#হৃদয়াবেগ
#পর্বঃ২৪,২৫
#রূপন্তি_রাহমান (ছদ্মনাম)
২৪
অতঃপর নাযীফাহ ফুপি বলে জড়িয়ে ধরলো। জান্নাত আহাম্মকের মতো তাকিয়ে আছে নাযীফাহ’র দিকে। নাযীফাহ জড়িয়ে ধরেই বলল,
‘তোমায় আমি চিনে ফেলেছি ফুপি। সেই কখন থেকে মনে হচ্ছিল আমি কাউকে দেখেছি কিন্তু ঠাহর করতে পারেনি। তোমার চলার ধরন দেখে কনফিউজড হয়ে গিয়েছিলাম।’
ওয়াহিদা মুখের নেকাব তুলে বললেন,
‘যাহ্ চিনে ফেললি।’
নাযীফাহ ওয়াহিদার একটা হাত জড়িয়ে ধরে বলল,
‘যত যাই বলো র’ক্ত বলে কথা। হাজার মাইল দূরে থাকলেও চুম্বকের মতো টানে।’
ফাহিম দৌড়ে ওদের সামনে এসে হাঁটুতে হাত রেখে হাঁপাতে লাগলো। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
‘তুমি বলে আসবে না, মা। ভাড়া মিটিয়ে দেখি তুমি নেই। এতোক্ষণ তো মুখ খোলা ছিলো ঢাকলে কেন? আমি এদিক ওদিক খুঁজতে খুঁজতে হয়রান।’
‘তুমি যে আসবে তোমার ছেলে জানে?’
‘ছেলে জানে। তুই আর মা জানিস না।’
কথা বলতে বলতে বের হলো তাহমিদ। এখানে মাকে দেখে কপাল কুঁচকালো সে। এগিয়ে এসে বলল,
‘তোমাকে না নিষেধ করলাম এখানে আসার দরকার নাই। তুমি তো এমনিতেও ক্লান্ত।’
____________________________________________
আমেনা বেগম দরজা খুলে ওয়াহিদা আর ফাহিমকে দেখেই প্রশস্ত হাসলেন। ওয়াহিদা আর আমেনা বেগমের চোখাচোখি হতেই দু’জন দু’জনের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসলেন।
আমেনা বেগম রুমে তছবি জপছেন। ফাহিম আর তাহমিদ রুমে বসে পড়াশোনা নিয়ে আলোচনা করছে। ওয়াহিদা আর নাযীফাহ রান্না করছে। ওয়াহিদা রান্না করছে আর নাযীফাহ পাশে দাঁড়িয়ে দেখছে আর এটাসেটা এগিয়ে দিচ্ছে। আজকের আয়োজন হাঁসের মাং’স আর খিচুড়ি।
টেবিলে খাবার দিতেই দুই ভাইয়ের চোখ খুশিতে চকচক করতে লাগলো।ফাহিম ক্ষুধিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
‘কতদিন পরও হাঁসের মাং’স খাবো। মা আগে বলবে না তাহলে কয়েকদিন না খেয়ে প্রিপারেশন নিতাম।’
নাযীফাহ মুখ বাঁকিয়ে বলল,
‘রা’ক্ষস যে। আস্তো একটা গরু জ’বাই করে তোকে দিলেও বলবি আরো দাও।’
ফাহিম দাঁত কেলিয়ে বলল,
‘সেম টু ইউ বেহেনজি। ওপস সরি ভাবিজি।’
মুখ ভেঙচি দিলো নাযীফাহ।
তাহমিদ মৃদু হেসে বলল,
‘ইশ! কতদিন পর তোমার হাতের রান্না করা হাঁসের মাং’স খাবো। পরিষ্কার করার অলসতায় বাসায় আনা হয় না।’
রাতে ঘুমানোর সময় এক বিছানায় গাদাগাদি করে নাযীফাহ, ওয়াহিদা আর আমেনা বেগম শুয়ে পড়লেন। অন্য রুমে ফাহিম আর তাহমিদ।
পরদিন সকাল হতেই ফাহিম চলে যায় নিজ গন্তব্যে। স্বাভাবিক দিনের মতো দিনটির ইতি ঘটলেও বিপত্তি ঘটে রাতের বেলা। ওয়াহিদা বেগম বেঁকে বসলেন এক বিছানায় তিনজন থাকবেন না। আর এই শীতে কাউকে ফ্লোরেও থাকতে দিবেন না। মায়ের মতিগতি ঠিক ঠাহর করতে পারছে না তাহমিদ। কপাল কুঁজিত করে নিষ্পলক তাকিয়ে আছে মায়ের দিকে।
‘তা তুমি কি করতে চাইছো, মা?’
