হৃদয়াবেগ #পর্বঃ১৬,১৭

0
1146

#হৃদয়াবেগ
#পর্বঃ১৬,১৭
#রূপন্তি_রাহমান
১৬

চুপচাপ, নীরব থেকে সবাই খাওয়া শেষ করলো।একেবারে শেষ মূহুর্তে তাহমিদ নাযীফাহ কে বলল,

‘কাল সকালে রেডি হয়ে থাকিস কলেজে ভর্তি করতে নিয়ে যাবো।’

সম্মতিতে মাথা নাড়ে নাযীফাহ। খাওয়া শেষ হতেই আমেনা বেগম বলেন,

‘খাওয়া শেষ হলে নাযীফাহ আর ফাহিম নিঃশব্দে রুমে চলে যা। আমার বড় দাদু ভাইয়ের সাথে কিছু দরকারি কথা আছে।’

কুঁজিত হলো তাহমিদের কপাল। দাদির অভিমুখে দৃষ্টিপাত করে দাদির মতিগতি অর্থোদ্ধার করার প্রয়াস চালালো সে। কিন্তু দাদির গুরুগম্ভীর, রাশভারি মুখ দেখে কোনো কিছু ঠাহর করতে পারলো না সে। খাওয়া শেষে ফাহিম চলে গেলো। নাযীফাহ আহ্লাদী গলায় বলল,

‘ও দাদি আমি থাকি? আমি শুনবো তোমরা কি বলো।’

হাসি পেলো আমেনা বেগমের। তারপরও চেহেরার গাম্ভীর্যতা বজায় রেখে বলেন,

‘যা বলবো তা সহ্য করতে পারবি তো? নাকি লজ্জায় লাল নীল হয়ে যাবি? শুনলে সব কথা শুনতে হবে এবং উত্তর দিতে হবে। কথার মাঝখানে যাওয়া যাবে না।’

এসব শুনে আর এখানে থাকার সাহস হয়নি নাযীফাহ’র।এক ছুটে রুমে চলে গেছে। সবটা না বুঝলেও দাদির কথা শুনে কিছুটা আন্দাজ করতে পারলো কি বলবে। নীরবে, শব্দহীন হাসলো সে।

‘দাদু ভাই?’

‘হুম দাদি?’

‘কয়েকটা কথা বলি তোমাকে। নাযীফাহ তোমার বিয়ে করা বউ। তোমার কিন্তু হক আছে ওর উপর। তাকে কাছে পেতে তোমার ইচ্ছে করতেই পারে। নাযীফাহ এসব পাপ পূণ্য না বুঝলেও আমরা তো বুঝি। আমরা কিন্তু গুনাহের ভাগিদার হবো। তুমি যদি বলো এভাবে থাকবে না। তোমরা একসাথে থাকবে তাহলে আমি অনুষ্ঠানের কথা বলতে পারি তোমাদের মা বাবার সাথে।’

দাদির কথা শুনে অট্টহাস্য সে।

‘মনে মনে যা ভেবেছিলাম তাই বলেছো তুমি। আচ্ছা আমি কি কখনো কোনো ইঙ্গিত দিয়েছি যে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না? আজ বিয়ে না করলে আমি একা একা থাকতাম না বলো? আমি এখন ওই বাঁদরটার সাথে সংসার শুরু করলে ওর পড়াশোনা লাটে উঠবে। যদি কখনো মনে হয় নিজেকে আর সংযত করতে পারছি না। নিজের দৃষ্টি হেফাজত করতে কষ্টসাধ্য হচ্ছে বা আমি অন্য নারীতে আসক্ত হয়ে যাচ্ছি তখন তোমাকে আমি নিজে বলবো যে, দাদি আমার নাযীফাহ কে প্রয়োজন। নাযীফাহ’র এইচএসসি শেষ করার আগে অন্তত এসব বলো না। আপাতত না হয় পারিবারিক ভাবে অনুমোদন দেওয়া প্রেম করি। যাকে বলে সার্টিফিকেট প্রাপ্ত হালাল প্রেম।’

____________________________________________

সকালে রেডি হয়ে নাযীফাহ আর তাহমিদ মাত্রই বাসা থেকে বের হলো। সিঁড়ির কাছে এগিয়ে যেতেই পিছন থেকে ডাকল নিতুর মা। এক গাল হেসে জিজ্ঞেস করলো,

‘কোথাও যাচ্ছো বুঝি?’

