#হৃদয়ে_লুকানো_প্রেম,৪১,৪২
#নুুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৪১
“আপনি কীসে পড়েন?”
আনমনে হাঁটছিল পরী। অচেনা ছেলেটার সাথে একসাথে হাঁটতে খানিক লজ্জা ও ভীরুতাও কাজ করছিল। হঠাৎ ছেলেটির কণ্ঠস্বরে ছেলেটির দিকে তাকায়। ছেলেটি সুদর্শনও বটে! পরী কয়েক সেকেন্ড নিরন্তর তাকিয়ে থাকে যার দরুণ ছেলেটি বিব্রত হলো। হালকা কাঁশির শব্দে পরী থতমত খেয়ে নজর সরিয়ে নেয়। দুজনেই চুপচাপ হাঁটছে। কিছুক্ষণ পর রাদ আবারও জিজ্ঞেস করে,
“কোথাও বসবেন? চলুন বসি।”
ওরা দুজনে একটা বেঞ্চিতে বসল।
“আপনার নামটাই তো জানা হলো না।”
“আমি পরী! অ্যাই মিন, আমার নাম ‘রিদিতা পরী’। আপনার নামটাও জানা হলো না।”
রাদ হেসে বলল,
“রায়হান ইসলাম রাদ। আপনার নামের সাথে মিল আছে লক্ষ্য করেছেন?”
কথাটা বলেই হাসলো। পরীও হেসে বলল,
“হুম কিছুটা।”
“আপনি কীসে পড়েন বললেন না তো?”
“এইতো এইচএসসি দিলাম। সামনে এডমিশন টেস্ট।”
“কোচিংয়ে ভর্তি হয়েছেন?”
“হ্যাঁ। উন্মেষে ভর্তি হয়েছি। মেডিকেল লাইনে যাওয়ার ইচ্ছে সাথে একটু ভার্সিটির ম্যাথও প্র্যাকটিস হয়ে যাবে। কিছুদিন পরেই ক্লাস শুরু হবে।”
“তাহলে তো ভালোই। দোয়া করি ভালো কিছু হোক।”
এক চা-ওয়ালা মামাকে দেখে চা নেয় দুজনে। চুপচাপ সবুজের মাঝে সাথে যানবাহনের হর্ণ! এসবে দুজনে চা উপভোগ করতে থাকে।
_________
এদিকে পিহু ও আয়ান পুকুরপাড়ে এসে বসেছে। দুজন এখনও নিশ্চুপ। আয়ান পানিতে কংকর নিক্ষেপ করছে বসে বসে। পিহু হাঁটতে হাঁটতেও উুঁশখুশ করছিল কথা বলতে। আয়ান পানির দিকে দৃষ্টি রেখেই বলে,
“কেমন আছো পিহু?”
পিহু এখন চুপ করে আছে। তার অভিমান পরিলক্ষিত। আয়ান নিরব হাসে।
“এতো অভিমান যে করে বসেছ? অভিমানের সাথে মনে পাহাড়সম আকাঙ্ক্ষা জমিয়েছ তা যদি কেউ পূরণ না করে তখন?”