ওয়াহিদা মুখে হাসি ফুটিয়ে বলেন,
‘তুই আর নাযীফাহ একসাথে থাক আমি আর মা একসাথে, ব্যস।’
এতোক্ষণে মায়ের ছলচাতুরী ধরতে পারলো তাহমিদ। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। নাযীফাহ বিস্মিত গলায় বলল,
‘তুমি এসব কি বলছো ফুপি?’
‘এই তুই চুপ থাক।’
‘শুনো মা এসব আজাইরা চিন্তা বাদ দাও আর ঘুমোতে যাও। কাল সকালে নাযীফাহ’র কলেজ আছে।’ বলেই দাঁড়ালো না তাহমিদ। প্রস্থান করলো সেখান থেকে। ওয়াহিদা রাগী চোখে তাকিয়ে আছে ছেলের যাওয়ার পানে। আমেনা বেগমও চুপচাপ আছে। কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পর আচমকা ওয়াহিদা বললেন,
‘নাযীফাহ যা তো আমার জন্য আদা চা করে আন। মাথাটা ভিষণ ধরেছে।’
এই রাতে বেলা চা খাওয়ার কথা শুনে কপালে ভাঁজ পড়ে নাযীফাহ’র।রাতের বেলা চা খাওয়া মানে ঘুমকে টাটা বায় বায় জানানো।
‘তুমি এই রাতে চা খাবে? তাহলে তো আর ঘুম আসবে না। তার চেয়ে ভালো ঘুমালেই সেরে যাবে।’
ওয়াহিদা মৃদুস্বরে ধমক দিয়ে বললেন,
‘তোকে যা বলছি তাই কর। শ্বাশুড়ির সেবা করতে করতে হাঁপিয়ে গেছিস নাকি?’
‘আমি কখন বললাম এই কথা?’ গাল ফুলিয়ে নাযীফাহ চলে গেলো রান্নাঘরে।
ওয়াহিদা আমেনা বেগম ধরে চললেন শোবার ঘরের দিকে। অনেক সময় নিয়ে চা বানালো নাযীফাহ। চা বানানো শেষে কাপ নিয়ে ছুটলো শোবার ঘরের দিকে। দরজার কাছে এসেই বুঝতে পারলো ভেতর থেকে লক করা দরজা। পরপর কয়েকটা টোকা দিলো নাযীফাহ। কোনো সাড়াশব্দ নেই। বার কয়েক ডাকল আমেনা বেগম এবং ওয়াহিদাকে। এবারও কোনো প্রতিক্রিয়া পেলো না সে। বাধ্য হয়ে ছুটলো তাহমিদের রুমের দিকে। চাকরি সংক্রান্ত খবর আছে কিনা তাই দেখছিল তাহমিদ বিভিন্ন কোম্পানির ওয়েবসাইটে। হঠাৎ নাযীফাহকে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করল,
‘কিছু বলবি?’
‘ফুপি ভেতর থেকে দরজা আঁটকে দিয়েছে।’
এবার পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো তাহমিদ।
‘ভেতর থেকে দরজা আঁটকে দিয়েছে। তুই বাইরে কি করছিলি?’
নাযীফাহ কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,
‘ফুপি বলল তার নাকি মাথা ধরেছে চা করে দিতে। চা বানিয়ে দেখি ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে রেখেছে।’
তপ্ত শ্বাস ফেলল তাহমিদ। বিড়বিড় করে বলল,
‘মায়ের চালাকি ধরতে পারলি না?’
‘আমি ঘুমাবো না?’
