হৃদয়_নিবাসে_তুই #পর্ব_২৭,২৮

0
682

#হৃদয়_নিবাসে_তুই
#পর্ব_২৭,২৮
লেখনীতেঃভূমি
২৭

রক্তিম যখন গাড়ি থামাল তখন চারদিকে অন্ধকার।রাস্তার ল্যাম্পপোস্ট গুলো সবেমাত্র জ্বলে উঠছে। ক্লান্ত শরীরটার ক্লান্তিতে গাড়ি চালানোর মাঝে কখন যে চোখে ঘুম নামল বুঝেই উঠেনি অদ্রিজা।গাড়ি থামানো মাত্রই ঘুমটা ভাঙ্গল তার।সদ্য ঘুম ছাড়া ফোলা চোখ নিয়ে গোধুলীর আকাশে একনজর তাকিয়েই অদ্রিজার মুখচোখে তেঁতো চাহনি ফুটল।শরীরটা বড্ড বেশি ক্লান্ত অনুভব হলো।গাড়ির সিটেই চোখজোড়া বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়তে পারলেই যেন ডের ভালো হতো।তবুও ক্লান্ত শরীরটাকে আরো কিছুটা মানিয়ে নিয়েই গাড়ির বাইরে নজর ফেলতেই আকাশসম বিরক্তি নিয়ে কপাল কুঁচকাল।তার বাসার সামনে গাড়ি থামায়নি রক্তিম।রক্তিমের বাসার সামনে এসেই থেমেছে।চটচটে বিরক্তির ভাব স্পষ্ট ফুটিয়েই অদ্রিজা বলল,

‘ এখানে?কি হলো এটা?আমি বাসায় যাব।’

রক্তিমের ভাবলেশহীন উত্তর,

‘ বাসায় ই তো এনেছি।আশ্চর্য!’

অদ্রিজার বিরক্তি ভাবটা তড়তড় করে বাড়ল।দৃষ্টি হলো সুচালো।কপালের সাদা ধবধবে ঐটুকু চামড়ায় বেশ কয়েকটা ভাজ পড়ল মুহুর্তেই। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বেশ কয়েক সেকেন্ড গম্ভীর দৃষ্টি ফেলল রক্তিমের মুখে। ছোট্ট শ্বাস ছেড়েই বলল,

‘ সমস্যা কি আপনার?এমন করছেন কেন?’

রক্তিম পাত্তা দিল না তার বিরক্তির।তার গম্ভীর দৃষ্টিটাকে এটুকুও মূল্য না দিয়ে উপেক্ষা করল চমৎকার হাসি দিয়ে। মুখের খোঁচা দাঁড়িটায় গাড়ির ছোট আয়নায় দেখতে দেখতেই হাত বুলাল।মুখে চমৎকার হাসিটা ছাপিয়ে এবার ঠোঁট বাঁকিয়ে অদ্ভুত রকম হাসল।অদ্রিজার দিকে তাকিয়েই সে হাসিটা আরো বাঁকিয়ে গভীর নয়নে তাকাল।সেই নজরেও মুখের বাঁকানো দুষ্টু হাসির ঝলক স্পষ্ট।ভ্রু নাচিয়েই বলে বসল,

‘ কেমন করছি অদ্রি?ওফফস!অদ্রিজা!’

অদ্রিজা ভেতরে থাকা জ্বলন্ত রাগটা দেখাতে চেয়েও থেমে গেল।শরীর বড্ড্ ক্লান্ত।এই লোকটার সাথে কথা বলে বেশ একটা লাভ হবে বলেও মনে হলো না তার। ক্লান্ত ভারী শরীরটা নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়েই রাস্তার একপাশে গিয়ে বুকে হাত গুঁজে দাঁড়াল।চোখজোড়া ঘুমে হেলদোল করলেও জোর করে মেলে রাখল চোখজোড়া।বিচক্ষন চাহনি ফেলে কিছুটা সামনে খালি রিক্সা দেখেই ডাকতে যাবে ঠিক তখনই পেছন থেকে কেউ মুখ চেপে ধরল।অদ্রিজা চমকাল না।মানুষটা কে হতে পারে তা বুঝে উঠেই ক্ষোভে বিষিয়ে গেল ছোট্ট মন।মস্তিষ্কের নিউরনে নিউরনে তখন রাগ, ক্ষোভ টনটনে করছে।নিজের হাতজোড়া দিয়ে রক্তিমের হাতটা ছাড়ানোর চেষ্টা করেই ক্লান্ত দেহটা আরো ক্লান্ত হলো।ভারী লতানো রূপময় শরীরটা এবার এলিয়ে এল।চোখজোড়া হালকা মিনমিনে করেই রক্তিমের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকানো মাত্রই রক্তিম ছেড়ে দিল মুখটা।ঠোঁট টিপে মুচকি হেসেই বলে উঠল,

