হৃদয়_রেখেছি_জমা,পর্বঃ১১,১২
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ১১
পরেরদিন সকালে মাহমুদের ঘুম ভাঙ্গার আগেই মেহরিন বেরিয়ে গেলো। ঘুম থেকে উঠে মাহমুদ অবাক! মেহরিন নেই। মনে মনে খুব রাগ হলো তাঁর! নিশ্চয়ই তাঁর মুখোমুখি হতে চায় না বলে খুব সকালে বেরিয়ে গেছে মেহরিন? মেহরিন শারাফাত! দ্যা হরিবল লেডি! একটাবার সরি বলারও প্রয়োজন মনে করে নি? এত রাগ মাহমুদের প্রতি! অথচ মাহমুদ সারারাত জেগে ছিলো। সে ভেবেছিলো মেহরিন একবার হলেও তাঁকে সরি বলতে আসবে। কিন্তু না মেহরিন আসে নি।আশায় আশায় জেগে থেকে ভোররাতের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিলো। সেই ফাঁকেই বেরিয়ে গেছে মেহরিন।ফ্রেশ বিচ্ছিরি একটা মেজাজ নিয়ে অফিসের রওনা দিলো মাহমুদ।
ইরফান সাহেবের রুম থেকে ফাইল নিয়ে একত্রে বেরোচ্ছিলো সোহাগ এবং মেহরিন। মাহমুদকে দেখে সোহাগ হাসিমুখে এগিয়ে এসে বললো,’কি খবর মাহমুদ ভাই? জ্বর সেরেছে?’
মাহমুদ জবাব দিলো না। চুপচাপ নিজের কাজে ডেস্কে গিয়ে বসলো। মেহরিন আড়চোখে একবার তাকিয়ে নিজের কাজে ফিরে গেলো। সে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কাজে মনোযোগ দিলো মাহমুদও।
সোহাগ মনে মনে বেশ অবাক হলো। হঠাৎ করে কি হলো মাহমুদের? তবে গতকাল আবার ঝগড়া হয়েছে মেহরিনের সঙ্গে? কিন্তু সে তো মেহরিনকে ঘুমে দেখে এসেছিলো। তাহলে ঝগড়াটা হলো কখন? যাই হোক এখন আর বেশি ঘাটালো না। সুযোগ মত মেহরিনকে জিজ্ঞেস করার সিদ্ধান্ত নিলো।
সেদিন আর মেহরিনের সঙ্গে মাহমুদের তেমন কথাবার্তা হলো না। মেহরিনও বললো না। এভাবে আরো দুই দিন কেটে গেলো। মুখোমুখি দুচার দেখা হলেও সম্পূর্ণ ভাবে পাশ কাটিয়ে গেলো মেহরিন। চতুর্থ দিন আবারো দুজনের একসঙ্গে কাজের দায়িত্ব পড়লো। ইরফান সাহেব দুজনকে একসঙ্গে কাজ দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত কোন রকম বাক্য বিনিময় ছাড়াই কাজ করলো দুজনে। এবারেও মাহমুদ আশায় ছিলো মেহরিন হয়ত একা পেয়ে তাকে সরি বলবে। কিন্তু মেহরিন বরাবরের মতই চুপচাপ রইলো। কোন রকমের কোন অনুতাপ প্রকাশ পেলো না তাঁর কাজেকর্মে। মনে মনে হতাশ হলো মাহমুদ! এত রাগ একটা মানুষের কি করে হতে পারে!
কাজ শেষে একসঙ্গে নিচে নামলো দুজনে। মেহরিনের গাড়ি ঠিক হয়েছে। পকেট থেকে চাবি বের করে গাড়িতে ঢুকতে যাচ্ছিলো সে এমন সময় মাহমুদ গিয়ে সামনে দাঁড়ালো। ভ্রু জোড়া অটোমেটিক কুঁচকে গেলো মেহরিনের। ইশারায় জিজ্ঞেস করলো সে ,’কি?’
