#হৃদয়_নিবাসে_তুই
#পর্ব_৩৭,৩৮ শেষ
লেখনীতেঃ ভূমি
৩৭
দিহানের হাতটা একহাত দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরেই আরেক হাত দিয়ে পেট চেপে ধরল অদ্রিজা।কম্পনরত চাহনি নিয়ে চাতক পাখির মতো মাঠের আশেপাশে তাকাল বার কয়েক।কোন পরিচিত মুখ ভেসে উঠল না।নেহাও বোধ হয় আজ ভার্সিটিতে আসে নি।পেটের অসম্ভব ব্যাথায় বাধ্য হয়ে দিহান নামক যুবকটিরই সাহায্য নিতে হলো।যে যুবকটিকে সে ভালোবাসার সুযোগ দিবে বলেও দেয়নি, ঠকিয়েছিল, সেই যুবকটির হাতই শক্ত করে চেপে ধরল নিঃসন্দেহে।এক ঝুড়ি ভরসা, আশ্বাস নিয়েই দিহানের ঘাম জড়ানো মুখের দিকে চাইল অদ্রিজা।তলপেটটা হাত দিয়ে খামচে ধরেই অস্পষ্ট কন্ঠে বলল,
‘ দি্ দিহান?নেহাকে একটু বলবে আসতে?প্লিজ!কল করো না একটু ওকে।’
দিহান বোকার মতো চাইল।অদ্রিজার অসুস্থতা দেখেই ভড়কে গেল।মাথা ফাঁকা লাগল কয়েক মুহুর্ত।কি করবে, কি বলবে বুঝে না উঠেই শূণ্যের দিকে তাকিয়ে জোরে জোরে শ্বাস ফেলল সে।কপাল চেপে ধরে পকেট থেকে মোবাইলটা বের করতে করতেই অদ্রিজাকে বলে উঠল,
‘ দ্রিজা?এখানে অনেক রোদ।বসবে একটু কোথাও।হয়তো ভালো লাগবে।এমন রোদে দাঁড়িয়ে থাকলে তো শরীর আরও খারাপ হবে।’
অদ্রিজা মিনমিনে চোখে চাইল। কিছু না বলেই ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলে দিহানের হাতটা ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল।কিন্তু পারল না।ব্যাথায় বিষিয়ে উঠল পুরো শরীর। প্র্যাগন্যান্সির চার মাসের মাঝেই এই ব্যাথার কোন উৎস খুঁজে না পেয়েই শরীর কেঁপে উঠল তার।হাত পায়ের শিরায় টান পড়ল যেন।দুই হাত দিয়ে তলপেটটা চেপে ধরেই টলমল করা চোখজোড়া বন্ধ করে নিল অদ্রিজা।সঙ্গে সঙ্গেই নরম গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল নোনতা পানি।দিহান ছোটছোট চোখে অদ্রিজার গাল বেয়ে নোনতা পানি গড়ানো, অস্থিরতা, অস্বাভাবিক ব্যাথায় মুখ চোখ নীল হওয়া সবটাই পর্যবেক্ষন করল।নেহাকে কল করে দ্রুত আসতে বলেই কল কাঁটল।এক দৈাড়ে ভার্সিটির সামনে থাকা টং দোকানটা থেকে একটা পানির বোতল নিয়েই আবারও দৈাড়ে এসে দাঁড়াল অদ্রিজার সামনেই।পানির বোতলটা এগিয়ে দিয়েই কপালের ঘাম।মুঁছতে মুঁছতে বলে উঠল,
‘ অল্প পানি খেয়ে মুখে পানির ছিটে দাও তো। হয়তো ভালো লাগবে।হঠাৎ এমন ব্যাথা হচ্ছে কেন?কিছুই তো বুঝতে পারছি না।’
অদ্রিজা মাথা তুলে ঝাপসা চোখে দিহানের দিকে তাকাল।চোখের ঘন পাঁপড়ি গুলো ভিজে উঠল মুহুর্তেই।শূণ্য, সাদা, অনুভূতীহীন মুখটা ব্যাথায় ক্রমশ নীলাভ হয়ে উঠল যেন।দাঁতে দাঁত চেপেই কোনভাবে বলে উঠল সে,
‘ দে্ দেওয়ালের সাথে ধাক্কা খেয়েছিলাম সিঁড়ি দিয়ে নামার সময়।পেটের দিকে ধাক্কাটা একটু জোরেই লেগেছিল। তাই..’
অদ্রিজার বাকি কথাটা শেষ হলো না।ব্যাথায় বিষিয়ে উঠল মন প্রাণ।দাঁতে দাঁত কাঁমড়ে কান্না হজম করার সহস্র চেষ্টা করতে করতেই সামনে উপস্থিত হলো বিশালদেহী, লম্বা চওড়া শরীরের রক্তিম নামক যুবকটি।মুখ চোখ গম্ভীর তার।দৃষ্টি অত্যাধিক শান্ত!জমে থাকা গলাটা হালকা ঝেড়েই কোলে তুলে নিল অদ্রিজাকে।ঠোঁট চেপে শীতল গলায় বলে উঠল,
‘ চলাফেরাতে একটু হুশ রাখলে ক্ষতি কি হয়?আপনি তো এখন একা নন।এটা কেন মনে থাকল না আপনার?এত তাড়াহুড়ো করে চলার কি ছিল?’
