#হৃদয়ের_একূল_ওকুল
#পর্ব_৫,৬
#সুরভি হাসনিন
পর্ব-৫
নয়া নয়া বিয়ের পর স্বামী স্ত্রীর মধ্যে নাকি মোহাব্বতের ঠেলায় একটা মাছি আসতে পারে না। এই খানে দুই কোলবালিশের দূরত্ব নিয়ে আবদুল্লাহ ভুইত্তা নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। আমি নিশ্চিন্ত হয়েও ঘুমাতে পারছি না। খোলা পুকুরে যে মানুষ এগিয় আসে, সে বন্ধ দরজার ভেতরে এত সভ্য ভব্য হয়ে থাকে এটা দশম আশ্চর্য। আবদুল্লাহ মিয়া পিছন ফিরে ঘুমাচ্ছে। খুব শান্ত নিরিবিলি ঘুম। আব্বা ছাড়া অন্য কোন পুরুষ মানুষকে আমি ঘুমাতে দেখি নাই। আব্বা বুকের কাছে ছোট পাতলা বালিশ নিয়ে ডান কাতে বিসমিল্লাহ বলে ঘুমায়। ঘুমানোর আগে মাথায় এক কোষা হালকা গরম নারিকেল তেল আম্মা ডলে দেয়। ঐ সময়ে সারা দিনের সাংসারিক হিসাব আম্মা আব্বাকে বলে, খুব বেশী সময় না। পাঁচ থেকে দশ মিনিট, এর মধ্যে পুরো চব্বিশ ঘন্টার বৃত্তান্ত আম্মা কেমন করে আব্বাকে বলে, আমি বুঝতে পারি না। এটাই হয়ত সংসার ধর্ম। পুরো দিন যে যার কাজে ব্যস্ত থাকবে, দিন শেষে একটা একান্ত সময়ে একে অন্যের সাথে সব কিছু ভাগ করে নেবে। দীর্ঘশ্বাস ফেলি, আবদুল্লাহ মিয়া না আসলে ভালো হতো। অন্তত রাতটা নির্ঘুম কাটতো না।
বিছানা ছেড়ে সাবধানে নামি। শব্দ হলে ঘুম ভেঙে লোকটার মুখোমুখি পরার ইচ্ছে নেই। আম্মা আমাকে একটা জিনিষ বিয়ের দিন দিয়েছে। আমার গর্ভধারিণী মায়ের ছবি। একটা পুরনো ছবিতে চেয়ারে আম্মা বসে আছে। আব্বা মাথার কাছে দাঁড়ানো। আম্মার গায়ে বেনারসী শাড়ি, দুই হাত ভর্তি চুড়ি, কানে ঝুমকো দুল। মাথায় ঘোমটা টানা উনিশ বছরের মেয়েটা কেমন লাজুক চোখে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আছে। আব্বার গায়ে সাদা পায়জামা পাঞ্জাবী, ভীষণ খুশী। আম্মা বলেছে, আমি পেটে আসার পর নাকি আব্বা আম্মাকে স্টুডিওতে নিয়ে ছবিটা তুলেছিলো। আম্মার সাথে আব্বার খুব বেশী দিন সংসার করা হয় নাই। সাড়ে নয় মাসের মাথায় একটা ফুটফুটে কন্যা সন্তান উপহার দিয়ে আম্মা চিরদিনের জন্য আকাশের ঠিকানায় স্থায়ী বসতি গেড়েছে। আম্মার ছোট বোন, আমার এই আম্মার সাথে আব্বার বিয়ে হয় চার মাস পর। আম্মা তখন সতের বছরের। ঝিনুক দিয়ে নানী বুড়ি আর আম্মা আমাকে দুধ খাওয়াতো। আম্মা আমাকে কোলে নিয়ে শুধু কাঁদতো। অনেক বছর পর, গল্প শোনার সময়ে আম্মার কাছে জানতে।চেয়েছিলাম, আম্মা কেনো আমাকে কোলে নিয়ে কাঁদত। আম্মা হেসে কুটিকুটি হয়ে উত্তর দিলো, ‘তোর আব্বারে ডর লাগতো। শরম পাইতাম। তোরে কোল থেকা নামাইতে পারতাম না। তুই চিক্কুর পারা শুরু করতি। তোর নানীয়ে আমারে মুততে গেলেও পাহারা দিতো। যদি আমি পলাই যাই। আমি কই পলামু, তোরে ছাইড়া ভাতের নলা মুখে তুলবার পারতাম না। তুই ঠ্যাং উল্টায়া মুইত্তা দিতি। ‘ আব্বাকে ডর লাগতো কেনো, প্রশ্ন করতে আম্মা আরো হেসে গড়াগড়ি। ‘ হেয় আমার কত বড়, আফার থিকা বড় আছিলো, আমি ডাকতাম দুলাভাই, হেয়ান থন হইয়া গেলো হাই, তার সামনে আমি কেমনে সরল হই মায়মুনা।
সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে গেছি। আবদুল্লাহর জন্য ছোট ছোট লাল আলুর সাথে কলিজা ভুনা করা হয়েছে। সুমনা চেয়ারে বসে নফ্রালীকে দিয়ে পরোটার খামির করাচ্ছে। শশুড় আব্বা আজকে হাঁটতে যায়নি। ওনার সাথে দেখা করে শাশুড়ি আম্মার নাস্তা নিয়ে গেলাম। বুড়িকে কাল রাতে গরম তেল মালিশ করতে সুমনা ভুলে গেছে। নাস্তা খেতে খেতে বুড়ি সুমনার নামে এক গাদা অভিযোগ করলো। বুড়ির সাথে তাল দিতে মন সায় দিলো না। সুমনার শরীর ভারী হয়ে যাচ্ছে দিন কে দিন। বুড়িকে একা হাতে টানা হ্যাঁচড়া করা সম্ভব না। নফ্রালীকে বুড়ি গায়ে হাত লাগাতে দেবে না। বুড়িকে মুখ মোছাতে গিয়ে দেখি, হাত পায়ের তালু ঠান্ডা ঠান্ডা লাগে। পেট পিঠ বেজায় গরম। বুড়ি গায়ের কাপড় সরিয়ে পাখা বাড়াতে বলছে। বেশী বাতাসে বুড়ির ঠান্ডা লেগে যাবে। সুমনাকে বুড়ির কাছে পাঠাবো। সুমনার বদলী একটা মেয়ে খুঁজে বের করতে হবে। আম্মা আমার মুসকিল আসান, কবিরাজী জিন। আম্মার কানে কোনরকমে কথাটা ঢুকায় দিতে পারলে ঝামেলা শেষ। শশুড় আব্বার চশমা খুঁজে পাচ্ছেন না। বুড়ো মানুষদের নিয়ে এই এক যন্ত্রনা। সকালে ঔষধ খেয়ে একটু পর বলবে খাই নাই। যদি বলি, ‘আল্লার কিরা, আমি নিজের চোক্ষে দেখছি, আপনে ঔষধ খাইসেন’। তখন বলবে, ‘ তোমার চোক্ষে একশ চাউলের কিরা, আমারে কি বেকুব পাইছো, আবাল কুনহানকার।’ তাই সেধে বুড়োদের দোষ গুন নিয়ে কথা না বলাই উত্তম। শশুড় আব্বার চশমা খু্ঁজতে যাবো, আবদুল্লাহ মিয়া হাতে চশমা নিয়ে হাজির।
–আব্বা, আজ বিকালে আমি রওয়ানা দিবো। বড় স্যার ফোন দিয়েছে। একটা জরুরী কাজের দায়িত্ব দেয়া ছিলো। বড় ঝামেলা হইতে পারে। আমার জন্য দোয়া করবেন। আম্মাকে বিশেষ কিছু বলার দরকার নাই। আমি ঝামেলা মিটায়া আম্মাকে জানাবো।
–তোমার আম্মা জিজ্ঞাস করলে মিছা কথা বলবো? ছেলের সমস্যা, মায়ের দোয়া হইলো আসল বিষয়। মায়ের হাত আল্লাহ পাক কখনো ফেরায় না জানো তো।
–জি আব্বা, জানি। কিন্তু শুধু শুধু আম্মাকে চিন্তায় ফেলার দরকার নাই। আম্মা আরো নরম হয়ে গেছেন।
–আম্মা নরম হইছে, আব্বারে কি আপনের জুয়ান মনে হয়? সে তো পানি ভাত অবস্থায় আছে। তাহার কি আরেকটা হাঙ্গা করার বয়স আছে? আপনের আব্বার চশমার পাওয়ার ঠিক করান দরকার। সে বসে আছে, আপনে আসলে, আপনেরে লগে নিয়ে ডাক্তার কবিরাজ দেখাবে। আপনে এমন ছাতার মাথা আইয়েন না। এমন ডিম পারা আসা আসার দরকারটা কি?
