হৃদয়াবেগ #পর্বঃ১০,১১

0
1270

#হৃদয়াবেগ
#পর্বঃ১০,১১
#রূপন্তি_রাহমান (ছদ্মনাম)
১০

রিক্সা থেকে নেমে উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে বাসার সামনে এসে দাঁড়ালো সে।নুয়ে হাঁটুতে হাত দিয়ে হাঁপাতে লাগলো। মিনিট দুয়েক বাদে কলিংবেল চাপলো। সেকেন্ডের মাথায় ফাহিম দরজা খুললো। যেন সে তাহমিদের আসার অপেক্ষায় ছিলো।তাহমিদ কোনো দিকে না তাকিয়ে ব্যস্ত পায়ে ছুটলো নাযীফাহ যে রুমে আছে সেই রুমের দিকে। তাহমিদকে দরজার কাছে দেখতেই রুম থেকে বেরিয়ে গেলো আমেনা বেগম। দরজায় দাঁড়িয়ে বিছানায় শুয়ে থাকা মেয়েটির পলকহীন, নিরাধার, অগতি, বিবশ চক্ষুতে তাকিয়ে রইলো। কুঁজো হয়ে পেট চেপে ধরে অনবরত কাঁদছে মেয়েটা। কান্নার প্রকোপে কেঁপে কেঁপে উঠছে ওর শরীর। তাহমিদ ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো নাযীফাহ’র দিকে। শিয়রের পাশে বসে নাযীফাহ’র মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে নিস্তব্ধ, অবিক্ষুদ্ধ,ধীরস্থির গলায় ডাকলো,

‘নাযীফাহ?’

নিজের শিয়রের কাছে তাহমিদ কে বসে থাকতে দেখে লজ্জায় কুঁকিয়ে গেলো সে।চোখমুখ খিঁচে বন্ধ করে রাখলো। তাহমিদ স্নিগ্ধ, আলতো স্বরে জিজ্ঞেস করলো,

‘পেট ব্যথা করছে খুব?’

হ্যা বোধক মাথা নাড়ে নাযীফাহ। তাহমিদ পুনশ্চ জিজ্ঞেস করে,

‘সকালে উল্টোপাল্টা কিছু খেয়েছিস?’

এবার না বোধক মাথা নাড়ে নাযীফাহ। কপালে সূক্ষ্ম রেখার ভাঁজ পড়ে তার। বিছানার দিকে নজর যেতেই পেট ব্যথার রহস্য উদঘাটন করলো সে। দ্রুত পায়ে রান্নাঘর গেল তাহমিদ। চুলোয় পানি গরম করে একটা হট ওয়াটার পটে নিলো। তারপর তড়িৎ গতিতে আবার নাযীফাহ’র নিকট এলো। ওয়াটার পট নাযীফাহ’র হাতে দিয়ে বললো,

‘তুই এটা পেটে স্যাঁক দে। আমি আধাঘন্টার ভিতর নিচ থেকে আসছি।’

ব্যস্ত পায়ে আবারও ছুটলো বিল্ডিংয়ের নিচে। নাযীফাহ একটু পর পর পেটে স্যাঁক দিচ্ছে। এখন আগের থেকে ব্যথা একটু কমেছে। আধা ঘণ্টার মাথায় আবারও তাহমিদ নাযীফাহ’র নিকটে এলো। ধরে উঠিয়ে বসালো নাযীফাহ কে। তারপর একটা স্যানিটারি ন্যাপকিন এর প্যাকেট আর এক পাতা এলজিন ট্যাবলেট তার হাতে দিলো। এসব দেখে নাযীফাহ’র আপাদমস্তক যেন লজ্জা এবং ত্রপায় গ্রাস করলো। প্রণয়িনীর এমন মুখশ্রী দেখে মনে মনে হাসলো সে। তারপর গাঁ ঘেঁষে বসলো। নাযীফাহ’র একটা হাত নিজের মুঠোবন্দি করে কাতর গলায় বলল,

‘এটাই কি প্রথম?’

এবারও লজ্জায় মিইয়ে যায় নাযীফাহ। অর্ধাঙ্গীর এমন মিইয়ে যাওয়া মুখশ্রী দেখে অন্তঃস্থলে এক অন্যরকম শিহরণ বয়ে গেলো তার। অব্যাকুল গলায় পুনশ্চ বলল,

‘তুই এতোটা বড় না আবার এতোটা ছোটও না যে স্বামী স্ত্রীর ব্যপার গুলো বুঝবি না। স্বামী স্ত্রীর নিকট আর স্ত্রী স্বামীর নিকট থাকবে খোলা বইয়ের মতো। যেন একজন আরেকজনকে যেকোনো সময় পড়তে পারে। তোর এসব মেয়েলি ব্যপার গুলো আর কারো সাথে না হউক অন্তত আমার সাথে শেয়ার করতে হবে।এখন হউক আর ভবিষ্যতে। এমনে এমনে একজনকে আরেকজনের অর্ধাঙ্গ বলা হয় না। বুঝেছিস কি বলেছি?’