-‘স্যে সরি!’, গম্ভীরমুখে জবাব দিলো মাহমুদ।
-‘বেহায়া!’, পাশ কেটে যাচ্ছিলো মেহরিন। সে ভাবতেই পারে নি মাহমুদ নিজে থেকে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে আসবে। যদিও সেদিনের পর থেকেই মনে মনে অনুতাপে ভুগছিলো সে কিন্তু এই বাহানায় মাহমুদ দূরে সরে থাকবে ভেবে চুপ করে ছিলো। কিন্তু মাহমুদ এভাবে এসে তাঁকে সরি বলতে বলবে এটা তাঁর কল্পনার বাইরে।
ফের পথ আটকালো মাহমুদ। পূর্ববৎ গম্ভীর গলায় বললো,’ইউ হ্যাভ টু স্যে সরি! আই অ্যাম ইউর সিনিয়র!’
-‘সিনিয়র?’
-‘ইয়েস সিনিয়র!’
-‘হোয়াট টাইপ অফ সিনিয়র ইউ আর? জুনিয়রকে বুলেয়িং করা সিনিয়র? তোমার কি ধারণা তুমি আমার সঙ্গে মিসবিহেভ করবে আর আমি তোমাকে ছেড়ে দেবো? কখনো না। এত যদি সিনিয়র সাজার ইচ্ছে হয় তাহলে সবার আগে নিজেকে ত্রুটিমুক্ত করার চেষ্টা করো। লার্ন টু বিহেভ ইউরসেল্ফ!’
-‘ঠিক আছে আমি আমার সেদিনের ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চাইছি। আই অ্যাম সরি। এবার তোমার পালা।’
-‘বলবো না সরি! কি করবে তুমি?’
অবাক হলো মাহমুদ। একটু আগে তাকে ভাষণ দিয়ে এখন নিজেই সরি বলবে না বলছে?
ঠিক আছে মাহমুদও ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়। সে যখন সরি বলেছে তখন মেহরিনকেও সরি বলতে হবে। চট করে মেহরিনের হাতে থাকা গাড়ির চাবিটা কেড়ে নিলো সে। হাতের মুঠোয় নিয়ে হাসিমুখে বললো,’ইউ হ্যাভ টু রেসপেক্ট ইউর সিনিয়র!’
-‘চাবি দাও!’
-‘নো। আগে সরি, তারপর চাবি। তোমার মনে রাখা উচিৎ ছিলো তুমি মাহমুদ সিদ্দিকির গালে চড় মারছো!’
-‘ঠিক আছে লাগবে না আমার চাবি। আমি টেক্সিতে করেই যাবো!’
নিমিষেই মুখ কালো হয়ে গেলো মাহমুদের। এমন ইগোয়িস্টিক, ঘাড়ত্যাড়া মেয়ে সে জীবনে আর দুটো দেখে নি!
মেহরিন অলরেডি গেটের দিকে হাঁটা ধরেছে। মাহমুদ দ্রুত এগিয়ে গিয়ে তাঁর হাতে চাবি দিয়ে বললো,’এই ঘাড়ত্যাড়ামির জন্য তোমার কপালে দুঃখ আছে মেহরিন। বিয়েশাদী জীবনেও হবে না।’
-‘আমার বিয়ে নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। তুমি নিজের বিয়ের কথা ভাবো।’
-‘আমার বিয়ে তো কোন ব্যপারই না। আমি চাইলে এইমুহূর্তেই বিয়ে করে ফেলতে পারি। কিন্তু তোমাকে বিয়ে করবে কে? তোমার যা স্বভাব তাতে তো কবুল বলার আগেই তালাক হয়ে যাবে।’
-‘হলে হবে। তোমার কি?’
-‘আমার আবার কি? আমি তো শুধু সত্যিটা বলেছি!’
-‘কে চাইছে তোমার সত্যি শুনতে? ডোন্ট ইউ হ্যাভ আ গার্লফ্রেন্ড? যাও না তাঁকে গিয়ে এসব শোনাও। আমাকে কেন আমাকে বিরক্ত করছো?’
‘গার্লফ্রেন্ড?’ অবাক হলো মাহমুদ। পরোক্ষনেই মুচকি হেসে বললো,’তার কারণ গার্লফ্রেন্ডকে বিরক্ত করা যায় না। গার্লফ্রেন্ডকে শুধু ভালোবাসতে হয় তাই!’
মেহরিনের মুখের ভাব কঠোর হয়ে গেলো। থমথমে গলায় হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো,’চাবি দাও! আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে।’
-‘উঁহু! যতক্ষণ না পর্যন্ত আমাদের কথা শেষ হচ্ছে ততক্ষণ তুমি চাবি পাবে না।’
-‘কিসের কথা?’
