#হৃদয়ের_একূল_ওকুল
#পর্ব_১০
পাশের ঘর থেকে গোঙানীর আওয়াজ আসতেছে। মেয়েছেলের কথার মাঝে পুরুষ লোকের জোর গলার শব্দ, এরপর সব চুপ। আবদুল্লাহ এখনো ফেরে নাই। অফিস শেষে আবদুল্লাহ মিয়া নাইট স্কুলে ফ্রি ফ্রি পড়াইতে যায়। লোকটার তেল দেইখে অবাক হই। এত কিছুর পরে আবার বুড়া বুড়িদের পড়ানোর দরকারটা কি? কাশেইম্যাকে টাইট দেয়ার পর, সারাদিনে একবারো চেহারা দেখিনাই। রতন বিকালে এসে খোঁজ নিয়ে গেছে। রতনের বাপ -ভাই নাই। মায়ের এক পা ভাঙা, বাড়ি বসে কাঁথা সেলাই করে। ক্লাস টেন পর্যন্ত পড়া রতনের মাথা খুব ভালো। সেকেন্ডে অংক কষে, ইংরাজী ট্রান্সলেশন করতে পারে। আমার মাথায় যত গু -গোবর রতনের মাথায় ততই মনি মুক্তা। শ্বশুড় আব্বা রতনকে পাইলে পালক লইতেন। তাহার মন সাগরের মতন বিশাল। রাত আটটার সময় আবদুল্লাহ মিয়া দুই প্যাকেট বিরিয়ানী নিয়া উপস্থিত হইলো। আবদুল্লাহ মিয়া কড়াইতে প্রথমে হালকা তেলে এক চিমটা লবন দিয়া তেল গরম করে তাতে বিরিয়ানী ঢেলে দিলো। তার মধ্যে দিলো আধা কাপ পানি। সব শেষে ঝাঁপা ঢাকা দিয়ে মিনিট দশেক গরম করে ঢাকা খুললো। বিরিয়ানীর সুবাসে ঘর ভুরভুর করতেছে। খেতে গিয়ে দেখি, বটি দিয়া কু্ঁচি কুঁচি করে কাটা সাইজের মাংস দাঁতে টেনে ছেড়া যাচ্ছে না।
— আপনারে ডস দিয়া কুত্তার জিবরার বিরানী ধরায় দিসে। এইটা গরুর বিরানী? ওয়াক থু! মাংস গুলান মনে হইতেছে কুত্তার মাংস। রাস্তা থিকা কুত্তা ধইরা ছিল্লা কাইটা চাইলের ভিতরে দিয়া আপনাগো মত বদল গুলার লাইগা রাইন্দা রাখছে। বিরিয়ানী খাইলে আমারে কবেন। আপনের আম্মায় আমারে অনেক রান্দা বাড়া শিখাইছে।
— আল্লাহ তোমার কপালে আজকা এই রিজিক রাখছে। খাদ্য নিয়া বাজে কথা বইলো না। কুত্তার মাংস শুনছি, জিবরা শুনি নাই। তুমি কি কথা পয়দা করো, মুনা।
–জিন্দেগীর বাগানে আপনে আমার পুরা নামটা কয়েক বার কইলেন। মুনা নামে আপনের কোন গোপন প্রেম আছিলো না?