নত মস্তক উপর নিচ করে নাযীফাহ।

‘এখন বল, এইবারই কি প্রথম নাকি আগেও হয়েছে?’

‘আগেও হয়েছে। মা’ই এসব দেখাশোনা করতো। কারন এই সময় আমার প্রচুর পেট ব্যথা করে। আর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রগুলো কোথায় রাখি আমার মনে থাকে না। তাই মা এসব গুছিয়ে রাখতো। এখানে আসার আগেও মা সব গুছিয়ে দিয়েছে। আগের মাসে ব্যবহারের পরে কোথায় রেখেছি মনে করতে পারছি না। তাই আরকি।’

তাহমিদের অন্তঃস্থল থেকে বহির্ভূত হয় দীর্ঘ নিঃশ্বাস।

‘এখানেও আর কোনো টেনশন করতে হবে না। আমি সবকিছু গুছিয়ে রাখবো। এখন কষ্ট করে পোশাক বদলে আয়। আর গায়ের পোশাক ওয়াশরুমের একপাশে জড়ো করে রাখিস। আমি বিছানার চাদর উঠিয়ে রাখছি।এটাও রাখিস। আমি রাতে এসে এসব ধুয়ে দিবো।

বিস্ফোরিত, ত্রস্ত লোচনে তাকায় নাযীফাহ তাহমিদের দিকে।

‘আপনি ধুয়ে দিবেন আমার কাপড়। বুয়া আছে তো সে সকালে এসে ধুয়ে দিবে। আর না হয় আমি কেঁচে নিবো।’

এক রামধমক দেয় তাহমিদ নাযীফাহ কে। কেঁপে উঠে নাযীফাহ’র শরীর।

‘আমি বলছি না আমি ধুয়ে দিবো। কথা কানে যায় না? আমি আমার মামাতো বোনের কাপড় না নিজের স্ত্রীর কাপড় ধুয়ে দিবো, কোনো পরনারীর না। স্ত্রীর কাজ করলে গুনাহ হয় না এটা সুন্নত। আর তোর এসব কাপড় আমি চাই না অন্যকেউ ধরুক। আর কি বললি? নিজে কেঁচে নিবি? এ্যাহ্ আসছে, পেটের ব্যথায় শুয়া থেকে উঠতে পারে না আবার আসছে কাপড় কাঁচতে। যা বলছি তাই করবি। আর ফ্রেশ হয়ে কিছু একটা খেয়ে ঔষধ খেয়ে নিবি।তাহলে পেট ব্যথা কিছুটা কমবে। তুই জানিস দাদি যখন বললো তুই ছটফট করছিস আমি ঠিক কিভাবে এসেছি।ক্লাসটা পর্যন্ত করিনি।’

নাযীফাহ নত মস্তকে ওয়াশরুমে চলে গেলো। মিনিট বিশেক পরে ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে নাযীফাহ দেখলো বিছানায় নতুন চাদর। আর তাহমিদ খাবারের প্লেট হাতে বসে আছে। নাযীফাহ কাছে এসে নত মস্তকে বলল,

‘আপনি এখনো যাননি?’

‘না, তুই যেই বিচ্ছু।পেট ব্যথার বাহানায় না খেয়ে ঘুমিয়ে যাবি। তাই তোকে বসে থেকে খাইয়ে যাবো।’

‘আপনার ক্লাস?’

‘অফিসে ফোন করে বলে দিয়েছি যাতে ছুটির পরও স্টুডেন্টরা থাকে বলার জন্য।’

নাযীফাহ ‘ওহ’ বলে খাওয়া শুরু করলো। খাওয়া শেষ হতেই প্লেট আর গ্লাস হাতে নিয়ে তাহমিদ বলে,

‘মেয়েদের অল্প ভেঙে গেলে চলবে না।মনে জোর সঞ্চয় করে রাখতে হয়।’

____________________________________________

রোজ বিকেলে তাহমিদ বাসায় আসলেও সেদিন আর বিকেলে বাসায় আসলো না। নাযীফাহ ঘুম থেকে উঠে আধশোয়া হয়ে পেটে গরম পানির স্যাঁক দিতে লাগলো। আগের থেকে অনেক আরাম লাগছে। থমথমে, মেঘমেদুর, তমসাবৃত মুখ নিয়ে রুমে প্রবেশ করলেন আমেনা বেগম। ক্রুদ্ধ, খিটখিটে, ক্রোধিত গলায় বলল,

