#হৃদয়ের একূল ওকুল
#পর্ব_২
–তারপর, ভাশুর তোমারে কি দিয়া বশ করলো, শুনি।
–আমি সাপ নাকি যে বশ করতে হবে। উনি উনার কাজ করছে, আমি আমার কাজ করছি।
–দুই জন মিল্লা কামকাজ করসো? বাপ্রে! তুমি তো মেলা ইস্মাট।
–ইস্মাট না স্মার্ট। আমি এস এস সি পাশ মেয়ে, ইংরেজি জানি।
–পুরা পাশ দেও নাই। আধামাধা পাশ দিসো। এল্লাই তো তোমার আব্বায় চাচার পোলার লগে তোমারে বিয়া দিসে।
শশুড় বাড়িতে আব্বা আমার মান ইজ্জত দেখি কিছুই রাখে নাই। মেয়ে এক বিষয়ে ফেল, সব সত্য কথা বলে বিয়ে দিসে। আমি কানা হইলে, আমার বছর ব্যাপী ডায়রিয়া থাকলে ও আব্বা কিছু লুকাইতো না। বরং, আমার বর্ণনা দিতো, একটি সারা বছরের ডায়রিয়া রুগী, অসহায় কানী মেয়ের জন্য সৎপাত্র খুঁজতেছি। এখন আবদুল্লাহ মিয়ার সাথে বিবাহ হবার পর মনে হচ্ছে ‘বুঢ্ঢা মিল গ্যায়া’। দীর্ঘশ্বাস চেপে রুমা ভাবীর প্রশংসা শুরু করলাম। মহিলাদের দূর্বল জায়গা হলো, তাদের রূপের প্রশংসা করা।
–ভাবী, আল্লাহয় আপনারে কোন জায়গার মাটি দিয়া বানাইছে গো।
–ও আল্লাহ, কি কও এসব। কেন কি হইছে।
— ঐ জায়গার মাটি আইনা গালে ঘসতাম। কি চকচকাইতেছে গাল দুইডা।
–হালা ইটার দিসি, বুজো না! এই লাইগা চকচকায়।
রুমা ভাবী হালারেই খেয়ে ফেলছে বুঝলাম। নাহ, এই বোকা মহিলায় মাথায় পায়খানা। এরে দিয়ে আমার আর কোন কাজ হবে না। বরং বাড়িটা ঘুরে দেখায় মন দিলাম। মোটামুটি আধুনিক বাড়ি। গাও গেরামের মধ্যে এমন বাড়ি করার জন্য কলিজা লাগে। তার চেয়ে ও বড় রুচি লাগে। আম্মা এই বাসায় আসলে খুব খুশী হবে। আম্মার কথা মনে হতে বুকটায় টান লাগলো। আমার আম্মা আমার সৎ মা। সৎ মানে এক্কেবারে সৎ, খাঁটি। কোন ভেজাল নাই এমন মা। আমার মরা মা কেমন হতো বেঁচে ঘাকলে আমি জানি না। কিন্তু আমার এই মায়ের চেয়ে ভালো হতো না। আব্বা আমাকে জীবনে বহুবার শাসন করতো গিয়েছে। যতবার শাসনের কাজ করেছি, আম্মা ততবার আব্বার সামনে দাঁড়িয়ে আমাকে আড়াল করে রেখেছে। এই যে আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবার চিন্তা করছি, সেটাও করতে পারছি আম্মার ভরসায়। আব্বাকে বুঝিয়ে আম্মা ঠিক আমার মাফ আদায় করে নেবে। এই বাসা থেকে ভালো দিন দেখে পালাতে হবে। আব্বা আসলে এরা আমাকে আব্বার সাথে পালাতে দেবে না। শশুড় আব্বা ভালো মানুষ। এক সকালে সে আমার মন জয় করে নিয়েছে। কিন্তু, যাকে দিয়ে এই সম্পর্ক, তারেই আনার ভালো লাগে নাই। সুতরাং, দিরং করং যাবে না। পলান্তি পলান্তি খেলা খেলে, পালাতে হবেই।