অদ্রিজা কিছু বলল না।রক্তিমের শার্টটা মুঠো করে খামচে ধরল।অন্য দিনের মতো নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা চালাল না আজ।হাত পা জমে উঠল ক্রমশ।ভারী শরীরটার নিয়ন্ত্রন যেন নিজের উপর আর রাখা গেল না।রক্তিমের বাহুডোরে নিজের পুরো শরীরের ভার এলিয়ে পড়ল মুহুর্তেই।চোখজোড়া বুঝে নিতে নিতেই অস্ফুট গলায় বলে উঠল সে,
‘ আ্ আমায় কোলে তুললেন কোন সাহসে?আমি যেতে পারব।’
রক্তিম এবার গম্ভীর মুখ চাহনিতেও হাসি ফুটাল।ঠোঁট চওড়া করে হেসেই দিহানকে ধন্যবাদ জানিয়ে পা বাড়াল। গাড়ির সিটে অদ্রিজাকে আলতো করে বসিয়ে দিয়েই বাঁকা হেসে বলে উঠল,
‘ এই না হলে রক্তিমের ওয়াইফ? মরে যাবে তবুও রক্তিমের মতোই জেদ নিয়ে বসে থাকবে।আহহ!আপনার রাগ জেদ এসব দেখেই তো ফিদা হয়ো যাই।আর ফিদা হতে চাই না।চুপচাপ বসে থাকবেন।ব্যস!’
অদ্রিজা কিছু বলল না।বলার জন্য গলা দিয়ে কোন শব্দ ও আসল না অবশ্য।চোখজোড়া বুঝে নিয়েই শরীরটা এলিয়ে দিল গাড়ির সিটে।রক্তিম ড্রাইভিং সিটে বসেই আয়নায় তাকিয়ে অদ্রিজার মুখটা দেখল।ক্লান্তি মাখা ঝিমিয়ে পড়া চোখ। ঘেমে উঠা কপালে ছোটছোট চুল গুলো আটকে আছে।চুপসে আছে পুরো মুখ।রক্তিম দীর্ঘশ্বাস ফেলল।অদ্রিজার পেটের নিচে হাতজোড়া দিয়ে খিচে ধরা আর ব্যাথায় নীলাভ মুখ, তিক্ত চাহনি দেখেই বুকের ভেতরটা মুঁচড়ে উঠল অজানা ভয়ে।জীবনের প্রতিটা মুহুর্ত,প্রতিটা ক্ষণ যেখানে হাজার দুঃখও সে হাসিমুখে বরণ করেছে সেখানে আজ এইটুকুতেই বুক ভারী হয়ে উঠছে তার।কঠিন দীর্ঘশ্বাস গুলো মুক্ত করা বেশ কঠিন হয়ে উঠছে আজ!এটাই বুঝি একজন বাবার অনুভূতি।নিজের অনাগত সন্তানের একটুখানি ক্ষতির আভাসেও বুঝি বাবাদের বুকে এমন উতাল পাতাল ঝড় সৃষ্টি হয়?আচ্ছা!তার বাবা কি তার জন্য এতটা উদ্বিগ্ন থাকত?এতটা চিন্তা করত তার জন্য?না!করে নি এত চিন্তা।এতটা উদ্বিগ্নও হয় নি।মনে মনে নিজেকে নিজেই উত্তর গুলো দিয়ে চোখজোড়া বন্ধ করল রক্তিম।উষ্ণশ্বাস ফেলে সামনে থাকা পানির বোতলটার মুখ খুলেই অদ্রিজাকে হা করতে বলল।অদ্রিজা কয়েক সেকেন্ড চুপ থাকলেও পরমুহুর্তে কিছু না বলেই হা করল।এই গরমে, ঘামে চুপসে উঠা এই শরীরের জন্য ঐটুকু পানি প্রয়োজন ছিল।শুকনো গলা এবার বুঝি একটু ঝরঝরে হলো।রক্তিমের দিকে ছোট ছোট চোখে তাকাতেই রক্তিম হালকা হেসে বোধ হয় বুঝাতে চাইল সে চিন্তা করছে না।এটা চিন্তা করার মতো কোন বিষয়ই না।কিন্তু মন জিনিস টা বড্ড অবাধ্য।শরীরের ক্লান্তি, পেট ব্যাথায় বিষিয়ে উঠা যন্ত্রনার সাথে এবার মন খোঁচখোঁচ করা অজানা ভয় যোগ হলো।গলা সরু করে কিছু বলার আগেই রক্তিম গাড়ি স্টার্ট দিল।সঙ্গে সঙ্গে হালকা বাতাসে শীতল হয়ে উঠল শরীর।নিস্তেজ হয়ে উঠল ভারী দেহ।হাত পা লতিয়ে পড়ল গাড়ির সিটের উপর।চোখ জোড়াও বুঝে আসল মুহুর্তেই।
.
হসপিটালের করিডোরেই দাঁড়িয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলল নেহা।নিচ থেকে উপরে জোরে জোরে সিঁড়ি বেয়ে আসার দরুন হাুঁটুতে ভর দিয়ে হাঁপাল কিছুক্ষন।দিহান চোখ ছোট ছোট করে নেহার দিকে তাকিয়ে রইল।মৃদু হেসে নেহার দিকে এগিয়েই বলল,
‘ এত জোরে উঠলি কেন?এখন হাঁফাতে থাক।আমি যাচ্ছি।’
নেহা মুখ তুলে চাইল।দিহান যাচ্ছি বলেও গেল না।স্থির দাঁড়িয়ে থেকে নেহার হাঁফাতে থাকা মুখটা দেখতে ব্যস্ত হয়েই মুচকি হাসল।ঠোঁট চেপে বলল,
‘ যাব?তুই একাই আসিস তাহলে।’
নেহা আবারও মিনমিনে চাহনিতে তাকিয়ে রইল।কিছু না বলে জোরে জোরে হাঁফিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল।দিহানের হাতটা আকস্মিকভাবেই খপ করে ধরে নিয়ে বলে উঠল,
‘ কি আশ্চর্য!এতটা পথ যখন তোর সাথেই এসেছি তখন এটুকু পথ তুই আমাকে রেখে একা একা চলে যাবি? এত খারাপ তুই?!’
