হৃদয়াবেগ #পর্বঃ১২,১৩

0
1301

#হৃদয়াবেগ
#পর্বঃ১২,১৩
#রূপন্তি_রাহমান (ছদ্মনাম)
১২

পশ্চাদভিমুখে আবর্তিত হয়ে তাহমিদ কে দেখে জানে পানি আসলো নাযীফাহ’র। বদ্ধ কামরায় সে আর তাহমিদ অন্তঃস্থলে এক নাম না জানা ঝড় বইতে শুরু করলো। সেই ঝড়ে নেই কোনো ভয়, নেই কোনো আশংকা। আছে শুধু এক রাশ ভালো লাগা, অজানা অনুভূতির সংমিশ্রণ, আসক্তি, অনুরাগ আর অভিরতি। তাহমিদ কে দেখে প্রফুল্লিত, আনন্দিত হলো হৃদয়। কিন্তু মুখে তা প্রকাশ করলো না। চেহেরায় এমন অভিব্যক্তি করলো যেন সে খুব বিরক্ত হয়েছে তাহমিদ কে দেখে। কাল এতো বকাবকির পরেও সে এই মুহূর্তে খুব করে তাহমিদের সঙ্গ চাইছিলো। কেন চাইছিলো এই প্রশ্নের উত্তর তার অজানা। তবে তাহমিদ তার আশেপাশে থাকলে মন খারাপেরা কাছে ঘেঁষতে পারে না।

নাযীফাহ’র অভিমানী মুখশ্রী দেখে তপ্ত, উষ্ণ শ্বাস ফেলে তাহমিদ। শ্লথ, মন্থর গতিতে নাযীফাহ’র পিছনে গিয়ে দাঁড়ায় সে। তাহমিদের প্রশস্ত বুকে এসে ঠেকে নাযীফাহ’র পিঠ।কম্পান্বিত হয় নাযীফাহ’র হৃদয়গহ্বর। বাইরে তা প্রকাশ করলো না সে। চোখমুখ খিঁচে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। নাযীফাহ’র অবস্থা কিছুটা আন্দাজ করে স্মিত হাসে তাহমিদ। নিজের মুখ নাযীফাহ’র কানের কাছে নিয়ে গেলো সে। চুল থেকে শ্যাম্পুর মাতাল করা সৌরভ আসছে। পরম আবেশে চুলে নাক ডুবাতে ইচ্ছে করছে তার। হাত মুষ্টিমেয় করে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলো সে। নম্র, মৃদুস্বরে বলল,

‘রেগে আছিস আমার উপর?’

নিশ্চুপ, নিশ্চল নাযীফাহ। শ্রবণগোচর হচ্ছে শুধু শ্বাস প্রশ্বাসের নিনাদ। অভিমানিনীর অভিমান দেখে মৃদুমন্দ, অক্রূর হাসলো সে।

‘রাগ কি খুব বেশি হয়েছে?’

এবারও নীরব, নিসাড়া রইলো সে। তাহমিদের অন্তঃস্থল নির্গত হলো দীর্ঘ নিঃশ্বাস। অভিমানিনীর অভিমান যে কতটা দুর্ভেদ্য, শঠতাপুর্ন তা তাহমিদের অজানা নয়। নাযীফাহ কে নিজের দিকে ফিরালো তাহমিদ। হাওয়ায় এলোমেলো হওয়া চুলগুলো পরম যত্নে গুঁজে দিলো কানের পিছনে। নাযীফাহ’র নত মস্তক উপরে তুলতেই দেখতে পেল নেত্রজলে টইটম্বুর কনীনিকা। তাহমিদের এমন স্নিগ্ধ শীতল স্পর্শ এবং আহ্লাদীপনায় ম্লান হলো নাযীফাহ’র নয়নবারি। প্রেয়সীর এমন ক্রন্দনরত মুখশ্রী দেখে নিজের সেই বহুদিনের আন্তরিক বাসনা, স্পৃহা আর দমিয়ে রাখতে পারলো না তাহমিদ। অর্ধাঙ্গিনীর ঘর্মাক্ত কপালে অধরের উষ্ণ স্পর্শ দিয়েই দিলো সে। শিরদাঁড়া বেয়ে তরল স্রোত বয়ে গেলো নাযীফাহ’র। পরম আবেশে দুইজন চোখ বন্ধ করে ফেলল।তাহমিদের উষ্ণ, সন্তপ্ত, অত্যষ্ণ মন শীতল হয়ে গেলো কয়েক সেকেন্ডে। ওষ্ঠে ফুটে উঠলো তৃপ্তি আর সন্তুষ্টির হাসি। তাহমিদের শার্ট খামচে ধরলো নাযীফাহ। অন্তঃস্থল তারও শীতল হয়ে এলো। মিনিট খানিক ওভাবেই থেকে দূরে সরে এলো তাহমিদ। তাহমিদের আকস্মিক কান্ডে লজ্জায় মাথা নত করে রাখলো নাযীফাহ।