পিহু মুখ ভাড় করে ফেলে। ছেলেটা এমন কেনো? এতো স্পষ্ঠভাষী কি হতেই হবে? একটু কম হলে হয় না! ফুস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,
“হয়তো একটু বেশিই আশা করে ফেলেছি! আপনাকে তার জন্য আসতেও হলো। সরি।”
আয়ানের হাত থেমে যায়। ঘুরে বসে পিহুর দিকে। সে বলে,
“যার ভালোবাসার মানুষটা অন্যের হয়ে যাওয়ার পরেও সে নিরব ছিল। তার থেকে তুমি প্রেম না করে প্রেমিকা হওয়ার আশা করছ। পরে নিজেই কস্ট পাচ্ছ। আমার জানো, কাউকে সজ্ঞানে আশা দিতে মন চায় না। যদি নিয়তিতে থাকে তবে সব হবে। বর্তমানকে ভালোবাসা উচিত। আমার মনে হচ্ছে আমার একটা রো*গ হচ্ছে! আমি কেমন যেন হয়ে গেছি।”
পিহু মনোযোগ দিয়ে শুনল। সে বলল,
“আপনি বাহ্যিকভাবে নিশ্চুপ থাকলেও আপনার মন কিন্তু নিশ্চুপ ছিল না। আপনি নিজের মধ্যে দমিয়ে রেখেছেন বলেই হয়তো খারাপ লাগছে। তাছাড়া সেই মানুষটার বিয়েতেও আপনি গিয়েছেন বলেছিলেন।”
“হ্যাঁ। সেই মানুষটাকে আমি প্রতিদিন দেখি। ও হাসলে, ওর ভালোবাসার মানুষটার সাথে খুশি থাকলে আমার হৃদয়ে শূণ্যতার বদলে ভালো লাগা অনুভব হয়। কেনো হয় জানিনা। বন্ধুত্ব চিরকাল থাক।”
পিহুর মনে হলো আয়ান আবার অন্যমনা হচ্ছে। তাই সে নিজের মুড পরিবর্তণ করে উচ্ছাসের সাথে বলে উঠল,
“চলুন ফু*চকা খা*ই। ঝাল ঝাল করে। যাতে চোখ বেয়ে পানি পরে!”
আয়ান পিহুর উচ্ছাসতা দেখে ভ্রুঁকুটি করেও হেসে ফেলে।
“চলো তাহলে। আমি ফু*চকা খাইনা এমনিতে তবে তোমার ফুচকার প্রতি এক্সপ্রেশন দেখে ইচ্ছে হলো।”
পিহু ঝাল ঝাল ফুচকা খাচ্ছে আর কাঁদছে! ফুচকাওয়ালাকে সে বাড়তি বো*ম্বাই ম*রিচ দিতে বলেছিল। এমনিতেও ফুচকাওয়ালা মামা বো*ম্বাই ম*রিচ দেন। আয়ান আবার নিজেরটাতে মোটামুটি ঝাল দিতে বলেছিল। পিহুর এই বেসামাল অবস্থা দেখে আয়ানের মনে পরল, সে তো পিহুর জন্য চকোলেট এনেছিল। বেচারি ঝা*লে কাঁদছে তারপরেও খাওয়া থামাচ্ছে না। আয়ান ওর দিকে চকোলেটটা এগিয়ে দিলো। পিহু ঝাপসা চোখে চকোলেটটা দেখে খুশি হলো। ছিনিয়ে নিলো আয়ানের হাত থেকে। আয়ান হাসলো।
ফুচকা খাওয়া শেষে পিহু চকোলেট খাচ্ছে আর ঝাল কমানোর চেষ্টা করছে। পাশাপাশি হাঁটছে। আয়ান পকেটে হাত গুঁজে বলল,
“সন্ধ্যা হয়ে আসছে। আমি রাদকে ফোন করে তোমার বোনকে নিয়ে আসতে বলি।”
পিহু আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখল, আকাশে লালিমা ছড়াচ্ছে। সূর্য ডুবে গেছে। পিহু আফসোস করে বলল,
“এতো সময় কখন চলে গেলো বুঝতেই পারলাম না। আরেকটু থাকতে ইচ্ছে করছে।”
আয়ান হাসলো। কোনো প্রত্যুত্তর করল না। পিহু হুট করে বলে উঠল,
“একটা কথা বলি? ওই আপুটার নাম কী? আপনি যে তাকে ভালোবাসেন সে জানে?”