তাহমিদ ল্যাপটপ শাট ডাউন করে বলল,
‘তুই এখানে শুয়ে পড়। আমি ড্রয়িং রুমে ম্যানেজ করে নিবো।’
‘এই ঠান্ডায় ড্রয়িং রুমে শোবেন? ঠান্ডা লেগে যাবে তো।’
‘ভারী কাঁথা আছে। সমস্যা নেই।’
____________________________________________
মাঝরাতে হাঁসফাঁস করতে লাগলো তাহমিদ। এপাশ ওপাশ করছে কিন্তু ঘুম আসছে না। শুয়া থেকে উঠে ধীর পায়ে চলল রুমের দিকে। নাযীফাহ গুটিসুটি হয়ে ঘুমিয়ে আছে। তাহমিদ গিয়ে বসলো নাযীফাহ’র কাছে। অপলক তাকিয়ে রইলো ঘুমন্ত প্রেয়সীর অভিমুখে। ড্রিম লাইটের আবছা আলোয় বড্ড মায়াবী লাগছে নাযীফাহকে। নাযীফাহ’র একটা হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিলো তাহমিদ। ঠোঁট ছুঁয়ালো হাতের উল্টো পৃষ্ঠে। অকস্মাৎ চোখ মেলে তাকায় নাযীফাহ। চোখে সামনে পুরুষ অভয়ব দেখেই চাপা গলায় চিৎকার করে উঠে বসে সে। তাহমিদ ধীর গলায় বলে,
‘ভয় পাস না আমি তোর তাহমিদ ভাই।’ বলেই বেড সাইডের ল্যাম্প জ্বালালো। তাহমিদের চেহারা স্পষ্ট হতেই নাযীফাহ শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো তাহমিদ কে। ভয়ে হাত কাঁপছে তার। ঘন ঘন শ্বাস ফেলেছে সে। তাহমিদও দু’হাতে আগলে নিলো নাযীফাহকে। মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
‘ভয় পেয়েছিস?’
শুকনো ঢুগ গিলে নাযীফাহ। ফিসফিস করে বলল,
‘পানি খাবো।’
নাযীফাহ’র অস্থিরতা একটু কমতেই নিজের থেকে ছাড়ালো তাকে। নাযীফাহ’র চোখে মুখে এখনো আতংক বিদ্যমান। রুমে থাকা জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢাললো তাহমিদ। গ্লাস টা নাযীফাহ’র হাতে দিয়ে বললো,
‘আমি আছি তো। তাহমিদ বর্তমান থাকা অবস্থায় তাহমিদ কে ডিঙিয়ে কে তোকে ছুঁতে আসবে? এতো সাহস কার?’
‘আপনি তো ড্রয়িং রুমে থাকবেন বলেছিলেন। এখানে কেন?’
নাযীফাহ’র প্রশ্নে চমকে উঠে তাহমিদ। এমন প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিলো না সে। কিয়ৎকাল নীরব রইলো সে।
‘নিজের চোখকে শান্তি দিচ্ছিলাম একটু। চোখের তৃপ্তি মিটচ্ছিলাম।’ নির্বোধের মতো তাকিয়ে রইলো নাযীফাহ।
নাযীফাহ’র চিৎকার শুনে উঠে এসেছিল ওয়াহিদা। আড়াল থেকে দু’জন কে একসাথে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সে। নিঃশব্দে সেখান থেকে প্রস্থান করার আগে দুষ্টু বুদ্ধি আটলেন তিনি। মুখ দিয়ে অদ্ভুত শব্দ করে তড়িৎ গতিতে রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে ফেললেন।
এই নিস্তব্ধ, নির্জন রজনীতে অকস্মাৎ ভয়াল শব্দ কর্ণগোচর হতেই নাযীফাহ পুনশ্চ তাহমিদকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। তিগ্ম, তপ্ত শ্বাস ফেলে নাযীফাহকে আগলে নিলো তাহমিদ।নাযীফাহ তাহমিদের টি-শার্ট খামচে ধরে বলল,
