#হৃদয়ের_একূল_ওকুল
#পর্ব_৭,৮
#সুরভি হাসনিন
পর্ব-৭
বাড়ি ঘরে শশুড় শাশুড়ী একলা থাকবে, তাই রুমা ভাবীকে কদিনের জন্য তলব করা হয়েছে। ভাবী এসেই আমার সাথে মশকরা করা শুরু করেছে।
— ওমা, দিন গিয়া রাইত আইলো না, এর মধ্যে মেমান ধইরা লয়া আইলা মায়মুনা বেগম। ভাব ভালোবাসা কুনু বেশী বেশী তোমরার ভিত্রে নাকি? আবদুল্লাহ মিয়াভাইয়ের দেখি তর সইলো না।
— সমস্যা কি ভাবী। আল্লাহর বাগানে ফুল ফুটবো, আল্লাহ কইছে, বাগান ভইরা ফুল গাছ লাগাইতে। আপনের মন চাইলে, আপনেও ফুল ফোটান। অন্যের গাছে নজর দেওনের দরকার কি?
রুমা ভাবী চোখ কটমটিয়ে জুতোয় ঠাস্ ঠাস্ আওয়াজ তুলে আম্মার ঘরে ঢুকে গেলো। ঢুকেই গুজুর গুজুর শুরু হয়েছে।।কান পাতা লাগলো না। বাহির থেকে শুনছি, রুমা ভাবী আম্মাকে বলছে, ‘আগেই কইসিলাম, কম বয়সী মাইয়া বিয়া করায়েন না চাচী, শুনলেন না। অখন ফললো নি আমার কথা। বিয়া হইতে দেরী, বাইচ্চা নিয়া পোলারে আলাদা কইরা দিতাছে। আপনেরা ও কেমুন, পোলার লগে বউ দিয়া দেন। কই মাইয়াডারে আটকায় থুইবেন, তা না। পোলার লগে স্বাধীন কইরা দিলেন। অখন কি আর হেয় আবদুল্লাহ ভাইরে আইতে দিবো? ড্যাঙ্গা মাইয়া তালগাছ হইয়া তাল পাড়তে লাগছে। আইবো আর জন্মে আপনের পুলায় এই মুখ।’
মন চায়, রুমা ভাবীর চাপা বরাবর কারাতে ক্লাসে শেখা একটা ‘ উইড়া পরা লাত্থি’ মারতে। না মারলাম, সম্পর্কে বেটি আমার ছোট।
আজ দেখলাম, বুড়া ষাঁড়ের জিদ। আবদুল্লাহ মিয়ার সাথে আমাকে যেতে হবে মানে যেতেই হবে। মোবাইল ফোন দিয়ে আব্বাকে নিজের মুখে খবরটা জানাতে চাইলাম। বুড়ো সে সুযোগ দিলো না। বলে কি না, ‘ভ্যানে চইড়া যাইতে যাইতে জানাইবা। ত্বরা করো। পোলায় দূর যাইবো। এ বেলা খানা খাদ্য নিয়া ভাইবো না। সাথে পোটলা করে দেয়া হইছে। ‘ ‘জি আব্বা’ বলে মাথা তো নাড়লাম, কিন্তু পাও দুইটা পাত্থর বানায় দাঁড়ায় ছিলাম। শেষে শশুড় আব্বা বললেন, বাইরে যাও মা, বাড়ির দূয়ার বন্ধ করবো। নফর আলী তেমাদের সাথে রিকশা দিয়া পিছন পিছন আসতেছে।’
ভাঙ্গা ভ্যানে মাঝখানে খাম্বা বসায়ে, তিন দিকে তিন শাড়ি পেরেক মেরে পর্দা আটকানো হয়েছে। ভ্যানটা দেখতে হয়েছে মুরগীর খোঁয়াড়। পাল পাল মুরগী ‘ কুকুরুক্কু’ ডাকতে ডাকতে সন্ধ্যাবেলা যেমন মালিকের হাতে খ্যাদানী খেয়ে খোঁয়াড়ে ঢোকে, আমিও তেমন শশুড় আব্বার প্যাঁদানীর ভয়ে সুড়সুড় করে ভ্যানে বসলাম। বুড়ো নরম সুরে কথা বললে কি হবে! বুড়ো বেজায় শক্ত। আবদুল্লাহ ভুইত্তা পর্যন্ত গলা উঁচায়ে কথা বলার সাহস পায় নাই। নিজেরে লাগছে ডিমে বসা ধুলধলী হাসের মতো। কাচায় কোচায় বসে আছি ঠিকই, ঠ্যাং গুলো মেলা যাচ্ছে না। আবদুল্লাহ মিয়া ভ্যানচালকের সাথে বসেছে। একটু পরপর শাড়ির ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখে নিশ্চিত হচ্ছে, আমি পালিয়ে গেলাম কিনা।