‘যদি ভেবে থাকিস তোর অভিমান ভাঙানোর জন্য এমন করেছি তাহলে বলবো এটা আমার অধিকার। তোকে ছোঁয়ার পূর্নাঙ্গ অধিকার আমার আছে। কালকের বকাবকির জন্য কিছুই আমি বলবো না। আর না বলবো আমি ভুল করেছি। একটা সময় তুই আমার বোন ছিলি। তবে এখন আমাদের সম্পর্কের ধরন বদলেছে, মানে বদলেছে। আমরা নতুন একটা সম্পর্কে বাঁধা পড়েছি। এক ঘরে থাকি না বলে যে সম্পর্কের মানে বদলে যাবে এমনটা তো নয়। এখন তোর এই ভাই সম্বোধন এর জন্য তোকে যদি কেউ আমার বোন বলে আমার রাগ হওয়াটা কি স্বাভাবিক নয়? যেদিন আমার মতো যেদিন হবি সেদিন বুঝবি গতকালকের রাগের কারণ।’

এতটুকু বলে থামল তাহমিদ। তারপর পা থেকে মাথা পর্যন্ত নজর বুলালো নত মস্তকে দন্ডায়মান কিশোরীর দিকে। ‘কবুল’ বলে গ্রহণ করার পর অন্যরকম টান অনুভব করে এই মেয়েটার উপর। এটাই হয়তো বিয়ের মমার্থ। নাযীফাহ কে পুনশ্চ লজ্জায় ফেলার জন্য তাহমিদ কুটিল হেঁসে বলে,

‘মনের সাথে যু’দ্ধে পরাস্ত, অভিহত হয়ে যখন তোকে অন্যরকম ভাবে নিজের স্পর্শ দিয়েই ফেলছি তখন এমন হুটহাট স্পর্শের জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত থাক। হয়তো আমর্শ আরো গভীর হবে। একবার যখন তোর কপাল অব্দি আমার ঠোঁট পৌঁছে গেছে তখন আর এমন হুটহাট স্পর্শের জন্য নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ করে রাখতে পারবো না। আজ কপাল ছুঁয়েছি কাল হয়তো তোর অধর স্পর্শ,,,।’

এতোক্ষণ যাও একটু স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করছিলো নাযীফাহ। তাহমিদের এমন ধারা কথা শুনে লজ্জায় মিইয়ে গেলো সে। নাযীফাহ’র লাজুক, রক্তিমাভ মুখশ্রী দেখে ক্রূর হাসলো তাহমিদ। কিয়ৎকাল পার হলো। নাযীফাহকে স্বাভাবিক করার জন্য বলে উঠলো,

‘আমার অপ্রত্যাশিত রাগ, অমর্ষ হজম করতে গিয়ে তো রাতে খাওয়া দাওয়া করলি না সকালেও না। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি দু’জন একসাথে খাবো।’

নাযীফাহ চট করে বলে ফেলল,

‘আপনি তো ঠিকই খেয়েছেন। আমি সকালে দরজার আড়াল থেকে দেখেছি।’ বলেই জিভে কামড় দিলো সে।

বাগাড়ম্বরপূর্ণ, শব্দবহুল হাসলো তাহমিদ।

‘বসলেই খাওয়া হয়? কেউ একজন আমার জন্য খাওয়া দাওয়া করলো না। আর আমি দিব্যি খেয়ে নিবো? এতোটা পাষাণ, নির্দয় অন্তত আমি না। আমি যাচ্ছি তুই আয়।’ বলেই চলে গেলো তাহমিদ।