শশুড় আব্বা আমার দিকে তাজ্জব হয়ে চেয়ে আছেন। আবদুল্লাহ মিয়া, ‘ছাগল-পাগল’ শব্দটা কয়েক বার বলতে বলতে শাশুড়ী আম্মার ঘরে যাচ্ছে। নফ্রালী আব্বার জন্য চা নিয়ে আসছিলো। আমাদের কথা শুনে হেঁচকি তুলে হাসা শুরু করেছে। সুমনা নফ্রালীর পিঠে বেদম চিমটি কাটছে। নফ্রালীর হাসি বন্ধ হচ্ছে না। আমি বুঝতেই পারলাম না, সামান্য একটা কথায় এত ঘটনা কেনো ঘটে গেলো। হাঙ্গা শব্দটা ভদ্র কাকী প্রায়শই ব্যবহার করতো। আমি আর শাহিনা, কাকীর বাড়ির কুল গাছের ডালে চেপে যখন কুল চুরি করতাম, কাকী আমাদের বলতো, হাঙ্গা দিলে ত্যাল কই যাইবো। তহন আর কুল গাছের ডালে চইড়া পেত্নি নাচন লাগতো না। সারাদিন টাট্টুর উপ্রে থাকবা।’ বিবাহ হইলো, স্বামী পেলাম সাত চড়ে রা নাই, দিলদার টাইপ। গো বেচারা বেবুক মহাজন। শশুড় শাশুড়ী আধমড়া। মাঝ দিয়া, আমার আর সুমনার বয়স কম। তাও সুমনার পেট আছে। আমার তো কিছুই নাই। এমনকি, কথা বলার ছিরি ও নাই। আমারে কে ভালোবাসবে!
দুপুর বেলায় পাশের বাড়ির মেয়ের বিয়েতে দাওয়াত পেয়ে আবদুল্লাহ মিয়ার বউ সেজে খেতে এসেছি। পোলাও ভাত, মুরগীর গন্ধে পেটের মধ্যে ঘুরান্টি দিচ্ছে। বিশাল এক রাতা মোরগের রোস্ট করা হয়েছে বউ’র জন্য। জামাইয়ের জন্য আস্ত খাসী। টেবিলের ওপর বড় ডিসে, পোলাওর ওপর চার ঠ্যাং ভেঙে খাসী মিয়া বসে আছে। খাসীটার সাথে আবদুল্লাহর মিল আছে। মুখ খুললেই ‘ব্যাঁ’ ডেকে উঠবে। লাল আলু সীম ভাজি পাতে দিয়ে গেলে বিসমিল্লাহ বলে খাওয়া শুরু করেছি। আত্মীয় গোছের এক পরিচত হোদল কুতকুত মহিলা, মাথার কাপড় টেনে উপস্থিত। মুখের মধ্যে খাবলা খাবলা গু’র মতো করে পান ঠেসে ঢোকানো। লাল রঙের পিক খক করে টেবিলের পাশে ফেলে মহিলা আমার চেয়ার পাশে চেয়ার টেনে বসে পরলো।
–তুমি আবদুল্লাহর বউ না? পফেসর সাবের বাড়ির বউ। কান, গলায় বাপ মায়ে কিছু পিন্দায়া বিয়া দেয় নাই?
