হৃদয় রেখেছি জমা,পর্বঃ১,২
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ১
প্লেনে উঠে নির্ধারিত সীটে চুপচাপ বসে আছে মেহরিন। এনএস আই থেকে উজবেকিস্তানের একটা মিশনে পাঠানো হচ্ছে তাঁকে। মিশনটা একাই হ্যান্ডেল করতে হবে মেহরিনকে। সেখানকার স্থানীয় পুলিশ অবশ্য সহযোগীতায় থাকবে কিন্তু বাংলাদেশি কোন এজেন্ট থাকবে না। সিক্রেট মিশন! তাই যথাসম্ভব কনফিডেনসিয়াল রাখার চেষ্টা করছে এনএসআই। ফ্লাইট টেইক অফ করবে এমন সময় পাশের সীটে মাহমুদকে দেখে রীতিমত চমকে উঠলো সে। গোলগোল চোখে চেয়ে থেকে বললো,’তুমি?’
মাহমুদ দাঁত কেলিয়ে হাসলো। হাতের আঙুল দিয়ে ঝাঁকড়া চুলগুলো ব্রাশ করতে করতে বললো,’বস তোমার ওপর পুরোপুরি ভরসা করতে পারছেন না তাই জোরপূর্বক আমাকে পাঠানো হয়েছে। আমার অবশ্য আসার কোন ইচ্ছে ছিলো না কিন্তু ভাবলাম ছুটি যখন আছে তখন এনাকে নিয়ে একটু ঘুরে আসি। সেই সাথে….না থাক!’ পুরো কথাটা শেষ করলো না সে।
এমনিতেই তাঁকে দেখেই মেজাজ একশো দুই ডিগ্রী হাই হয়ে গেছে মেহরিনের। তারওপর এমন গা জ্বালানো কথাবার্তা। তেতে উঠে বললো,’সেই সাথে কি? সেই সাথে যদি আমার মিশনে খানিকটা বাগড়া দেওয়া যায় ক্ষতি কি? তাইতো?’
মাহমুদ হাসলো। ডান হাতের তর্জনী দিয়ে মেহরিনের নাকে আলতো করে একটা টোকা দিয়ে বললো,’এক্সেক্টলি। ইউ গট মাই পয়েন্ট!’
রাগ ক্রমাশয় বাড়ছে মেহরিনের। মাহমুদ তাঁর পাশে থাকা মানেই মেজাজ আউট অফ কন্ট্রোল হয়ে যাওয়া। বদের হাড্ডিটা জ্বালিয়ে হাড়মাংস কয়লা করে দিয়েছে তাঁর। তথাপি বহু কষ্টে নিজেকে সংযত করে বললো,’এনা কোথায়?’
-‘পেছনে।’
ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে চাইলো মেহরিন। সঙ্গে সোহাগও আছে। অবাক হলো সে, তাঁকে একা পাঠানোর কথা বলে পুরো টিম পাঠানোর মানেটা কি?
বস্তুত আজকে সকালের আগে মাহমুদরা নিজেরাও জানতো না তারা মিশনে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে ইরফান আহমেদ খুব সুক্ষ্ম একটা চাল চেলেছেন। মেহরিনকে ফ্রন্টলাইনে রেখে শত্রুপক্ষের নজর হটানোটাই উনার মূল উদ্দেশ্য। কারন তিনি ভালো করেই জানেন এনএস আই এজেন্টের (মেহরিন) উজবেকিস্তানে যাওয়ার খবরটা চাপা থাকবে না। ইনফরমেশন লিক হবেই। সো, সেই অনুযায়ী প্ল্যানটা সাজাতে হবে তাঁকে। মাহমুদ, এনা এবং সোহাগ কেউই মেহরিনের সঙ্গে উজবেকিস্তান যাচ্ছে না। স্টপওভার এয়ারপোর্ট গুলোতে নেমে আলাদা আলাদাভাবে উজবেকিস্তান যাবে তাঁরা। এবং পরবর্তী ইন্সট্রাকশন না পাওয়া পর্যন্ত আত্মগোপন করে থাকতে হবে। কিন্তু মেহরিনকে রাগানোর জন্য ইচ্ছে করে কথাটা বলে নি মাহমুদ।
উপরন্তু, খোঁচা মেরে বললো,’সোহাগ অবশ্য নিজে থেকেই এসেছে। তাঁর অতি প্রিয় মেহরিনের ম্যামের মিশনের আমি বাগড়া দেবো শোনার পর আর কিছুতেই আটকে রাখা যায় নি তাঁকে। আদর্শ প্রেমিক বলে কথা!’