— তোমার মাথায় প্রেম ছাড়া আর কিছু ঘোরে না। আল্লাহর নাম নিয়া খায়া নেও।
মাংস বাইছা বিরানীর ভাত একটা ডিম ভাইজা খাইতে লাগছি, ভুইত্তামারা খাবলা দিয়া আমার পাতের হাফ ডিম নিয়া খাওয়া শুরু করলো। লোকটা আসলেই বিহায়া। আরেক বেটির পাত হাতায়া আইডা জুডা খায়। খা, তুই খাবি আগে জানলে তেলাপোকার ডিম মিশায় আনতাম। আবদুল্লাহ মিয়া ডিম ভাজি মুখে দিয়া হাত তুইলা আল্লাহর কাছে দোয়া করা শুরু করছে,
— ইয়া মাবুদ, ইয়া পরওয়ারদিগার, তেমার দরবারে লাখ কোটি শুকরিয়া। তুমি আমার পাগল স্ত্রীর হাতে কি জাদু দিসো। এক ডিম ভাজি দিয়া ভাত খাওয়া হয়ে যায়। তুমি তার মাথায় একটু বিবেক বুদ্ধি দান করো, আমিন।
–চ্যাতাইতাছেন ক্যান আমারে? আমার মাথার ঘিলুতে বেরেন নাই কইতে চান তো সোজাসুজি কন। ঘুরান্টি মাইরা প্যাচ লাগায় কন ক্যারে। আপনে বেডা মানুষ হইলে কিত্তো, আপনের পেডে জিলাপী। চৌদ্দ প্যাঁচের জিলাপীর লোক আপনে।
— কি আর করবা, এডাও আল্লাহর ইচ্ছা। তোমার পেটে জিলাপী নাই, তাই মগজে বুদ্ধি ও নাই। প্রতিদিন পেট ভিতরের দিকে টাইনা তিন খান প্যাচ আঁকবা। দেখবা, জিলাপী তৈরী হয়া গেছে।
ভাতের থাল নিয়া রাগের চোটে পাকের ঘরে রাখছি। এই লোকটা আমারে মানুষ মনে করে না নাকি! বয়সে ছোট, শিক্ষায় কম, তাই যখন যা মন চায়, তাই কয়া খেপায়। এর একটা বিহিত করা দরকার। পাশের রুমের দরজা খোলার আওয়াজ পাইলাম। লুৎফা ছিনালী খাবার গরম করতে আসছে। ছিনালীর গায়ে কমলা রঙের ম্যাক্সীর উপরে লাল রঙের বড় ওড়না। ছিনালী আবার গলা মাথা ঢাইকা রাখছে। হুহ, ঢংয়ের পিরিতি রে। কাইল পরছে জর্জেটের শাড়ি, আইক পরছে বুরকা। শালী একটা ছিনালীর ঘরের আস্তা বৈতাল বেডি। একেক সময় একেক রূপ দেখায় বেডা ছউলের মন কাড়ে। আবদুল্লাহ মিয়া হাত ধুয়ে পান মুখে দিয়া পাশের ঘরে গল্প করতে গেলো। গোলামের পুত কাশেইম্যারে সহ্য করতেছি। হাতে কোন দলিল দস্তাবেজ নাই। দেখি দিন যাউক। লুৎফা দেখি আস্তে আস্তে হাটে চলে। ঘটনা বুজলাম না। কালকেও কেমন পক্ষী হইয়া উড়তে ছিলো। আইজ হইলো কি। জিজ্ঞেস করার দরকার নাই। বেশী খাতির জমাইলে পরে কোলে উঠব।
–তুমি কোন কলেজে ভর্তি হয়ে যাও ভাবী। দিনের বেলা একলা একলা বাড়ি থাকো, বরং পড়াশোনা করো। তোমার কি পড়াশোনায় গ্যাপ আছে?
–গ্যাপ কিতা। কলেজে ভর্তি হমু যে, আমার তো এক বিষয়ে পাস নাই। বলেই জিহ্বায় কামড় দিলাম। তুই একটা ছাগলা বেডি মায়মুনা। দিলি তো লুৎফার সামনে নিজের ইজ্জতটার টায়ার পাংচার কইরা।
— এক সাবজেক্টে সমস্যা নেই। তুমি কলেজ শুরু করো। মাঝে ঐ বিষয়ে পরীক্ষা দিয়ে নিলে। তোমার সামনে জীবন পরে আছে ভাবী। সময় নষ্ট করো না। আবদুল্লাহ ভাই ভালো মানুষ। সবার কপালে এমন ভালো মানুষ জোটে না।
— সে ভালো না খারাপ তা দিয়া আপনের কি কাম। আপনে এত কেমনে জানেন সে ভালো না মন্দ। আমি তার ভাত খাই, কিছু বললে আমি বলবো। আপনে আর সাটিফিকেট দিয়েন না।
লুৎফা কিছু না বলে চলে যাচ্ছিলো। ওর চাদর টা সরে গেছে খেয়াল করে নাই। দুই হাতে বেল্টের দাগে ভরা। ঘাড়ে গলায় লাল লাল আঁচড়। আমি দেখে মুখে আঁচল চাপা দিলাম। ভয়ে, খুব ভয়ে। কাশেইম্যা এই বেটিরে তাইলে তখন মাইর ধোর করছে? আবদুল্লাহ মিয়া এতদিন এদের সাথে থাকে, কিছু টের পায় নাই। কিছুই বোঝে নাই? অবশ্য, ছেলেদের বোঝার ক্ষমতা এই সব বিষয়ে মেয়েদের চেয়ে কম। আবদুল্লাহ মিয়া সহজ সিদা মানুষ। সে হয়ত খেয়ালই করে নাই। লুৎফার জন্য আমার খারাপ লাগতেছে, খুব খারাপ। ওরে কত গালি গালাজ দিসি মনে মনে। এদিক দিয়া সে এমনে মাইর খায়। আচ্ছা, জামাইটা যেমন বদমাইশ, এমন তো হইতে পারে বউটাও বদমাইশ। সে তো ছিনালী করে। আমার নিজের চোক্ষে দেখা। তাইলে মনে হয় তাইরে ছিনালীর জন্য খিচা দিসে কাশেইম্যা। কিন্তু কাশেইম্যারে পিটাইবো কে। মাথার মধ্যে কুটকুট করে উকুন কাটা শুরু হইছে। পাশের রুমেই এমন দুইটা জিনিষ থাকলে কি আর শান্তিতে থাকা যায়!