— যে দিসে, এই যে, আমার স্বোয়ামী, হেই আমার গলার হার, ফাঁসির দড়ি, হাতের চুড়ি, পায়ের জুতা, মাথার তাজ। তার সাথে পরিচিত হইবেন? ও আবদুল্লাহ মিয়া, নানী আপনের লগে পরিচয় করতে চায়।
–বউয়ের মাথাত কোন ছিট মিট আছেনি আবদুল্লাহ। শুনছিলাম তো ভালা বংশের মাইয়া। বিয়া করতে গিয়া, রূপ দেইখা ভুইলা গেছস।
–জি নানী, আমার রূপের তবিজ, আমার খসমরে গুলায়া খাওয়াইসি। এক চিমটা রূপ, এক চিমটা রূহালী বাবার ওয়াক থু, আরেক চিমটা মিডাই। সব মিলায়া গেলাসর পানিত ফালায়া দিসি জোরসে ঘুটা। আপনের লাগবো? নানার লাইগা দিমুনি।
আবদুল্লাহ খাওয়া বন্ধ করে এঁটো হাতে বসে আছে। ডান হাত দিয়ে আমার পায়ে গুতো দিচ্ছে। এই বুড়িকে এখন চিনতে পেরেছি। আমার শাশুড়ী মায়ের সৎ বোন। বুড়ি বিবাহের দিন নানা মশকরায় আমাকে নাস্তানাবুদ করতে চেয়েছিল। আম্মা মেয়ে হাউস আমারে দিয়া মিটাক। বুড়ি আবদুল্লাহকে জোর করে খাওয়া শেষে এক খিলি জর্দা পানি মুখে গুজেছে। চপর চপর শব্দ তুলে পান খাওয়া লোকটাকে এখন লাগছে লাল লুঙ্গী, সবুজ জামা গঞ্জের দোকানদার। যে কিনা বউরে বাড়ি থুয়ে যাত্রপালা দেখতে যায়। এখন এই বুড়ির কিচ্ছা কাহিনী গুলো যাত্রপালার চেয়ে কম রঙিন না।
–তোমার শাশুড়ীরে পায়া লই। কেমুন বউ বিয়া করাইলো বইনে। আদব লেহাজের কিছু জানে না।
–এই যে লাল বেনারসী পরলাম, হাতে চুড়ি ও লাগাইতাম। তয় চুড়ি গুলা এত ঢলঢলিয়া, পিন্দা আরাম নাই। আপনের হাতের চুড়ি গুলান দিয়া যান নানী। ম্যালা সোওয়াব পাইবেন।
নানী বুড়ির পান খাওয়া দাঁতের কটকটি এখান থেকে শোনা গেছে। বিড়বিড়িয়ে ভেতর ঘরে দৌড়ে যাচ্ছে। এখনি আমার নামে এক গাদা গপসপ বাড়ির মহিলাদের কাছে লাগাবে। খাওয়া দাওঅ শেষ। বোরহানীর গ্লাস হাতে সামীয়ানার বাইরে আবদুল্লাহর জন্য অপেক্ষা করছি, আমাদের গ্রামের ছেলে কামরুলকে দেখতে পেয়ে মন ভালো লাগলো। কামরুল আমার স্কুলে নবম শ্রেনীর ছাত্র। তার চাচাতো ভাইয়ের বেয়ান বাড়ির বোনের মেয়ে হইলো আজকের বিবাহের কন্যা। এ কথা সে কথা শেষে কামরুলকে ফোন নাম্বার দিলাম।।শাহিনাকে দেবার জন্য। অপেক্ষার প্রহর ফুরায় না, হঠাৎ দেখতে পেলাম, অপরূপ সুন্দরী এক মহিলারে পাশে নিয়ে আলো ঝলমলি চেহারায় আবদুল্লাহ মিয়া হেঁটে হেঁটে আসছে। এই মহিলার বেস বাস শহরের মেয়েদের মতো সুন্দর। টাইটফিট হিট হিট শাড়ি চুড়ি, টিপ সেন্টের ভুরভুর খুশবুতে পুরুষ মানুষ দূর থেকে হিমালয়ের বরফের লাহান গলে গলে পরবে। ছিনাল টাইপ হাসিতে ঢলে ঢলে পরা মহিলার পাশে হাঁটা, আবদুল্লাহ মিয়া আর কোন ছাড়!