তাহমিদ ব্যস্ত গলায় বলল,

‘নাযীফাহ কলেজে ভর্তি করাবো তাই বের হচ্ছি, ভাবি।’

নিতুর মা পুনশ্চ বলল,

‘তাহলে তো তাড়া বেশি। আর দেরি না করাই তোমাদের। আজকে আমার নিতুর জন্মদিন। সন্ধ্যায় তোমাদের দাওয়াত। ছোটখাটো পার্টি হবে।আসতেই হবে কিন্তু।’

তাহমিদ মৃদুস্বরে হেসে বলল,

‘আচ্ছা ভাবি আসবো।’

দু’সিঁড়ি নামতেই নিতুর মা নাযীফাহ কে শান্ত গলায় ডাকতেই পিছু ফিরে তাকালো সে। নিতুর মা মুচকি হেসে বলে উঠলো,

‘ মিয়া পাঞ্জাবি আর বিবি শাড়ি পড়ে আসতে হবে।’

নাযীফাহ অসহায়, মলিন গলায় বলল,

‘আমি শাড়ি সামলাতে পারি না।’

নাযীফাহ’র কথাকে পাত্তা না দিয়ে নিতুর মা বলল,

‘কয়েক ঘন্টার জন্যে শাড়ি গায়ে জড়ালে কিছু হবে না।’

নাযীফাহ নিরাধার চক্ষে তাকালো তাহমিদের দিকে।তাহমিদ সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে বলল,

‘আমার দিকে এভাবে তাকাবি না।এসব বিষয়ে আমি কিছু জানি না।’

____________________________________________

ভর্তি কার্যক্রম শেষ করে মাত্রই কলেজ থেকে বের হলো দু’জন। নাযীফাহ কে উদ্দেশ্য করে তাহমিদ বলল,

‘এখান থেকে কোচিং সেন্টার মাত্র পনেরো মিনিটের রাস্তা। চল হেঁটে যাই তাহলে আশপাশ টা দেখতে পারবি।’

নাযীফাহ ও এক গাল হেসে সম্মতি জানালো। পথিমধ্যে তাহমিদের কল আসায় কথা বলতে বলতে সামনে এগিয়ে গেলো সে। হোঁচট খেয়ে জুতোর ফিতা খুলে গেলো তার।বিরক্তিতে ‘চ’ উচ্চারণ করে ফুটপাতে বসেই জুতার ফিতা লাগাতে লাগলো। মাথা তুলে তাকাতেই দেখলো একটা বাস বেপরোয়া গতিতে তার দিকে ধেয়ে আসছে। হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে গেলো সে। হাত পা অসাড় হয়ে গেলো তার। ভয়ে, আতংকে চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে রইলো সে।

একটানে নাযীফাহ কে বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো তাহমিদ। সারা শরীর কাঁপছে তার। শক্ত করে নিজের সাথে জড়িয়ে রাখলো। এই তো এখনই সব শেষ হয়ে যেতো আর একটু হলে।

তাহমিদের পিঠ খাঁমচে ধরলো নাযীফাহ। কয়েক সেকেন্ড আগেও সে মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করেছে সে। তাহমিদের বুকে মাথা রেখে হার্টবিট শুনতে লাগলো নাযীফাহ ।যা খুব দ্রুত গতিতে উঠানামা করছে। ভয়ে, আতংকে এক পর্যায়ে নাযীফাহ কেঁদে দিলো।

মোটামুটি ভিড় জমে গেছে জায়গাটায়। লোকজন বলাবলি করছে, ‘মেয়ের দোষ নাই। প্রতিযোগিতা করে এসব চালকরা গাড়ি চালায় আর রাস্তার সাধারণ মানুষ প্রাণ দে’য়। আর একটু হলেই মেয়ের গায়ের উপর দিয়ে চালিয়ে নিতো। ভাগ্যিস ছেলেটা দৌড়ে এলো।’

