হৃদয়াবেগ #পর্বঃ১৮,১৯

0
1106

#হৃদয়াবেগ
#পর্বঃ১৮,১৯
#রূপন্তি_রাহমান (ছদ্মনাম)
১৮

সম্মুখে দন্ডায়মান কালো বোরকায় আপাদমস্তক আবৃত এক নারী। শুধু চক্ষুদ্বয় উন্মুক্ত। নিজের মাকে দেখে চিনতে এক মুহূর্ত দেরি হলো নাযীফাহ’র। অসাড় হয়ে গেলো তার কায়া।আচমকা ফুঁপিয়ে উঠে এলোমেলো পায়ে হেঁটে গিয়ে মাকে ঝাপটে ধরলো সে। মায়ের বুকে মাথা রেখে নীরবে নেত্রজল পরিত্যাগ করছে । ফাহমিদা বেগম মেয়ের মাথায় পরম মমতায়, স্নেহশীতল স্পর্শ দিতে লাগলেন। মায়ের আদুরে ছোঁয়া পেয়ে নাযীফাহ’র ক্রন্দনের অনুভূমিকত্ব যেন আরো প্রগাঢ় হলো। আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো সবাই। ফাহমিদা বেগম ঠোঁট ছুঁয়ালেন আত্মজার ললাটে।

‘নিজেকে ঢেকে রাখার পরও চিনে ফেললি?’

অনবরত কেঁদেই চলেছে নাযীফাহ। কনীনিকার বর্ষন যেন সময়ের সাথে সাথে ভারী হচ্ছে। কোনো রকম নাক টেনে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,

‘কালো কাপড় দিয়ে যদি তোমার চক্ষুদ্বয় ঢেকে রাখতে তাও চিনে নিতাম। তোমার গায়ের মিষ্টি গন্ধটা আমি এক মাইল দূর থেকে পাই।’

‘শুধু মা না বাবাও যে এসেছে সেদিকে কি কারো খেয়াল আছে?’ খালেদ মোশাররফের শান্ত, শীতল স্বর।

মেয়েরা স্বভাবতই বাবার আদুরে হয়। বাবার সংস্পর্শে আহ্লাদী হয়ে উঠে মুহূর্তেই। দুনিয়া একদিকে তো বাবা আরেকদিকে। বাবার স্নিগ্ধশীতল গলার স্বর নাযীফাহ শ্রবণগোচর হতেই এইবার ঠোঁট উল্টে শব্দ করে কেঁদে দিলো সে। খালেদ মোশাররফ কয়েক পা এগিয়ে এসে পরম মমতায়, স্নেহার্দ্রতায় মেয়েকে বুকে আগলে নিলেন। বাবার বুকে মাথা রেখে একাধারে হেঁচকি দিয়েই কেঁদেই চলেছে নাযীফাহ।

‘এসব কান্নাকাটি বন্ধ করে যদি এই অধমের ছোট্ট বাসায় পায়ের ধূলো দিতেন তো আমি ধন্য হয়ে যেতাম। যেভাবে কান্নাকাটি শুরু হয়েছে বিল্ডিং না ভেসে যায়।’

দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল কথাগুলো বলল তাহমিদ।

ওয়াহিদা বেগম বিষন্ন, মেঘমেদুর কন্ঠে বললেন,

‘এতো খানি পথ ফাঁড়ি দিয়ে আমরাও এসেছিলাম। না ছেলে দু’টো কাছে এলো আর ছেলের বউ।’

মায়ের কথা শুনে আহাম্মক হয়ে গেলো ফাহিম। মায়ের দিকে ক্যাবলাকান্তের মতো তাকিয়ে বলে,

‘ইয়া বড় বড় দু’টো লাগেজ হাতে নিয়ে তোমাকে জড়িয়ে ধরবো?’

ফাহিমের কথা কে পাত্তা না দিয়ে ওয়াহিদা বলেন,

‘শুন বাপ ইচ্ছে থাকলে অনেক কিছু করা সম্ভব।’

বাবাকে ছেড়ে ফুপিকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরলো নাযীফাহ। টুপ করে গালে একটা চুমু দিয়ে বলে,

‘তুমি তো আমার আরেকটা মা, ফুপি। তোমাকে ভুলবো কেমন করে?’