-‘এসবের মানে কি?’, চটে গেলো মেহরিন। রাগলে তাঁর মুখ লাল হয়ে যায়। চোখে পানি চলে আসে। স্বভাবগত ভাবে খুবই আবেগপ্রবণ সে। রাগটা কিছুতেই সামলাতে পারে না। মাহমুদ ফের বিচ্ছিরিভাবে হেসে বললো,’ভালোবাসা! একেবারে খাঁটি ভালোবাসা।’
এক্ষেত্রে সোহাগের বর্ণনা দেওয়াটা খুবই জরুরী। এনএসআই এর নিরতিশয় ভদ্র এবং অমায়িক প্রকৃতির একজন এজেন্ট সে। নিজের দায়িত্ব এবং কর্তব্যের প্রতি যথেষ্ট সচেতন। হার্ডওয়ার্কিং এ্যান্ড কো-অপারেটিভ। তাঁর কেবল একটাই দোষ মেহরিনের প্রতি একটু বেশিই সহানুভূতিশীল সে। ব্যপারটা অবশ্য মাহমুদের নিজস্ব ধারণা। বাকিরা এর সঙ্গে একমত কিনা এই ব্যপারে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। তবে সোহাগের পয়েন্ট অব ভিউ থেকে যদি বলা হয় তাহলে মাহমুদের সবসময় পেছনে লাগার ব্যপারটা একদমই পছন্দ নয় তাঁর। কারণে অকারণে মেহরিনকে বিরক্ত করে মাহমুদ। তাই মাঝেমধ্যে মেহরিনের হয়ে প্রতিবাদ করে সে। কিন্তু মাহমুদ ব্যপারটা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে এসেছে ইতোমধ্যে অফিসের অনেকেই সত্যি সত্যি বিশ্বাস করতে শুরু করে দিয়েছে মেহরিনের সঙ্গে গোপনে একটা রিলেশন চলছে তাঁর। আড়ালে কানাঘুষাও চলে তাদের দুজনকে নিয়ে। কিন্তু মেহরিনের সামনে ভয়ে বলার সাহস নেই কারো নেই।
আরো একবার নিজেকে সংযত করে নিলো মেহরিন। মাহমুদের খোঁচাটাকে একপাশে সরিয়ে রেখে কাঠকাঠ গলায় প্রশ্ন করলো,’বলা হয়েছিলো আমাকে একা পাঠানো হবে। তাহলে তোমাদের পাঠানোর উদ্দেশ্যটা কি?’
-‘বললাম তো। টাকলু তোমার ওপর ভরসা করতে পারছিলো না।’
-‘এইকথাটা আমাকে সরাসরি বললেই তো হতো?’
মাহমুদ নিতান্ত অনিচ্ছা প্রকাশ করে বললো,’সেটা আমি কি করে জানবো? আমাকে এত প্রশ্ন করছো কেন?’