দিহান হালকা হাসল।নেহার হাতটা নিজের হাতের সাথে জড়িয়ে আছে দেখেই গম্ভীর গলায় বলল,
‘ আজ তোরা সবাই আমার হাতটাকে ধপাধপ ধরে ফেলছিস কেন বুঝে উঠছি না।’
নেহা সরু চোখে চাইল।কি বুঝেই মনে হলো, কোনকিছুতে জোর করা উচিত না।দিহান যদি তাকে ভালোবাসে তাহলে কোন একদিন সেও হাত ধরবে।জোর করে হাত ধরতে হবে কেন হাত?কথাটা ভেবেই দিহানের হাতটা ছেড়ে দিল।দু পা এগিয়েই হাঁটতে হাঁটতে বলে উঠল,
‘ স্যরি দিহান।খেয়াল করা হয় নি। হুটহাট কি করে ফেলি খেয়াল থাকে না আমার!’
দিহান কপাল কুঁচকাল।সামনের মেয়েটা যে নেহাই বুঝে উঠতে দেরি হলো।এত সহজে কষ্ট পেয়ে গেল এই মেয়েটা?তার হাতটা ছেড়ে দিল?অথচ সেইদিন তাদের বাসার সামনেও কত জোর দিয়ে কথা বলেছিল। অদ্ভুত!কষ্ট পেল কেন?মনে মনে প্রশ্নগুলো করেই নিজের মাথায় নিজেরই ঘুষি বসাতে মন চাইল দিহানের।দাঁতে দাঁত চেপে দ্রুত পায়ে এগিয়ে নেহার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েই নেহার হাতটা খপ করে ধরে বসল।ভ্রু কুঁচকেই বলল,
‘ তুই এইটুকুতেও মাইন্ড করিস?জানা ছিল না।’
‘ মাইন্ড কখন করলাম?’
দিহান দৃষ্টি গভীর করল।কপাল কুঁচকানো চাহনি নিয়ে নেহার দিকে তাকিয়েই গম্ভীর গমগমে কন্ঠে বলে উঠল,
‘ তাহলে হাত ছাড়লি কেন?’
নেহা অবাক হলো।হাত ছাড়বে না?তাহলে কি করবে? বোকার মতোই প্রশ্ন করল নেহা,
‘ হাত ছাড়ব না?তুই তো বিরক্ত হচ্ছিলি।তাহলে?হাত ছাড়া উচিত হয়নি আমার?’
দিহান শক্ত কন্ঠেই অন্য পাশ ফিরে বলল,
‘ নাহ!উচিত হয়নি।কেন হাত ছাড়বি তুই?হাত ছাড়ার অনুমতি কে দিল তোকে?’
নেহা এবার বোকার মতো তাকাল।ফুস করে নিঃশ্বাস ফেলে চাহনিটা দিহানের মুখ থেকে নিজের হাতের দিকে নিল।দিহানের হাত যে তার চিকন হাতটা ধরে রেখেছে তা বোধগম্য হতেই ক্লান্তিমাখা নিঃশ্বাস বেরিয়ে এল ভেতর থেকে।মুখে ফুটল মৃদু মিষ্টি হাসি। চোখজোড়া বন্ধ করে নিয়ে প্রশান্তির হাসি হাসল।প্রতিউত্তরে একটা কথাও না বলে নিশ্চুপে দিহানের সাথে পা মিলিয়েই পা বাড়াল।
.
হসপিটালের কেবিনে নিজেকে আবিষ্কার করতেই চোখ মেলে চাইল অদ্রিজা।নিজের অনেকটা কাছে কোন পুরুষের অস্তিত্ব বুঝে উঠেই থমকে গেল সে।উষ্ণ নিঃশ্বাসগুলো মুখচোখ ছুঁয়ে যেতেই কেঁপে উঠল।হাত পায়ের তালু ইষৎ ঘেমে উঠল অস্বস্তিতে।তবুও নড়াচড়া করার মতো এটুকু শক্তি পেল না নিজের মধ্যে। বার কয়েক শুকনো ঢোক গিলেও নিজের মুখের উপর উপছে থাকা পুরুষটিকে সরার জন্য বলতে পারল না সে।মুখ দিয়ে একটা শব্দ ও বের হলো না।বিস্ময়, অস্বস্তি নিয়ে ছোটছোট চোখে উপরের দিকটায় চেয়ে থাকতেই বুঝতে পারল সামনের লোকটা ফুপাচ্ছে। আরও বুঝল,লোকটার ঠোঁটজোড়া তার কপালের মসৃন ত্বকটাতেই স্থির। অদ্রিজা হালকা কাঁপল।হাঁসফাঁস করল। অস্ফুট স্বরে অনেক চেষ্টা করেই বলে উঠল,
‘ র্ রক্ তিম!’
অদ্রিজার অস্ফুট স্বরে কেঁপে কেঁপে বলা কথাটা শুনেই সামনের লোকটি মুহুর্তেই এক লাফে সরে দাঁড়াল। অদ্রিজা এতক্ষন জেগে ছিল ভেবেই চমকাল সে।কন্ঠ নিচু করেই গমগমে কন্ঠে বলল,
‘ স্যরি।আ’ম স্যরি। বুঝতে পারিনি আপনি জেগে আছেন।’
অদ্রিজা কিছু বলতে পারল না।তাকিয়ে রইল স্থির দৃষ্টিতে। রক্তিমের শুকনো মুখচোখ পরখ করেই গলা শুকিয়ে আসল মুহুর্তেই।কি এমন হয়েছে?রক্তিম এতটা চুপচাপ?এতটা শান্ত?শরীর শিউরে উঠল মুহুর্তেই।চোখজোড়া ছোটছোট করে স্থিরভাবে রক্তিমের দিকে তাকাতেই মনে জাগল কঠিন প্রশ্ন।কাঁপা কাঁপা ভাবে বাম হাতটা গিয়ে ঠেকল তার পেটে। ঠোঁটে ঠোঁট চেপেই বলে উঠল
‘ র্ রক্ তি….’