(চলবে)
#হৃদয়ের_একূল_ওকুল
#পর্ব_৬
-বাদ আসর তোমার বউয়ের জন্য দোয়া খায়ের করা হবে। মেয়েছেলে পোয়াতী হইছে। বিষয়টা মাথায় রাইখো। হুটহাট যাওয়া আসা করবা তা তো হবে না। যত জরুরী কাজ থাকুক, আজকের মাহফিলে তুমি না থাকবা। এত মানুষের মধ্যে কার দোয়া কবুল হইবে কে জানে। তুমি বাপ হইতে যাচ্ছো। বাপের উপস্থিতি দরকারী। তাছাড়া মেয়েটা কম বয়সী। এখনো বুঝ ব্যবস্থা কম। চটপট কথা কয় ঠিকই, কিন্তু প্যাঁচ ঘোঁচ কইরা মন বিষায় তোলার স্বভাব নাই। তোমার আম্মার মুত সে সাফ সাফান্তি করে। তার বাপের কুলে সে একা, তোমার কুলেও তুমি একা। তাই, বাচ্চা কাচ্চার সময়ে কোন অন্য কাজের দোহাই দিবা না।
মাথায় হাত দিয়ে আবদুল্লাহ মাথা ঝুঁকিয়ে বসে আছে। আমার পায়ের তলায় মাটি নাই, আগুনের গোল্লা তৈয়ার হয়ে মাটি দুই টুকরা হয়ে গেছে। আবদুল্লাহ মিয়ার আব্বার কথা অনুসারে, আমি পোয়াতী। এই মায়মুনা, যার স্বামীর সাথে কোন প্রকারের বনিবনা নাই। মিল -মোহাব্বত দূরে থাক, সাপ -বেজির সম্পর্ক নিয়া স্বামীর ঘর করি, সে বলে পোয়াতী। হাসতেও পারি না, কাঁদতেও পারি না। হাসলে লোকে বেহায়া মেয়েছেলে বলবে, কাঁদলে বলবে খান্ডারনী।
আমরা বসে আছি আবদুল্লাহর মায়ের ঘরে পাটির উপর। ঘণ বুননের শীতল পাটি। জায়গায় জায়গায় নকশীর ফুল তোলা। তার উপরে কুরুশের কাটা দিয়ে করা বড় আকারের চাদর বিছানো হয়েছে। এই চাদরটা আমার তোলা। বাসায় বসে অকাজ করতে ভালোই লাগে। এটা বানানো হয়েছিলো, ট্রাঙ্কের উপরে বিছানোর জন্য। তা না দিয়ে এখন আবদুল্লাহ মিয়ার পাছার নিচে শোভা পাচ্ছে। ভুইত্তার চেহারা হয়েছে জোলা গুড় খেয়ে পেট ছাড়া বুড়ো গরুর মতো। আমি বুঝে পাচ্ছি না, এই বিশাল মিথ্যা কথাটা কোন বেক্কলের বাচ্চা পয়দা করলো।
— তোমার আম্মা সুমনার কাছে খবর শুইনা বউরে বালা দিসে। তোমার বাচ্চার নাম ঠিক করছে, মেয়ে হইলে নাম রাখবে, মানু, ছেলে হইলে নূরু।
–আপনেরা বেশী বেশী করতেছেন আব্বা। আম্মারে বাড়াবাড়ি করতে মানা করেন।
–কি নিয়া তোমার আম্মা বাড়াবাড়ি করলো আবদুল্লাহ? তোমার পোলাপাইন কি আমাদের কিছু হয় না। পোলাপাইন আসতে আসতে আমরা পর হয়া গেলাম।
–আব্বা আপনে আর আম্মা আমারে বিয়ে দিলেন, বিয়ের আগে কন্যার বয়স বললেন না। ছবিও দেখাইলেন না। ছুটিতে আসলাম, পাত্রী দেখতে নিয়া গেলেন, বিয়াও করায় দিলেন। আমি সেখানে কিছু বলছি? বলি নাই। এখন পোলাপান নিয়া পরলেন। আপনাদের এসব আধিখ্যেতা আমার আর ভাল লাগে না।