রাগে মুখ ফিরিয়ে নিলো মেহরিন। সে খুব ভালো করেই জানে এসব কেন হচ্ছে? তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস মাহমুদের কানপড়াতেই ইরফান আহমেদ বাধ্য হয়ে এমন একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। নতুবা হঠাৎ করে প্ল্যান চেইঞ্জ করবার আর কি কারণ থাকতে পারে? সব ঠিকঠাক হয়ে যাওয়ার পর মাঝখান দিয়ে মাহমুদের এন্ট্রি। একটা মিশনও সে শান্তি মতন কমপ্লিট করতে দেবে না মেহরিনকে। বাঁ হাত ঢোকাবেই!
সে রেগে আছে বুঝতে পেরে আর বেশি খোঁচালো মাহমুদ। পিছন ফিরে একঝলক সোহাগের দিকে চাইলো। বেচারার মুখে দুঃখী দুঃখী ভাব! নিশ্চয়ই ভাবছে সুযোগ পেয়ে তার প্রাণপ্রিয় মেহরিন ম্যাডামকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে কয়লা বানিয়ে দিচ্ছে মাহমুদ। তাঁর ভাবনাটাকে সত্যি প্রমাণ করার উদ্দেশ্যে চোখে চোখ পড়তেই প্রচন্ড বিরক্তিকর এবং গাত্র জুলুনিদায়ক একটা হাসি দিলো সে। এই হাসির মানে সোহাগের অজানা নয়। এর মানে হচ্ছে তাঁর ধারণা সম্পূর্ণ নির্ভুল। পায়ে পা লাগিয়ে মেহরিনের সঙ্গে ঝগড়া শুরু করে দিয়েছে মাহমুদ। চোখেমুখে অনুনয় ফুটে উঠলো তাঁর। নিঃশব্দে মাথা দুলিয়ে বোঝাতে চাইলো ‘প্লিজ স্যার!’ জবাবে আবারো হাসলো মাহমুদ। তবে এবারের হাসিটা একটু অন্যরকম।
.
.
.
চলবে
#হৃদয়_রেখেছি_জমা
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ২
উজবেকিস্তানের রাজধানী তাসখন্দের একটা বিলাসবহুল পাঁচতারা হোটেলে অবস্থান করছে এন এস আই এর চার সদস্য। তাদের জন্য বুকিং করে রাখা হোটেলে উঠেনি কেউই। প্ল্যান অনুযায়ী অন্য একটা হোটেলে উঠেছে।
বহুতল ভবনবিশিষ্ট এই হোটেলটির লবিতে বসে আছে মাহমুদ, এনা এবং সোহাগ। একটু আগেই ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমেছে তিনজন। সবার আগে এসেছে সোহাগ। তারপর মাহমুদ। তারপর এনা। মেহরিন এখনো নিচে নামে নি। তারজন্য অপেক্ষা করতে করতে আলোচনা শুরু করে দিলো বাকি তিন জন।
ডিনারে কে কি খাবে সেই নিয়ে আলোচনা! প্রায় ঘন্টাখানেক বাদে ফ্রেশ হয়ে নিচে নামলো মেহরিন। তাঁর পরনে হালকা আকাশি রংয়ের একটা ফতুয়া আর ব্ল্যাক জিন্স। ভেজা চুলগুলো এলোমেলো কাধের ওপর ছেড়ে দিয়েছে। বামহাতে দামী রিস্টওয়াচ। বেশ স্নিগ্ধ লাগছে দেখতে। তাঁকে দেখে আলোচনা থামিয়ে দিলো মাহমুদ। বাকি দুজনকে উদ্দেশ্য করে ভাষণ দেওয়ার ভঙ্গিতে বললো,’ঐ যে এনএস আই এর উজ্জ্বল নক্ষত্র মেহরিন শারাফাত সিঁড়ি দিয়ে নামছেন। মাত্র একঘন্টা তিনমিনিটে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়েছেন তিনি।’
