হৃদয়াবেগ #পর্বঃ০৮,০৯

0
1289

#হৃদয়াবেগ
#পর্বঃ০৮,০৯
#রূপন্তি_রাহমান (ছদ্মনাম)
০৮

একটু একটু করে রাত বাড়তে শুরু করেছে। খাওয়া দাওয়া মাত্রই শেষ করলো তাহমিদ আর নাযীফাহ। ফাহিম আর আমেনা বেগমের জন্য পার্সেল নিয়ে বের হয় রেস্টুরেন্ট থেকে। বাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে রিক্সায় গিয়ে বসতেই নাযীফাহকে বাঁধা দেয় তাহমিদ। ভ্রু কুঞ্চিত হয় নাযীফাহ’র। তাহমিদ নিজে আগে রিক্সায় উঠে বসলো।

‘রিক্সায় মেয়েরা ডানপাশে বসে না। মেয়েদের বামপাশে বসতে হয়। এটা সেইফ জোন।’

নাযীফাহ ঘুরে গিয়ে বামপাশে বসে।নাযীফাহ বসতেই তাহমিদ তার একহাত দিয়ে নাযীফাহকে কটিবন্ধ করে। রিকসাওয়ালা রিক্সার প্যাডেল ঘুরাতেই লোডশেডিং হয়। ক্ষীন আলো আচ্ছাদিত হয়ে যায় প্রগাঢ় তমসাচ্ছন্নে। এই প্রগাঢ় আঁধারে ভয়ে তাহমিদের কটিবন্ধ হাত খামচে ধরে নাযীফাহ। নাযীফাহকে আশ্বস্ত করে তাহমিদ বলে উঠে,

‘ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমি আছি তো পাশে। এখনই সব দোকানে জেনারেটর চালু করবে।’

কয়েক মিনিটের মাথায় আবারও প্রদীপ্ত হয় চারপাশ। খামচে ধরা হাতের বাঁধন হালকা করে নাযীফাহ। বাসার কাছাকাছি আসতে শীতল হাওয়া বইতে লাগলো। আর উপক্রমণিকা হয় গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির।যে ক্ষুদ্রাকার বারিবিন্দু কায়া স্পর্শক হওয়া মাত্রই অখিল কায়া প্রশান্তিতে ছেয়ে যায়।

‘আপনি রিক্সাটা একটু থামান না?’ নাযীফাহ’র কথায় রিক্সা থেমে যায়। তাহমিদ নাযীফাহ’র উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে রুঢ় দৃষ্টিপাত করে। নাযীফাহ দেখেও না দেখার ভান করলো। তাহমিদের রুঢ় দৃষ্টিকে তোয়াক্কা না করে তাহমিদের হাত সরিয়ে লাফ দিয়ে নেমে পড়ে।

‘বকুনি দিবেন না তাহমিদ ভাই। আজ বহুদিন পরে অভ্রভেদ করা বারিবিন্দু ছুঁয়ে দেওয়ার সুযোগ হয়েছে। মনে হচ্ছে কত বছর পরে বৃষ্টির ফোঁটা আমাকে আলিঙ্গন করছে।’ বলেই এই নিস্তব্ধ, নিঝুম রাতে দু-হাত মেলে বারিবিন্দু নিজের গাত্রে ছোঁয়াতে লাগলো সে।

নাযীফাহ’র এমন উৎফুল্লিত, আনন্দিত, প্রানোচ্ছল মুখশ্রী দেখে কিছু বলার আর সাহস হলো না তাহমিদের। ভাড়া মিটিয়ে নাযীফাহ’র গা ঘেঁষে দাঁড়ালো সে। নাযীফাহ’র কটিদেশ একহাতে স্পর্শ করতে গিয়েও গুটিয়ে নিলো তার হাত। তার মন বলছে, অপেক্ষা কর। অপেক্ষাতেই একপ্রকার শান্তি আছে। সে সামলে নিলো নিজেকে। নাযীফাহ চোখ বন্ধ করে বারিবিন্দু অনুভব করছে।

‘মাঝরাস্তায় এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না। সামনেই বাসা হাঁটতে হাঁটতে বৃষ্টির ফোঁটাকে অনুভব কর।’