‘ আপনার বিশ্রামের প্রয়োজন অদ্রিজা।চলুন ঘুমোবেন।’

অদ্রিজা ঘুমুঘুমো চোখ নিয়ে তাকিয়ে রইল রক্তিমের দিকে।হাই তুলেই বুকে হাত গুঁজে আগের মতোই দাঁড়াল।শক্ত গলায় বলল,

‘বাসায় গিয়ে ঘুমাব।’

‘ তো আমি কি আপনাকে রাস্তায় ঘুমিয়ে পড়তে বলছি অদ্রিজা?চলুন বলছি।ঘুমোবেন। ‘

অদ্রিজা দাঁতে দাঁত চেপেই বলল,

‘ আমার বাসা!আই মিন আম্মুদের বাসা।আপনার বাসায় নয়।গট ইট?’

রক্তিম কপাল প্রসারিত করে ঠোঁট চওড়া করল। আঙ্গুল দিয়ে ভ্রু চুলকাতে চুলকাতেই বলে উঠল,

‘ইট’স মাই হোম।এন্ড ইউ আর মাই ওয়াইফ।সো কারেন্টলি,মাই হাউজ ইজ ইউর’স হাউজ।রাইট?’

অদ্রিজা তেঁতো চাহনি ফুটাল মুখে।রক্তিমের সাথে আর একটাও কথা না বলে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সেখানে। কত সহজেই ওয়াইফ ক্ষেতাব দিয়ে দিয়েছে তাকে। অথচ দুইদিন আগেও এই নিয়ে কত দ্বিধা ছিল লোকটার।কেবলই পরিচিত ছিল সে।কাউকে নিজের ওয়াইফ বলে পরিচয় না দিয়ে কেবল পরিচিত কেউ বলে পরিচয় দিয়েছে।আর এখন?অদ্রিজা তাচ্ছিল্য নিয়ে হাসল।রক্তিমের দিকে তাকিয়েই বলল,

‘ হঠাৎ এই পরিবর্তন আপনার মিঃ রক্তিম?এতটা দায়িত্ব, এতটা কর্তব্য, অবাক হওয়ার মতো না?আ’ম রিয়েলি শকড!’

রক্তিম বাঁকা হাসল।চুল গুলোতে হাত বুলিয়েই বলে উঠল,

‘ ধরে নিন এর পেঁছনে বিশাল এক কারণ আছে।এখন বলুন যাবেন কি যাবেন না?সুইটহার্ট অপেক্ষা করছে আপনার জন্য।’

অদ্রিজা মুখ ফুলিয়ে রক্তিমের দিকে তাকাল।শক্ত গলায় জেদ ধরে বলল,

‘ যাব না।আপনার আশেপাশে তে দূর, আপনার থেকে কিলো কিলো পথ দূরে ও থাকব না।’

‘ ফালতু জেদ ধরছেন আপনি অদ্রিজা।তখন যেভাবে জোর করে গাড়িতে উঠিয়েছি সেই স্টেপ নিতে হবে? তো সোজাসুজিই বলতে পারেন।এত বাহানা দেখাচ্ছেন কেন আমার কাছাকাছি আসার জন্য?আপনি আমাকে চান সেটা আমিও জানি আপনিও জানেন।ফালতু জেদ দেখাচ্ছেন! ‘

অদ্রিজা চোখ বড়বড় করেই চরম রাগল।ফোঁসফাঁস করেই বলে উঠল,

‘ জাস্ট এ্যা ইরিটেটিং ম্যান!আজগুবি কথা একদমই বলবেন না রক্তিম।কোন বাহানা দেখাচ্ছি না আমি।আপনার বাসায় জীবনেও আর প্রবেশ করব না আমি।’

রক্তিম বাঁকা হাসল। আকস্মিক দুই হাত দিয়ে অদ্রিজার কোমড় চেপে ধরল।কপালে কপাল ঠেঁকিয়েই বাঁকা হেসে বলল,

‘ যদি করেন?তবে?’

‘ প্রবেশ করব না যখন বলেছি তখন করব না।এটাই শেষ কথা!’

রক্তিম কপাল সরিয়ে চোখ টিপল।বাঁকা হাসিটা আগের মতোই চোখেমুখে ঝলকিয়ে বলল,

‘ আর যদি একবার প্রবেশ করেই ফেলেন তাহলে?তাহলে কিন্তু আর বের হতে পারবেন না অদ্রিজা।দরকার পড়লে পা ভে*ঙ্গে বসিয়ে রাখব বাসায়!’