‘ আমার কাছে বললে কি আমি তোরে খেয়ে ফেলতাম নাকি এসব আমার কখনো হয়নি। তোর এমন ছটফটানি দেখে জানিস কতটা ভয় পেয়েছিলাম আমি।’

আমেনা বেগমের এই থমথমে মুখেও নিজের জন্য উদ্বিগ্নতা দেখে তৃপ্ত হাসলো নাযীফাহ।

‘বেশি কথা বলো না বুড়ি।মাথায় হাত বুলিয়ে দাও। সারা শরীরে ব্যথায় জরাজীর্ণ।’

আমেনা বেগম নাযীফাহ’র পাশে বসে নাযীফাহ’র মাথায় মায়া, মমতা ও স্নেহ শীতল স্পর্শ দিতে লাগলেন।

রাতে বাসায় এসে আগে কাপড়গুলো কেঁচে দেয় তাহমিদ। তারপর লাগোয়া বারান্দায় মেলে দেয়। যতক্ষণ পর্যন্ত তাহমিদ এই রুমে থাকে আমেনা বেগম রুমে আসেন না। কারন নাযীফাহ এমনে লজ্জায় কাঁচুমাচু হয়ে যায়। আর আমেনা বেগম কে দেখলে নাজেহাল অবস্থা হবে।

নিজে শাওয়ার নিয়ে এসে খাবার খেতে আসলো তাহমিদ। ফাহিম আর আমেনা বেগম বসে আছে। নাযীফাহ’র জায়গাটা খালি দেখে তপ্ত শ্বাস ফেলল। একটা প্লেটে খাবার নিয়ে আসলো নাযীফাহ’র কাছে। নকশিকাঁথাটা কোমর অব্দি দেওয়া। একটা বালিশ বুকে জড়িয়ে পাশ ফিরে ঘুমোচ্ছে সে। তাহমিদ ধীরস্থির পায়ে নাযীফাহ’র কাছে গিয়ে বসল। সুস্থির, শান্ত গলায় ডাকতেই নাযীফাহ পিটপিট করে তাকালো। ঘামের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিন্দুগুলো চিকচিক করছে নাকে আর কপালে। নাযীফাহ কে উঠিয়ে খাওয়ানো শেষ করলো।

____________________________________________

থমকে নেই সময়। ঘড়ির কাঁটা এক সেকেন্ড এক সেকেন্ড করে ঘুরতেই থাকে। অতিবাহিত হলো পাঁচ দিন। নিতুরা ঘুরতে গিয়েছিল বাসায় এসেছে গতকাল। গতকাল রাতে তাহমিদ বাসায় আসার আগে রসমালাই নিয়ে এসেছে যেন নিতুদের বাসায় দিতে পারে। সকাল সকাল রসমালাই এর বাটি নিয়ে নিতুদের বাসার সামনে হাজির হয় নাযীফাহ। মুখে হাসি ঝুলিয়ে বার কয়েক কলিংবেল চাপে সে। খানিক বাদে দরজা খুলে নিতুর মা। নাযীফাহ প্রশ্বস্ত হেসে রসমালাই এর বাটি উনার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,

‘আমি পরীক্ষায় পাশ করেছি। আপনারা ছিলেন না বলে দিতে পারিনি,,,,,,,’

কথা শেষ করার আগেই ভেতর থেকে নিতুর চিৎকারের শব্দ পেয়ে হন্তদন্ত হয়ে ভেতর গেলো নিতুর মা। উনার পিছু পিছু নাযীফাহ ও গেলো। একটা নাইফ দিয়ে হাত কে’টে ফেলেছে নিতু। গলগল করে র’ক্ত ঝড়ছে। নিতুর বাবাও দৌড়ে রুম থেকে বের হলেন। মেয়ের হাতের এই অবস্থা দেখে নিচ থেকে উনি নাইফটা তুলে সাবধানে হাত দিয়ে চেপে বাঁকা করে ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দিলেন। নিতু বার বার অনুরোধ করতে লাগলো এটা না করার জন্য। নিতুর মুখভঙ্গি দেখে মনে হলো সে হাত কা’টার থেকে বেশি কষ্ট পেয়েছে নাইফটা ফেলে দেওয়ায়। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে সে।

‘পাপা আমার সাথে আর কখনো কথা বলবে না। তুমি আমার ফেভারিট নাইফ ফেলে দিয়েছো।তুমি খারাপ হয়ে গিয়েছে।’

ডাক্তার হওয়ার সুবাদে নিতুর বাবা বাসায় বসেই নিতুর হাত ব্যান্ডেজ করে দিলো। সোফায় বসে আমার হাত জড়িয়ে ধরে কাঁদছে সে। কাঁদতে কাঁদতে এক পর্যায়ে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লো সে। নিতুর মা কাছে আসতেই নাযীফাহ বলে,

‘নাইফটা না ফেললে পারতেন। দেখছেন কিভাবে কাঁদছে?’