বাকি কথাটা বলা হলো না অদ্রিজার।রক্তিম তার তর্জনি আঙ্গুলটা অদ্রিজার ঠোঁটে রেখেই হালকা হাসল।কন্ঠটা পিচেল করার চেষ্টা করেই বাঁকা হাসার চেষ্টা করল।কিন্তু চেষ্টা সফল হলো না।স্পষ্ট বুঝা গেল রক্তিমের হাসিটা বানোয়াট।চোখেমুখে হাসির সেই উচ্ছ্বলতাটা ফুটেই উঠল না।তবুও বানোয়াট সে হাসি নিয়েই বুঝাতে চাইল সবটা ঠিক আছে।কোন চিন্তা নেই।কিন্তু মিথ্যে সেই সান্ত্বনাতে অদ্রিজার মন মানল না।স্থির নয়নে তাকিয়ে আবারও বলার চেষ্টা করল,
‘ আ্ মা্ র বে্ বি ভা….’
রক্তিম আবারও আঙ্গুলটা অদ্রিজার ঠোঁটে রেখেই লম্বা নিঃশ্বাস ফেলল।মুখে চোখে হাসির রেখা ফুটানোর চেষ্টা চালিয়েই শুকনো কন্ঠে বলল,
‘ আপনার শরীরে ইনজ্যাক্ট করা হয়েছে।ঘুমানোর কথা আপনার। ঘুমোন।আপনার শরীর দুর্বল।পরে কথা বলার শক্তি পেলে কথাগুলো বলে নিবেন।ওকে?যা জানার জেনে নিবেন।এখন প্লিজ চুপ থাকুন।প্লিজ!’
অদ্রিজা মুখ ফুলাল।বড়বড় চোখে রক্তিমের মুখের দিকে দৃষ্টি স্থির রাখতেই তপ্তশ্বাস বেরিয়ে আসল ভেতর থেকে।রক্তিম কি তার থেকে কিছু এড়িয়ে যাচ্ছে?লুকোতে চাইছে কিছু?কথাগুলো মস্তিষ্কের নিউরনে নিউরনে ঘুরতেই আবারও নিস্তেজ হয়ে আসল শরীর।চোখজুড়ে নেমে আসল চরম ঘুম।মুহুর্তেই বুঝে আসল চোখজোড়া। ঝাপসা হলো দৃষ্টি।সামনের লোকটার মুখও ঝাপসা হয়ে আসল সেই দৃষ্টিতে।তার চোখজোড়া বোধ হয় ছলছল করছিল।কে জানে!ঝাপসা চাহনিতে অতো কিছু বুঝা হয়ে উঠে নি আর!
#চলবে…
#হৃদয়_নিবাসে_তুই
#অন্তিম_পর্ব
লেখনীতেঃভূমি
‘ বেবিটা আপনার ওয়াইফের অসতর্কতা বশত চলাফেরার জন্য অল্পের জন্য নিজের অস্তিত্ব হারায়নি মিঃ রক্তিম মাহমুদ।তবে একেবারেই যে বেবিটাকে নিয়ে ভয় কেঁটে গিয়েছে তা একদমই নয়।উনার পেট ব্যাথা সহ আরও বিভিন্ন প্রবলেম হতে পারে প্র্যাগনেন্সির সময়টাতে।বাচ্চাটা মিসক্যারেজও হতে পারে।উনাকে সতর্ক হয়ে চলাফেরা করতে বলবেন।আর হ্যাঁ, নিয়মিত ঔষুধ আর একদমই রেস্টে থাকতে বলবেন।আশা করি নিজেদের ভবিষ্যৎ বেবির কথা ভেবে এইটুকু অবশ্যই মেনে চলবেন।রাইট?’
রক্তিম হালকা হাসার চেষ্টা করল।নিজের সামনেই কম বয়সী যুবতী ডক্টর।হাতে রিপোর্ট।দৃষ্টি অতি তীক্ষ্ণ রেখে রিপোর্ট গুলোর দিকেই চেয়ে আছে সেই যুবতী ডক্টর।কন্ঠেও তার তীক্ষ্ণতার তেজ স্পষ্ট।রক্তিম চোখ তুলে তাকিয়ে কিছু বলতে নিতেই সামনের সুন্দরী ডক্টর আবার ও বলে উঠল,
‘ যদি এরপরও এমন কিছু হয় তাহলে সত্যিই বেবিটা মিসক্যারেজ হয়ে যেতে পারে মিঃ রক্তিম।ইভেন এবারও বেবিটা মিসক্যারেজ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা শতকরা পঞ্চাশ পার্সেন ছিল।আমি মনে করি, এরপর থেকে একটু সাবধানে চলাফেরা করবে আপনার ওয়াইফ?আর যদি তা না হয় তো আপনারা আপনাদের অনাগত সন্তানকে হারাবেন।তাছাড়া বিভিন্ন প্রবলেমও হতে পারে।উনি যতোটা হালকা ভাবে আঘাত পেয়েছেন বলছেন বিষয়টা অতোটাও হালকা নয়।আমার মনে হয় না।আপনাদের খেয়াল রাখা উচিত ছিল।প্র্যাগনেন্সির এই কয়টা মাস একটু সতর্কতা নিয়ে চলা উচিত ছিল।আমি জানি না উনার প্র্যাগনেন্সি জার্নিটা কেমন কাঁটবে।তবে বেশ ভালো কাঁটবে না এটুকু বলতে পারি।তবে সতর্ক হয়ে চললে আশা করি কিছু হবে না।’
রক্তিমের মুখ গম্ভীর হলো।ঠোঁট চেপে জোরে শ্বাস ফেলেই বলে উঠল,
‘ হ্যাঁ।এরপর আর অসতর্কতা নিয়ে চলাফেরা করবে না।আমি দিব না।’
কথাটা বলেই উঠে দাঁড়াল।মুচকি হেসে ডক্টরের কেবিন থেকে বেরিয়ে এসেই অদ্রিজার উদ্দেশ্যে পা বাড়াল।মিনিট দুইয়ের মধ্যে পৌঁছালও অদ্রিজার কাছে।বেঘোরে ঘুমোচ্ছে।চোখজোড়া বন্ধ।রক্তিম মৃদু হাসল সেই বন্ধ চোখজোড়া আর ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়েই।হাতজোড়া অদ্রিজার কপালের কাছে নিয়েই ছোট ছোট চুলগুলো কপাল থেকে সরিয়েই সামনের চেয়ারটায় বসল।অদ্রিজার হাতটা দুইহাতে মুঠোবন্দি করে নিয়েই চোখজোড়া বন্ধ করে সিক্ত কন্ঠে বলে উঠল,