অদ্রিজা অবাক হলো।বিস্ময় নিয়ে চোখ বড়বড় করে রক্তিমের দিকে তাকাল।রক্তিমের চোখেমুখে কৌতুক মাখা গা জ্বালানো হাসি।ফুস করে বড়সড় নিঃশ্বাস ফেলেই বিরক্তি নিয়ে বলল সে,

‘ যাব না।আপনি এখান থেকে গেলে ভালো লাগবে।প্লিজ আপনার বাসায় যান।’

রক্তিম এত সহজেই ছেড়ে দিল না।অদ্রিজার সোজাসাপ্টা কথায় সহজ সরল মানুষের মতো মাথা দুলিয়ে রাজি ও হলো না।বরং চোখে মুখে তীব্র বিদ্বেষ নিয়ে জিজ্ঞেস করল,

‘ যাবেন কি যাবেন না?লাস্টবার বলছি!’

অদ্রিজা মুখ ফুলিয়ে বিরক্তি নিয়ে বলে উঠলো,

‘ কানে শুনেন না নাকি রক্তিম?যাব না।’

ব্যাস!অদ্রিজার ঐ কথাটা শেষ করল কি না করল অপেক্ষা করল না রক্তিম। ঠিক আগের পন্থা ব্যবহার করেই আকস্মিক কোলে তুলে নিল অদ্রিজাকে।চোখেমুখে স্পষ্ট রাগ নিয়েই অদ্রিজার কোমড় চেপে নিজের বুকে মিশিয়ে নিল।অদ্রিজা অবাক হয়েই চেয়ে রইল। রক্তিমের চোখেমুখের রাগটা দেখেই শিউরে উঠল এবার।নিজের কোমল , লতিয়ে যাওয়া শরীরটা রক্তিমের বাহুডোরে রক্তিমের শরীরের সাথেই লেপ্টে আছে ভেবেই অস্বস্তিতে ভারী হয়ে উঠল মুখচোখ।নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা বিশেষ করা গেল না।দুই হাত দিয়ে বেশ শক্তভাবেই চেপে ধরে রেখেছে রক্তিম।অদ্রিজা ছাড়ানোর চেষ্টা চালাতে নিলেও নিজের সাথে একেবারে লেপ্টে মিশিয়ে নিল অদ্রিজার শরীর।দাঁতে দাঁত চেপে শক্ত গলায় বলল,

‘ চেয়েছিলেন তো এমন কিছু হোক।খুশি না হয়ে ছটফট করছেন কেন হুহ?’

‘ আমি মোটেই এমন কিছু চাইনি।’

রক্তিমের রাগে টানটান মুখে এবার হাসি ফুটল। অদ্রিজার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল,

‘ উহ!বুঝি তো আমি।’

অদ্রিজা বিরক্ত হলো।অস্বস্তিতে শরীরটা ঘেমে উঠল মুহুর্তেই।রক্তিমের বুকের সাথে মাথাটা লেপ্টে থাকায় স্পষ্ট শোনা গেল রক্তিমের বুকের ধুকফুক করা শব্দ।চোখ ছোট করে রক্তিমের দিকে চেয়ে থাকতেই রক্তিম পা এগিয়ে গেইটের ভেতর ডুকল।সিঁড়ি বেয়ে দোতালায় এসেই বাসার সামনে নামিয়ে দিল অদ্রিজাকে।কলিংবেল বাঁজিয়েই অদ্রিজার কানে ফিসফিসিয়ে বলল,

‘ বাসায় ডুকলে কিন্তু আর বের হতে পারবেন না।রেহাই পাবেন না। মনে করিযে দিলাম জাস্ট। ‘

অদ্রিজা রাগে ফোঁসফাঁস করে তাকিয়ে কিছু বলতে যাবে ঠিক তখনই সুইটহার্ট দরজা খুলল।মাথার সাদা চুলগুলো আজ ছেড়ে দেওয়া।পরনের সাদা শাড়িটা আজ ভিন্ন নিয়মে যুবতীদের মতো পরা।কানের কাছে একটা শুভ্র সাদা গন্ধরাজ ও গাঁথা।সাদা কুচকানো চামড়ার মিষ্টি চেহারায় সেই শুভ্র ফুলটা চমৎকার রকম মিষ্টতা যোগ করল।অদ্রিজা মিষ্টি হাসল সুইটহার্টের ভিন্ন মিষ্টি সাঁজ পর্যবেক্ষন করেই।ঠোঁট টেনে হেসেই বলে উঠল ,

‘ কেমন আছো সুইটহার্ট?’