–আবদুল্লাহ মিয়া, আপনের ডেরা আর কত দূর। যাইতে গেলে এক আনা, আইতে গেলে এক আনা। মাইঝ দিয়া আমার জিন্দেগীর বত্তিরিশ আনাই টোটাল লস হয়া গেলো।
— ডেরা মানে? ডাকাইত গো ডেরা হয়। আমার ডেরা হইব কেন।
–ঐ তো আস্তনা আর কি। আপনে কি ডাকাইত, মস্তানের থিকা কুনু অংশে কম সম আছেননি।
–এই মাইয়া, মুখটা সামলাও। আমার কিন্তু বেদম মেজাজ খারাপ আছে। বেশী কথা বলবা, ধাক্কা দিয়ে ভ্যান থেকা ফালায় দেব। বাকি জীবন লুলা হয়ে ঘুরবা। লোকে ডাকবে, ‘লুলী মুনা’।
— এ্যাঁহ, আরে আমার সমুন্দীরে, আমারে ফালাইবেন, আমি কি চায়া চায়া জিলাপী খামু? উইঠা খাড়ায়া আপনেরে ফালায় দিমু। দশ গেরামের মাইনষে টিকিট কাইটা দেখতে আইব, ‘ভুইত্তা লুলা’রে।
–এই কি বললা তুমি! এই ভ্যানওলা, উচা নিচা রাস্তা দিয়া জোরে জোরে চালাও। আমি তোমারে দশ টাকা বাড়ায়া দিব।
— ও ভ্যান আলা ভাইজান, আপনে আমার ধর্মের ভাই। এই বইনের স্বামী অত্যাচারী ফেরাউন। আপনে তার কথা শুইনেন না। আপনেরে আমি একশ টাকা বাড়ায় দিমু।
ভ্যানওয়ালা কি বুঝতে কি বুঝলো, মাঠির ঢেলায় ভরা রাস্তা দিয়েআসতে আসতে আমার আর আবদুল্লাহর কোমর শ্যাষ। ইশার আযানের পর পর ভ্যান থামলো পাঁচ তলা এক বাড়ির সামনে। বাড়ির বাইরে বড় করে লেখা ‘শান্তি ভিলা’। ছোট্ট বাচ্চাদের তিন দিনের জমা কষা গু কালারের বাড়িটা দেখে ‘লা হাওলা ওয়ালা কু আতা’ পড়তেছি। ভ্যান ওয়ালা গামছা দিয়ে ঘাম মুছে, দাঁত ক্যালায়ে এসে সামনে হাজির।
–আফা, একশত টেহা দিবেন কইছিলেন, দ্যান। আপনের মনের মত চালায় আনছি।
— অই ব্যাডা, রাস্তায় এমুনই ঢেলা আছিলো। তুমি কি কুনু ঢেলা টোকায়া রাস্তায় ফালাইসো? ব্যাডা ফাজিলের বাপ।
–আফা, এই ডাহেন ধর্মের ভাই, এই কন ফাজিল। আপনের মাতা কুনু খারাপনি। আহারে, কেমুন সোন্দর জামাইডার লগে এমুন ফাগল বেডিরে বিয়া দিসে।
— আবদুল্লাহ মিয়া, বেয়াদ্দপ ডারে একশত টেকা দেন। আমার বাজি হারা টেকাডা ওরে দেন।
আবদুল্লাহ ভ্যান ওয়ালাকে ডেকে কি জানি বুঝিয়ে বিদায় করলো, কে জানে। ব্যাগ সহ সিড়ি দিয়ে ওঠা শুরু করেছি। একটা লোক কাইত হয়ে সিড়ি দিয়ে উঠতে পারে মতন সিড়ি ঘর। প্রতু তালায় দুইটা করে বাসা। তিন রুমের ফ্লাটের একেক রুমে একেক পরিবার। একটা পাকা পায়খানা। একটা রান্নাঘর। সিড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে, আবদুল্লাহ মিয়া আমাকে একটা মোটামুটি ধারনা দিয়ে দিচ্ছে। মগজের মধ্যে আতিক্কা একটা গরম প্রশ্ন উদয় হইলো,
–একটা পায়খানা, তাইলে ধরনে দুই পরিবারের এক সাথে এক ও দুই নাম্বারে যাওনের দরকার লাগবো। তারা কি পাশের ফেলাটে গিয়ে লাইন দেবে?