‘ ভালোবাসি তোমায় অদ্রি।কখনো বলতে পারব কিনা এই সাংঘাতিক কথাটা জানি না।তবে ভালোবাসি।তুমি কেন বুঝো না?ভালোবাসাটা মুখে স্বীকার করতে হবে কেন।আমার কোনকিছু দেখেই কি বুঝে উঠো না আমি তোমায় ভালোবাসি?কেন বুঝো না।কেন এই যুবকটিকে এখন আর “ভালোবাসি ” বলো না?হ্যাঁ ভুল করেছিলাম। ভুলটা তো আমি করিনি ইচ্ছে করে।সৃষ্টিকর্তা আমার সাথে যেমনটা করেছিল আমার যে এইছাড়া আর কোন উপায় ছিল না।আমি চেয়েছিলাম তুমি ভালো থাকো।তুমি সুন্দর জীবন লিড করো।কে জানত তোমার সাথেই আমার জীবন জড়িয়ে যাবে।তাও প্রথম রাতে এমন কিছু ঘটে যাবে নেশার ঘোরে । তখন কেবল মনে হতো নেশার ঘোরে ঐ কাজটা আমার চরম অন্যায় হয়ে গিয়েছে যেখানে সারাজীবন আমি তোমার পাশে থাকতেই পারব না সেখানে এমন কিছু করার অধিকার কি আমার ছিল?ছিল না।তবুও আমি এই অনাধিকার চর্চা করে ফেলেছিলাম।আর এই অনাধিকার যাতে আবার না ঘটে তাই তোমাকে বারংবার দূরে সরিয়ে রাখতে চেয়েছিলাম।তোমার জীবনের সাথে আমার জীবন না জড়াক এটা বারংবার চেয়েছি তখন।কিন্তু সৃষ্টিকর্তা আমার সেই চাওয়া পূর্ণ করল না অদ্রি।তোমার জীবনের সাথে আমার জীবনটা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে দিয়েছেন উনি।আমি চাইলেও তোমার থেকে আলাদা হতে পারিনি। ভালোবাসি।ভালোবাসি তোমায়।প্লিজ আমার অন্তরের এই কথাটা বুঝে নিও।প্লিজ!’
কথাগুলো বলা শেষ করতেই অদ্রিজা চোখজোড়া খুলল।সচল মস্তিষ্কে এতক্ষনকার কথাগুলো আরো একবার ভেবে নিয়ে ঠোঁটে ঠোঁট চাপল।শরীরটা অল্প ক্লান্ত।তবে কথা বলতে পারবে। ঠোঁট জোড়া টেনেই মৃদু গলায় বলে উঠল সে,
‘ ক্ কি?আবার বলুন।ভালোবাসেন আমায়?’
রক্তিম চোখ তুলে চাইল।চোখজোড়ার দৃষ্টি মুহুর্তেই অপ্রস্তুত হলো।কি বলবে বুঝে না উঠেই অদ্রিজার দিকে তাকিয়ে থাকার মাঝেই অদ্রিজা আবারও বলে উঠল,
‘ কি হলো বলুন!ভালোবাসেন?বললে আপনাকে অদ্রি ডাকার অনুমতি দিয়ে দিব।প্রমিজ!’
রক্তিম হালকা হাসল।ঠোঁট টেনে মৃদু গলায় বলল,
‘ হ্যাঁ, ভালোবাসি।খুব আগে থেকেই ভালোবাসি।আরো বছর এক আগে।রায়মানের সাথে সেইবার ওর পারিবারিক অনুষ্ঠানে আমার প্রথম যাওয়া।ওহ হ্যাঁ, রায়মানের সাথে আমার কোনকালেই কোন সমস্যা ছিল না অদ্রিজা।কেবল সাময়িক ভুল বুঝাবুঝি ছিল রিমুর ফিলিংসটা নিয়ে।কিন্তু যখন ও আমার ব্রেইন টিউমারের কথা জানতে পেরেছিল তারপর থেকে সব মিটে গিয়েছিল।আপনার মায়ের সামনে রায়মানের ঐ ব্যবহারটা নাটক ছিল।রিমু ভালোবাসত আমায় ঠিকই, কিন্তু তাই বলে রায়মান অতোটাও জঘন্য বিহেভ আমার সাথে করবে না এটুকুও বুঝলেন না আপনারা।যায় হোক, আমি সেইবার আপনাদের পরিবারিক অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম মূলত অত্রিয়াকে দেখার জন্য। রায়মান বলেছিল ওর দিকে কোন এক পিচ্চি মেয়ে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে আর ও সেটা নিয়ে মজা নেয়।ব্যস!সেই মজার কাহিনী নিজ চোখে দেখার জন্য রায়মানের হাজার অনুরোধে অবশেষে হাজির হলাম সেখানে।ঠিক সেখানেই ঘটে গেল বিপত্তি!আপনি নামক রমণীকে দেখে সেখানেই তব্দা খেয়ে গেলাম।না, ঠিক তখন থেকে আমি আপনাকে ভালোবাসিনি।তখন শুধু ভালো লাগাই ছিল বোধ হয়।আমি আপনাকে ফলো করতাম।আপনার চলাফেরা, কথাবার্তা সবটাই ভালো লাগত।জানি না তখন ভালোবাসা তৈরি হয়েছিল কিনা।তবে বিষয়টা জট পাঁকাল অন্য জায়গায়।আপনার প্রতি ভালো লাগা বা ভালোবাসা যায় হোক, তার খোঁজই কোনভাবে মিস্টার মাহমুদ জেনে গিয়েছিল।আর ভেবেছিল আপনার সাথে আমার বিয়েটা দিয়ে দিলেই সব সমস্যার সমাধাণ হয়ে যাবে।আমার অতি খারাপ রূপ তার কাছে ভালো হয়ে যাবে বোধ হয়।