সুইটহার্ট মিষ্টি ভাবে হাসল।অদ্রিজার গাল টেনেই বলল,

‘ একদম ভালো।তুমি?’

‘ আমিও ভালো।অনেকদিন পর দেখা তোমার সাথে।ভেবেছিলাম আর কোনদিন দেখাই হবে না তোমার সাথে।’

সুইটহার্ট হেসে বলল,

‘ ভেতরে আসো।ফ্রেস হয়ে বিশ্রাম নাও কিছুটা সময়।কিছুক্ষন পর কিন্তু আর বিশ্রাম নেওয়া যাবে না বলে দিলাম।’

অদ্রিজা অবাক হলো।বিশ্রাম নেওয়া যাবে না মানে?কেন যাবে না বিশ্রাম নেওয়া?বুঝে উঠল না।পা ফেলে বাসায় ডুকতে যাবে ঠিক তখনই সেখানে হুড়মুড় করে এসে উপস্থিত হলো দিহান।মুখেচোখের চরম ক্লান্তি নিয়েই পায়ের জুতোজোড়া খুলতে খুলতেই ব্যস্ত হয়ে বলে উঠল সুইটহার্টের উদ্দেশ্যে,

‘ দাদিমা?লেট হয়ে গেল বুঝি?টিউশনিটা শেষ করতেই দেরি হয়ে গেল। ‘

সুইটহার্ট চমৎকার হাসল।দিহানের দেরি হওয়ার জন্য তিনি কিছু না বললেও অদ্রিজা চোখমুখ কুচকে বলে উঠল,

‘ দিহান তুমি?এখানে?কিসের লেট হবে?বুঝলাম না।’

দিহান হাতের ঘড়ির দিকে তাকাল।হালকা হেসেই বলল,

‘ দেরি হয়নি বলছো?’

‘ আমি কি করে জানি তা।কিন্তু তুমি এখানে?কেন?’

দিহান নিরাশ হলো।চোখে মুখে হতাশ হওয়া ভাব করে শান্ত কন্ঠে বলল,

‘ এইখানে আজ আমার আসাটা কি খুব অনুচিত নাকি দ্রিজা?তুমি বলতে চাইছো আমার আসা উচিত হয় নি। তাই তো?’

অদ্রিজা কিছুই বুঝল না দিহানের বলা কথাগুলোর।বোকার মতো ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকার মাঝেই রক্তিম আর দিহান ভেতরে ডুকে গেল।সে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকল।সুইটহার্ট তাকে ভেতরে ডুকিয়েই এগিয়ে নিল নেহার কাছে। নেহাকে দেখেই আরেক ধাপ অবাক হলো অদ্রিজা।নেহার শরীরেও সাদা শাড়ী।তারও চুলগুলো ছেড়ে দেওয়া।কানের পেছনে তারও সাদা গন্ধরাজ গোঁজা।অদ্রিজা বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইল।নেহার ছোট্ট শরীরে এই সাঁজটা ভীষণ মানিয়েছে। মুচকি হেসে দুইজনের এই একই সাঁজের মানে খুঁজতে লাগল অদ্রিজা।সেই খোঁজাখুঁজির মাঝেই নেহা আরো একটা সাদা শাড়ি নিয়ে এগিয়ে এল।মুচকি হেসেই বলল,

‘ এই, ঘুমোবি এখন? ঘুমোলে ঘুমিয়ে নে তাড়াতাড়ি।তোকে শাড়ি পরিয়ে রেডি করাতে হবে আবার।তাড়াতাড়ি কর।’

অদ্রিজা ড্যাবড্যাব করেই চেয়ে রইল।তখনই পেছন থেকে অত্রিয়া বলল,

‘ উহ আপু।একটু বসে বিশ্রাম নে তো।ঘুমোলে রাত কাবার হয়ে যাবে তোর।’

অদ্রিজা আরেক ধাপ অবাক হলো।অত্রিয়া যে এখানে তা তো জানা ছিল না তার।এখানে কেন সে?ঘাড় ঘুরিয়ে পেঁছন ফিরে অত্রিয়াকে দেখতেই চমকে উঠল সে।তার থেকে চমৎকার রূপবতী মেয়েটার সাদা ধবধবে শরীরেও সাদা শাড়ি।ঠিক একই সাঁজ!অদ্ভুত তো!এরা কি আজ সাদায় সাদায় শুভ্রতা ছড়িয়ে দেওয়ার প্ল্যান করেছে নাকি?