ওয়াহিদা নাযীফাহ’র কপালে চুমু দিয়ে বলেন,

‘আর তুই তো আমার ঘরের লক্ষি।’

মায়ের কাছে এগিয়ে এলো তাহমিদও।জামান সাহেব চক্ষের সামনে এমন আবেগঘন ঘটনা অবলোকন করার পরে আক্ষেপের স্বরে বলেন,

‘আমি তো বরাবরই অবহেলিত পুরুষ। আমি সব সময় সবার দৃষ্টি সীমার বাইরে থাকি।’

‘ তা তুমি বাবা, মায়ের কথা জিজ্ঞেস করেছো কয়বার?’ ভ্রু যুগল কুঁচকে কথাগুলো বললেন আমেনা বেগম। শ্বাশুড়িকে দেখামাত্রই নাযীফাহ কে ছেড়ে শ্বাশুড়ির কাছে এলেন ওয়াহিদা। পায়ে ছুঁয়ে সালাম করতেই আমেনা বেগম বিরক্তির স্বরে বললেন,

‘আহ! তাহমিদের মা তোমাকে না বলেছি পা ছুঁয়ে সালাম করা আমাদের ধর্মে নিষেধ করেছে।মুখে সালাম দেও।’ তারপর একহাতে জড়িয়ে ধরে বললেন,

‘কেমন আছো তোমরা?’ ওয়াহিদা বিষন্ন স্বরে বললেন,

‘ছেলে দু’টো কে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরে বয়স্ক এক বাচ্চাও বাড়িতে নেই। ভালো থাকি কি করে?’

মাকে দেখে কয়েক পা এগিয়ে এসে মায়ের কপালে চুম্বন করলো জামান সাহেব।

____________________________________________

বাসায় প্রবেশ করে ফ্রেশ হয়ে নিলো সবাই। ড্রয়িং রুমে সবাই জড়ো হতেই ফাহমিদা বেগম আর ওয়াহিদা ব্যাগ থেকে একে একে সব জিনিসপত্র নামাতে লাগলেন। ফাহমিদা বেগম আতপচাল আর হরেক রকমের শুকনো পিঠা বের করে বলেন,

‘তোর পছন্দের সব রকমের পিঠা শুকিয়ে নিয়ে এসেছি। মাঝে মাঝে ভেজে খেতে পারবি।’

ওয়াহিদা ফ্রোজেন একটা মাছ বের করে বললেন,

‘ পুকুরে জাল ফেলেছিলো। তাহমিদ তোর তো মুড়িঘন্ট পছন্দ তাই আমি বড় কাতল মাছটা রেখে দিয়েছিলাম।’

ওয়াহিদা একে একে তাহমিদের পছন্দের আরো অনেক কিছু বের করলেন। ফাহিম তীক্ষ্ণধার দৃষ্টিতে দাঁত কটমট করতে লাগলো। ধৈর্যের বাঁধ ভাঙতেই রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে নাক ফুলিয়ে বলে,

‘ বড় ছেলের পছন্দের সবকিছু এনেছে। আমাকে কুড়িয়ে পেয়েছে বলে আমার দিকে কারো নজর নেই। লোকে ঠিক বলে, চোখের আড়াল হলে মনের আড়াল হয়ে যায়। আমার পছন্দ অপছন্দের কথা কাউকে মনে রাখতে হবে না।’

রাগ দেখিয়ে ধপাধপ পা ফেলে রুমে চলে গেলো ফাহিম। ফাহিম চলে যেতেই সকলে শব্দযোগে হাসতে লাগলো।

ফাহিম রুমে গিয়ে ধপ করে গিয়ে বালিশে মুখ গুঁজে খাটে শুয়ে পড়লো। কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পরে ওয়াহিদা এসে ছেলের মাথায় হাত রাখলো। মায়ের স্পর্শ বুঝতে পেরে কপট রাগ দেখিয়ে ফাহিম বলল,

‘আদর দেখাতে আসবে না একদম।যাও নিজের বড় ছেলের কাছে যাও। আমি কে? আমি তোমার ছেলে না। আমাকে তো কুড়িয়ে পেয়েছো।’

ছেলের রাগ দেখে মৃদু হাসলেন ওয়াহিদা। পরম মমতায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন ছেলের মাথায়। ধীর, মন্থর গলায় ফাহিমের কানের গিয়ে বললেন,

‘তোর পছন্দের মাংসের শুঁটকি এনেছি। রাতে ঝাল ঝাল করে রান্না করে দিবো।’

মায়ের কথা শ্রবনেন্দ্রিয় হতেই চট করে উঠে বসলো ফাহিম। উৎফুল্লিত কন্ঠে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘সত্যিই মাংসের শুঁটকি এনেছো? কতদিন হলো তোমার হাতের ঝাল ঝাল মাংসের শুঁটকি রান্না খাইনা।’