–তুমি কি বিয়াতে রাজী ছিলা না? মত না নিয়া বিয়া দিছি তোমার, এই কইতে চাও।
— এই মেয়ের মত নিসিলেন? আপনাদের মনে হইলো, বিয়া দিলাম বাস। এবার…
— আপনেরা ঝগড়া থামান। নফ্রালী কেমনে বলবে, আমার পেট হইলো না পিঠ হইলো? আমি কি নফ্রালীর বউকে গিয়া কানে কানে বলেছি, আমার গর্ভে আবদুল্লাহ বংশের বাত্তি আসছে। ব্যাটির নিজের পেট নিয়ে কুল পায়, আপনের বউ নিয়া টানাটানি। নফ্রলাী ব্যাটার এত ত্যাজ কেন। বাড়ির নফর থাকবে নফরের মতো। তা না, বাড়ির পোলার বউয়ের পেটের খবর বাহির করতে চায়। এত তেল সুমনা বিবির।
— আমরা চাকর বাকী হিসাব করে ঘরে থুই না মা জননী। তুমি কথাডা ফিরায় নাও। তোমার আসনের আগে ওদোর ভরসায় আমরা বুড়া বুড়ি ছিলাম। তুমি পোয়াতী মানুষ, ঘরে যাও। কাইল ঋর সন্ধ্যায় বাজারে ঘুরসো, তোমার শাশুড়ী বিষয়টা পছন্দ করে নাই।
— উনি কি বুঝবো, পালছে তো শুনলাম পরের পোলা। নিজে কোনদিন বাচ্চা পয়দা করসে?
— মায়মুনা, আমি তোমার আব্বা হইলে তোমারে চড় দিতাম। তোমার সাথে আবদুল্লাহর কোন সমস্যা হইলে ঘরে গিয়া মিটমাট কইরা নাও। বাপ -পুতের কথার মাঝে কথা কইসো ঠিক, শাশুড়ীরে নিয়া এমন কথা আর কোনদিন কইবা না। শামসুন্নাহার ক্যান সন্তান লয় নাই, সেই কৈফিয়ত খোঁজার মালিক তুমি না।
কালো মুখে ঘরে ফিরে আসছি। আবদুল্লাহ এখনো তার আব্বার সাথে কথা বলে। আমার মনের ভেতর, ‘সাপের ছুঁচা গেলা’ অবস্থা চলতেছে। না পারি বিয়ে মানতে, না পারি বিয়ে ভাঙতে। সুমনাকে আড়ালে পেয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, আমারে নিয়ে এত বড় কিচ্ছা ফেঁদে ওর কি লাভটা হলো। সুমনা আকাশ থেকে পরলো। আমি ওর সাথে ঘণ ঘণ তেঁতুল গোলা, ঝুড়ি আচার খাই। মাঝে সাঝে ওয়াক ওয়াক তুলি, কখনো কখনো খেতে রুচি হয় না। তাই ওর বদ্ধমূল ধারনা হয়েছে, আমিও পোয়াতী। এই মুরুক্ষ বেটির কোন চুলে রাবার গাছের আঠা লাগিয়ে ছিলাম মনে করতে পারছি না। ওকে বুঝিয়ে বললাম,পেটে গ্যাস থাকলে মানুষ ওয়াক করতে পারে। স্কুলের সামনে এত এত আচারের গোলা বিক্রি হয়, সবাই কি পোয়াতী! ক্ষুধা না থাকলে মানুষ খাবে না, মানুষ তো আর গরু ছাগল না, সামনে পাইলেই খেতে হবে। সুমনা মাথা নাড়লো ঠিক, কিন্তু বিশ্বাস করলো বলে মনে হলো না। ওকে ভালো মতন বুঝিয়ে বলে, আম্মাকে কিছু জানাতে নিষেধ করলাম। বুড়ি খুশীবাসী আছে, থাকুক। শরীরটা আরো