খাওয়া দাওয়া শেষ করে ড্রয়িং রুমে মাত্রই বসল দু’জন। খাওয়ার পুরোটা সময় তাহমিদ নাযীফাহ’র দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসলেও নাযীফাহ মাথা নত করে খাওয়া শেষ করে। তাহমিদের চোখে চোখ রাখার সাহস করে উঠতে পারেনি সে। আকস্মিক কলিংবেলের আওয়াজে ঘাবড়ে যায় নাযীফাহ। তড়িঘড়ি করে বুকে থুথু দেয় সে। তাহমিদ বিদ্রূপপূর্ণ দৃষ্টিপাত করে বলে,

‘কলিংবেলই বেজেছে বাঘ ভালুক তো আসে নাই যে এভাবে ঘাবড়ে যেতে হবে। মনে হয় দাদি আসছে তাড়াতাড়ি দরজা খোল।’

তাহমিদের কথায় কপাল কুঁচকে বিড়বিড় করতে করতে দরজা খুলে নাযীফাহ। দরজা খুলেই দেখতে পায় আমেনা বেগমের সূঁচালো, তীক্ষ্ণধার দৃষ্টি।

‘আমি তো বাইরে থেকে দরজা আঁটকে গিয়েছিলাম। তাহলে বাসায় কে এলো?’ তারপর তাহমিদকে বসে থাকতে দেখেই বিদ্রুপের সুর টানলো,

‘ওওওওওওওওও আপনি? তলে তলে সবাই টেম্পু চালায়।আর আমরা সাধারণ জনগণ হ’রতাল ভেবে মন খারাপ করি।’

তাহমিদ মোবাইলে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বলল,

‘কোনো এক সময় তোমরাও হ’রতাল, অ’বরোধ সবকিছু করেছো। এখন আমরা করলেই দোষ?’

____________________________________________

‘তোমাদের কতদিন হলো দেখি না মা। আমি না হয় না গেলাম গ্রামে তোমরা তো আসতে পারো। মোবাইলে দেখে কি আর বাবা মা দেখার তৃপ্তি মিটে? না আমি তোমার কোলে মাথা রাখতে পারি আর না তুমি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে পারো। তোমার মমতাময়ী, স্নেহশীতল স্পর্শ পাওয়ার জন্য আমার অন্তর কাঁদে মা।’ মোবাইল স্ক্রিনে মায়ের দিকে তাকিয়ে অসহায়, নিরাধার, বিবশ গলায় বলে উঠলো নাযীফাহ।

এপাশে মেয়ের কথা শুনে অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে গেলো ফাহমিদা বেগমের মুখ। তিনিও মেয়ের দিকে অসহায়, নিরুপায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। মেয়ের জন্য তারও অন্তর কাঁদে। রাতে বেলা মেয়ে ঘুমালে ঘুম থেকে উঠে তিনি কয়েকবার মেয়েকে দেখে যেতেন। কতদিন হলো মেয়েকে সামনা-সামনি দেখেন না। তিনি শুকনো,মলিন হেসে বলেন,

‘এই তো কয়েকদিন পরে ধান কা’টা পড়বে। নতুন ধান ঘরে তুলে তারপর ঢাকা যাবো। সাথে করে নিয়ে যাবো আতপচাল। তোর তো পিঠাপুলি পছন্দ। তোর ফুপু, ফুপাও যাবে। বেশ কয়েকদিন থেকে আসবো।’

____________________________________________

নিজেদের রুমে খুনসুটিতে মত্ত আমেনা বেগম আর নাযীফাহ। আমেনা বেগম উনার ছোট বেলার ঘটনা বলছেন আর নাযীফাহ হাসতে হাসতে লুটোপুটি খাচ্ছে। ঐ সময় রুমে প্রবেশ করে তাহমিদ। নিজেকে সামলে ঠিক হয়ে বসে নাযীফাহ। তাহমিদ কে মাথা নত করে ফেলে সে । তাহমিদ কে দেখলে তার লজ্জারা ভর করে। লোকটার চোখে চোখ রাখার সাহস তার হয় না। তাহমিদ স্বাভাবিক গলায় বলল,