____________________________________________

রাতে ফাহমিদা বেগম আর ওয়াহিদা রান্নার আয়োজন করতেই নাযীফাহ তাদের সামনে গিয়ে নত মস্তকে আবদারের স্বরে বলল,

‘ফুপি আমি তোমার কাছ থেকে মুড়িঘণ্ট রান্না শিখবো। ঠিক তুমি যেভাবে রাঁধো সেভাবে।’

মেয়ের মুখে রান্না শেখার কথা শুনে বিস্ফোরিত চোখে মেয়ের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে রয় ফাহমিদা বেগম। ওয়াহিদারও নাযীফাহ’র কথা ঠিক হজম হচ্ছে না। কপাল কুঁজিত করে ওয়াহিদা বললেন,

‘হঠাৎ রান্না শেখার শখ হলো, ব্যপার কি? তাও মু,,,ড়ি,,,ঘ,,,ন্ ‘

কথা অর্ধ সমাপ্ত রেখেই চুপ হয়ে গেলেন ওয়াহিদা। কিছু একটা ভাবতেই তার চোখ দু’টো চকচক, অত্যুজ্জ্বল হয়ে উঠলো। অতঃপর উৎসাহিত গলায় বললেন,

‘শুধু মুড়িঘণ্ট আরো অনেক রান্না তোকে শিখাবো। যেসব রান্নার ঘ্রান কেউ একজন পেলে আহ্লাদে আটখানা হয়ে যায়।’

নত মস্তকে লাজুক হাসে নাযীফাহ। ফাহমিদা বেগমের সমস্ত ব্যপার যেন মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। ওয়াহিদার দিকে অনুসন্ধানী দৃষ্টিপাত করতেই সে চোখের ইশারায় কিছু একটা বললো। অধর জোড়া প্রসারিত হলো ফাহমিদা বেগমেরও। উনি প্রফুল্লচিত্তে চোখ বড় বড় করে তাকালেন ওয়াহিদার অভিমুখে। তার চাহনির অর্থ, সত্যি? ওয়াহিদা উপর নিচ মাথা নাড়ে। ফাহমিদা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। যাক এবার তাহলে তার মেয়ে একটু একটু করে সবকিছু বুঝতে পারছে। তাহমিদের পছন্দ অপছন্দের দিকে নজর পড়েছে তার।

খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ করার পরে বিপত্তি সৃষ্টি হয় শুয়া নিয়ে। বেডরুম দুইটা কিন্তু মানুষ অনেকজন। অনেক চিন্তাভাবনা করার পর ঠিক হয়, এক রুমে খাটের উপরে থাকবেন আমেনা বেগম আর নাযীফাহ। নিচে বিছানা করে থাকবেন ওয়াহিদা আর ফাহমিদা বেগম। আর অন্যরুমের খাটে থাকবেন জামান সাহেব আর খালেদ মোশাররফ। আর নিচে বিছানা করে থাকবে তাহমিদ আর ফাহিম।

মাঝরাতে হাঁসফাঁস করতে লাগলো তাহমিদ। কিছুতেই তার ঘুম আসছে না। কারণ এই সময়টায় সে ড্রিম লাইটের আবছা আলোয় দু’চোখ ভরে দেখতো ঘুমন্ত নাযীফাহ কে। চক্ষের তৃষ্ণা মিটাতো সে। আজ সেখানে যাওয়াটা বেমানান। মা শ্বাশুড়ি সবাই আছে। আকস্মিক কারো কাছে ধরা পড়ে গেলে ব্যপারটা দৃষ্টিকটু। তপ্ত শ্বাস ফেলে উঠে বসলো সে। ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে জানালার একপাশ খুলে অন্তরীক্ষের জ্বলজ্বল করতে থাকা নক্ষত্র দেখতে লাগলো। কয়েকদিন তাকে এসব দেখেই চোখের তৃষ্ণা মিটাতে হবে।

____________________________________________

আজ কলেজে নাযীফাহ’র প্রথম দিন।তাহমিদ সাথে করে কলেজে নিয়ে এসেছে। শ্রেণিকক্ষ দেখানোর পরে তাহমিদ শান্ত, অঘোর কন্ঠে নাযীফাহকে উদ্দেশ্য করে বলল,