#চলবে….

#হৃদয়_নিবাসে_তুই
#পর্ব_২৮
লেখনীতেঃ ভূমি

‘ কনগ্রেচুলেশন মিসেস রক্তিম মাহমুদ ফর ইউর থার্ড মান্থ’স অফ প্র্যাগনেন্সি।’

অদ্রিজা থমকাল রক্তিমের শান্ত কন্ঠে কথাগুলো শুনে।নেহার জোরাজুরিতে সে ও সেঁজেছে।তবে এই সাঁজের কোন নির্দিষ্টি কারণ না পেয়েই এতক্ষন চুপ ছিল।হঠাৎ ঐ তাকে ছাদে আনা হলো।অদ্রিজা কোনকিছুরই কারণ খুঁজে পেল না।শান্ত গম্ভীর চাহনি ফেলে প্রসস্ত ছাদটার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল কেবল।বেশ সুন্দর সাঁজানো হয়েছে।ছাদের মাঝখানটায় ইয়া বড় টেবিল।টেবিলের উপরই বড়সড় কেক রাখা।ছাদের ঠিক সেই জায়গাটায় বেলুন দিয়ে চমৎকার সাঁজানো।ছাদের বাকি চারপাশ কাঁচা ফুল দিয়ে সাঁজানো।কাঁচা ফুলের সুভাস মৌ মৌ করতেই ছাদে উপস্থিত হলো মিষ্টি মিষ্টি পিচ্চি পাখিগুলো।পিচ্চি ছেলেমেয়ে গুলোর দিকে মুগ্ধ চাহনিতে তাকাতেই আকস্মিক সামনে আসল রক্তিম।তার একটা হাত টেনে ধরেই শান্ত শীতল গলায় কথাগুলো বলল রক্তিম।অদ্রিজা বিস্ময় নিয়ে রক্তিমের দিকে তাকাল।নিজের হাতটা এক টানে ছাড়িয়ে নিয়েই কিছুটা দূরে সরে দাঁড়াল।মুখেচোখে চাপা অনিভূতি নিয়ে চারপাশ ফিরে চাইল।সুইটহার্ট,নেহা,অত্রিয়া, দিহান, রায়মান সহ পিচ্চি পিচ্চি ছেলেমেয়ে গুলোর মুখে মিষ্টি হাসি।হাসিগুলো নজর ফেলে ভালোভাবে দেখতে দেখতেই চোখজোড়া গিয়ে স্থির হলো সেই মানুষগুলোরই পাশে থাকা আরেকজন মানুষের উপর।তার মা!এখানে?প্রথম দফায় বিশ্বাস না করলেও নিজের চোখকে অবিশ্বাস করার কারণ খুঁজে পেল না সে।বিস্ময় নিয়ে সেদিক পানে তাকিয়ে থাকার মাঝেই রক্তিম আবার ও তার হাতটা ধরল। পকেট থেকে একটা রিং বের করেই আঙ্গুলে পরিয়ে দিতে দিতেই ফিসফিসিয়ে বলল,

‘ হাত ছাড়িয়ে নিলেন কেন?আপনার হাত সত্যি সত্যি ভেঙ্গে ফেলব ভেবেছেন?’

অদ্রিজা বিরক্তি নিয়ে তাকাল।হাতটা পুনরায় ছাড়িয়ে নিয়ে ঝাঁঝাল দৃষ্টিতে তাকাল।অনামিকা আঙ্গুল থেকে রিংটা খুলে নিয়েই রক্তিমের হাতের মুঠোয় ধরিয়ে দিল।তীব্র রাগ আর ক্ষোভে মুখচোখ লাল করেই বলে উঠল,

‘ আপনার দেওয়া কোনকিছুই পরব না আমি।রিংটা আপনার কাছেই রাখুন।আপনার দেওয়া পায়েলটাও অনেক আগেই খুলে রেখে দিয়েছি।আপনাকে দিয়ে দিব।’

রক্তিমের হাসিমাখা মুখের চাহনির বদল ঘটল এবার।ফর্সা ধবধবে নাক, মুখ লাল হলো।চোয়াল শক্ত হয়ে এল যেন।হাঁটু গেঁড়ে বসেই অবিশ্বাসের সাথে অদ্রিজার শাড়ি সরিয়ে পায়ের পায়েলটা যে নেই তা নিশ্চিত হলো।সঙ্গে সঙ্গেই রাগটা শতগুণ বাড়ল।অদ্রিজার থেকে কিছুটা দূরে সরে এসেই ছাদের রেলিংটায় জোরেসোরে এক ঘুষি বসাল।ক্ষ্রিপ্ত চাহনিতে অদ্রিজার দিকে তাকিয়েই দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