‘তোর কলেজে ভর্তির জন্য আবেদন করেছিলাম। সিলেক্ট ও হয়েছিস। আমি যেই কোচিং-এ ক্লাস নেই সেখান থেকে রিক্সায় গেলে ১৫ মিনিটের দূরত্ব। কলেজ ছুটির পরে সেখানে একাডেমিক কোচিং ক্লাসও হয়। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর সেখানেও ক্লাস করবি তুই। তাহলে দু’জন একসাথে বাসায় আসতে পারবো। তোর কথা ভাবতে গিয়ে আলাদা চাপ নিতে হবে না আমার।’

‘তাহলে দু’জন একসাথে বাসায় আসতে পারবো’, এটা শুনে অধর জোড়া প্রসারিত হলো নাযীফাহ’র।

চলে গেলো তাহমিদ।

____________________________________________

পরদিন সকাল বেলা সবাই নাস্তার টেবিলে আসলেও তাহমিদ এলো না। আমেনা বেগম ডাকতেই সে বলল,

‘এখন আমার খিদে নেই দাদি।তোমরা খেয়ে নাও। আজকে কোচিং-এ আমার ক্লাস নেই। আজ বাসায় আছি যেকোনো সময় খেতে পারবো।’

বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলো নাযীফাহ। ভ্রু যুগল কুঁচকে এলো আমেনা বেগমের।

‘তুই দাঁড়িয়ে পড়লি কেন? তোর কি হলো?’

নিশ্চুপ, নীরব, নত মস্তকে দাঁড়িয়ে রইলো সে। আমেনা বেগম কিছুটা আন্দাজ করে বলেন,

‘তাহমিদের সাথে খাবি?’ মাথা নাড়ে নাযীফাহ।

ফাহিম খোঁচা দিয়ে কিছু বলার জন্য উদ্যত হতেই আমেনা বেগম চোখের ইশারায় না করে। চুপ হয়ে যায় ফাহিম। নিজের রুমে চলে গেলো নাযীফাহ। নাযীফাহ চলে যেতেই আমেনা বেগম ফাহিম কে বলেন,

‘সব সময় ওকে লজ্জা দিস না। বিশেষ করে এই বিষয়গুলোতে। মেয়েটা একটু একটু বুঝতে শিখছে। আমরা মজা নিলে কিন্তু সে লজ্জায় নিজেকে গুটিয়ে নিবে। বড় দাদু ভাইয়ের প্রতি ভালোবাসাটা আর প্রকাশ পাবে না।’

সম্মতিতে মাথা নাড়ে ফাহিম।

____________________________________________

কপালে হাত ঠেকিয়ে আধশোয়া হয়ে বসে আছে তাহমিদ। ফাহিম শব্দহীন পায়ে হেঁটে তাহমিদের পায়ের কাছে গিয়ে দিগ্বর্তী হলো। নির্বিরোধ গলায় ডাকল তাহমিদকে। তাহমিদ সেই অবস্থায় থেকে জবাব দিলো, ‘হুম?’

ভাইয়ের সাথে কথা বলতে গলা কাঁপছে ফাহিমের। কান্নাগুলো দলাপাকিয়ে গলায় আটকে আসছে।

‘আমি যে কোনো ভার্সিটিতে চান্স পেলাম না তুমি কি আমার উপর রেগে আছো? তোমার এখানে কোচিং করা কত ছেলে মেয়ে চান্স পেলো। আর আমি তোমার ভাই হয়ে ব্যর্থ। বিশ্বাস করো ভাইয়া আমি অনেক চেষ্টা করেছি।’

কপাল থেকে হাত নামিয়ে ছোট ভাইয়ের দিকে নেত্রপাত করলো তাহমিদ। ভাইয়ের আগুন লাল, রক্তিম বর্ণের চক্ষুদ্বয় দেখে ভীত, আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে যায় ফাহিম।

#চলবে

বানান ভুল ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

#হৃদয়াবেগ
#পর্বঃ১৩ (Bonus)
#রূপন্তি_রাহমান (ছদ্মনাম)