‘আপনি এখান থেকে যাবেন না, প্লিজ। আমার ভয় করছে খুব।’
____________________________________________
মুখ গোমড়া করে কলেজের জন্য রেডি হচ্ছে নাযীফাহ। কারো সাথেই কথা বলছে সে। আমেনা বেগম আর ওয়াহিদাও সেই রাগকে পাত্তা দিচ্ছে না। নাযীফাহ রেডি হয়ে ডাকতে লাগলো তাহমিদ কে। বাসার পোশাক তাহমিদের গায়ে দেখে কপালে ভাঁজ পড়ে নাযীফাহ’র।
‘আপনি আজ বের হবেন না।’
‘না, আয় তোকে রিক্সা করে দিয়ে আসি।’
রিক্সায় উঠে বসার পর তাহমিদ রিকসাওয়ালাকে বলল,
‘এতো তাড়াতাড়ি রিক্সা চালানোর দরকার নাই। আপনি আস্তেধীরে চালিয়ে যাবেন।ঠিক আছে? আর তুই রিক্সার একপাশ শক্ত করে ধরে রাখবি। আমি কিন্তু সাথে নেই যে তোকে সামলে নিবো। আমি ভাড়া দিয়ে দিয়েছি।কলেজ ছুটির পরে কোথাও যাবি না আমি যাবো কলেজে তোকে নিতে।’
আরো কিছু বলতে নিবে নাযীফাহ বলে উঠলো,
‘আর কিছু বলতে হবে না আপনাকে।আমি কিন্তু সেই প্রথম দিনের নাযীফাহ নই।’
বাসায় প্রবেশ করে তাহমিদ আমেনা বেগমকে নিজের রুমে ডাকল। আমেনা বেগম রুমে যেতেই তাহমিদ বলল,
‘মায়ের সাথে তো কথা গুলো বলতে পারবো না, তাই তোমাকে বলা। কয়েকদিন আগে তোমাকে কি বলেছিলাম? যদি মনে হয় নাযীফাহ কে আমার একান্তে প্রয়োজন তাহলে তোমাকে আমি বলবো। তাহলে তোমরা উঠে পড়ে কেন লেগেছে? ভয় পাচ্ছো যদি আমাদের মতিগতি পরিবর্তন হয়ে যায় এজন্য? সেক্ষেত্রে তোমাকে আমি কথা দিতে পারি আমার সবটা জুড়ে শুধু নাযীফাহ। আর নাযীফাহ’র কথা বলতে গেলে ও নিতান্ত বাচ্চা। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে হয়তো মতিগতি, আবেগ, ভালোবাসার পরিবর্তন হতেও পারে।ফিকে হয়ে যেতে পারে আমার নামের সমস্ত অনুরাগের। তখন আমি সানন্দে নাযীফাহ’র সকল সিদ্ধান্ত মেনে নিবো। যে মায়া সময় গড়ানোর সাথে সাথে কে’টে যাবে সেই মোহ মায়া তাহমিদের দরকার নেই। তাছাড়াও নাযীফাহ মাত্র ষোলো বছরে পা দিলো। আমরা একসাথে থাকলাম। আমি পুরুষ মানুষ দাদি তার উপর নাযীফাহ আমার স্ত্রী। একটা সময় নিজের কাছে করা প্রতিজ্ঞা ভুলে গিয়ে নাযীফাহ কে কাছে টেনে। ঠিক যতটা কাছে স্বামী আর স্ত্রী থাকে৷ দু’জনের মাঝে দূরত্ব থাকে না বিন্দুমাত্র। তারপর কি হবে? ভুলক্রমে যদি ও কনসিভ করে ফেলে তখন কি হবে? একজন মেয়ের গর্ভধারণের পরিপূর্ণ বয়স হচ্ছে বিশ বছর। তাও যদি বাদ দেই তাহলে আঠারো। অপ্রাপ্ত বয়সে গর্ভধারণ মানেই লাইফরি’স্ক৷ নাযীফাহ কে মৃত্যু ঝুঁকিতে রেখে আমি একদন্ডও শান্তি তে থাকতে পারবো না দাদি। এই ব্যপার গুলো নিয়ে আর ঘাটাঘাটি করো না। মাকে বুঝাও। আমি স্বামী হয়ে যদি অপেক্ষা করতে পারি তোমরা কেন পারবে না? তার চেয়ে ভালো নাযীফাহ বড় হউক।সংসার ধর্ম বুঝতে শিখুক। আমি অপেক্ষা করি বাচ্চা বউ বড় হওয়ার।’