আয়ান বিকেলের শেষ বাতাসে নিজের দীর্ঘশ্বাস উড়িয়ে দিয়ে বলল,
“ওর নাম প্রিয়া। আমি কখনও নিজের ফিলিংস জাহির করিনি। ফ্রেন্ডরা যেভাবে থাকে সেভাবেই থেকেছি। স্বভাবত ইন্ট্রোভার্ট হওয়ার একটা সুবিধা।”
পিহু মুখ ফসকে বলে ফেলে,
“আপনার সাথে তিন মাসের পরিচয় আমার। আপনি অন্যকারও হননি তাও আমি সেটা ভাবলেও সহ্য করতে পারিনা। আর আপনি! আপুটা অন্যকারও হয়ে গেছে। কীভাবে সহ্য করেন?”
আয়ান মৃদু হাসলো তবে জবাব দিলো না। পিহু কী বলেছে ভেবেই মুখ চেপে ধরল। লজ্জায় চোখ খিঁ*চে দাঁ*ত দিয়ে জি*ভ কা*টল। আয়ান রাদকে ফোন করে আসতে বলল। দশমিনিট পর রাদ ও পরী এসে পরেছে। পিহু ও পরীকে এগিয়ে দিয়ে আয়ান ও রাদ চলে যায়।
______________
পেরিয়ে গেছে অনেকগুলো দিন। পড়াশোনা, পরীক্ষা, আড্ডা সবমিলিয়ে চলছে ওদের দিন। রূপা ও তার বান্ধুবীরা প্রিয়াদের সাথে আর কথাই বলতে আসেনি। মূলত ভয়ে আসেনি তবে সামনে পরলে মুখ বাঁকিয়ে চলে যায়। দেখতে দেখতে এই সেমিস্টারটাও শেষ। প্রিয়ার তো পরীক্ষা শেষ হয়েছে আজকে। সকাল সকাল পরীক্ষা শেষ তাই চলে এসেছে। বন্ধুদের সাথে কালকে ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যানিং আছে তাও কাশবনে। জারিফের পরীক্ষার গার্ড বিকেল পর্যন্ত বলে প্রিয়া জারিফকে নিজের জন্য ও তুতুলের জন্য চকোলেট আনতে বলে দিয়েছে। এখন সে আর তুতুল ড্রয়িংরুমে অপেক্ষারত। তামান্না বলে,
“তোদের দুটোকে বাচ্চার থেকে কম লাগছে না!”
“আরে ভাবী চকোলেট আনলে তোমাকেও দিবো বুঝছ।”
“হু! তুতুলই খেয়ে নিবে। ওর বাবার আনা সব চকোলেট ওর পেটেই যায়।”
“এবার নো চিন্তা। তুতুলের জন্য আলাদা আনবে।”
হঠাৎ কলিংবেল বেজে উঠলে প্রিয়া তুতুলকে নিয়ে উঠে দরজা খুলতে যায়। ডোর মিররে দেখল দরজার ওপাশে জারিফ। প্রিয়া তুতুলকে শিখিয়ে দিলো কী করতে হবে। দরজা খুলেই প্রিয়া ও তুতুল নিজেদের ডান হাত বাড়িয়ে দিল। জারিফ ওদের মুখের দিকে একবার তাকায় আবার হাতের দিকে। প্রিয়া হাত নাড়াতে নাড়াতে বলে,
“চকোলেট দিন। চকোলেট দিন।”
“দিবো তো। আগে ঢুকতে দেও।”
জারিফের কথায় না সূচক বলে,
“উঁহু! আগে চকোলেট দিবেন তারপর।”
তুতুলও বলে,
“দাও দাও দাও। নাহলে তোমাকে আবার দোকানে পাঠাব!”
জারিফ কপাল কুঁচকে ব্যাগ থেকে চকোলেট গুলো বের করে ওদের হাতে দেয় আর বলে,
“এই নাও! এখানে তোমার, তুতুলের ও ভাবীর জন্য আছে। এবার তো ঢুকতে দাও!”