ভাইয়ের গাঁয়ে হাত চমকিত হয় ফাহিম। সারা শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। যার দরুন চক্ষুদ্বয় লাল আকার ধারণ করেছে। ফাহিম উচ্চস্বরে ডাকলো আমেনা বেগম আর নাযীফাহ কে। ফাহিমের আচমকা এমন ডাকে ঘাবড়ে যায় দু’জন। তড়িৎ গতিতে রুমে এসে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই তাহমিদ কে দেখে বুঝতে পারে ওর কিছু একটা হয়েছে। আমেনা বেগম তাহমিদের কপালে হাত দিয়ে নাযীফাহ কে বলে একটা বাটিতে পানি আর কাপড়ের টুকরো নিয়ে আসার জন্য। জলপটি দিতে হবে। নাযীফাহ এসব নিয়ে এলে চোখের ইশারায় বলে তাহমিদের কপালে জলপটি দেওয়ার জন্য। ফাহিম নিচে গিয়েছে গলির মোড়ের ফার্মেসীতে বসা ডাক্তার কে নিয়ে আসার জন্য।

নাযীফাহ অনবরত জলপটি দিয়ে যাচ্ছে। শরীরের তাপমাত্রা কমার কোনো লক্ষণ নেই। ডাক্তার জ্বর মাপার পর বলেছে ১০৪° জ্বর। আপাতত জ্বর কমার জন্য ঔষধ দিয়ে গেলেও বলেছে, যদি কালকের ভিতর জ্বর না কমে তাহলে যেন হাসপাতালে নিয়ে যায়। বার কয়েক ভিজা তোয়ালে দিয়ে শরীরও মুছে দেওয়া হয়েছে।

বিকাল তিনটা!

তাহমিদের শরীরের তাপমাত্রা নামতে শুরু করেছে। সে চোখ বন্ধ করে রাখলেও সব শুনতে পাচ্ছে। ভাইয়ের শিয়রের কাছে বসে ফাহিম বলল,

‘ভাইয়ার জ্বরের খবরটা মাকে দেওয়া দরকার।’

তৎক্ষনাৎ চোখ মেলে তাকায় তাহমিদ। তারপর দূর্বল গলায় বলল,

‘মাকে এসব বলিস না। আমরা দুই ভাই এখানে থাকি বলে এমনিতেই মায়ের টেনশনের শেষ নেই। এসব বললে মা পাগলামি করবে। তাছাড়া এখানে তো দাদি আছে। অযথা মাকে টেনশন দিস না।’

আমেনা বেগমও বললেন,

‘এখন এসব বলার দরকার নাই। যদি সকালের ভিতরে একেবারে জ্বর না ছাড়ে তখন বলা যাবে।’

ফাহিমেরও কথা গুলো যৌক্তিক মনে হলো। আমেনা বেগম নাযীফাহ’র কাছে এসে ওর মাথায় হাত রাখলো।

‘সকালে তো নাস্তা করলি না। এখনও দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো আয় কিছু একটা খেয়ে নিবি।’

বিস্ফোরিত নয়নে তাকায় তাহমিদ।

‘ও এখনো কিছু খায়নি?’

আমেনা বেগম প্রাণহীন, নির্জীব গলায় বললেন,

‘সকালে তুই পরে খাবি বলাতে ও বলেছিলো তোর সাথে খাবে৷ এরপর তো তোর এই অবস্থা। তোর কপালে জলপটি দিলো।খাওয়ার সুযোগ হলো কই?’

‘তাহলে এক প্লেটে খাবার নিয়ে আয়। তুইও খাবি আমিও খাবো।’

তাহমিদের এমন কথায় চোখ বড় বড় করে তাকায় নাযীফাহ। বিস্মিত গলায় বলে,

‘আপনি আমার হাতে খাবেন?’