নাযীফাহ’র কথায় মলিন হাসলো নিতুর মা।

‘যখন মা হবে তখন বুঝবে সন্তানের সামান্য তম বিপদে, অসুস্থতায় মা বাবার ভেতরটা কি করে।কতটা বিচলিত হয়ে পড়ে মা বাবা। সে সাময়িক কাঁদবে কিন্তু ওই বিপদের মুখোমুখি তো আর হবে না। আজ হাত কে’টেছে অন্য কোনো দিন যে আরো বড় বিপদ হবে না তার গ্যারান্টি কি? তার চেয়ে বরং কাঁদুক। আজ কাঁদলে কাল আর মনে থাকবে না।’

প্রতিটা কথা কর্ণগোচরে পৌঁছানো মাত্রই মস্তিষ্ক সচল হলো নাযীফাহ’র।বুকের ভেতরে বাবা মা জন্য ছ্যাৎ করে উঠলো তার। হাসফাস করতে লাগলো সে। যেখানে সামান্য হাত কা’টাতে নিতুর মা বাবা এমন পাগলামো করছে সেখানে সে তো পুরো দুইদিন নিখোঁজ ছিলো। তার মানে কি তার বাবা মা তাদের একমাত্র মেয়ের জীবন সংশয়ের ভয়ে অতিদ্রুত ঢাকা পাঠিয়ে দিয়েছে। আর নাযীফাহ তাদের ভুল বুঝে গেলো। নাযীফাহ এলোমেলো পায়ে বেরিয়ে এলো নিতুদের বাসা থেকে। বাসায় প্রবেশ করেই গেলো তাহমিদের কাছে। ঘড়ির কাঁটা ন’টার ঘর ছুঁয়েছে মিনিট পাঁচেক হলো। তাহমিদের পিছনে দাঁড়িয়ে বলে,

‘আমি মায়ের সাথে কথা বলবো তাহমিদ ভাই।’

শার্টের বোতাম লাগাচ্ছিলো তাহমিদ। কথাটা শুনে সচকিত হয় সে। পিছন ফিরে নাযীফাহ’র অসহায়, মলিন, বিষাদভারাতুর মুখশ্রী দেখে আর আশ্চর্যান্বিত হয় সে।

‘কি হয়েছে নাযীফাহ? এইতো হাসিখুশি নিতুদের বাসায় গেলি। এখন কি হলো।’

নাযীফাহ ভেজা আখিঁ পল্লবে বলল,

‘একটা ফোন দিন না মাকে। আমি মায়ের সাথে কথা বলবো।’

বিলম্ব না করে তাহমিদ ডায়াল করলো মামুর নাম্বারে। বার দুয়েক রিং হওয়ার পর রিসিভ হলো। তাহমিদ মোবাইল বাড়িয়ে দিলো নাযীফাহ’র দিকে।

‘কি হয়েছে তাহমিদ? এতো সকালে ফোন দিলি, নাযীফাহ সুস্থ আছে তো?’

‘বাবা।’

মেয়ের মুখে ‘বাবা’ ভেতরটা শীতলতায় ছেয়ে গেলো খালেদ মোশাররফের। আহা! মেয়ে তার কতদিন পরে বাবা বলে ডাকলো। নিশ্চয়ই রাগ পড়েছে। শব্দহীন হাসলো সে।

‘তোমাদের সাথে কথা বলি না বলে তোমরা আমাকে ভুলে গেছো তাই না?’

মেয়ের অভিমানী গলা শুনে এবার শব্দ করেই হাসলেন তিনি।

‘কোনো বাবাকে কি তার সন্তানকে ভুলে থাকতে পারে? তুই তো আমাদের সব।’

‘তোমরা কেমন আছো, বাবা?’

‘এতোদিন ভালো ছিলাম না।আজ মেয়ের গলা শুনে চাঙা হয়ে গেছি।’

খালেদ মোশাররফের কান থেকে মোবাইল টান দিয়ে গেলেন ফাহমিদা বেগম।

‘নাযীফাহ মা আমার?’

এতোদিন পরে মায়ের গলা শুনে শরীর অবস হয়ে এলো নাযীফাহ’র। কি মধুর মায়ের গলা। দুই মা মেয়ে নৈঃশব্দ্যে কাঁদছে।

‘মায়ের সাথে কথা বলবি না?’ মায়ের উপর এখনো রাগ কমেনি?’