প্রিয়া দাঁ*ত বের করে হেসে বলে,
“হ্যাঁ হ্যাঁ আসুন।”
জারিফ ফ্রেশ হতে নিজের ঘরে চলে যায়। প্রিয়া ও তুতুল দরজা লাগিয়ে চকোলেট ভাগাভাগি করে নেয়। ভাগাভাগি শেষে প্রিয়া জারিফের ও নিজের, দুজনের জন্য দুধচা+কফি একসাথে চাফি বানিয়ে নিয়ে যায়। সাথে আবার চকোলেট গলিয়ে চাফিতে দিয়েছে। জারিফ এতক্ষণে জামা-কাপড় বদলে ফ্রেশ হয়ে বেড়িয়েছে। প্রিয়া মগটা এগিয়ে দিয়ে বলে,
“এই নিন! গ*রম গ*রম চাফি!”
জারিফ মৃদু হেসে মগটা নেয়। এক চুমুক খেয়ে বলে,
“চকোলেটও দিয়েছ? বাহ।”
প্রিয়া খুশি খুশি হয়ে বলে,
“হুম। এটার টেস্টটা অনেক রিফ্রেশিং। এনার্জি পাওয়া যায়। কোনো ফ্লেবারই কড়া না।”
“হুম।”
গোধূলিরাঙা আকাশ দেখতে দেখতে দুজনে ব্যালকনিতে বসে। জারিফ প্রিয়াকে নিজের বুকে আগলে নেয়।
চলবে ইনশাআল্লাহ্,
#হৃদয়ে_লুকানো_প্রেম
#নুুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৪২
সময় যতো যায় সম্পর্ক ততো গাড়ো হয় নয়তো ফিকে হয়। সময়ের জোয়ারে নতুন সম্পর্ক গঠিত হয়। মুন্নি ও রাদিফের আজ বিয়ে। অক্টোবর মাসের শুরুর দিকে। প্রকৃতিতে শরৎকালের শেষ সময়। দূর্গা পূজোর ছুটিতে বিয়ের আয়োজন করে ফেলেছে। ঢাকা থেকে জারিফরাও হাজির। জারিফ ও জায়ান গেস্টদের ওখানে দেখাশোনা করছে আর প্রিয়া ও তামান্না মুন্নির কাছে ওর ঘরে আছে। প্রিয়া মুন্নিকে বারবার দেখছে। মেয়েটা দেখতে মায়াবি। মায়াবি মুখশ্রীর অধিকারিণীকে জারিফ নজর-আন্দাজ করে দিলো! মুন্নি কয়েকবার লক্ষ্য করেছে প্রিয়ার তাকানো তাই তামান্নাকে বলে,
“ভাবী একটু মাকে ডেকে দিবে? সাথে আমার জন্য একটু পায়েস নিয়ে আসোনা। ভাইয়াকে বলো সে ব্যাবস্থা করে দিবে।”
তামান্না উঠে গেল। ঘরের ভিতর থাকা অন্যদের মুন্নি একটু বাহিরে যেতে বলে। ওরা বাহিরে যাচ্ছে তাই প্রিয়াও যাওয়া ধরলে মুন্নি ওর হাত টেনে ধরে।
“আপনি যাবেন না।”
প্রিয়া কিছুটা বিস্মিত হয়। সবাই বেরিয়ে গেলে মুন্নি প্রিয়ার হাত ছেড়ে দিয়ে বলে ওঠে,
“এতক্ষণ যাবত আপনি আমাকে পর্যবেক্ষণ করছিলেন তাই না?”
প্রিয়া ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়। মুন্নি হেসে বলে,
“ভাবছেন আমি সুন্দরী হওয়া স্বত্বেও আপনার স্বামী আমাকে রিজেক্ট করল কেনো? জানেন? এই প্রশ্ন আমারও মন মস্তিস্কে ঘুরপাক খে*তো। তারপর আমার বাবা আমাকে বুঝালো। যার চোখে যে সুন্দর। আপনার স্বামীর চোখে আমি বোন তাই আমার রূপ-সৌন্দর্যে তার কিছু যায় আসত না। আপনি ভাগ্যবতী বটে। আপনাকে একসময় আমি ঈ*র্ষা করেছিলাম। এখন আর সেই ঈ*র্ষা নেই। যা হয়েছে ভালোর জন্য হয়েছে। আমার জীবনে এমন একজন এসেছেন, যিনি আমাকে খুব ভালোবাসেন। চারটা মাস বন্ধুর মতো তিনি আমার পাশে ছিলেন। আমাকে তার সাথে সহজ করেছেন। আমার না বলা অনেক কিছু বুঝে নিয়ে তা পূরণ করেছেন। তাছাড়া তিনি মাশাআল্লাহ্ অনেক সুন্দরও। জানিনা ভালোবেসে ফেলেছি কীনা? হয়তো তার জন্য ভালোবাসা জন্মে গেছে। তিনি আশেপাশে থাকলে মানুষিক শান্তি পাই। ভরসা পাই। আর কি চাই বলুন?”