সকালে আবদু্লাহ মিয়ার জন্য হাত রুটি, আলু ভাজি, ডিমের পোচ কইরা দিলাম। সে নাস্তা পাইয়া অত্যন্ত অবাক। সাথে সাথে তার আব্বাকে টেলিফোন দিয়া জানাইলো। কয়টা দিন পর শ্বশুড় আব্বার সাথে কথা বলতে পারলাম। তার কাছে মাপ চেয়ে শান্তি লাগতেছে। কাশেইম্যারে আমি ঘুরান্টি প্যাঁচে ফালাইছি, এটা বলতে পারলে শান্তি লাগতো। কিন্তু এটা বললে আবদুল্লাহ মিয়া ঘটনা জেনে যাবে। বরফ পানি হও মায়মুনা বেগম, ধীরে বইয়া যায় যমুনা। তুমি ও ধীরেসুস্থে আগাও। আব্বারে বললাম, কারাতের ক্লাসটা আমি আবার শুরু করতে চাই। উনি শুইনা খুবই খুশী হইছেন বুঝলাম, কিন্তু প্রকাশ করলেন না। আম্মার সাথে কথা বইলা দোয়া নিলাম। সুমনা, নফ্রালী লাইন দিয়া আমাদের সাথে কথা বলার জন্য দাঁড়ায় ছিলো। সুমনার খুব শখ, আমার সংসারে একদিন আইসা থাকবে। ওরে বল্লাম,
–পেটের জিনিষটা খালাস কইরা লও বিয়াক্কল, আমারে তো পোয়াতী বানায় দিসিলা। এইখানে আসলে কবা, আমার তিন বাচ্চা আছে। একটা আব্বা, একটা আম্মা, আরেকটা তোমাদের আবদুল্লাহ মিয়া।
সুমনা বেদম প্রকার হাসতে হাসতে ফোন কাটছে। কাশেইম্যা লুৎফারে নিয়া অফিস গেলো। লুৎফা কয়েক পিস সুজির হালুয়া দিসে। আবদুল্লাহ মিয়ারে সুজির হালুয়া দিতে চাইলাম। সে না করলো। সে নাকি তার বউয়ের হাতের নাস্তার সোয়াদ অন্য কিছুতে মিশাইতে চায় না। ওরে আমার পিরিতিরে, রসের বাইদা পিরিতি। রতন কি আজকে নাস্তা নিয়া আসবে? সে আসলে তারে দিয়া কয়টা কাপড় কিনাবো। বাসায় বইসা থাকতে ভালো লাগে না। তার মায় কাঁথা বানায় কই বেচে জানতে হবে। আমার হাতে কোন টাকা পয়সা নাই। এখান থেকে ভাগতে হইলে ও টাকা পয়সা লাগবে। আবদুল্লাহ মিয়ার মায়ায় আটকাইলে জীবন চলতো না মায়মুনা। তুই ভুলিস না,তোর জীবনটা এইখানে জালে আটকাইন্না কাতলা মাছের লাহান খাবি খাইতাছে। খলখল কইরা সময় নষ্ট করলে চলতো না তোর। আবদুল্লাহ মিয়ারে বিদায় দিয়া, কাপড় নাড়তে ছাদে গেছি। কালকের ঝগড়াইট্টা নানী দেখি বইসা বইসা লাঠি দিয়া কাউয়া তাড়ায়।
–হে গো তাড়ায় লাব আছে? নিজে এমন রইদে বইয়া বুড়ি কাউয়া হয়া আছে, আবার কাউয়া তাড়ায়।
— এ নাতিন, তুই দেহি আমার লাহান আছোস। তোর বয়সে আমিও এমুন মাত মাতাইতাম। তুই আবদুল্লাহর বউ না। কাছে আয় দেহি।
–ক্যান বুড়ি, আমার চুলডি ছিড়তি? আমি অত বেকুব না।
— আহরে, আয় না নাতিন। তোরে ভালো কইরা দেহিও নাই। শিক্কিত মাইয়াডা কেমুন আছে। লুৎফুন্নেসা খানম?