নাযীফাহ ফুঁপিয়ে বলে উঠলো,

‘তোমাকে খুব ভালোবাসি মা। তোমাকে ছাড়া থাকতে আমার খুব কষ্ট হয়।’

অশ্রুসিক্ত নয়নে মুখে হাসি ফুটে উঠে ফাহমিদা বেগমের।

‘তোর রেজাল্টের দিন তোর বাবা তোর বিচ্ছু বাহিনীর দলকে দুপুরে দাওয়াত দিয়েছিলো। ওরা এক লোকমা মুখে তুলেছে আর জিজ্ঞেস করেছে তুই কবে আসবি। আমার ভেতরটা তখন শূন্যতায় হাহাকার করেছে। ওদের দেখলে মনে হয় তুই আমার কাছে আছিস।’

কথা শেষ করে মোবাইল তাহমিদের হাতে দিলো নাযীফাহ। এতোক্ষন দরজায় দাঁড়িয়ে সব শুনেছে আমেনা বেগম। একটা দিক থেকে টেনশন মুক্ত হলেন তিনি।

মোবাইল হাত নিয়ে তাহমিদ আলতো হাতে মুছে দিলো নাযীফাহ’র চোখ।

‘এতোদিনে তাহলে শুভ বুদ্ধি উদয় হলো। তা কিভাবে মনে হলো মা বাবা ঠিক কাজ করেছে।’

‘এমনে এমনে বুঝলাম।’

যা খুশি হয়ে তোকে আজ বিকেলে ঘুরতে নিয়ে যাবো।

____________________________________________

তাহমিদ বাসায় এসে চিৎকার করে ডাকে নাযীফাহকে। কন্ঠ স্বরে তার ক্রোধ, রাগ, রোষ আক্রোশ মিশ্রিত। তাহমিদের এমন ক্রোধান্বিত ডাক শুনে গলা শুকিয়ে এলো নাযীফাহ’র। কি এমন করেছে সে?

#চলবে

বানান ভুল ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

#হৃদয়াবেগ
#পর্বঃ১১
#রূপন্তি_রাহমান (ছদ্মনাম)

পড়ন্ত, নিম্নগামী অপরাহ্ন। সূর্য নুয়ে পড়েছে পশ্চিমাকাশে। দিবসের উচ্চ তাপ ধীরে ধীরে শিথিল হচ্ছে। ফুটপাত ধরে ধরে হাঁটছে তাহমিদ আর নাযীফাহ। নাযীফাহ’র এক হাত তাহমিদের হাতের বন্ধনে আবদ্ধ। অপ্রত্যাশিতভাবে থমকে দাঁড়ায় তাহমিদ। পা চলা থেমে যায় নাযীফাহ’রও। কপাল কুঁচকে দৃষ্টিপাত করল তাহমিদের দিকে। তাহমিদ প্রশস্ত হেসে পকেট থেকে টিস্যু বের করে নাযীফাহ’র ললাটে অবক্ষিপ্ত হওয়া ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘামের বিন্দু মুছে দিলো পরম ত্তয়াস্তায়, কায়মনোবাক্যে। অধর কোণ প্রসারিত হলো নাযীফাহ’র ও।আজকাল তাহমিদ এমন ছোট বড় সমুদয় বিষয়ে যত্ন, ত্তয়াস্তা, উদ্বিগ্নতায় অন্যরকম সুখানুভূতি হয় নাযীফাহ’র। যা আর কখনো সে অনুভব করেনি সে। তাহমিদ অকস্মাৎ স্পর্শে ধঁক করে উঠে তার অন্তঃস্থল। পুলকিত, বিমুগ্ধ, মোহিত হয় তার হৃদয়। অহর্নিশ তাহমিদের আশেপাশে থাকার আকুলতা, অভিলাষ, স্পৃহা নাযীফাহ’র বক্ষগহ্বরের জাগ্রত হয়। তাই তো তাহমিদ যখন হাঁটতে বের হওয়ার কথা বলে সে তখন বিনাবাক্যে রাজি হয়ে যায় হাজার অসুস্থতা থাকা সত্বেও। তার সুখানুভব হয় তাহমিদের হাতে হাত রেখে হাঁটতে।

‘হাওয়াই মিঠাই খাবো ভাইয়া।’

আশেপাশে নজর বুলালো তাহমিদ হাওয়াই মিঠাই খোঁজার উদ্দেশ্যে। এদিক ওদিক তাকিয়ে রাস্তার অপর পাশে দেখতে পেল একটা বারো তেরো বছর বয়সী ছেলে হাওয়াই মিঠাই বিক্রি করছে। রাস্তা পাড় হওয়ার জন্য উদ্যত হতেই তাহমিদের কর্ণে এসে। ধাক্কা লাগলো কোনো মেয়েলি কন্ঠস্বর

‘কেমন আছেন স্যার?’