— এখানে এক ফ্লাটে বেশীর ভাগ জামাই বউ থাকে।পোলাপান নাই। বাকিগুলা ব্যাচেলর। ব্যাচেলরদের সমস্যা হয় না। নিজেদের ভেতরে মিল মোহাব্বাত না থাকলে ব্যাচেলর থাকা যায় না।
— আপনে কি ফ্যামেলী না ব্যাচেলর? আমারে কেন বাসাত রাখবেন তাইলে।
— ছিলাম তো ব্যাচেলর, এখন ওখানে থাকবা। ধীরেসুস্থে ফ্যামেলী বাসা দেখব। তার আগ পর্যন্ত, আল্লাহর ওয়াস্তে তুমি কোন ঝামেলা বান্দাবা না, মুনা।
–আমি তো ঝগড়াইট্টা কুটিল বেডি মায়মুনা। যারে পাই তার পায়ে কনি মাইরা ঝগড়া শুরু করি। আপনে আমারে এত খারাপ ভাবেন ক্যান।
পাঁচতালার শেষ ফ্লাটের সামনে ব্যাগ রেখে হাঁপাচ্ছি। আবদুল্লাহ মিয়া ঠান্ডা পানির বোতল আনতে নীচে নেমেছে। হেলতে দুলতে নফ্রালী এসে উপস্থিত। তাহার দুই হাতে বিশাল বিশাল দুই টিফিন ক্যারিয়ার। নফর আলী বাসার বাইরে সুইচের মতো কি জানি একটা চাপলো। ওমা! বাসার ভিতর থেকা একটা কোকিল পাখি কি সোন্দর ডাক দিয়া উঠছে। এরা মনে হয় কোকিলের গলায় ঘন্টা বাইধা রাখছে। ঘন্টার রশি বাইরের সুইচের সাথে লাগানো। দরজার কাছে পায়ের আওয়াজ পাচ্ছি। আবদুল্লাহ মিয়া পানি নিয়া ফিরা আসছে। ‘ও আমি, দরজা খুইলা দেখমু যারে করমু তারে বিয়া’ গানটা গুনগুনাইতেছি। বাসার দরজা ক্যাঁচর ক্যাচর আওয়াজ তুইলা খুলছে, দরজায় দাঁড়ায় আছে মেলার সেই ছিনাল বেডি। এই বেডি এইখানে কি করে?