তাঁর বলার ঢংয়ে হেসে ফেললো এনা। কৃত্রিম শাসনের ভঙ্গিতে বললো,’ব্যাড ম্যানার্স! জানো না মেয়েদের ফ্রেশ হতে টাইম লাগে।’ সোহাগও হাসলো তবে সেটা মাহমুদকে উদ্দেশ্য করে নয়। মেহরিনকে স্বাগতম জানানোর জন্যে। তাঁর পাশে সিঙ্গেল সোফায় বসলো মেহরিন। জ্বলজ্বল চোখে একবার মাহমুদের দিকে তাকিয়ে ডিনার অর্ডার করলো। তিনটে ভেজিটেবল রাইস, একটা থাইস্যুপ আর গ্রিল্ড চিকেন দিয়ে ডিনার শেষ করলো তাঁরা। ডেজার্ট হিসেবে মাহমুদ এবং এনা আইসক্রিম নিলেও বাকি দুজন সাফ মানা করে দিলো। তারপর শুরু হলো মিশন নিয়ে আলোচনা।
বেশ কিছুদিন আগের ঘটনা, বাংলাদেশে সফর করতে আসা ভিয়েতনামের পররাষ্ট্র মন্ত্রীর ওপর হামলার পরিকল্পনা চালায় বাংলাদেশের কুখ্যাত একটি মাফিসা গ্যাং। যদিও কড়া নিরাপত্তার কারণে তাদের চেষ্টা সফল হয় নি তবে গোপন সূত্রে জানা গেছে, আবারো হামলার পরিকল্পনা করছে দলটি। এবং হামলার সমস্ত পরিকল্পনা তাসখন্দ থেকে আনুমানিক সত্তর কিলোমিটার দূরবর্তী আলমালেক শহরে চলছে। কিন্তু কবে, কখন, কোথায় তাঁরা হামলা করবে সে ব্যপারে এখনো কিছু জানা যায় নি।
★
আলোচনা প্রায় শেষ। সবার বক্তব্য শেষে পুরো প্ল্যানটা আরেকবার ব্রিফ দিচ্ছে মেহরিন। মাহমুদের সেদিকে মন নেই। তাঁর দৃষ্টি সামনের দিকে। বিশাল রিসেপশন এরিয়ে পেরিয়ে একপাশে গান বাজনার পশরা চলছে। অন্যপাশে গ্যাম্বলিংয়ের আসর। ওয়েস্টার্ন ড্রেস পরিহিতা উঠতি বয়সী কিছু তরুনী গানের তালে তালে নৃত্য করছে। আনমনে সেদিকেই তাকিয়েছিলো সে। বস্তুত আগামী কালকের প্ল্যান নিয়ে ইরফান আহমেদের সঙ্গে তাঁর কিছু জরুরি ডিসকাশন আছে । সে ব্যপারেই ভাবছিলো সে। রুমে গিয়ে ইরফান সাহেবকে মেইল পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলো।
এদিকে তাঁর দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনে চাইলো মেহরিন। মুহূর্তেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। এত গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা রেখে মাহমুদ মেয়েদের নাচ দেখছে? নাহ! আর সহ্য করা যাচ্ছে না। হাতের ফোনটা শব্দ করে সেন্টার টেবিলের ওপর রেখে গম্ভীর কন্ঠে বললো,’নজর হটানো গেলে আলোচনাটা ঠিকভাবে করা যেত।’
ধ্যান ভাঙ্গলো মাহমুদের! মুচকি হেসে মেহরিনের দিকে চাইলো সে। আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠে দাঁড়ালো। তাঁর সামনে দিয়েই ট্রে-ভর্তি রেড ওয়াইন নিয়ে যাচ্ছিলো অল্পবয়স্ক এক তরুণ ওয়েটার। তাঁকে ডেকে পরপর দুটো পেগ গলাধঃকরণ করলো মাহমুদ। তিন নাম্বারটা হাতে নিয়েই একেবারে তরুনীদের মাঝখানে চলে গেলো। তাদের সাথে তাল মিলিয়ে ডান্স মুভ দেওয়ার চেষ্টা করলো। প্রথমে যদি খানিকটা অসুবিধে হলো কিন্তু ধীরে ধীরে তাল মিলতে শুরু করলো। মেহরিন তীক্ষ্ণ চোখে সেদিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে চোখ সরিয়ে নিলো। রাগে তাঁর সমস্ত শরীর জ্বলছে।
হাতের ম্যাগাজিনটা রেখে এনাও উঠে দাঁড়ালো। দ্রুত পায়ে মাহমুদের দিকে এগিয়ে গেলো। তাকে দেখে হাসিমুখে হাত বাড়ালো মাহমুদ।
সোহাগ সেদিকে একঝলক তাকিয়ে মেহরিনকে উদ্দেশ্য করে বললো,’বসের ঠিক কি প্ল্যান, তুমি কি কিছু জানো?’