কন্ঠস্বর চিনতে ভুল হলো তাহমিদের।নাযীফাহ’র হাত ধরে দাঁড়িয়ে পড়লো সে। হাত মুষ্টি বদ্ধ করে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রয়াস চালাচ্ছে সে। ভালো মন্দ কোনো উত্তর না পেয়ে সাবিহা পুনশ্চ বলল,

‘স্যার কি আমার উপর রেগে আছেন? আসলে স্যার আমি ওইদিন ওভাবে মিন করিনি ট্রাস্ট মি।’

যথাসম্ভব নিজেকে শান্ত রেখে তাহমিদ জবাব দিলো,

‘তোমার আর আমার সম্পর্কটা শিক্ষক আর ছাত্রীর। তোমার উপর রেগে থাকার মানেই হয় না।’

হাওয়াই মিঠাই ওয়ালা ছেলেটাকে চলে যেতে দেখেই আকস্মিকভাবে নাযীফাহ তাহমিদের হাত খামঁচে ধরে বলল,

‘ভাইয়া হাওয়াই মিঠাই চলে যাচ্ছে। ও ভাইয়া চলে যাচ্ছে তো।তাড়াতাড়ি চলুন না।’

সাবিহা না চিনার ভান ধরে বলল,

‘আপনার বোন হয় বুঝি, স্যার? কিউট কিন্তু খুব। চোখেমুখে মায়া উপচে পড়ছে।যে কেউ দেখলে মোহাচ্ছন্ন হয়ে যাবে।’

‘আপনার বোন হয় বুঝি, স্যার?’ এতটুকুই ছিলো আগুনে ঘি ঢালার মতো। তাহমিদের চোখেমুখে কাঠিন্য, কঠোরতা দেখে দিলো। রাগে হাত চেপে ধরলো নাযীফাহ’র। নাযীফাহ যন্ত্রনায় মৃদু আর্তনাদ করে বলল,

‘ভাইয়া আমার লাগছে।’

নাযীফাহ’র কথা কর্ণপাত না করে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেলো থেমে রিক্সার গুলো কাছে। তাহমিদের অকস্মাৎ রেগে যাওয়ায় মুখ আপনাআপনি হা হয়ে গেলো নাযীফাহ’র। তিন মাস কোচিং করা অবস্থায় স্যারকে কখনো রাগতে দেখেনি সে। আজ হঠাৎ হলো যে স্যার রেগে গেলো? সে তো স্যারের বোনের প্রশংসাই করেছে খারাপ কিছু তো বলেনি। পিছু ডাকতে গিয়েও থেমে গেলো সে। অতর্কিত যদি তাকেও কিছু বলে বসে। তাহলে সহ্য করতে পারবে না সে। তবে স্যারের হঠাৎ রেগে যাওয়াটা সাবিহার কাছে রহস্যই থেকে গেলো।

____________________________________________

রিক্সাগুলো কাছে এসে হাত ছেড়ে দিলো তাহমিদ। নাযীফাহ হাতটা ধরে বলল,

‘এভাবে কেউ ধরে? দেখুন হাতটা লাল হয়ে গেছে।’

মন খারাপ করে অভিমানী স্বরে পুনশ্চ বলল,

‘আর হাওয়াই মিঠাইও চলে গেলো।’

পরপর কয়েকটা শ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত, স্থির, নিরূপদ্রব করার প্রয়াস চালাচ্ছে তাহমিদ।

‘খেতে হবে না এসব ছাইপাঁশ। বাসায় যাবি এখন।’

‘মাত্রই তো এলাম।’

‘কথা কানে যায় না? বাসায় যাবি মানে বাসায় যাবি।’

কোনো প্রকার কথা না বলে বাধ্য মেয়ের মতো রিক্সায় চড়ে বসলো সে। তাহমিদও বসলো পাশে।

বাসার নিচে আসতেই কাঠকাঠ গলায় তাহমিদ বলে উঠলো,

‘এদিক ওদিক না তাকিয়ে সোজা বাসায় যাবি।’

নাযীফাহ শুকনো ঢুক গিলে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,

‘আপনি যাবেন না বাসায়?’