-‘তোমার বিয়ের। যাইহোক, সেটা যখন হচ্ছে না তখন থাক। আমরা অন্য প্রসঙ্গে কথা বলি!’
-‘সহ্যের কিন্তু একটা সীমা আছে বলে দিচ্ছি।’
-‘ তোমার সবকিছুই সীমাহীন। কেবল বুদ্ধি আর ধৈর্য ছাড়া। সুতরাং সেই প্রসঙ্গে না গেলেই ভালো। এনিওয়ে, তুমি যাকে আমার গার্লফ্রেন্ড ভেবে ভুল করছো সে কিন্তু আমার গার্লফ্রেন্ড নয়। সে আমার বন্ধু। খুব ভালো বন্ধু।’
-‘বন্ধু?’ খানিকটা তাচ্ছিল্য মেহরিনের গলায়।
-‘হ্যাঁ বন্ধু। সোহাগ যেমন তোমার বন্ধু তেমনি এনাও আমার বন্ধু।’
-‘মোটেও তেমন নয়। আমার এবং সোহাগের বন্ধুত্ব তোমাদের চাইতে আলাদা। আমাদের বন্ধুত্বের মাঝে একটা লিমিট আছে। কিন্তু তোমাদের ব্যপারটা পুরোপুরি লাগামছাড়া!’
-‘তোমার এবং সোহাগের বন্ধুত্বের মাঝে লিমিট কেবল তোমার কারণে। তোমার দিক থেকে যদি সেরকম কোন পজিটিভ সাইন থাকতো তাহলে তোমাদের বন্ধুত্বটাও আরো গভীরে যেতে পারতো। তুমি সোহাগকে সেরকম কোন সুযোগ দাও নি তাই তোমাদের বন্ধুত্বটা আর বেশিদূর আগায় নি। একটা ছেলে আর একটা মেয়ের মাঝে যখন বন্ধুত্ব তৈরী হয় তখন কমফোর্ট জোন তৈরীর ব্যপারটা একটা মেয়ের ওপরেই নির্ভর করে। মেয়েটা ঐ ছেলেটাকে তাঁর কতটুকু কমফোর্ট জোনের ভেতরে ঢুকতে দেবে সেটা মেয়েটাকেই নির্ধারণ করে নিতে হয়। এক্ষেত্রে তোমার সঙ্গে এনার হয়ত কিছুটা তফাৎ আছে। ওর কমফোর্ট জোন তোমার চাইতে অনেক বেশি! ও একটু বেশিই ফ্র্যাঙ্ক! কিন্তু তারমানে এই নয় যে ওর সঙ্গে আমার অন্য কোন সম্পর্ক আছে। এনা আমার বন্ধু। আমি ওকে বন্ধু হিসেবেই ভালোবাসি।’
অফিসে জয়েন করার কিছুদিনের মধ্যেই ইরফান সাহেবের সঙ্গে এনার সম্পর্কের কথা জেনে যায় সবাই। তার মা ইরফান সাহেবকে ধোঁকা দিয়ে অবৈধ সন্তান জন্ম দিয়েছে এই খবর ফাঁস হওয়ার পর অফিসের কেউই খুবই একটা ভালো চোখে দেখতো না তাঁকে। বেচারি দারূন ভাবে ভেঙ্গে পড়েছিলো। একমাত্র মাহমুদই সেই সময়টাতে আন্তরিকতার সহিত কো-অপারেট করে তাঁর সঙ্গে। সেই থেকেই খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়ে যায় দুজনের। যে কোন সমস্যার কথা নির্দ্বিধায় মাহমুদকে খুলে বলতে পারে সে। অবশ্য মাহমুদের কিলার টাইপ এটিচিউড আর বন্ধুবৎসল ব্যক্তিত্বের কারনে যদিও মনে মনে সে মাহমুদকে ভালোবেসে ফেলেছে কিন্তু মাহমুদের দিক থেকে সেরকম কোন প্রকাশ না থাকায় বলে উঠতে পারে নি।
কিন্তু মেহরিনের চোখকে ফাঁকি দেওয়া সম্ভব হয় নি। সে-ও মাহমুদকে ভালোবাসে। এনার চোখেও সেই একই ভালোবাসা! নিজের অজান্তেই বুকের ভেতর অসহ্য রকমের জ্বালাপোড়া হয় মেহরিনের! অথচ সে নিজেই চায় মাহমুদ নতুন করে শুরু করুক। সুখী হোক। সংসারী হোক! কিন্তু তবুও তাঁর কষ্ট হয়। না পাওয়ার বেদনায় নিরবে ছটফট করে সে!