ভালো হলে একদিন আমি বুঝিয়ে বলবো। আর শশুড় আব্বাকে আবদুল্লাহ হয়ত সত্যিটা বলবে। নয়ত আমি পায়ে ধরে মাপ চেয়ে কথাটা বলে দেব। উনি আমারে বড়ই স্নেহ করেন। এমন মানুষটারে মুখের ওপর এসব কথা বলা একদম ঠিক হয় নাই। মনটা পুরো দুপুর বিকাল খারাপ হয়ে থাকলো। বাদ আসর মিলাদ শেষে আবদুল্লাহ মিয়া বিদায় নিতে আব্বা আম্মার কাছে আসলো। শাশুড়ি আম্মা হাসিমুখে ছেলে বিদায় দিয়েছে। শশুড় আব্বার মুখ ভার। এক সময়ে ওনার কাছে মাফ চেয়ে নিতে হবে। কথা গুলো বলা আমার উচিত হয় নাই। ঝোঁকের মাথায় বলে বসেছি। নিজের কাছে বারবার খারাপ লাগছে। শশুড় আব্বা গলা খাঁকারী দিয়ে কিছু দলিল দস্তাবেজ আবদুল্লাহ হাতে দিলো।
–এগুলা সব বাড়ির দলিল। তুমি জানো, বাড়ি আমার নিজের টাকায় হইছে। জমি গুলা বন্দক দিয়া লোন নিসিলাম। বাড়ির কিছু টাকা দেয়া এখনো বাকি। এই ধরো লাখ খানেক। তোমারে এসব নিয়া চিন্তা করতে হবে না। আমি যতদিন বাঁইচা আছি, এসব কাজ আমার। তুমি মন দিয়া সংসারী হও, চাকরী নিয়া ঝামেলা কইরো না। রিজিকের মালিক আল্লাহ। সে চাইলে সকল কিছু সহজ হইয়া যায়।
–আমার কিছু কথা বলার আছে আব্বা। আপনের জানা দরকার। আম্মাকে আমি শহরে নিয়া বড় ডাক্তার দেখাবো। ফিজিও থেরাপী দিলে হয়ত একটু ব্যাথা কমতে পারে। হালকা হাঁটা চলার ক্ষমতা আসলো। আপনি ওনারে চ্বড় ডাক্তার দিয়া চিকিৎসা করাইসেন মানলাম। সে তো অনেক বছর আগের কথা। এখন বিজ্ঞান আগায় গেছে। কত শত ঔষধ বাহির হইলো। আম্মারে নতুন করে দেখাইলে হয়তো ভালো কিছু হইতে পারে।
–আমি মরার আগে এই বাড়ির সীমানা ডিঙ্গামু বাপ। তোর আব্বারে লয়া ডাক্তর দেখায় আন। লোকটা বাইরে দিয়া আবলুস কাঠ, ভেতরে দিয়া নরম পাউপ্পা।
–দুইজনরেই দেখাইলাম। সাথে মায়মুনা গেলো। ওরে ও ডাক্তার দেখায় আনলাম।
আবদুল্লাহ মিয়ার মতলব কিছু বুঝতে পারছি। বাপ মায়েরে ডাক্তার দেখায়া, আমারে দেখাবে। ডাক্তারের মুখ দিয়া কথাটা বাহির করবে বাপ মার সামনে, যে আমি পোয়াতী না। কোন ভুল হইছে। বাহ রে বাহ, ভুইত্তামারা, তোর বুদ্ধির মধ্যে ব্রেন চিকচিক করতেছে। ঘিলুতে কারেন্টের অভাব নাই। কারেন্টে কারেন্টে ঠুকাঠুকি খায়া ফিলিপস বাত্তি জ্বালাই দিসে। কেয়া বাত! নফ্রালী কোথা থেকা চাইটা সুটকেস এনে ঘরে রাখলো। আবদুল্লা মিয়া কোন ব্যাগ পত্র নিয়ে আসে নাই্ এতবড় সুটকেসের ভিতরে কোন মুলুকের সোনা তামা ঢুকাইছে বেয়াক্কলের জামাউটা, কে জানে?