তাহমিদের রসকষহীন কাঠখোট্টা, নিরাবেগ জবাব,

‘না, তবে সন্ধ্যার পর তুই কোথাও যাবি না। তোর সাথে আমার বোঝাপড়া আছে।’

কপালে সূক্ষ্ম রেখার ভাঁজ পড়ে নাযীফাহ’র। কি এমন করলো সে যে তার সাথে বোঝাপড়া আছে? এসব ভাবতে ভাবতে চলল বাসার দিকে।

বাসায় এসে ফাহিমের সাথে খুনসুটিতে মত্ত হলো নাযীফাহ। তাহমিদের বলা শেষোক্ত কথা গুলো তার মস্তিষ্ক থেকে বেরিয়ে গেলো।

নিজেকে শান্ত, অক্রোধ, অনুত্তেজিত করার অভিসন্ধিতে নিরিবিলি, নির্জন জায়গায় এসে বসে আছে তাহমিদ। সামান্য একটা কথার জন্য সে এতো কেন রাগান্বিত, রুষ্ট, ক্রোধিত হচ্ছে তার জানা নেই। নাকি তার ক্রোধের কারন সাবিহা তার স্ত্রীকে বোন বলেছে বলে? অবশ্য বলারই কথা, মাঝরাস্তায় রাস্তায় ভাই ডাকলে যে কেউই বোন মনে করবে। মনের সাথে যুদ্ধ করে উঠে দাঁড়ালো সে। আজ কয়েকটা কথা মেয়েটাকে বলতেই হবে। বরকে ভাই ডাকার স্বাদ জন্মের মতো ঘুচিয়ে দেবে সে।

____________________________________________

চোখ মুখে কঠিনতা বজায় রেখে কলিং বেল চাপলো তাহমিদ। গুটিগুটি পায়ে এসে দরজা খুললো আমেনা বেগম। তাহমিদ বাসায় প্রবেশ করেই হাতে থাকা হাওয়াই মিঠাই গুলো ছুড়ে মা’রল। রাগত, ক্রোধান্বিত, রুষ্ট স্বরে চেঁচিয়ে ডাকলো নাযীফাহ কে। তাহমিদ এর এমন ক্রুদ্ধ স্বরে চমকিত হয় নাযীফাহ। তার মনে পড়ে যায় তখনকার কথা। ভয়ার্ত চোখে মুখে রুম থেকে বেরিয়ে আসে সে। বেরিয়ে আসে ফাহিমও। নিচে পড়ে থাকা হাওয়াই মিঠাই গুলো দেখে মুখে হাসি ফুটলেও তাহমিদের রক্তিম বর্ণের চোখ দেখে চুপসে গেলো সে। তাহমিদ শার্টের দু’টো বোতাম খুলে ঢিলে করল শার্ট। হাত দিয়ে কপাল স্লাইড করলো,

‘আমি তোর ভাই লাগি?’

নিরুত্তর নাযীফাহ। তাহমিদ হালকা চেঁচিয়ে বলল,

‘কথা বলছিস না কেন? আমি তোর ভাই লাগি?’

তাহমিদের চিৎকারে কেঁপে উঠলো নাযীফাহ’র শরীর। আজ পর্যন্ত তাকে কেউ এভাবে ধমক দেয়নি।নাযীফাহ বিস্মিত, আশ্চর্যান্বিত হয়ে তাকিয়ে আছে তাহমিদের দিকে।

‘তোকে নিজের স্ত্রী বলে গ্রহণ করেছি মাঝরাস্তায় সবার সামনে আমাকে ভাই ডাকার জন্য? আর মানুষ তোকে আমার বোন বলে জানার জন্য? তুই এখনো বাচ্চা না যে এসব বুঝবি না। তুই গ্রামে বড় হয়েছিস। তোর সমবয়সী অনেকে বিয়ে করে সংসার করছে।আর তুই এখনো দশ বছরে আঁটকে আছিস। এভাবে দিন পাড় করা যায় না,,,,, ‘

নিজের মতো করে কথা বলে যাচ্ছে তাহমিদ। ফাহিম তাহমিদের অগোচরে সামনে দৃষ্টি স্থির রেখে নাযীফাহ কে ফিসফিস করে বলে,

‘আমি আগেই বলেছি, তাহমিদ ভাই তাহমিদ ভাই করে মাথা না খেয়ে ওগো, হেগো, জানু, কলিজা এসব বলে ডাক শুনলি না তো আমার কথা। গরীবের কথা বাসি হলেও ফলে। এখন আমার ভাইয়ের চোখে রাগ, ক্রোধ আর রোষানল না দেখে ভালোবাসা দেখ তাহলে মন খারাপ হবে না।’

বলেই নাযীফাহ’র দিকে তাকাতেই দেখলো,নাযীফাহ’র চক্ষুদ্বয় নয়নবারিতে টইটম্বুর। নিমেষ ফেললে হবে ভারী বর্ষণ। আর কিছু বলার সাহস করলো না ফাহিম।