প্রিয়ার ওষ্ঠকোণে প্রশান্তির হাসির রেখা ফুটলো। মুন্নির মনে যে তাকে নিয়ে তিক্ততা নেই সেটা জেনে স্বস্থি পেলো। ব্যাগ থেকে একটা বক্স বের করল। সেখানে একজোড়া ডায়মন্ডের টপ ইয়ারিং আছে। সেটা মুন্নির হাতে দিয়ে বলল,
“এটা আমার ও জারিফের পক্ষ থেকে। তোমার জীবনে রাদিফের সাথে সুখের মুহূর্তগুলো সর্বদা উজ্জ্বল হয়ে থাকুক। আমাদের জন্যও দোয়া করো।”
“এটার কোনো প্রয়োজন ছিল না। আমি আপনাদের নিয়ে মনে কোনো অসন্তোষ রাখিনি।”
“অসন্তোষের জন্য না। আমাদের জন্য তোমার জীবনে কিছু সময়ের জন্য হলেও অন্ধকার ভর করেছিল। সেই অন্ধকার তোমার জীবনে আর না আসুক। বলতে পারো, আলোর দিশারী স্বরূপ দিলাম। তোমার জীবনের শুভ কামনা স্বরূপ।”
মুন্নি চোখে হাসল সাথে প্রিয়াও। ততক্ষণে মুন্নির মা হাজির। তিনি মেয়ের কী লাগবে তা নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পরেন। প্রিয়া ঘর থেকে বেরিয়ে বিয়ে বাড়িতে জারিফকে খুঁজছে। এই ভারী লাল বেনারসি পড়ে সে ভাবছে আশেপাশের মানুষ আবার তাকে বউ ভেবে ভুল না করে! হলোও তাই। এক বয়স্ক মহিলা এসে কিছুটা সন্দেহের নজরে দেখে সুধায়,
“এই মেয়ে! কোথায় যাচ্ছ? একটু পর তোমার বিয়ে পড়াবে আর তুমি এখানে ঢেং ঢেং করে হাঁটছ! কোনো অন্য মতলব আছে নাকি?”
প্রিয়া ঠোঁট উলটে তাকায় অতঃপর করুণ স্বরে বলে,
“আন্টি আমি মুন্নি না। আমি ওর কাজিনের ওয়াইফ। মুন্নি ওইযে কোনার দিকের দ্বিতীয় ঘরটাতে আছে।”
মহিলাটি ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে চোখে চশমাটা ঠেলে বলে,
“অহ। এজন্যই বলি? মাথায় ওড়না কোথায়? এমন পাথরের গহনা কেনো? তা বাপু? তোমাকে কি বিয়েতে গহনাগাঁটি দেয়নি? কিসব পা*থর পড়ে আছ!”