মাহমুদের কথার জবাবে দীর্ঘশ্বাস গোপন করে গম্ভীর গলায় বললো,’এসব আমাকে কেন বলছো? তোমার সঙ্গে এনার সম্পর্ক যাই হোক না কেন আমার কাছে সেটা একেবারেই ম্যাটারই করে না। আই রিয়েলি ডোন্ট কেয়ার!’ কথা শেষ করে আর একমুহূর্তও দাঁড়ালো না সে। সঙ্গে সঙ্গেই গাড়ি স্টার্ট দিলো। মাহমুদ নিরব দর্শকের মত তাঁর চলে যাওয়ার পানে চেয়ে রইলো কেবল! এত নিষ্ঠুর!
.
.
.
চলবে
#হৃদয়_রেখেছি_জমা
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ১২
হস্পিটালের করিডোরে পাশাপাশি বসে আছে মাহমুদ এবং মেহরিন। গতকাল রাতে হার্ট এটাক করেছেন ইরফান সাহেব। সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নিয়ে এসেছে মাহমুদ। খবর পেয়ে মেহরিনকে নিয়ে লায়লা শারাফাত নিয়ে ছুটে এসেছেন। সারারাত অবচেতন অবস্থায় থাকার পর সকালের দিকে জ্ঞান ফেরে ইরফান সাহেবের। তাই মাহমুদ জোর করে লায়লা শারাফাতকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছে।
ডাক্তার কেবিন থেকে বেরিয়ে এসে জানালো ইরফান সাহেবের কন্ডিশন এখন আগের চাইতে অনেকটাই স্টেবল। তাঁরা চাইলে দেখা করতে আসতে পারে।মাহমুদ দেখা করে বেরিয়ে মেহরিনকে ভেতরে যেতে ইশারা করলো।’
ধীর পায়ে ভেতরে ঢুকলো মেহরিন। ইরফান সাহেব অসহায় ভাবে বিছানায় শুয়ে আছেন। বয়সের ভারে শরীর অনেকটাই জরাগ্রস্ত! অফিসের শক্ত, রাশভারী বসের সঙ্গে হস্পিটালে শায়িত এই মানুষটার অনেক বেশিই তফাৎ! এই মানুষটা মেহরিনের বাবা। যিনি অসহায় অবস্থায় তাঁর মাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। অথচ ভালোবেসেই বিয়ে করেছিলো তাঁর মাকে। কিন্তু আগলে রাখতে পারেন নি। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ক্ষীণ গলায় ডাক দিলো সে,’বাবা!’
অবাক হলেন ইরফান সাহেব। এইপ্রথম মেহরিন তাঁকে বাবা ডেকেছে। রুগ্ন মুখখানায় হাসি উঠলো তাঁর। স্নেহে চোখ ভিজে গেলো। যথাসম্ভব মোলায়েম কন্ঠে বললেন,’এসো মা! আমার কাছে এসে বসো।’
ইরফান সাহেবের বেডের পাশে গিয়ে বসলো মেহরিন। অশ্রুসিক্ত নয়নে তাঁর কপালে চুমু খেলেন ইরফান সাহেব কিন্তু মেহরিন বিব্রত হলো দেখে ছেড়ে দিলেন। তারপর টুকটাক কথাবার্তা হলো দুজনের মধ্যে। মেহরিন তাঁকে শরীরের যত্ন নিতে বলে বেরিয়ে যাওয়ার সময় লো ফের কাছে ডাকলেন ইরফান সাহেব। মেয়ের হাত ধরে অনুরোধের সুরে বললেন,’একটা কথা জিজ্ঞেস করার ছিলো তোমাকে। বলতে পারো অনুরোধ।’
-‘কি?’