‘এই পরিবেশটা তোর জন্য একেবারে নতুন। তুই গ্রামে বড় হয়েছিস।আর এটা শহর। হয়তো প্রথম প্রথম কারো সাথে তোর মিশতে খুব কষ্ট হবে। একবার এই পরিবেশের সাথে খাপখাওয়াতে পারলে আর সমস্যা হবে না। রেগুলার কয়েকদিন ক্লাস করলে বন্ধুবান্ধবও হয়ে যাবে। তোর ক্লাস টিচার ফারুক স্যার আমার ফ্রেন্ডের বড় ভাই। কলেজে কোনো সমস্যা হলে বা কেউ কিছু বললে স্যারকে বললে হবে।বাকিটা উনি সামলে নিবে। আর একটা কথা, তোকে আগেও বলেছি তোর হাতে কিন্তু শুধু বাবার সম্মান না আমার সম্মান এবং আমার পরিবারের সম্মান জড়িত। এটা ঢাকা শহর মুখোশের আড়ালে অনেক অমানুষও থাকে। নিজেকে হেফাজতও করবি।সব সময় তো আর আমি পাশে থাকবো না। হুট করে কেউ ভাব করতে আসলে পাত্তা দিবি না।’ এতটুকু বলে এদিক ওদিক তাকালো তাহমিদ। আশেপাশে ছাত্রছাত্রীর অভাব নেই। তাহমিদের খুব ইচ্ছে করছিলো নাযীফাহ’র কপালে উষ্ণ স্পর্শ দিতে। কিন্তু তা আর হবে না এখন। মৃদু হেসে বলে,

‘যা এখন ক্লাসে যা। ছুটির পর কোথাও যাবি না। আমি এসে নিয়ে যাবো।’

ক্লাসে গিয়ে চুপচাপ হয়ে বসে আছে নাযীফাহ। ক্লাসে সবাই যে যার মতো ব্যস্ত। নিজেকে খুব একা লাগছে তাঁর। হুট করে একটা মেয়ে তার পাশে এসে বসলো। কোনোরকম কথা বললো না সে। মেয়েটা নাযীফাহ’র বাহুতে খোঁচা দিয়ে বলল,

‘আমি তোমার সাথে বসেছি কথা বলছো না কেন?’

ঠোঁট উল্টে চোখ মুখ কুঁচকে তাকালো নাযীফাহ। মেয়েটা কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,

‘আমার সব ফ্রেন্ডরা অন্য কলেজে ভর্তি হয়ে গেছে। আমি এই কলেজে একা। তুমি আমার ফ্রেন্ড হবে?’

নাযীফাহ খুশিতে ডগমগ হয়ে বলল,

‘সত্যি? সেই কখন থেকে একা একা বসে আছি।’

মেয়েটা হেসে বলল,

‘আমার নাম জান্নাত। তোমার নাম কি?’

নাযীফাহ মুচকি হেসে বলে,

‘নাযীফাহ।’

____________________________________________

ছুটি হওয়ার আগেই কলেজ গেইটে এসে দাঁড়িয়ে আছে তাহমিদ। নাযীফাহ’র বের হওয়ার অপেক্ষায় আছে সে। হঠাৎ নাযীফাহকে কোনো মেয়ের সাথে হাসতে হাসতে আসতে দেখে কপালে ভাঁজ পড়ে তার। গেইট থেকে বের হয়েই জান্নাত নাযীফাহ’র থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়। তাহমিদ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে নাযীফাহ’র দিকে। নাযীফাহ তাহমিদের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,

‘তাড়াতাড়ি বাসায় চলেন। খুব খিদে পেয়েছে।’

‘বাব্বাহ্! একদিনে বান্ধবীও বানিয়ে ফেলেছিস? আমি তো ভেবেছিলাম আমি কলেজ এসে দেখবো তুই কান্না করছিস।’ ঠাট্টা করে বলল তাহমিদ। নাযীফাহ কিছু না বলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তাহমিদ দিকে।

রিক্সায় উঠার পর তাহমিদ নাযীফাহ’র একটা হাত খুব শক্ত করে ধরে রাখলো। কোলাহলপূর্ণ রাস্তা ছেড়ে রিক্সা একটু নিরিবিলি রাস্তায় উঠতেই তাহমিদ রিক্সার হুড তুলে দিলো। নিজের মুঠোয় রাখা নাযীফাহ’র হাতটায় আলতো করে ঠোঁট ছুঁয়ালো। কেঁপে উঠলো নাযীফাহ’র সর্বাঙ্গ। তাহমিদ যে এমন কান্ড করবে হয়তো এটা তার ধারণার বাইরে ছিলো। মাথা তুলে চোখ বড় বড় করে তাহমিদের অভিমুখে নেত্রপাত করতেই তাহমিদ মৃদু হেসে আলতো করে জড়িয়ে ধরলো একহাতে। রিকসাওয়ালার দিকে তাকিয়ে লজ্জায় নেতিয়ে গেলো নাযীফাহ। রিক্সাওয়ালা একমনে রিক্সা চালিয়ে যাচ্ছে। পিছনে কি হচ্ছে এসব তার ধারণার বাইরে। বাসার কাছাকাছি আসতেই ঠিক হয় বসে তাহমিদ।

বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘরের দিকে যায় নাযীফাহ। মা আর ফুপি খোশগল্পে মেতে আছে বলে আর বিরক্ত করলো না সে। তাহমিদ বিছানায় পিঠ লাগাতেই নিদ্রা ভর করলো চোখে। আচমকা রান্নাঘর থেকে নাযীফাহ চিৎকারের শব্দ পেয়ে দিক বেদিক দিশা না পেয়ে হুড়মুড়িয়ে গেলো রান্নাঘরের দিকে। তাহমিদের পিছু পিছু বাকি সবাইও গেলো। রান্নাঘরের দৃশ্য অবলোকন হওয়া মাত্রই চোখেমুখে কাঠিন্যভাব দেখা দিলো তাহমিদের।

#চলবে

#হৃদয়াবেগ
#পর্বঃ১৯
#রূপন্তি_রাহমান (ছদ্মনাম)

রান্নাঘরে এসে আর ভাত খেতে ইচ্ছে করলো না নাযীফাহ’র। মা আর ফুপিকে বিরক্ত না করে নিজেই নুডলস রান্না করতে এলো। যেহেতু নুডলস রান্না করতে সে পারে সেহেতু তাদের বিরক্ত করার আর মানেই হয় না। সেদ্ধ নুডলস এর পাতিল চুলা থেকে নামাতে গিয়ে হাত ফসকে বাম পায়ের উপর পড়ে যায়। গরম পানি পায়ে পড়ার সাথে সাথেই নাযীফাহ, ‘ওমাগো ‘ বলে চিৎকার করে ওঠে। মাত্রই চোখ লেগে এসেছিলো তাহমিদের। নাযীফাহ’র চিৎকারে ধড়ফড়িয়ে উঠে সে। দিক বেদিক দিশা না পেয়ে একছুটে রান্নাঘরে আসে। তার পিছু পিছু বাকি সবাইও এলো। রান্নাঘরের চিত্র দেখে তার মুখে কাঠিন্যভাব দেখা দিলো। পাতিল একপাশে, নুডলস ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মেঝেতে। অন্যপাশে নাযীফাহ পা ধরে বসে কান্না করছে। তাহমিদ সাবধানে নাযীফাহ’র কাছে গিয়ে এক প্রকার টেনেই তুলল তাকে। ওয়াশরুমে এনে পায়ে পানি দিতেই তাহমিদের শার্ট খামচে ধরলো সে।প্রচুর জ্বালাপোড়া করছে পা। বাকি সবাই নিঃশব্দে প্রস্থান করলো সেখান থেকে। ড্রয়িং রুমে নাযীফাহ কে বসিয়ে তাহমিদ ফাস্টএইড বক্স থেকে অয়েন্টমেন্ট নিয়ে আসলো। চোখ মুখ তার আগুন লাল হলেও সে সযত্নে নাযীফাহ’র পায়ে অয়েন্টমেন্ট লাগিয়ে দিচ্ছে। দেওয়া শেষ করে উঠে দাঁড়ালো সে।রক্তিমবর্ণ চোখে নাযীফাহ’র দিকে তাকিয়ে বলে,

‘বড্ড রান্নার শখ না তোর? ভবিষ্যতে আমি তোকে হেঁসেলে রেখেই মা’র’বো। কোনো কাজ করতে হলে আগে দেখতে হয় বড়রা কিভাবে করে। সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। তোর নুডলস খেতে ইচ্ছে করছে এটা বললে কেউ তোকে রান্না করে দিতো না?’