দুপুরের পর আব্বা এক হাতে বিশালাকার রুই – কাতলা, অন্য হাতে পিঠার পাতিল নিয়ে উপস্থিত। আব্বার পিছন পিছন কানি ঘোমটা টানা ধীর চলনে পায়ে পায়ে হেঁটে আসা মহিলাটা আমার উনিশ বছরের চেনা আম্মা। আম্মার ফিরানীতে আসার কথা না। আম্মা খুব কম বাড়ির বাইরে আসে। নানাবাড়ি গেলেও বছরে একবার। আম্মার আলাদা কোন জগৎ নাই। আসলে, ছিলো ও না। আমার কিসে ভালো হবে। কিসে মন্দ হবে, সব কিছুর খোঁজ রাখতে রাখতে আম্মার জীবনটাই আমিময় হয়ে গেছে। আজকে আমিহীন বাড়িতে আম্মার প্রান আইঢাই করছিলো। বেশ বুঝতে পারলাম, ছোটবেলায় খেলার পুতুলটারে বিয়ে দিয়ে যে কান্নায় বুক ভাসাতাম, আম্মার সত্যি সত্যি জ্যান্ত খেলার পুতুলকে হারিয়ে, আম্মা অস্থির হয়ে উঠে ছিলো। তাই আব্বার সাথে চলে এসেছে। শশুড় আব্বা ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠেছে। এমনকি আমার মুতালী শাশুড়ী বুড়ীর হাঁক ডাক শুনতে পাচ্ছি। ভালোই লাগছে। বুড়ীটা যত খারাপ ভেবে ছিলাম, তত না।
নফ্রালী ও তার বউ দুই মাছ কেটে কুটে নামিয়ে ফেললো। কল্লা দিয়ে মাষকলাই ডাল, রুই পেটির টমেটো ঝোল, কাতলের কালিয়া, লেজের সাথে বেগুন আলুর কষা, সাথে মুরগীর সালুন। আব্বা খেতে বসে বারবার ‘আলহামদুলিল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ ‘করতে লাগলো। আম্মা ঘোমটার এক কোনা দাঁতে আঁটকে ভাত খেতে খেতে অন্য হাতে অনবরত চোখ মুছছে। শশুড় আব্বা, আমার আব্বার জন্য খেজুর গুড় আলা চালের পায়েস রান্না করিয়েছে। রুমা ভাবী বারবার আমার সৌভাগ্য নিয়ে চিন্তিত। এত আয়োজন মেয়েপক্ষের জন্য ছেলেপক্ষ বিয়ের পরেও করতে পারে, এটা উনি বিশ্বাস করতে পারছে না। আব্বা খেয়ে সেরে নফ্রালীকে নগদ পাঁচশ টাকা বকশিশ দিলো। আম্মা দেখি আরো বিশাল দাতা। সুমনাকে কানবালি খুলে দিয়ে দিলো। সুমনা কানবালি গুলো হাতের ফাঁকে আটকে রেখে দাঁড়িয়ে আছে। আম্মা তাকে বুকের মধ্যে টেনে নিয়েছে।
তখনি জানলাম, চার বছরের নফ্রালীকে পাশের রেলস্টেশনে কে কারা নামিয়ে দিয়ে গিয়েছিলো। শশুড় আব্বা দেখতে পেয়ে বাড়ি নিয়ে আসে। সুমনার গল্পটা আরো অদ্ভুত। একদিন সকালে শাশুড়ী আম্মা কলপাড়ে একটা বছর তিনেকের বাচ্চা মেয়েকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখেন। যারে খুঁজতে কেউ কোনদিন আসে নাই। এই মেয়েটা সুমনা। আমি নিজেকে এতিম ভাবতাম কখনো কখনো। দুজন এতিম মানুষকে দেখে নিজেকে আল্লাহর দয়ায় বেঁচে থাকা মানুষ মনে হচ্ছে। সুমনা আম্মার বুক থেকে সরছে না। মনে হচ্ছে, আম্মাই সুমনার মা। আমার খুব হিংসা হচ্ছে। আমার এমন মায়ের ভাগ আমি কোনদিন কাউকে দিব না। কোনদিন না।
যাবার আগে আব্বা ঘরের ভেতর বসে বিশাল লেকচার দিয়ে বুঝিয়ে দিলো, আমার কত ভালো ঘরে বিবাহ হয়েছে। আম্মার কিছু বলার নাই। আব্বার কথায় মাথা নেড়ে হাঁ’তে হাঁ, না’তে না বলে যাচ্ছে। সবশেষে আব্বা পকেট থেকে একটা ছোট্ট কালো বাক্স বের করে আমার হাতে দিলো।
–এইটা মুবাইল ফোন। জামাই বাবাজীরে এটা দিয়া নিয়মিত ফোন করবা। ব্যালেন্স আমি প্রতি মাসে দিবনে। অন্য কোথাও সংযোগ করলে আগের বারের মতো তোমারে ক্ষমা করবো না। নিজের জীবন নিয়া ছিনিমিনি খেলতে চাইছো। এখন স্বামী সংসারের বাপের ইজ্জত নিয়া কোস্তাকুস্তি করলে বিয়াইত্তা মাইয়া হয়ে বাপের হাতে ঠেঙ্গানি খাবা। দশ গ্রামে জানাজানি হবে। বিষয়টা তোমার জন্য ভালো হবে না। বুঝতে পারছো?