কিন্তু তিনি জানতেনই তার ছেলের ব্রেইন টিউমার। তিনি অজান্তেই যে একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করে ফেলছেন বুঝেই উঠেননি।আর আমি বিয়েটা করেছিলাম পিচ্চিগুলোর কথা ভেবে।ওদের জন্য ওই এরিয়াটা প্রয়োজন ছিল। আর ঐ এরিয়াটা মিস্টার মাহমুদের আন্ডারে। তাই উনার শর্ত অনুযায়ী বিয়েটা করা।ভেবেছিলাম বিয়েটাই তো।ডিভোর্স হয়ে গেলেই সবটা শেষ।আপনার জীবনও নষ্ট হবে না।কিন্তু বিয়ের প্রথম রাতেই নেশার ঘোরে যা হয়েছিল তার জন্য আমি প্রতিমুহুর্তেই ভুগেছি।প্রতি মুহুর্তেই অপরাধবোধে ভুগেছি।আপনাকে আমার থেকে দূরে সরানোর শত চেষ্টা চালালাম।কিন্তু পারলাম আর কোথায়?বাবা হবো কথাটা শুনেই আমার মন ঘুরে গেল। অনেক চেয়েও আপনার থেকে নিজেকে আলাদা করতে পারিনি আমি।সেই বাবা হওয়ার কথা ভেবেই আবেগে আপ্লুত হয়ে গিয়েছিলাম।খুশিতে মাথা ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল আমার।সেইদিনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আপনাকে এত সহজে ছাড়া যাবে না।’
‘ নয়তো ছেড়ে দিতেন?শুধুমাত্র বাবা হওয়ার আনন্দে টিকে আছে সম্পর্কটা?’
রক্তিম চোখ বন্ধ করল।তীব্র বিষাদ নিয়েই বলে উঠল,
‘ হ্যাঁ, ছেড়ে দিতাম।কারণ তখন আমার জীবনটা অনিশ্চিত ছিল।চাই নি এই অনিশ্চিত জীবনের সাথে আপনার জীবন জড়িয়ে যাক।আপনি কষ্ট পান।তাই তো দিহানকে বলেছিলাম আপনাকে আগলে নিতে।দিহান আপনাকে ভালোবাসত।সেই হিসেবে সে আপনাকে খুব ভালো রাখতে পারত।এই কথাটাই মাথায় ঘুরপাক খেয়েছিল তখন।কেবল আপনাকে কষ্ট না দেওয়ার জন্যই আপনাকে ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।’
অদ্রিজার মুখ চোখ ও এবার গম্ভীর হলো।কন্ঠটা চরম রকম গম্ভীর করেই বলে উঠল,
‘ ঠিকাছে!মানলাম।’
রক্তিম হালকা হাসল।অদ্রিজার হাতটা দুই হাত দিয়ে সেভাবেই ধরে রেখে বলে উঠল,
‘ ভালোবাসি।তখন থেকে কিংবা এখন থেকে।কবে ভালোবাসার শুরু হয়েছিল জানি না। তবে এইটুকু জানি, ভালোবাসি অদ্রিজা।’
অদ্রিজা মুখ ফুলাল।গম্ভীর স্বরে বলল,
‘ ঠিকাছে।আপনাকে অদ্রি ডাকার অনুমতি দিয়ে দিলাম।’
রক্তিম হাসল।চোখ জোড়া সরু করেই অদ্রিজার দিকে তাকিয়ে থেকেই অদ্রিজার হাতে চুমু দিল।মুচকি হেসেই বলে উঠল,
‘ আপনি বললেন না তো!ভালোবাসেন আমায়?
অদ্রিজার সাদা ধবধবে মুখ এবার লাল হলো।কি বলবে না বলবে স্থির করতে পারল না।চোখজোড়া বন্ধ করে নিল টুপ করেই।রক্তিমের বলা কথাটি শুনতেই পাইনি এমন একটা ভাব করেই চোখজোড়া বন্ধ রেখেই বলে উঠল,
‘ আমার ঘুম পাচ্ছে।ঘুমাব একটু।যান প্লিজ।’
.
নেহা একপাশেই পার্কের বেঞ্চিতে বসা।দিহান দাঁড়িয়ে আছে বুকে হাত গুঁজে। দুপুরের তরতাজা রোদে ঘেমে চুপসানো মুখ নিয়ে নেহার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।ফুচকাওয়ালা থেকে দুই প্লেট ফুসকা নিয়েই বেঞ্চের অন্য পাশে গিয়ে বসল।ফুসকার একটা প্লেট নেহার হাতে দিয়ে অন্য প্লেটটা বেঞ্চেরই এককোণায় রাখল।কপাল কুঁচকেই বলে উঠল,
‘ এই রোদে এভাবে ফুসকা খেতে মজা আছে?আমি খাব না।’
নেহা ঘাড় ঘুরাল।দিহানের ফুসকার প্লেটটা দিহানের হাতে ধরিয়ে দিয়েই বলে উঠল,
‘ না খেলে তোর সাথে কথা নেই।এরপর থেকে আর কোন কথা বলবি না আমার সাথে। যা ফুট!’
দিহান চোখ নামিয়ে নেহার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।এই গরমে চরম বিরক্তি নিয়েই প্লেট থেকে একটা ফুসকা মুখে ফুরল।ভরা গলায় বলল,
‘ শান্তি এবার?খেয়েছি।’
‘ মাত্র একটা।এটা কোন খাওয়ার নমুনা হলো?সবগুলো খাবি।’
দিহান কড়া চোখে চাইল এবার।দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
‘ তোকে খেতে দিচ্ছি এটাই অনেক।এই গরমে এগুলো খেয়ে পরে অসুস্থ হয়ে যাবি।সেইদিক দিয়ে তোকে খাওয়ার অনুমতি দিয়েছি এটা তো তোর ভাগ্য!’