কান্নার আধ্বান তাহমিদের কানে বাজতেই লোকজনকে তোয়াক্কা না করে নাযীফাহ’র মুখটা তুলেই এলোপাতাড়ি অধর ছোঁয়াতে লাগলো প্রেয়সীর চোখে মুখে। তাহমিদের এমন আদর মাখা স্পর্শ পেতেই ফুঁপিয়ে উঠলো নাযীফাহ। তাহমিদ কোনোদিক না তাকিয়ে নাযীফাহ’র হাতটা শক্ত করে ধরে এগিয়ে গেলো সামনের দিকে। তার চোখে শুধু ভাসছে বাসটা কিভাবে ধেয়ে যাচ্ছিলো নাযীফাহ’র দিকে। কিছুটা পথ এগিয়ে যেতেই তাহমিদের বয়সী একটা ছেলে পিছু ডাকল ওদের।

‘এক্সকিউজ মি! একটু শুনবেন আপনারা?

তাহমিদ পিছনে ফিরে তাকাতেই ছেলেটা দৌড়ে এসে হাঁপাতে লাগলো। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো তাহমিদ। কিয়ৎকাল পরে ছেলেটা প্রফুল্লচিত্তে, অম্লান কন্ঠে বলল,

‘আপনার গার্লফ্রেন্ড হয় বুঝি?’

কপাল কুঁজিত করে তাকিয়ে রইলো তাহমিদ। ছেলেটা পুনশ্চ উৎসাহ নিয়ে বলে,

‘বলেন না ভাইয়া আপনার গার্লফ্রেন্ড হয়।’

না বোধক মাথা নাড়ে তাহমিদ। ছেলেটার কপালে ভাঁজ পড়লো। গোমড়া মুখে বলে,

‘তাহলে?’

তাহমিদ অম্লান হেসে বলে,

‘শুধু প্রেমিকা না। একেবারে সরকারি অনুমোদন গৃহীত প্রেমিকা।’

নাযীফাহ’র একটা হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,

‘সার্টিফিকেট প্রাপ্ত হালাল প্রেমিকা আমার।’

ছেলেটা মুচকি হেসে বলে,

‘বউ?’

প্রশ্নের জবাবে তাহমিদও মুচকি হেসে বলে,

‘বউ ঠিক আছে। তবে আগে সে প্রেমিকা হিসেবে উত্তীর্ণ হবে। তারপর বউ হবে।’

‘খুব ভালোবাসেন বুঝি?’

প্রশ্ন শুনে তাহমিদ নাযীফাহ’র দিকে তাকালো। লজ্জায় মাথা নত করে রেখে সে। ছেলেটা তাহমিদের সাথে হ্যান্ডশেক করে বলে,

‘তখন আপনার পাগলামি দেখে ভেবেছিলাম আপনার প্রেমিকা হয় বুঝি। তাই নিজেকে দমিয়ে না রেখে জিজ্ঞেস করলাম। কিছু মনে করেননি তো?’

তাহমিদ মৃদু হেসে বলে,

‘মনে প্রশ্ন জেগেছে তাই জিজ্ঞেস করেছেন। এখানে কিছু মনে করার কি আছে।’

কোচিং সেন্টারের দিকে আর যাওয়া হলো না ওদের। সোজা বাসায় চলে গেলো ওরা।

____________________________________________

বিকেলের দিকে নাযীফাহ’র হাতে একটা শাড়ি তুলে দেয় তাহমিদ। শাড়ি দেখে কাঁদো কাঁদো হয়ে তাকালো সে তাহমিদের দিকে। তাহমিদ সান্ত্বনা দিয়ে বলল,

‘কয়েক ঘন্টার ব্যপারই তো কষ্ট করে হয় একটু সামলে নিস।তাছাড়া আমি আছি তো।’