(চলবে)
#হৃদয়ের_একূল_ওকুল
#পর্ব_৮
মেয়েছেলে যত সুন্দরই হোক, অন্য একটা সুন্দরী মহিলার সামনে পরলে নিজেরে নিয়ে তুলনা করতে শুরু করে। আমি যেমন এখন ছিনালী লুৎফার সাথে আমার তুলনা করতেছি। একেকবার বেটির চুলের সাথে আমার চুলের লম্বা মিলাই, আর মনে মনে বেটির গায়ে ছ্যাপ মারি। এক দুইটা ছ্যাপ না, গুইনা গুইনা একশত একটা ছ্যাপ। ছ্যাপ গুলা চোক্খে দেখা গেলে এতক্ষণে এই চিপা বাড়ির পাঁচ তলার ইন্দুরের বাসা মার্কা রুমে সমুদ্র হয়ে যেত। সমুদ্রের নাম হইত ‘ছ্যাপ সমুদ্র’। সেখানে ছিনালী লুৎফা আর আবদুল্লাহ মিয়ার রঙ ঢং দেখতে জনগন ভীড় করত। ক্যামেরা দিয়া ছবি তুলার আগে ক্যামেরাম্যান বলতো, ‘ইস্মাইল পিলিজ।’ ছিনালীটা লাফ দিয়ে আবদুল্লাহর কোলে উঠে দাঁত ক্যালায় হাসি দিত। লুৎফা বেগম ও তার স্বামী কাশেম আবদুল্লাহর অফিসে চাকরী করে। এটুকু শোনার পরেই বাকি কাহিনী বুঝতে পারছি। কাশেমের গলায় ঝুইলা ছিনালী এখন আবদুল্লাহর মাথায় কাঁঠাল ভাইঙা খাচ্ছে। ওরে ও ছিনালী, তুই তো জানিস না, মায়মুনা কি এটম বোম। আমি আইসা পরছি, এবার তোরে কাঁঠাল কেন, কাঁঠালের একটা দানা ও আমি খাইতে দিবো না। কিন্তু আবদুল্লাহর মাথায় কাঁঠাল রাখুক আর গাব রাখুক, তাতে আমার কি? আমি এই চিপার থেকে কেমনে বাহির হবো এই বুদ্ধি বের করা লাগবে।
নফ্রালী বেশ বিরক্ত নিয়ে আবদুল্লাহকে দেখছিলো। আমি চুলায় চা বসায় আসলাম। আবদুল্লাহ ঘরে ঢুকে বাকি ঘর দূয়ার চেনায় দিসে। মিটসেফের মধ্যে ছোট্ট পোলাপানের মেশিনের সমান একটা তালা ঝুলানো। আবদুল্লাহ মিয়া লুৎফা ছিনালীর কাছ থেকে আমাকে চাবি নিতে বলেছে। আবদুল্লাহর মুখে এত বিরাট খুশীর হাসি জন্মে দেখি নাই। তার দাঁত আর ঘরে থাকতেছে না। ছিনালী একটা কথা বললেই, ফাল দিয়া বাহির হয়ে আসতেছে। আবদুল্লাহরে আমি কয় বার দেখছি! হাতে গুনতে পারবো। এই কয় বারে আসলে বোঝা যায় না, বেশী খুশী হইলে মানুষের দাঁত ফাল পারতে পারে না কি পারে না। ছিনালীর কাছ থেকে চাবি নিতে হবে ভেবে চামড়ায় তেলপোড়া ছ্যাক লাগতেছে।
–এই বেডি, চাবি দেন। আপনের আর এই চাবি রাখার দরকার নাই। আমি গুছায় রাখমু। ইশার নামাজ নমাজ পরছেন? পরপুরুষের লগে কেলাইলে হইবো? নমাজ পরেন গিয়া।
— ওমা আবু ভাই, আপনার বউ কি মজা করে কথা বলে। ভাবী ডাকবো? বয়সে অনেক ছোট তো।
–আবু কিতা? কিতা আবু? আবুর লগে ‘দ’ দিয়াই ডাকেন হেরে। আবুদ ওবুদ, বাইচ্চা পোলাপান বানায় দেন এক্কেবারে।
— মুনা, চাবি পাইছো না। যাও, পাকঘরে কি করতে গেছো করো। কাশেম ভাই আমার সিনিয়ার মানুষ। আমার কলেজের ছোট বোন, লুৎফা। আপা ডাকবা।
–পারতাম না, আমারে ভাবী কইবেন। আপনে আসেন, পাকঘরে পিড়ি পাতছি, চা খায়া যান। নফ্রালী, তোমারে কি দাওয়াত দিয়া আনা লাগবে?