মাথা নেড়ে হা বলেছি। আব্বার মুখের উপর কথা বলার সাহস নেই। আম্মা যাবার বেলায় শাশুড়ী আম্মার কাছে আমার নাদানীপনার জন্য আগে থেকে মাপ চেয়ে নিলো। কথা ঠিক হয়েছে, আসছে শুক্রবারের পরের বৃহঃস্পতিবার, বাদ যোহর আবদুল্লাহ মিয়ার বাড়ি থেকে আমরা সবাই আমাদের বাড়ি যাবো। আবদুল্লাহ মিয়া সরাসরি ঐ বাড়িতে উপস্থিত হবে। ঘুমোবার আগে ফোনটা পুরো চার্জ করে বালিশের নিচে রেখে দিলাম। আবদুল্লাহর নম্বর আমার জানা নাই। তার সাথে যোগাযোগের দরকার নাই।
সকাল সন্ধ্যা বাড়িতে আমার করার কিছু খুঁজে পাই না। বুড়ো বুড়ি নিজেদের রুটিনে চলে। নিয়ম করে শশুড়ের সাথে নাস্তা খাওয়ার সাথে কারাতে ক্লাসে ভর্তি হয়েছি। মোবাইলের ভেতর গ্রান্ডমাস্টার নামের এক লোক হাই হুই করে কারাতে শেখায়। নফ্রালীকে দিয়ে আমার জন্য কারাতে বাসায় আয়ত্ব করার জিনিষপত্র আনানো হয়েছে। কারাতের পোশাক শশুড় আব্বা অনলাইন থেকে অর্ডারে বানিয়ে এনেছেন। যদিও ওটা পরতে আমার খুবই শরম করে। তবু শশুড় আব্বার মন রাখতে পরে নিয়মিত কসরত করতে হয়। আব্বা বলেন,
–দিনকাল ভালো না মা। ঘোর কলিকাল। এরমধ্যে তুমি জুয়ান মেয়েছেলে। আমার আবদুল্লাহ মানুষ ভালো। তয়, সে কুনু ঝগড়া ঝাটির মধ্যে নাই। তার সিনা শক্ত, মন সিরায় ভেজা পুয়া পিঠা। বাহিরে মচমচা, ভিতরে নরম কোমল।
–হে তো মানুষ, তারে কি খাওয়া যাবে আব্বা? তার নরম মন দিয়া আমি কি করব বলেন। মন শক্ত হইলে ভালো ছিলো। ঝগড়া হইলে সে মুড়ি চাবাইতো।
–তুমি বড়ই দুষ্টু মা জননী। আমার আবদুল্লাহর জন্য আমি এমন মাইয়াই খুঁজছি। তোমরা হইবা একে অন্যের লাঠি।
–আমার এমন কি বয়স আব্বা! এখনি আমি লাঠি হবো। আমি বড়জোড় হইলে গেলাস হইতে পারি। সব সময় পানি থাকলো, আপনের পএলার মাথাও ঠান্ডা থাকলো। দরকারে তার মাথাত পানি ঢাইলা দিলাম।
— শোন, লাঠি হইলো কথার কথা। ‘দশের লাঠি একের বোঝা ‘ পড়ছো তো। সেই রকম, স্বামীর বিপদে স্ত্রী হইবে শান্ত। স্ত্রীর বিপদে স্বামী হইবে মান্দার গাছ। স্ত্রীরে সর্বদা নিরাপদে।ছায়া দিবে। স্বামীরে স্ত্রী আশ্রয় দিবে। নিজেদের মধ্যে মান অভিমান কম করবা মা। ছেলে আমি মানুষ করছি। তোমার অমর্যাদা হবে না।