চোখ মেলে তাহমিদের দিকে নেত্রপাত করে নাযীফাহ। সামনের দিকে পা ফেলে সে।তাহমিদ ও দু’কদম দিয়ে নাযীফাহ’র সমান সমান হয়ে হাত আঁকড়ে ধরে। কপালে ভাঁজ পড়ে নাযীফাহ’র

‘এখানে হাত ধরেছেন কেন তাহমিদ ভাই? এখন তো হারিয়ে যাওয়ার ভয় নেই।’

উত্তর দিলো না সে। সামনের দিকে তাকিয়ে সোজা হাঁটতে লাগলো।

একজনের মনে এক আকাশ সমান অনুভূতি থাকলেও আরেকজন অনুভূতির ‘অ’ ও টের পাচ্ছে না। বুঝতে পারছে না তার করা এক তাগড়া যুবকের বুকের ভেতরের তোলপাড়। কোনো একদিন আসবে যখন হাতে হাত রেখে হাঁটার প্রতিটা কদমে থাকবে অনুভূতির ছড়াছড়ি। হাঁটা থামিয়ে নাযীফাহ খুব শান্ত, সুস্থির, কাতর গলায় বলল,

‘তাহমিদ ভাই, ফুপি কে একটা ফোন দিবেন?’

‘হঠাৎ মাকে ফোন দিতে বলছিস?’

‘খুব ইচ্ছে করছে কথা বলার জন্য।’

‘মায়ের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে নাকি মামির সাথে।’

নাযীফাহ কপট রাগ দেখিয়ে বলে, ‘আপনি কল দেওয়ার হলে দিন। এতো কথা বলবেন না।’

তাহমিদ স্মিত হেসে ফোন লাগায় মায়ের নাম্বারে। দু’বার রিং হওয়ার পর কল রিসিভ করে ওয়াহিদা।

‘তোমার সাথে কথা বলতে চায় নাযীফাহ।’

ঘুমিয়ে পড়েছিল ওয়াহিদা। নাযীফাহ কথা বলতে চায় শুনে তন্দ্রাভাব কেটে গেলো তার। উৎফুল্ল হয়ে বলে,

‘দাঁড়া, দাঁড়া আমি তোর মামুর বাড়ি আছি। তোর মামিকে ডেকে নিয়ে আসি। ফাহমিদা সেই কবে থেকে মেয়ের গলার স্বর শুনার জন্য আকুল হয়ে আছে।’

তাহমিদ মোবাইল এগিয়ে দিলো নাযীফাহ’র দিকে। নাযীফাহ কানে ধরেই বলে,

‘কেমন আছো ফুপি?’

‘এতোদিন পরে ফুপির কথা মনে পড়লো? ঢাকা গিয়ে তো আমাদের ভুলেই গেছিস?’

মলিন হাসলো নাযীফাহ।

‘বললে না তো কেমন আছো?’

‘আমরা ভালো আছি। তোর মা বাবাও ভালো আছে।’

‘তুমি রাতে খাবার খেয়ে ঔষধ খেয়েছো।’

মুখ টিপে হাসে ওয়াহিদা।

‘রাতে খাওয়ার পর আমার কোনো ঔষধ নেই। তবে তোর বাপ প্রেশারের ঔষধ আর তোর মা খাওয়ার আগে ইনসুলিন নিয়েছে।’

ওয়াহিদার কাছে বসে থাকা নাযীফাহ’র মা এতোদিন পরে মেয়ের গলা শুনতে পেয়ে নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলছেন।

‘তোমাদের কোনো অসুবিধা হচ্ছে না?’

‘আমারও কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। তোর বাবা মায়েরও কোনো অসুবিধা হচ্ছে না।’

‘তুমি বার বার তাদের কথা বলছো কেন? আমি তাদের কথা জিজ্ঞেস করেছি?’

‘না মানে…….

কাঠকাঠ গলায় বললো,

‘তাদের কথা আর বলবে না।’

ওয়াহিদা বাধ্য গলায় বলল,

‘আচ্ছা।’

‘বিচ্ছু বাহিনীর দল আমার খোঁজে আসে?’

