের ভালোবাসায় কোনো ভেজাল থাকে না।’

____________________________________________

মেয়ের রুমে এসেছে ফাহমিদা। নাযীফাহ ঠিক যেই জায়গাটায় ঘুমাতো সেই জায়গায় এসে শুয়েছেন তিনি।পিছু পিছু নাযীফাহ’র বাবাও এসেছেন। নিরবে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছেন ফাহমিদা বেগম। শিয়রের কাছে গিয়ে বসলেন খালেদ মোশাররফ।

‘তুমি বুঝের মানুষ হয়ে এভাবে কান্না করলে না জানি আমার অবুঝ মেয়েটা কিভাবে কি করছে।’

‘আমার মেয়েরে এনে দাও।আমার অশান্তি লাগে। আমার বুকের ভেতরটা খাঁ খাঁ করে। মনে হয় কত বছর দেখি না।’

‘মেয়েটা মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছে। তারেক সাহেবকে পুলিশ নিয়ে গেছে মানলাম। উনার কোনো চেলা পেলা যে আমার মেয়ের কোনো ক্ষতি করবে না তার কোনো গ্যারান্টি দিতে পারবে? এর চেয়ে ভালো মেয়েটা দূরে থাক। অন্তত অক্ষত, অনাহত তো থাকবে।’

স্তব্ধতায় আচ্ছন্ন হয়ে গেলো চারপাশ

____________________________________________

বাসায় এসে ফ্রেশ হয়েছে তাহমিদ। আমেনা বেগম ছোট্ট ড্রয়িং রুমটায় বসে তছবিহ জপছে।তোয়ালে দিয়ে মাথার চুল মুছতে মুছতে আমেনা বেগম জিজ্ঞেস করলো নাযীফাহ’র কথা। উনি রুমের দিকে ইশারা করলেন।

দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে তাহমিদ সুস্থির, অচঞ্চল গলায় ডাকল,

‘নাযীফাহ?’

নাযীফাহ’র ভণিতা বিহীন উত্তর,

‘আমার এখানে দম বন্ধ লাগে তাহমিদ ভাই।’

#চলবে

বানান ভুল ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

#হৃদয়াবেগ
#পর্বঃ০৭
#রূপন্তি_রাহমান (ছদ্মনাম)

দিনের ঔজ্বল্যতা কিভাবে ক্ষীনালোকে পরিনত হয় তাই এক মনে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে দেখছিলো নাযীফাহ। তখনই তাহমিদের স্নিগ্ধ শীতল স্বর তার কর্ণকুহরে পৌঁছায়। সম্মুখে চাহনি স্থির রেখে সে বলে,

‘আমার এখানে দম বন্ধ লাগে তাহমিদ ভাই।’

কোনো প্রকার প্রতিক্রিয়া করে না তাহমিদ।খুব সন্তর্পণে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে নাযীফাহ’র পাশ ঘেঁষে দাঁড়ায়। নির্বিকার নাযীফাহ অপলক তাকিয়ে আছে বহির্ভাগে।আর তাহমিদ নির্নিমেষ তাকিয়ে দেখছে নাযীফাহকে।

‘গ্রামে যেতে ইচ্ছে করছে?’

উত্তর দিলো না নাযীফাহ।

‘মামু আর মামির কথা মনে পড়ছে?’ এবারও নিষ্ক্রিয়ভাবে দাঁড়িয়ে রয় সে।

‘মামুর সাথে কথা বলবি কল দিবো?’ বলেই মোবাইল আনার জন্য রুমের দিকে কদম বাড়াতেই আটকায় নাযীফাহ।

‘আমি কারো সাথে কথা বলবো না তাহমিদ ভাই।’

‘তাহলে?’

বিষাদভারাতুর মুখে নাযীফাহ বলে,

‘এই চার দেয়ালের মাঝে নিজেকে কেমন জেলখানার আসামী আসামী মনে হয়।আমি একটু বাইরে গিয়ে প্রাণখোলা নিঃশ্বাস নিতে চাই।’

থমকে যায় তাহমিদ। পুনরায় অগ্রসর হয় নাযীফাহ’র দিকে।পুনশ্চ পাশ ঘেঁষে দাঁড়ালো সে।

‘রাতের ঢাকা শহর দেখবি নাযীফাহ? সোডিয়াম আলোয় ঝলমলে ঢাকা শহর?

____________________________________________

‘দাদি বাইরে ঘুরতে যাবো তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও।’ কথাটা তাহমিদ বলা মাত্র প্রখর দৃষ্টিতে তাকায় আমেনা বেগম। আমেনা বেগমের এমন খর দৃষ্টি দেখে ভরকে যায় তাহমিদ।

‘কি, এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?’