কোনো প্রকার টু শব্দ করলেন না আমেনা বেগম। নৈঃশব্দ্যে প্রস্থান করলো সেখান থেকে।
____________________________________________
সময় গড়ায় চোখের পলকে। রাত্রি শেষ করলেও একটি নতুন দিনের সূচনা। কেউ জন্ম নেয় কেউ মৃত্যুবরন করে।আবার কেউ নতুন সম্পর্কে জড়ায়।কারো কারো ঘটে বিচ্ছেদ। এমন করেই চলে যাচ্ছে দিন। নিজের প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে সপ্তাহ খানেকের মাথায় বিদায় নিয়েছিলো ওয়াহিদা। এর মাঝে কয়েকদিন এসে ফাহমিদা বেগমও থেকে গেছে। নাযীফাহ’র ফাইনাল শেষ হলো সেই কবেই। আজ রেজাল্ট দেওয়ার কথা। সেজন্য আলোচনা সভা হচ্ছে কলেজে।
রেজাল্ট কার্ড পেয়ে খুশিতে আটখানা নাযীফাহ। কারন টেনেটুনে সকল বিষয় পাশ করেছে।ফেইল নামক শব্দ কানের ঠিক দু ইঞ্চি নিচ দিয়ে গেছে। ফেইল নামক শব্দটাকে ডিঙিয়ে পাশ সে করেছে এতেই খুশি সে। জান্নাত চার বিষয়ে ভালো নাম্বার পেলেও তিন বিষয়ে খুব নাম্বার পেয়েছে। কাঁদো কাঁদো মুখে তাকিয়ে আছে নাযীফাহ’র দিকে। বাসায় গেলে রক্ষে নেই তার। নির্ঘাত বাবা রেজাল্ট দেখলে রিকসাওয়ালার সাথে বিয়ে দিয়ে দিবে।
রাতে খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ করে নাযীফাহ রেজাল্ট কার্ড দেখালো তাহমিদকে। কার্ড হাতে নিয়ে এক-এক করে সব বিষয়ের নাম্বার দেখার পর শুকনো হেসে বলল,
‘আমি হয়তো টিচার বা গাইডলাইন হিসেবে ব্যর্থ। না হলে রেজাল্ট আরো ভালো হতো। হয়তো প্রপার গাইড করতে পারিনি তোকে।’
হাসিখুশি মুখটা চুপসে গেলো নাযীফাহ’র। নাযীফাহ ভেবেছিল পাশ নাম্বার দেখলে খুশি হবে তাহমিদ। এখন তার উল্টো হলো। রেজাল্ট কার্ডের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে তাহমিদ বলল,
‘আচ্ছা নাযীফাহ তোর মনে কখনো প্রশ্ন উদয় হয়নি? সবারই তো ভাই অথবা বোন আছে তোর নাই কেন? কেন তুই বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান হওয়ার পরও তোকে আঠারো পূর্ণ হওয়ার আগে বিয়ে দিয়ে দিলো? এসব নানা রকম প্রশ্ন মনমধ্যে জাগ্রত হয়না? কেন গ্রামে থাকা কালীন এতো দুষ্টুমি করার পরও ধমক পর্যন্ত দিতো না?’
তাহমিদের কথা গুলো শ্রবণেন্দ্রিয় হতেই বিস্ফোরিত চোখে তাকায় নাযীফাহ। কই কখনো তো তার মাথায় এসব চিন্তা এলো না।
#চলবে
#হৃদয়াবেগ
#পর্বঃ২৫ (বোনাস)
#রূপন্তি_রাহমান (ছদ্মনাম)
আসলেই তো তার মাথায় তো এই প্রশ্ন উদয় হয়নি কেন তার ভাই বোন নেই? কেন একমাত্র সন্তান হওয়া সত্বেও বাবা তাকে এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে দিলো? তাহমিদ পুনশ্চ জিজ্ঞেস করলো,
‘কখনো এই প্রশ্ন মাথায় আসেনি তাই তো?’
নাযীফাহ না বোধক মাথা নাড়ে।
‘তুই মামুর কততম সন্তান জানিস?’