-‘না।’ গম্ভীর গলায় জবাব দিলো মেহরিন। তাঁর প্রচুর রাগ লাগছে। ইরফান সাহেবকে যদি একবার এদের কাণ্ডকারখানাটা দেখাতে পারতো সে! যেন ফুর্তি করতে এসেছে ওরা।
-‘মাহমুদ ভাইকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। উনিও জানেন না।’
-‘কি জানি।’, নিরাসক্ত কন্ঠে জবাব দিলো মেহরিন। সোহাগের এসব উটকো কথাবার্তা ত্যক্ত লাগছে তাঁর।
আলোচনা বিশেষ জমলো না। চুপ করে রইলো সোহাগ। মেহরিন চারপাশে চোখ বুলিয়ে একটা ম্যাগাজিন তুলে নিয়ে পড়তে শুরু করলো। মিনিট দশেক বাদে ফিরে এলো মাহমুদ। পরনের শার্টটা ঘামে ভিজে চুবচুবে। ধপ করে সোফায় বসে পড়ে শার্টের প্রথম দুটো বোতাম খুলে দিলো সে। ঘাড়ের কাছে খানিকটা নামিয়ে দিলো কলারটা। টিস্যু দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বললো,’এদের মিউজিক চয়েস খুব ভালো। নাচের জন্য একদম পার্ফেক্ট!’
চাপা রাগে মুখ ফিরিয়ে নিলো মেহরিন। মাহমুদকে উপেক্ষা করে সমস্ত মনোযোগ ম্যাগাজিনের দিকে দেওয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু না! না চাইতেও দৃষ্টি বারবার মাহমুদের দিকে চলে গেলো। এনা এসে একেবারে তাঁর ঘা ঘেঁষে বসেছে। মিষ্টি হেসে মেহরিনকে উদ্দেশ্য করে বললো,’মাহমুদ বলছিলো আপনি নাকি খুব ভালো ডান্স করতে পারেন। আমাদের সঙ্গে জয়েন করলেন না কেন আপু?’
-‘ইট’স ওকে। আমি ঠিক আছি।’, থমথমে গলায় জবাব দিলো সে।
মাহমুদ সরাসরি তাঁর মুখের দিকে চাইলো। চোখাচোখি হতেই মুখ দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো মেহরিন। হাই তুললো। প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছে তাঁর। সারাদিনের জার্নিতে শরীর ভীষণ ক্লান্ত। উঠে দাঁড়ালো সে। সোহাগকে উদ্দেশ্য করে বললো,’আমি রুমে যাচ্ছি।’
জবাবে সোহাগ কিছু বলার আগেই মাহমুদ তড়িঘড়ি করে বললো,’আমি আর এনা রুম নম্বর থ্রি-সিক্সটি ফাইভে থাকবো। তোমাদের কোন অসুবিধে নেই তো?’
থমকে গেলো মেহরিন। একঘরে থাকবে মানে? লজ্জা শরমের কি মাথা খেয়েছে মাহমুদ? রাগে মুখ লাল হয়ে গেলো তাঁর। একটা মানুষ কি করে এতটা ডেস্পারেট হতে পারে? ক্রুর দৃষ্টিতে মাহমুদের দিকে চাইলো সে। ক্ষ্যাপা কন্ঠে ডাক দিলো,’মি.মাহমুদ?’