ওয়াহিদার বক্ষস্থল থেকে নির্গত হয় দীর্ঘশ্বাস। বড্ড ভারী এই দীর্ঘশ্বাস। কন্ঠে অসহায়ত্ব ফুটিয়ে তুলে বলে,

‘রোজ জিজ্ঞেস করে তোর কথা। তুই কবে আসবি। পুকুর পাড়ের মাঠে এখন আর খেলা জমে না। কারন দলনেত্রী নেই।’

নাযীফাহ’র চক্ষুযুগলে ভির করে অভিমানী অশ্রু। মনে হয় সে কত বছর তার গ্রাম কে দেখে না।গ্রামের বৃষ্টি ভেজা মাটির ঘ্রাণ নেয় না। তারপর দুজনেই চুপ করে কানে মোবাইল ধরে রেখেছে। নিরবতা ঘুচলো ওয়াহিদার কথায়,

‘এখন কি ঢাকা বৃষ্টি হচ্ছে?

‘হুম, কেন বলো তো?’

‘তোরা কি বৃষ্টিতে ভিজছিস?’

‘হুম। একটু হাঁটতে বের হয়েছি তাহমিদ ভাইয়ের সাথে। কিন্তু কেন?’

‘না কিছু না। এমনি জিজ্ঞেস করলাম।’

অশ্রুসিক্ত নয়ন কিন্তু ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো ফাহমিদা বেগমের। নিশ্চয়ই বৃষ্টি দেখে মায়ের কথা মনে পড়ছিলো। তাই সুকৌশলে মায়ের সব খবরাখবর নিয়ে নিলো মেয়েটা।

কথা শেষ করে আবারও দু’জন হাঁটছে। তাহমিদ মনে মনে হাসছে সে। পুচকি চালাক আছে। কেমন করে কৌশলে মা বাবার খবর জেনে নিলো। মা বাবার খবর জানতে না চাইলে প্রথম কথাতেই বলে দিলে পারতো। কিন্তু না সে রাগ দেখালো সব জানার পরে।

____________________________________________

বাসায় এসে পোশাক বদলেছে দুইজন।তারপর বাহির থেকে আনা খাবার দুই প্লেটে নিয়ে ফাহিম আর আমেনা বেগমকে খাবার দিলো নাযীফাহ। ফাহিম এখনো পড়ছে। তাহমিদ কপালে হাত ঠেকিয়ে বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে আছে। ফাহিমের সামনে প্লেট রেখে নাযীফাহ বলল,

‘তাহমিদ ভাই?’

নাযীফাহ’র ডাকে কপাল থেকে হাত নামালো সে। তারপর জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই নাযীফাহ পুনশ্চ বলল,

‘একটু চিকেন চাপ নিতুকে দিয়ে আসি? ও আমাকে ছাড়া কিছু খায় না।’

‘এখন রাত হয়ে গেছে। এতোরাতে কারো বাসার কলিং বেল বাজানো দৃষ্টিকটু। কাল বরং আবার আমি কিনে আনলে নিতুকে নিয়ে দিস।’

মাথা নেড়ে সায় জানায় নাযীফাহ। পুনরায় ফাহিমের কাছে গিয়ে বলে,

‘শুন ফাহিম্মা, যতটুকু দিয়েছি সবটা শেষ করবি। প্লেটে যদি একটুও থাকে তোর খবর আছে। রেস্টুরেন্টে একঘন্টা দাঁড়িয়ে থেকে এই পার্সেল এনেছি।’

ফাহিম বাঁকা হেসে বলে,

‘তাইলে চিন্তা কর তুই কি পরিমাণ মুটি। তোরে রেস্টুরেন্টের কর্তৃপক্ষও চেয়ারে বসতে দিলো না। যদি চেয়ার ভেঙে যায় সেই ভয়ে।’

নাযীফাহ দাঁত কটমট করে বলে,

‘তুই মুটি, তোর বউ মুটু, তোর চৌদ্দ গোষ্ঠী মুটি।’

ফাহিম মাছি তাড়ানোর ভান করে বলল,

‘একে তো শুকনা পাটকাঠি।দ্বিতীয়ত আমার বউ নেই যে মুটি হবে। তবে আমার ভাইয়ের বউ খুব মুটি।’

নাযীফাহ কথায় না পেরে হনহন করে চলে গেলো। নাযীফাহ’র এমন অবান্তর কথা শুনে নৈঃশব্দ্যে হাসলো তাহমিদ।