নাযীফাহ চোখ পিট পিট করে বলল,
‘কততম আবার আমিই তো প্রথম।’
তাহমিদ মলিন, বিষন্ন হাসলো।
‘পঞ্চম সন্তান তুই। তোর বড় আরো চারজন ছিলো।’
বিস্মিত লোচনে তাকায় নাযীফাহ। দু’লাইনের কথা যেন তার হজম হচ্ছে না। দৃষ্টির ভাবভঙ্গি বলে দিচ্ছে চক্ষুদ্বয়ে হাজার প্রশ্ন। এই প্রথম কোনো চরম সত্যির মুখোমুখি হচ্ছে সে। বিষাদভারাতুর, বিবর্ন, থমথমে গলায় তাহমিদ পুনশ্চ বলল,
‘আমার জন্মের কয়েকমাস পরে মামি প্রথম সন্তানের জন্ম দেন।অদৃষ্টের কি পরিহাস জানিস? জন্মানোর এক ঘন্টা পরেই সে মা-রা যায়। মামিকে শান্ত করা যাচ্ছিলো না কিছুতেই। কেবল আমি তার কাছে থাকলেই একটু শান্ত থাকতো। মা তোদের বাড়িতে থাকে আমাকে নিয়ে পুরো ছয়মাস। ছয়মাস পরে মামি আবারও কনসিভ করে। এবারও ভাগ্য সহায় ছিলো না। প্রেগন্যান্সির চার মাসের মাথায় মিসক্যারেজ হয়ে যায়। সেই সময়টায় মামিকে ঘুমের ঔষধ দিয়ে রাখা হতো। পরে ডাক্তার মামুকে কড়াকড়ি নিষেধ করে বেবির জন্য যাতে ট্রাই না করে। মামি যেন মেন্টাললি আরো স্ট্যাবল হয়। এসব কিছুই আমার অবগত ছিলো না।মায়ের মুখে শুনেছি। তবে তৃতীয় জনের সময় আমি কিছু কিছু বুঝতাম। তখন মনে হয় আমি ছয় বছরের। আবারও তোর একটা বড় ভাই হয়। সেদিন দেখেছিলাম মামিকে প্রাণখোলা হাসতে। প্রসব ব্যথা যেন ভুলে গিয়েছিল বাবুর মুখ দেখে। তবে ভাগ্য এবারও সহায় ছিলো না। পনেরো দিনের মাথায় হুট করে গলায় বান পড়ে মা’রা যায় সে। মামি যেন পাথরের মূর্তিতে পরিণত হয়। আর মামু ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়লেও নিজেকে স্বাভাবিক রেখে মামিকে আগলে নিয়েছিলো। মামি জানালার ধারে বসে অপলকহীন তাকিয়ে থাকতো বাইরে। আমাকে দেখলেই জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের ন্যায় ফুঁপিয়ে কাঁদত। এরপর ফাহিম হলো। ফাহিমের তখন সম্ভবত দশ মাস। মামি আবারও কনসিভ করলো। তবে এবার মামিকে জানানো হয়নি। মামির বোধ শক্তি ছিলো না। অনুভূতিহীন মানবীতে পরিনত হয়েছিল মামি। মামু শুধু আড়ালে কাঁদত। দুই মাসের মাথায় আবারও মিসক্যারেজ। মামি দুই দিন হাসপাতালে ছিলো। আমার এখনো মনে আছে হসপিটালের বেডে শুয়ে মামি মামুর হাতটা নিজের পেটের উপর রেখে বলেছিল, ‘এখানে আরো একজন ছিলো তাই না? কি এমন পাপ করেছি আমি? আমার সাথেই কেন এমন হচ্ছে?’ ডাক্তার বলেছিলো বেবির জন্য আর চেষ্টা না করে। মামির জীবন হু’মকির মুখে পড়বে। মামি মামুকে বলেছিল,
‘আমি তোমাকে সন্তান দিতে অপারগ। আমি তোমার সাথে থাকলে কখনো পিতৃত্বের স্বাদ নিতে পারবে না। তুমি বরং আবার বিয়ে করো।’