-‘মাহমুদকে কি একটাবার ক্ষমা করে দেওয়া যায় না? ছেলেটা কষ্ট পাচ্ছে। তুমি শুধুশুধু তাঁকে ভুল বুঝছো। সে তোমাকে ভালোবাসে। রাতুলের মৃত্যু ওপর মাহমুদের কোন হাত নেই। রাতুল তাঁ নিজের দোষে মরেছে। তুমি প্রফেশনাল, তোমার তো এই কথাটা আরো ভালো করে বোঝা উচিৎ।’
-‘আপনি অসুস্থ। এসব কথা এখন থাক!’, সম্পূর্ণ অনিচ্ছা প্রকাশ পেলো মেহরিনের চেহারায়। এইব্যপারে কথা বলতে একান্ত অনিচ্ছুক সে।
ইরফান সাহেব দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মেয়ে হাত ছেড়ে দিলেন। তারপর ধীরে ধীরে পাশ ফিরে শুলেন। মেহরিন বেরিয়ে গেলো। বাইরে মাহমুদ বসে আছে। কাল সারারাত একফোঁটাও ঘুমায় নি। ক্লান্তিতে শরীর নুয়ে আসছে। সমস্ত শরীর ম্যাজম্যাজ করছে। মেহরিনকে দেখে হাত দিয়ে ঘাড়ের কাছ টা মালিশ করতে করতে জিজ্ঞেস করলো,’তুমি কি লাঞ্চ পর্যন্ত থাকবে নাকি বাসায় যাবে?’
মেহরিন জবাব দিলো না। মূর্তির মতন চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। তাঁর চোখে পানি টলমল করছে। চাপা কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে। অথচ মুখ ফুটে একটা কথাও বলতে পারছে না। মাহমুদ তাঁর চোখে পানি দেখে ব্যতিব্যস্ত হয়ে বললো,’কি ব্যপার? কাঁদছো কেন?’
-‘এমনি হঠাৎ শরীরটা একটু খারাপ লাগছে।’, দ্রুত চোখের পানি মুছে ফেললো মেহরিন। মাহমুদ মনে মনে ধারণা করে নিলো হয়ত ইরফান সাহেবের জন্য খারাপ লাগছে তাই আর বেশি কিছু জিজ্ঞেস করলো না। খানিকটা কোমল গলায় জিজ্ঞেস করলো,’থাকবে নাকি বাসায় যাবে?’
-‘বাসায় যাবো।’
-‘ঠিক আছে। চলো তোমাকে এগিয়ে দিয়ে আসি।’, বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো মাহমুদ।
-‘লাগবে না। আমি একাই যেতে পারবো।’
কিন্তু গেলো না মেহরিন। মাহমুদকে টেনে বসিয়ে দিয়ে তাঁর পাশে বসে পড়লো। তাঁর একটা হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে ছলছল চোখে বললো,’আমার একটা কথা রাখবে?’
কিছুক্ষণের জন্য কোন কথা বলতে পারলো না মাহমুদ। আচ্ছন্নের মত চেয়ে রইলো মেহরিনের মুখের দিকে। কত কথা জমে আছে দুজনের! কিছুই বলা হয় নি। ধীরে ধীরে মেহরিনের ধরে রাখা হাতখানার দিকে চাইলো সে। শক্ত করে তাঁর হাত চেপে ধরে আছে মেহরিন। দ্বিধা সংকোচহীন ভাবে। তাঁকে মন্ত্রমুগ্ধের মতন চেয়ে থাকতে দেখে নিরবতা ভেঙ্গে মেহরিনই প্রথমে কথা বললো,’রাখবে?’
-‘হ্যাঁ? কি?’, অবচেতন ভাবেই প্রশ্ন করলো মাহমুদ।
-‘বলছি, আমার একটা কথা রাখবে?’
সম্বিত ফিরে পেলো মাহমুদ। মুচকি হেসে বললো,’কি?’
-‘বিয়ে করে নাও।’
নিমিষেই হাসি মিলিয়ে গেলো মাহমুদের। এমনটা মোটেও আশা করে নি সে হতাশ ভাবে মাথা নাড়ালো। মেহরিনের হাতের মুঠো থেকে নিজের হাত খানা ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,’তুমি নিশ্চয়ই তোমার আমার বিয়ের কথা বলছো না?’
‘হ্যাঁ!’ বলতে পারলো না মেহরিন। নতমুখে বসে রইলো। ঠোঁট কামড়ে যথাসম্ভব কান্না চাপার চেষ্টা করলো। মাহমুদ গম্ভীর গলায় বললো,’তাহলে সম্ভব না!’