____________________________________________

গভীর, নিগূঢ়, ঘুটঘুটে আঁধার।এলোমেলো শুয়ে আছে নাযীফাহ। ছোট ছোট অবাধ্য চুলগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মুখে।আমেনা বেগম একপাশে গুটিসুটি হয়ে শুয়ে আছেন। তাহমিদ সতর্কতা অবলম্বন করে শব্দহীন পায়ে হেঁটে রুমে আসলো। নাযীফাহ যেই পাশে শুয়েছে সেই পাশে গিয়ে হাঁটু ভাঁজ করে বসলো। নিমিষহারা তাকিয়ে রইলো তিন ‘কবুল’ বলে গ্রহন করা স্ত্রীর দিকে। এ যেন এক অন্যরকম মানসিক তৃপ্তি। ঘুমন্ত প্রেয়সী যেন চক্ষু শীতলকারী। এই পবিত্র চেহারার অধিকারী রমনীর দিকে তাকিয়ে কাটিয়ে দেওয়া যাবে বছরের পর বছর। এলোমেলো চুল গুলো মুখ থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য হাত বাড়িয়েও হাত গুটিয়ে নিলো সে। পাছে যদি নাযীফাহ জেগে যায়। ছুঁয়ে দেওয়ার অধিকার আছে কিন্তু বিবেক বাধা দেয়।মায়াবী গড়নের কিশোরীটি তার শুধুই তার। এই কিশোরীকে দেওয়া প্রতিটা স্পর্শে থাকবে পবিত্রতা। কিন্তু ছুঁয়ে দিতে মানা। উঠে দাঁড়ায় সে।এখানে থাকা আর সম্ভব না। অবাধ্য মন বার বার ঘুমন্ত কিশোরীকে ছুঁতে চাইছে। তার শুষ্ক ওষ্ঠদ্বয় বারবার ওই কপালে উষ্ণ স্পর্শ দিতে চাইছে। এখানে আর কিছুক্ষণ থাকলে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা কষ্টসাধ্য হবে।

সামনে দিকে পা বাড়াতেই থমকে যায় তাহমিদ। তাহলে কি ধরা পড়ে গেলো সে?

#চলবে

বানান ভুল ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

#হৃদয়াবেগ
#পর্বঃ০৯
#রূপন্তি_রাহমান (ছদ্মনাম)

‘বউরে কাছে পাইতে ইচ্ছে করে দাদু ভাই?’

চমকিত, বিস্মিত, আশ্চর্যান্বিত হয় তাহমিদ। থমকে দাঁড়ায় সে। পা চলার গতি বন্ধ হয়ে যায় তার। বুকে হাত রাখলো।হৃদপিণ্ড তার তড়িৎ গতিতে লাফাচ্ছে। সেখানে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো তাহমিদ। আমেনা বেগম পুনশ্চ বললেন,

‘কি হলো বললে না যে বউরে কাছে পাইতে ইচ্ছে করে?’

কোনো উত্তর না দিয়ে এবারও অসাড়, নিশ্চল আর স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সে। দাদির কাছে ধরা পড়ে যাওয়ার লজ্জায় সে মাথা নত করে, চুপ হয়ে রইলো। আমেনা বেগম অন্ধকার হাতরে উঠে দাঁড়ালেন।তারপর গুটি গুটি পায়ে তাহমিদ এর কাছে এসে কাঁধে রাখলো।দাদির দিকে ফিরে তাকালো সে।

‘ওরে কাছে পাইতে ইচ্ছে করে কিনা জানি না। তবে, এই অবুঝ মেয়েটার অন্ধকারাচ্ছন্ন, মলিন, বিষাদভারাতুর মুখশ্রী দেখলে আমার বক্ষঃস্থল ঝড় বয়ে যায়।তোলপাড়, আলোড়ন সৃষ্টি হয় সেখানে। মাথার মধ্যে সারাক্ষণ ঘুরপাক খায় কি করলে ওই মেয়েটা একটু হাসবে। আগের মতো আবারও চঞ্চল হবে।’

নাতির কথায় শব্দহীন পরিতৃপ্ত হাসলো আমেনা বেগম। নাতির সাথে ওই ডানপিটে মেয়েটার বিয়ে দিয়ে কোনো ভুল তিনি করেননি। ড্রিম লাইটের মৃদু আলোয় বোঝা গেলো না আমেনা বেগমের সেই সন্তুষ্ট,পরিতৃপ্ত হাসি।