যে যার রুমে কিন্তু ড্রয়িং রুমের কোণে অবহেলায়, অবজ্ঞায় পড়ে আছে সেই হাওয়াই মিঠাই গুলো। যা একটু একটু করে চুপসে যাচ্ছে।

____________________________________________

হাই স্পিডে পাখা ছেড়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে নাযীফাহ। যেন সবাই বুঝতে পারে সে ঘুমিয়ে আছে। রাতে খাওয়ার সময় তাহমিদ দেখলো ফাহিম আর আমেনা বেগম থাকলে নাযীফাহ নেই
তাহমিদ বসতেই আমেনা বেগম আর ফাহিম খাওয়া শুরু করলো। তাহমিদের বিপরীতের জায়গাটা খালি দেখে গলা দিয়ে ভাত নামলো না তাহমিদের। ভাত গুলো নড়াচড়া করে পানি ঢেলে উঠে গেলো সে। ফাহিম কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখালেও দীর্ঘশ্বাস ফেলল আমেনা বেগম।

নিগূঢ়, ঘুটঘুটে যামিনী। এলোমেলো হয়ে গভীর তন্দ্রায় নিমগ্ন নাযীফাহ। ধীর, সুস্থির পায়ে হেঁটে নাযীফাহ’র কাছ এসে বসলো তাহমিদ। তন্দ্রাচ্ছন্ন নাযীফাহ’র ফোলা ফোলা আঁখিদ্বয় দেখে অনুশোচনা হতে লাগলো তাহমিদের। খুব সতর্ক ভাবে নাযীফাহ’র মাথায় হাত রাখলো তাহমিদ। জেগে গেলে যাবে। ও কিছু একটা বলে বুঝিয়ে দিবে। নাযীফাহ’র একটা হাত নিজের হাতের মুঠোতে নিলো সে। হাতটা আঁকড়ে ধরে নির্নিমেষ তাকিয়ে রইলো ঘুমন্ত, নিদ্রামগ্ন নাযীফাহ’র দিকে।

নাতির উপস্থিতি টের পেয়েও সাড়াশব্দ করলো না আমেনা বেগম। তবে নাতির করুণ অবস্থা দেখে হাসি পেল তার খুব।

____________________________________________

সকালে নাস্তার টেবিলেও নাযীফাহ কে না দেখে তাহমিদের অন্তঃস্থল থেকে নির্গত হয় তপ্ত শ্বাস। নাস্তা করার ইচ্ছে না থাকলেও বসে সে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে পেলো চুপসে যাওয়া হাওয়াই মিঠাই গুলো সোফার উপরে। খারাপ লাগলো তার। হাতের ভাঁজে থুতনি ঠেকিয়ে বসে আছে তাহমিদ। আমেনা বেগমের কাঠখোট্টা কথা,

‘মেয়েটাকে এভাবে ধমকে ধামকে না বললেও পারতে দাদুভাই। সে জন্মের পর থেকেই তোমাকে ভাই বলে ডেকে এসেছে। তুমি যে তার বর হবে সেটাতো সে জানতো না। বা বিয়ের পরও তাকে তুমি নিষেধ করোনি ভাই ডাকার জন্য। মেয়েটা রাতেও কিছু খায়নি। এখনো এতো টানাটানি করে এলাম আসলো না।তুমি মাঝে মাঝে এমন বোকার মতো কাজ করো কি বলবো।’

কোনো জবাব দিলো না তাহমিদ। সাবিহা তার স্ত্রীকে বোন বলেছে বলেই তার এতো রাগ। এটা তো এখানে বলতে পারবে না। বিবাহিত জানলে হয়তো আর তাকে নিয়ে স্বপ্ন বুনতো না।

____________________________________________

পরিশ্রান্ত অপরাহ্নে জানালার দিকে মুখ করে বসে আছে নাযীফাহ। মন মস্তিষ্ক তার বিক্ষিপ্ত। তাহমিদের রণমুর্তি যেন সে এখনো তার চোখ থেকে সরাতে পারছে না। তাহমিদের দিক থেকে তাহমিূ যেমন ঠিক তারও খুব খারাপ লাগছে। এভাবে না বললেও তো হতো।

ফাহিম বাসায় নেই। আমেনা বেগম ছাদে গিয়েছে বাইরে থেকে দরজা আটকে। নাযীফাহ’র কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না বলে জানালা দিয়ে নীল আকাশ দেখছে।

শব্দ করে দরজা আটকানোর আওয়াজে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠে নাযীফাহ’র। বাসায় তো কেউ যে রুমের দরজা আটকাবে। তাহলে কি,,,

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here