শরীরের উষ্ণতার জন্য এমনিতেই চোখ লাল তাহমিদের। নাযীফাহ’র এমন কথায় চোখ গরম করে তাকায় সে। মুখ টিপে হাসলো আমেনা বেগম এবং ফাহিম।

____________________________________________

নাযীফাহ এক লোকমা ভাত তাহমিদের মুখে দিতেই তাহমিদের মনে হলো কেউ তার মুখে নিম পাতার রস ঢেলে দিয়েছে। ভাত মুখে নিয়ে থম মে’রে রইলো তাহমিদ। নাযীফাহ ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই তাহমিদ চোখ মুখ খিঁচে ভাত গলাধঃকরণ করলো তাহমিদ। তারপর ইশারায় নাযীফাহকে খেতে বলল।

তাহমিদের শরীরের তাপমাত্রা এই কমছে এই বাড়ছে। রাতে জ্বর হালকা কমতেই আমেনা বেগম বললেন,

‘নাযীফাহ তো ছোট ও তাহমিদের সাথে থাকতে পারবে না। আর ফাহিম তোরও রাতে না ঘুমালে মাথা ব্যথা করে।আমি বরং দাদু ভাইয়ের কাছে থাকি।’

নাযীফাহ আমতাআমতা করে বলল,

‘দাদি, বলছিলাম কি আমি থাকি? তুমিও অসুস্থ।’

আমেনা বেগম মলিন গলায় বললেন,

‘না রে বোন তুই পারবি না।তার চেয়ে ভালো আমিই থাকি।’

নাযীফাহ আমেনা বেগমের হাত দু’টো ধরে বলল,

‘আমার অন্য জায়গায় বিয়ে হলে তো সব কাজ করতে হতো সবাইকে আগলে রাখতে হতো।সেখানে তোমরা আমাকে একটা বিড়াল ছানার মতো যত্নে রাখছো। আমি না হয় উনার কাছে। যদি রাতে বেশি ছটফট করে তাহলে তোমাদের ডাকবো।’

ফাহিম এগিয়ে এসে নাযীফাহ’র মাথায় হাত রেখে বলল,

‘আমাদের ডানপিটে নাযীফাহ তাহলে একটু একটু করে বড় হচ্ছে।’

____________________________________________

মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে তাহমিদের মাথার কাছে বসেই ঘুমিয়ে পড়ে নাযীফাহ। মাঝরাতে গোংরানির শব্দে ঘুম ভেঙে যায় তার। তাহমিদের কপালে হাত দিয়ে বুঝতে পারে জ্বরের মাত্রা আবারও বেড়েছে। হাতের কাছের বাটি থেকে কাপড়ের টুকরো টা নিয়ে আবারও জলপটি দিতে শুরু করে সে। তাহমিদের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,

‘বেশি খারাপ লাগছে আপনার? দাদি কে ডাকবো?’

কোনো সাড়াশব্দ করলো না তাহমিদ। উঠে দাঁড়াতেই নাযীফাহ’র হাত শক্ত করে ধরে সে। চকিত হয় নাযীফাহ। শান্ত, নিস্তরজ স্বরে তাহমিদ বলে উঠলো,

‘তুই আমার পাশে থাক। আমার আর কাউকে লাগবে না। একটু ভালোবেসে মাথায় হাত বুলিয়ে দে।দেখবি আমার জ্বর কমে গেছে। কোথাও যাস না আমার কাছেই থাক। আমার শুধু তোর সঙ্গ চাই।’

বিড়বিড় করে ঘুমিয়ে গেলো সে। আর উঠে গেলো না নাযীফাহ। তাহমিদ মাথায় জলপটি দিতে লাগলো। তারপর একটা তোয়ালে ভিজিয়ে দুপুরের মতো আবারও বুক, হাত, গলা মুছে দিলো। তোয়ালেটা ওয়াশরুমে মেলে দিয়ে রুমে এসেই দেখলো তাহমিদ খাটে বসে আছে। নাযীফাহ কাছে এসে বসেই কপালে হাত দিয়ে বলল,

‘জ্বর কি ছেড়েছে?’