মাথা নত করে ফেলে নাযীফাহ।

____________________________________________

একের পর এক দিনের সমাপ্তি ঘটিয়ে ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টায়। কোনো কোনো দিন কাটে আনন্দমুখর আবার কোনো কোনো দিন কাটে বিষন্নতায়। হেমন্তকাল শেষে শীতের আগমন ঘটেছে। প্রকৃতি হয়েছে রুক্ষ।এক এক করে গাছের সব পাতা ঝরে যাচ্ছে। গ্রামাঞ্চলে শীতের প্রকোপ থাকলেও শহরের শীত ওই কুয়াশা আবৃত ভোর পর্যন্তই। শহরে ঋতু পরিবর্তনের তেমন একটা প্রভাব দেখা যায় না।বারোমাসই ফ্যান চালু দিয়ে ঘুমোতে হয়। নাযীফাহ’র কলেজ, কোচিং বাসা আর তাহমিদের কোচিং-এ ক্লাস নেওয়া, নিজের পড়াশোনা চালিয়ে দিনগুলো বেশ যাচ্ছে। ফাহিম ঢাকা কলেজে ভর্তি হয়েছে ইংরেজি বিভাগে। এখান থেকে যাতায়াতের সমস্যা বলে কলেজের কাছেই একটা মেসে উঠেছে। বৃহস্পতিবার রাতে আসে আবার শুক্রবার বিকেলে চলে যায়। তাহমিদ আর নাযীফাহ’র বাবা মা দিন দশেক থাকার পরে আবার গ্রামে ফিরে গিয়েছিল। সেইদিন নাযীফাহ মায়ের শাড়ির আঁচল টেনে ছোট বাচ্চাদের ন্যায় কেঁদে ছিলো। ফাহমিদা বেগম মেয়েকে সান্ত্বনা দিলেও আড়ালে তিনিও চোখের পানি বিসর্জন দিয়েছেন। নাযীফাহ’র মনের সেই বিষন্নতার পাহাড়কে দূর করার জন্য সেইদিন দ্বিতীয়বারে ন্যায় মাঝরাত অব্দি দু’জন ছাদে বসে ছিলো। পার্থক্য হলো সেদিন পূর্ণিমা ছিলো না। ঘোর অমাবস্যা ছিলো। চারদিকে ঘুটঘুটে আঁধারের মাঝে একটা চাদর গায়ে জড়িয়ে বসেছিলো ছাদের কিনারায়। নাযীফাহ বিষন্ন আর বেদনার্ত মন শান্ত করার জন্য আকঁড়ে ধরেছিল তাহমিদের বুক। আর তাহমিদ ভালোবেসে আগলে নিয়েছিল নাযীফাহকে। বাসায় কেউ না থাকলে আমেনা বেগমের সময় কাটে নিতুর মায়ের সাথে গল্প করে। নাযীফাহ যখন কলেজ থেকে ফিরে তখন নাযীফাহ গল্পের ঝুড়ি নিয়ে বসে। কাকে কিভাবে বোকা বানালো, কার সাথে কি করলো এসব বলে আর হাসতে হাসতে লুটোপুটি খায়। দুষ্টুমির জন্য কলেজে মোটামুটি পরিচিত সে।

নিজের ক্লাস শেষ করে ভার্সিটি থেকে মাত্রই অফিস রুমে এসে বসেছে তাহমিদ। একটা শীট চেক করার জন্য হাতে নিতেই মোবাইল বেজে উঠলো তার।মোবাইল স্ক্রিনে ফারুক স্যারের নাম্বার দেখে কপালে সূক্ষ্ণ রেখার ভাঁজ পড়ে। মনে মনে দোয়া পড়ে কল রিসিভ করলো যেন নাযীফাহ’র নামে কোনো বিচার না হয়। কল রিসিভ করে সালাম দিতে দিতেই ওপাশ থেকে বলল,

‘তাহমিদ এ কাকে কলেজে ভর্তি করিয়ে দিয়ে গেলে? আমি ভেবেছিলাম গ্রামের মেয়ে শান্ত প্রকৃতির হবে। এ তো সারা কলেজ মাথায় তুলে রাখে। আজ কোনো কারণে আমার মেজাজ খুব খারাপ ছিলো। মনে করেছি ক্লাসে গেলে হয়তো ছাত্রছাত্রীরা আস্তো থাকবে না । সে আমার রাগত চেহারা দেখে বলল, ‘স্যার রাগলে আপনাকে বেশি সুন্দর লাগে। আপনি এখন থেকে রেগে থাকবেন। আমি সিউর ম্যাম আপনার রাগ দেখেই পাগল হয়েছিলো। শত চেষ্টা করেও নিজের মুখের গাম্ভীর্যতা ধরে রাখতে পারিনি।ফিক করে হেসে দিয়েছিলাম।’

‘মা’ই’র দিবেন স্যার তাহলে পরবর্তীতে এমন দুষ্টুমি আর করবে। মা’ই’রে’র উপর আর ঔষধ নাই।’