মামু সেদিন কিছু না বলে মামিকে জড়িয়ে ধরে শুধু কেঁদেছিল। এরপর তুই পেটে এলি। এটা পুরো অজ্ঞতাবশত। মামির লাইফরিস্ক আছে শুনে মামু বার বার এবোর্শনের কথা বলতো। মামি বাধ্য হয়ে আমাদের বাড়িতে ছিলো প্রায় তিনমাস। ওই তিনমাস মামু আমাদের বাড়ি থেকে তোদের বাড়ি শুধু যাতায়াত করতো।কিন্তু মামি রাগে অভিমানে কথা বলতো না। একটা সময় পর মামু ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল মামিকে নিয়ে গেলো। মামির যখন প্রসব যন্ত্রণা শুরু হয় মামির মামুর হাত ধরে বলেছিলো,
‘আল্লাহর দরবারে শুধু দোয়া করেন আমরা যেন সুস্থ সবল অবস্থায় ফিরতে পারি। আমি আপনাকে খুব ভালোবাসি।’
এবার ঘটেছিলো মিরাকল। দুইজনই সুস্থ ফিরলি। তবে মামু বলেছে তার আর সন্তানের দরকার নেই। একজনই আলহামদুলিল্লাহ। সন্তানের মতো সন্তান হলে একজনই যথেষ্ট। বড় হলে পড়াশোনা করে তুই নাকি চাকরি করবি তাদের দেখবি।
এমন পড়াশোনা করে দেখবি তুই? এই যে তুই গ্রামে থাকা কালীন এর গাছ ওর গাছ থেকে চুরি করতি কয়জন বিচার নিয়ে আসতো? হাতে গুনা কয়েকজন। কারন মামু এর মূল্য পরিশোধ করে দিতো মামু।’
কথা শেষ করে তাকালো তাহমিদ নাযীফাহ’র দিকে। ফুঁপিয়ে চলেছে সে। অর্ধেক শুনেই এই অবস্থা বাকি অর্ধেক শুনলে কি করবে? তবে আজ সে বলবে। কিছু কিছু কথা চেপে রাখা যায় না।
‘এখনই বন্যা করলে তো হবে না। আমার কথা এখনো বাকি।’
‘আমি আর কোনো মন খারাপের কথা শুনবো না।’
‘তবে আজ যে আমি বলবোই। বছর দুয়েক আগে যে মামু খুব অসুস্থ হয়ে পড়ায় ঢাকা নিয়ে আসছিলাম তোর মনে আছে?’
নাযীফাহ ফুঁপাতে ফুঁপাতে বলে,
‘হুম মনে আছে। বাবা খুব অসুস্থ হয়ে গেছিলো।’
‘মামুর একটা কিডনি বিকল।’
বিস্মিত চোখে তাকায় নাযীফাহ। না এবার আর নিজেকে সামলাতে পারবে না সে।দেহ কেমন অসাড়, নিশ্চল হয়ে গেছে। নাযীফাহ’র নিভু নিভু চোখ দেখে দ্রুত এগিয়ে এলো তাহমিদ। তাহমিদ কে চোখের সামনে দেখে শক্ত করে জাপটে ধরলো সে। একটা ভরসার স্থান দরকার ছিলো তার। যেখানে মাথা রেখে অশ্রু বিসর্জন দিতে পারবে। এই প্রশস্ত বুকটাই তার শান্তির জায়গা।
‘মানুষ একটা কিডনি দিয়ে চলতে পারে। তবে আরেকটা তো নাই তাইনা? তখন থেকে মা আর মামু সিদ্ধান্ত নেয় তোর সাথে আমার বিয়ে দিবে। হয়তো মামু আমাকে যোগ্য মনে করেছে। নয়তো ভেবেছে তুই আমার কাছে থাকলে সে নিশ্চিন্তে থাকবে।’
‘আমি বাবার সাথে একটু কথা বলবো।’
‘না, এখন কোনো কথা না।মামু বুঝে যাবে আমি তোকে সব বলে দিয়েছি।মামুর কড়া নিষেধ ছিলো তোকে যেন কিছু না বলি।’
তাহমিদের বুকটাকে আঁকড়ে ধরে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে নাযীফাহ। নাযীফাহ’র কান্না নিস্বন শুনে রুম থেকে বেরিয়ে এলেন আমেনা বেগম। এসেই দেখলেন নাযীফাহ তাহমিদের সাথে লেপ্টে আছে। তাহমিদ আর আমেনা বেগমের দৃষ্টি বিনিময় হতেই তিনি চোখের ইশারায় জিজ্ঞেস করলো, কি হয়েছে? তাহমিদ আস্বস্ত করলো যে কিছুই হয়নি।