নেহা ভ্রু কুঁচকাল।বলে উঠল,
‘ ওমাহ!আমি অসুস্থ হলে হবো।তোর কি? তুই অনুমতি দেওয়ার কে?আশ্চর্য!’
দিহান কিছু বলল না।মুখ ভার করে অন্যদিকে ফিরে রইল।মাথার উপর ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকা সূর্যের উত্তপ্ত রোদকে এক মুহুর্তেই সরিয়ে দিতে মন চাইল।কিন্তু সম্ভব নয়।বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে বসে থাকার মাঝেই নেহা তার সামনে এসে দাঁড়াল।মুখে ফুসকা ফুরতে ফুরতেই বলে উঠল,
‘ ভালোবাসিস আমায় দিহান?আমার কথাতে ফুসকাটা খেয়ে নিলি যে?তুই তো এসব বাইরের জিনিস খাস না।’
দিহান মুখ তুলে চাইল। মৃদু গলায় বলল,
‘ হঠাৎ এমন প্রশ্ন?’
‘ মনে হলো।’
দিহান হালকা হাসল।ঠোঁট চওড়া করে বলল,
‘ মনে হলো যখন তখন হয়তো ভালোবাসি।একটা মানুষ মুখে ভালোবাসি বলে বুঝাতে পারা, আর কাজে ভালোবাসি বুঝাতে পারা এই দুটোর মধ্যে দ্বিতীয়টাই উত্তম।তাই না?’
নেহা মুচকি হাসল।কিছু বলল না।দিহানের দিকে ফিরে আর একটাও কথা না বলে দ্রুত পেছন ফিরল।আনন্দে ধুকবুক করা হৃদয়টা জোর করে আবদ্ধ রেখেই ফুসকার প্লেটটা নিয়ে ফুসকাওয়ালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল।প্লেটটা সেখানেই রেখে আড়চোখে চাইল দিহানের দিকে।মুখে চাপা হাসি যুবকটির।তবে কি সত্যিই! নিজের হাতে চিমটি দিতেই হৃদপিন্ডের হৃদস্পন্দটা দ্বিগুণ হলো নেহার।সত্যিই দিহান ভালোবাসে তাকে!
.
হসপিটালে রায়মান যখন অদ্রিজাকে একবার দেখেই বেরিয়ে যাচ্ছিল ঠিক তখনই পিচ্চি দেখতে অত্রিয়া নামক মেয়েটির আগমণ ঘটল।রায়মানের মুখোমুখি দাঁড়িয়েই কোমড়ে হাত গুঁজল সে।দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
‘ আপনি! এখানেও!সব জায়গায় এমন আপনি আপনি ময় হয়ে যাচ্ছে কেন!আজব!’
রায়মান গভীর চোখে চাইল অত্রিয়ার দিকে।মুখ ভার করেই বলে ফেলল,
‘ ভালো টালো বাসলে যা হয় আরকি।বোধ হয় আমাকে ভালোবাসো তুমি।তাই তো তোমার সবকিছু আমিময় হয়ে যাচ্ছে। তাই না?’
অত্রিয়া ঠোঁট উল্টিয়েই বলল,
‘ মোটেই না।আপনার মতো কাউকে আমি কেন ভালোবাসব।পাগলা কুকুরে কাঁমড় দিয়েছে আমাকে?আজব!’
‘ সেটাই তো।ভালোই যদি না বাসো তবে এভাবে বারবার আমার সামনে এসে পড়ছো কেন?হুটহাট আমার পথ আটকে দাঁড়াচ্ছো কেন?মুখ ফুলিয়ে আগ বাড়িয়ে কথাই বা বলছো কেন?সত্যিই কি ভালো টালো বাসো না?’
অত্রিয়া মুখ তুলে চাইল।ভ্রু কুঁচকে নিয়েই বলে উঠল,
‘ হোয়াট ইজ ভালো টালো বাসা?আই মিন, হোয়াট ইজ টালো?’
রায়মান হতাশ হলো।বুকে এক সাগর দুঃখ নিয়েই মুখ কালো করল।কেন এই পিচ্চি মেয়ের প্রেমে পড়তে গেল?কেন!এখন জীবনটাই বরবাদ।শুধু বরবাদ নয়।চরম রকম বরবাদ!এই মেয়ে তাকে জ্বালাবে।প্রচুর জ্বালাবে।কথা গুলো ভেবেই ভারী নিঃশ্বাস ফেলল।মুখ ভার করে বলল,
‘ ভালো টালো বাসা মিন, তোমার প্রতি আমার যে ফিলিংসটা আছে সেটা।এন্ড মে বি তোমার ও আমার প্রতি এই ফিলিংসটা আছে।রাইট?’
অত্রিয়া চকচকে চোখে চাইল এবার।অবিশ্বাস্য কন্ঠেই বলে উঠল,
‘ মানে, আপনি আমায় ভালোবাসেন?রিয়েলি!শ্যামপুরুষ অত্রিয়াকে ভালোবাসে এই খবরটাতো আপুকে এক্ষুনিই দেওয়া উচিত!’
রায়মান ভ্রু বাঁকিয়েই বলল,
‘ তুমি না এতক্ষন ভালো টালো বাসা বুঝছিলে না?এক ধাক্কায় সব ক্লিয়ার?কি ব্রিলিয়্যান্ট!’