আমেনা বেগমের কাঠকাঠ গলায় বললেন,

‘তোমাদের শরীরে রং থাকলে তোমরা যাও। আমি এখানেই ঠিক আছি। তোমাদের সাথে ঘুরতে যাই আর সেদিনের মতো আমার নামাজ কাযা হউক।’

‘আরে দাদি এশার নামাজের সময় তো বেশি থাকে।’

‘থাকুক তারপরও আমি যাবো না।’

হাজার বার বলার পরও যেতে রাজি হলেন না আমেনা বেগম। অগত্যা বাধ্য হয়ে রুমের দিকে পা বাড়ালো সে। রুমে গিয়ে দেখলো ফাহিম মনযোগ দিয়ে পড়ছে।

‘রেডি হয়ে নে নাযীফাহ আর তোকে নিয়ে বাইরে ঘুরতে যাবো।’

বইয়ের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে ফাহিম বলে,

‘দাদি যাবে না?’

‘না। তার নামাজ কাযা হয়ে যাবে।’

‘এশার নামাজও কাযা হয়ে যাবে?’

‘হুম।’

‘তাহলে আমিও যাবো না।দাদিকে বাসায় একা রেখে যাওয়া ঠিক হবে না। তাছাড়াও একটা দামড়া ছেলে আর একটা অবুঝ শিশুর কেমিস্ট্রির শুরুতে আমি বাঁধা দিতে চাই না।’

চোখ গরম করে তাকায় তাহমিদ। ফাহিম ভয় পাওয়ার অভিনয় করে বলে,

‘এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? আমার ভয় করে তো। এই দেখো আমি ভয়ে কাঁপছি।’

তাহমিদ কিছু না বলে চলে যায় রেডি হতে।

____________________________________________

কোলাহলপূর্ন ঢাকা শহর। যে যার মতো হেঁটে যাচ্ছে। কারো দিকে কারো নজর নেই।চারপাশের দোকান থেকে আসা বাহারি রঙের আলোর সাথে সোডিয়ামের আলোয় মোটামুটি সব কিছুই স্পষ্ট। ফাঁকা জায়গায় ফুচকার স্টল, আবার কেউ কেউ পিয়াজু, আলুর আরো নানারকম ভাজাপোড়া বিক্রি করছে। ফুটপাত ধরে হাঁটছে তাহমিদ। তার এক পেছনে নাযীফাহ। নাযীফাহ ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক ওদিক সবকিছু দেখছে।ওয়েস্টার্ন পড়া কাউকে দেখলে বা হাতে হাত রেখে হাঁটতে থাকা কোনো কাপল দেখলে কপাল কুঁচকাচ্ছে। যেন পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট দৃশ্য এটা। হাঁটা থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে তাহমিদ। কপাল কুঁচকায় নাযীফাহ। তাহমিদ পিছনে ফিরে বলে,

‘এতো পিছনে হাঁটছিস কেন? হারিয়ে যাবি তো।’

তারপর নাযীফাহ’র অগোচরে বিড়বিড় করে বলে,

‘আমার একমাত্র শিশু বউ। হারিয়ে গেলে পাবো কোথায়?

দু’কদম এগিয়ে এসে তাহমিদ এর সমান সমান হয়ে দাঁড়ায় সে।

‘মাত্রই এক হাত পিছনে। এতো পিছনে কই হাঁটলাম?’

তাহমিদ অকস্মাৎ নাযীফাহ’র হাত নিজের হাতের মুঠোয় বন্দি করে।বিস্মিত, স্তম্ভিত, চমকিত নাযীফাহ। শিউরে ওঠে তার শরীর। বিস্ফোরিত নয়নে একবার মুঠোবন্দি হাতের দিকে আর একবার তাহমিদের দিকে তাকায়।

‘আব,,,,,,।’

তাহমিদ কোনো তোয়াক্কা না করে বলল,

‘নে এইবার হাটঁ। এইবার আর হারিয়ে যাওয়ার ভয় নেই। না হলে তোকে ছেলেধরা নিয়ে যাবে।’

ছেলেধরার কথা শুনে ভয়ে সিটিয়ে গেলো নাযীফাহ। ছোটবেলা থেকেই তার ছেলেধরাকে ভয় লাগে। এটাই অবশ্য স্বাভাবিক।

মুখে কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখালেও মনে মনে হাসলো তাহমিদ। সে ইচ্ছে করেই নাযীফাহ’র হাত ধরেছে। সামনে এতো এতো কাপল দেখে তারও ইচ্ছে হলো অর্ধাঙ্গিনীর হাতে হাত রেখে হাঁটতে। এখানে কোনো পাপা নেই। এই স্পর্শ সম্পূর্ণ পবিত্র। মনের অদম্য ইচ্ছেটাকে আর দমিয়ে রাখতে পারলো না। তাই অযুহাতে ধরেই ফেলল অর্ধাঙ্গীর হাত।

তিমিরাচ্ছন্ন, নিষ্প্রভ পথে তাল মিলিয়ে হাঁটছে দু’জন। একজনের মুখে আতংকের ছাপ। আর আরেকজনের মুখে অদৃশ্য ক্রুর হাসি।

‘ফুচকা খাবি?’