‘এটাই আল্লাহর কালাম কে সাক্ষী রেখে তিন কবুলের জোর। মায়া, মোহ, প্রেম, প্রণয় আর ভালোবাসা এসব বলে কয়ে হয় না। পাশে থাকা মানুষটার জন্য এমনি জন্ম নেয়। সে শারিরীকভাবে বড় হলেও মানসিকভাবে আরো একটু বড় হউক। এইতো সুযোগ এখন তার সাথে বেশি বেশি সময় কাটাও। তোমার মনের অজানা অনুভূতি তাকে জানান দাও। তোমার মনে যেমন তার জন্য ঝড় বয়ে যায় তার মনেও তোমার নামে ঝড় উঠার জন্য আয়োজন করো। কয়দিন পর সে কলেজে ভর্তি হবে তখন কিন্তু সময় পাবে না।’

দাদির কথা এতোক্ষণ মন দিয়ে শুনেছে তাহমিদ। তার অন্তঃস্থল থেকে নির্গত হয় দীর্ঘ নিঃশ্বাস। এই দীর্ঘ নিঃশ্বাসের গভীরতা পরিমাপ করা যাবে না। আছে শুধু অসহায়ত্ব।

‘আমার নিজেকে ওর অপরাধী মনে হয় দাদি। মনে হয় আমি ওর স্বাভাবিক জীবনে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছি। মেয়েটা কেমন আগের থেকে চুপচাপ হয়ে গেছে। আমিও যে হতাশ্বাস, নিরুপায়। ম’র’তে ম’র’তে বেঁচেছে মেয়েটা। আবার কি করে ওকে ওই জায়গায় রেখে আসি বলো? মৃত্যু ঝুঁকি থেকে ঢের ভালো সাময়িক মন খারাপ।’

আর দাঁড়ালো না তাহমিদ। ব্যস্ত পায়ে দ্রুত কক্ষ ত্যাগ করলো সে। আমেনা বেগম পুনরায় বিছানায় পা উঠিয়ে বসল। আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো নাযীফাহ’র মাথায়। আজ বড্ড মনে পড়ছে তার স্বামীর কথা। তাহমিদ যেন তার দাদারই প্রতিচ্ছবি। তিনিও গম্ভীর আর বুঝদার ছিলেন। কোনোকিছু সহজেই বুঝে যেতেন। স্বামীর সকল গুন বড় নাতির মাঝে প্রতীয়মান দেখে তিনি অবাক, আশ্চর্যান্বিত, বিস্মিত। একজন বুঝদার, গম্ভীর মানুষের কপালে বুঝি অবুঝ, বিমূঢ়, নিরেট,ডানপিটে মেয়ে জুটে। ভাবতেই মৃদু শব্দে হাসলেন৷ আজ মানুষটা বেঁচে থাকলে খুব খুশি হতেন। কেননা তাহমিদ আর নাযীফাহ যেন তাদের কৈশোরকালের প্রতিচ্ছবি। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে সেখানেই হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন তিনি।

___________________________________________

সকালে সবাই বসে নাস্তা করছে। চুপচাপ কারো মুখে কোনো রা নেই। যে যার মতো খেয়েই চলেছে। বুয়া ওয়াশরুমে কাপড় কাঁচে। খাওয়ার মাঝে ফাহিম ক্রূর বিদ্রুপ করে বলে উঠলো,

‘বুঝলে দাদি এই অল্প কয়দিনের জীবনে অনেক কিছু দেখে ফেলছি। আর কিছু দেখার বাকি নাই। যা দেখার কথা ছিলো না তাও দেখেছি। এখন আল্লাহ আল্লাহ করে ম’র’তে পারলে বাঁচি।

আমেনা বেগমও ব্যঙ্গ করে বললেন,

‘কি এমন রাজকার্য দেখেছো যে আর বাঁ’চা’র ইচ্ছে নাই? আমরাও একটু শুনি।’

‘আরে দাদি আমার এই মহামূল্যবান চক্ষুদ্বয় দ্বারা কেবল দেখিইনি কর্ণ দ্বারা শুনছিও। বিয়ের পরও বরকে ভাই বলে ডাকতে শুনছি।’

ফাহিমের দিকে প্রগাঢ় দৃষ্টিতে তাকায় নাযীফাহ। যেন দৃষ্টি দ্বারা সে ফাহিমকে ভস্ম করে দিবে। ফাহিম সেই দৃষ্টিকে তোয়াক্কা না করে পুনশ্চ বলল,

‘তোর বিয়ে হয়েছে তুই কেন বরকে তাহমিদ ভাই, তাহমিদ ভাই বলে মাথা মাথা খাবি?’