-‘কেন সম্ভব না? এনা খুব ভালো মেয়ে। তাছাড়া আমাদের ব্রেক-আপ হয়ে গেছে। দুজনেরই মুভ অন করা উচিৎ।’
-‘তো করছো না কেন?’
-‘আমি? কি করে…’, গলার স্বর আটকে এলো মেহরিনের। ফ্যালফ্যাল করে মাহমুদের মুখের দিকে চেয়ে রইলো সে। তাঁর কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা দেখে মাহমুদ হাসলো। হাসিমুখেই বললো,’কারণ এখনো আমাকে ভালোবাসো তাই তো?’
চোখের পানি টুপটুপ করে হাতের ওপর পড়লো। শত চেষ্টা করেও চোখের পানি ঠেকিয়ে রাখতে পারলো না মেহরিন। দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে বললো,’আমি বাসায় যাচ্ছি।’ মাহমুদ জবাব না দিয়ে আপন মনে হাসলো কেবল। তাড়াহুড়ো করে হস্পিটাল থেকে বেরিয়ে গেলো মেহরিন।
★
দুপুরের দিকে ইরফান সাহেবকে দেখতে হাসপাতালে এলো সোহাগ। মাহমুদের গম্ভীর মুখ দেখে বারবার জিজ্ঞেস করল কি হয়েছে। জবাবে মাহমুদ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে করুণ মুখে বললো,’মেহরিন আমাকে বিয়ে করতে বলছে!’
চোখের মনি চিকচিক করে উঠলো সোহাগের। হাসিহাসি মুখ করে বললো,’এটা তো খুশির খবর! আপনি মুড অফ করে আছেন কেন?’
-‘তোমার কি মনে হয় সোহাগ, মেহরিন আমাদের বিয়ের কথা বলেছে?’
-‘তবে?’
-‘ও এনার সঙ্গে আমার বিয়ের কথা বলছে !’
চোখ বড়বড় করে ফেললো সোহাগ। অবিশ্বাস্য কন্ঠে বললো,’কিন্তু কেন?’
-‘জানি না। আমার ধারণা ও কোনকিছু নিয়ে খুব বেশি ডিপ্রেশনে আছে!’
-‘হতে পারে!’
দুজনের কথোপকথন আর বেশিদূর এগোলো না। মেহরিনের হঠাৎ এমন অনুরোধের কারণ দুজনের কাছেই রহস্যজনক। দুজনেই ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতিতে সমাধানের কথা ভাবলো।
★
সেদিন রাতে মেহরিনের সঙ্গেও দেখা হলো সোহাগের। ইরফান সাহেবের জন্য খাবার পাঠিয়েছেন লায়লা শারাফাত। খাবার নিয়ে হস্পিটালে এসেছে মেহরিন। মাহমুদও আছে। কেউ কারো সঙ্গে কথা বললো না। মাহমুদের মুখের দিকে তাকিয়ে মায়া হলো সোহাগের। মেহরিনের সঙ্গে একা কথা বলার সুযোগ খুঁজলো সে। অবশেষে মেহরিন বাসায় ফেরার জন্য কেবিন থেকে বেরোতেই তার পিছু নিলো।
মেহরিন তাঁকে দেখে অবাক হয়ে বললো,’কি ব্যপার সোহাগ? কিছু বলবে?’
-‘হ্যাঁ। তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।’
-‘কি কথা?’
-‘চলো নিচে চলো, বলছি।’
হস্পিটাল থেকে বেরিয়ে গেটের সামনে দাঁড়ালো দুজনে। মেহরিন যদিও কিছুটা অবাক তবে সোহাগ সময় নিলো না। কোনরকম ভনিতা না করেই জিজ্ঞেস করলো,’তোমার সঙ্গে কি মাহমুদ ভাইয়ের আবার ঝগড়া হয়েছে?’