আমেনা বেগমের সাহায্যে প্রায় এক ঘন্টা সময় নিয়ে শাড়ি গায়ে জড়িয়েছে নাযীফাহ। এখানে সেখানে এবং যেখানে যেভাবে পারে সেভাবেই সেফটিপিন দিয়ে আঁটকেছে সে। কিছুক্ষন আগেই আমেনা বেগম আর ফাহিম নিতুদের বাসায় গেলো। তাহমিদ নাযীফাহ কে ডাকতে এসেই যেন পলক ফেলতে ভুলে গেলো। হার্টবিট থেমে গেলো তার।সারা শরীরের র’ক্ত চলাচল বন্ধ হওয়ার উপক্রম। নিষ্পলক, নিশ্চল হয়ে তাকিয়ে রইলো নাযীফাহ’র দিকে। খোলা চুল, দুই ভ্রুর মাঝে এক রত্তি টিপ, অধর জোড়ায় লাল লিপস্টিক। তাহমিদের এক হাত চলে গেলো বুকের বা পাশে। আচমকা তাহমিদ কে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বুকে থুথু দেয় নাযীফাহ। তারপর তাহমিদের পাঞ্জাবি নজরে আসতেই বলল,

‘ওমা আপনার পাঞ্জাবির সাথে তো আমার শাড়ি একেবারে মিলে গেলো।’

তাহমিদ নিজেকে সামলে দৃষ্টি নত করে বলল,

‘কিনেছিলাম কাপল সেট আরো আগে। তাই মিলে গেছে।’

____________________________________________

জন্মদিনের অনুষ্ঠান প্রায় শেষের পথে। রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার অর্ডার করায় এতো ঝামেলা হয়নি। হালকা পাতলা যা গেস্ট এসেছিলো প্রায় সকলেই চলে গেছে। নিতুর মা তাহমিদ এবং নাযীফাহকে থাকতে বলেছে দরকারী কথা আছে বলে। নাযীফাহ নিতুর সাথে খেলছে। কেক কা’টা’র পরপরই আমেনা বেগম এবং ফাহিম বাসায় চলে গেছে। মেহমান যখন সব চলে গেলো তখন নিতুর মা তাহমিদ কে একপাশে ডেকে এনে বলল,

‘কি ব্যপার মিয়া বিবির কাছাকাছি না থেকে দূরে দূরে পালিয়ে বেড়াচ্ছে কেন? ঝগড়া হলো নাকি?’

মৃদুস্বরে হেসে বলে তাহমিদ,

‘তাহলে আপনার চোখে ধরা পড়ে গেছি।’

নিতুর মা বাঁকা হেসে বলে,

‘জহুরির চোখ ভাই ধরা তো পড়তেই হতো। এখন বলো সমস্যা কি?’

তাহমিদ পরপর কয়েকটা শুকনো ঢুক গিলে বলল,

‘শাড়িতে নারীর সৌন্দর্য কয়েকগুণ বেড়ে যায়। বিয়ের দিন এতোটা খেয়াল না করলেও আজ আমি ওর থেকে দৃষ্টি ফিরাতে পারছি না। ওর কাছে পাশে থাকলে যেকোনো একটা ভুল হয়ে যাবে। আর আমি নাযীফাহ’র এইচএসসি কমপ্লিটের আগে কোনো ভুল করতে ইচ্ছুক না। আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখলে কোনো একদিন ওকে শাড়ি পড়িয়ে আমার সামনে সারাদিন বসিয়ে রাখবো।’

তাহমিদের কথা শুনে কিছু একটা ভাবলো নিতুর মা। তারপর চোখেমুখে হাসির রেখা টেনে বলে,

‘ছোটখাটো ভুল করাই যায় বলো।আবার সেই ভুলকে ফ্রেমবন্দীও করা যায় তাই না? তুমি কর্নারের রুমে যাও আমি এক্ষুনি নাযীফাহকে নিয়ে আসছি। তাহমিদ নিতুর মায়ের কোনো কথা না বুঝে হ্যাবলাকান্তের মতো কর্নারের রুমে যেতে লাগলো। মিনিট পাঁচেক বাদেই নিতুর মা এক হাতে ক্যামেরা আর আরেক হাতে নাযীফাহ কে টানতে টানতে এই রুমে নিয়ে এলো। নাযীফাহকে তাহমিদের পাশে দাঁড় করিয়ে বলল,

‘একেবারে মেইড ফর ইচ আদার। এখন তাহমিদ চটপট করে নাযীফাহ’র কপালে চুমু দাও। আমি এই পবিত্র মুহূর্তটাকে ফ্রেমবন্দী করবো।’

মুখে কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখালেও মনে মনে হাসলো তাহমিদ। আর নাযীফাহ চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে নিতুর মায়ের দিকে। নিতুর মা নাযীফাহ’র মনের ভাব বুঝতে পেরে বলল,