নাযীফাহ দাঁত কটমট করে অগ্নিবর্ণ চোখে তাকায় ফাহিমের দিকে।

‘তাহলে তোর ভাইকে কি বলে ডাকবো, তাহমিদ জামাই বলে?’

নাযীফাহ’র মুখ নিঃসৃত বাক্য শ্রবণগোচর হওয়া মাত্রই হাত থেমে গেলো তাহমিদের। এমন একটা ভাব ধরলো যেন সে কিছুই শুনেনি। নাযীফাহ নিজেও হতবিহ্বল হয়ে গেলো। লোকটার সামনে বসেই সে এই কথা বলে ফেলল। চোখমুখ খিঁচে বন্ধ করে জিভে কামড় দেয় সে। আমেনা বেগম আর ফাহিম শব্দযোগে হাসতে লাগলো। হাসির গতিতে আমেনা বেগমের শরীর দুলছে। ফাহিমের হাসতে হাসতে চোখে পানি চলে আসছে। তাহমিদ মুখে থমথমে, গভীর, বিবর্ণ রূপ চেয়েও ধারণ করতে পারছে না।দাঁতে দাঁত চেপে আছে যেন কোনোভাবে হাসি না আসে। পেট চেপে বহু কষ্টে হাসি থামালো ফাহিম।

‘তাহমিদ জামাই কেন বলবি? বলবি তো, ওগো শুনোনা,এইইই জানু, হেগো এসব বলে।’

মাত্রই পানির গ্লাসে চুমুক দিয়েছিলো তাহমিদ। ফাহিমের কথা শুনে পানি চলে যায় তার শ্বাসনালীতে। খুক খুক করে কাশতে লাগলো সে। কাশতে কাশতে চোখমুখ লাল হয়ে গেছে তার। নাযীফাহ আর নত মস্তক উপর তুলল না লজ্জায়।

____________________________________________

হাঁটি হাঁটি পা পা করে দিনগুলো কেমন চলে যায়। একটা একটা করে ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টায়। দিন শেষ করে সপ্তাহ এরপরে মাস। এমন করে শেষ হয় বছরও।

উদাস, উদ্বেগহীন, কৌতূহলশূন্য দৃষ্টিতে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বহিরাংশে তাকিয়ে আছে নাযীফাহ। চক্ষুদ্বয়ে তার অসহায়ত্ব। ক্ষণে ক্ষণে ফেলছে দীর্ঘশ্বাস। এই দীর্ঘশ্বাস যে বিষাক্ত করে তুলছে চারপাশ। আজ তার রেজাল্ট দেওয়ার কথা। ফাহিম সকাল থেকে হাজার বার খুঁচিয়েছে তাকে ফেল করবে বলে। পরীক্ষা বেশি ভালো না হলেও সে জানে ফেল করবে না। উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের সাথে তারা নামও থাকবে। রেজাল্ট এখনো তার হাতে এসে পৌছায়নি। আজ তার বাবার কথা বড্ড মনে পড়ছে। নিশ্চয়ই সে রেজাল্ট পাবলিশড হওয়ার আগেই বাড়িতে মিষ্টি নিয়ে হাজির হতো। বাবার পাগলামির কথা ভাবতেই অধর কোণে হাসি ফুটে উঠলো তার। সহসা কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে চকিত, ত্রস্ত হয় নাযীফাহ। তাহমিদকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সে। বাটি থেকে চামচে করে একটা রসমালাই এর গুটি মুখের সামনে তুলে ধরে তাহমিদ।

‘সারাদিন এ পাড়া ও পাড়া করে ঘুরাঘুরি করে, হাঁটুর বয়সী বাচ্চাদের সাথে দৌড়াদৌড়ি করে আমার মামুর মেয়ে এসএসসি পরীক্ষায় ৪.৭২ পেয়েছে। ভাগ্যিস মাথাভর্তি গোবর থাকলেও হাতের লেখায় প্রাণ আছে। না হলে শুনতে হতো ফেল করা বউয়ের বর আমি।’