অবাক হলো মেহরিন। মাহমুদের সঙ্গে তাঁর রিলেশনের কথা কখনো সোহাগকে জানায় নি সে! তাহলে সোহাগের হঠাৎ এমন প্রশ্ন করার মানে কি? নাকি নরমালি-ই জিজ্ঞেস করছে সে। অফিসে সবাই জানে মাহমুদের সঙ্গে মেহরিনের বনিবনা নেই। তাঁকে চুপ করে থাকতে দেখে সোহাগ নিজে থেকেই বললো,’তোমার কথা মাহমুদ ভাই আমাকে বলেছে।’
এবার আগের চাইতে দ্বিগুণ বেশি অবাক হলো মেহরিন! মাহমুদ বলেছে? কেন বলেছে? হঠাৎ? কৌতূহল চেপে রেখে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,’না! আজকে তাঁর সঙ্গে আমার কোন ঝগড়া হয় নি।’
-‘তাহলে কেন তুমি উনাকে, এনাকে বিয়ে করার কথা বলেছো। তোমার কি মনে হয় না ব্যপারটা লঘুপাপে গুরুদণ্ডের মতন হয়ে যাচ্ছে? তুমিও জানো রাতুলের মৃত্যু তাঁর নিজের দোষে হয়েছে। এক্ষেত্রে মাহমুদ ভাইয়ের কিছু করার ছিলো না। তাহলে কেন তুমি মাহমুদ ভাইয়ের কাছে ফিরে যাচ্ছো না? কেন তাঁকে কষ্ট দিচ্ছো? আমি জানি তুমি নিজেও কষ্ট পাচ্ছো তবে কি লাভ উনাকে এমন শাস্তি দিয়ে?’
-‘আমি তাঁকে শাস্তি দিচ্ছি না সোহাগ। আমি তাঁকে মুক্তি দিচ্ছি।’
-‘মানে কি?’
-‘আই কান্ট বি আ মাদার!’,টুপ করে দুফোঁটা অশ্রুবিন্দু গড়িয়ে পড়লো মেহরিনের চোখ থেকে। এই দুফোঁটা অশ্রুর ভার যে কতটা দুর্বিষহ তা কেবল একটা মেয়েই বুঝতে পারবে! অথচ কি শান্তভাবেই না দাঁড়িয়ে আছে মেহরিন! প্রবল ধাক্কা খেলো সোহাগ! এটা কি করে সম্ভব? ভুল শুনেছে সে! মেহরিন কি করে…মস্তিষ্ক গুলিয়ে এলো তাঁর!
মেহরিন চোখ মুছে পূর্বের ন্যায় শান্ত গলায় বললো,’আশাকরি তুমি তোমার বন্ধুত্বের মর্যাদা রাখবে। মাহমুদকে এসব কথা জানাবে না!’
সোহাগ তখনো নিশ্চুপ! আকস্মিক শকটা কাটিয়ে উঠতে পারি নি! এতবড় কথা মেহরিনের মত ইমোশোনাল মেয়ে কি করে চেপে রেখেছে এতদিন! হাউ ইজ দিজ পসিবল? নরম, কোমল কন্ঠে বললো,’মাহমুদ ভাই তোমাকে ভালোবাসে!’
মেহরিম ম্লান হাসলো। বললো,’তাই বলে আমি তো আর তাঁকে সারাজীবন দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে দিতে পারি না! একটা বাচ্চার জন্য আমার বাবা আমার মাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলো। আমি জানি সন্তানের আকুতি ঠিক কতটা গভীর হতে পারে! আমার বাবাকে দিয়েই বুঝেছি। আমি চাই না মাহমুদের জীবনে সেরকম কোন আফসোস থাকুক। আমি চাই ও সবকিছু দিয়ে সারাজীবন পরিপূর্ণ থাকুক! আমার ভাগের সুখটুকু সৃষ্টিকর্তা ওকে দিক!’
মন্ত্রমুগ্ধের মতন মেহরিনের মুখের দিকে চেয়ে রইলো সোহাগ! বদরাগী, মাথামোটা, গম্ভীর স্বভাবের এই মেয়েটা ঠিক কতটা গভীর ভাবে একটা মানুষকে ভালোবাসতে পারে সেটা নিজের চোখে না দেখলে সে বিশ্বাসই করতো না। কোন প্রতিউত্তর করতে পারলো না সোহাগ! তাঁর কষ্ট হচ্ছে! অনেক বেশি কষ্ট হচ্ছে। এত গভীর ভালোবাসা, তবুও কেন এত বিরহ! কেন? আশ্চর্য নিষ্ঠুর পরিহাস!
.
.
.
চলবে