‘কয়েক সেকেন্ডের ব্যপারই তো। দু’জনের ম্যাচিং ড্রেস তাই ভাবলাম একটা বিশেষ মুহূর্তের স্মৃতি হিসেবে ছবি তুলে রাখি।’

তাহমিদ কয়েক পা এগিয়ে এসে নাযীফাহ’র মুখোমুখি দাঁড়ালো। লজ্জায় মিইয়ে গেলো নাযীফাহ।

তাহমিদ নিজের ওষ্ঠের উষ্ণ স্পর্শ দিলো নাযীফাহ’র ললাটে। পরম আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেলল সে। ঘনঘন শ্বাস ফেলতে লাগলো নাযীফাহ। মুচকি হাসছে নিতুর মা। কয়েক সেকেন্ড পরে নাযীফাহ তার গণ্ডদেশে পানির অস্তিত্ব অনুভব করতেই চট করে চোখ মেলে তাকালো। তাহমিদ এখনো চোখ বন্ধ করে আছে। নিতুর মা আতঙ্কগ্রস্ত গলায় বলল,

‘কি হলো তাহমিদ তুমি কাঁদছো কেন?’

নিতুর মায়ের গলা যেন তাহমিদের কর্ণকুহর অব্দি পৌঁছালো না।আচমকা তাহমিদ,,,,

#চলবে

বানান ভুল ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

#হৃদয়াবেগ
#পর্বঃ১৭
#রূপন্তি_রাহমান (ছদ্মনাম)

আচমকা তাহমিদ নাযীফাহ কে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো। তাহমিদের বলিষ্ঠ হাতের বাহুডোরে আবদ্ধ নাযীফাহ। তাহমিদের আকস্মিক কান্ডে চমকিত, হতবিহ্বল সে। তাহমিদের সমস্ত গতিবিধি, কার্মকান্ড সবই যেন মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে তার। নাযীফাহ’র মন মস্তিষ্ক কোনো কিছুই যেন অর্থোদ্ধার করতে পারছে না। তাহমিদের ফুঁপানোর ফলে সমস্ত কায়া কম্পিত হচ্ছে।

নিতুর মা যেন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলো। কোনোকিছুই বোধগম্য হচ্ছে না উনার।ইন্দ্রিয় যেন বুঝেও বুঝতে পারছে না কিছু। হাতের ক্যামেরাটা একপাশে রেখে দ্রুত কদম ফেলে অগ্রসর হলো তাহমিদের অভিমুখে। তাহমিদের কাঁধে হাত রাখলেন উনি। নিসাড়া তাহমিদ। নিতুর মায়ের স্পর্শ যেন ষষ্ঠইন্দ্রিয় ধারণ করতে অক্ষম। একটু ধাক্কা দিতেই চেতনা ফিরে পেলো সে। নিতুর মা বিস্মিত গলায় জিজ্ঞেস করলেন,

‘কি হয়েছে তাহমিদ? এভাবে বাচ্চাদের মতো কাঁদছো কেন? কিছুক্ষণ আগেও তো ভালো ছিলে। হঠাৎ কি হলো?’

অকস্মাৎ তাহমিদ নাযীফাহ’র সামনে হাঁটু গেড়ে বসলো পড়লো। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে নিতুর মা। তাহমিদ নাযীফাহ’র হাত দু’টো নিজের আজঁলায় নিয়ে ললাট ঠেকালো। কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল,

‘ আজ আর একটু হলে সবকিছুর পরিসমাপ্তি এখানেই ঘটতো। সকল মনের টান, অপ্রকাশিত অনুভূতি, আবেগ, অনুরক্তির ইতি এখানেই টানতে হতো আমার । ভাবি, এই মেয়েটা কেন বুঝে না ওর কিছু হলে আমার পুরো পৃথিবীটাই উলোটপালোট হয়ে যায়। অন্তঃস্থলে বয়ে যায় ভয়ঙ্কর প্রলয়। কেন একটু সবদিক নজর রাখে না? একটু আধটু নিজের খেয়াল রাখলে কি অনর্থ হয়ে যাবে? হারিয়ে ফেলবো মনে করে নিজের কাছে এনেছি এখানে এসেও এমন হলো। সেসময় নিজেকে বড্ড ব্যর্থ মনে হচ্ছিল।’