বড় করে একটা নিঃশ্বাস নিলো নাযীফাহ। না বোধক মাথা নাড়ে সে। বিস্মিত হয়ে তাহমিদ বলে,

‘মেয়েরা তো ফুচকা পাগল আর তুই ফুচকা খাবি না?’

‘কে বলে খাবো না? খাবো তো তবে পরে এখন না। আগে আমাকে একটু মুক্ত হাওয়া গায়ে লাগাতে দিন।মনে হচ্ছে জেলখানা থেকে বের হয়েছি। কতদিন পর বাইরের পরিবেশ দেখলাম। আগে একটু প্রাণখোলা নিঃশ্বাস নেই। আচ্ছা ঢাকা শহরে মানুষ এভাবে বন্দি হয়ে থাকে কিভাবে?’

আবছা, নীহারিকাবেষ্টিত আলোয় নাযীফাহ’র দিকে অপলক তাকিয়ে রইলো তাহমিদ। প্রদোষকালের এই অস্পষ্ট আলোয় অপূর্ব মায়াবী লাগছে নাযীফাহ’র মুখশ্রী। আরো একটা অদম্য ইচ্ছা জাগ্রত হলো তাহমিদের অন্তর্দেশে। নাযীফাহ’র কপালে তার অধর জোড়ার সস্নেহ স্পর্শ দিতে মন চাইলো। হাত ধরার ইচ্ছেটা দমিয়ে রাখতে না পারলেও তার মনের এই সুপ্ত বাসনা না চাইতেও দমিয়ে রাখতে হলো । অকস্মাৎ এমন স্পর্শ করলে তাহমিদ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা মনে পোষণ করবে নাযীফাহ। তার চেয়ে বরং অপেক্ষা করুক এমন একটা সময়ে। যখন নাযীফাহ মরিয়া হয়ে থাকবে তাহমিদের অনুরাগ মিশ্রিত, ভালোবাসাপূর্ণ স্পর্শ পাওয়ার জন্য। সবুরে তো মেওয়া ফলে। আর ধৈর্যের ফল তো বরাবরই মিষ্টি হয়।

‘কি হলো কথা বলছেন না যে?’

তাহমিদ নাযীফাহ’র প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বলল,

‘আমার সাথে রোজ রাতে হাঁটতে বের হবি? তাহলে আর তোর কাছে নিজেকে বন্দি মনে হবে না। আর আশপাশটাও চিনে রাখলি।’

না বোধক মাথা নাড়ে সে। তাহমিদ ভ্রু কুঁচকে বলে,

‘কেন?’

‘কারণ আপনি সারাদিন নিজে পড়াশোনা করে তারপর কোচিং-এ ক্লাস করে ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরেন। ফ্রেশ হয়ে একটু রেস্ট নিয়ে আবার সন্ধ্যায় টিউশন যান। আবার আমাকে নিয়ে বাইরে বের হওয়া আপনার জন্য কষ্টকর হয়ে যাবে।’

তাহমিদের জন্য নাযীফাহ’র এমন উদ্বিগ্নতা দেখে প্রশান্তিতে ছেয়ে গেলো মন। অধর কোণ প্রসারিত হলো তার।

‘ওসব নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না। তুই শুধু সময়মতো রেডি হয়ে থাকবি।’

আবারও নিরবে চলতে শুরু করলো দু’জন। পথিমধ্যে দুইটা কুকুর দেখে তাহমিদের শার্ট খামচে ধরলো নাযীফাহ।অবুঝ অর্ধাঙ্গিনীর ভরসার স্থান হতে পেরে শব্দহীন শান্তিপূর্ণ হাসলো সে।