তাহমিদ তাকালে নাযীফাহ’র দিকে। চোখ দুইটা পূর্বের ন্যায় টকটকে লাল। নাযীফাহ প্রথমে ভয় পেলেও সামলে নিলো নিজেকে। অকস্মাৎ তাহমিদ নাযীফাহ’র বক্ষঃস্থলের দিকে ইশারা করে বলে,

‘ তোর এইখানে আমাকে একটু জায়গা দিবি? আমার অশান্ত মনটাকে একটু শান্ত করবি? তোর,,,’

আর কিছু বলার আগেই নাযীফাহ বলল,

‘আপনি পাগলামি করছেন। আমি দাদিকে ডেকে নিয়ে আসি।’

তাহমিদের সেই আগের উত্তর,

‘তুই কোথাও যাবি না। আমার শুধু তোকে প্রয়োজন। আচ্ছা থাক তোর বুকে আমাকে জড়িয়ে নিতে হবে না। কিন্তু আমার পাশ থেকে কোথাও যাবি না।’

বলেই শুয়ে পড়লো সে। নাযীফাহ বোকার মতো তাকিয়ে আছে আর তাহমিদের পাগলামি দেখছে। সেখানেই থম মে’রে বসে রইলো সে। আকস্মিকভাবে তাহমিদ নাযীফাহ’র কোলে মাথা রেখে পেটে মুখ ডুবিয়ে দিলো। তাহমিদের এহেম কান্ডে হতবিহ্বল হয়ে গেলো নাযীফাহ। সমস্ত কায়া কেঁপে উঠল তার। হৃদপিণ্ডের লব ডবের মাত্রা যেন কয়েকগুন বেড়ে গেলো। তাহমিদের শরীরের উষ্ণতা যেন নাযীফাহ’র শরীরেও ছড়িয়ে পড়ছে। নাযীফাহ কি করবে বুঝে উঠতে পারলো না। তাহলে কি তাহমিদ এই গভীর, প্রগাঢ়, আবেগময় স্পর্শের কথাই বলেছিলো?

তাহমিদ নাযীফাহ’র একটা হাত নিজের মাথায় রেখে বলল,

‘দেখ আমি কিন্তু তোর বুকে মাথা রাখিনি। তোর কোলে মাথা রেখেছি। এখন তোর আলতো হাতে আমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দে। আর কিচ্ছু লাগবে না।’ বলেই দু’হাতে পেট জড়িয়ে ধরলো।

নাযীফাহ পরপর কয়েকবার শুকনো ঢুক গিলে। তারপর কাঁপতে কাঁপতে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো তাহমিদের মাথায়।

____________________________________________

বিছানায় শুয়ে ছটফট করছেন ওয়াহিদা। আজ সকাল থেকেই মনটা অশান্ত তার। একে তো ধান কাটা পড়েছে তারপর কোনো কাজে মন বসাতে পারছে না সে। বুকে শুধু অজানা হাহাকার। রাত প্রায় শেষ হতে চলো কিন্তু উনার চোখে ঘুম নেই। এপাশ ওপাশ কখন থেকে করছেন কিন্তু শান্তি পাচ্ছেন না। সারা শরীর জ্বালাপোড়া করছে। আর থাকতে না পেরে জামান সাহেব কে ডাকলেন উনি। পরপর তিনবার ডাকার পরে পিটপিট করে তাকান জামান সাহেব। স্ত্রীর ফোলা ফোলা আঁখি দেখে ঘুম গায়েব হয়ে যায় উনার। তটস্থ, ভীত গলায় বললেন,

‘শরীর খারাপ লাগছে তোমার? আগে বলবে না।’

‘আমার শরীর ঠিকই আছে। মনে শান্তি পাচ্ছি না। আমার মন বলছে ছেলে দুইটা ভালো নেই। আপনি একটা ফোন দিন না।’ কাতর গলায় বললেন ওয়াহিদা।

জামান সাহেব মোবাইল হাতরে দেখলেন রাত দু’টো বাজে। স্ত্রীর হাত ধরে বললেন,

‘অনেক রাত হয়েছে ওয়াহিদা। কাল সকালে ফোন দেই? এখন যদি আমি ফোন করি তাহলে উল্টো ওরা ভয় পাবে। মনে করবে আমরা বোধহয় বিপদে। তুমি শুয়ে পড়ো আমি তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।’

____________________________________________

খুব সকালে ঘুম ভাঙে নাযীফাহ’র। তারপর নিজের অবস্থান আর তাহমিদের অবস্থান দেখে লজ্জায় মিইয়ে যায় সে।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here