নফ্রালী আদেশ পেয়ে আবদুল্লাহকে ধাক্কা দিয়ে নিয়ে আসলো। আবদুল্লাহর পিছন পিছন ছিনালী এসে উপস্থিত হয়েছে। আবদুল্লাহর পাশে আরেকটা পিড়ি পেতে বসার আগে আমি লাফ দিয়ে আবদুল্লাহ মিয়ার পাশে খালি জায়গায় বসে পরলাম। ‘ লে বৈতালনী, এলা বয় গিয়া নফ্রালী বুইড়ার পাশে। বইসা বইসা ক্যালা’। আবদুল্লাহর মিটসেফে তিন দিনের পুরান পাউরুটি, আর এক প্যাকেট গ্লুকোজ বিস্কিট পাওয়া গেছে। বুদ্ধি করে পাউরুটি গুলা তেল দিয়ে সেঁকে চিনি ছিটায় দিসিলাম। ছিনালী পাউরুটিতে এক কামড় দিয়ে, আমার হাত ধরে কেঁদে ফেলেছে। ওমা রে! এইটা তো শাবানার চেয়েও বেশী কান্দুনী।
— আমার মা যেদিন মারা যায়, সেদিন সকালে আমাকে এমন করে রুটি ভেজে দিয়েছিলো। ভাবী, তোমার হাতে মায়ের হাতের সেই স্বাদ পেলাম।
–আমি আম্মা হইলে, উনি আপনের আব্বা। তাইলে অখন থেকা ওনারে আব্বা ডাইকেন। আমারে ভাবী বোলাইলে চলবে। ওনার বয়স বেশী, আব্বা ডাক মানা যাইবে। আমার বয়স কম। মাত্র উনিশ বছর। এত কম বয়সে এরম ধাঙ্গী বেডির আম্মা, এডা মানাইতো না।
লুৎফা ছিনালী চোখ মুছে খাওয়া শুরু করেছে। ছিনালীর ভালো কোন কাপড় নাই মনে হয়। চ্যালচ্যালা জর্জেটের শাড়ি পরে পেট ভাসায় রাখছে। চা খাই আর চোখের কোনা দিয়া আবদুল্লাহ মিয়ারে পাহারা দেই। যতবার বেটির পেট দেখবে তত বার বেটার চায়ে ছ্যাপ মিশাবো। কঠিন খেলা হবে আবদুল্লাহ মিয়া। বিয়া যখন করছেন, আইসা যখন হাজির হইছি, মায়মুনা বেগমের চোখের সামনে ফষ্টিনষ্টি করা চলবে না। নো, নো, নো।
চা নিয়ে আবদুল্লাহ আর নফ্রালী বিষম খেয়েছে। আবদুল্লাহ মিয়া চিন্তিত মুখে জানতে চাইলো, আমি তিন বার নো বললাম কেনো। তার প্রশ্নের উত্তর দেয়ার দরকার নাই। টিফিন ক্যারিয়ার খুলে তরি-তরকারি জ্বালে বসালাম। সুমনা বেশ গুছায় দিয়েছে। শাশুড়ী আম্মার জন্য বুকটা ছ্যাঁত করে উঠলো। বুড়িকে খাওয়ানো অভ্যাস হয়ে গিয়েছিলো। শ্বশুড় আব্বা লোকটা খাওয়ার পর ঔষধ খায়। সে ঠিকঠাক ঔষধ খেলো কিনা জানা দরকার। আব্বা -আম্মাকে জানাতে হবে পৌছায় গিয়েছি। আজকে প্রথমবার বুঝলাম, রক্ত সম্পর্কের টান কাছাকাছি থাকলে যত না বোঝা যায়, দূরে গেলে আরো বেশী টান বাড়ে। রক্ত ছাড়াও আরো দুইটা বিষয়ের উপরে সম্পর্ক হয়। একটা হলো মায়া, অন্যটা দয়া। শ্বশুড় আব্বা -আম্মার সাথে আমার রক্ত সম্পর্ক নাই ঠিক। মায়া দয়ার সম্পর্ক জুড়ে গেছে। এ বান যে কত শক্ত আজ টের পাইলাম।