তাহমিদের কথায় মলিন হাসলেন উনি।

‘তাহমিদ তুমি নিজেও টিচিং প্রফেশনে আছো।তুমি বুঝবে। কিছু কিছু স্টুডেন্ট থাকে যারা হাজার দুষ্টুমি করলেও তাদের উপর রাগ করা যায় না। নাযীফাহ তাদের কাতারেই পড়ে। তুমি জানো কি না জানি। কয়েকদিন আগে ওর ফ্রেন্ড জান্নাত প্রেশার ফল করে সেন্সলেস হয়ে যায়। কোনো মা’ও হয়তো এভাবে কান্না করতো না সে যেভাবে বান্ধবীর জন্য কান্না করেছে। যতই দুষ্টুমি করুক না কেন সে কিন্তু একেবারে সরল।’

মৃদুস্বরে হাসলো তাহমিদ। প্রিয় মানুষের প্রশংসা সবারই শুনতে ভালো লাগে। হুট করে ইচ্ছে হলো প্রেয়সীর ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত, ঘর্মাক্ত আনন দেখার জন্য। ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকালো সে।নাযীফাহ’র কলেজ ছুটি হতে আরো পনেরো মিনিট। কেউ একজনকে ডাকল তাহমিদ।

‘শাওন ভাই আমার ক্লাসটাইমে আপনি ক্লাসটা নেন।আমি আপনার ক্লাসটা আমি করবো।’

ব্যস্ত পায়ে ছুটলো বাইরে। কলেজ গেইটে পা দিতেই ছুটির ঘন্টা বাজলো। প্রায় মিনিট দশেক পরে নাযীফাহ কলেজের বাইরে পা দিলো। জান্নাতের সাথে কথা বলতে বলতে হঠাৎ তাহমিদকে দেখে কপাল কুঁজিত হলো তার। জান্নাতকে সাথে নিয়ে তাহমিদের মুখোমুখি হলো সে।ভ্রু যুগল কুঁচকে প্রশ্ন করলো,

‘আপনার তো কোচিং সেন্টারে থাকার কথা এখানে যে?’

জান্নাতের দিকে তাকিয়ে কোনো উত্তর দিলো না তাহমিদ। নাযীফাহ’র প্রশ্নের জবাবে শুধু শব্দহীন হাসলো। হাসি দেখে যা বুঝার বুঝে নিলো নাযীফাহ। তার মনের দ্বারেও আজকাল অনুভূতিরা কড়া নাড়ে। তাহমিদের প্রকাশিত অপ্রকাশিত সকল আবেগ, অনুরাগ, গভীর প্রণয় যেন তার হৃদগহীনেও অনুভূতির অন্বেষণ ঘটাচ্ছে। মাঝে মাঝে তাহমিদের নিক্ষেপ করা শান্ত চাহনি,হুটহাট গভীর স্পর্শ তার বক্ষঃপঞ্জর শীতল থেকে শীতল করে তুলে। জান্নাত ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল,

‘নাযু তুই তাহলে ভাইয়ার সাথে যা। আমার টেইলর্সের দোকানে গিয়ে লেইট হবে।’

নাযীফাহ বলল,

‘তাহলে আমিও যাই তোর সাথে।’

‘ভাইয়া যেহেতু এসেছে তাহলে তোর আর উল্টো পথে যাওয়ার দরকার নেই। তুই ভাইয়ার সাথে যা। আমি আসছি। আমার জন্য বসার জায়গা রাখবি কিন্তু।’

রিক্সায় চড়ে বসতেই নাযীফাহ পুনশ্চ প্রশ্ন করলো,

‘তখন কিন্তু বলেনি হঠাৎ কেন এসেছেন।’

তাহমিদ তার অধর জোড়া প্রসারিত করে নাযীফাহ’র একটা হাত মুঠোবন্দি করলো।

‘কেউ একজনের এলোমেলো কেশ, ক্লান্ত চাহনি একটা নজর দেখার জন্য হৃদগহ্বরে স্পৃহা জেগেছিল। তাই এক মুহূর্ত দেরি না ছুটে এলাম। কারো ক্লান্তি মাখা আনন দর্শন করে নিজের মানসিক ক্লান্তি দূর করার জন্য।’

তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো নাযীফাহ। তাহমিদ নাযীফাহ’র সেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে বলল,

‘বেশি ক্লান্ত লাগলে আমার কাঁধে মাথা রেখে ক্লান্তি নিবারন করতে পারিস আমি মাইন্ড করবো না।’