সকালের সেই মুহূর্তের কথা মনে পড়তেই সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠলো নাযীফাহ’র। গলা শুকিয়ে গেলো তার। আজ হয়তো তার জীবনের শেষ দিন হতে পারতো। নিঃশ্বাস নেওয়ার অবসান ঘটলেও ঘটতে পারতো। নাযীফাহ’র কয়েক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল এটাই হয়তো তার তাহমিদের সাথে কাটানো শেষ মুহূর্ত।

‘সকালে কি হয়েছে একটু খোলাখুলি বলবে?’ নিতুর মায়ের আতংকিত, চিন্তিত কন্ঠস্বর।

ফ্লোরে হাঁটু গেড়ে নিশ্চুপ বসে রইলো তাহমিদ। তাহমিদের কাছ থেকে কোনো জবাব না পেয়ে নিতুর মা নাযীফাহ’র দিকে তাকালো। নাযীফাহ সকালে ঘটনা থেমে থেমে বলতেই আঁতকে উঠলেন তিনি। ভয়ার্ত গলায় বললেন,

‘আজ অনেক বড় ফাঁড়া গেছে তোমার উপর দিয়ে। আজ অনেক কিছুই হতো পারতো। হয়তো হায়াত ছিলো বলেই রক্ষা পেয়েছো। স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলেও তাহমিদ হয়তো ট্রমা থেকে বের হতে পারছে না।’

চুপ হয়ে গেলো নিতুর মা। চোখের ইশারায় বললো তাহমিদ বসা থেকে উঠানোর জন্য। ইশারা বুঝতে পেরে তাহমিদ কে টেনে দাঁড় করালো। নত মস্তকে, বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তাহমিদ। নিতুর মা পুনশ্চ নাযীফাহ কে ইশারা করলো তাহমিদ কে জড়িয়ে ধরার জন্য। এবার আর লজ্জা গ্রাস করতে পারলো না নাযীফাহ কে। কারণ তাহমিদ এমন নিস্তব্ধতা, বিমূঢ়তা দেখে তার বক্ষঃপিঞ্জরে আকস্মিক ঝড়ে উলোটপালোট হয়ে যাচ্ছে সবকিছু। সম্মুখে দন্ডায়মান যুবকের এমন বিষাদভারাতুর, নির্জীবতা মানায় না। অপ্রত্যাশিতভাবে তাহমিদের বক্ষের ঠিক বা পাশে আলতো করে মাথা রাখলো নাযীফাহ। তাহমিদ দু’হাতে আগলে নিলো নাযীফাহ কে। মৃদুস্বরে হাসলো নাযীফাহ। এই লোকটাকে চক্ষের সামনে দেখলে শান্তি অনুভব হয়। আর যখন বিড়াল ছানার মতো বুকে আগলে নেয় তখন এই প্রশস্ত, চওড়া বুকটাকে নিরাপদ স্থান মনে হয়।

‘নাযীফাহ হয়তো ভাগ্যবতী নারীদের মধ্যে একজন। তোমাকে হারানোর ভয়ে, শংকায় কোনো এক পুরুষ বাচ্চাদের ন্যায় কাঁদছে। এর থেকে বড় পাওয়া কি হতে পারে। তোমাকে যেমন আগলে রাখে তুমিও আগলে রেখো। ভালোবাসার মানুষকে আগলে রাখা জন্য বয়স না হৃদয়গহ্বরে ভালোবাসা থাকা লাগে। কি না হওয়া দেবদাস? একটুতে এভাবে ভেঙে পড়লে চলে? বিপদ আপদ যে কোনো সময় আসতে পারে। পুরুষ কে মানসিকভাবে শক্ত থাকতে হয়।’

তাহমিদ প্রাণহীন, নিস্তেজ হাসলো। অক্লিষ্ট গলায় বলল,

‘ভাবি, পুরুষ মানুষ নিজের আসন্ন বিপদে ডরায় না। যতটা কাছের মানুষের বিপদ, ঝুঁকির কথা চিন্তা করে ডরায়।’