লুৎফা ছিনালী গান গায়। ‘তখন তোমার একুশ বছর বোধ হয়, আমি তখন অষ্টাদশীর ছোঁয়ায়’… তাই কি কোন ভাবে তাইরে আমার চেয়ে ছোট প্রমাণ করতে চায়? ওরে বৈতালের ঘরের ছৈতালনী, রাখ, সময় আসতে দে। একদিনে ঔষধের ডোজ বেশী দেয়া ঠিক না। তোরে আমি চুলায় লাকড়ি বানায় পোড়াবো, তিন কসম। কাপ পিরিচ ধুয়ে নফ্রালীকে বিদায় দিতে গেলাম। নফ্রালী দেখি লাল লাল ভুত মার্কা চোখ নিয়ে দাঁড়ায় আছে।
–ভাবী যাই গিয়া। মাপ কইরা দিয়েন। আপনেরা সংসার করতাছেন জানলে হেরায় খুব খুশী হইবো। বুড়া বুড়ি তো, আপনাগো ভালো চায়। সুমনার কাজটা হওনের সময় আপনেরে নিয়া যামু। দোয়া দিবেন।
–আইচ্ছা। অখন ত্বরায় যাও গিয়া। আর ওনাগো কইয়ো, আমার পেট মেট কিছু হয় নাই। তোমার বেয়াক্কল বউয়ে ভুল বুজঝে। সুমনারে বেশী কইরা ফলমূল খাওয়াও। মাইনষের হয় পেট পাতলা, ওর হইছে ব্রেন পাতলা। পেটেরটার জানি মগজে বুদ্ধি থাকে।
নফ্রালী বিদায় নিলে আবদুল্লাহ মিয়া টিভি দেখতে বসলো। টিভির মধ্যে লাল নীল জাঙ্গিয়া পড়া দামড়া দামড়া বেটারা কুস্তি লড়ে। তাদের কুস্তি দেখতে গিয়ে টিভির সামনে আটকায় গেছি। লাল জাঙ্গিয়ার মুখে কেমন ভুতের মুখোশ পরা। নীল জাঙ্গিয়ার একটা চারকেনা বেল্ট আছে। লাল জাঙ্গিয়ার দশ বারোটা মাইর খেয়ে নীল জাঙ্গিয়া খাম্বার পাশে বসে। আহারে, বেটাটা, গায়ে গতরে লালটার থেকে উঁচা লম্বা, তবু মার খাস। নীলটা দেখলাম বেল্টটা জড়ায়া চারখান চুমা খেলো। ও বাবা গো, চুমায় উঠেই লাল জাঙ্গিয়াকে পটপট ঘুসি মেরে ফালায় দিসে। বান্দরের মতো সাদা কালো জামা পরা আরেকটা বেটা এতক্ষণ লাফাইতে ছিলো। এখন নীল জাঙ্গিয়ার হাত উঁচায়া ধরসে। আগলা পাগলা খেলা, আবদুল্লাহ মিয়া মনযোগ দিয়া দেখতেছে। নামাজ কালম পাঠ শেষে আব্বারে খবর জানালাম। আম্মা ফেনের ভিতর দিয়া আমারে সূরা পইড়া ফুয়াইতে ফূয়াইতে ঠান্ডা লাগায় দিলো। তাদের কাছে বিদায় নিয়া শ্বশুড় আব্বারে ফোন দিলাম। বুড়া ধরলো না। কঠিন মাইন্ড খাইসে বুড়া। ওক্কে, আমি মায়মুনা বেগম, ক্ষমা চামু চরম। রাগ মাগ ধুইয়া পানি ফালায় দিমু। ভাত তরকারী সাজায় টিভি দেখতে বসছি, এমন সময় কোকিল ডাইকা উঠছে। বাসার ভিতরে কোকিলরে খুঁজতেছি। আবদুল্লাহ মিয়া আমারে বেল চিনাইলে। অখন বুজলাম, দুনিয়ায় আমার থেকা বহুত বেশী জানা লোক আছে। আবদুল্লাহ মিয়া দরজা খুলে দিলো। বাসার মধ্যে বাইটা, টাকলা, ভুড়িওয়ালা যে লোকটা ঢুকলো, সেই নাকি কাশেম মিয়া। এই কাশেম মিয়ারে আমি চিনি। সে আমার গ্রামের চেয়াম্যান সাবের ফুফুর ননাশের ছেলে।
(চলবে)