নাযীফাহ উষ্ণ শ্বাস ফেলে বলল,

‘আপনিও ক্লান্ত আমিও ক্লান্ত। থাক দু’জনের ক্লান্তি, নিস্তেজ ভাব আর অবসন্নতা আপনার কাঁধে রেখে আপনার বোঝা আর না বাড়াই।’

তাহমিদ ভ্রু নাচিয়ে বলল,

‘কেউ একজন মনে হচ্ছে খুব দ্রুত বড় হয়ে যাচ্ছে? সে কি অতি দ্রুত পুরোপুরি মিসেস তাহমিদ হওয়ার জন্য আপ্রান প্রয়াস চালাচ্ছে নাকি? তাহলে কিন্তু আগেভাগে তাহমিদ বলে দিচ্ছে একশো তে দেড়শো পেলেও তাহমিদের কথার নড়চড় হবে না। আগে এইচএসসি পাশ করতে হবে। তারপর অন্যকিছু।’

তাহমিদের কথা শ্রবণেন্দ্রিয় হতেই সূঁচালো দৃষ্টিতে তাকালো নাযীফাহ। তাহমিদ বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে বলল,

‘তার আগে এই রাক্ষসের মতো নখ গুলো কাটতে হবে। বিকজ সেফটি ফার্স্ট। আমার অক্ষত দেহটাকে কেউ সুযোগ পেয়ে ক্ষ’ত বি’ক্ষ’ত করবে সচেতন নাগরিক হয়ে এটা আমি অন্তত চাই না।’

চোখ পাকিয়ে তাহমিদের বাহুতে চিমটি কাটে নাযীফাহ

____________________________________________

ইংরেজি ক্লাস নিচ্ছে তাহমিদ। বোর্ডে টেন্সের এর স্ট্রাকচার লিখছে সে। নাযীফাহ’র পানির পিপাসা পাওয়ায় সে ফিসফিস করে জান্নাতের কাছে পানি চাইতেই সামনে থেকে আরেকটা মেয়ে বলে উঠলো,

‘স্যার নাযীফাহ কথা বলছে। তার বিশৃঙ্খলার জন্য আপনি কি বলছেন কিছুই শুনতে পাচ্ছি না।’

মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো তাহমিদের। ক্লাসে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা তার মোটেও পছন্দ না। আর নাযীফাহ’র নাম নেওয়ায় রাগের মাত্রা যেন বাড়ল। মার্কার পেনের মুখ আঁটকে পিছনে ফিরে ক্রোধান্বিত গলায় বলল,

‘স্ট্যান্ড আপ নাযীফাহ।’

আকস্মিক কান্ডে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলো নাযীফাহ। সবটাই যেন তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। কথাই বললো কখন আর বিশৃঙ্খলাই করলো কখন? পিপাসা পাওয়ায় ফিসফিস করে তো শুধু পানিই চাইলো। আর কিছু তো না।

তাহমিদ পুনশ্চ গর্জে উঠে বলল,

‘আই সে স্ট্যান্ড আপ।’

ধমকের শব্দে কেঁপে উঠলো নাযীফাহ সহ বাকিরাও। উঠে দাঁড়ালো সে। তাহমিদ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

‘বলেছি না ক্লাসে বিশৃঙ্খলা আমার পছন্দ না। ক্লাস ভালো না লাগলে চলে যাবেন। অন্যকে বিরক্ত করার মানে কি?’

অভিমানেরা ভিড় জমাতে লাগলো মনের আনাচে-কানাচে। আর সেই অভিমান গুলো অশ্রু হয়ে জমতে শুরু করলো কনীনিকার কোণে। যেন পলক ফেললে বৃষ্টি হয়ে ঝরবে অভিমানের অশ্রু। রাগে, অভিমানে ব্যাগটা নিয়েই ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলো সে। নাযীফাহ’র যাওয়ার পানে তীক্ষ্ণধার দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তাহমিদ। পরপর কয়েকটা শ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করার প্রয়াস চালালো সে। নিস্তব্ধতায় ছেয়ে গেলো পুরো ক্লাসরুম। এর আগে তাহমিদকে এতো রাগতে কেউ দেখিনি। জান্নাত সামনের মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রাগে ফুঁসছে। ক্লাসে ঘুরে ঘুরে টপিক বুঝাচ্ছে তাহমিদ। বোর্ডে গিয়ে আরেকটা স্ট্রাকচার লিখতেই আচমকা দু’কদম পিছিয়ে এলো সে। সম্মুখের আপতিত দৃষ্টিগোচর হতেই চোখ মুখ শক্ত হয়ে এলো তার। ক্রোধে হাতের মার্কার পেনটা চেপে ধরলো সে।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here