‘ ভালো করলেন না এটা!একদমই ভালো করলেন না অদ্রিজা।’

অদ্রিজা তাচ্ছিল্য নিয়ে হাসল।বুকে হাত জোড়া ভাজ করে দাঁড়িয়েই নেহাদের কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়াল।ক্লান্ত কন্ঠে বলে উঠল,

‘ আমি সত্যিই অনেক ক্লান্ত নেহা।অত্রি চল, বাড়ি যাব।সুইটহার্ট?এবার বাড়ি যাই?প্লিজ!’

সুইটহার্ট মিনমিনে চোখে তাকাল। অসহায় মুখ করে একবার রক্তিম তো একবার অদ্রিজার দিকে তাকাল।কত আশা, কত স্বপ্ন নিয়ে সবাই মিলে এই সারপ্রাইজ প্ল্যান করল।শেষ পর্যন্ত সারপ্রাইজটার যে বারোটা বেঁজে গিয়েছে তা রক্তিমের মুখচোখ দেখে বুঝতে আর বাকি রইল না তার।হতাশ চাহনি ফেলেই বলে উঠলেন তিনি,

‘ যাবে?যাবে মানে?এবার থেকে তুমি এখানেই,আমার সাথেই থাকবে।একা একা আর কত বাঁচা যায় শুনি?জান তো আগে বলেইনি আমার একটা সতীন আছে।নয়তো অনেক আগ থেকেই সতীন নিয়ে সংসার করা শুরু করে দিতাম।সবটা জানের দোষ!’

অদ্রিজা ম্লান হাসল।নরম কন্ঠে বলল,

‘ সুইটহার্ট?তুমি চিন্তামুক্ত থাকো।তোমার সুখের সংসারে কোন সতীন আসবে না।সতীন নিয়ে জ্বালাময় সংসার ও করতে হবে না তোমায়।তোমার জানের সাথে আমার ডিভোর্স হয়ে যাবে কয়েক মাস পর।’

অদ্রিজার অপ্রত্যাশিত কথাটাতেই রাগটা এবার ফুলেফেঁপে উঠল রক্তিমের।চোখেমুখে এক ভয়ংকর চাহনি।কপালের রগটা ইতমধ্যেই ফুলে উঠেছে। লাল রক্তিম চেখজোড়া নিয়ে একনজর অদ্রিজার দিকে তাকিয়েই হনহনিয়ে এগিয়ে এল সুইটহার্টের কাছে।গম্ভীর তীক্ষ্ণ গলায় স্পষ্টভাবে বলে বসল,

‘ সুইটহার্ট, এখানে কিছু হবে না আর।সবার খাওয়ার ব্যবস্থা করো গিয়ে।আমার জন্য এক মগ কফি পাঠিয়ে দিও।খাব না আমি।আর হ্যাঁ,অদ্রিজা?’

অদ্রিজা মাথা তুলে চাইল।রক্তিমের লাল রক্তিম চোখজোড়ার দিকে তাকিয়েই মুহুর্তে শিউরে উঠল।গম্ভীর চোখমুখে তাকিয়ে থাকার মাঝেই রক্তিম বলল,

‘ আপনি এই বাসাতেই থাকবেন।বের হবেন তো পা কেঁটে রেখে দিব বলে দিলাম।মাইন্ড ইট!আমাকে এর থেকে বেশি রাগালে ফল ভালো হবে না বলে দিলাম।’

অদ্রিজার স্পষ্ট জবাব,

‘ কি করবেন?মেরে ফেলবেন?আপনার কাছে থেকে যেটুকু নিশ্চয়তা থাকবে তার থেকে একটা উম্মাদের সাথে থাকলেও বেশি নিশ্চয়তা থাকবে রক্তিম।কি কথার ধরণ!ছিঃ!’

রক্তিম ভ্রু কুঁচকাল।অদ্রিজার মুখের দিকে কিছুটা ঝুকতেই চুলগুলো ঝুকে পড়ল কপালে।অদ্রিজার হাতজোড়া খামচে ধরেই ক্ষোভ নিয়ে বলে উঠল,

‘যদি নিশ্চয়তা নাও থাকে, তবুও আপনাকে আমার সাথেই থাকতে হবে।মানলে ভালো।না মানলে সেটা আপনার বিষয়।আমার মুডটাই নষ্ট করে দিয়েছেন আপনি।ডিসগাস্টিং!’