প্রিয়া মহিলাটির কথায় বিরক্তই হলো বেশ।
“দিয়েছে আন্টি। সেই ঢাকা থেকে তো সব আনা যায় না। তাছাড়া আমি যদি সেসব পড়ি তবে আপনি তো আমার এই সাঁজেই বউয়ের সাথে গু*লিয়ে ফেলেছেন! তখন তো আমাকে জি**ম্মি করে আমার দ্বিতীয় বিয়েও সেরে ফেলতেন! আপনার মনের শান্তির জন্য পরশু বউভাতে আমি ওসব পড়বনে। চোখ দিয়ে দেখে নিবেন তখন।”
প্রিয়া এই বলে সরে গেলো। আরেকটু পর জারিফকে দেখল বরের বাড়ির মানুষদের সাথে কথা বলছে। প্রিয়া নিশ্চুপে জারিফের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। জারিফ একপলক দেখে হেসে আবার কথা বলছে। কথা বলা শেষে জারিফ প্রিয়াকে নিয়ে বাগানের দক্ষিণ পাশে যে শিউলি ফুল গাছটা আছে সেটার কাছে। গাছটার নিচে চাদরের মতো শিউলি ফুলগুলো বিছিয়ে আছে। জারিফ গাছের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে প্রিয়াকে বলে,
“কী ব্যাপার? তুমি আমার পাশে এসে দাঁড়ালে অথচ কিছু না বলে দাঁড়িয়েই ছিলে। মন বুঝি খুব খুশি?”
প্রিয়া জারিফের দিকে এগুলো। তার গলা জড়িয়ে ধরে বলে,
“মনে জমে থাকা মেঘ কে*টে গেছে। বুক ভরে প্রশান্তির শ্বাস নিতে পারছি।”
জারিফ প্রিয়ার গালে স্লাইড করে ঘোরলাগা স্বরে বলে,
“বাই দা ওয়ে! তোমাকেই তো বউ বউ লাগছে। কেউ আবার তোমাকে নিয়ে ধরে বেঁধে বিয়ে না দিয়ে দেয়! আমার একমাত্র বউকে আমি অকালে হারাতে পারব না। তুমি আমার সাথে সাথেই থাকবে।”
প্রিয়া লজ্জায় আড়ষ্ট হচ্ছিল তন্মধ্যে হেসে ফেলে।
“দিতো তো। ভাগ্যিস উনার এক্সপেক্টেশন অনুসারে আমি সাঁজিনি।”
দুজনেই হেসে উঠল। জারিফ এক মুঠো শিউলি ফুল কুড়িয়ে নিয়ে বলে,
“একদিন শিউলিমালা খোঁপায় গেঁথে আমার শরৎশশী সাঁজবে প্রিয়। আমি মুগ্ধ নয়নে দেখব।”
সমীরণে আজ প্রেমের ছোঁয়া। হৃদয়ে প্রখর অনুভূতিরা ঠিকরে পরছে।
____________
মুঠো ভর্তি কাশফুল হাতে নিয়ে পিহুর উচ্ছাসতা দেখছে আয়ান। বাচ্চাদের মতো খিলখিল করে হাসছে। পরী ও রাদ এদিকে কিছুটা দূরে কাশফুলের সাথে ছবি তুলতে ব্যাস্ত। নিশি, মিম, অর্ষা, অন্যপাশে ছবি তুলছে তাদের ক্যামেরাম্যান সাদ! আয়ান দেখল পিহুর ঝাঁকানোর কারণে কাশফুলের রেণু অনেক ছড়িয়ে পরছে তাই দ্রুত ওর হাত থেকে ফুলগুলো ফেলে দিয়ে বলে,
“এই রেণু কিন্তু চোখের জন্য ক্ষ*তিকর। অনেক লা*ফালে এবার চলো।”