-‘ইয়েস, মিস মেহরিন?’, নড়েচড়ে বসলো মাহমুদ। মুখে মিটিমিটি হাসি। রেগে গেলে মেহরিনের প্রফেশনালিজম মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। তখন মাহমুদ হয়ে যায়, মি. মাহমুদ।
-‘আপনি বোধহয় ভুলে যাচ্ছেন আমরা মিশনে এসেছি, হানিমুন পালন করতে নয়!’
-‘আমি মোটেও ভুলি নি মিস মেহরিন। আমার স্মরণ শক্তি একদম ঠিক আছে।,
-‘তাহলে?’
-‘তাহলে আর কি? আপনি বোধহয় বসের নির্দেশের কথা ভুলে গেছেন।’
-‘বেশ আপনিই তবে স্মরণ করিয়ে দিন?’
-‘হোয়াই নট? আমাদের এখানে উঠার একটাই উদ্দেশ্য শত্রুপক্ষের নজর এড়ানো। যতদিন না মুখোমুখি হামলার নির্দেশ দেওয়া হয় ততদিন পুরোপুরি ছদ্মবেশে থাকতে হবে আমাদেরকে। উই হ্যাভ টু বি ইন ডিজগাইস!’
বিব্রত হলো মেহরিন। রাগের চোটে এই কথাটা মাথা থেকে একদম বেরিয়ে গেছিলো তাঁর। ইরফান আহমেদের সঙ্গে পরামর্শ করেই স্বামী স্ত্রীর পরিচয়ে কামরা বুক করেছে তাঁরা। তখন অবশ্য বুঝতে পারে নি রাতেও একঘরে থাকতে হবে সোহাগের সঙ্গে। অস্বস্তি বোধ করলো সে। যদিও প্রফেশনের দিক থেকে ইট’স অল অফ দেয়ার ডিউটি বাট মেয়েলি ইনস্টিংক্ট বলে তো একটা ব্যপার আছে? যতই সহকর্মী হোক, একা এক ঘরে সোহাগের সঙ্গে থাকার ব্যপারটা স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারলো না সে।
মাহমুদ সেটা বুঝতে পেরে বললো,’দুটো কামরাই ডাবল বেডের! দুজন ইজিলি ম্যানেজ করা যাবে!’
চোখ জোড়া জ্বলে উঠলো মেহরিনের। এরমানে ‘আর একটা কথাও বলবে না তুমি।’ সে রেগে আছে বুঝতে পেরে মাহমুদকে ভয়ে আর কিছু বললো না ঠিকই কিন্তু এনাকে বগলদাবা করে উপরে চলে গেলো।
সোহাগ গম্ভীর মুখে বললো,’আমি ভেবেছিলাম এনা অন্তত আপত্তি করবে।’
-‘বাচ্চা মেয়েটার ব্রেইনওয়াশ করে দিয়েছে। দেখছো না কেমন মাহমুদ, মাহমুদ করে মুখে ফেনা তুলছে?’
সোহাগ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,’কি আর করা। আফটার অল, উই আর প্রফেশনাল। আমাদেরকে সব রকম পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে।’
মেহরিন প্রতিউত্তর করলো না। তাঁর ভেতরটা জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। একটা মানুষ কি করে এত বদলে যেতে পারে? সোহাগ ব্যস্তভাবে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,’তুমি রুমে যাও। আমি একটা ফোন সেরে আসছি।’
★
ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো মেহরিন। ঘুমে তাঁর চোখ ঢুলুঢুলু। সোহাগ এখনো আসে নি। দরজায় নকের আওয়াজ পেয়ে উঠে দাঁড়ালো সে।দরজার বাইরে এনা দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখে হাসিমুখে বললো,’ঘুমিয়ে পড়েছিলেন?’