— সে যাইয়ো যখন যায়। এখন তোমার বউরে নিয়া বিদায় হও। আমরা তার ব্যাগ পত্র গুছায়া দিসি। ঐ খানে নিয়া নিজের কাছে বউ রাখো, সংসার করো। আমরা বুড়া বুড়ি তোমার বউরে আর দেখভাল করতে পারবো না।
–এগুলা আপনি কি কন আব্বা? এই মেয়েরে নিয়ে আমি কোথায় তুলবো? আমার বাড়িতে কি ওরে রাখতে দেবে। ব্যাচেলর বাসা। বাড়িওয়ালা রাতে রাতে, বাসা ছাড়ার নোটিশ পাঠাবে। এই জুলুমটা কইরেন না আমার সাথে। ও আপনাদের সাথে আছে, এমনে থাকুক। আমি নিয়ম করে আসবো। আপনার বা আম্মার কোন কিছু করতে হবে না।
–আমি কোথাও যাইতেছি বা আব্বা। এখান থেকে যাওয়ার কোন নিয়ত আমার নাইৃ আমার আব্বা আমাকে এইখানে থাকতে বলে গেছেন। আব্বা আম্মা আইসা আমাকে খুঁজলে তখন আপনে কি উত্তর দিবেন?
— মা জননী, স্বামী যেখানে থাকে, স্ত্রীর উচিত সেইখানে থাকা। আবদুল্লাহ তোমারে যেমনে রাখতে পারবে, তুমি ওখানে থাকবা। তোমার আব্বা আম্মাকে জানানো হইছে। তারা তোমাদের দুয়া দিসেন। নিজের ঘর সাজাও নাও। পরে পস্তাইবা।
পরে কেনো পস্তাবো এটা জিজ্ঞাস করতে গিয়েও করলাম না। মাথায় চিরিক দিয়ে বিদ্যুত আসলো, হাটের মধ্যে ছিনাল বেটিটা আবদুল্লাহ মিয়ার প্রেমিকা না তো? হইতেও পারে। আব্বার প্রচুর ছাত্র, তাদের কেউ হয়ত আব্বার কানে দিয়েছে। কিন্তু আমি এই ঘোর বিপদ কেমনে সামলাবো। আমার তো সংসার করার কথা ছিলো বা। পলান্তি হওয়ার কথা ছিলো। লাট্টু হয়ে এ জায়গা থেকে ঐ জায়গায় ঘুরতেছি। পলাইতে পারছি না। নফ্রালী খবর দিলো, বাড়ির সামনে পর্দা দেয়া ভ্যান রিকশা আনা হয়েছে। আবদুল্লাহ মিয়ার বাইক কাল পরশু পৌছে দেয়া হবে। পোয়াতী শরীরে বাইকে করে লম্ফ ঝম্প করে যাবার দরকার নাই। আমার বুক গলা শুকায় কাঠকাঠ। আবদুল্লাহ মিয়ার মুখের দিকে তাকানো যায় না। বাজ পরা কাউয়া হয়ে সে হাঁটা শুরু করলো। আমিও পিছন পিছন যাচ্ছি। জানি না কপালে নতুন করে কোন শনির, ঝাঁটার বাড়ি খেতে হবে রে মায়মুনা।
(চলবে)