____________________________________________

রাতের শান্ত পরিবেশকে উপভোগ করতে বের হয়েছে সাবিহা। অপ্রত্যাশিতভাবে তাহমিদকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লো। প্রথমে মনের ভুল ভাবলেও পরে খেয়াল করে দেখলো আসলে তাহমিদ। আর তার পাশে কোনো মেয়েকে দেখে বক্ষস্থলে ছ্যাৎ করে উঠে তার। তার মানে কি স্যার প্রেম করে। চোখের কোণে অশ্রুকণা ভির করতে লাগলো। তারমানে কি মনের কথা বলতে সে দেরি করে ফেলল? আবছা আলোয় মুখ অস্পষ্ট হলেও মেয়েটার দৈহিক গঠনে সাবিহা বুঝতে পারলো মেয়েটা তার থেকেও বয়সে ছোট। তার ধারণা স্যার কখনো এতো ছোট মেয়ের সাথে প্রেম করবে না। ওদের অলক্ষ্যে পিছু নিলো সাবিহা।

প্রায় অনেকক্ষণ যাবৎ হাঁটার পর দু’জন একটা ফুচকা স্টলে গিয়ে বসলো। তাহমিদ ফুচকাওয়ালাকে ডেকে বলল,

‘মামা, এক প্লেট ফুচকা দিয়েন ঝাল ছাড়া।’

কপালে ভাজ পড়লো নাযীফাহ’র। ঝাল ছাড়া ফুচকা খেয়ে আধৌও কোনো টেস্ট পাওয়া যাবে। নাযীফাহ ভ্রু কুঁচকে বলল,

‘ফুচকা ঝাল ছাড়া হলে আমি খাবো না।’

‘ঝাল খাওয়া যাবে না।পেট ব্যথা করবে।’

‘করলে করুক তারপরও আমি খাবো। নতুবা আমি খাবো না।’

তাহমিদ বাধ্য হয়ে ফুচকাওয়ালাকে বলল ঝাল বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য।

‘আপনি খাবেন না ফুচকা?’

তাহমিদ একমনে মোবাইল টিপছিল। নাযীফাহ’র কথায় মাথা তুলে তাকাল সে।তারপর আবার মোবাইলে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বলল,

‘আমি এসব আনহাইজেনিক খাবার খাই না।’

মুখে কিছু না বললেও নাযীফাহ মনে মনে বলল,

‘এ্যাহ্ আসছে আমার স্বাস্থ্য সচেতন লোক।’

তাহমিদের পশ্চাতে দুই হাত দূরে বসেছে সাবিহা।যেন তাকে তাহমিদ দেখতে না পায়। তবে দুইজনের কথা শুনার আপ্রান চেষ্টা করছে সে।

ফুচকা খেয়ে নাজেহাল অবস্থা নাযীফাহ’র। ঝালে চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে। জিহ্বা বের করে হাত দিয়ে বাতাস করছে সে।নাযীফাহ’র দিকে তীক্ষ্ণধার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাহমিদ। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

‘আমি তখন নিষেধ করেছিলাম না এতো ঝাল খাওয়ার জন্য। এখন বোঝ মজা।’

নাযীফাহ একটু জোরে বলল,

‘তাহমিদ ভাই আপনি পরে বকাবকি করেন।আগে আমাকে পানি এনে দেন।’

তাহমিদ দাঁত কটমট করে বলল,

‘তুই এখানেই থাকবি। কেউ কিছু বললে জবাব দিবি না। আমি যাবো আর আসবো।’৷ সম্মতিতে মাথা নাড়ে নাযীফাহ।

‘তাহমিদ ভাই’ এটা শুনে ঠোঁটে হাসি ফুটে সাবিহার। আত্মায় পানি আসলো তার। এতোক্ষণ যেন দমটা আঁটকে ছিলো। পরপর কয়েকটা শ্বাস নিলো। মনে মনে ভাবলো,

‘তার মানে মেয়েটা স্যারের বোন। হয়তো গ্রাম থেকে এসেছে বলে স্যার হাঁটতে বের হয়েছে ওকে নিয়ে।’

তাহমিদের অগোচরে সেখান থেকে চলে এলো সাবিহা। না হলে দেখলে বলবে,

‘পড়াশোনা না করে বাইরে কি করো সাবিহা। পরেও ঘুরতে পারবে। এখন পড়াশোনা করো মন দিয়ে।’

স্যারের গম্ভীর কন্ঠের কথা ভাবতেই হাসি পেলো তার। যাক তার বাইরে বের হওয়া সার্থক হয়েছে। সেদিনের পর অনেকগুলো দিন অতিবাহিত হয়েছে। আর আজ দেখলো। পুলকিত হলো তার মন।

____________________________________________

আমেনা বেগম আর ফাহিমের জন্য চিকেন চাপ আর নানরুটির পার্সেল নিয়েছে তাহমিদ। দুজনেই রিক্সায় বসে। নাযীফাহ আচমকা রিক্সাওয়ালাকে রিক্সা থামাতে বলেই লাফ দিয়ে নেমে গেলো।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here