রসমালাই এর গুটি টা মুখে নিয়ে ফিক করে হেসে দিলো। তার সাথে তাহমিদও হাসলো। হুট করে নাযীফাহ’র হাস্যোজ্জ্বল মুখটা নিগূঢ়,ঘুটঘুটে যামিনীর ন্যায় তমসাচ্ছ হয়ে গেলো। হঠাৎ করে নাযীফাহ’র মুখটা অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যেতেই কপালে সুক্ষ্ম রেখার ভাঁজ পড়ে তাহমিদের। নাযীফাহ কিছু একটা বলতে গিয়েও যেন বলল না। তাহমিদ বুঝলো এই মেয়ের অভিমান বড্ড গভীর, দূর্ভেদ্য, শঠতাপূর্ণ। বাবা মায়ের কথা জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করলো না। নাযীফাহ মুখভঙ্গি দেখে তাহমিদের অন্তঃস্থল থেকে উৎক্ষাত হয় দীর্ঘশ্বাস। নাযীফাহ মন অন্য দিকে ঘুরানোর জন্য বলে উঠে তাহমিদ,

‘গোলাপ গ্রামে যাবি নাযীফাহ? যেখানে রোজ ফুটে হাজার হাজার র’ক্ত গোলাপ। চাষ হয় স্নিগ্ধ ভালোবাসার প্রতীকের।’

গোলাপ শব্দটা কর্ণগোচর হতেই আঁখিদ্বয় চকচক করে উঠে। তার এই জীবনে সে হাতে গুনা কয়েকবার গোলাপ ছুঁয়ে দেখেছে। খুশিতে মাথা নাড়ে সে। তাহমিদ মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।

‘শাড়ি সামলাতে পারবি?’

নাযীফাহ মন খারাপ করে উত্তর দেয়, ‘না।’

‘আচ্ছা সমস্যা নেই। তুই যেভাবে কমফোর্ট ফিল করিস সেভাবেই চল। তবে তাড়াতাড়ি রেডি হতে হবে। এখন বের হলে সেখানে পৌঁছাতে বিকেল হবে। আর দেরি করলে সন্ধ্যা। তখন গিয়ে আর লাভও হবে না।’

তাহমিদের কথা শেষ হওয়ার আগেই নাযীফাহ দৌড়ে ওয়ারড্রব থেকে একটা কূর্তি বের ওয়াশরুমে চলে গেলো। নাযীফাহ’র কর্মকাণ্ড দেখে আহাম্মক, ক্যাবলাকান্তের মতো তাকিয়ে রইলো তাহমিদ। এরপর শব্দযোগে হাসলো সে।

____________________________________________

ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করে তিনের ঘর ছাড়ালো। গোলাপ গ্রামে মাত্রই এসে পৌঁছালো দু’জন। চারিদিকে শুধু ফুল আর ফুল। যতদূর দৃষ্টি যায় তত দূর অব্দি শুধু লাল রঙের গোলাপ। খুশিতে আটখানা হয়ে গেলো নাযীফাহ। গোলাপ ফুলের ক্রাউন মাথায় দিয়ে গাছে থাকা ফুটন্ত গোলাপ কে স্পর্শ করছে সে। তার অগোচরে ক্যামেরাবন্দি হয় সে তাহমিদের মোবাইলে। কখনো ওষ্ঠদ্বয় প্রসারিত করে হাসছে তো কখনো কপাল কুঁচকে তাকাচ্ছে। নাযীফাহ’র অগোচরে একের পর এক ক্লিক করার পর ছবি গুলো দেখতে লাগলো। ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে মনে মনে ভাবলো,

‘এক ফুটন্ত গোলাপ ছুঁয়ে দিচ্ছে আরেক গোলাপকে।’

তাহমিদের সামনে দিয়ে একটা কাপল যেতেই ছেলেটাকে ডাকল তাহমিদ। ছেলেটা ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকাতেই তাহমিদ অনুনয়ের স্বরে বলল,

‘ভাইয়া ওই লাল কালার কূর্তি পড়া মেয়েটাকে দেখছেন আমি ওর পাশাপাশি গিয়ে দাঁড়ালে কয়েকটা ছবি তুলে দিতে পারবেন? কিন্তু মেয়েটা যেন বুঝতে না পারে।’

ছেলেটা সায় জানাতে তাহমিদ তার হাতের মোবাইলটা ছেলেটার হাতে দিলো। আবেগময় আঁখিতে প্রণয়িনীর দিকে দৃষ্টিপাত করতেই সেই মূহুর্ত ক্যামেরাবন্দি করলো ছেলেটি। পরপর কয়েকটা ক্লিক করার পর তাহমিদ ছেলের কাছে আসতেই সে হেসে প্রশ্ন করলো,

‘একতরফা ভালোবাসা?’