‘আমি জানি তাহমিদ, পুরুষ মানুষ পুরো পৃথিবীর সাথে লড়াই করতে পারলেও এরা নারীর কাছে এসে দূর্বল হয়ে যায়।হউক সে মা, বোন, মেয়ে কিংবা বউ। নিতুর জন্মের সময় আমার কিছু কমপ্লিকেশন ছিলো। সেই ভয় থেকে লোকটা আজ পর্যন্ত আমাকে দ্বিতীয় বার মা হওয়ার জন্য কিছু বলে না। আমার শ্বাশুড়ি মা-রা যাওয়ার পর থেকে লোকটা সম্পূর্ণ আমার উপর নির্ভরশীল হয়ে গেছে। আমি বাচ্চার কথা বললে লোকটা মাঝে মাঝে কি বলো জানো? ‘ তুমি আছো, নিতু আছে আমার আর কিছু চাই না। মা মা-রা যাওয়ার পরে তুমি আমাকে সামলে নিয়েছো। তোমাকে হারালে আমি থাকতে পারবো না। আমার এক সন্তানই যথেষ্ট। আর লাগবে না।’ আলহামদুলিল্লাহ তাহমিদ নিজেকে মাঝে মাঝে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হয়। তবে আজ আমি অন্য এক তাহমিদ কে দেখলাম। যার আগের রূপ আর আজকের রূপ সম্পূর্ণ ভিন্ন। আকাশ পাতাল তফাৎ।’

আর দাঁড়ালো এখানে। দ্রুত প্রস্থান করলো কক্ষ থেকে। এরা একটু সময় কাটাক। নাযীফাহ তাহমিদের দিকে তাকিয়ে মৃদু শব্দে বলল,

‘ছাদে যাবেন? সুবিশাল আকাশের মধ্যিখানে মস্ত বড় চাঁদ উঠেছে। চাঁদ দেখবেন?’

তাহমিদ প্রশস্ত হেসে বলে উঠলো,

‘আয় তবে। এক চাঁদ কে সাথে নিয়ে আরেকটা চাঁদ দেখবো।’

লাজুক হাসলো নাযীফাহ। নিতুর মাকে দরজা বন্ধ করার কথা বলে বাসা থেকে বেরিয়ে দু’জন।

____________________________________________

ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে দু’জন। তমসাচ্ছন্ন, কৃষ্ণাভ এই রজনীতে আলো ছড়াচ্ছে চন্দ্রমা। চারিদিকে নিস্তব্ধতা বিরাজমান। শুধু দু’জনের শ্বাস প্রশ্বাসের মৃদু শব্দ শ্রবণগোচর হচ্ছে।
তাহমিদ নাযীফাহ’র আঙুলের ভাঁজে আঙুল রেখে বলে,

‘চল ওখানে বসে চাঁদ দেখি। তুই দেখ অন্তরীক্ষের চাঁদ আর আমি দেখি মা বাবার আমার জীবনে এনে দেওয়া চাঁদকে।’

তাহমিদের কথা কর্ণগোচর হতেই লজ্জায় মিইয়ে গেলো নাযীফাহ।

দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে চন্দ্রসুধা গায়ে মাখছে দু’জন। একটা সময় পর তাহমিদ খেয়াল করলো তার কাঁধে মাথা রেখে গভীর নিদ্রায় তলিয়ে গেছে নাযীফাহ। নিদ্রামগ্ন নাযীফাহ’র ভারী নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ছে চারপাশে। তপ্ত শ্বাস ফেলল সে। তন্দ্রা রাণী তার আঁখি পল্লবেও ভর করেছে। নাযীফাহ’র ঘুমন্ত দেহকে একহাতে আগলে নিয়ে মাথায় ঠোঁট ছুঁয়ালো তাহমিদ। তারপর নাযীফাহ’র মাথাটা কাঁধ হতে ছাড়িয়ে বুকের সাথে মিশিয়ে কিছু সময়।

‘কিছু কিছু অসম্ভব সুন্দর মুহূর্ত তোর অচেতন অবস্থায় কেন তৈরি হয়? একা একা আমিই কেন শুধু সেসব সন্ধিক্ষণ অনুভব করি? কবে দু’জন একসাথে এইসব ছোট ছোট মুহূর্তকে হৃদয়ঙ্গম করবো?’ একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে দ্বিতীয় বারের মতো কোলে তুলে নিলো নাযীফাহ কে।