নানী বুড়ির কথায় চমকালাম। লুৎফা ছিনালীর নাম এত সুন্দর! আমার একটা নাম মায়মুনা, তার সাথে বেগম লাগায় শ্যাষ, আর সে বেটির নাম খানম? আব্বা একবার বলছিলেন, ভালো বংশের মাইয়া পোলার নামের শ্যাষে খান না লিখা খানম লেখে। নানী বুড়ির কথা শুরু হইছে,
— মাইয়াডা লেহাপড়া জানা। কাশেম একটা বেহুরমত। ওর গলায় মাইয়াডা কেমনে আইলো এডাই বুজি না। তোর জামাই তো সোনার টুরকা হীরার টুরকা পুলা। সাত চড়ে রা করতো না, তয় বিপদে আগাইয়া আইব হগ্গলের আগে। কাশেম হমুন্দীর পুতে হইলো হিয়াল, কাইল্লা হিয়াল। লুৎফুন্নেসা খানম মাইয়াডা হুরপরী। হিয়ালে পরীরে জাদু কইরা বাইন্দা রাখছে। এই জাদু কাডাইতে আইবো এক বড় জাদুগর।
–জাদুগরডা কেডা বুড়ি? আবদুল্লাহ মিয়া নাকি নীচতলার কবি খাসী। তোমার বাড়িত সব আজিব আজিব লোকের জায়গা দিয়া রাখছো।
–একেক ফেলাটে একেক রঙ্গের সংসার। কার কথা কে কয়রে বইন। যে যার তালে চলে, ভাও বুইজা বাঁচে। মুখে মুখে পিরিতির গান, স্বার্থ শ্যাষে আপনা বুজে হগ্গলতে ভগবান।
— ও বাবা বুড়ি! তোমার চিমসা প্যাডে এত কথা? তোমার কাছে পুরান শাড়ি আছে? কাঁথা বানামু।
–ক্যান তোর কি বিয়ানের বয়স হইছে। মাত্র বিয়া করলি, আদর সোহাগে মানুষডারে বুজ। ঝড়গা কর, মিলমিশ কর, ত্বরার কিতা লাগাইলি।
–ঝগড়াইট্টা বুড়ি, কাঁথা বানায় বিক্রি করমু। হাতে টেকা পয়সা নাই। আমার বিয়াত মত আছিলো না। ঘর সংসার ভাল লাগে না। মনের ভিত্রে পলাই পলাই লাগে। আবদুল্লাহ মিয়া খুব ভালো মানুষ। আমার মন বসে না বুড়ি।
— কস কি ঘরজ্বালানী। আইজ থেকা আবদুল্লাহ আওনের আগে লিবিস লুবিস লাগায় শাড়ি পিনবি।
বুড়ির আচারের ডিব্বা থেকে এক খাবলা আচার তুলে নিয়ে দৌড় দিলাম। — বুড়ি, তোর আবদুল্লাহরে তুই শাদী কইরা ফেলা। আমিও বাঁচি, তুই ও বাঁচস। হিহি।
দরজায় তালা দিয়ে নীচের দোকানে গেছি। আনাজ পাতি নাড়া চাড়া করে সামনের হোটেলে গিয়ে রতনের খোঁজ কইরা শুনি,রতন কাজে আসে নাই। লুৎফার কথা গুলা মাথায় ঘুরতেসে। আবদুল্লাহ মিয়ার সাথে আমার কোন সম্পর্ক হয় নাই। এখন তারে কলেজের কথা বললে সে কি মানবে? আমার পিছনে টাকা খরচ কইরা তার লাভ কি। আব্বা ফেল করার পর পরিষ্কার বইলা দিসে, আমার লেখাপড়ার পিছে একটা টেকাও সে খরচ করবে না। শ্বশুড় আব্বারে বললে, তিনি নাচতে নাচতে রাজী হয়া যাবেন। যে মানুষ গুলার কাছ থেকা এত সাহায্য নিয়া জীবনে বড় হইতে যাবো, দিন শ্যাষে তাদের সাথে বেঈমানী করি কেমনে। কেমনে মায়মুনা, তুই তো মুনাফিক না। নিজের স্বার্থের জন্য শেষ পর্যন্ত মুনাফিকি করবি? আর ভাবতে পারতেছি না। চোখ ফাইটা পানি আসতেছে। হোটেলের লোকটা ভালো, এক কাপ চা খাইতে দিসে। চা খাইতে বসছি, কানের পাশে পরিচিত স্বরে নিজের নাম শুইনা হেঁচকি খাইলাম। নজমুল হিরু হিরু সাজ নিয়া পাশের চেয়ারে বইসা আমার দিকে প্রেম প্রেম চোখে চায়া আছে।
(চলবে)