মাথা নাড়ে তাহমিদ।

‘তাহলে বলে দিন। না হলে তো অন্য কেউ এসে নিজের নামে করে নিবে।’

তাহমিদ হেসে জবাব দিলো,

‘সেই সুযোগ নেই। সে আমারই।’

‘এতো কনফিডেন্টের সাথে কিভাবে বলছেন?’

‘কারন সে আমার বিবাহিত স্ত্রী।’

বিস্মিত, চকিত নয়নে তাকায় ছেলেটি আর তার পাশে থাকা মেয়েটি। বিস্ফোরিত গলায় বলল,

‘বিবাহিত স্ত্রী হলে এভাবে লুকিয়ে ছবি তুললেন কেন? পাশাপাশি দাঁড়িয়ে হাতে হাত রেখেও তো ছবি তুলতে পারতেন।’

‘কারন বউয়ের নাবালিকা থেকে সাবালিকা হওয়ার অপেক্ষায় আছি।বিয়ে করলেই যে তার দেহ ভোগ করার জন্য ঝাপিয়ে পড়তে হবে এমন তো কোনো কথা নেই। ইসলামিক এবং সামাজিক দুই নিয়মে সে আমার। আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখলে অবশ্যই তাকে আমি একান্ত ভাবে পাবো। এতে কোনো সন্দেহ নেই। হউক না সে আরো একটু। এখন আমি তার কাছে গেলে নিশ্চয়ই তার মনে বিয়ে নিয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।’

ছেলে মেয়ে যেন আরো দ্বিগুণ আশ্চর্যান্বিত, সচকিত হলো।

‘স্যলুট ভাই আপনাকে। যেখানে বিয়ের পর নিজের পুরুষত্ব জাহির করার জন্য প্রথম রাতেই কোনো পুরুষ ঝাঁপিয়ে নববধূর উপর। নিজের অধিকার ফলানো শুরু করে।বউকে কামুকতা মিটানোর বস্তু মনে করে। সেখানে আপনি একজন তাগড়া যুবক হয়ে দিনের পর দিন স্ত্রী কে চোখের সামনে দেখেও নিজেকে সংযত রেখেছেন। আপনার মতো কয়জন ভাবে বলুন তো।’

মৃদু হেসে ছেলেটির হাত থেকে মোবাইল নিয়ে পা বাড়ালো নাযীফাহ’র দিকে।

____________________________________________

সকালে নাস্তার টেবিলে নাযীফাহকে না দেখে কপালে ভাঁজ পড়ে তাহমিদের।গম্ভীর কন্ঠে আমেনা বেগমকে জিজ্ঞেস করে নাযীফাহ’র কথা। তিনি জবাব দেন,

‘শরীর নাকি খারাপ লাগছে। এখন খাবে না পরে খাবে।’

তাহমিদ ভাবলো হয়তো কালকে এতো দূর যাওয়ার জন্য শরীর খারাপ লাগছে। একটু ঘুমালেই ঠিক হয়ে যাবে। তাই আর মাথা ঘামালো না। নাস্তা করে চলে গেলো।

ইংরেজি ক্লাস নিচ্ছে তাহমিদ। আচমকা মোবাইলের রিংটোনে আঁতকে উঠল সে। মোবাইল স্ক্রিনে ফাহিমের নাম্বার দেখে ভ্রু কুঞ্চিত হয় তার। রিসিভ করে কানে ধরতেই আমেনা বেগম আতংকিত গলায় বললেন,

‘তাড়াতাড়ি বাসায় আসো দাদু ভাই। নাযীফাহ কেমন ছটফট করছে কেমন।’

বুকে মোচড় দিয়ে ওঠে তাহমিদের। ক্লাস না করেই ব্যতিব্যস্ত হয়ে ছুটলো বাসার দিকে।

#চলবে

বানান ভুল ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here