তাহমিদ নাযীফাহকে স্বাভাবিক করার জন্য বলে,
‘চিন্তা কর চারজনের পর তুই টিকলি শুধু আমাকে জ্বালানোর জন্য। সারাজীবনের মতো আমার হাড়মাস জ্বালিয়ে খাওয়ার জন্য।’
____________________________________________
ইন্টারে ভর্তি হলে প্রথম বর্ষে সময় পেলেও দ্বিতীয় বর্ষ চোখের পলকে চলে যায়। আসলেও তাই হাতে গুনা দিনগুলো কেমন করে এক এক করে ক্যালেন্ডার থেকে বিদায় নেয়। ছিটকে পড়ে হিসেবের খাতা থেকে। এইতো ক’দিন আগে প্রথম বর্ষের সমাপনী পরীক্ষা দিলো। আর এখন নির্বাচনী পরীক্ষা। উত্তীর্ণ হলে বসা যাবে বোর্ড পরীক্ষায়। কতগুলো দিন চলে গেলো জীবনের খাতা থেকে। ঢাকা শহর মোটামুটি পরিচিত নাযীফাহ। এখন একা একা কোথাও গেলে সমস্যা হয়না। তাহমিদেরও এমবিএ কমপ্লিট। চাকরির চেষ্টা করছে। আজ নাযীফাহ’র নির্বাচনী পরীক্ষার শেষ দিন তাই জান্নাত আর নাযীফাহ প্ল্যান করেছে আজ দুপুরে রেস্টুরেন্টে খাবে। সবচেয়ে বড়কথা হলো আমেনা বেগম কয়েকদিনের জন্য গ্রামে গেছে। আর তাহমিদ বলেছে আজ পরীক্ষা শেষে নিতে আসবে না।কাজ আছে নাকি।
রিক্সা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে মাত্রই রেস্টুরেন্টে ঢুকলো নাযীফাহ আর জান্নাত। তবে সামনের দৃশ্য দেখার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না দু’জন। ভরা রেস্টুরেন্টে একজন মেয়ে তাহমিদের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে ভালোবাসা নিবেদন করছে আর তাহমিদ মুচকি হেসে ফুল গুলো গ্রহন করলো। হাত খামচে ধরলো নাযীফাহ জান্নাতের। চক্ষুদ্বয়ে বারিবিন্দুর আনাগোনা। এইতো বর্ষন হবেই তুমুল বেগে। জান্নাতও যেন বিশ্বাস করতে পারলো না ব্যপারটা। নাযীফাহ জান্নাত কে শান্ত গলায় বলল,
‘আমার শরীরে আর বিন্দু পরিমাণ শক্তি নেই। খাওয়ার ইচ্ছেও মাটি হয়ে গেছে। চল চলে যাই।’
জান্নাত নাযীফাহ’র হাতটা ধরে আস্বস্ত করে বলল,
‘আর একটু দেখ না স্যার কি করে। আমরা যা ভাবছি তা নাও তো হতে পারে।’
‘যাই হোক আমার আর কিছু দেখার শক্তি নেই। বাসায় বলেছেন আজ উনার ইমপোর্টেন্স কাজ আছে তাই নিতে আসতে পারবে না। এটাই সেই কাজ।’
বলেই এলোমেলো পায়ে বেরিয়ে এলো সেখান থেকে। নাযীফাহ’র পিছু পিছু ছুটলো জান্নাতও। তাহমিদ অন্যকারো থেকে ফুল নেওয়া যে নাযীফাহ দেখে সেটা অজানাই থেকে গেলো তাহমিদের
রাস্তায় এলোমেলো হাঁটছে নাযীফাহ। আশপাশের সবকিছু বি’ষাক্ত মনে হচ্ছে। গাড়ির হর্ণ, জনকোলাহল একেবারে বি’ষিয়ে তুলছে। একটা শান্ত নির্জন পরিবেশ দরকার যেখানে একটু কান্না করা যাবে। একটু হালকা হওয়া যাবে।
#চলবে
বানান ভুল ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।