পিহু আয়ানের ধরা হাতের দিকে তাকালো। এতোদিনে ওদের বন্ধুত্ব আরও সুন্দর হয়েছে। পিহুর ভালোবাসা আরও গাড়ো হয়েছে আর আয়ানের মনে হচ্ছে সে এই বাচ্চা স্বভাবের মেয়েটির ভালোবাসায় আটকে গেছে। আয়ান পিহুর নজর দেখে হাতটা আরও জোড়ালো ভাবে ধরল। পিহু মুচকি হাসে। সূর্যরশ্মি মৃদু আঁচ দিচ্ছে। সূ্র্যের দিকে তাকিয়ে কদম বাড়াতেই হোঁ*চট খেতে নিলে আয়ান সামলে নেয়।
“পরে যেতে তুমি।”
“আপনি আছেন তো।”
এই ভরসাস্বরূপ জবাবে আয়ান স্নিগ্ধ হাসলো। কিছুটা দূরে এক হাওয়াই মিঠাইওয়ালা দেখলে পিহু বলে ওঠে,
“ওই দেখুন। ওখানে নিজেদের পছন্দ মতো শেইপে হাওয়াই মিঠাই বানানো যায়। চলুন খাব।”
আয়ান পিহুকে নিয়ে গেল। বেচারি শাড়িতে বারবার পা পেঁচিয়ে যাচ্ছিল। একটা লাভ শেইপ হাওয়া মিঠাই বানাতে বলল। সেটা নিয়ে পিহু আয়ানের সাথে সেলফিও তুলল। আয়ান মনে মনে ভাবে,
“আমার যাওয়ার দিন তোমাকে উপহারস্বরূপ দেওয়ার আরও একটা কিছু যুক্ত হলো। তোমার মুখের বিষাদময়তায় এক টুকরো হাসির কারণ হবে।”
________
দেখতে দেখতে জারিফ ও প্রিয়ার এনিভার্সিরি চলে আসে। বসন্তসাঁজে প্রিয়া নিজেকে সাঁজিয়েছে। খোঁপায় তার বেলিফুল। সাদার মধ্যে হরেক রঙের ফুলের সমাহার শাড়িতে। জারিফকেও ম্যাচিং পাঞ্জাবি পড়িয়েছে। আজ ওরা রবীন্দ্র সরোবরে এসেছে। জারিফ বেলিফুল ও কাঠগোলাপের মালা কিনে প্রিয়ার দুহাতে পড়িয়ে দিয়েছে। একটা কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে বসেছে ওরা। প্রিয়া বলে,
“কীভাবে একটা বছর পেরিয়ে গেলো বলুন? সব কেমন দ্রুত চলে গেল না? এইতো সেদিন আমাদের পরিচয় হলো।”
জারিফ একটা কৃষ্ণচূরা প্রিয়ার কা*নের পিঠে গুঁজে বলে,
“একদিন আমরা বুড়ো হবো। তখন দুজনে আবার আসব এখানে। সাথে নাতি-নাতনী থাকলে মন্দ হয় না বলো?”
“ইশ! এখনও বাচ্চাই হলো না আর সে নাতি-নাতনীর চিন্তা করে!”
“হবে তো। তোমার গ্রাজুয়েশন কম্পিলিট হোক।”
প্রিয়া আফসোস করে বলে,
“ভেবেছিলাম, বিয়ে হবে আর পড়ব না। কিন্তু কপালে তো শান্তি নাই। স্যারের সাথে বিয়ে হলো।”
জারিফ হেসে উঠল যার দরুন প্রিয়া ওর বাহুতে থা-*প্প**ড় দিলো। জারিফ রম্যস্বরে বলে,
“আমার আরও দূরদর্শী চিন্তা আছে। তোমাকে নিয়ে কানাডা যাব। আমি পিএইচডি করব আর তুমি মাস্টার্স ও পিএইচডি করবে।”
প্রিয়া চোখ রসোগোল্লার মতো বড়ো বড়ো করে বলে,
“কিহ! গ্রাজুয়েশনের পর আমি অতো প্যা*রা নিতে পারব না। আপনার মন চাইলে ডাবল ত্রিপল পিএইচডি কইরেন। আমাকে টানবেন না। আমি তো রিল্যাক্স করব।”
“আচ্ছা! তখন দেখা যাবে।”
সন্ধ্যার বাতায়নে রক্তিম আভা ছড়াচ্ছে। জীবনের প্রহর থেকে আরও একটি বাৎসরিক সন্ধ্যা বিদায় জানাচ্ছে ওদের।
চলবে ইনশাআল্লাহ্