ফ্ল্যাটের সামনে এসে কলিংবেল চাপতেই প্রায় মিনিট দশেক পরে ঘুম ঘুম চক্ষু নিয়ে দ্বার খুলে আমেনা বেগম। তাহমিদের কোলে ঘুমন্ত কিশোরীকে দেখে কুটিল হেঁসে ব্যঙ্গ করে বলেন,

‘আহারে বউ প্রেম করতে করতে ঘুমিয়ে গেলো? তা প্রেমালাপ শুরু করেছিলি নাকি এর আগেই?’

‘তুমি আসলেই দাদি,,,,’

____________________________________________

নাস্তার টেবিলে বসে আছে সবাই। রুটির টুকরোটা মুখে দিয়ে ফাহিম তাহমিদ কে বলল,

‘ভাইয়া তুমি না চাকরির জন্য এপ্লাই করেছিলে কি হলো?’

ভাইয়ের কথার জবাবে তাহমিদ বলে,

‘এমবিএ কমপ্লিট করার পরে চাকরি নিবো। ছয়মাস পরে এমবিএ পরীক্ষা। এডমিশনের কোচিং তো শেষ। কয়েকদিন পরে একাডেমি কোচিং শুরু হবে। এখানেই আছি এখানেই থাকি। নিজের পড়াশোনাও চলছে পার্ট টাইম জবও হচ্ছে।’

কথা মাঝে ফোঁড়ন কাটে নাযীফাহ।

‘আমার ক্লাস শুরু হবে কবে থেকে?’

তাহমিদ নাযীফাহ’র দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,

‘ভূতের মুখে রামনাম। দ্যা গ্রেট নারীফাহ জিজ্ঞেস করছে পড়াশোনার কথা?

নাযীফাহ চোখ মুখ কালো করে তাকিয়ে রইলো তাহমিদের দিকে। নাযীফাহ’র মুখের ভাবভঙ্গি দেখে শব্দযোগে হাসল তাহমিদ। ফাহিম বিদ্রুপ করে বলে,

‘তোকে পুরো হূলো বিড়ালের মতো লাগছে। মনে হচ্ছে কেউ তোর সামনে মাছের কাঁটা নিয়ে গেছে।’

ফাহিমের কথায় রাগে ফোঁসছে নাযীফাহ। নাযীফাহ’র রাগ দেখে মুচকি মুচকি হাসছে তাহমিদ।

‘সপ্তাহ খানেক পরে তোর ক্লাস শুরু হবে। তার আগে কলেজ ড্রেস বানাতে হবে। আজ বিকেলে হাঁটতে বের হলে টেইলর্সের দোকানে যাবো।’

তাহমিদ আর ফাহিম বাসা থেকে বেরিয়ে যেতেই নাযীফাহ আমেনা বেগমকে জড়িয়ে ধরে আহ্লাদী গলায় আবদারের স্বরে বলল,

‘ও দাদি আমাকে রান্না করা শিখাবে? ফুপি বলেছে তোমার হাতের রান্না নাকি খুব মজা।’

আমেনা বেগম বিস্ফোরিত চোখ নাযীফাহ’র দিকে তাকিয়ে রইলেন।

‘ও দাদি না বলবে না কিন্তু।’

আমেনা বেগম মুচকি হেসে বলেন, ‘আচ্ছা ঠিক আছে।’

____________________________________________

রাত পোহালে নতুন সপ্তাহ। আজ শুক্রবার বিধেয় সবাই বাসায়। তাহমিদ দুপুরে খাবার খেয়ে ঘুমিয়েছে এখনো ওঠেনি। ফাহিম মাত্রই বাসা থেকে তড়িঘড়ি করে বের হলো। মনে হয় খুব তাড়া তার। ফাহিমের যাওয়ার পানে বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইলো নাযীফাহ। ঠিক বিশ মিনিটের মাথায় কলিং বেল বেজে উঠলো। দরজা খুলে সামনে তাকিয়ে আঁতকে উঠল সে।

#চলবে

বানান ভুল ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here