শশুড় আব্বার কথা ঘাড় নেড়ে মেনে নিয়েছি। বুড়োর সাথে তর্ক করে লাভ নাই। বুড়ো-বুড়ির উপর মায়া লাগে। আব্বা আম্মার কথা মনে হয়। তাদের দিলে দুখ দিলে যেমন কষ্ট লাগত, তেমনি এই বুড়ো বুড়ি তাদের আদর সোহাগ দিয়ে আমারে বেঁধে ফেলছে। তবে, বিবাহের সুফল টের পাচ্ছি। এখন পর্যন্ত কেউ আমাকে পড়তে বসতে বলে নাই। শাশুড়ী আম্মা দিনে কয়েকবার আমাকে দেখতে চান। কাছে বসলে পুরানো দিনের গাল গল্প করেন। সেখানে মানু নামের এক নারীর জীবন কাহিনী উঠে আসে। এই মানুকে আমি জানি না। আমার শাশুড়ীর নাম শামসুন্নাহার। শশুড় আব্বা আম্মাকে ব্যপক মোহাব্বত করেন। যৌবন বয়সে, তিনি আম্মার জন্য একবার ঘোড়া ভাড়া করে নিয়ে এসেছিলেন। আম্মা আপাদমস্তক বোরখাবৃত হয়ে সেই ঘোড়ায় চড়ে সারা গ্রাম ঘুরে বেড়িয়ে ছিলো।
–বুঝাল বউ, তোমার আব্বায় আমারে আইনা দিলো এক লাল শাড়ি। লগে ঠোঁট রাঙ্গানী। আমি হইলাম বুরকা পরা মায়ালোক। আমার কি আর অমন শাড়ি পইরা অভ্যাস। তোমার শশুড় জোড় কইরা শাড়ি পরতে কইলো। পইরা, লিবিস দিয়া হেরে সালাম করসি। ওমা, হেয় খুশীতে কাইন্দা দিসে। শাড়ির উপ্রে বোরখা পরলাম ক্যান। এঔ নিয়া কত কথা, কত রাগ। আমার তো শরম করে। গেরামে গেরামে ঘুরমু, পরপুরুষে দেখব।
–বেডারা দেখলে ক্ষতি কি। আপনে সুন্দর মানুষ, দেখলো একটুস খানি।
–তৌবা তৌবা, কি কও? স্বামী ছাড়া রূপ সৌন্দর্য দেখান উচিত না। তুমি বুরকা পরবা? এই সুমনা, বৌরে আমার সৌদি বুরকাডা বাইর কইরা দে। বউয়ে একবার পরুক।
–আমি বোরখা পরতাম না। আপনের বেরখা আপনেই পরেন। অত পুরান বোরখা গায়ে দিলে কুটকুটাইব।
–ও মা! পুরান হইত কেরে। নয়া বুরকা। আমার আবদুল্লাহ, আমাগো লইয়া হজ্জ কইরা আসুনের সময় আমারে কিনা দিসে।
–আম্মা আপনের ছেলে হজ্জ কইরা ফেলছে? সে তো বিরাট ওলী। বিবাহ শাদীর দিন দুনিয়ায় সে কি করে। তার তো চিল্লায় বইসা থাকা দরকার আসিলো।
মুতালী বুড়ি ততক্ষণে হজ্জের গল্প জুড়েছে। আবদুল্লা তার পিতা-মাতাকে হজ্জ করাইয়া কি পুন্যের কর্ম করিয়াছেন। আম্মার চোখ ক্ষণেক্ষণে ভিজে উঠছে। চোখ মুছে কুল পান না। সুমনা এসে দুপুরের খাবার খাওয়াতে নিলে আমি খাওয়ায় দিলাম। এরা অনেক কিছু বোঝে না। বুড়িকে সুন্দর মতো পরিষ্কার করলে বুড়ির পাশে অনেকক্ষণ বসা যায়। জাউভাত আর বিদেশী মুরগীর সালুন খেতে খেতে বুড়ি গল্প করে। টুকরো টুকরো স্মৃতিমাখা ভালোবাসা শুনতে ভালো লাগে। মানুর কথা আসে আসবাবে,তৈজসপত্রে।
–এই খাটটায় মানু ঘুমাইতে পছন্দ করতো। তোমার আব্বায় মানুর জন্যি হাতে বোনা চাদর কিনা আনছিলো। কি আরাম গাত দিলে ঘুম আহে।
–মানুর খাটে আপনে ঘুমান কেন। মানু কই।