ভ্রুজোড়া আপনা আপনি কুঁচকে গেলো মেহরিনের। মাহমুদের ওপর রাগ ঝাড়তে না পেরে অলরেডি মেজাজ প্রচুর খারাপ হয়ে আছে তাঁর। তারওপর এনাকে দেখে আরো বেশি বিরক্ত হলো। বিরক্তি চেপে যথাসম্ভব শান্ত কন্ঠে প্রশ্ন করলো,’তুমি?’
প্রতিউত্তরে এনা আবারো মুচকি হেসে বললো,’আমি এখানে ঘুমাবো। মাহমুদ আপনার সঙ্গে দুষ্টুমি করেছে।’
মেহরিন হতভম্ভ! মানে কি? এটা কি মজা করার মতন কোন বিষয়? মাহমুদ শুরু করেছে টা কি?
রাগে তাঁর গা জ্বলে উঠলো! বারবার তাঁকে বিভ্রান্তিতে ফেলে কি প্রমাণ করতে চাইছে মাহমুদ? প্রতিশোধ নিচ্ছে মেহরিনের ওপর? এনার ডাকে ধ্যান ভাঙলো। ভেতরে ঢুকে খাটের ওপর আরাম করে বসেছে সে। মেহরিন চুপ থাকতে দেখে কৈফিয়ত দেওয়ার মতন করে বললো,’আপনি বোধহয় শুয়ে পড়েছিলেন তাই না। আসলে আরো আগেই আসার কথা ছিলো। কিন্তু বস হঠাৎ ভিডিও কল দিয়ে বসলেন তাই দেরী হয়ে গেছে।’
এতক্ষণ যাবত মাহমুদের সঙ্গে বসে থেকে তাঁর এবং ইরফান আহমেদের কথাবার্তাই শুনে এসেছে এনা। পুরোটা অবশ্য শুনতে পারে নি কথার মাঝখানে উঠে বারান্দায় চলে গেছে মাহমুদ। কিন্তু যেটুকু শুনেছে তাতে মনে হলো এখানকার কিছু স্থানীয় এজেন্টও সহযোগীতায় থাকবে তাদের। মেহরিনকে সেটা জানানোর জন্যই প্রসঙ্গটা তুলেছিলো সে। ভেবেছিলো মেহরিন জিজ্ঞেস করবে কি কথা হয়েছে ওদের মধ্যে। কিন্তু মেহরিন কোনরূপ আগ্রহ প্রকাশ করলো না। উলটো হাই তুলে বললো,’তুমি যদি কিছু মনে না করো, তাহলে আমি এখন ঘুমাতে চাই এনা। প্রচুর ঘুম পাচ্ছে আমার। এসব নিয়ে আমরা সকালে আলোচনা করবো।’ এনা মাথা দুলিয়ে সায় জানালো। শুয়ে পড়লো মেহরিন। যদিও তাঁর ঘুম আসছে না। মাথায় অন্য চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। মাহমুদের সঙ্গে আর্জেন্ট কথা বলা দরকার। আজকে সে যা করেছে সেটা সোহাগ এবং মেহরিন দুজনের জন্যই খুবই বিব্রতকর ছিলো। কড়া করে কিছু কথা শুনিয়ে দেওয়া দরকার মাহমুদকে।
অথচ সে জানে না, শুধুমাত্র তাঁর জন্যই ইরফান আহমেদের নির্দেশ অমান্য করে এনাকে এই ঘরে পাঠিয়েছে মাহমুদ। ইরফান আহমেদ বারবার করে বলে দিয়েছিলেন ‘শত্রুপক্ষের গুপ্তচর যে কোন জায়গায় থাকতে পারে। তোমরা সাবধানে থেকো। কেউ যেন বুঝতে না পারে তোমরা টুরিস্ট নও।’
.
.
.
চলবে