অত্রিয়া পাত্তাই দিল না আর রায়মানের কথাগুলোকে।মোবাইল বের করে অদ্রিজাকে কল করতে ব্যস্ত হয়েই খিলখিলিয়ে হেসে বলে উঠল,
‘ ধুররর!আপনি আসলেই বোকা।আমার সতেরো বছর।ভালো টালো বাসা আমি বুঝব না?ওটা তো জাস্ট মজা করছিলাম।আপনি বুঝলেনই না।’
রায়মান আরেক ধাপ হতাশ হয়ে মুখচোখ কালো করল।এই মেয়েকে যতোটা পিচ্চি সে ভেবেছে ততোটাও পিচ্চি নয় এই মেয়ে।আস্ত এক বিচ্ছু!
.
‘ আপনি জানেন আমি কতোটা ভয় পেয়েছিলাম?কোন ধারণা আছে আপনার।যদি আমার বেবিটা আর না থাকত?আমার এত স্বপ্ন, কল্পনা সব যদি ভেস্তে যেত?ভেবেই কলিজা কাঁপছিল আমার!’
অদ্রিজা আধশোয়া হয়ে বসে রইল।রক্তিমের কথাগুলো শুনেই চোখ বড় বড় করে চাইল।পাশে থাকা পানির গ্লাসটা থেকে পানিটা ঢগঢগ করে খেয়ে নিয়েই হালকা হেসে বলল,
‘স্বাভাবিক তো!প্রত্যেক বাবারই তার সন্তানকে নিয়ে চিন্তা হয়।এর বাইরে অস্বাভাবিক কিছু তো করে বসেননি আপনি।তাই না জানারও বিষয় না এটা।আর হ্যাঁ, স্যরি।আমার আরেকটু সতর্ক হয়ে চলা উচিত ছিল।’
রক্তিম হালকা হাসল।রুমের জানালার কাছে দাঁড়িয়েই পর্দাটা টেনে দিতে দিতে মুখ ফুলিয়ে জোরে শ্বাস ফেলেই অদ্রিজার দিকে তাকাল।তারপর বিছানার পাশের টেবিলের ড্রয়ারটা থেকে ঔষুধ নিয়ে এগিয়ে দিল অদ্রিজার দিকে।মুচকি হেসেই বলল,
‘ এবার থেকে আপনার সমস্ত কিছুর খেয়াল আমি রাখব।কেবলই নিজের সন্তানের সেফটির জন্য।আর কিছু না।কিছু ভাববেন ও না।’
অদ্রিজা ভ্রু জোড়া কুঁচকে নিয়েই বলল,
‘ আর কি মনে করব?কি ভাবব মিঃ রক্তিম মাহমুদ?আপনি আমায় ভালোবাসেন তা তো আমি অনেক আগ থেকেই জানি।সুইটহার্ট বলে দিয়েছিল।’
রক্তিম অবাক হলো।সুইটহার্ট তার থেকে কিছু লুকিয়ে গেছে ভাবতেই পারল না।রুম থেকে বের হয়ে গিয়েই আবার কিছুটা সময় পর রুমে ডুকল।অদ্রিজার চোখমুখের দিকে দৃষ্টি ফেলেই বলে উঠল,
‘ আপনি খুবই অভদ্র অদ্রিজা।আমি আপনাকে এমনটা ভাবিই নি।সুইটহার্টের থেকে কথা হাতিয়ে নিয়ে আমাকে জ্বালাতে চাইছিলেন!আসলেই বিপদজনক মহিলা আপনি!’
অদ্রিজা খিলখিলিয়ে হাসল।ঠিক তখনই সুইটহার্ট এসে দাঁড়াল।হাতের ছোট প্লেটটায় কেঁটে রাখা ফল।অদ্রিজার দিকে এগিয়ে দিয়েই হালকা হেসে বলল,
‘ এটা কি করলে অদ্রি?জান তো এবার আমায় ভুল বুঝল।’
‘ ধুরর!তোমার জান তোমাকে বুঝে।তুমি শুধু শুধু চাপ নিচ্ছো।’
রক্তিম হাসল।সুইটহার্টে কাঁধে হাত দিয়েই মুচকি হেসে বলল,
‘ ইয়েস!তোমার জান তোমাকে ভুল বুঝতেই পারে না সুইটহার্ট।’
সুইটহার্ট হালকা হাসল ফলের প্লেটটা অদ্রিজার হাতে ধরিয়ে দিয়েই যেতে যেতে বলল,
‘ চটজলদি খেয়ে নাও অদ্রি।না বললে কিন্তু শুনব না।’
অদ্রিজা মুখ ফুলিয়ে তাকাল।রক্তিম মৃদু হেসেই তার কাছে এসে বসল। কন্ঠ পিচেল করে বলল,
‘ আপনি কিন্তু বললেন না অদ্রিজা।ভালোবাসেন আমায়?’
অদ্রিজার মুখচোখ আবারও লাল হলো লজ্জ্বায়।নিঃশ্বাস ঘন হয়ে উঠল।আগের বার যেমন এত সহজেই ‘ ভালোবাসি ‘ কথাটা উচ্চারণ করতে পেরেছিল এবার বিষয়টা ততটাই জটিল!কন্ঠ ভীষণ ভারী। সেই ভারী কন্ঠেই এই ছোট্ট ‘ভালোবাসি ‘ শব্দটি বের হওয়াটা যেন অনেক বেশি কষ্টকর।চোখজোড়া বন্ধ রেখেই জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলল সে।বার কয়েক ঢোক গিলেই চোখজোড়া সেভাবে বন্ধ রেখে মৃদু কন্ঠে বলল,
‘ ভালোবাসি।আমিও ভালোবাসি। ‘
রক্তিম এবার বাঁকা হাসল।অদ্রিজার কপালে ঠোঁটজোড়া ছুঁয়ে দিয়েই ফিসফিসিয়ে বলল,
‘ আজ শতবার ভালোবাসি বলতেও আমার জড়তা কাজ করবে না।ভালোবাসি অদ্রি।আমার হৃদয়ের ভেতর থাকা সেই রমণী, তুমি, তুমি নামক মেয়েটিকে বড্ড ভালোবাসি।আমার হৃদয় নিবাসে যে তুমিই অদ্রি।ভালোবাসি।’
#সমাপ্ত