এই প্রশ্নের আর উত্তর হয় না। বুড়ি ফিকফিক হাসে। বুড়ির জন্য ডায়পারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। শশুড় আব্বা আমার উপর মহা খুশী। ঘর দুয়ার নিজের হাতে পরিষ্কার করে স্যাভলন ছিটিয়ে আগর বাতি জ্বালিয়ে দিলাম। সুমনা এখন এই ঘরে নামাজ পরে। নফ্রালীর সাথে ঝগড়া হলে, এই ঘরে পাটি পেরে ঘুমিয়ে থাকে। মাঝ রাতে নফ্রালী দরজায় টোকা দিলে, সুমনা বেড়িয়ে এসে ওকে হালকা স্বরে হুমকি দেয়। আমার রাতে ঘুম আসে না। কে কোথায় কি করে, সব জেগে দেখি। ফোনটায় আজ পর্যন্ত আব্বা ছাড়া কারো ফোন আসেনি। আবদুল্লাহ মিয়া সেই যে গেছে, কর্মস্থল থেকে ফেরার কোন খবর নেই। শশুড় আব্বার কাছে শুনেছি, সে ভালো আছে। চাকরিতে কাজের চাপ থাকায় ছুটি পাচ্ছে না। আমার এতে কোন বিকার নেই। ছাদের উপর আমসত্ব বানিয়ে রোদে শুকিয়ে ডিব্বা ভর্তি করি। প্রণালী আমার শশুড় আব্বার। আলাদা চমক দিয়েছে শাশুড়ীর বুদ্ধি। একেক আমসত্বে একেকে রকম মশলা মিশিয়ে বানানো হয়। আশপাশের বাড়িতে এই আমসত্বের কদর অনেক। শাশুড়ী আম্মার কাছে বিভিন্ন পদের রান্না শিখি। আম্মা কোনদিন আমার গায়ে আগুনের তাপ লাগতে দেয় নাই। এখন একটা খয়েরী রঙের ডায়রীতে যা পারি টুকে রাখি। শশুড় শাশুড়ীর আনন্দে আমিও আনন্দিত। এ বাড়িটাকে একটু একটু করে ভালো লাগছে। আবদুল্লাহ মিয়াকে মাঝে মাঝে মনে হয়। লোকটা এক দুই বার আসলে মন্দ হয় না। ছেলেকে দেখলে বুড়ো বুড়ির মন ভালো হতো।
নফ্রালী আজকাল হাসিহাসি মুখ করে বাড়িঘরে ঘুরে বেড়ায়। সুমনা মা হতে চলেছে। আব্বা আম্মা আমাকে এসে কয়েক বার দেখে গেছে। আম্মা প্রতিবার সুমনার জন্য খাবার রান্না করে আনে। আগে হলে খুব হিংসা হতো। আমার আদরের ভাগ অন্য কেউ পাক, সহ্য করতে পারতাম না। বাড়িতে থাকতে থাকতে কেমন যেনো মানুষগুলোর মতো দিল খোলা হয়ে উঠেছি। সুমনা এখন সিড়ি দিয়ে ওঠা নামা কম করে। শাশুড়ী আম্মার ঘরে আমি মাঝে মাঝে শুই। বুড়ি মনের আনন্দে সারা রাত বকরবকর করে। ভোর রাতে আমার একটু শীত শীত লাগলে বুড়িকে কষে ধমক দিয়ে ঘুমোতে বলি। নয়ত বুড়ি সারাদিন পাগলা পাগলা হয়ে থাকবে। ফজরের নামাজ শেষে রান্নাঘরে যাই। শশুড়ের নাস্তার যোগাড় শেষে শুনি নফ্রালী সুমনার জন্য আল্লাহ পাকের দরবারো খাস দিলে দূয়া করছে। আসন্ন সন্তান ও তার মায়ের জন্যে পিতার তোলা দুই হাত কি আল্লাহ কখনো ফেরান? মনে হয় না। আচ্ছা, আমার বাচ্চা হলে কি আবদুল্লাহ মিয়াও এভাবে দূয়া করবে? উদ্ভট চিন্তার জন্য পরক্ষণে নিজের মাথায় গাট্টা মারি। ছি ছি, ছিনাল মেয়েছেলে, তোর মুন্ডুতে ঘিলু আছে, ব্রেন নাই। নাহ, মায়মুনা, তুই মায়া কাটা। মায়া না কাটালে বন্ধন ভাঙা যায় না।
(চলবে)