কথাগুলো বলেই অদ্রিজার হাতজোড়া ছেড়ে দিয়ে চলে গেল রক্তিম।চোখেমুখের সেই তীব্র রাগের আকস্মিক আক্রমনে শিউরে উঠল অদ্রিজার মন প্রাণ।একটু বেশিই কি করে ফেলেছে রক্তিমের সাথে?মস্তিষ্ক বলল, না!আত্নসম্মান নিয়ে এটুকু করা অন্যায় নয়।রক্তিমই তো বলেছিল তার আত্মসম্মান নেই, বেহায়া।তবে? আজ কেন আত্মসম্মান দেখাতে না দেখাতেই রাগে থিতিয়ে গেল তার চোখ মুখ?

.

এই বাসা থেকে শত জোরাজুরির পরও যাওয়া হয়ে উঠে নি অদ্রিজার।রাত এখন অনেক।এত রাতে বাসায় একা ফেরা যেমন তার পক্ষে সম্ভব নয় তেমনই এই বাসায় থাকাটাও তার জন্য উচিত নয়।অত্রিয়া আর তার মা জোর করেই রেখে গেল এখানে।তার চাওয়ার কি কোন গুরুত্ব নেই?অদ্রিজা ভেবে পেল না।মনটা হঠাৎ ভীষণ খারাপ বোধ হলো।যুবতী মন হঠাৎ ঐ কিশোরী মনের মতো রাগ, অভিমানে জড়োসড়ো হলো।কান্না আটকানো কষ্টে ছটফট করল।তার বোন, তার বান্ধবী করতে পারল এমনটা?বাসায় পৌঁছে দিলে কি খুব বেশি ক্ষতি হয়ে তাদের?অদ্রিজা ভাবল!ভীষণভাবে ভাবল।মুখচোখ কালো করল।দমবন্ধকর কষ্টে কান্না আটকাল।ঠিক তখনই দরজায় কড়াঘাত পরল।অদ্রিজা ঘাড় ঘুরিয়ে চাইল দরজার দিকে।এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিতেই চোখে পড়ল রক্তিমের ভেজা মুখ। চোখজোড়া এখনও আগের মতোই লাল টকটকে।কপালে ভাজ।মাথার কালো চুলগুলো ভেজা।মুখের খোঁচা খোঁচা ছোট দাঁড়িগুলোতেও জলের ছিটেফুটে।অদ্রিজা একনজর চেয়েই গম্ভীর কন্ঠে শুধাল,

‘ কি সমস্যা?এত রাতে আমার রুমের দরজায় নক করছেন কেন?আশ্চর্য!ঘুমের মধ্যে বিরক্ত করবেন না।’

রক্তিম ম্লান হাসল। ভেজা চুলগুলো হাত দিয়ে পেছনে ঠেলে দিয়ে লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।ঠোঁট চেপে বলল,

‘ এটা আমার রুম।আপনার রুম হলো কবে থেকে?’

অদ্রিজা নড়েচড়ে দৃষ্টি ফেলল রুমে।হবে হয়তো রক্তিমের রুম।এভাবে হুট করে নিজের রুম বলে দেওয়া উচিত হয়নি তার।কাঁপা গলায় বলল সে,

‘ সুইটহার্ট বলেছে এটা আমার রুম।জিজ্ঞেস করুন গিয়ে?’

‘ জিজ্ঞেস করার দরকার নেই।বিশ্বাস করি আপনাকে।’

‘ কিন্তু আমি আপনাকে বিশ্বাস করি না।এটা যে আপনার রুম তার কি প্রমাণ আছে?বলুন।’

রক্তিম ক্লান্ত চাহনিতে তাকাল।বুকে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে চোখ দিয়ে ইশারা করল পেঁছনে তাকাতে।সঙ্গে সঙ্গে অদ্রিজা পেঁছন ফিরে চাইল।খাটের পাশেই টেবিলটার উপর রাখা ছবিটার ফ্রেমের ভেতর সুইটহার্ট আর রক্তিমের হাস্যোজ্জ্বল চেহারা।রক্তিম তখন অল্প বয়সী তরুণ বোধ হয়।হ্যাংলা,পাতলা শরীর।পরনে একটা টিশার্ট।ট্যারাব্যাকা দাঁত কেলানো সেই হাসিটা মুখে।পাশেই সুইটহার্টের মিষ্টিমুখ!অদ্রিজা হতাশ হয়ে ছবিটা খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষন করল।রক্তিমের দিকে চোখ ছোট ছোট করে তাকাতেই রক্তিম ক্লান্তি নিয়ে বলল,

‘ প্রমাণ পেয়েছেন?আমি ক্লান্ত।আপনি হয়তো আমার থেকে বেশি ক্লান্ত, তবে আমার এই মুহুর্তে ঘুমের প্রয়োজন। প্লিজ সাইড!’

অদ্রিজা সরল।চাপা কন্ঠে বলল,

‘ তাহলে আমি?আমি কোথায় ঘুমাব?আমারও ঘুম পাচ্ছে।’

রক্তিম ভ্রু কুঁচকাল।অদ্রিজার দিকে তাকিয়েই বিরক্তিসহিত বলে উঠল,

‘ প্রথমত আপনি আমার মুডটাই চেঞ্জ করে দিয়েছেন।দ্বিতীয়ত বাচ্চাদের সাথে কেক মাখামাখি, হৈচৈ করে ক্লান্ত আমি।ঐসব কিছু আপনার জন্যই এরেঞ্জ করা হয়েছিল, আপনি তা ভেস্তে দিলেন। সমস্যা নেই।আমার পিচ্চিরা অলটাইম থাকে আমাকে খুশি রাখার জন্য।তাদের সাথে এতক্ষন সময় কাঁটিয়ে এখন বোধ হয় আমার ঘুম প্রয়োজন তাই না?আপনি প্লিজ এখন নতুন নাটক শুরু করবেন না অদ্রিজা।’

অদ্রিজা তৎক্ষনাৎ রাগল।রাগে চোখমুখ আগুন করেই ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল,

‘ নাটক?এটাকে আপনার নাটক মনে হচ্ছে রক্তিম?এটার মতো সিরিয়াস ইস্যু আর হতে পারে?আমি আপনার সাথে এক রুমে কেন থাকব?আশ্চর্য!’

রক্তিম মাথা চেপে ধরল।দাঁতে দাঁত চেপেই বলল,

‘ স্টুপিড!আপনি আমার সাথে এক রুমে থাকেন নি?কি হলো? থাকেন নি?বলুন।’

অদ্রিজা স্পষ্ট জবাব দিল,

‘ থেকেছি, তখন তো সেই চুক্তি অনুযায়ী থাকতে বাধ্য হয়েছিলাম।এইছাড়া কিছুই নয়।এখন তো সেই চুক্তির দায়বদ্ধতা নেই!আপনিই সেই দায়বদ্ধতা থেকে আমায় রেহাই দিয়েছেন। ‘

রক্তিম কঠিন চাহনিতে তাকাল।শক্ত গলায় বলল,

‘ শুধুমাত্র দায়বদ্ধতা?আরো কিছু ছিল তো!সেসবের সমাপ্তি ঘটিয়ে দিয়েছেন?আসলেই ভালোবাসা বলে কিছু হয় না।আমি ঠিক ছিলাম।’

অদ্রিজা স্পষ্ট গলায় বলল,

‘ ঠিক। ভালোবাসা বলে কিছুই নেই। সবটা বাহ্যিক!’

রক্তিম ঠোঁট টিপে হাসল অদ্রিজার কথা শুনে।মাথার চুলগুলো হাত দিয়ে হালকা ঝাড়া দিয়েই বলে উঠল,

‘ভালোবাসা আপাদত বাদ।চুপচাপ ভালো মেয়ের মতো আমার পাশে এসে ঘুমিয়ে পড়বেন।অনেক রাত হয়েছে।সুইটহার্ট বোধ হয় জেগে নেই।আর অন্য রুমগুলোও পরিষ্কার নেই। সো এইখানেই ঘুমোতে হবে।’

অদ্রিজা শক্ত কন্ঠেই বলল,

‘ ঘুমাব না।’

রক্তিম কড়া চাহনিতে তাকাল। কপাল কুঁচকেই বিরক্তি নিয়ে বলল,

‘ কেন?কি সমস্যা?’

অদ্রিজা অস্ফুট স্বরে বলল,

‘ ঐ যে আত্নসম্মান।আপনিই তো বলেছিলেন বেহায়ার মতো আপনার পেছনে পড়ে আছি।’

রক্তিমের চোয়াল শক্ত হয়ে এল।অদ্রিজার দিকে তাকিয়েই ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলল,

‘ ভুলগুলো কি আমার ছিল আদৌ অদ্রিজা?সৃষ্টিকর্তা ইচ্ছে করেই ভুলগুলো আমার উপর চাপিয়ে দিয়েছেন। আর সেই মিথ্যে ভুলের শাস্তিটাও আমায় পেতে হচ্ছে।আপনি খাটে ঘুমোন। আমি সোফায় ম্যানেজ করে নিব।’

#চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here